কাজী মোতাহার হোসেন মার্জিনে মন্তব্য ও আরজ-দর্শন

আরজ আলী মাতুববর (১৯০০-৮৬) ছিলেন স্বশিক্ষেত দার্শনিক – জিজ্ঞাসু ও দ্রোহী। এই দর্শন-দারিদ্রে্যর দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত প্রত্যন্ত পলিস্নর এক হতদরিদ্র কৃষক-সন্তানের জগৎ-জীবন ও শাস্ত্র-ধর্ম সম্পর্কে সন্ধিৎসা ও অভিজ্ঞান বিস্ময় জাগায় মনে। আরজ আলী বেশ কয়েকটি বই ও পুসিত্মকা লিখেছিলেন, তার মধ্যে সত্যের সন্ধান (১৯৭৩) ও সৃষ্টি-রহস্য (১৯৭৮) তাঁকে খ্যাতি ও পরিচিতি এনে দেয়। পরে তিন খ– তাঁর রচনাবলিও প্রকাশিত হয়। দেশের খ্যাতিমান লেখক-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদের কাছে তাঁর চিন্তা-দর্শন সমাদর পায়। তাঁর বই সম্পর্কে অনেকেই অভিমত জানান ও কেউ কেউ আলোচনাও করেন। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে আরজ আলী মাতুববর বাংলাদেশে এবং কিছু পরিমাণে ভারতের বাংলাভাষী অঞ্চলের বিদ্বৎসমাজের কাছেও পরিচিত হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের যেসব বুদ্ধিজীবী ও লেখক আরজ আলীর প্রতি মনোযোগী, অনুরক্ত এবং সাগ্রহে তাঁর বইয়ের আলোচনায় ব্রতী হন, তাঁদের মধ্যে জাতীয় অধ্যাপক ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।

 

দুই

কাজী মোতাহার হোসেনের অভ্যাস ছিল হাতের কাছে লেখার কাগজ না পেলে পুরোনো খাম, কোনো পত্রিকার মলাটের ওপর, এমনকি কখনো কোনো কিছুই না পেলে নিদেনপক্ষে সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে অপর পিঠের সাদা অংশেও লিখতেন, পরে এই খসড়া বা নোট থেকে মূল লেখা তৈরি হতো। ভাব-ভাবনা যাতে হারিয়ে না যায়, হয়তো সেই কারণেই চটজলদি এই ধরনের বাতিল কাগজের টুকরোয় মনের কথা লিখে রাখতেন।

তাঁর আরেকটি অভ্যাস ছিল বই বা পত্রিকার মার্জিনে মন্তব্য লিখে রাখা। একটি-দুটি শব্দ বা বাক্যে নির্মিত সে-মন্তব্য কখনো ত্রুটিনির্দেশক, কখনো প্রশংসামূলক, আবার কখনো বা রসাত্মক। বিরক্তিপূর্ণ বা ঝাঁঝালোও হতো কখনো কখনো সে-মন্তব্য। সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় (ঢাকা, ৯ নভেম্বর ১৯৮৪/ ২৩ কার্তিক ১৩৯১) ‘ডঃ কাজী মোতাহার হোসেনের অপ্রকাশিত খসড়া’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি রচনা পাঠক-বুদ্ধিজীবীমহলে বিশেষ সাড়া ফেলে দেয়। এ নিয়ে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও বেশ হয়েছিল। এই মার্জিনে মন্তব্যের সংগ্রাহক-সংকলকের নাম ছাপা হয়নি – শুধু উল্লেখ আছে : ‘বিভাগীয় সম্পাদক, বিচিত্রা’ – তবে এর ভূমিকায় যে-কথাগুলো বলা হয় তাতে মোতাহার হোসেনের সন্ধিৎসু পাঠ-পদ্ধতির সঙ্গে পাঠকের অন্তরঙ্গ পরিচয় ঘটে। সংকলক উল্লেখ করেছেন : ‘… একজন সাহিত্যিককে সর্বাংশে জানার জন্য তাঁর রোজনামচা, চিঠিপত্র, নানা লেখার খসড়া প্রভৃতি দলিলপত্রের সাহায্য অপরিহার্য। তাঁর ভেতরটা যেন অনেকখানি আলোকিত হয় এইসব কাগজপত্রে। কাজী সাহেবের যে খসড়াটি আমরা উপস্থাপিত করছি তাতে স্পষ্টতর হবে কী গভীর নিষ্ঠায় তিনি প্রতিটি গ্রন্থ খুঁটিয়ে পড়তেন এবং লেখার জন্যে খসড়া তৈরী করতেন। তাঁর লেখা ছিল ঋজু, ভাষা ছিল দ্বিধাহীন। সেজন্যে তাঁর বক্তব্যে ও মন্তব্যে কোন সঙ্কোচ ও অস্পষ্টতা নেই। একজন সাহিত্যিক হিসেবে ঠিক কথাটি ঠিকমতো বলা তিনি কর্তব্য বিবেচনা করতেন। কিন্তু একই সঙ্গে নির্মল ও সূক্ষ্ম হাস্যরসে তাঁর প্রতিটি কথাই তিনি ঐশ্বর্যম–ত ও বাঙ্ময় করতে চাইতেন’ (সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ওই, পৃ ৪১)।

মোতাহার হোসেনের এই খুঁটিয়ে মনোযোগ-সহকারে বই পড়া ও আলোচনার জন্যে মার্জিনে মন্তব্য লিখে রাখার স্বাক্ষর মিলবে আরজ আলী মাতুববরের দুটি বই সত্যের সন্ধানসৃষ্টি-রহস্যেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সময় আত্মীয়তার সুবাদে সেগুনবাগিচার ১১৩ নম্বর বাড়িতে থাকার সুযোগ আমার হয়। ওই সময়ে জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের ঘনিষ্ঠ সঙ্গ-সান্নিধ্যলাভের সৌভাগ্য লাভ করি। তাঁর খসড়া লেখা ও পঠিত পুস্তক-পত্রিকা সংরক্ষণের দায়িত্ব দেন আমাকে। সত্যের সন্ধানসৃষ্টি-রহস্য বইদুটিও সেই প্রক্রিয়াতেই আমার হাতে আসে।

 

তিন

আরজ আলী মাতুববর তাঁর প্রথম বই সত্যের সন্ধান (১৯৭৩) কাজী মোতাহার হোসেনকে ‘পড়িবার অনুরোধ ও সমালোচনার জন্য’ উপহার দেন ১৯৭৩-এর ২৮ নভেম্বর। লেখকের এই অনুরোধ মোতাহার হোসেন যথাযথভাবে রক্ষা করেছিলেন বইটি পড়ে ও তার সমালোচনা লিখে। নিবিড়-পাঠের সাক্ষ্য বইটিতে পাওয়া যায় : ১. বানান বা মুদ্রণ-প্রমাদ সংশোধন, ২. শব্দ বা শব্দাবলি যোগ করে বাক্যকে অধিক অর্থবহ ও পূর্ণ করা, ৩. লেখকের বক্তব্য সম্পর্কে মার্জিনে ইংরেজি বা বাংলায় মন্তব্য লিখে রাখা।

সত্যের সন্ধান বইয়ের প্রথম প্রস্তাবে (আত্মবিষয়ক) লেখক লিখেছেন : ‘জীবের জীবন নাকি যমদূত (আজরাইল) হরণ করেন। কিন্তু তিনি কি প্রাণের সহিত মনকেও হরণ করেন? অথবা প্রাণ যেখানে যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, মনকে তৎসঙ্গে থাকিতেই হইবে, – এরূপ কোন প্রমাণ আছে কি? নতুবা মনবিহীন প্রাণ পরকালের সুখ-দুঃখ ভোগ করিবে কিরূপে?’ (পৃ ২০) এ-বিষয়ে মোতাহার হোসেন মন্তব্য করেছেন : ‘This is most reasonable.’

পরকালবিষয়ক তৃতীয় প্রস্তাবে ‘বেহেস্ত-দোজখ’ সংক্রান্ত আলোচনা (পৃ ৪৮) প্রসঙ্গে মোতাহার হোসেনের মন্তব্য : ‘Why does he insist of literal interpretation? The Quran declares these descriptions as similes & metaphors.’

‘Half self government is given to Man & God is watching how he behaves (although He also wants that none can do good except on the consent or permission of Allah. All is Allah’s will.).’ (‘আবার আল্লাহ অন্যায় বিচার করবেন না।’) – ধর্মবিষয়ক চতুর্থ প্রস্তাবের শুরুতেই লেখকের ‘আল্লাহ্ মানুষের মন পরিবর্তন না করিয়া হেদায়েতের ঝঞ্ঝাট পোহায় কেন?’ (পৃ ৫০) – এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষেতে মার্জিনে মোতাহার হোসেন উপরিউক্ত বক্তব্য লিখেছেন।

চতুর্থ প্রস্তাবে লেখক এক জায়গায় বলেছেন : ‘…শয়তানের সংখ্যা চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পাইলেও অসৎ কাজের মাত্রা ঐ অনুপাতে বাড়িতেছে না। বরং মানবিক জ্ঞান ও সভ্যতা বৃদ্ধির সাথে সাথে অসৎ কাজের মাত্রা ক্রমশঃ  হ্রাস পাইতেছে’ (পৃ ৪৫)। এই কথার সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া মোতাহার হোসেনের – ‘really!’ এখানে খানিক কৌতুক যেন একটু ঝিলিক দিয়ে উঠেছে। আবার লেখক ওপরের ওই কথার জের টেনে বলেছেন : ‘ধর্মপ্রচারকদের বর্ণনা শুনিয়া মনে হয় যে, ফেরেস্তাগণ সবই নপুংসক। মকর্মও তাহাই ছিল।… তৎপর তার বংশবৃদ্ধির জন্য লিঙ্গভেদ হইল কখন?… শয়তানের বংশবৃদ্ধি সত্য হইলে – প্রথমতঃ তার ক্লীবত্ব ঘুচাইয়া পুংলিঙ্গ গঠনান্তে একটি স্ত্রী শয়তানেরও আবশ্যক ছিল। বাস্তবিক কি শয়তানের স্ত্রীও আছে? আর না থাকিলেই বা তাহার বংশবৃদ্ধির উপায় কি?’ (পৃ ৪৫) এ-সম্পর্কে মোতাহার হোসেনের মন্তব্য : ‘interesting!’

লেখকের যৌক্তিক জিজ্ঞাসাকে সমর্থন জানাতে দ্বিধা করেননি তিনি। উপাসনার সময়ের হেরফের নিয়ে তিনি যখন প্রশ্ন তুলেছেন (পৃ ৫৮), তখন মোতাহার হোসেন স্বচ্ছন্দে বলেছেন : ‘Proper question’.

চান্দ্র ও সৌর বর্ষের পার্থক্যের ফলে ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানের সময়গত যে-সমস্যা ও গরমিল দেখা দেয় সে-সম্পর্কে লেখকের প্রশ্ন : ‘এই রকম প্রাকৃতিক পরিবর্তনযোগ্য ঈদ, কোরবাণী ইত্যাদি অনুষ্ঠানে চাঁদ নির্ণয়ের সার্থকতা কি?’ (পৃ ৮৯) এ-বিষয়ে মোতাহার হোসেন মতামত দিচ্ছেন এইভাবে : ‘This is a cogent argument’. আবার এরই সূত্র ধরে লেখক যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের চান্দ্র ও সৌর মাসের ফারাক-সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ সম্পর্কে উল্লেখ করেন (পৃ ৮৯), তখন মোতাহার এই দৃষ্টান্ত ও পরামর্শকে ‘more reasonable’ বলে মন্তব্য করেন। সৌরমাসের সুবিধা এবং চান্দ্রমাসের জটিলতার ফলে ‘মুসলিম জাহানের যে কোন ধর্মানুষ্ঠান অবিরাম ঘুরিয়া বেড়ায়’ (পৃ ৯০) – এই অসংগতিকে ‘very un-scientific’ বলে মনে করেন মোতাহার হোসেন। লেখক এই তারতম্যের আরেকটি উদাহরণ দিয়েছেন : বাংলাদেশের ‘জন্ম’ (বিজয় দিবস) ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর মোতাবেক ২৭ শাওয়াল। সৌরমাসের কারণে খ্রিষ্টীয় তারিখ অপরিবর্তিত থাকলেও হিজরি সনের তারিখ বদলে যাবে। বিষয়টি লক্ষ করে মোতাহার বলেছেন : ‘সত্যিই ত!’

লেখক আরজ আলী মাতুববর সব ধর্মশাস্ত্রের অসংগতি ও নিষ্ফল আচার-অনুষ্ঠানের কথাই বলেছেন। উদাহরণও দিয়েছেন সর্বধর্মীয়। লক্ষ্মীপূজার প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন : ‘হিন্দুমতে – লক্ষ্মীদেবী সম্পদ বিতরণের মালিক। তাই তাঁহার পূজা করিলে তিনি প্রসন্না হইয়া তাঁর ভক্তকে বেশী পরিমাণ ধনরত্ন দান করেন।… কিন্তু দেখা যাইতেছে যে, চারি আনা পয়সা খরচ করিয়া লক্ষ্মীদেবীর প্রতিমা কিনিতে না পারিয়া কেষ্ট সাধু (লেখকের প্রতিবাসী) ছেলেবেলা হইতেই কলাগাছের লক্ষ্মী সাজাইয়া তাঁর পূজা করিতে আরম্ভ করিল, আর এখন তার পঞ্চাশ বৎসর বয়সেও কলাগাছ ছাড়িয়া প্রতিমা কিনিবার তফিক হইল না। অথচ আমেরিকার ফোর্ড সাহেব (Henry Ford) লক্ষ্মীপূজা না করিয়াও সারা পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী হইলেন’ (পৃ ৯১)। কেষ্ট সাধু আর হেনরি ফোর্ডের তুলনায় চমৎকৃত মোতাহার হোসেনের মন্তব্য : ‘Interesting incident.’

‘চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময় ‘কসুক’ বা ‘খসুক’ নামাজ অথবা অন্য কোনরূপ স্তবস্ত্ততি’ যে অর্থহীন (পৃ ৯৪) – লেখকের এই বক্তব্য মোতাহার হোসেন সমর্থন করে বলেছেন : ‘really nonsense’.

লেখক প্রশ্ন তুলেছেন : ‘হজরত ইব্রাহিমের পদাঙ্ক অনুসরণ বা তাঁর কৃতকর্মের অনুকরণ করাই যদি তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশ্য হয়, তবে তিনি যেই তারিখে অগ্নিকু– পতিত হইয়াছিলেন, সেই তারিখে তাঁহারা অগ্নিকু– ঝাঁপ দেন না কেন?’ (পৃ ৯৯) মার্জিনে এর পরিপ্রেক্ষেতে কাজী মোতাহার হোসেনের মন্তব্য : ‘relevant’. আর এর আগে কোরবানির প্রসঙ্গ তুলে লেখক জানতে চেয়েছেন : ‘কোরবানীর পশুর জবেহ হইতে আরম্ভ করিয়া – মাংস কাটা বখ্রা ভাগ ইত্যাদি ও খাওয়াদাওয়া পর্যন্ত চলিতে থাকে যতরকম হাসি-তামাসা, গল্পগুজব ও পান-সিগারেটের ধুম। হজরত ইব্রাহিমের কোরবানীর সাথে ইহার পরিবেশগত কোন সামঞ্জস্য আছে কি?’ (পৃ  ৯৮-৯৯) লেখকের এই গুরুতর ও প্রাসঙ্গিক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষেতে মোতাহার হোসেন এর পাশে লিখে রেখেছেন : ‘ভাববার কথা’।

কোরবানির অনুষঙ্গে লেখক মনে করেছেন : ‘অতি প্রাচীনকাল হইতেই মানুষ গোপালন করিয়া আসিতেছে – দুগ্ধপ্রাপ্তি ও
কৃষিকাজের জন্য। কিন্তু মরুময় আরবদেশে কৃষিকাজ ‘‘নাই’’ বলিলেই চলে। সুতরাং ওদেশে দুগ্ধবতি গাভী কাজে লাগিলেও বলদগুলি কোন কাজেই লাগে না। তাই আরবদেশের লোকে – পুণ্যার্থেই হউক আর ভোজার্থেই হউক, বাহুল্যরূপেই গোহত্যা করিতেন।… পক্ষান্তরে – ভারতবর্ষ চিরকালই কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশে গোজাতি মানুষের পরম উপকারী পশু।… সুতরাং কৃষিপ্রধান দেশগুলিতে ‘‘গোহত্যা’’ ক্ষতিজনক নয় কি?’ (পৃ ১০১-১০২) এখানে মোতাহার হোসেন পালটা প্রশ্ন তুলেছেন – ‘আরব আর বাংলার কি একরকম অবস্থা?’

পঞ্চম প্রস্তাবে ‘প্রকৃতিবিষয়ক’ আলোচনা স্থান পেয়েছে। এই অধ্যায়ে ‘পৃথিবী কিসের উপর প্রতিষ্ঠিত’ উপশিরোনামে এ-বিষয়ে মানুষের যুক্তিহীন বিজ্ঞানবিরোধী ভ্রান্ত ধারণার পরিচয় দিয়ে তা খ-নের চেষ্টা আছে। লেখক আধুনিক প–তদের বরাত দিয়ে বলেছেন : ‘…পৃথিবী কোন কিছুর উপর প্রতিষ্ঠিত নহে। পৃথিবীর কোন দৃশ্যমান অবলম্বন নাই। ইহার সকল দিকেই আকাশ বা শূন্যস্থান’ (পৃ ১১২)। মোতাহার হোসেন ‘শূন্যস্থান’ শব্দের নিচে দাগ দিয়ে মার্জিনে মন্তব্য করেছেন : ‘বায়ু কি বস্ত্ত নয়?’

লেখক ‘বিবিধ’ বিষয়ে আলোচনা করেছেন ষষ্ঠ প্রস্তাবে। এখানে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় সালসহ বৈশ্বিক নানা ঘটনা বা পরিস্থিতির উদ্ভবের উল্লেখ করা হয় (পৃ ১২৬-২৭), সে-বিষয়ে মোতাহার হোসেনের মন্তব্য এইরকম : ‘Pear’s Encyclopedia এবং বহু বৈজ্ঞানিক ইতিহাস গ্রন্থে এসব খবর পাওয়া যায়’ – আবার কালনির্দেশক সালের ক্ষেত্রে মন্তব্য : ‘সব Approximate’.

‘নীল নদের জল শুকাইল কেন?’ উপশিরোনামে লেখকের যুক্তিপূর্ণ আলোচনার পরিপ্রেক্ষেতে (পৃ ১৩১-৩৪) মোতাহার হোসেন এক জায়গায় মন্তব্য করেছেন : ‘ভদ্রলোকের বুদ্ধি আছে!’

লেখক শাস্ত্র, ধর্ম ও ধর্মীয় মহাপুরুষ সম্পর্কে অনেক লঘুগুরু বক্তব্য উপস্থাপন ও মন্তব্য পেশ করেছেন। এতে তাঁর অনেক জিজ্ঞাসা, সংশয়, অবিশ্বাস, কৌতূহল ও সন্ধিৎসা প্রকাশ পেয়েছে। ষষ্ঠ প্রস্তাব বা শেষ অধ্যায়ে ‘যীশু খ্রীষ্টের পিতা কে?’ উপশিরোনামে যিশুর জন্মরহস্য সম্পর্কে প্রশ্নোত্তরের ছলে নিজেই তাঁর মতামত পেশ করে বলেছেন : ‘তৎকালে সে দেশের রাজার নাম ছিল হেরোদ, তিনি জাতিতে ছিলেন ইহুদী। তাই রাজ্য শাসিত হইত তৌরিতের বিধান মতে। তৌরিতের বিধান মতে – ‘‘ব্যভিচার’’ ও ‘‘নরহত্যা’’, এই উভয়বিধ অপরাধেরই একমাত্র শাসিত্ম ‘‘প্রাণদণ্ড’’। এখানেব্যভিচারের অপরাধে সখরিয়ার প্রাণদণ্ড-র বিষয় জানা যায় বটে কিন্তু সখরিয়াকে বধ করার অপরাধে কোন ইহুদীর প্রাণদণ্ড-র বিষয় জানা যায় না’ (পৃ ১৪৬)। লেখকের এই বক্তব্য খ-ন করে মোতাহার হোসেন মার্জিনে মন্তব্য লিখেছেন : ‘তারা ত অপরাধীকেই বধ করেছিল। বধ্যকে বধ করা কেন দূষনীয় হবে?’

 

চার

কাজী মোতাহার হোসেন খুব মনোযোগ-সহকারে খুঁটিয়ে আরজ আলী মাতুববরের সত্যের সন্ধান বইটি পড়েছিলেন। সব বই বা রচনাই তিনি খুব গুরুত্ব দিয়ে নিবিষ্টমনে পড়তেন – পড়তেন যে তা বেশ বোঝা যায় বই বা রচনার উল্লেখ্য বা প্রশংসাযোগ্য বা ত্রুটি-কণ্টকিত অংশের নিচে দাগানো এবং মার্জিনে মন্তব্য লিখে রাখার ভেতর দিয়ে। সত্যের সন্ধান বইটি হাতে পেয়ে পড়তে একেবারেই সময় নেননি, আর খুব দ্রম্নতই এর একটি মাঝারি কলেবরের আলোচনা লিখে ফেলেন। সেটি ছাপা হয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মাসিক মুখপত্র বই পত্রিকায় (জানুয়ারি-ফেব্রম্নয়ারি ১৯৭৪/ মাঘ-ফাল্গুন ১৩৮০)। বইটি হাতে পান ১৯৭৩-এর ২৮ নভেম্বর, ডিসেম্বরেই আলোচনা লিখে ফেলেন আর তা পত্রিকায় ছাপা হয় জানুয়ারি-ফেব্রম্নয়ারি ১৯৭৪-এর যুক্ত-সংখ্যায়। আমাদের অনেক লেখক-সমালোচকই আপন বলয়ের লেখকের বই সম্বন্ধে বিশেষ আগ্রহী হন বা আলোচনা-সূত্রে যেখানে সুযোগ-সুবিধার সম্ভাবনা থাকে, সেইদিকেই সাধারণত ঝোঁকেন। কাজী মোতাহার হোসেন এই ধরনের মত ও পথ থেকে সবসময়ই দূরে ছিলেন – লেখকের কর্তব্য ও সততা সম্পর্কে নিত্য সচেতন ও আন্তরিক ছিলেন। তাই তিনি অজ লামচরি গ্রামের অখ্যাত লেখক আরজ আলী মাতুববরের বইয়ের আলোচনায় আগ্রহ দেখান।

প্রায় তিন পাতার এই গ্রন্থ-সমালোচনার শিরোনাম ছিল একটু বড়োই : ‘মানব মনের নানাবিধ জিজ্ঞাসার যথার্থ উত্তরের সন্ধান’। সমালোচক মোতাহার হোসেন পুস্তক-লেখকের যুক্তি-বুদ্ধির তারিফ করে তাঁর বক্তব্য কখনো সমর্থন করেছেন, কখনো তাঁর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে মতৈক্য পোষণ করতে পারেননি, আবার কখনো নিজের স্বতন্ত্র মত-মন্তব্য পেশ করেছেন। লেখক খুব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তাই সেসব বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সমালোচককে কিছু পরিমাণে সতর্ক থাকতে হয়েছে। উভয়ে প্রগতিমনস্ক হলেও বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনায় লেখক ও সমালোচকের কিছু ফারাক আছে। লেখক শাস্ত্র-ধর্মের প্রচলিত বিশ্বাসের দুর্গে আঘাত করে নাসিত্মক্যবোধের প্রতি ঝুঁকেছেন, অপরপক্ষে সমালোচক এই দ্রোহী জিজ্ঞাসু লেখকের অনেক যুক্তির সারত্ব স্বীকার করে নিয়েও শাস্ত্র ও ধর্মের সব বক্তব্যকেই নাকচ করতে বা সংশয়ের দৃষ্টিতে দেখতে রাজি হননি। এখানে দ্রোহী জিজ্ঞাসু ও সংশয়ীর সঙ্গে মুক্তমনের অধিকারী অথচ শাস্ত্র-ধর্মে আস্থাবান আচারনিষ্ঠ বিশ্বাসীর একটি সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব ও মতভিন্নতার আভাস মেলে। তবু এই বই পড়ে সমালোচক ‘আনন্দ লাভ’ করেছেন ‘মানবমনের নানাবিধ জিজ্ঞাসার যথার্থ উত্তরের সন্ধান’ এতে আছে বলে। আলোচনার শেষে মোতাহার হোসেন বলেছেন : ‘ধন্যবাদ জানাই ‘সত্যের সন্ধানে’র রচয়িতাকে এই ভেবে যে তাঁর এই পুস্তক পাঠ করে এ যুগের লোক হয়ত কিছু আনন্দ পাবে, কিছু বিস্মিত হবে, আবার হয়ত আরও কিছু নতুন প্রশ্ন-উত্থাপন করবে। বিশুদ্ধ নির্মল সত্য থাকুক বা না থাকুক, কুছ পরোয়া নাই। তাতে আমাদের কি? যাঁর ভাবনা তাঁরই মাথায় থাক, আমরা নিশ্চিন্তে নিশ্চুপ থাকি।’ মোতাহার হোসেনের মূল্যায়নে একটা মাঝামাঝি পথ অনুসরণের প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

 

পাঁচ

আরজ আলী মাতুববরের দ্বিতীয় বই সৃষ্টি-রহস্য প্রকাশ পায় জানুয়ারি ১৯৭৮-এ। ৩০০ পাতার ২৫ টাকা দামের এই বইটির প্রকাশক ছিল ঢাকার বর্ণমিছিল। বইটি উৎসর্গিত হয় লেখকের ‘পরম সুহৃদ’ মোহাম্মদ আলী নূর সাহেবকে। সৃষ্টি-রহস্যের ভূমিকা লিখে দেন বিশিষ্ট দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ ঢাকার আবুজর গিফারী কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আজরফ। লেখকের ‘নিবেদনে’ বই রচনার উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা পাওয়া যায়। মানবমনে বদ্ধমূল ‘অন্ধবিশ্বাস’ ও ‘কুসংস্কার’ দূর করার ব্রত নিয়ে লেখক এই লেখায় হাত দেন। ‘নিবেদনে’ তিনি উল্লেখ করেছেন : ‘অতীতে বহু মনীষী কুসংস্কাররূপী মহীরুহের মূলে যুক্তিবাদের কুঠারঘাত করিয়া গিয়াছেন, যাহার ফলে বহু মানুষ উহার ছায়াতল হইতে বাহির হইয়া দাঁড়াইয়াছে মুক্তমনের খোলা মাঠে আর তরুণ-তরুণীরা ভীড় জমাইতেছে দর্শন-বিজ্ঞানের পুষ্পোদ্যানে।’

কী আছে এই বইয়ে, সে-বিষয়ে ধারণা দিয়ে লেখক বলেছেন : ‘এই পুস্তকখানির আদ্যন্ত অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করিলে সুধী-পাঠকবৃন্দ বিশ্বসৃষ্টি সম্বন্ধে মানব-মনের ধারাবাহিক চিন্তা, গবেষণা ও সর্বশেষ যুক্তিসম্মত মতবাদের বিষয় জানিতে পারিবেন।’ লেখক বিনয় প্রকাশ করে বলেছেন, এই বই রচনায় তাঁর ‘তত্ত্বমূলক অবদান… কিছুই নাই’, তিনি এর সংকলক-সংগ্রাহক মাত্র। পরিশিষ্টে সংযোজিত সহায়ক গ্রন্থের তালিকা দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় তাঁর ব্যাপক পাঠ-শ্রমের কথা। ‘ভূমিকা’য় মোহাম্মদ আজরফ এ-বই সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন : ‘আলোচ্য পুস্তককে নানাবিধ জ্ঞান সংক্রান্ত চিন্তাধারার একখানা ক্ষুদ্র বিশ্বকোষ বলা যায়। কারণ মানবজীবন তথা এ বিশ্বের নানাবিধ সমস্যার সমাধানকল্পে গঠিত ও আবিষ্কৃত নানা সিদ্ধান্তের এক একটা ধারাবাহিক রূপ তিনি এতে সন্নিবেশ করেছেন। এসব উপকরণ থেকে একদিকে যেমন মানব-মানসের আদিরূপের আভাস পাওয়া যাবে, তেমনি সে মানস কোন ধারায় অগ্রসর হচ্ছে তারও সংকেত পাওয়া যাবে।’ সত্যের সন্ধান আরজ আলী মাতুববরকে বিদ্বৎসমাজে যুক্তিবাদী জিজ্ঞাসুর পরিচিতি দিয়েছিল, আর সৃষ্টি-রহস্য তাঁকে দিলো লোক-দার্শনিকের প্রতিষ্ঠা।

 

ছয়

আরজ আলী মাতুববর তাঁর গুণগ্রাহী ও প্রথম বইয়ের আলোচক জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে তাঁর দ্বিতীয় বই উপহার দেন ৩০ জুন ১৯৭৮। মোতাহার হোসেনের অভ্যাসমতো এই বইটিও তিনি খুঁটিয়ে পড়েন – উল্লেখযোগ্য অংশগুলো দাগিয়ে নজরটান করে রাখেন। মার্জিনে বাংলা-ইংরেজি-আরবি ভাষায় সংক্ষিপ্ত মন্তব্য লিখে রাখেন কোনো কোনো জায়গায়। এর উদ্দেশ্য, এইসব সূত্রের আলোকে বইয়ের আলোচনাটি বিষয়মুখী ও স্পষ্ট করে তোলা।

সৃষ্টি-রহস্য বেশকিছু উপ-অধ্যায়ে সমন্বিত। মূল অধ্যায়গুলো এইভাবে বিন্যস্ত : ‘আদিম মানবদের সৃষ্টিতত্ত্ব’, ‘ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্ব’, ‘বিজ্ঞান মতে সৃষ্টিতত্ত্ব’, ‘সূর্য’, ‘বংশগতি’, ‘সভ্যতার বিকাশ’, ‘সভ্যতাবিকাশের কতিপয় ধাপ’। আমরা এবারে নজর করবো মোতাহার হোসেনের মার্জিনে মন্তব্যের দিকে। আগেই মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি, আরবি ভাষায় জ্ঞান না থাকায় আরবি মন্তব্যগুলো পাঠকসমীপে পেশ করতে পারলাম না। ‘দার্শনিকমতে সৃষ্টিতত্ত্ব’ বিষয়ে আলোচনায় এসেছে থেলিস, আনাক্সিমান্দর, পিথাগোরাস, জেনোফেন্স্, হিরাক্লিটাস, এম্পিডো কল্স্, আনাক্সাগোরাস, ডেমক্রিটাস, লিউকিপ্পাস, সক্রেটিস, পেস্নটো, আরিস্টটল, লাইবেনিজের নাম। এঁদের নামের বিপরীতে মোতাহার হোসেন মন্তব্য লিখেছেন : ‘Legends of Greece & Rome’.

‘সূর্য’ অধ্যায়ে হিন্দু পুরাণের ভাষ্য-অনুসারে কশ্যপ মুনির ঔরসে তাঁর পত্নী অদিতির গর্ভে জন্মের কারণে সূর্যের আর এক নাম ‘আদিত্য’ (পৃ ৬০)। পাশে মোতাহার হোসেন লিখে রেখেছেন : ‘সূর্যের এক নাম আদিত্য কেন?’ ‘আদিত্য’ নামকরণের কারণ লেখকের বক্তব্যেই আছে। হয়তো সেটি তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ায় ভুল করে মার্জিনে তাঁর এই মন্তব্য।

গ্রহম-লীর কথা বলতে গিয়ে লেখক বিজ্ঞানীদের বরাত দিয়ে বলেছেন : ‘দূর ভবিষ্যতে শুক্রের দেহের তাপ কমিয়া পৃথিবীর তাপের কাছাকাছি হইলে ওখানে জলের অণু সৃষ্টি হইবে এবং উদ্ভিদাদির জন্ম হইবে’ (পৃ ৭৮) – ইত্যাদি। এর পাশে মোতাহার হোসেনের মন্তব্য : ‘fore-cast’.

১০১ পৃষ্ঠায় লেখক বলছেন : ‘…ধূমকেতুরা দুই ভাগে বিভক্ত; যাহারা একাধিকবার সৌরাকাশে প্রবেশ করে না, তাহারা হইল ‘পলাতক’ এবং যাহারা বার বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে তাহারা হইল ‘বন্দী’।’ ‘পলাতক’ ও ‘বন্দী’ – এই নামদুটি মোতাহার হোসেনের বেশ মনে ধরে, তাই তিনি মন্তব্য করেছেন : ‘বেশ নাম দুটো’। ‘উল্কা’ উপ-অধ্যায় সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য : ‘These are so very interesting’.

লেখক বলেছেন : ‘মক্কার শহরে পবিত্র কাবাগৃহে ‘হেজরল আসোয়াদ’ নামে কালো রং-এর একখানা পাথর রক্ষেত আছে। ঐ পাথরখানা নাকি আকাশ (স্বর্গ) হইতে পতিত হইয়াছিল। হাজীগণ উহাকে সসম্মানে চুম্বন করিয়া থাকেন। বোধহয় যে, ঐ পাথরখানাও একখানা মাঝারি ধরনের ‘উল্কা’ (পৃ ১০৫)। এই বক্তব্যের পাশে মোতাহার হোসেন লিখেছেন : ‘A nice guess’.

‘যুগ বিভাগ’ পর্যায়ে ‘কলিযুগ’ ও ‘কল্কি অবতার’-এর আবির্ভাব সম্পর্কে লেখক আলোচনা করেছেন (পৃ ১২২)। মোতাহার হোসেন মার্জিনে হিসাব করে দেখেছেন চলমান কলিযুগ শেষ হতে আরো ৪,২৬,৯৩০ বছর লাগবে – এর পাশে তাঁর মন্তব্য : ‘আরও এত বৎসর পরে কলি যুগ সম্পূর্ণ হবে, আর কল্কী অবতার জন্মিবেন।’

‘প্রলয়ের পর পুনঃসৃষ্টি’ অধ্যায়ে লেখক এ-বিষয়ে নানা ধর্মীয় ও দৈশিক মতামত বিশেস্নষণ করেছেন। ‘মুসলমানদের মত’ আলোচনা প্রসঙ্গে মোতাহার হোসেন ‘ ‘‘সিদ্রাতুল মুন্তাহা’’ উলিস্নখিত হয়নি’ বলে লেখকের আলোচনার অসম্পূর্ণতা নির্দেশ করেছেন।

‘চার্বাকীয় মতে’র আলোচনা করতে গিয়ে লেখক এক জায়গায় চার্বাকের জীবনদর্শনের সারাৎসার উদ্ধৃত করেছেন :

যাবজ্জীবং সুখং জীবেৎ,

ঋণাং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।

(পৃ ২৯২)

এই আত্মসুখ-অন্বেষী চূড়ান্ত ভোগবাদী মতবাদকে মোতাহার হোসেন ‘শয়তানী মত’ আখ্যা দিয়েছেন।

সাত

আরজ আলী মাতুববরের সৃষ্টি-রহস্য বইটি মোতাহার হোসেনের যে যথেষ্ট মনোযোগ পেয়েছিল, তার স্বাক্ষর মেলে স্থানবিশেষে কলমের কালিতে দাগিয়ে পড়ায় ও মার্জিনে ত্রিভাষিক মন্তব্যে। সৃষ্টি-রহস্যের একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনাও লিখেছিলেন তিনি। আলোচনাটি কোথাও ছাপা হয়েছিল কি না তার কোনো সাবুদ মেলে না। তাঁকে লেখকের উপহার-দেওয়া সৃষ্টি-রহস্য বইটি এবং তার একটি ছোটো আলোচনার খসড়া আমাকে দিয়েছিলেন সংরক্ষণের জন্যে। তাঁর অভ্যাসমতো, হাতের কাছে কাগজ না পাওয়ায়, অনুশীলন সংঘ নামে একটি সংগঠনের স্মরণিকার মলাটে আলোচনাটি লিখেছিলেন। এটি যদি খসড়া হয়, তবে তার চূড়ান্ত কপি তৈরি করেছিলেন কি না তা আজ আর জানার কোনো উপায় নেই। আমরা এখানে, আমাদের বিবেচনায় অপ্রকাশিত, কাজী মোতাহার হোসেনের গ্রন্থ-আলোচনাটি প্রকাশ করলাম। অবশ্য ‘আলোচনা’ না বলে ‘পরিচিতি’ বললেই বোধকরি যথার্থ হয়। তবে কথা এই যে, মৃত্যুর বছরতিনেক আগে যখন তিনি জরা-শোকে আক্রান্ত, স্মৃতি ও চিন্তাশক্তিও দুর্বল হয়ে এসেছে, বক্তব্য গুছিয়ে পেশ করার মতো মানসিক স্থৈর্যও অটুট নেই, সেইরকম সময়ে সৃষ্টি-রহস্যের আলোচনা লেখেন। তাই খানিক খেই হারিয়ে ফেলেছেন – তবু ভাবতে আশ্চর্য লাগে, বয়স ও মানস অনুকূল না থাকলেও অশক্ত শরীর ও বিক্ষিপ্ত মন নিয়েও মননচর্চার ভুবনে সক্রিয় রেখেছিলেন নিজেকে।

 

আট

সৃষ্টি-রহস্য

আরজ আলী মাতুববর

জনাব আরজ আলী মাতববর [মাতুববর] সাহেবের ‘‘সৃষ্টি-রহস্য’’ নামক পুস্তকখানা পড়ে বেশ ভাল লাগলো। এর ভাষার সচ্ছল [স্বচ্ছন্দ] গতি, প্রকাশভঙ্গীটাও রসাশ্রিত। অন্তরের নিগূঢ় ভাবও সহজ ক’রে বলা, প্রকাশ করা সহজকর্ম নয়।

আশ্চর্যের বিষয়, আমার প্রীতিভাজন মোহাম্মদ আজরফ [এর] ভূমিকাটা পাঠ ক’রে জানতে পারলাম, ‘‘আরজ আলী মাতববর [মাতুববর] সাহেব […] সেকেলে পাঠশালার দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ করেছেন। স্বকীয় অনুসন্ধিৎসার প্রেরণায় তিনি এ ক্ষেত্রে যে গবেষণা করেছেন, তা সত্যিই অনন্য; এতে প্রমাণিত হয় এ সব প্রশ্ন মানব-মানসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে [জড়িত]।’’

আমার মনে হয়, কেবল কোনও কোনও বিশেষ উপযুক্ত ক্ষেত্রেই আল্লাহ দয়া-প্রবণ হয়ে তাঁর বান্দাকে এরূপ অনুপম মতিগতি ও সাধ্যসাধনা প্রদান করে ভক্তের জীবনকে ধন্য ক’রে থাকেন। আমি দেখলাম সেকালের দ্বিতীয় বৎসর পর্যন্ত পড়া লোকের ব্যাকরণ একদম শুদ্ধ, সন্ধি-সমাস, কারক, বিশেষ্য, বিশেষণ, শব্দ-প্রয়োগ প্রক্রিয়া – কিছুতেই ত্রুটি নাই। দুই-একটা বানান ভুল – তা নিশ্চয়ই ছাপার ভুল।

আদিম মানুষের সৃষ্টিতত্ত্বে – চৈনিক, মিশরীয়, ফিনিসীয়, ব্যাবিলনীয় মত, পলিনেশীয় মত, বৈদিক মত, পার্সি মত, ইহুদি, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, ইসলাম প্রভৃতি ধর্মীয় মত – কেলিস, আলাক্সি মস্তর, জেনোফেনাস, পিথাগোরাস, ডেমোক্লিটাস – ইত্যাদি; বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও আইসোটোপ, অতল, বিতল, সুতল, রসাতল, তলাতল, মহাতল ও পাতাল; স্পুটনিক, ধূমকেতু, বাষ্পীয় শক্তি, মহাপস্নাবন, চার্বাক ঋষির মত – ইত্যাদির সুষ্ঠু সমাচার রয়েছে এ-বইয়ে। সাত দোজখ ও আট বেহেশ্তের [কথাও] বাদ পড়েনি। তাই আমি সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হ’য়ে দোওয়া করছি – মাতোববর [মাতুববর] সাহেবের বইখানা যেন পাঠক-সমাজেরও মনোহরণ করে।

আমার আর কিছু বলবার নাই। সবই যেন মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়।

(কাজী মোতাহার হোসেন) r