চার

আষাঢ় মাসের সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে ঠাকুরের নৌকা নিয়ে বাড়ি এসেছিল বদরু। বরইতলায় নৌকা বেঁধে উঠানে এসে দেখে জমসেদ তখনো ঘরের ছেমায় বসা। বড়ঘরের খোলা দরজায় পিতলের বড় কুপিটা জ্বলছে। ছোট ভাই দুটো, বোন দুটো মেজো বোনের ঘরের ছেমায় বসে কিচ্ছা শুনছে কফিলের কাছে। আধা-প্রতিবন্ধী মানুষটা আবার কিচ্ছার ওস্তাদ। কত কিচ্ছা যে তার ঝোলায়! প্রতিদিন দু-চারটা কিচ্ছা ঝোলা থেকে বের করে সে।

শালা-শালিকে শোনায়। পাগল শালিটাও কফিলের কিচ্ছা শোনে মন দিয়ে। একটুও শব্দ করে না।

জমসেদের চারপাশে মশা ভ্যান-ভ্যান করছিল। বাড়িতে ধূপ আর নারকেলের কিছু ছোবড়া আছে। বদরু বহুবার বলেছে সন্ধ্যাবেলা ‘আইলা’য় অর্থাৎ মাটির মালসায় নারকেলের ছোবড়া জ্বালিয়ে কিছুটা ধূপ দিলে ধূপের গন্ধ আর ধোঁয়ায় মশা পালাবে। ঠাকুরবাড়িতে রোজ সন্ধ্যায় এই কাজটা করে বদরু। ধূপও সে ওই বাড়ি থেকেই চুরি করে এনেছে। কিন্তু তার কথাটা কেউ মনে রাখে না। যে যাকে নিয়ে আছে সংসারে। জমসেদের দিকে তাকানোর সময় কোথায় তাদের?

সেই রাতে বাড়িতে এসে ওই নিয়ে একটু খ্যাচরম্যাচর করল বদরু। জমসেদকে কোলে করে ঘরে আনল। তার বিছানা ঘরের উত্তর পাশের বেড়ার সঙ্গে। বিছানা মানে খড়নাড়ার ওপর বহু পুরনো একখানা কাঁথা আর তাকিয়ে দেখা যায় না এমন একখানা বালিশ। ওই বিছানায় জমসেদকে বসিয়ে ভাত খাওয়ালো বদরু। তারপর নিজে খেতে গিয়ে দেখে মায়ের মুখ গম্ভীর।

‘কী হইছে?’

‘ভাত নাই।’

‘কও কী? তয় আমি খামু কী?’

‘আল্লাদ কইরা বাপরে যেইডা খাওয়াইলি, ওই ভাত তর লেইগা রাকছিলাম।’

কথাগুলো জমসেদ শুনছিল। বলল, ‘তয় তুমি আগে কইলা না ক্যা? আগে কইলে আমি তোমাগ বেবাকতের লাহান আইজ রাইতে না খাইয়া থাকতাম। পোলাডা এত কাম করে হারাদিন, নাও বাইয়া আইলো ভাত খাইতে, অহন কী না খাইয়া থাকব?’

‘তয় আমি কী করুম? ঘরে চাউল-ডাইল কিছু নাই।’

বদরু বিরক্ত গলায় বলল, ‘দোফরে দিহি কিছু কইলা না?’

মাজেদা বলল, ‘তরে আর কত কমু? বড় পোলাডার কামকাইজ নাই, মাজারোডা আছে বিয়ার তালে। ছোডগুনি পেডেভাতে কাম করে এই বাড়ি ওই বাড়ি। একলা তুই এতবড় গুষ্টি টানবি কেমতে? চাউল যেডু আছিল দোফরে খাইতে পারছে বেবাকতেই, রাইত্রে রান্দনের কিছু আছিল না। দোফরের ভাত সালুন বাঁচাইয়া তর লেইগা রাকছিলাম। হেই ভাত তুই তর বাপরে খাওয়াইয়া দিলি।’

‘বাজানে খাইছে তাতেই আমি খুশি। আমি বিয়ানেঐ চাউলের বেবস্থা করতাছি। পাখিরে সারেঙ বাইত্তে পাডাইয়া দিও। হেরা চাউল দিবনে। অহন যাওনের সমায় আমি সারেঙ বাড়ি হইয়া যাইতাছি।’

জমসেদ হায় হায় করে উঠল। ‘রাইত্রে তুই না খাইয়া থাকবিনি, বাজান?’

বদরু হাসল। ‘আমারে লইয়া তুমি চিন্তা কইরো না বাজান। রাইত্রে আমি না খাইয়া থাকুম না। সারেঙ বাইত্তে গিয়া মুড়ি মিডাই খাইয়া যামুনে। তুমি হুইয়া পড়ো বাজান।’

জমসেদকে অতিযত্নে শুইয়ে দিলো বদরু। জমসেদ চিৎ হয়ে শুয়ে বলল, ‘না খাইয়া কইলাম থাকিস না বাজান। তর চিন্তায় কইলাম প্যাডের ভাত হজম হইব না আমার। ঘুম আইবো না।’

‘কইলাম যে তুমি চিন্তা কইরো না। আমার বেবস্থা আমি করুম নে।’

অন্ধকার চকমাঠের ওপর দিয়ে, তারার আলোয় পথ দেখে তারপর সারেঙ বাড়িতে এসেছিল বদরু। সারেঙ বাড়ির মিলু ছেলেটাকে খুবই পছন্দ করে সে। এই বাড়ির তিন শরিকই সারেঙ। বড় সারেঙ মারা গেছেন। বাকি দুইজন আছেন। বড় ভাই সারেঙগিরিতে ঢুকে ছোট দুই ভাইকেও জাহাজে চাকরি দিয়েছিলেন। দিনে দিনে তাঁরা সারেঙ হয়েছিলেন। তবে তিন শরিকের মধ্যে মিলমিশ তেমন নেই। প্রত্যেকেই যেন প্রত্যেকের শত্রু। বড় সারেঙের বিধবা ভালো জায়গা-সম্পত্তির মালিক। দুই মেয়ে তাঁর। বড় মেয়ে ঢাকায় থাকে। ছোটটা থাকে কবুতরখোলা গ্রামে, শ্বশুরবাড়িতে। অবস্থা দুই মেয়েরই ভালো। বড় মেয়ের মেজো ছেলে মিলু। সে নানির খুব বাধুক। নানির কাছেই থাকে। রতনপুর স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। এই বয়সেই গল্পের বই পড়ে, গানবাজনা আর গল্প শোনার ওস্তাদ। বদরুকে সে ডাকে বদরুদাদা। বদরুও তাকে নাম ধরে ডাকে না। ডাকে দাদা।

সারেঙ বাড়িতে বদরু যায় শুধু বড় সারেঙের ঘরে। মিলুর টানেই যায়। সারেঙের বিধবাকে সে ডাকে আম্মা। আবার তাঁর নাতিকে ডাকে দাদা। রিস্তার কোনো আগামাথা নেই।

বড় সারেঙের বিধবার নাম মাবিয়া খাতুন। মানুষটা তিনি খুবই ভালো। দয়ালু। গরিব মানুষের উপকার করেন। পাড়ার গরিব মানুষেরা ঠেকায় পড়লে তাঁর কাছেই আসে। চাউলটা ধার নেয়, দু-চারটা টাকা ধার নেয়। কেউ না খেয়ে আছে শুনলে মাবিয়া খাতুনের মনটা কান্দে। ডেকে একবেলা খাইয়ে দেন। এজন্য বাড়ির অন্য দুই শরিক তার ওপর খাপ্পা। কেন তিনি ওইসব করেন? তাদের ভাষায় ছোটলোকদের এত লাই দেওয়ার কী আছে?

রাতের ভাত খেয়ে ঠাকুরবাড়ি যাওয়ার আগে বদরু প্রায়ই এই বাড়িতে আসে। মাবিয়া খাতুনের ঘরে বসে মিলুকে কিচ্ছা শুনিয়ে যায়। বর্ষাকালে বাড়ির ঘাটে নৌকা বেঁধে নামে, খরালিকালে পায়ে হেঁটে গান গাইতে গাইতে আসে। দূর থেকে তার গলা শুনে মিলুর মন আনন্দে নাচে।

আজ বদরু এলো নিঃশব্দে।

হারিকেনের আলোয় পড়তে বসেছে মিলু। রাতের খাওয়া-দাওয়ার পরও সে বই নিয়ে বসে। বাংলা বইয়ের গল্পগুলো
ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পড়ে। অদ্ভুত একটা স্বভাব আছে ছেলেটার। রাতের বেলা সে খাতা নিয়ে বসে না। লেখে না, অঙ্কও করে না। কে যেন তাকে শিখিয়েছে, রাতের বেলা লিখলে হাতের লেখা খারাপ হয়ে যায়। তবে মিলুর হাতের লেখা খুব সুন্দর। গোটা গোটা অক্ষরে যত্ন করে লেখে সে। ঠাকুরও তার হাতের লেখার প্রশংসা করেন। মিলুর মাথা ভালো। অর্থাৎ ছাত্র ভালো সে। ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়। বদরুর কাছে যে কিচ্ছা একবার শোনে সেটা খুব ভালো করে মনে রাখে। অনেক সময় বদরুর বলা গল্প নানিকে শোনায়।

বারান্দার দিককার দুয়ার খোলা ছিল। সেই আলোয় বদরুকে দেখা গেল ঢুকতে। তাকে দেখেই ভারি সুন্দর হাসি ফুটল মিলুর মুখে। ‘বদরুদাদা, তুমি দিহি আউজকা গান গাইতে গাইতে আইলা না?’

বারান্দাটা কামরার মতো। ওদিককার দরজা বন্ধ করলে বারান্দাটা ঘরের ভেতর ঢুকে যায়। সেখানে একটা চৌকি ফেলা। চেয়ার-টেবিল আছে মিলুর পড়ার। বদরু চৌকিতে বসল। ‘আউজকা মিজাজটা খারাপ দাদা।’

মিলু কথা বলার আগেই মাবিয়া খাতুন বললেন, ‘ক্যা রে, কী অইছে?’

তিনি পালঙ্কে বসে পান চিবাচ্ছেন। হারিকেনের আলোয় তাঁর মুখে সুখী ভাব। বাড়ির কাজের মহিলা অজুফা একটা জলচৌকি নিয়ে বসে আছে তাঁর পায়ের কাছে।

বদরু বলল, ‘ভাত পাই নাই।’

মাবিয়া খাতুন অবাক। ‘না খাইয়া আইলিনি?’

‘হ। আমার ভাত বাজানরে খাওয়াইয়া দিছি।’

‘ওইডা ভালোই করছস। তয় আমগো খাওনও তো শ্যাষ। ঘরে তো ভাত নাই! কী দিমু তরে?’

বদরু নির্বিকার গলায় বলল, ‘মুড়ি মিডাই দেন। হেদিন দেইক্কা গেলাম কবরি কেলা জাগ দিছেন। পাকে নাই? পাকলে কেলাও দেন। বিরাট খিদা লাগছে।’

মিলু বলল, ‘হ কলা পাকছে। আমি আইজ দুধকলা দিয়া ভাত খাইছি। লগে খাজুড়া মিডাই আছিল।’

‘তয় দেন আম্মা।’

মাবিয়া খাতুন অজুফার দিকে তাকালেন। ‘অজুফা, অরে এক সাজি মুড়ি দে। তিন চাইরডা কেলা দে। মিডাই দিছ।’

মানুষকে কিছু দিতে হলে অজুফা একটু বিরক্ত হয়। যেন সে এই বাড়ির মালিক। তার জিনিস অন্যকে দিয়ে দিতে হচ্ছে। এইসব মুহূর্তে মুখটা সব সময় অন্ধকার হয় তার। এখনও হলো। কিন্তু  মাবিয়া খাতুনের আদেশ তো আর ফেলতে পারে না! মুড়ির ‘জের’ থেকে সাজিতে মুড়ি ঢালতে ঢালতে একটু গজগজ করল সে। ‘প্যাডে টান পড়লেই এই ঘরে আহে বেবাকতে। রাইত নাই দিন নাই আইতেই আছে।’

তাকে একটা ধমক দিলেন মাবিয়া খাতুন। ‘এই তুই চুপ কর। তরডা খায়নি কেঐ? যা কইলাম, তাড়াতাড়ি কর।’

অজুফার এই স্বভাবের কথা বদরু জানে। সে কিছু মনেই করল না। সাজিভর্তি মুড়ি, বড় একখানা খেজুড়ে গুড়ের পাটালির অর্ধেকটা আর তিনটা পাকা কবরি কলা নিয়ে আরামসে খেতে লাগল।

মিলু বলল, ‘বদরুদাদা, কিচ্ছা কও।’

‘আইজ কিচ্ছা কওনের মন নাই দাদা। কাউলকা আইয়া কমু নে।’

এতে কি মিলু আর দমে? কোনো না কোনোভাবে কিচ্ছা বা বদরুর ভূত-প্রেতের অভিজ্ঞতা, বা গ্রাম এলাকার শোনা কাহিনি কিছু না কিছু একটা তাকে শুনতেই হবে। বড় বুদ্ধিমান ছেলে। কথায় কথায় বদরুকে দিয়ে অনেক সময়ই অনেক কিছু বলিয়ে ফেলে। যেদিন বদরু কিচ্ছা-কাহিনি বলতে চায় না সেদিন ওই কায়দাটা মিলু ধরে।

আজো ধরল। ‘ও বদরু দাদা, তুমি যে এমুন আন্ধাইরা রাইত্রে মিয়াগো ছাড়াবাড়ির ওই মিহি দিয়া, দবির মামাগো ছাড়া বাড়ির ওই মিহি দিয়া আসা-যাওয়া করো, ওই মিহি তো দিনের বেলাও আমরা যাইতে ডরাই। মিয়ার ছাড়ায় আছে ‘কনধনাইয়া (স্কন্ধকাটা)’ আর দবির মামাগো ছাড়ার উত্তর-পুব কোনার তেঁতুইল গাছটায় আছে একজন। কত মাইনষে দেখছে। তুমি কোনোদিন দেহ নাই?’

বদরু গুড়মুড়ি খেতে খেতে জড়ানো গলায় বলল, ‘আমি কোনোদিন কিছু দেহি নাই। তয় ওই দুই জাগা দিয়া যাওনের সমায়, এমুন আন্ধাইরা রাইত্রে আমার শইল্লের পশম বেবাক খাড়াইয়া যায়। কোনোহানে কিছু হয় না, খালি ওই দুইডা জাগায় গেলে এমুন হয়।’

‘ঠাকুরবাইতে দেহ নাই?’

বদরুর প্রায় মুখে এসে গিয়েছিল আটজন ঠাকুরের কথা, জামগাছে আর তার তলায় রাতবিরাতে তাদের চলাফেরা আর হাঁকিহুঁকি করার কথা, স্বচোক্ষে তাদের দেখার কথা। বলতে গিয়ে গলা আটকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝল, এসব ঠাকুরের কেরামতি। চাইলেও তাদের কথা বদরু কাউকে বলতে পারবে না। তার গলা আটকে যাবে।

বদরু কথা ঘোরাল। ‘তয় দাদা বেজগাঁও গেরামে একখান আজিব কারবার ঘটছিল। এক গিরস্তের যমক পোলা। ম্যালা জাগা জমিন গিরস্তের। যমক দুই পোলা জন্ম দিয়া বউ মইরা গেছে। গিরস্তে আর বিবাহ করে নাই। পোলা দুইডার লালন পালন করছে ‘ধরনী’ (ধাত্রী)। সে ওই গিরস্তের বাইত্তেই থাকে। গিরস্তের বয়স হইছে। যহন-তহন মইরা যাইব। হেয় মনে করল, জাগা জমিন দুই পোলারে সমান ভাগ কইরা দিব। আমিন লইয়া জমিন মাপতে গেছে, গিয়া দেহে জমিন দুই ভাগ অয় না, অয় তিনভাগ। তিনদিন ধইরা তিনবার চাইরবার জমিন মাপল। একই কারবার। জমিন দুইভাগ অয় না, অয় তিনভাগ। সে তো অবাক হইলই, আমিনও অবাক। জিন্দেগিতে বহুত জমিন মাপছে আমিন, এমুন কোনোদিন হয় নাই। ব্যাপারটা কী?’

মুড়ি প্রায় শেষ করে এনেছে বদরু। শেষ মুঠ মুড়ি মুখে দিয়ে একটা কলা ছিলল। মুড়ির সঙ্গে এক কামড় কলা খেল। ‘ও আরেকখান কথা। জমিন খালি তিনভাগই অয় না, তিনভাগের একভাগে দেখা যায় বিরাট কালা একখান সাপ জানি কই থিকা আসে। আইসা জমিনের একভাগে লাম্বা হইয়া পইড়া থাকে। তয় গিরস্তরে আর আমিনরে কিছু কয় না। মাইনি সাপে মানুষ দেখলে হয় পলাইয়া যায়, নাইলে ছুইটা আহে কামড়াইতে। এই সাপটা কিছুই করে না। সাত-আষ্ট হাত লাম্বা শইলডা লইয়া তিনভাগের একভাগ জমিনে হুইয়া থাকে। তিনবার জমিন মাপনের পর যহন এই কারবার দেখল আমিন, সে বলল, এই জমিন আমি আর মাপুম না। আপনে অন্য আমিন আনেন। গিরস্ত বিরাট চিন্তায় পড়ল। রাইত্রে দুই পোলায় খাইয়াদাইয়া তাগো ঘরে গেছে, গিরস্তরে ভাত বাইড়া দিছে ধরনী। তারে ঘটনা কইলো গিরস্তে। শুইনা ধরনী বুড়ি একটু চুপ কইরা রইল। তারবাদে কইল ‘ঘটনা আমি বুজছি। আপনের যমক পোলা দুইডা আমার হাতে হইছে, তয় খালি দুই পোলাই হয় নাই আপনের, তাগো লগে একটা সাপও হইছিল।’

শুনে মিলু তো চমকালোই, মাবিয়া খাতুন আর অজুফাও শুনছিল বদরুর কথা, তারাও চমকালো। মাবিয়া খাতুন বললেন, ‘কচ কী?’

‘হ আম্মা। হাচা কথা।’

‘মাইনষের পেডে সাপ জন্মাইছে? এমুন কথা তো কোনোদিন হুনি নাই।’

মিলু বলল, ‘তারবাদে কী হইল?’

ধরনী কইল, ‘ওই সাপটাই বড়। পয়লা সাপটা বাইরা হইল আপনের বউর প্যাট থিকা, তারবাদে হইল যমকপোলা। আমি পয়লা বোজতে পারি নাই, ওইডা কী? রাইত দোফরে হইল আপনের পোলারা। হারিকেন জ্বলতাছিল। হেই আলোয় আমি তারবাদে দেখি কালা একখান সাপ। বেশি বড় না। হাতখানি লাম্বা। হওনের পর পাঁচ মিনিট মনে হয় ঘরে আছিল, তারবাদে বেড়ার তলের ফাঁক দিয়া বাইর হইয়া গেল।’ এই কথা শুইনা গিরস্তের টাসকি লাইগা গেল। কইল, এইবার ঘটনা আমি বুজছি। হেয়ও তো আমার ওয়ারিশ। অহন হেয় আমার পোলাগ লাহান বড় হইছে। জমিন ভাগ হইতাছে দেইখা নিজের ভাগ বুইঝা নিতে আইছে। এই হগল ওপরআলার কুদরত। মাইনষের কিছু করণের নাই।’

তার পরই কান খাড়া করেছিল বদরু। নিমপাখির ডাকটা কানে আসছিল। মিলুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নিমপক্ষি ডাকে নি রে দাদা?’

মিলুও ডাকটা শুনেছে, মাবিয়া খাতুন আর অজুফা শুনেছে। মিলু বলল, ‘হে নিমপাখিই ডাকে। ও নানি তুমি হোনতাছো? নিমপাখি ডাকতাছে না?’

‘হ মিয়াভাই, নিমপাখিঐ। কোন বাইত্তে ডাক পারে রে?’

বদরু আরো দু-তিনবার খেয়াল করে বলল, ‘ঠাকুরবাড়ির মিহিইত্তো ডাক পাড়ে। না, আমি যাই রে দাদা। নিমপাখির ডাক ভালো না।’

বদরু তারপর সারেঙ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে মিয়াদের ছাড়াবাড়ির ওদিক দিয়ে, গুহের বাড়ি হাতের বাঁয়ে রেখে ঠাকুরবাড়ির পথ ধরেছিল। কিন্তু নৌকা ছাড়ার পর অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়েছিল তার। নিজেদের বাড়িতে যাওয়ার সময় অন্ধকার আকাশে অজস্র তারা দেখেছে সে। তারার আলোয় নৌকা বাইছিল। এখন দেখে আকাশে একটিও তারা নেই। ঘোর অন্ধকার আকাশ। কোথাও আলোর চিহ্নমাত্র নেই। কোথাও কোনো শব্দ নেই। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকে না কোথাও, ধানক্ষেতে কিংবা খোলা চকমাঠে শ্বাস ছাড়তে ওঠে না কোনো মাছ। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় না বাদুড়। চারদিক যেন এক নিঝুমপুরী কিংবা মৃত্যুপুরী। এই মৃত্যুপুরীতে থেকে থেকে ডেকে যাচ্ছে এক নিমপাখি। নিম, নিম …

জামতলায় নৌকা ভেড়াতে গিয়েও নিমপাখির ডাকটা শুনতে পাচ্ছিল বদরু। চদরি বাড়ির গাবগাছটার ওদিকে যেন ডাকছে পাখিটা। হাওয়া যেন এখন বইছেই না। অন্ধকার আকাশখানি যেন নেমে এসেছে ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়। ঝিঁঝিঁ ডাকে না, জোনাকি ওড়ে না। এক অলৌকিক নিস্তব্ধতায় যেন ভরে গেছে পুরো গ্রাম। আজকের আগে কখনো তো এমন হয়নি! ঠাকুরবাড়িই বা কেন এমন অন্ধকার? বদরু নিজ হাতে হারিকেন জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছিল ঠাকুরের ঘরে। ঠাকুর-চদরি দুজনেই তখন ঘরে। দরজা বন্ধ করে দিলেও বাইরে থেকে দেখা যাবে আলোর রেখা। কোথায় কী? আলোর চিহ্নই নেই। অন্ধকার, ঘোরতর অন্ধকার ঠাকুরবাড়ি। প্রাণের কোনো স্পন্দনই নেই কোথাও। শুধু নিমপাখিটা ডাকে। নিম, নিম।

বদরুর তখন গা কেমন কাঁটা দিছিল। শরীরের লোম সব খাড়া হয়ে গেছে। এই কী অবস্থা? আন্ধারে কী ঠাকুর দাদায় সেই সাতজনের লগে কথাবার্তা কয়নি? কথা কইলে তো সেই আওয়াজও অল্প-বিস্তর পাওয়া যাইব। এই বাইত্তে দেহি গাছের পাতাও লড়ে না। হারিকেন নিভাইয়া ঠাকুর কী এত তাড়াতাড়ি শুইয়া পড়ল?

অন্ধকার উঠোন পেরিয়ে ঠাকুরের ঘরের সামনে গেল বদরু। গিয়ে আরো অবাক। আরে, দুয়ার দেখি খোলা! ঠাকুর কো? চদরি কো? কী হইছে বাড়িতে? কারবারটা কী হইছে?

ঠাকুরের ঘরে ঢুকতে গিয়ে প্রথমে পায়ের তলায় চটচটে তরল একটা দ্রব্য লাগল বদরুর। তার পরই তার পা গিয়ে পড়ল মাটিতে পড়ে থাকা ঠাকুরের পায়ে। তখনো ঘটনা সে বুঝতে পারেনি। তবে দিশেহারা হয়েছে। দিশেহারা হয়ে আরেকটু এগোতে চেয়েছে। তখন পা লেগেছে ঠাকুরের মাথায়। পায়ের তলার চটচটে জিনিসটা তখন বদরু চিনে ফেলেছে। রক্ত। ঠাকুরের রক্ত। সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের ভিতরটা শীতকালের কচুরির তলার পানির মতো হয়ে গেল। ছিটকে ঘর থেকে বেরোল সে। উঠোনের ওপর দিয়ে দৌড় দিতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল আরেকটি লাশের ওপর। সেই লাশ চদরির।

বদরু তারপর শুরু করেছিল প্রাণ ফাটানো চিৎকার। ‘কে কই আছেন আপনেরা? আউগ্গান। ঠাকুররে জব কইরা হালাইছে। চদরিরে জব কইরা হালাইছে। তাড়াতাড়ি আউগ্গান, তাড়াতাড়ি।’

বদরুর চিৎকারে থেমে গিয়েছিল গাবতলার দিককার নিমপাখির ডাক। খেয়েদেয়ে ঘুমাতে যাওয়া মানুষজন বিছানায় না গিয়ে কুপি বাতি হারিকেন টর্চলাইট নিয়ে বেরিয়েছিল। দেখতে দেখতে গ্রামের চারদিককার বাড়িঘর থেকে এলো কোষানাও, ডিঙ্গিনাও। আলোয় আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল ঠাকুরবাড়ি। সেই আলোয় দেখা গেল ঘরের দুয়ারে ঠাকুরের লাশ, উঠোনে চদরির। মানুষের কোলাহলে রতনপুর গ্রামটি আর ঘুমাল না। সারারাত জেগে রইল। গ্রামের যুবক পোলাপান ঠাকুরবাড়ি পাহারা দিলো রাতভর। ভোররাতে বেলদারদের নৌকা নিয়ে দফাদার ফইজু চলে গেল লৌহজং থানায় খবর দিতে। দুপুরের মুখে মুখে দারোগা-পুলিশে ভরে গেল ঠাকুরবাড়ি। মহকুমা শহর মুন্সিগঞ্জ থেকে স্পিডবোট নিয়ে এলেন পুলিশের বড়কর্তা। লোকে বলে ‘পুলিশ সাহেব’। সারা গ্রামের লোকজনকে ডেকে ডেকে তাঁরা কথা বললেন। জেরা করলেন একে-ওকে। সব চাইতে বেশি জেরা চলল বদরুর ওপর দিয়ে। বিকেলের মুখে মুখে চটে প্যাঁচিয়ে ঠাকুর-চদরির লাশ তোলা হলো স্পিডবোটে। মুন্সিগঞ্জে নিয়ে আরো কাটাছেঁড়া হবে লাশ। লাশের সঙ্গে বদরুকেও নিয়ে গেল পুলিশ-দারোগারা। হাজামবাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেল।

তবে বদরুকে আটক করেনি পুলিশ। দুদিন থানা হাজতে রেখে জেরার পর জেরা, জেরার পর জেরা। তারপর যখন নিশ্চিত হলো, না, বদরু সত্যিই কিছু জানে না, তখন ছেড়ে দিলো। ঝড়ো কাকের মতো চেহারা নিয়ে দুদিন পর ফিরে এসেছিল বদরু। রাহা খরচা ছিল না। লোকের হাতে-পায়ে ধরে, এর নৌকা, ওর নৌকা করে কোনো রকমে গ্রামে এসে পৌঁছেছিল। ওদিকে ঠাকুরের ঘর তালা মেরে গেছে পুলিশ-দারোগারা। চাবি দিয়ে গেছে দফাদারের কাছে। নৌকা পড়েছিল বাড়ির ঘাটে।

তারপর তো পুরো গ্রামটাই মরে গেল বা খুন হয়ে গেল।

ঘটনা ঘটার প্রথম কয়েকদিন দফায় দফায় পুলিশ-দারোগা এসেছে। এর-ওর সঙ্গে কথা বলেছে। বদরুকে ডেকেছে বারবার। তারপর ঘটল আরেক ঘটনা। পাকিস্তান-ইন্ডিয়া যুদ্ধ বেধে গেল। ইংরেজি সেপ্টেম্বর মাসের ছয় তারিখে লাগল যুদ্ধ। একদিকে আইয়ুব খান আরেকদিকে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। দিন দশ-বারো চলেছিল যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে কে হারল কে জিতল বোঝাই গেল না। তবে ঠাকুর চদরির হত্যাকাণ্ড চাপা পড়ে গেল। পুলিশ-দারোগার আনাগোনা বন্ধ হলো। ঠাকুরের ঘর তালাবন্ধ পড়ে রইল। সেই যে হত্যাকাণ্ডের রাতে নৌকাটা জামতলায় ভিড়িয়েছিল বদরু, নৌকা সেখানেই ভেড়ানো থাকল। বর্ষা গিয়ে খরালি এলো। নৌকার তলা থেকে সরে গেল পানি। নৌকা পড়ে রইল ডাঙায়। একজোড়া শালিক পাখি নৌকার ছইয়ে বাসা বেঁধে দিব্যি বাচ্চা ফোটাল। তবে নিঃশব্দে। কারণ সেই রাতের পর, পুলিশের আনাগোনা থেমে যাওয়ার পর গ্রামটি মরে গিয়েছিল। প্রকৃত অর্থে খুন হয়ে গিয়েছিল ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে।

কোনো কোনো রাতে বাড়িতে এসে থাকে বদরু। সেইসব রাতে বৃষ্টি বাদলা না থাকলে, বাপকে রাতের খাবার খাইয়ে কোলে করে উঠোনে এনে বসায়। নানা রকমের গল্পগাছা করে বাবার সঙ্গে। সন্ধ্যা হতে না হতেই রাতের খাবারদাবার সেরে যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়ে। ছেলে যেদিন বাড়িতে থাকে জমসেদ সেদিন ঘুমাতেই চায় না। ঘুম তার চোখে আসেই না। উঠোনে ছেলের সঙ্গে বসে সেও যে কত কথা বলে! বয়রা হওয়া কান তখন যেন আর বয়রা থাকে না। রাতের বাতাসে গাছের পাতার কাঁপনের শব্দটাও যেন সে শুনতে পায়। বাবা ছেলে কথা বলে, বাড়ির মানুষজন সেসবের কোনো কিছুই টের পায় না। তাদের কথা শোনে উঠোনের মাটি, বাড়ির ঘরদুয়ার আর গাছপালা। তাদের কথা শোনে চারপাশের চকমাঠ, ঝিঁঝিঁ পোকা আর রাতপাখি। তাদের কথা শোনে জলতলার মাছ-মাথার ওপরকার আকাশ আর বয়ে যাওয়া হাওয়া। দূর আকাশে চাঁদ থাকলে, চাঁদের কানেও যেন যায় বাপ-ছেলের আন্তরিক কথামালা। নক্ষত্রেরা আনন্দে টিমটিম করে জ্বলে।

আজ তেমন এক রাত। আষাঢ় মাসের আকাশে আজ মেঘ নেই। শুক্লপক্ষের চাঁদ জেগে আছে দূর আকাশে। হাজামবাড়ির উঠোনে এসে পড়েছে একটুখানি চাঁদের আলো। সেই আলোয় মরে শুকিয়ে যাওয়া ছিটকি ঝোপের মতো উঠোনের মাটিতে বসে আছে জমসেদ। আর তার গা ঘেঁষে বসেছে বদরু। ভরপেট খাওয়া হয়েছে অনেক আগে। যে যার মতো শুয়ে পড়ার আয়োজন করছিল ঘরের ভেতর। তখন বদরু তার বাজানকে কোলে করে এনে বসিয়েছে উঠোনের মাটিতে। মাটি খটখটে শুকনো বলে খড়নাড়া কিংবা হোগলা বা ছপ বিছানোর দরকার হয়নি।

আজকের রাতটি বাপ-ছেলের গল্প করা অন্যান্য রাতের মতো নয়। এই রাত ভিন্ন রাত। এই রাতে বদরু তার বাজানকে গূঢ় এক সমাচার শোনাবে। আষাঢ় মাসের প্রকৃতি যেন সেই সমাচার শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। কদম ফুলের গন্ধ ভাসে হাওয়ায়। ঝিঁঝি পোকাদের ডাক শোনা যায়। বাদুড় এসে বসে পেয়ারা গাছের ডালে। বর্ষার জলে ঘাই দিয়ে যায় কোনো মাছ। সবাই যেন উন্মুখ। বাজানকে তার কোনো গূঢ় সমাচার জানাতে চায় বদরু।

আজ দুপুরের পর থেকেই কথাটা ভেবেছে বদরু। যে দেবু ঠাকুর খুন হলো ঠিক এক বছর আগের এই দিনে তাঁকেই আজ স্বচোক্ষে দেখলো বদরু। দিনের পরিষ্কার আলোয় স্পষ্ট দেখলো। তেরো বছর ঠাকুরের সঙ্গে সে কাজ করেছে। সেই মানুষের পুঙ্খানুপুঙ্খ বদরুর চেনা। হাঁটাচলা, কথাবলা, হাসি মশকরা সব, সবকিছু বদরুর জানা। দূর থেকেই ঠাকুরকে সে দেখেছে। উত্তর-পশ্চিম কোণের বাঁশঝাড় ঘেঁষা আমগাছগুলোর তলায় দাঁড়িয়েছিলেন। বদরুকে দেখে তাঁর পরিচিত হাসিটা হাসলেন। তারপর ধীরপায়ে হেঁটে বাড়ির ভিতরদিকে চলে গেলেন। বদরুর একবার ইচ্ছে করেছিল বাঁশঝাড় তলায় গিয়ে নৌকা ভেড়ায়। নেমে দৌড়ে গিয়ে দেখে আসে ঠাকুর তাঁর কথামতো ফিরে এলেন কি না। ঠাকুরের জবান মিথ্যা হওয়ার কথা না। বদরু জানে তিনি একজন নন। তিনি আটজন। এক ঠাকুর খুন হয়েছেন, তিনিই তাকে বলেছিলেন এক বছর পর ঠিক এই দিনে আরেকজন ঠাকুর ফিরে আসবেন। তিনি কী ফিরলেন?

কেন যে ঠাকুরবাড়ির বাঁশঝাড় তলায় নৌকাটা ভেড়াল না বদরু? কেন যে সামনাসামনি গিয়ে তাঁকে দেখে এলো না? এখন সে-কথাই বাজানকে বলতে চাইছে বদরু। কেউ কোথাও জেগে নেই বলে বলতে চাইছে। জগৎ সংসারে এই একজনই ভরসার মানুষ বদরুর, যাকে সে সব কথা বলতে পারে। যাকে সে কখনো মিথ্যা বলে না।

ঠাকুর খুন হওয়ার পর ঠাকুর চৌধুরীর লাশের সঙ্গে বদরুকেও নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। দুদিন পর ছেড়েও দিয়েছিল। বাড়ি ফিরে উঠোনের মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শিশুর মতো কেঁদেছিল বদরু। জমসেদ বসেছিল উঠোনের কোণে। তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েই কাঁদছিল ছেলেটা। জমসেদের চোখেও পানি ছিল। ছেলের কান্না মানুষটা সহ্য করতে পারছিল না। একসময় নিরিবিলিতে বদরুকে সে ধরেছিল। ‘আমার কাছে হাছা কথা ক বাজান।’

গামছায় চোখ মুছে বদরু বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। সেদিন তাদের পাশে বাড়ির সবাই। বদরু বলেছিল, ‘আমি তোমার লগে কোনোদিন মিছা কথা কই নাই বাজান। নিজে ঠাকুররে খুন করলেও সেই কথা তোমার কাছে স্বীকার করতাম। পুলিশ-দারোগারা আমারে অনেক রকমভাবে জিগাইছে। ফাঁসির ডর দেখাইছে, মারছে। আমার ওই একই কথা। আমি কিছুই জানতাম না। আমি কিছু সন্দেহ করলে ঠাকুররে কেউ মারতে পারতো না। তার লাইগা আমি জান দিয়া দিতাম।’

জমসেদ তার ঘোলা চোখে ছেলের মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়েছিল। ‘আমি তর কথা বিশ্বাস করলাম বাজান। যা, তর কিচ্ছু হইবো না। দারোগা পুলিশ কোর্ট-কাচারি কেউই তর কিছু করতে পারবো না। সত্যবাদীরে আল্লায় রক্ষা করে।’

সত্যি সত্যি বদরুর কিছু হলো না। গ্রামের কারোরই কিছু হলো না। পাকিস্তান-ইন্ডিয়া যুদ্ধ শুরু হলো। আর ঠাকুর চৌধুরীর হত্যাকাণ্ড চাপা পড়ে গেল। কারা রাতের অন্ধকারে এসে খুন করে গেল মানুষ দুটিকে তার কোনো হদিসই পাওয়া গেল না। তবে, চৌধুরীর কথা কেউ ভাবে না। ঠাকুরের কথাই মনে রেখেছে সবাই। তাঁর সঙ্গে গ্রামটি খুন হয়ে গেছে। আজ এক বছর।

বদরু আস্তে করে বাবাকে ডাকলো। ‘বাজান।’

জমসেদ বললো, ‘ক বাজান।’

‘আমি আইজ ঠাকুররে দেখছি।’

মরা ছিটকি ঝোপে প্রবল হাওয়া লাগলে যে রকম কাঁপন ওঠে, জমসেদ সেইভাবে কাঁপলো। ‘কী? কারে দেখছোস তুই?’

‘ঠাকুররে দেখছি। দেবু ঠাকুররে।’

‘কই দেখছোস? কেমতে দেখছস?’

ঘটনা বললো বদরু। শুনে জমসেদ কিছুক্ষণ চুপ করে  রইলো। তারপর বলল, ‘তর চোখের ভুল। তুই ভুল দেখছোস।’

‘না বাজান, ভুল দেখি নাই। ঠাকুররে দেখতে আমার চোখ ভুল করবো না।’

‘অপঘাতে মরণ, খুন হওয়া মানুষের আত্মা অনেক সময় বাড়ি ছাইড়া যায় না। হিন্দুগ ওইরকম আত্মা অনেক সময়

থাইকা যায়। কোনো কোনো সময় মানুষ তাগো দেখতে পায়। তুই ওই রকমভাবে ঠাকুররে দেখছোস।’

‘না বাজান, তিনায় ভূতপেত না। তিনায় আসলেই ঠাকুর। মইরা গিয়া ফিরত আইছেন। আমার কথার প্রমাণ তোমরা পাইবা। ঠাকুর আমারে কইছিলেন, এক বছর বাদে তিনায় ফিরত আসবেন।’

জমসেদের শরীরে আবার আগের মতো কাঁপন লাগলো। সে কোনো কথা বলতে পারলো না।

বদরু বললো, ‘ঠাকুর খুন হওয়ার আইজ এক বছর পুরা হইলো। আইজই তারে আমি দেখছি। আমার মিহি চাইয়া হাসছে।’

জমসেদ থতমত খাওয়া গলায় বললো, ‘এই হগল তুই কী কইতাছোস বাজান? এইডা কেমতে হয়? মরা মানুষ ফিরত আহে? এমুন ঘটনা তো কোনোদিন হুনি নাই।’

‘এইটাই হইছে বাজান।’

একটু থেমে বদরু বললো, ‘আরো অনেক কথা আইজ তোমারে কওন লাগে বাজান। জানি না কওন ঠিক হইবো কি না। ঠাকুর আমারে কইতে না করছিল। তয় আইজ আর না কইয়া উপায় নাই।’

‘ক বাজান, ক। বেবাক কথা আমারে খুইলা ক। খুইলা কইলে আমি বেবাক বুঝতে পারুম।’

বদরু ধীরে ধীরে সব কথা খুলে বলল জমসেদকে। আটজন ঠাকুরকে সে এক রাতে দেখেছে। জামতলায় তাদের কথাবার্তা শুনেছে অনেক রাতে। চোর ডাকাত কুকুর বিড়াল শিয়াল খাটাশ কোনো কিছুই ঠাকুরবাড়িতে কেন কোনো দিন ঢুকতে পারে না, প্রিয়নাথের মৃত্যুর কথা কেমন করে আগাম বলে দিয়েছিলেন ঠাকুর – এই সবকিছুই জমসেদকে খুলে বললো বদরু। শুধু ঠাকুরের নারীঘটিত ব্যাপারগুলো চেপে গেল। বাপকে কী আর ওসব কথা বলা যায়?

সব শুনে স্তব্ধ হয়ে রইলো জমসেদ। বদরু আর কথা বললো না। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো।

সেই রাতে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটলো।

তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। অন্ধকার ঘরে ঘুমিয়ে আছে জমসেদের বউ পোলাপান। জমসেদের পাশে শুয়ে গভীর ঘুমে ডুবে আছে বদরু। ঘুমন্ত মানুষের শ্বাস পড়ে গভীরভাবে। কেউ হা করে ঘুমায়, কেউ বা মৃদু বা উচ্চশব্দে নাক ডাকে। কিন্তু জমসেদের ঘরে সেই রাতে কোনো শব্দ ছিল না। ঘুমন্ত মানুষগুলো যেন বেঁচে নেই। যেন সবাই মৃত। এই ঘর এক মৃত্যুপুরী। ঘুমিয়ে গেলে জমসেদ নিজেও ঘড়ঘড়ে এক ধরনের শব্দ করে। আজ সেই শব্দও নেই।

এ-সময় উঠোন থেকে জমসেদকে কে যেন ডাকলো। ‘ওঠো হাজাম, আর কত ঘুমাইবা?’

এক ডাকেই জেগে উঠলো জমসেদ। কে ডাকে তাকে? সঙ্গে সঙ্গে জমসেদ টের পেল তার বয়রা হওয়া কান আর বয়রা নেই। যৌবনকালের মতো একদম পরিষ্কার সব শুনতে পাচ্ছে সে। ঘরের ভেতর শব্দ নেই ঠিকই কিন্তু বাইরে হাওয়ার চলাচল সে শুনতে পাচ্ছে। পাতা কাঁপার শব্দ, ঝিঁঝিঁর ডাক, রাতপাখির উড়ে যাওয়া, বাড়ির লাগোয়া চকে মাছের ঘাই, সব সে শুনতে পাচ্ছে। তারপরই টের পেল অন্ধকারেও তার চোখ যৌবনকালের মতো কাজ করছে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে চাঁদের একটুখানি আলো ঢুকেছে। সেই আলোটা সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। হাওয়া ঢুকছে ঘরে। হাওয়ায় কদম ফুলের গন্ধ। গভীর আনন্দে বুক ভরে গেল জমসেদের। তার কান-চোখ-নাক সবই কাজ করছে। সে আর মরা ছিটকি ঝোপের মতো নেই।

তারপরই জমসেদ টের পেল তার শরীর ফিরে গেছে প্রথম যৌবনের দিনগুলোতে। লম্বা তাগড়া জোয়ান মানুষটি হয়ে উঠেছে সে। গভীর আনন্দ নিয়ে খড়নাড়ার বিছানায় উঠে বসলো জমসেদ। তখন আবার সেই ডাক। ‘ওঠো হাজাম, আর কত ঘুমাইবা?’

জমসেদ ওঠে দাঁড়ালো। যৌবনভর্তি শরীর নিয়ে শক্তিশালী পায়ে হেঁটে ঘরের ঝাঁপ খুললো, উঠোনে এলো।

উঠোনে একজন দশাসই মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কালো আলখাল্লায় ঢাকা। মুখে কালো নেকাব। শুধু তার বিশাল চোখ দুটো দেখা যায় ধক্ধক্ করে জ্বলছে।

জমসেদ বিনীত গলায় বললো, ‘হুজুর আপনে কে?’

সেই মানুষ বললেন, ‘তুমি আমাকে চিনতে পারোনি? আমি তোমার মওত। তোমাকে নিতে এসেছি। পশ্চিমের বাঁশঝাড়ের দিকে তাকাও।’

জমসেদ সেদিকে তাকালো। সেখানে কালো আলখেল্লা পরা আরো চারজন। তাঁরা টুকটুক শব্দে বাঁশ কাটছেন। দেখতে দেখতে কাঁচা বাঁশের একটা মাচা তৈরি করে ফেললেন সেই চারজন। উঠোনে নিয়ে এলেন। প্রথমজন বললেন, ‘এই তোমার কাঁচা বাঁশের পালঙ্ক জমসেদ। শুয়ে পড়ো। আরামে ঘুমাও। গভীর আরামে ঘুমাও। এই তোমার শেষ ঘুম।’

জমসেদ হাসিমুখে সেই খাটে শুয়ে পড়লো। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে তার চোখে ভেসে উঠলো বহুদূর অতীতে ফেলে আসা জীবনের নানা রঙের দিনগুলো। রানাদিয়া গ্রাম থেকে টুকটুকে একটি বউ বিয়ে করে ফিরছে সে। সেই বউয়ের নাম মাজেদা বেগম। কত আনন্দের দিন কেটে গেছে তার সঙ্গে! কত মায়াবী রাত কেটেছে! আদরে ভালোবাসায় সংসারে এসেছে একের পর এক মুখ। দূর গ্রামে খৎনার কাজ সেরে সন্তানদের জন্য খাবার বাঁচিয়ে এনেছে সে। বাড়ি ফেরার পর পাখির ছানার মতো ঘিরে ধরেছে সন্তানেরা। সেই অতুলনীয় আনন্দের দিনগুলো চোখের উপর ভেসে উঠছিল জমসেদের। কত চৈত্রদিনের খা-খা দুপুর, শ্রাবণসন্ধ্যার হঠাৎ উজ্জ্বল হওয়া আকাশ, গৌধূলিবেলার প্রহেলিকা, শিশির ভেজা শীতের সকাল, বর্ষা দিনের প্রথম কদমফুল, বসন্তের উদাসী হাওয়ায় শুধুই ফুলের সুবাস! চারদিককার পৃথিবীতে কত আনন্দ, কত মধুময় দিনরাত্রি, কত পাখির গান, কত উদাসী হাওয়ার বয়ে যাওয়া, সব পেছনে ফেলে জমসেদ চলে যাচ্ছে কোনো অচিনলোকে …!

ভোরবেলা ঘুম ভেঙে বদরু দেখে তার পাশে মরে পড়ে আছে তার বাজান জমসেদ হাজাম। (চলবে)