নয়

কাঞ্চনকন্যা

এই আখ্যান এখন একটু পিছন ফিরবে।

বাসন্তীর ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরের বছর বর্ষাকালের কথা। পুব কুমারভোগের মীর্জা বাড়িকে লোকে বলে ‘বড়বাড়ি’। বাড়িটি ছিল জমিদার অশ্বিনীকুমার চক্রবর্তীর। বিক্রমপুর ছিল পরগনা। ছোট-বড় জমিদার ছিল অনেক। অশ্বিনীবাবু তেমন বড় জমিদার ছিলেন না। আবার খুব ছোটও ছিলেন না। দু-আড়াই হাজার কানি জমির মালিক ছিলেন। বাড়িটা ছিল তিরিশ-পঁয়ত্রিশ কানির ওপর। বাড়িতে ঢোকার একপাশে বিশাল বাঁধানো পুকুর, আরেক পাশে কাছারিঘর। পুকুর আর কাছারিঘরের মাঝখানে বিশাল আঙিনা। দক্ষিণমুখী বাড়িটির কাছারিঘরটা ছিল বিশাল। একতলা এক দালান। তারপর অন্দরমহলে ঢোকার দেয়াল। ভেতরে উত্তর-দক্ষিণ আর পূর্বদিকে তিনখানা পুরনোকালের দোতলা দালান। পশ্চিমদিকে বাঁধানো ঘাটলার আরেকখানা পুকুর। এই পুকুর বাড়ির মেয়েদের জন্য। উত্তরদিককার দালানটির পেছনে ফলফলাদির বাগান। বাগানে উত্তর পাশটা শুধুই বাঁশঝাড়। এই বিশাল বাড়িটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। অশ্বিনীবাবুর ছেলেমেয়ের সংখ্যা ছিল এগারো। বাড়িতে চাকর-নফর ছিল চল্লিশ-পঞ্চাশ জন। লাঠিয়াল ছিল একদল। সব মিলিয়ে গমগমে বাড়ি।

অশ্বিনীবাবু ছিলেন চিন্তাশীল মানুষ। পড়াশোনা করা মানুষ। এই ধরনের মানুষেরা দেশের রাজনীতির হাওয়াটা আগাম বুঝতে পারেন। অশ্বিনীবাবু বুঝে গিয়েছিলেন ব্রিটিশরা আর কোনোভাবেই ভারতবর্ষে থাকতে পারবে না। ভারত দেশটি তাদের ছাড়তে হবে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের কথাও তাঁর মনে আছে। সবমিলিয়ে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গের বাস একদিন তুলতে হবে। কলিকাতার টালিগঞ্জ এলাকায় প্রাসাদোপম বাড়ি কিনে রেখেছিলেন। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর ছেলেদের স্থায়ী করে দিয়েছেন কলিকাতায়। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন কলিকাতায় বসবাস করা পাত্রের কাছে। অন্যদিকে খুবই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, বিচক্ষণতার সঙ্গে ধীরে ধীরে জমি বিক্রি করতে শুরু করে দিলেন। এলাকার উঠতি মুসলমান বেপারিরা সেইসব জমি কিনছিল। দেশ বিভাগের আগে আগে দেখা গেল, প্রায় হাজার দেড়েক কানি জমি তিনি বিক্রি করে ফেলেছেন। আট-নয়শো বা হাজার-এগারোশো কানি জমি তখন রয়ে গেছে। আর রয়েছে বাড়িটি। এই সম্পত্তি বিক্রি করতে পারলেই স্ত্রীর হাত ধরে তারপাশা থেকে স্টিমারে চড়বেন। তারপাশা থেকে গোয়ালন্দ ঘাট। সেখান থেকে ট্রেনে সোজা শিয়ালদহ। কলিকাতা।

কিন্তু এত বড় সম্পত্তি কিনবে কে? যদিও প্রায় জলের দরেই বিক্রি হচ্ছিল জমিজমা। সেই টাকার অঙ্কটাও কম নয়। কলিকাতার ব্যাংকে টাকা জমেছে প্রচুর। এখন এই সম্পত্তি যতটা পারেন বিক্রি করবেন আর না পারলে বিশ্বস্ত কর্মচারীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে যাবেন।

দিঘলী বাজারে ব্যবসা করে তখন বেশ বড় হয়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণগাঁওয়ের মুসলমান কারবারি হোসেন মীর্জা। মূলত তাঁর পাটের কারবার। বিশাল বিশাল নৌকা করেছেন শ’খানেকের ওপর। দিঘলী বাজারে বিরাট পাটের আড়ত। এলাকায় তখন পাট চাষ হতো ব্যাপক। হোসেন মীর্জার কর্মচারীরা ছোট-বড় নৌকা নিয়ে গ্রামে গ্রামে যায়। গৃহস্থ বাড়ি থেকে অল্প দামে শুকনো পাট কিনে নৌকা বোঝাই করে আড়তে নিয়ে আসে। হোসেন মিয়ার গস্তি নাওগুলো পাট বোঝাই করে লাইন ধরে যায় নারায়ণগঞ্জ বন্দরে। সেখানেও লোক আছে হোসেন মীর্জার। গোডাউন আছে। পাট চলে যায় আদমজী জুট মিলে। টাকা আসে বস্তা বস্তা। নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় বড়সড় তিনতলা একটা বাড়িও কিনেছেন হোসেন মীর্জা। ঢাকার গেণ্ডারিয়াতেও কিনেছেন। স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে প্রায়ই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ আসা-যাওয়া করেন।

ছেচল্লিশ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হলো নোয়াখালী আর কলিকাতায়। অশ্বিনীবাবুর ছেলেমেয়েরা সব কলিকাতায়। তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। দুশ্চিন্তা নিজেকে নিয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে। তাঁরা পড়ে আছেন পূর্ববঙ্গে। যদিও বিক্রমপুরে দাঙ্গা  লাগার কোনো কারণ নেই। সাধারণ মানুষের বেশিরভাগই মুসলমান। তবে হিন্দুদের সংখ্যাও কম নয়। এই অঞ্চলের মানুষ নিরীহ প্রকৃতির। দাঙ্গা-লুটতরাজ করার মানসিকতা তাদের নেই। অশ্বিনীবাবুর লাঠিয়াল বাহিনীর পুরোটাই মুসলমান। অতি চৌকস এক-একজন লাঠিয়াল। দুরন্ত সাহসী। বাবুকে রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে দেবে। তারপরও ভয় আর আতঙ্ক কাজ করত অশ্বিনীবাবুর মনে। গভীর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বিচক্ষণ মানুষ। তাঁর নায়েব মোসলেমউদ্দিন অতি বিশ্বস্ত ও সৎলোক। অশ্বিনীবাবুর ডান হাত বলা যায় তাকে। দীর্ঘদিন বাবুর সঙ্গে সে। একদিন মোসলেমউদ্দিনকে নিয়ে বসলেন অশ্বিনীবাবু। ‘অবস্থা সুবিধার না মোসলেম। কলিকাতায় চলে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু এদিকটায় বিলি-ব্যবস্থা কী করব তার কূল-কিনারা করতে পারছি না। জমাজমি বাড়িঘর সবই বিক্রি করে দিতে চাই। তুমি তো গত কয়েক বছরে চেষ্টা-তদবির করে বহু জমি বিক্রি করেছ। বাকিটার ব্যবস্থা করো। পুব চকের দেড়শো কানি তোমাকে দিয়ে দেব। বাকিটা বিক্রি করে দাও।’

মোসলেমউদ্দিন এতই সৎ এবং নির্লোভ মানুষ, তিনি নির্বিকার গলায় বললেন, ‘আমারে দিতে হইব না কিছুই কর্তা। আমি একজন মানুষকে আপনার কাছে নিয়া আসুম। আমার মনে হয় তার লগে আপনে সরাসরি কথা কইলে কাজ হইয়া যাইব।’

‘লোকটা কে?’

‘তার নাম হোসেন মীর্জা। পাটের কারবার কইরা বিরাট টাকার মালিক হইছে। ইচ্ছা করলে হেয় নিজেই আপনার বেবাক জমি আর বাড়িঘর কিইনা লইতে পারে।’

অশ্বিনীবাবু উদাস গলায় বললেন, ‘খবর দেও তোমার ওই হোসেন মীর্জারে।’

দুদিন পর হোসেন মীর্জা এলেন পালকি চড়ে। একটু ভারী শরীরের মানুষ। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা। মাথায় সাদা গোল টুপি। চাপদাড়ি কাঁচা পাকায় মিশানো। তবে দাড়ি ছোট করে ছাঁটা। চোখে চশমা আছে। গায়ের ফর্সা রং থেকে বনেদিয়ানা ঝরে পড়ছে। সঙ্গে আটজন দেহরক্ষী লাঠিয়াল আছে। মোসলেমউদ্দিন তাঁকে কাছারিঘরে বসিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর অশি^নীবাবু নিজে দ্রুতপায়ে হেঁটে এলেন সেই ঘরে। এমন সাধারণত তিনি করেন না। আজ কেন করলেন মোসলেমউদ্দিন তা বুঝল। হোসেন মীর্জারও না বোঝার কথা নয়। মীর্জা সাহেব বসে ছিলেন একটা আরাম কেদারায়। বাবুকে দেখে বিনীত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। ‘আদাব।’

‘আদাব, আদাব।’ বলেই মোসলেমউদ্দিনের দিকে তাকালেন বাবু। ‘মীর্জা সাহেবকে কাছারিঘরে বসিয়েছ কেন মোসলেম? অন্দরমহলে আমার বৈঠকখানায় নিয়ে আসবে না?’

অতি সম্মানের সঙ্গে মীর্জা সাহেবের হাত ধরলেন বাবু। বললেন, ‘আসেন, আসেন মীর্জা সাহেব। চলেন আমার বৈঠকখানায় গিয়া বসি।’

বৈঠকখানায় এসে মুখোমুখি বসলেন দুজনে। তখন বিকেল। বৈঠকখানা ঘরে একটা খাবারের টেবিল আছে। দেখা গেল চারজন কাজের লোক খাবারের পর খাবার এনে টেবিল ভরে ফেলছে।

অশ্বিনীবাবু বললেন, ‘চলেন মীর্জা সাহেব। বৈকালের জলখাবার খেতে খেতে কাজের কথাটা সারি।’

মীর্জা সাহেব বললেন, ‘আমি সামান্য কিছু মুখে দেব, তাও আপনের সম্মানে। এই সময় আমি তেমন কিছু খাই না। শুধু এক কাপ চা খাই।’

‘যাই হোক কিছু একটা মুখে দেন, তারপর চা খান।’

সেই বিকেলেই জায়গা-সম্পত্তি-বাড়িঘরের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল। মীর্জা সাহেব তেমন দামদস্তুর করলেন না। সাড়ে আটশো কানির মতো ফসলের জমি আর এই বাড়ি পুরোটা তিনি কিনে নিলেন। অশ্বিনীবাবু তাঁর কথামতো পুবপাড়ার পুরো চকটাই দিয়ে দিলেন মোসলেমউদ্দিনকে। গভীর কৃতজ্ঞতায় মোসলেমউদ্দিন খুব কেঁদেছিল সেদিন। তবে মীর্জা সাহেব একটা কাজ করেছিলেন, মোসলেমউদ্দিনকে বিদায় করেননি। নায়েবের দায়িত্বে তাকে বহাল রেখেছিলেন। মাহিনা ইত্যাদি অশ্বিনীবাবু যা দিতেন তার চেয়ে কিছু বাড়িয়ে দিয়েছেন। ব্যবসায়ী মানুষ। বুঝে গিয়েছিলেন এত বড় সম্পত্তির অনেক কিছুরই হদিস করতে পারবেন না তিনি। পুরনো বিচক্ষণ নায়েব তাঁর দরকার হবে। এমনকি লাঠিয়াল বাহিনীকেও তিনি রাখলেন। বাড়ির কাজের লোকেরা স্ব-ইচ্ছায় যারা বিদায় হলো তাদের তিনি ঠেকালেন না। যারা থাকতে চাইল তারা থেকে গেল। মাস
তিন-চারেকের মধ্যে দেখা গেল অশ্বিনীবাবু চলে গেছেন কলিকাতা। তাঁর বাড়ি এখন গমগম করছে হোসেন মীর্জার পরিবারের পদচারণে। সাত ছেলে মীর্জার আর একটি মাত্র মেয়ে। মেয়েটি সবার ছোট। সবার নয়নের মণি। তার নাম কিরণ। চাঁদের কিরণের মতো গায়ের রং। অপূর্ব সুন্দরী। দশ-এগারো বছর বয়সে তার সৌন্দর্যে পুরো বাড়ি আলোকিত হয়ে থাকে। সাত ভাই চম্পার একটি বোন পারুল সে।

মীর্জা সাহেবের সাত ছেলের বড় এবং মেজো ছেলে থাকে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার বাড়িতে। ওখান থেকে দু-ভাই পাটের ব্যবসাটা দেখে। তারা দুজনেই ম্যাট্রিক পাশ করেছে।

আইএ-বিএ আর পড়া হয়নি। মীর্জা সাহেব তাদের ব্যবসায় নামিয়ে দিয়েছেন। বড় পরিবারে দুই ছেলের বিয়েও দিয়েছেন। চতুর্থ ছেলেটি ঢাকায় থেকে জগন্নাথ কলেজে আইএ পড়ে। তার ইচ্ছে এমএ পাশ করে প্রফেসারি করবে। ব্যবসা-বাণিজ্য সে দেখতে পারবে না। সেজো ছেলে আর ষষ্ঠ ও সপ্তম এই তিনজন গ্রামের বাড়িতে আছে। ছোট ছেলেটি তখন ব্রাহ্মণগাঁও হাই স্কুলে পড়ে। সেজো আর ষষ্ঠ ছেলেটি নাইন পর্যন্ত পড়ে আর লেখাপড়া করেনি। অল্প বয়সেই তারা দিঘলী বাজারের পাটের আড়তে বসতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্য বুঝে নিচ্ছে। তবে মীর্জা সাহেবের মেয়ে কিরণের লেখাপড়ার প্রতি খুব ঝোঁক। অশি^নীবাবু ছিলেন বই পড়ার পোকা। অন্দরমহলের বৈঠকখানার পাশের কামরাটিতে বিপুল বইয়ের সংগ্রহ তাঁর। বেশিরভাগই ইংরেজি। শেক্সপিয়র থেকে শুরু করে হাল আমলের বিদেশি লেখকদের অনেক বই। বাঙালি লেখকদের মধ্যে আছেন বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র এই সমস্ত লেখক।

এই বাড়িতে এসে কিরণের সবচাইতে প্রিয় জায়গা হয়ে উঠল অশ্বিনীবাবুর পড়ার ঘরটি। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় সে ইংল্যান্ডের নামকরা প্রকাশনা সংস্থা থেকে দামি কাগজের চামড়ার বাঁধাই করা শেক্সপিয়র রচনাবলির প্রথম খণ্ড হাতে নেবে। শীত-সকালের রোদে দু-খানা জলচৌকি নিয়ে উঠোনে বসবে। শেকসপিয়র রচনাবলির প্রথম খণ্ড খুলবে। পাশে অক্সফোর্ডের ইংলিশ টু ইংলিশ আর ইংলিশ টু বেঙ্গলি ডিকশনারি নিয়ে অতি যত্নে আর মনোযোগ সহকারে শেক্সপিয়র পড়তে থাকবে।

মীর্জা সাহেবের সেজো ছেলেটির নাম হাসান মীর্জা। সে একটু অন্য ধরনের মানুষ। বিয়েশাদি না করার ব্রত নিয়েছে। আধ্যাত্মিক লাইনের চিন্তাভাবনায় মগ্ন থাকে। তবে ব্যবসাটা ভালো বোঝে। হাজার চেষ্টা করে বিয়েতে তাকে রাজি করানো যায়নি। তার আশা ছেড়ে দিয়ে মীর্জা সাহেব একেবারে ছোটটি ছাড়া পঞ্চম আর ষষ্ঠ ছেলে দুটোর বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। ছোটটির এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। আর মেয়ের বিয়ের দেরি আছে। মেয়েটি এখন মাত্র দশ পেরোচ্ছে। বিয়েশাদির কথা উঠলে সে পরিষ্কার বলে, ‘আমি লেখাপড়া নিয়ে থাকব, বিয়ে করব বিএ পাশ করার পর।’ ব্রাহ্মণগাঁও হাই স্কুলের ক্লাস সিক্সের ছেলেদের পেছনে ফেলে সে বরাবর ফার্স্ট হয়। যেমন বই পড়ার নেশা, তেমন গান-বাজনা-নাটকের নেশা। মীর্জা সাহেব মেয়েকে মারফি কোম্পানির সুন্দর একটা ট্রানজিস্টার কিনে দিয়েছেন। কিরণ এই বয়সেই আকাশবাণী কলিকাতার অনুরোধের আসর শোনে, পাঁচমিশালি গানের অনুষ্ঠান শোনে, নাটকগুলো শোনে। বাড়িতে গ্রামোফোনও আছে। গ্রামোফোনও কেনা হয়েছে কিরণের তাগিদে। ভাইয়েরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ থেকে আসার সময় তার জন্য সদ্য বেরোনো রেকর্ড কিনে আনে। উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা এলে ভাই-ভাবিদের সঙ্গে ঢাকায় গিয়ে সেইসব সিনেমা দেখে আসে কিরণ। ফলে তার রুচি তৈরি হয়েছে অন্যরকম। দেশগ্রামের মুসলমান পরিবারের মেয়েগুলোর মতো সে হয়নি।

মীর্জা পরিবার ধর্মপ্রাণ। মীর্জা সাহেব আর তাঁর স্ত্রী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। ছেলেরাও কেউ কেউ পড়ে। অশ্বিনীবাবুর বাড়ি কেনার পর কাছারিঘরের লাগোয়া সুন্দর মসজিদ করেছেন হোসেন মীর্জা। মসজিদের পেছনে সাড়ে তিন কানির মতো জমিতে পারিবারিক কবরস্থান করেছেন। জায়গাটি গাছপালার ছায়ায় সুনিবিড়।

এই পরিবারের আবহে যেহেতু বড় হচ্ছিল কিরণ, কোরআন শরিফ পড়াটা সে শিশু বয়সেই শিখেছে। নামাজ শিখেছে। তবে শবেবরাতের রাত ছাড়া নামাজ সেভাবে পড়া হয় না তার। সে আছে স্কুলের পড়া নিয়ে আর অশ্বিনীবাবুর লাইব্রেরি নিয়ে। হাতের লেখা ভারি সুন্দর মেয়েটির। নিজের জগতে মেতে থাকা মেয়েটিকে বাড়ির কেউ কিছু বলে না। যে-কোনো আবদার করলে মা-বাবা, ভাইয়েরা, ভাইয়ের বউয়েরা সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায় তা পূরণ করতে।

ওদিকে যত বড় হচ্ছে ততই সৌন্দর্য বাড়ছে কিরণের। যে কেউ তাকে দেখলে চোখে পলক ফেলতে ভুলে যাবে।

এই মেয়ের সঙ্গে ঠাকুরের দেখা হলো, মেয়েটি যখন ক্লাস নাইনে পড়ে। বয়স পনেরো বছর চার মাস। দেখা হলো শ্রাবণদিনের বর্ষণমুখর বিকেলবেলায়।

ততদিনে মীর্জা বাড়ি ‘বড়বাড়ি’ নামে এই অঞ্চলে বিখ্যাত। দেশবিভাগের পর মীর্জা সাহেবের ব্যবসা আরো ফুলেফেঁপে উঠেছে। জমি বেড়েছে চার-পাঁচগুণ। অশ্বিনীবাবুর চেয়ে বেশি প্রতাপশালী জমিদার হয়ে উঠেছেন তিনি। পঞ্চম ছেলেটির বউ গর্ভবতী। বউটি সুশ্রী। নাম বকুল। বড়-মেজো ভাইয়ের বউরা বলেছিল, প্রসবের মাসখানেক আগে বকুলকে যেন ঢাকা কিংবা নারায়ণগঞ্জ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানকার হাসপাতালে প্রসব হবে। কষ্ট বলতে গেলে পাবেই না বউটি।

বকুলের স্বামীর নাম আতিক মীর্জা। তারও পরিকল্পনা ছিল ভাবিদের কথামতোই কাজটি সে করবে। তা আর হলো না। সময়ের আগেই এক দুপুরে প্রসববেদনা উঠল বকুলের। বাড়ির লোকজন দিশেহারা হলো। আতিক মীর্জা স্ত্রৈণ স্বভাবের। সে খুবই বিচলিত হয়েছে। মনীন্দ্র ঠাকুরকে ডেকে আনতে লোক পাঠিয়ে দিলো।

বড়বাড়ির ডাক। রাতদুপুরে হলেও যেতে হবে। কোনো উপায় নেই। সেই বাড়ি থেকে নৌকা পাঠানো হয়েছিল ঠাকুরের জন্য। সেই নৌকায় তিনি চড়লেন না। বদরুকে নিয়ে নিজের নৌকায় রওনা দিলেন। যাত্রার মুহূর্তে ঝুমবৃষ্টি। বড়বাড়ি পৌঁছাতে দেড়-ঘণ্টা সময় লাগল। তার আগেই বৃষ্টি থেমেছে। হঠাৎ করেই শ্রাবণের আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। আকাশে পশ্চিম প্রান্ত থেকে গোধূলিলগ্নের কিছুক্ষণ আগে একটুকরা রোদ এসে পড়েছে মীর্জা বাড়ির ঘাটে। নৌকা মাত্র ঘাটে বাঁধবে বদরু সেই সময়ে ঠাকুর দেখেন বাড়ির পুবদিককার পুকুরপাড়ের ঝাপড়ানো বকুলগাছটির তলায় পায়চারি করছে স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক অপ্সরী। শেষবেলার আলো স্টিমারের সার্চলাইটের মতো পড়েছে কন্যার মুখে, শরীরে। পরনে হালকা আকাশি রঙের তাঁতের শাড়ি আর সাদা ঘটিহাতা ব্লাউজ। মাথার লম্বা চুল পিঠময় ছড়ানো। পায়ে হালকা চপ্পল মেয়ের আর দু-হাত ভর্তি রংবেরঙের কাচের চুড়ি।

ঠাকুর নৌকা থেকে নামলেন। সেই মেয়ের দিকে তাকিয়ে তাঁর চোখ স্থির হয়ে গেল। তিনি চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেলেন। অপ্সরীও কি এত সুন্দর হয়? স্বর্গের দেবীও কি এত সুন্দর হন? এ তো সোনার বরণী মেয়ে, সোনা দিয়ে গড়া। কাঞ্চনকন্যা।

কিরণও ঠাকুরকে দেখতে পেয়েছে। কয়েক পলক সে ঠাকুরকে দেখল। বদরু নৌকা বেঁধে ঠাকুরের ডাক্তারি ব্যাগ নিয়ে নেমেছে। ঠাকুরকে আনতে গিয়েছিল যারা তারা তিনজনই হিন্দু। মীর্জা বাড়ির কর্মচারী। ঠাকুরকে কর্তা সম্বোধন করল। ‘আসেন কর্তা, আসেন।’

ঠাকুরের চোখ তখন কিরণের দিক থেকে সরছেই না। কিরণও তাঁকে কেমন কৌতূহলী চোখে দেখছে।

আতিক মীর্জার শোবার কামরায় উঁচু পালঙ্কে সাদা চাদর গায়ে শুয়ে আছে বকুল। মুখে তীব্র যন্ত্রণার চিহ্ন। বাড়ির ছোট বউ ডালিম আছে তার সঙ্গে। মীর্জা সাহেবের স্ত্রী আছেন। গ্রামের একজন ধাত্রীও আছে।

বকুলকে ঠাকুর তীক্ষèচোখে বেশ খানিকক্ষণ দেখলেন। ঠাকুরের পেছন পেছন আতিক মীর্জাও ঢুকেছিল এই কামরায়। সে অস্থির গলায় বলল, ‘কেমন দেখতেছেন ডাক্তারবাবু?’

ঠাকুর নির্বিকার গলায় বললেন, ‘এটাকে বলে ফলস পেইন। প্রসব হতে আরো তিনদিন লাগবে। আজ বুধবার। প্রসব হবে শুক্রবার দুপুরের পর। আর তোমার স্ত্রীর ছেলে হবে।’

‘ছেলে হবে’ – ঠাকুরের এই কথা শুনে বাড়িতে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল। বকুল যে তিনদিন ব্যথায় কষ্ট পাবে আতিক মীর্জা ছাড়া এ নিয়ে কেউ মাথাই ঘামাল না। সে এসে স্ত্রীর শিয়রে বসল। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল, ‘বোঝতাছি তুমি বেদনায় খুব কষ্ট পাইতাছ। কী আর করবা? একটু কষ্ট করো।’

বকুল কথা বলল না, গোঙানির মতো একটু শব্দ করল।

ওদিকে মীর্জা সাহেব ডেকেছেন ঠাকুরকে। ডেকে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, আপনে বলছেন আমার নাতি হবে তিনদিন পর। তয় আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। এই তিনটা দিন আমার বাড়িতে আপনের থাকতে অইব। টাকা-পয়সা যা  চাইবেন তাই দিমু। আর আমার বাড়িতে আপনের কোনো অযত্ন অইব না। আপনে হিন্দু মানুষ, আমার বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নাই। হিন্দু মাইয়ালোকও কাজ করে। আপনের রান্দন-বাড়ন তারা কইরা দিব। আপনে খালি বলবেন কী খাইতে চান।’

ঠাকুর হাসিমুখে বললেন, ‘মীর্জা সাহেব, আমি টাকা-পয়সার চিন্তা কইরা রোগী দেখতে আসি না। বহু রোগীর বাড়ি যাই, তারা নিতান্তই গরিব মানুষ। একটা পয়সাও দিতে পারে না। আমি তাগো মাগনা অষুধ দিয়া আসি। পথ্য কিনার পয়সাও দেই। আপনে বলছেন, আপনের মতো মানুষের কথা আমি ফেলুম না। তিনদিন থাকুম আপনের বাড়িতে। আর খাওনদাওনের কথাটা যে কইলেন, ওইসব আমার নাই। আমার কাছে ধর্ম থেইকা মানুষ অনেক বড়। আপনের বাড়িতে যা রান্না হইব তাই আমি খাইতে পারুম। তয় ফল আর দুধ আমি বেশি খাই। এই দুটা জিনিস থাকলেই হইব। সকাল-বিকাল দুই বেলা ঘন দুধের চা খাই। এছাড়া আর কোনো চাহিদা নাই আমার। শুক্কুরবার দুপুরের পর আপনেরে নাতির মুখ দেখাইয়া তার বাদে আমি যামু।’

সেই সন্ধ্যায় কিরণের মুখোমুখি হয়েছিলেন ঠাকুর। তাঁকে থাকতে দেওয়া হয়েছে আতিক মীর্জা যে দালানে থাকে সে দালানের পুবদিককার বড় কামরায়। সুন্দর পালঙ্ক, বনেদি আলমারি, আরাম কেদারা, পড়া বা খাবারের জন্য একপাশে একটা টেবিল, সঙ্গে একটা চেয়ার। ঘরের জানালাগুলো বড় বড়। পালঙ্কের বিছানাটা খুবই পুরু আর আরামদায়ক। পালঙ্কের স্ট্যান্ডে দামি মশারি পরিপাটি করে রাখা। খানিক আগে ঠাকুরকে এক কাপ দুধ চা দিয়ে গেছে অল্পবয়সী একটি কাজের ছেলে। চা অতি সুস্বাদু হয়েছে। ঠাকুর আয়েশ করে চায়ে গোটা-দুই চুমুক দিয়েছেন। দরজার সামনে এসে দাঁড়াল সেই মেয়ে। কিরণ। ‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম ডাক্তারবাবু। আপনি কী করে বললেন তিনদিন পর, শুক্রবার দুপুরের পর ভাবির বাচ্চা হবে এবং বাচ্চাটি হবে ছেলে বাচ্চা। এভাবে রোগী দেখে কোনো ডাক্তার কি বলতে পারেন তিনদিন পর ছেলে বাচ্চা হবে?’

এ-বাড়িতে ঢুকেই কিরণের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন ঠাকুর। এখন তার কথা শুনেও মুগ্ধ হলেন। এই মেয়ে তো বিক্রমপুরের ভাষায় কথাই বলে না, কথা বলে বইয়ের ভাষায়। বিশুদ্ধ বাংলায়। ঠাকুরও তার সঙ্গে সে-ভাষায় কথা বলতে লাগলেন। ‘অন্য ডাক্তাররা পারেন কি না তা আমি জানি না। আমি পারি। কীভাবে পারি সেটা তোমাকে বলব না, তবে তুমি দেখবে আমি যা বলেছি ঠিক তাই হবে। তোমার ভাইয়ের ছেলেটির নামও তুমি ভেবে রাখতে পারো।’

ঠাকুরের কথা শুনে কিরণের চোখে আনন্দের এক ঝিলিক খেলে গেল। ‘বাহ, আপনি তো খুব সুন্দর ভাষায় কথা বলেন! এরকম ভাষায় কথা বলা মানুষ আমার খুব পছন্দ। কিন্তু আপনি যখন ভাবির ঘরে বসে কথা বলছিলেন, তখন আমি দরজার বাইরে ছিলাম। সেখান থেকে আপনার কথাগুলো শুনতে পেয়েছি। তখন তো আপনি কথা বললেন বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষায়। তারপরেই আবার ভাষাটা বদলে ফেললেন কেমন করে?’

ঠাকুর হাসলেন, ‘তুমি আমাকে প্রভাবিত করেছ। তোমার ভাষা শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তোমার মতো করে কথা বলতে শুরু করেছি।’

কিরণ খেয়াল করল ঠাকুরের হাসি খুব সুন্দর। আজকের আগে কোনো পুরুষ মানুষের এত সুন্দর হাসি সে দেখেনি। সে অতিসুন্দরী এক মেয়ে। ক্লাস নাইনে পড়ে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে আসা-যাওয়া করে। বহু যুবক পুরুষের চাহনি আর হাসি সে নারীর সহজাত স্বভাব থেকে লক্ষ করে। এই প্রথম সে একজন মানুষের হাসি আর তাকানো লক্ষ করল। হাসি সুন্দর, চোখের দৃষ্টিতে গভীর মুগ্ধতা আছে। মানুষটা দেখতেও বেশ। অত্যন্ত সুপুরুষ। বয়স বোঝাই যায় না।

ঠাকুর তখন কিরণের দু-হাত ভর্তি কাচের চুড়িগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন। ব্যাপারটা খেয়াল করে কিরণ বলল, ‘আমি কাচের চুড়ি খুব পছন্দ করি। হাত নাড়াচাড়ার সময় চুড়ির শব্দ আমার খুব ভালো লাগে।’

ঠাকুর ভারী গলায় চমৎকার উচ্চারণে বললেন, ‘টুং টাং টুং টাং চুড়ির তালে থৈ থৈ বন্যা নাচে রে, রিমঝিম রিমঝিম বরষাতে জলতরঙ্গ বাজে রে।’

শুনে শিশুর মতো লাফ দিয়ে উঠল কিরণ। ‘আরে, এই গানটা তো আমি আকাশবাণী কলকাতায় শুনেছি। মৃণাল চক্রবর্তীর গান। আপনি এত সুন্দর করে বললেন, খুব ভালো লাগল। আপনার কণ্ঠস্বর খুব সুন্দর। আরেক কাপ চা খাবেন?’

ঠাকুর হাসলেন। ‘তোমার নামটা আমার জানা হয়নি।’

‘ডাকনাম কিরণ। ভালো নাম সাদিয়া মীর্জা।’

‘কিরণ মানে আলো। আলো মানে সোনার বর্ণ। তুমি হচ্ছ সোনার বরণী মেয়ে। তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা গান আছে …’

কিরণ উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘আমি জানি। কাজল নদীর জলে, ভরা ঢেউ ছলছলে, প্রদীপ ভাসাও কারে স্মরিয়া, সোনার বরণী মেয়ে, বলো কার পথ চেয়ে আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া।’

ঠাকুরের মুগ্ধতা ক্রমশ বাড়ছিল। কিরণ তো সবকিছু মিলিয়ে অসাধারণ! মীর্জা পরিবারের মতো ব্যবসায়ী পরিবারে এরকম মেয়ে জন্মেছে! তিনি মুগ্ধ গলায় বললেন, ‘সোনার আরেক নাম কাঞ্চন। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গান আছে – ‘জল ভরো কাঞ্চনকন্যা, জলে দিয়া মন …’। তুমি হচ্ছো কাঞ্চনকন্যা। সোনার বরণী মেয়ে।’

রাতের বেলা ঠাকুরের ঘরে এলো আতিক মীর্জা। খুবই বিনীত কণ্ঠে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, বকুল বড় কষ্ট পাইতাছে। কিছু একটা করা যায়?’

ঠাকুর তখনো শুয়ে পড়েননি। আরাম কেদারায় বসে চিন্তামগ্ন হয়ে ছিলেন। তাঁর চোখ জুড়ে শুধু কিরণের মুখখানি। কিরণের সৌন্দর্য। কিরণের কথার রেশ রয়ে গেছে দু-কান ভরে। যেমন সুন্দর মেয়ে কিরণ; তেমন সুন্দর তার কথা, তেমন সুন্দর তার গানের রুচি। চোখ থেকে মন থেকে মেয়েটিকে তিনি সরাতেই পারছেন না।

আতিকের কথা শুনে ঠাকুর উঠলেন। বকুল আতিকের কামরায় এসে দেখেন মীর্জা গিন্নি, গ্রামের সেই ধাত্রী আর কিরণ আছে কামরায়। বকুল ব্যথায় গোঙাচ্ছে। কামরায় দুটি দামি লণ্ঠন জ্বলছে।

আতিকের সঙ্গে ঠাকুর এসে ঢুকলেন। ঢুকে প্রথমে তাঁর কিরণের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। ঠাকুরকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিলো আতিক। ঠাকুর ইশারা করলেন চেয়ারটা বকুলের মুখের পাশ বরাবর রাখার জন্য।

তাই করা হলো। ঠাকুর সেই চেয়ারে বসে বকুলের মুখের দিকে তাকালেন। ফর্সা সুন্দর মেয়েটির মুখ প্রসববেদনায় কালো হয়ে গেছে। কিরণের সঙ্গে যে-ভাষায় কথা বলেছিলেন ঠাকুর, সেই ভাষায় বকুলকে বললেন, ‘আমার কথাগুলো তুমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে বকুল। একই সময়ে আল্লাহ ভগবান বা ঈশ্বর সর্বত্র থাকতে পারেন না বলে তিনি মা সৃষ্টি করেছেন। এটা একটা প্রাচীন প্রবাদ। তার অর্থটা তুমি ভাববে। তুমি লেখাপড়া জানা মেয়ে। মায়ের চেয়ে আপন এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। মায়ের চেয়ে বড় সম্পদ এই পৃথিবীতে আর কিছু নেই। তোমার নারীজন্ম সার্থক যে তুমি মা হতে চলেছ। তুমি তোমার গর্ভের সন্তানের জন্য শুধু আজই কষ্ট করছ না, গর্ভধারণ করার পর থেকেই করছ! আজ নয় মাস কষ্টটা তুমি করে চলেছ। সন্তান জন্মের পর তার মুখ দেখে সেই কষ্ট তুমি ভুলে যাবে। বাকি জীবন সন্তানদের জন্য কষ্ট করেই যাবে। সেই কষ্টের চেয়ে বড় আনন্দের কিছু আর কোনো নারীর জীবনে নেই। শারীরিক ব্যথা নিয়ে তুমি এখন ভেবো না। তুমি ভাবো, শুক্রবার দুপুরের পর তোমার ঘর আলো করে আসবে এক রাজপুত্র। তার সৌন্দর্যের আলোয় ভরে যাবে তোমাদের বাড়ি। কিরণের মতো সৌন্দর্য পাবে তোমার ছেলে। তার চেয়ে সুপুরুষ মীর্জা পরিবারে আর কেউ জন্মাবে না। তুমি তোমার সেই রাজপুত্রের কথা ভাবো। আমি তোমার মাথায় তিনবার হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, ব্যথা কমে যাবে। রাতে তোমার ঘুমও হবে।’

ডান হাত অতি মমতায় বকুলের মাথায় তিনবার বুলিয়ে দিলেন ঠাকুর। ঘরে সবাই স্তব্ধ হয়ে আছে। কিরণ মুগ্ধচোখে তাকিয়ে আছে ঠাকুরের দিকে।

হাত বুলানো শেষ করে বকুলকে ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন কি তুমি ব্যথা অনুভব করছ?’

বকুল আস্তে করে বলল, ‘না। একটুও ব্যথা নাই।’

‘এবার তাহলে তুমি ঘুমাও।’

নিজের কামরায় আসার আগে ঠাকুর একপলক কিরণের দিকে তাকালেন। কিরণের চোখে অদ্ভুত এক মুগ্ধতা দেখলেন।

পরদিন বিকেলে মীর্জা বাড়ির সামনের দিকটায় বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন ঠাকুর। পুকুরঘাটে গিয়ে বসলেন। গোধূলিবেলায় ফিরে এলেন কামরায়। এখন তাঁর চা পানের সময়। তিনি সামনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখেন তাঁর কামরা বরাবর দোতলা দালানের রেলিংয়ে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিরণ। তার চোখ দিনশেষের মনোরম আলোয় ভরা আকাশের দিকে। আর তার ঘরে গ্রামোফোনে বাজছে গীতা দত্তের গান, ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়, এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু …।’ এই গান শুনে ঠাকুরের মন উতলা হলো। তিনি বুঝে গেলেন কিরণের অবস্থাও তাঁর মতোই।

খানিক পর কিরণই তাঁর চা নিয়ে এলো। সঙ্গে বিদেশি দামি বিস্কুট। টেবিলে চায়ের কাপ আর বিস্কুটের তস্তরি নামিয়ে রেখে বলল, ‘চা আমি বানিয়েছি। কেমন হয়েছে বলতে পারব না। তবে বাবা আমার চা খুব পছন্দ করেন।’

ঠাকুর প্রথমে একটা বিস্কুটে কামড় দিলেন, তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে মুগ্ধচোখে কিরণের দিকে তাকালেন। ‘অপূর্ব চা। অপূর্ব। এত ভালো চা আজকের আগে খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। তুমি অসাধারণ এক গুণী মেয়ে। অতিসুন্দরী মেয়েরা সাধারণত কম বুদ্ধির হয়। মেধা তাদের তেমন থাকে না। সব সময় নিজের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে থাকে। তুমি একেবারেই তেমন নও। পড়াশোনা করো, উচ্চ রুচির গান শোন। এরকম একেবারেই দেখা যায় না। ডাক্তারির কাজে বিক্রমপুরের বহু গ্রামে আমি গিয়েছি, বহু বাড়িতে গিয়েছি, বহু মেয়ে দেখেছি, তোমার মতো দেখিনি কাউকে।’

কিরণ বলল, ‘এত প্রশংসা করবেন না। আমি সহ্য করতে পারছি না। তবে আপনার মতো মানুষও আমি কোনোদিন দেখিনি। কাল রাতে এত সুন্দর করে মাতৃত্ব নিয়ে কথা বললেন ভাবির সঙ্গে, এত মূল্যবান সুন্দর কথা আমি কোনোদিন কারো মুখে শুনিনি। বইতে পড়েছি। বলতে শুনিনি কাউকেই। তারপর চোখের সামনে দেখলাম ভাবির মাথায় আপনি তিনবার হাত বুলিয়ে দিলেন আর তার ব্যথা কমে গেল। এরকম দৃশ্য দেখা তো দূরের কথা, শুনিওনি কোনোদিন। প্রসববেদনা কি এভাবে কমানো যায়? কিন্তু আপনি সত্যি সত্যি কমিয়ে দিলেন। ভাবি খুব ভালো ঘুমিয়েছে রাতে। এখনো তার ব্যথা নেই। বাড়ির সবাই শুধু আপনাকে নিয়েই আলোচনা করছে। এমন ডাক্তার নাকি হয় না।’

ঠাকুর বললেন, ‘সেই ডাক্তারই ভালো ডাক্তার, যিনি কথা বলে অর্ধেক রোগ ভালো করে দেন। স্নেহের হাত মাথায় বুলিয়ে রোগীর দুর্ভোগ দূর করে দেন। ওষুধ-পথ্য পরের ব্যাপার। আগে এই কাজগুলো করতে হয়। আমি ওটুকুই করেছি।’

ঠাকুরের কথামতো শুক্রবার দুপুরের পর অপূর্ব এক শিশু জন্মালো মীর্জা পরিবারে। সত্যি সত্যি সদ্যোজাত শিশুটির আলোয় পুরো বাড়ি যেন আলোকিত হলো। শিশুটির মাথাভর্তি চুল। নাক মুখ চোখ অপূর্ব। তার কান্নার শব্দে মুখরিত হলো মীর্জা বাড়ি। আনন্দে ফেটে পড়ল বাড়ির প্রতিটি মানুষ। ঠাকুরের এখন বিদায় নেওয়ার পালা। বদরু নৌকা নিয়ে তৈরি হয়ে আছে। এই তিনদিনে নিশ্চয়ই অনেক রোগী এসে ঘুরে গেছে ঠাকুরবাড়িতে বা অনেক বাড়ি থেকে লোক এসেছে ঠাকুরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কে মরেছে কে বেঁচেছে ভগবান জানেন।

বকুল-আতিকের শিশুটির ঘুমন্ত গালে মায়াবী ডান হাতখানি একবার ছোঁয়ালেন ঠাকুর। তারপর কামরা থেকে বেরিয়ে এলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন হোসেন মীর্জা। তাঁর মুঠোভর্তি টাকা। বিনীতভাবে ঠাকুরকে বললেন, ‘আপনার লেইগা তেমন কিছু করতে পারি নাই আমরা। এই টাকাটা রাখেন।’

টাকাটা তিনি ঠাকুরের হাতে গুঁজে দিতে গেলেন। ঠাকুর হাসিমুখে বললেন, ‘টাকা আমি নেব না মীর্জা সাহেব। যে আদর-যত্ন আপনারা আমাকে করেছেন, আমি তাতে খুব খুশি। তাছাড়া আমার ওপর আপনারা পুরোপুরি আস্থা রেখেছেন। এসবের মূল্য টাকা দিয়ে হয় না।’

হোসেন মীর্জা বললেন, ‘আপনে খালি ডাক্তার না, আপনি সাধু-সন্ন্যাসীর মতো মানুষ ডাক্তারবাবু। বউর বেদনা সারাইয়া দিলেন। বাচ্চা হওনের যে টাইম দিয়েছিলেন, ঠিক সেই টাইমে বাচ্চা হইল, এমন কোনোদিন দেখি নাই, শুনিও নাই। টাকাটা আপনে রাখেন। দরকার হইলে আরো দেই।’

ঠাকুর আবার হাসলেন। ‘এই নিয়ে আপনি আর ভাববেন না। টাকা আমি নেব না।’

ঠাকুর নৌকা-বাঁধা ঘাটের দিকে হাঁটতে লাগলেন। বকুলতলার ওখানটায় এসে দেখেন কিরণ দাঁড়িয়ে আছে। মুখে অদ্ভুত এক দুঃখের ছায়া। ঠাকুরকে দেখেই তাঁর কাছে এগিয়ে এলো। অনুচ্চ স্বরে শুধু একটি কথাই বলল, ‘আপনি হিন্দু হয়েছেন কেন?’

প্রশ্নটা করেই সে দৌড়ে অন্দরমহলের দিকে চলে গেল। ঠাকুর স্পষ্ট দেখলেন কিরণ কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নৌকায় চড়লেন। [চলবে]