কিশোরদের জন্য সুন্দর বই

নওশাদ জামিল

 

কিশোর মালঞ্চ

সম্পাদনা : হায়াৎ মামুদ

 

বেঙ্গল পাবলিকেশন্স

ঢাকা, ২০১৪

 

৯০০ টাকা

 

 

একদিন অদ্ভুত একটা চিঠি পেলেন জনপ্রিয় কবি ও কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। খামের ওপরে প্রেরকের         নাম-ঠিকানা নেই। খাম খুলে তিনি দেখলেন, চিঠিতেও নাম-ধাম নেই। সাদা পৃষ্ঠায় গুটি গুটি অক্ষরের এক লাইনের চিঠি। তাতে লেখা, ‘সবকিছু বাদ দিয়ে আপনি শুধু ছোটদের জন্য লিখতে পারেন না!’

বছর পাঁচ আগে ঢাকা ক্লাবে এ-চিঠির গল্প শুনেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখে। বলা বাহুল্য, চিঠিটা লিখেছিল তাঁরই রচনায় মুগ্ধ এক খুদে পাঠক। চিঠির প্রসঙ্গ টেনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘ছোটদের জন্য লেখা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। ছোটদের জন্য সময় নিয়ে লিখতে হয়। তাদের ঠকানো যায় না, সেটা উচিতও নয়। তাদের বুঝতে হয়, তাদের বিচিত্র মনের খোঁজ রাখতে হয়। অনেক লেখকই সেটা করতে ব্যর্থ হন বলে তাঁদের লেখা থেকে শিশু-কিশোররা মুখ ফিরিয়ে নেয়।’

কিশোরদের জন্য স্বর্গতুল্য বই কিশোর মালঞ্চ হাতে নিয়ে, সুবিশাল এ-সংকলনটির রচনা পড়তে-পড়তে মনে পড়ে গেল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠির গল্প। ছোটদের লেখালেখি প্রসঙ্গে তাঁর কথাগুলো অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ এবং যথার্থ। কেননা শিশু-কিশোরদের মন বড় বিচিত্র্য এবং কৌতূহলোদ্দীপক। তাদের বিচিত্রমনের খোঁজ অনেক লেখক রাখতে পারেন না, অনুভব করতে পারেন না; এ কারণে তাঁদের রচনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় শিশু-কিশোররা। অবশ্য একদম ছোটদের কথা আলাদা। কেননা অভিভাবকদের পছন্দমতো বই পড়ে তারা। তারপর গায়ে-গতরে খানিক বড় হয়ে, কিশোর বয়সে পৌঁছে বদলে যায় তাদের পাঠপ্রতিমা। তখন থেকেই তারা নিজেদের পছন্দমতো পড়তে চায় বিচিত্র ও মজাদার নানা বই।

বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ লেখক কলম ধরেছেন শিশু-কিশোরদের জন্য। তাদের জন্য লিখেছেন নানা স্বাদের গল্প-উপন্যাস, কবিতা-ছড়াসহ নানা রচনা। কবিতা-ছড়া এবং উপন্যাসের কথা থাক, এখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে কত কিশোর গল্প লেখা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা সহজ নয়। সেসব রচনা থেকে যদি শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো বাছাই করা যায়, যদি তা কিশোরদের হাতে তুলে দেওয়া যায়; দৃঢ়তার সঙ্গে বলব, নিঃসন্দেহে কাজটি হবে চমৎকার। কিন্তু কে করবেন এ-চমৎকার কাজ? কে নির্বাচন করবেন কিশোরদের জন্য লেখা সেরা গল্পগুলো? কিশোর মালঞ্চ পাঠশেষে বলব যে, যিনি কাজটি করেছেন, তাঁর চেয়ে সুযোগ্য মানুষ বিরল। বাংলা সাহিত্যের অসংখ্য কিশোর রচনার থেকে সেরা গল্পগুলো যিনি সুচিন্তিতভাবে নির্বাচন করেছেন, গুরুত্বপূর্ণ এ-দায়িত্বটি পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে, অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে – তিনি বিশিষ্ট লেখক ও সাহিত্যিক হায়াৎ মামুদ। কিশোরদের সেরা গল্প নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত ও সুসম্পাদিত এ-সংকলনটিরই নাম কিশোর মালঞ্চ।

কিশোর ও তরুণদের জন্য বলা যায় বইটি স্বর্গতুল্য। কিশোরদের জন্য লেখা  বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো নিয়ে এ-সুদৃশ্য সংকলন। ঝকঝকে ছাপা ও নান্দনিক অলংকরণসহ বইটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স লিমিটেড। এতে স্বর্ণকুমারী-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের লেখকদের গল্পও স্থান পেয়েছে। ৬১৬ পৃষ্ঠার এ-বইটিতে পত্রস্থ হয়েছে ১০১ জন লেখকের ১০৭টি মজাদার এবং চমকপ্রদ গল্প।

দুই

বইটির সম্পাদক হায়াৎ মামুদ শুধু আলোকিত জ্ঞানতাপস নন, একাধারে অগ্রগণ্য সাহিত্যিক, কবি, প্রাবন্ধিক এবং অনুবাদক। ভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ হিসেবেও তাঁর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।শিশু-কিশোরদের জন্য তাঁর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অনেক রচনা। সৃজনশীল রচনা ছাড়াও রুশ সাহিত্যের বহু ধ্রুপদী কিশোর রচনার অনুবাদকও তিনি। অতএব তাঁরই তো শোভা পায় এমন গ্রন্থ সম্পাদনার।

কিশোর ও তরুণদের কথা মনে রেখে বাংলাদেশে এর আগে এমন গুণমানে অনন্য বই আর প্রকাশিত হয়নি। আগামী দিনের প্রকৃত পাঠকের কথা ভেবে, তাদের কিশোরমনের খোরাক জোগাতে এগিয়ে এসেছেন কালি ও কলম সম্পাদক বিশিষ্ট সাহিত্যিক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক আবুল হাসনাত। বস্ত্তত, তাঁর কার্যকরী উদ্যোগেই এ-বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে কিশোর মালঞ্চ। অতএব বলা যায়, হায়াৎ মামুদ এবং আবুল হাসনাতের মনন, রুচি, চেতনাবোধ ও সাহিত্যবোধের সমবায়ে সৃজিত এ-বই।

বইটির ভূমিকা-কথনে হায়াৎ মামুদ লিখেছেন, ‘এমন সংকলন কিশোর ও তরুণ বয়সীদের কথা মনে রেখে বাংলাদেশ থেকে সম্ভবত আগে প্রকাশিত হয়নি। এখনো প্রকাশ করা অসম্ভব ছিল যদি-না বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ও তার মধ্যমণি কালি ও কলম-এর সম্পাদক আবুল হাসনাত উদ্যোগ গ্রহণ করতেন।’

বইটির সঙ্গে জড়িছেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীও। বইটির নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করে গেছেন  তিনি। প্রতিটি গল্পের সঙ্গে রয়েছে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর ড্রয়িং, এক কথায় তা শিল্পগুণে অসামান্য; তাতে বইটির গুরুত্ব যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনই বেড়েছে সৌন্দর্য।

সূচনাপর্বেই উল্লেখ করেছি, সুবিশাল এ-সংকলনে স্থান পেয়েছে স্বর্ণকুমারী-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের লেখকদেরও গল্প। গল্পগুলো নির্বাচন করতে গিয়ে হায়াৎ মামুদ শুধু কিশোর সাহিত্যের বৈচিত্র্যময় রচনারই সন্ধান দেননি, উপস্থাপন করেছেন কিশোরদের জন্য দিগন্তবিস্তারী মহাপৃথিবীর। নির্বাচিত একশ এক জন লেখকের মধ্যে একাধিক গল্প রয়েছে শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। রবীন্দ্রনাথের কিশোর গল্প স্থান পেয়েছে পাঁচটি, শরৎচন্দ্রের তিনটি গল্প। বাকি নিরানববইটি গল্প নিরানববই জন লেখকের। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের গল্প বেশি রাখার যুক্তিযুক্ত কারণ প্রকাশ করে হায়াৎ মামুদ লিখেছেন, ‘নির্বাচিত ১০১ জন লেখকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের রচনাসংখ্যা সর্বাধিক হওয়ার কারণ তাঁদের সাফল্য ও জনপ্রিয়তা। বর্তমানে কম পঠিত ও কম পরিচিত সাহিত্যিকও আমরা সংকলনে স্থান দিয়েছি এমন বিবেচনায় যে, এর ফলে বাংলা ছোটগল্পের উদ্ভব-বিকাশের ধারাটি ও কিশোরদের জন্য রচিত গল্পের ভুবনটি পাঠকের প্রত্যক্ষগোচর হয়ে উঠবে।’

বইটির ১০৭টি গল্পের নির্বাচন-প্রক্রিয়া থেকে লক্ষণীয় যে, ছোটগল্পের ধারাক্রমও এতে বিদ্যমান। প্রথমেই রয়েছে স্বর্ণকুমারী দেবীর গল্প আর সর্বশেষ গল্পটি প্রতিভাবান কথাসাহিত্যিক প্রশান্ত মৃধার। মাঝখানে সেতুবন্ধ তৈরি করেছেন নিরানববই জন লেখক এবং তাঁদের রচনা। হয়তো এ-জন্যও বইটি হয়ে উঠেছে কিশোর ছোটগল্পের একটি অ্যাকাডেমিক কালক্রম। হায়াৎ মামুদ তাঁর ভূমিকায় এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, ‘স্বর্ণকুমারী-রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত বিবেচনায় আনলে শতাধিক বৎসরের একটি ছবি চালচিত্রে দৃশ্যমান দেখি। বাংলা ছোটগল্পের সামগ্রিক রূপরেখাও আমাদের সম্মুখে উন্মোচিত হয়। অদ্ভুত রস, করুণ রস, বীর রস, হাস্যরস ইত্যাদি অলংকার শাস্ত্রের নবরসের মোটামুটি প্রায় সবই আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। এমনটি বীভৎস রস, সংখ্যায় নগণ্য হলেও, চোখে পড়ে। বয়স্কপাঠ্য গল্পের ন্যায় কিশোরপাঠ্য কাহিনিও সংখ্যায় অপ্রতুল নয়। বর্তমান কিশোর মালঞ্চ গল্প-সংকলনটি তা প্রমাণ করবে।’

সংকলনটি প্রকাশের পরপরই, গল্প নির্বাচন নিয়ে কেউ কেউ খানিক বিতর্ক উস্কে দিয়েছিলেন – হায়াৎ মামুদ          প্রাক-কথনেই তাতে জল ঢেলে দিয়েছেন। ভূমিকা-কথনে তাঁর নির্বাচন-প্রক্রিয়া সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন যে,  ‘যে-কোনো রচনাসংকলন নিয়ে পাঠকের মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে – এই রচনা বাদ দিয়ে ঐটি নয় কেন?’ বা এই ধরনের জিজ্ঞাসা। উত্তরে কেবল এটুকুই বলা সম্ভব : ‘সংকলক-সম্পাদকের যেহেতু সাধ্য নেই সবার দাবি মেটানো, তাই নিজস্ব রুচি ও প্রবণতার চাহিদা মেনে নেওয়াটাই তাঁর জন্য স্বস্তিকর ও শান্তিদায়ক।’

 

তিন

বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ লেখকই শিশু-কিশোর সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন, তাঁদের অনেকেই দায়বোধ থেকে এ-কাজটি করেছেন। অন্যদিকে সারাজীবন শিশু-কিশোরদের জন্যই লিখেছেন এমন লেখকের দৃষ্টান্তও কঠিন নয়। তাঁদের প্রত্যেকেই সফল হয়েছেন এ-কথা বলা সহজ নয়। কেননা শিশুদের মনস্তত্ত্ব এক ধরনের আবার কিশোরদের মন অন্য ধরনের। বয়স অনুসারে তাদের মন উপযোগী সাহিত্য তাই খুব বেশি নেই। বাংলা সাহিত্যে কিশোর গল্পে সার্থক ও শতভাগ সফল লেখক হিসেবে যাঁর নাম প্রথমেই আসবে – তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর ‘কাবুলিওয়ালা’ শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্বসাহিত্যেও সেরা কিশোর গল্প হিসেবে বহুল পঠিত। ‘কাবুলিওয়ালা’ ছাড়াও এ-সংকলনে স্থান পেয়েছে আরো চারটি গল্প। সেগুলো হলো – ‘মুকুট’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘ খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ ও ‘একরাত্রি’। প্রতিটি গল্পই মজাদার এবং শিক্ষণীয়। কিন্তু তাতে শিক্ষার ব্যাপারটি যত সরব, তার চেয়ে বেশি মুখর শিল্পগুণ। ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটির কথাই বলা যাক, তাতে শুধু কিশোরী মিনার অন্তর্জগৎ উন্মোচিত হয়নি, উঠে এসেছে পিতা-কন্যার অকৃত্রিম মমত্ববোধ, প্রকাশিত হয়েছে চাপাত্রস্থ এক বেদনাঘন আলেখ্য।

শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, হায়াৎ মামুদ সন্ধান দিয়েছেন কম পরিচিত লেখকদেরও সেরা গল্পটির। সীতা দেবী, সাজেদুল করিম, হেলেনা খান, গোলাম রহমান, কানাই কুন্ডু, আলমগীর সাত্তারসহ বেশ কয়েকজন কম পরিচিত লেখকের লেখাও স্থান পেয়েছে। তাঁদের পরিচিতি কম হলেও রচনা কিন্তু সাদামাটা নয়, বরং গুণেমানে অতুলনীয়। সংকলনে স্থান পাওয়া প্রতিটি গল্পই অসাধারণ, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ গুরুত্বপূর্ণ; কোনো গল্প  হাস্যরসে ভরপুর, কোনো গল্প আছে শিহরণ-জাগানিয়া রোমান্স; কোনো গল্পে আছে দেশপ্রেম, মানবিকতাবোধ, অন্যদিকে কোনো কোনো গল্পে আছে বিজ্ঞানের কল্পকাহিনিসহ নানা বিষয়। ফলে বিষয় ও স্বাদ ভিন্নতায় প্রতিটি গল্পই হয়ে উঠেছে কিশোরদের জন্য আনন্দদায়ক মানস-জার্নি।

সংকলনটির সূচিপত্রের দিকে তাকানো যাক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর থেকে পর্যায়ক্রমে যাঁদের গল্প স্থান পেয়েছে, তা সত্যিই বৈচিত্র্যময় এবং সমৃদ্ধ এক পাঠশালা। প্রমথ চৌধুরীর ‘আমার কথা’, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কানকাটা রাজার দেশ’, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘আদরিণী’, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’, ‘মামলার ফল’ ও ‘অভাগীর স্বর্গ’, পরশুরামের (রাজশেখর বসু) ‘কৃষ্ণকলি’, ‘সুকুমার রায়ের ‘দ্রিঘাংচু’, জগদীশ গুপ্তের ‘দিবসের শেষে’, ‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁইমাচা’, রমেশচন্দ্র সেনের ‘মৃত ও অমৃত’, ‘ইবরাহীম খাঁর ‘দুটি মানুষ’, জ্যোতির্ময় দেবীর ‘ব্যান্ডমাস্টারের মা’, সীতা দেবীর ‘পেটুক ভজু’, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের ‘অ-শরীরী’, ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘এ্যাও’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বনের পাপিয়া’, বনফুলের (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়) ‘অবর্তমান’, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘কে তুমি?’, যুবনাশ্বের (মনীশ ঘটক) ‘লুম্-কা’, জরাসন্ধের (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী) ‘হারানো, প্রাপ্তি, নিরুদ্দেশ’, শিবরাম চক্রবর্তীর ‘হাতেনাতে পাকড়ানো!’, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘মুহূর্ত’, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বাঁশি’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘হার্মাদ’, অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘না’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঈর্ষা’, সত্যেন সেনের ‘লাল গরুটা’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদপোড়া’, বুদ্ধদেব বসুর ‘আমরা তিনজন’, লীলা মজুমদারের ‘কাঠপুতলি’, আশাপূর্ণা দেবীর ‘অদ্ভুতুড়ে’, মোহাম্মদ নাসির আলীর ‘কুকুরছানার কারবার’, সুবোধ ঘোষের ‘ফসিল’, বিমল মিত্রের ‘সত্যমেব জয়তে’, সাজেদুল করিমের ‘উল্টো শার্লক হোমস’, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ছাতুবাবুর ছাতা’, শওকত ওসমানের ‘প্রাইজ’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘টোপ’, সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘ভাবী’, সোমেন চন্দের ‘ইঁদুর’, সত্যজিৎ রায়ের ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’, ননী ভৌমিকের ‘তিন পুরুষ’, হাবীবুর রহমানের ‘ঘুম তাড়ানোর গল্প’, আহমদ মীরের ‘ধোবিয়া তালাও’, মহাশ্বেতা দেবীর ‘তোতনের অ্যাডভেঞ্চার’, আতোয়ার রহমানের ‘একঠোঙা ভাত’, আনিস চৌধুরীর ‘ছবি-বিভ্রাট’, হেলেনা খানের ‘ভূতের খপ্পরে’, শহীদ সাবেরের ‘ক্ষুদে গোয়েন্দা অভিযান’, ‘সুচরিত চৌধুরীর ‘চুড়ি’, আব্দার রশীদের ‘ফুঁক মন্তর’, গোলাম রহমানের ‘গুণের আদর’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘সময়ের হৃদপিন্ড’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মায়ের স্বপ্ন’, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘লোহাগড়ার জঙ্গল’, তাসাদ্দুক হোসেনের ‘শয়তানের শাস্তি’, আবুবকর সিদ্দিকের ‘ছায়াপ্রধান অঘ্রান’, কাইয়ুম চৌধুরীর ‘তিমুর গল্প’, রাবেয়া খাতুনের ‘লোকটি মজার না ভয়ের’, কানাই কুন্ডুর ‘শ্মশানবন্ধু’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘বাবার সাথে যাওয়া’, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ‘ঘরে ফেরা’, শওকত আলীর ‘তিন পাহাড়ের হরিণ’, বশীর আল হেলালের ‘কান্ডারি’, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদের ‘বাবা’, বেলাল চৌধুরীর ‘গোগোদার সঙ্গে উলুউলু দেশে’, শাকের চৌধুরীর ‘শব্দহীন পায়ে’, রাহাত খানের ‘তাঁবুর জগৎ’, হাসান আজিজুল হকের ‘ফুটবল থেকে সাবধান’, হায়াৎ মামুদের ‘তুলু পুন্তি’, এখ্লাসউদ্দিন আহমদের ‘তুনুর গল্প’, নিয়ামত হোসেনের ‘চোর’, বুলবন ওসমানের ‘সৎভাই’, মাহমুদুল হকের ‘পদ্য লেখার জোরে’, মাহবুব তালুকদারের ‘স্বপ্ন’, শাহজাহান কিবরিয়ার ‘না’, রশীদ হায়দারের ‘রাজপুত্র’, বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘ভালুকের সঙ্গে শিকারির আলাপ’, আলমগীর সাত্তারের ‘আইয়ুব খানের কুমির শিকার’, ইমরুল চৌধুরীর ‘কুড়ানো টাকায় কুরুক্ষেত্র’, আবু কায়সারের ‘বারো বছর আগে’, মাহমুদ আল জামানের ‘রানুর দুঃখ, ভালোবাসা’, আখতার হুসেনের ‘দি টাইগার’, সেলিনা হোসেনের ‘কুড়কুড়ির মুক্তিযুদ্ধ’, হুমায়ূন আহমেদের ‘যাদুকর’, আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘বাবা ও টাইপরাইটার’, কাইজার চৌধুরীর ‘সোহরাবের কথা’, আলী ইমামের ‘লতাপাহাড়পুরের কাশু’, শাহরিয়ার কবিরের ‘একাত্তরের যিশু’, মুনতাসীর মামুনের ‘সোয়ালো পাখির গল্প’, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘জলপুরুষের প্রার্থনা’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘কপোট্রনিক ভবিষ্যৎ’, সৈয়দ ইকবালের ‘ডানাওয়ালা মানুষেরা’, আহমাদ মাযহারের ‘মাথায় যদি বুদ্ধি থাকে’, আমীরুল ইসলামের ‘রক্ত গোলাপ’, হুমায়ুন কবীর ঢালীর ‘শহর দেখতে গিয়ে’, জাকির তালুকদারের ‘মাতৃহন্তা’, ধ্রুব এষের ‘ওই লোকটা একদিন ঠিক করল’, মাসুদুল হকের ‘তেভাগা’ এবং প্রশান্ত মৃধার ‘লেবুপাতার বাস’ গল্প স্থান পেয়েছে বইটিতে।

ধারাবাহিকভাবে এসব গল্প পাঠ করলে বোঝা যায়, কিশোরদের গল্পের জগতটিও পাল্টে গেছে ধীরে ধীরে। কিশোদের এখন আর ভূত-প্রেতে ভয় নেই; বিজ্ঞানের নিত্যনতুন উদ্ভাবনের ফলে তাদের চিন্তার পৃথিবী যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনই তাদের কৌতূহলও বেড়েছে, বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি আকর্ষণও বেড়েছে। সমসাময়িক লেখকরা কিশোরদের ওই জগতটি অনুধাবন করতে পেরেছেন বলেই বলা যায়, কিশোর গল্পের প্রকরণ ও বিষয় পরিবর্তন হয়েছে। কিশোর গল্পে এসেছে নতুন শৈলী ও নিত্যনতুন বিষয়।

 

চার

বইটির গল্পগুলো পাঠশেষে বলা যায়, বইটিতে আছে কিশোরদের জন্য বৈচিত্র্যময় গল্প, তাতে উঠে এসেছে মানবিকতা, এসেছে দেশপ্রেমসহ মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার বন্ধনসহ নানা বিষয়। এসব গল্প পাঠের মধ্য দিয়ে যেমন তৈরি হবে কিশোরদের মানসভূমি, তেমনই দৃঢ় হবে তাদের মানবিক বোধ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মায়ের স্বপ্ন’ গল্পটির কথা বলা যাক, তাতে উঠে এসেছে চরম দারিদ্র্যপীড়িত এক পরিবারের আখ্যান। যেখানে দেখা যায় দুর্ভিক্ষের ফলে, একমুঠো ভাতের জন্য এক কিশোর তার মাকে ত্যাগ করে চলে যেতে চায় শহরে, আবার অন্য কিশোর সন্তান ঠিকই আগলে রাখে তার মাকে। গল্পে কালু হয়তো চলে যায়, কিন্তু অন্য সন্তান নিলু ঠিকই মায়ের পাশে দাঁড়ায় ভালোবাসা নিয়ে।

মায়ের দুঃখ যেমন সন্তানকে বুঝতে হবে, ঠিক তেমনই অনুভব করতে হবে পিতার মর্মযাতনা। সৈয়দ শামসুল হকের অসাধারণ গল্প ‘বাবার সঙ্গে যাওয়া’ তেমনই এক পিতা-পুত্রের মানবিক দলিল। অর্থকষ্টে বাবা যখন দূর-সম্পর্কের চাচার বাড়িতে যান টাকার জন্য, তখন পাশে থাকা কিশোর আনুও ওই যাতনা অনুভব করে। আনু বুঝতে পারে, টাকা দেয়নি চাচা। ফলে চাচার কাছে ‘প্রায় অপমানিত’ বাবার জন্য আনুর মনে তৈরি হয় অপরিমেয় ভালোবাসা।

পারিবারিক মমত্ববোধ শুধু নয়, দেশপ্রেম, মূল্যবোধ, শ্রদ্ধাবোধসহ যাবতীয় সুকুমার গুণাবলি যাতে কিশোরদের মনে ঠাঁই নেয়; সেসব গল্প রাখা হয়েছে এ-সংকলনে। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে আছে দুর্দান্ত কিছু গল্প, রাজনীতি-সমাজ নিয়ে চমৎকার লেখা, আছে ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরাণ নিয়ে গল্প, আছে দেশমাতৃকার জন্য আত্মদানের অনুপম রচনা। আলমগীর সাত্তারের রাজনৈতিক পটভূমিতে লেখা অসাধারণ ছোটগল্প ‘আইয়ুব খানের কুমির শিকার’। হাস্যরসের মধ্য দিয়ে গল্পটিতে যেমন তুলে ধরা হয়েছে আইয়ুব খানের চরিত্র, তেমনই উঠে এসেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি এ-অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ের টান। ঊনসত্তরের পটভূমিতে লেখা এ-গল্পে দেখা যায়, আইয়ুব খান কুমির শিকার করতে এবং বেড়াতে আসেন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবনে। কিন্তু একটা সময় আইয়ুব খান ঠিকই বুঝতে পারেন যে, জ্যান্ত কুমির নয়, তাঁর ভাগ্যে আছে মৃত কুমির শিকার। মোনায়েম খান যতই চাটুকারিতা করেন না কেন, তাঁর ছলচাতুরী ধরা পড়ে যায়। বোকাবনে যান আইয়ুব খান।

মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা কিছু প্রতি কিশোরদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তারে আছে মজাদার গল্প, আছে বেশকিছু ফ্যান্টাসি রচনা, আছে সায়েন্স ফিকশনসহ বিজ্ঞানের প্রতি কৌতূহল-জাগানো নানা রচনা। হুমায়ূন আহমেদের চমৎকার সায়েন্স ফিকশন ধাঁচের রচনা ‘যাদুকর’ গল্পটির কথা বলা যায়। গল্পে কাল্পনিক চরিত্রও বলে যে, বাবা তার সন্তানকে যতই শাসন করুন,  সন্তানের জন্য রয়েছে পিতার সমুদ্রসম উদার ভালোবাসা। ফলে পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রটিও বাবার ভয়ে হয়তো তটস্থ থাকে, কিন্তু ওই কিশোর ঠিক বুঝতে পারে যে, বাবা তাকে ভালোবাসে খুব।

 

পাঁচ

কিশোরদের জন্য নানা ধরনের বই প্রকাশিত হয় প্রতিবছরই। বইগুলোর বিচিত্র সব নাম, ঝকঝকে মলাট, ভেতরে আকর্ষণীয় অলংকরণ। বইয়ে অঙ্গসজ্জা মনোগ্রাহী হলেও কিশোরদের কী ধরনের বই পছন্দ, কী পড়তে ভালোবাসে – তা বোঝা সহজ নয়। এর কারণ বোধহয় কিশোরদের বিচিত্র মন ও মানস। কিশোরদের মানস-পৃথিবী অনুধাবন করে হায়াৎ মামুদ এ-সংকলনের জন্য গল্প নির্বাচন করেছেন। সেসব গল্প কিশোরদের মানস বিকাশের জন্য, তাদের মনের পুষ্টি জোগানোর জন্য হতে পারে অমূল্য সংগ্রহ।

বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক কিশোরের জন্য যত বই প্রকাশিত হয়, তা কিশোরদের পাঠক্ষুধা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। কিশোরদের জন্য দরকার আরো বিচিত্র ও আকর্ষণীয় এবং স্মার্ট রচনা। কেননা দেশের বিপুল পরিমাণ কিশোরের জন্য গুণেমানে অনন্য রচনার সংখ্য বেশি নয়। বলা যায় অপ্রতুল। কিশোরদের মনোজগতকে সমৃদ্ধ করে তুলতে এবং তাদের পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে এ-সংকলনটি যেমন ভূমিকা রাখবে, তেমনই কিশোরদের মনকেও করবে উদার ও মানবিকবোধ সম্পন্ন। বর্তমানে অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী খুব যান্ত্রিক হয়ে উঠছে, অনেক কিশোর স্কুল থেকে ফিরে ঘরবন্দি জীবন পার করছে, তাদের কল্পনার জগৎ হয়ে যাচ্ছে বর্ণহীন; তাদের জগতটা উজ্জ্বল করতে এই বই হতে পারে সহায়ক। সততা, নৈতিকতা আর আপসহীনতার বীজ কিশোর মনে বপন করতে হয়, বস্ত্তত এ কাজটি করতে পারে পাঠ্যাভ্যাস।

জীবনের মানস-বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় কৈশোর। এ-সময়টিই সবকিছু নতুন আলোক নিয়ে উপস্থিত হয়। তাই এ-পর্বটি অত্যন্ত কৌতূহলের। হায়াৎ মামুদ এ-বিষয়টি সামনে রেখে এসব গল্প নির্বাচন করেছেন কিশোরদের জন্য। এসব গল্প পাঠে কিশোরদের মন আলোকিত হবে, উদ্ভাসিত হবে; ভালোবাসতে শেখাবে জীবনকে, করে তুলবে সুন্দর ও আননদময়।