কৃষকের নাম মারে

ভাষান্তর : অংকুর সাহা

অনুবাদকের কথা

২০২১ সালে মহান লেখক ফিওদর দস্তয়েভস্কির জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী। তাঁর অন্তিম জীবনের একটি অপ্রচলিত ছোটগল্পের বাংলা অনুবাদের মাধ্যমে লেখকের প্রতি এই আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।

গল্পটি আত্মজৈবনিক; এতে লেখকের সাইবেরিয়ার ওমস্ক কারাগারে বন্দিজীবনের বর্ণনা রয়েছে যেমন, তেমনি রয়েছে ফ্ল্যাশব্যাকে তাঁর অল্পবয়সে গ্রামে বাবার খামারবাড়িতে সময় কাটানোর স্মৃতি। কৃষক মারের ঘটনাটি ঘটেছিল খুব সম্ভবত ১৮৩১ সালে, যখন লেখকের পিতা রাশিয়ার টুলা প্রদেশে জমিজমা কিনে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তার অল্প কিছুদিন পরে। জেলখানার ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮৫০ সালের পবিত্র ইস্টারের সময় (২৪ এপ্রিল) এবং ১৮৬১ সালে প্রকাশিত মৃতদের গৃহ নামক বিখ্যাত উপন্যাসে তার বিশদ বর্ণনা রয়েছে। ১৮৫৪ সালে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল এক লেখকের ডায়েরি মাসিকপত্রের ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৬ সংখ্যায়। পত্রিকাটি দস্তয়েভস্কি নিজেই প্রকাশ করতেন ১৮৭৬ থেকে ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত। গল্পটি লেখার অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন অগ্রজ লেখক কনস্তান্তিন আকসাকভের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ থেকে। সে- প্রবন্ধে আকসাকভ জানিয়েছিলেন যে, রাশিয়ার সাধারণ কৃষক নিরক্ষর হলেও তারা সভ্য, উদার ও সংস্কৃতিমনা এবং এক অদৃশ্য বন্ধনে তারা রাশিয়ার সেরা লেখকদের সঙ্গে যুক্ত। অগ্রজ লেখকের সেই যুক্তিকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে দস্তয়েভস্কি এই কৃশকায় গল্পটি লিখেছিলেন।

গুড ফ্রাইডের পরের সোমবার সেটা। বাতাসে উষ্ণতা, আকাশ নীল, সূর্য মধ্যগগনে, অনতিতপ্ত উজ্জ্বল দিন, কিন্তু আমার মনের ভেতর অন্ধকার। কয়েদিদের ব্যারাকের পেছনে জেলখানার চত্বরে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াই আমি, তাকিয়ে থাকি কারাগারের শক্তপোক্ত বেষ্টনীর দিকে – এক, দুই করে গুনে যাই তার প্রতিটি খুঁটি, তবে সেটা একেবারেই অভ্যাসের বশে, খুঁটির সঠিক সংখ্যা জানতে আগ্রহ নেই আমার। জেলখানায় আজ ছুটির দ্বিতীয় দিন। কালকের মতন আজকেও আমাদের বেগার খাটতে নিয়ে যাওয়া হয়নি, কয়েদিদের বেশিরভাগই মাতাল, অশ্রাব্য গালাগাল দিয়ে যায়, আর জেলখানায় আনাচে-কানাচেই মারামারি বেধে যায় কয়েক মিনিট অন্তর অন্তর। অশ্লীল, বিরক্তিকর সব খেউড় গান তাদের; বাঙ্কের নিচে বসে তাস পিটছে কয়েকটা দল; যেসব কয়েদি হইহল্লা বাধিয়েছিল, তাদের সাঙাতরাই উত্তম-মাধ্যম দিয়েছে তাদের, এখন তারা আধমরা অবস্থায় বাঙ্কে শুয়ে রয়েছে মেষচর্মের কম্বল চাপা দিয়ে, কখন তাদের জ্ঞান ফিরবে কে জানে; এইসব বাগবিতণ্ডার মধ্যে ছুরিছোরাও বেরিয়েছে অনেকবার – দুদিনের ছুটিতে এইসব ঘটনার বিদ্ঘুটে প্রভাব পড়েছে আমার মনে, বেশ অসুস্থই লাগছে নিজেকে। চাষাভুষো মানুষদের বন্য উদ্দাম তাণ্ডব আমি কোনোদিনই সহ্য করতে পারি না, এই কারাগারের বদ্ধ আবহাওয়ায় সেটা আরো বেশি করে চোখে লাগে। এইসব দিনে রক্ষীরাও কড়া নজর রাখে না কারাকক্ষগুলিতে, চালায় না খানাতল্লাশি, মদের বোতল দেখলেও নীরব থাকে, কারণ অনেকদিনের অভিজ্ঞতায় তারা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে, বছরে এমন দুয়েকদিন এই চালচুলোহীন লোকেদের একটু আনন্দ উপভোগ করতে না দিলে আখেরে শান্তি-শৃঙ্খলার অবস্থা আরো খারাপই হয়ে উঠবে। হালচাল দেখে একটা অন্ধ ক্রোধ আমার মনের ভেতর উঠলে উঠতে থাকে। আমি পোল্যান্ড থেকে নির্বাসিত রাজনৈতিক বন্দি মিরেটস্কির সঙ্গে কথা বলতে যাই। তার চোখে আগুনের ঝলক, রাগের চোটে ঠোঁটদুটো কাঁপে তার। ‘এইসব ঠ্যাঙাড়েকে আমি ঘেন্না করি!’ গলা নামিয়ে হিসহিসিয়ে সে বলে আর আমার পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলে যায়। আমি মৃদুপায়ে ফিরে যেতে থাকি ব্যারাকের দিকে, যদিও এই মিনিট পনেরো আগেই আমি পাগলের মতন ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এসেছি সেখান থেকে, যখন ছয়জন গাট্টাগোট্টা চাষি মিলে পাঁড়মাতাল তাতার গাজিনকে মাটিতে ফেলে তার ওপরে ঝাঁপিয়েছে আর নির্মমভাবে মারতে লেগেছে তাকে। এইভাবে মারাটা একেবারে অর্থহীন, একটা শক্তপোক্ত উটকেও এভাবে মারলে সে যে মরে যাবে তা নিশ্চিত। কিন্তু তারা জানে, এই রক্তমাংসের হারকিউলিসকে সহজে মেরে ফেলা সম্ভব নয়, তাই তাকে মারধর চালিয়ে যেতে পারে বিবেকের কোনো দংশন ছাড়াই। এখন, ব্যারাকে ঢুকেই আমি দেখি দূরের এক কোণের বাঙ্কে গাজিন শুয়ে রয়েছে অচেতন, প্রাণের কোনো চিহ্নই নেই তার শরীরে; মেষচর্মের কম্বলে তার দেহ ঢাকা এবং অন্য কয়েদিরা নীরবে হেঁটে যায় তার পাশ দিয়ে, মনে মনে তারা ভালো করেই জানে যদি নসিব খারাপ থাকে, অমন নির্মম মারধর থেকে একটা মানুষের মরে যাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই লোহার গারদ লাগানো জানালার উলটোদিকে আমার নিজের জায়গায় আর শুয়ে থাকি চোখ বন্ধ করে, মাথার পেছনে দুহাত রেখে। এই ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা আমার পছন্দ; আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে না কেউ আর আমি আপনমনে চিন্তা করতে বা স্বপ্ন দেখতে পারি। কিন্তু এই অবস্থায় স্বপ্ন দেখা অসম্ভব : বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে আমার এবং কানের ভেতর বারবার বেজে চলে মিরেটস্কির মুখের কথাগুলো : ‘এইসব ঠ্যাঙাড়েকে আমি ঘেন্না করি!’ সে যাই হোক, এইসব দৃশ্য নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়ে কী লাভ; মাঝেমধ্যেই স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে এই মুহূর্তগুলির ছবি এবং তার চেয়ে অধিক যন্ত্রণার আর কিছু নেই। হয়তো এখানে বলে নেওয়া ভালো যে, আজ পর্যন্ত আমি আমার কারাগারে কাটানো যৌবনের সময়টুকু নিয়ে ছাপার অক্ষরে বা খাতার পাতায় কিছুই জানাইনি; বছর পনেরো আগে আমি মৃতদের গৃহ নামে একটা উপন্যাস লিখেছিলাম, তাতে ছিল এক কাল্পনিক চরিত্র, যে খুন করেছিল তার স্ত্রীকে। এখানে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে এই কথাটা জুড়ে দেওয়া ভালো যে, সেই বইটি প্রকাশের সময় থেকেই অনেকে ভেবেছেন এবং এখনো ভেবে চলেছেন, আমাকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল আমার স্ত্রীকে খুন করার জন্যে।

এইভাবে ক্রমশ আমি ভুলতে থাকি  এখানকার পরিবেশকে আর নিজের অগোচরেই ডুবে যাই স্মৃতির অতলে। চার বছর কারাগারে কাটানোর সময়ে আমি অতীত নিয়েই নিজেকে ব্যস্ত রাখতাম নিয়মিত এবং এখনো আমি আমার পুরনো জীবনটাকেই নতুন করে যাপন করতে চাই। সেই স্মৃতিগুলো নিজের থেকেই মাথাচাড়া দেয়, আমি তাদের সচেতনভাবে আমার ভাবনায় টেনে আনি না কখনো। কোনো অচেতন মুহূর্তে আমার ভাবনার উদয় হবে, নিজের অজান্তেই দেখতে পাবো কিছু চিহ্ন, সেগুলো একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে সম্পূর্ণ হবে ছবিটি, স্পষ্ট এবং জীবন্ত রেখাপাতে আমার সংবেদনে। মনের মধ্যে ভেসে আসা সেই ছবিগুলিকে আমি চাইতাম বিশ্লেষণ করতে, সুদূর অতীতের কোনো এক ঘটনার গায়ে নতুন তুলির টান লাগিয়ে এবং সবচেয়ে বড়ো কথা, তার ভেতর বিন্দুমাত্র কোনো ত্রুটি থাকলে সেগুলোকে সংশোধন করা, কেবল যে একবারই সংশোধন করা তা নয়, একাদিক্রমে বারবার অবিশ্রান্ত, বিরামহীন এবং সেটাই হয়ে দাঁড়ায় আমার প্রধান অবসর-বিনোদন। এই মুহূর্তে, যে-কোনো কারণেই হোক, আমার মনে পড়ে যায় শৈশবের এক স্বল্পস্থায়ী ঘটনার কথা, আমার তখন নয় বছর বয়েস – যে-সময়ের কথা আমি পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেই বিশেষ সময়ে আমার প্রথম শৈশবের স্মৃতিসমূহই ভিড় করে এসেছিল আমার মনে। আমাদের পুরনো গ্রামে আগস্ট মাসের বিশেষ একটা দিনের কথা মনে পড়ে; শুকনো, উজ্জ্বল দিন, কিন্তু প্রচণ্ড ঠান্ডা আর কনকনে বাতাস; গরমকাল শেষ হয়ে আসছে, সময় হয়েছে আমাদের মস্কো ফেরার; আবার সেই বিরক্তিকর ফরাসি ভাষা শেখার ক্লাস এবং গ্রামের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে আমার মন বিষণ্ন। সেদিন আমি ফসল ঝাড়াই-মাড়াইয়ের কোঠা পেরিয়ে হাঁটতে থাকি, একটা গিরিখাত ধরে খানিকটা নিচে নেমে ঘন ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে গিরিখাতের উলটোদিকের জঙ্গলে ঢুকি। ঢোকার একটু পরেই আওয়াজ শুনতে পাই, খুব একটা দূর নয়, তিরিশ গজের মতন হবে, সেখানে জঙ্গল সাফ করে তৈরি ফাঁকা জমিতে একলা একা লাঙল দিচ্ছে এক চাষি। জমিটা সমতল নয়, একটা পাহাড়ের ঢালুতে অবস্থিত। লাঙলের সঙ্গে বাঁধা ঘোড়াটা সেই ঢালু বেয়ে উঠতেই চায় না, আমি মাঝে মাঝেই চাষিটার চিৎকার শুনতে পাই, ‘হেট্, হেট্!’ আমি আমাদের জমিতে চাষ করার প্রায় সব চাষিকেই চিনি, আমি জানি না তাদের মধ্যে কে এখানে কৃষিকর্মে রত আর তাতে আমার কিছু আসে-যায়ও না, কারণ আমি রয়েছি নিজের চিন্তায় মগ্ন – শশব্যস্ত হয়ে আমি বাদামগাছের একটা ডাল ভেঙে নিই ব্যাঙেদের মারব বলে; বাদামগাছের প্রশাখা দেখতে চমৎকার, কিন্তু তা খুব সহজেই ভেঙে যায়, বার্চগাছের প্রশাখার মতন শক্তপোক্ত নয়। গুবরে পোকা ও অন্যান্য পোকামাকড়েও আগ্রহী ছিলাম আমি এবং তাদের ধরতাম সুযোগ পেলেই; তাদের ভেতর কয়েকটা খুব সুন্দর দেখতে। লাল আর হলুদ মেশানো টিকটিকিদেরও আমার পছন্দ, কালো কালো ছোপ, মানুষ দেখলে দ্রুতগতিতে পালায়; কিন্তু সাপেদের আমি ভয় পাই ভীষণ। সেই জঙ্গলে টিকটিকির সংখ্যাই বেশি, সাপের সংখ্যা কম, এটাই স্বস্তির কথা। ব্যাঙের ছাতাটাও বিশেষ দেখিনি সেখানে; ব্যাঙের ছাতা পেতে হলে যেতে হবে একটু দূরের বার্চের বনে এবং এখন সেদিকপানেই চলেছি আমি। এই পৃথিবীতে আমি আর কিছুই চাইব না, যদি পাই ব্যাঙের ছাতা আর বুনো বেরিতে ভরা অরণ্য, তার যত পাখি আর গুবরে পোকা, তার সজারু আর কাঠবিড়ালি, এবং পচা পাতার আর্দ্র ঘ্রাণ। এত বছর পর আমি লিখতে বসেছি, এখনো আমি অনুভব করি সেই বার্চবনের গন্ধ : এইসব দৃশ্য মনের ভেতর জেগে থাকে সারাজীবন। হঠাৎ সেই নিভৃত নীরবতার পরিবেশে শুনতে পাই স্পষ্ট আর পরিষ্কার চিৎকার, ‘নেকড়ে বাঘ! নেকড়ে বাঘ!’ আঁতকে উঠি আমি, গলা থেকে বেরোয় তীক্ষè আর্তনাদ আর ছুটে বেরিয়ে যাই সেই খোলা জমিতে কৃষিকর্মে রত চাষির দিকে।

সেই হলো আমাদের চাষি, তার নাম মারে। আমি জানতামই না এমন কোনো নাম হতে পারে; কিন্তু সবাই তাকে ‘মারে’ বলেই ডাকে। মাঝারি উচ্চতার একটু ওপরে সেই চাষি – গাট্টাগোট্টা, ঘন বাদামি, খোঁচাখোঁচা, লম্বা দাড়ি তার। তাকে চিনতাম আমি; কিন্তু এর আগে তার সঙ্গে কথা বলেছি বলে মনে পড়ে না। আমার আর্তচিৎকার শুনতে পেয়েই প্রথমে সে লাঙলের সঙ্গে বাঁধা বুড়ো ঘোটকীকে থামায় এবং যখন আমি আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে এক হাতে তার কাঠের লাঙলের প্রান্ত আর অন্য হাতে তার জামার হাতা আঁকড়ে ধরি, সে বুঝতে পারে কী পরিমাণ ভয় পেয়েছি আমি।

‘ওই যে, ওইখানে, নেকড়ে বাঘ! নেকড়ে বাঘ!’ এক নিশ্বাসে বলে ফেলি আমি।

সে অবিশ্রান্ত মাথা নাড়ে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও এদিক-ওদিক তাকায়, একমুহূর্তের জন্যে হলেও বিশ্বাস করে আমার কথা।

‘কোথায় দেখলে নেকড়ে বাঘ?’

‘কেউ একজন চেঁচিয়ে বললে – এইমাত্র, নেকড়ে বাঘ!’ আমার কথা আটকে যায়। ‘আরে, না, না! এখানে আশেপাশে কোনো নেকড়ে বাঘ নেই,’ সে মৃদুস্বরে বলে যায়, আমাকে শান্ত করার জন্যে। ‘তুমি স্বপ্নের ঘোরে আছো, খোকা। এই অঞ্চলে কেউ কোনোদিন নেকড়ে বাঘের কথা শুনেছে?’ তখনো আমার সারাশরীর কম্পমান এবং গায়ের জোরে ধরে রেখেছি তার ঢিলে আংরাখার হাতা, এবং মনে হয় আমাকে খুব বিবর্ণ লাগছিল। দুশ্চিন্তার হাসি নিয়ে সে আমার দিকে তাকায়, দেখলেই বোঝা যায় আমার জন্যে উদ্বিগ্ন ও আলোড়িত সে।

‘হায়, হায়, খুব যে ভয় পেয়ে গেছ তুমি,’ মাথা নাড়ে সে। ‘একদম চিন্তা করবে না, খোকা। আহা, বেচারা, বাছা আমার! মাথা ঠান্ডা করো, শান্ত হও।’

সে হাত বাড়িয়ে আমার চিবুক ছোঁয়, স্নেহের ভঙ্গিতে।

‘করুণাময় যিশু তোমার সঙ্গে আছেন, বুকের ওপরে ক্রুশচিহ্ন এঁকে স্মরণ করো তাঁকে, এই তো, খুব ভালো ছেলে!’

আমি কিন্তু ক্রুশচিহ্ন আঁকি না, আমার দুই ঠোঁটের কোণ কেঁপে চলেছে তখনো এবং তা দেখে সে বেশ চমকে যায়। তার লম্বা হাত বাড়িয়ে আমার কম্পমান ঠোঁটদুটো ছোঁয়, দেখতে পাই তার হাতের কালো কালো নখের কোণে মাটি জমে রয়েছে।

‘আহা রে, বেচারা,’ সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, মধুর মাতৃত্বের হাসি, ‘হে ঈশ্বর, দেখুন, দেখুন কী আতঙ্কেই না রয়েছে ছেলেটা, করুণা করুন একে।’

এরপরে আমার খেয়াল হয় যে, সত্যিই কোনো নেকড়ে বাঘ নেই সে-অঞ্চলে এবং ওই চিৎকার আমার কল্পনাপ্রসূত। কথাগুলো যদিও আমার কানে স্পষ্ট ও পরিষ্কার, এমন ঘটনা (যদিও প্রতিবারই নেকড়ে বাঘ নিয়ে নয়) আগেও দু-একবার ঘটেছে, এবং আমি তা ভালো করেই জানতাম (এই ধরনের চিত্তবিভ্রমের অসুখ থেকে আমি সেরে উঠি কয়েক বছর পরে)।

‘ঠিক আছে, আমি তাহলে বাড়ি যাই এখন,’ আমি তার দিকে তাকাই আর কিছুটা প্রশ্নের স্বরে বলি।

‘জলদি, জলদি যাও, খোকা, আমি এখন থেকে খেয়াল রাখছি,’ সে বলে; একটু থেমে আবার জুড়ে দেয়, ‘কোনো ভয় নেই, নেকড়ে বাঘ তোমাকে কামড়াবে না!’ এই বলে সে আবার হাসে, একই সেই মায়ের মতন হাসি, ‘যিশু তোমার সঙ্গে থাকুন। জলদি, জলদি যাও, খোকা।’ সে আমার বুকে ক্রুশচিহ্ন আঁকে, তারপর নিজের বুকেও।

আমি ঘরের পানে রওনা দিই, হাঁটতে হাঁটতে উৎকণ্ঠায় পেছন ফিরে তাকাই। যতক্ষণ আমাকে দেখা যায়, মারে তার ঘোটকীর পাশে দাঁড়িয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি ঘাড় ঘোরালেই সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। সত্যি কথা বলতে কি তার চোখের সামনে এভাবে হঠাৎ ভয় পেয়ে যাওয়ার জন্যে আমার লজ্জাই করছিল, কিন্তু নেকড়ে বাঘের আতঙ্কটাও আমার সঙ্গে সঙ্গেই ছিল, যতক্ষণ না গিরিখাত বেয়ে ওপরে উঠি আর ফসল ঝাড়াই-মাড়াইয়ের কোঠার কাছে পৌঁছে যাই। সেই মুহূর্তে আমার আতঙ্ক সম্পূর্ণ উবে যায় আর আমাদের প্রহরী কুকুর ভলচিকের আবির্ভাব ঘটে যেন মাটি ফুঁড়ে এবং সে ছুটে আসে আমার দিকে। ভলচিককে পাশে পেয়ে আমার মনোবল ফিরে আসে এবং শেষবারের মতন ফিরে তাকাই মারের দিকে। সে তখনো হাসিমুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে। আমি হাত নাড়লে সেও হাত নাড়ে, তারপর আবার কাজে মন দেয় ঘোটকীর সঙ্গে।

‘হেট্ হেট্!’ দূর থেকে তার গলা শুনতে পাই, ঘোটকীকে লাঙলের সঙ্গে বেঁধে সে কৃষিকর্ম শুরু করে।

এক লহমায় সেইসব স্মৃতি ফিরে আসে, জানি না কেন, সবকিছু বিস্ময়কর খুঁটিনাটি সমেত। আমি উঠে বসি আমার বাঙ্কের বিছানায়, অনুভব করি যে সেই স্মৃতির মধুর হাসি এখনো লেগে রয়েছে আমার ঠোঁটে। আরো কয়েক মিনিট শৈশবের সেই ঘটনার উষ্ণতায় ডুবে থাকি আমি।

সেদিন মারের সঙ্গে সেই ঘটনার পরে আমি ঘরে ফিরে এসে কাউকে আমার এই ‘অ্যাডভেঞ্চার’ নিয়ে একটি কথাও বলিনি। এটা যে এমন কিছু একটা অ্যাডভেঞ্চার, তাও নয়। তারপর আমি মারের কথা পুরোপুরি ভুলে যাই। তারপর অবরে-সবরে যখনই তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, আমি তার সঙ্গে কোনো কথাই বলিনি, নেকড়ে বাঘের কথা তো নয়ই। এখন এই কুড়ি বছর পরে সুদূর সাইবেরিয়ায় এসে তার সঙ্গে সেই দেখা হওয়ার দৃশ্য এমন নিখুঁতভাবে, প্রতিটি খুঁটিনাটি সমেত আমার মনে এসে হাজির হবে কেন? তার মানে এই যে, ঘটনাটি আমার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে স্থান করে নিয়েছে আমার মনের গহিনে এবং যখনই তার ইচ্ছে হবে, তখনই সে দেখা দিতে পারে। আমার স্পষ্ট মনে আছে সেই ক্রীতদাসের মধুর, মাতৃসম হাসি, যেভাবে সে আমার ও তার নিজের বুকে ক্রুশ এঁকেছিল, আর তার করুণাময় দৃষ্টি। ‘হে ঈশ্বর, ভীষণ ভয় পেয়েছে ছেলেটা, বেচারা!’ বিশেষ করে স্মরণে আছে তার হাতের মোটা মোটা, কাদামাখা আঙুল কীরকম স্নেহের বশে ছুঁয়েছিল আমার কম্পমান ঠোঁট এবং তার অপ্রতিভ, মুখচোরা ভঙ্গি। সন্দেহ নেই, ওইরকম অবস্থায় যে-কোনো প্রাপ্তবয়েসি মানুষই চেষ্টা চালাত এক ভীত বালকের ভয় ভাঙাতে, কিন্তু আমার অতীতের সেই ঘটনাটি অনেকটাই আলাদা; আমি যদি তার নিজের সন্তান হতাম, তাহলেও স্নেহ ও ভালোবাসার প্রকাশ এর চেয়ে গভীর হতো না। সেই উজ্জ্বল চোখদুটো তার, কে তাকে বাধ্য করেছিল অমন স্নেহময় দৃষ্টিতে তাকাতে? মারে আসলে একজন ক্রীতদাস, আমাদের পরিবারের সম্পত্তি এবং আমি তার মালিকের সন্তান। কেউই কোনোদিন জানতে পারত না তার সেই সুকর্মের কথা এবং সে কোনো বখশিশও পাবে বলে আশা করেনি। সত্যি কি তার নিজের সন্তান ছিল আমার বয়েসি আর সে কি তাকেও এইভাবে ভালোবাসত? সন্দেহ নেই, এরকম মানুষ আরো রয়েছে। আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল এক নির্জন অরণ্যে, জনহীন এক খোলা জমিতে এবং কেবল ঈশ্বরই হয়তো স্বর্গ থেকে দেখেছেন কী গভীর আর আলোকিত মানব সংবেদন, এক রুক্ষ, বন্য, নিরক্ষর রুশ ক্রীতদাসের হৃদয় কী সূক্ষ্ম, নারীসুলভ কোমলতায় উপচে পড়ে, যে ক্রীতদাস সেই সময় প্রত্যাশাও করেনি বা স্বপ্নও দেখেনি দাসত্ব থেকে কোনোদিন মুক্তি পাওয়ার।

বলুন তাহলে কনস্তান্তিন আকসাকভ যখন আমাদের দেশের উচ্চ সংস্কৃতিমনা মানুষের কথা বলেছিলেন, তখন কি মারের মতন চাষির কথাই বলেননি?

বাঙ্ক থেকে নেমে এসে চারদিকে তাকাই আর মনে হয়, এইসব অসুখী, অসংস্কৃত কয়েদির দিকে আমি নতুন দৃষ্টিতে তাকাতে পারি; এবং যেন কোনো এক মন্ত্রবলে অন্তর্হিত হয়েছে আমার হৃদয়ের যত ক্রোধ ও ঘৃণা। কারাকক্ষের ভেতর ঘুরে বেড়াই এবং কেউ কাছাকাছি এলেই সোজা তার চোখের দিকে তাকাই। ওই যে শয়তান চাষিটা, মাথা কামানো আর মুখে উল্কি, মাতাল হয়ে তারস্বরে গান গায় হেঁড়ে গলায়, তার মধ্যেও হয়তো মারের মতন এক কোমল চাষি বর্তমান : আমি কি তার হৃদয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে পারি? সেই সন্ধেয় আবার দেখা হয় মিরেটস্কির সঙ্গে। বেচারা! তার কোনো স্মৃতি নেই মারের বা তার মতন অন্য কোনো চাষির স্নেহমধুর ব্যবহারের। তার পক্ষে সম্ভব নয়, ‘এইসব ঠ্যাঙাড়েকে আমি ঘেন্না করি!’ ছাড়া এইসব মানুষের বিষয়ে অন্য কোনো মতামতের। হ্যাঁ, পোল্যান্ডের মানুষদের অবস্থা আমাদের চেয়ে অনেকটাই খারাপ!

টীকা

মিরেটস্কি : ইনি কাল্পনিক চরিত্র নন, রক্তমাংসের মানুষ। পোল্যান্ডের রাজনৈতিক কর্মী ও’মিরেটস্কি লেখকের সঙ্গে তখন জেল খাটছিলেন।

‘এইসব ঠ্যাঙাড়েকে আমি ঘেন্না করি!’ এখানে লেখক একটি ফরাসি শব্দবন্ধ বারবার ব্যবহার করেছেন – ‘Je hais ces brigands!’ পূর্ব ইউরোপে ফরাসি ছিল শিক্ষিত, অভিজাত মানুষের মুখের ভাষা; পোল্যান্ড ও রাশিয়ার দুজন শিক্ষিত মানুষ কথা বলছেন ফরাসিতে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

তাতার গাজিন : এই চরিত্রটি লেখকের মৃতদের গৃহ উপন্যাসেও রয়েছে।

রুশ ক্রীতদাস : ১৮৬১ সালে রুশ ক্রীতদাসদের মুক্তি দেন জার দ্বিতীয় আলেক্সান্দার।

কনস্তান্তিন আকসাকভ (১৮১৭-৬০) : রুশ নাট্যকার, সমালোচক, বুদ্ধিজীবী। [১৯৬২ সালে প্রকাশিত ডেভিড মাগারশাকের (১৮৯৯-১৯৭৭) ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে।]