বর্ণবাদ,টু কিল এ মকিংবার্ড এবং আমাদের মানস

শুধু আমেরিকা নয় গোটা বিশ্বেই বর্ণবাদ একটি অভিশাপ। সময়ের তালে তালে মানুষ সভ্যতার দাবি করে বটে কিন্তু যুগ যুগ ধরে মানুষ এই ঘৃণ্য বর্ণবাদকে লালন করছে তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতেই। সে-কারণে বিভিন্ন সময়ে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন হয়েছে, প্রতিবাদ হয়েছে, রক্তপাত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই শিল্প-সাহিত্যের ভাষাতেও বর্ণবাদবিরোধী বাণী এসেছে। টু কিল এ মকিংবার্ড ঠিক এমনই একটি বর্ণবাদবিরোধী কাজলজয়ী উপন্যাস।  আজ থেকে ষাট বছর আগে উপন্যাসটির জন্ম হয়েছিল বটে কিন্তু এর নির্যাস এবং মর্মবাণী এখনো আমাদের সমাজে বর্তমান। বর্তমান এই অস্থির পৃথিবীতে বর্ণবাদ যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, মানবতার পথ যখন রুদ্ধ, মানুষ যখন শ্রেণিবৈষম্যের ভয়াল শিকার ঠিক এই সময়ে টু কিল এ মকিংবার্ড উপন্যাসটি আমাদের মানবিক এবং সংবেদনশীল মননে নতুন আশাবাদী এক বার্তা নিয়ে আসে।

দার্শনিক রুশো তাঁর সোশ্যাল কনট্রাক্ট গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘মানুষের যখন জন্ম হয় সে তখন থাকে মুক্ত শিকলবিহীন।’ শিকলবিহীন জন্ম হলেও মানুষ  ধীরে ধীর বড় হতে থাকে আর  রপ্ত করতে থাকে সমাজে টিকে থাকার জন্যে নানা রকম কৌশল। স্বাভাবিকভাবেই ধীরে ধীরে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যে সহজাত বন্ধনটি থাকার কথা ছিল তা ভেঙে যায়, প্রতিহত হয়। মানুষের মনে তখন জন্ম নেয় ঔপনিবেশিক মানসিকতার কঠিন মন্ত্র। মানুষ ভুলে যায় সে-ও প্রকৃতির এক বিরাট অংশ। মানুষের হিংস্রতার শিকার হয় বনের নিরীহ মকিংবার্ড। যে-মকিংবার্ড মনের আনন্দে বনে গান গায় মানুষ সেই  মকিংবার্ডের কণ্ঠ রোধ করে, হত্যা করে। এই হত্যা মানেই প্রকৃতির আইনকে ধ্বংস করা, মানবতাকে ধ্বংস করা অথবা প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের যে দীর্ঘদিনের সখ্য রয়েছে তা ধ্বংস করা। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছয় বছর বয়সী বালিকা ফিন্চ যার ডাক নাম স্কাউট বলছে, ‘Shoot all the bluejays you want, if you can hit ’em, but remember it’s a sin to kill a mockingbird.’ ১৯৬০ সালে টু কিল এ মকিংবার্ড উপন্যাসটির জন্ম। লেখক হারপার লি। আমেরিকার সাহিত্য-ইতিহাসে উপন্যাসটির জনপ্রিয়তা যেমন আকাশচুম্বী ঠিক একইভাবে আমেরিকা তথা গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসেও উপন্যাসটির বাণী অপরিসীম। আমেরিকার পুলিৎজারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র স্কাউটের চোখ দিয়েই বর্ণবাদে ঘেরা সমাজের দৃশ্যপট আঁকা হয়েছে। স্কাউটের বাবা অ্যাটিকাস ফিন্চ এই উপন্যাসের একজন আদর্শ নায়ক। তাঁকে আমরা মানবতার কণ্ঠস্বরও বলতে পারি। উপন্যাসটির দৃশ্যপটের সময়কাল ১৯৩০। অ্যালাবামার মেকম্ব একটি ছোট শেতাঙ্গবেষ্টিত শহর।  এই শহরেই স্কাউট তার বড় ভাই জেম ও বাবা অ্যাটিকাসের সঙ্গে বেড়ে ওঠে।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জিন লুইস ফিন্চ, যার ডাকনাম স্কাউট, নিতান্তই ছয় বছর বয়সী এক শিশু। এই চরিত্রটির বয়ানেই গোটা উপন্যাসের মূলভূমি রচিত হয়েছে। স্কাউটের যখন দু-বছর বয়স তখন তার মা মারা যায়। বাড়িতে রাখা নিগ্রো দাস কালপুর্নিয়ার হাতে স্কাউট বড় হয় এবং ধীরে ধীরে সে তার কাছ থেকেই বর্ণবাদ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেতে শুরু করে। সমাজের শ্বেতাঙ্গ মানুষগুলো কালো মানুষদের সম্পর্কে যে নীচ এবং হীন ধারণা লালন করে তার আভাস স্কাউট লাভ করেছিল কালপুর্নিয়ার কাছ থেকে। অন্যদিক থেকে স্কাউট নিগ্রো যুবক টম রবিনসনের মামলা থেকেও কালো মানুষদের প্রতি শ্বেতাঙ্গ মানুষদের বৈরী আচরণ কেমন হতে পারে সে-সম্পর্কে একটি ধারণা লাভ করে। উপন্যাসটিতে আমরা দেখতে পাই, টম রবিসন মামলার শুনানির দিন স্কাউট, তার ভাই জেম এবং বন্ধু ডিল কোর্ট হাউসের পেছনে কালো নিগ্রোদের জন্যে রক্ষিত চেয়ারে বসে বিচারকের মামলা পরিচালনা দেখছিল। বাবা অ্যাটিকাসের তা দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি তার ছেলেমেয়েদের বিচারকের রায় শোনার ব্যবস্থা করে দিলেন। বাচ্চারা যাতে এই বিচারকের রায় থেকে একটি যথাযথ শিক্ষা নিতে পারে সেটিই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। অ্যাটিকাস ফিন্চ সবরকম চেষ্টা সত্ত্বেও টম রবিনসনকে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া শ্বেতাঙ্গদের মিথ্যা মামলা থেকে মুক্ত করতে পারেননি।  টম একজন কালো নিগ্রো – এটাই ছিল তার সবচেয়ে বড় অপরাধ। টম বিচারকের রায়ে অপরাধী কিন্তু বিচারকাজে নিয়োজিত জুরিরাও জানত যে, টম ছিল সম্পূর্ণ নিরপরাধ। এই জটিল আবার সহজ বিষয়টি বুঝতে পারে না ছোট্ট মেয়ে স্কাউট। তার ধারণা, বাবা অ্যাটিকাস বারবার টমকে নিরপরাধ প্রমাণ করার পরও কেন তাকে শাস্তি পেতে হবে?  পরে ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে যে, টমের গায়ের রং ছিল কালো এবং এটিই হলো তার সবচেয়ে বড় অপরাধ। স্কাউট বুঝতে পারে, সাদারাই শাসক; কালোরা সবসময় শোষিত। জেম এবং অ্যাটিকাসের পারস্পরিক আলাপে সে-বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে, ‘There’s something in our world that makes men lose their heads – they couldn’t be fair if they tried. In our courts, when it’s a white man’s word against a black man’s, the white man always wins. They’re ugly, but those are the facts of life.’ (পৃ ২২০)। ফিন্চ তাদের এই কথোপকথন শোনে এবং বিষয়টি নিয়ে ভাবে। লেখক হারপার লির ক্ষমতা এখানেই। তিনি উপন্যাসের একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র স্কাউটের চোখ দিয়ে দেখা বর্ণবাদে আচ্ছন্ন গোটা সমাজকেই তাঁর উপন্যাসের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। ফিন্চ একটি শিশু। তার নিষ্পাপ মনে অনেক বিষয় নিত্যই উঁকিঝুঁকি দেয়। পৃথিবীর কোনো অসামঞ্জস্য তাকে ছুঁতে পারে না। এখানে দার্শনিক রুশোর সোশ্যাল কনট্রাক্টের বাণীকেও উপন্যাসে কাজে লাগানো হয়েছে। অন্যদিকে একজন শিশু স্পষ্টবাদীও। যে-কোনো অবিচার, বিভাজন এবং অসংলগ্নতা একটি শিশুর মনে দোলা দেয়। কারণ তাদের দেখার চোখ থাকে সরল এবং নিষ্পাপ। তাদের নির্দোষ এবং নির্মোহ হৃদয়ে অনেক প্রশ্ন এই বিভাজিত মানবসমাজকে বিচলিত করবে – এটাই স্বাভাবিক।

টু কিল এ মকিংবার্ড উপন্যাসের উৎসস্থল মেকম্ব শহরের শ্বেতাঙ্গ উচ্চবিত্তদের সামাজিক অবস্থান অনেক উঁচুতে। তারা বর্ণবাদকে লালন করে। সমাজের নিচুতলার মানুষ সম্পর্কে তাদের কোনো শ্রদ্ধা নেই। তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সবসময়ই তৎপর। এমন অধঃপতিত মানসিকতার উদাহরণ এ-উপন্যাসের পাতায় পাতায় বর্ণিত হয়েছে। টম রবিনসনের মামলাটির কথাই ধরা যাক। নিগ্রো টম রবিনসন খুব সাধারণ এক শ্রমিক। লিংক ডিয়াসে একটি তুলার খামারে তিনি কাজ করেন। মায়েলা ইউয়েল এক শ্বেতাঙ্গ নারী। টম তার কাজে যাওয়ার পথে বিভিন্ন সময়ে মায়েলার বাড়িতে ছোটখাটো কাজ করে দিতেন। একদিন টমকে মায়েলার বাড়িতে কিছু কাজ করে দেওয়ার জন্যে ডাকা হলো। সেদিন ওই বাড়িটা ছিল নির্জন। ঘরে কেউ নেই। টম রবিনসনকে বাড়ির ওপরের তাক থেকে কিছু তৈজসপত্র নামাতে অনুরোধ করল সাদা নারী মায়েলা। টম জিনিসগুলো ওপর থেকে নামিয়ে নিচে নামতেই মায়েলা তাকে জড়িয়ে ধরল। তাকে চুমু খেলো। ঠিক এই সময়ে মায়েলার বাবা বব ইউয়েল বাড়িতে এসে হাতেনাতে টম এবং মায়েলাকে সেই অবস্থায় ধরে ফেলল। মায়েলা নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যার আশ্রয় নিল। টমকে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত করল সে। আমেরিকার তৎকালীন সমাজের চেহারাটার দিকে আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে। তখন সমাজে এমন একটা ধারণা পোষণ করা হতো যে, শ্বেতাঙ্গরা সব রকম দোষ থেকে মুক্ত। যাই হোক না কেন সব দোষ ওই কালো মানুষদের। টম একে নিগ্রো, তার ওপর সাদা মায়েলাকে সে চুমু খেয়েছে। অতএব টমের বিচার হোক। মামলাটি যখন কোর্টে উঠল তখন টমকে সুকৌশলে অপরাধী করা হলো। বিষয়টা সেই সময় মেকম্ব শহরের শ্বেতাঙ্গ সমাজে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। একজন সাদা একজন নিগ্রোকে ধর্ষণ করবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু একজন নিগ্রো একজন শ্বেতাঙ্গকে চুমু দেবে! – এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কোর্টের বিচারকাজও ছিল প্রহসনমূলক! বিচারক ভাবলেন, টমকে যদি নির্দোষ ঘোষণা করা হয় তাহলে তা হবে শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের পরাজয়। শুধু মেকম্ববাসী নয়, তা হবে গোটা শ্বেতাঙ্গ সমাজের পরাজয়। অতএব টমকে জেলে পোড়া ছাড়া বিচারকের সামনে আর দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না। ছয় বছরের শিশু স্কাউটের মনকে এ-ঘটনা বিপুলভাবে নাড়া দেয়। স্কাউটের ভাষায়, There’s nothing more sickening to me than a white man who’ll take advantage of a Negro’s ignorance. Don’t fool yourselves – it’s all adding up, and one of these days, we’re going to pay the bill for it.’ (পৃ ২৩৩-২৩৪)

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হারপার লি’র এই গ্রন্থটি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা আমেরিকায় ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছিল এবং পরবর্তীকালে আমেরিকার আধুনিক ধ্রুপদী সাহিত্য হিসেবে উপন্যাসটি বিশেষ একটি জায়গা তৈরি করে নিয়েছিল। জানা যায়, উপন্যাসটির মূল চরিত্রায়ণ এবং পারিপার্শ্বিক সামাজিক অবস্থান তৈরি হয়েছিল লেখক হারপার লির ব্যক্তিগত পারিবারিক অভিজ্ঞতা তো বটেই তাঁর প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শোনা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। ১৯৩৬ সালে হারপার লি অ্যালাবামার মনরোভিল নামে ছোট শহরে  যখন বাস করতেন তখন তাঁর বয়স ছিল দশ বছর। আমেরিকার সেই সময়ের সামাজিক অবস্থান, বর্ণবাদ, শ্রেণিবৈষম্য লেখকের মনের গভীরে গভীর দাগ কেটেছিল। উপন্যাসটি সহজ-সরল উপস্থাপনের আড়ালে রয়েছে সমাজের প্রতি বিদ্রƒপ, ব্যঙ্গ এবং একই সঙ্গে তীর্যক হাস্যরসও। অ্যাটিকাস, স্কাউট – তারা সবাই পাঠকদের জন্য আদর্শবান মানুষ। তাদের সততা, ভদ্রতা এবং মানবিকতা আমাদের স্পর্শ করে, পাশাপাশি জীবনমুখীও করে তোলে। ইতিহাসবিদ জে. ক্রেসপিনোর ভাষায়, ‘টু কিল এ মকিংবার্ড সম্ভবত এই বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বেশি পঠিত একটি গ্রন্থ, যা আমেরিকার বর্ণবাদকে তুলে ধরতে পেরেছে। একই সঙ্গে গ্রন্থটির মূল চরিত্র অ্যাটিকাস ফিন্চের মধ্য দিয়ে উপন্যাসে জাতিগতভাবে বিকশিত নায়কদের মধ্যে সবচেয়ে টেকসই একটি ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে।’ গ্রন্থটি সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে অনেক লেখক এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব অনেক কথাই বলেছেন। লেখক মেরি মেকডোনফ মারফি গ্রন্থটির ওপর মানুষের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া এবং তাঁদের মতামত সংগ্রহ করেছেন। গ্রন্থটি প্রসঙ্গে বেশিরভাগ মানুষ এক বাক্যে যে বাক্যটি উচ্চারণ করেন তা হলো – ‘অসাধারণ একটা উপন্যাস।’ ২০০৬ সালে ব্রিটিশ লাইব্রেরিয়ান টু কিল এ মকিংবার্ড গ্রন্থটিকে জনপ্রিয়তার দিক থেকে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র গ্রন্থ ‘বাইবেলে’র ওপরে স্থান দিয়েছে। তাদের মতে, ‘মৃত্যুর আগে প্রতিটি মানুষের এই গ্রন্থ পড়া জরুরি।’

মানুষ জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন শ্রেণী এবং বর্ণ বৈষম্যের শিকার। প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষও বুক চিতিয়ে সবার আগে নিজের অবস্থানকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে। ‘আমিই সেরা এবং সবাই আমার করতলে’ – এই ধারণা মানুষের সহজাত। এই ধারণা থেকেই সমাজে তৈরি হয় শ্রেণিবিভাজন। যাদের শক্তি আছে তারা শাসন করে। যারা দুর্বল তারা শোষিত হয়। এই নিয়ম মেনেই সমাজ গড়ে ওঠে। হারপার লি তাঁর উপন্যাসে এই শ্রেণিবিভাজনকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটির একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি তুলে ধরছি –  ‘You never really understand a person until you consider things from his point of view, until you climb into his skin.’ এবার উপন্যাসটির পটভূমিকা এবং সেই সময়ের সমাজ নিয়ে একটু আলোকপাত করা যেতে পারে। যে-সময়টি নিয়ে এই উপন্যাসের যাত্রা সেই ১৯৩০ সালের আমেরিকার সমাজ কেমন ছিল? এই প্রশ্নটিও একজন পাঠকের মনে নিশ্চিতভাবেই বারবার উদিত হবে। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দাকালীন কঠিন সময়ে দেশটির শুধু দক্ষিণাঞ্চল নয় মোটামুটি সর্বত্রই ছিল বর্ণবাদে ঠাসা এক সমাজব্যবস্থা। উপন্যাসে লেখক যে-স্থানটি বেছে নিয়েছেন সেটি হলো অ্যালাবামা অঙ্গরাজ্যের মেকম্ব শহর। অ্যালাবামাসহ আমেরিকার দক্ষিণে অবস্থিত রাজ্যগুলো সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের আমেরিকার ইতিহাসের দিকেও একটু নজর দিতে হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ চলাকালে দাসপ্রথার প্রশ্নে দক্ষিণের উগ্র শ্বেতাঙ্গরা সবসময় এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। অন্যদিকে আমেরিকার উত্তরের অঙ্গরাজ্যগুলো ছিল দাসপ্রথা বিলুপ্তির পক্ষে। এই বিরোধিতা থেকেই বর্ণবাদমনস্ক দক্ষিণের শ্বেতাঙ্গরা কখনোই নিগ্রো দাসদের মুক্তির জন্যে আন্তরিক ছিল না। যে কারণে তারা ঠিক এখনো পর্যন্ত আফ্রিকান-আমেরিকানদের ক্রীতদাস হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত। ভাবুন, আজ থেকে মাত্র সত্তর বছর আগেও নিগ্রো দাস সম্পর্কে দক্ষিণের উগ্র বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গদের মানসিকতা কেমন ছিল। সেই মানসিকতার সূত্র ধরেই নিগ্রোরা সেই শত বছর আগে দাসপ্রথা থেকে মুক্তি পেলেও এখনো সামাজিকভাবে তারা নিচুতলার মানুষই রয়ে গেছে। অথবা বলা যায় তাদের সমাজের সবচেয়ে নিচের স্তরে কৌশলে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই ধারণাগুলো দক্ষিণাঞ্চলের অঙ্গরাজ্যের ছোট ছোট শহরে বসবাসরত শ্বেতাঙ্গদের মজ্জাগত। যে-কারণে এই উপন্যাসটি পাঠ করলে আমেরিকার গৃহযুদ্ধোত্তর সময়, বর্ণবাদ এবং সেই সঙ্গে বর্ণবাদপুষ্ট আমেরিকার উগ্রবাদী শ্বেতাঙ্গ মানুষদের মানসিকতার চেহারার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। তখন স্কাউটের মতো পাঠকের মনেও ঠিক একই প্রশ্ন জাগে যে, মকিংবার্ড মনের আনন্দে গান গায়, মানুষকে বিনোদন দেয়, তারপরও কেন তাকে মরতে হয়? ‘Mockingbirds don’t do one thing but make music for us to enjoy. They don’t eat up people’s gardens, don’t nest in corncribs. They don’t do one thing but sing their hearts out for us. That’s why it’s a sin to kill a mockingbird.’

মানুষের অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার, একরোখা মানসিকতা এবং মানববিদ্বেষের বিভিন্ন রকম ভয়ংকর রূপ এই পৃথিবীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সৃষ্টির আদিতেও তা ছিল, এখনো আছে এবং সবসময়ই থাকবে। মানুষের এই রূপ চিরন্তন এবং সর্বকালীন। টু কিল এ মকিংবার্ড উপন্যাসে এই বিষয়গুলো খুব সূক্ষ্ম এবং সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। গ্রন্থটি নিয়ে চলচ্চিত্রও হয়েছে। ১৯৬২ সালে রবার্ট মুলিগানের পরিচালনায় নির্মিত সে-চলচ্চিত্র অ্যাকাডেমিক অ্যাওয়ার্ড পুরস্কারও লাভ করে। টু কিল এ মকিংবার্ড গ্রন্থের রচয়িতা হারপার লি’র আরেক উপন্যাস গো সেট এ ওয়াচম্যান প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই। হারপার লি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিলেন।

সন্দেহ নেই টু কিল এ মকিংবার্ড উপন্যাসটি শুধু আমেরিকা নয়, গোটা পৃথিবীর সমাজ এবং রাষ্ট্রের অশুভ আত্মাকে প্রতিনিয়ত আঘাত করে। উপন্যাসের  আদর্শ চরিত্র স্কটের বাবা অ্যাটিকাস ফিন্চের বক্তব্য দিয়ে লেখটি শেষ হতে পারে।

‘As you grow older, you’ll see white men cheat black men everyday of your life, but let me tell you something and don’t you forget it…Whenever a white man does that to a black man, no matter who he is, how rich he is, or how fine a family he comes from, that white man is trash.’ আমরাও বিশ্বাস করি পৃথিবী থেকে একদিন বর্ণবাদ বিদায় নেবে। বর্ণবাদমুক্ত এক সুন্দর সমাজ গড়ে উঠবে। অ্যাটিকাসের সঙ্গে আমরাও সুর মেলাতে চাই Ñ ‘বর্ণবাদ এবং শ্রেণিবৈষম্য পোষণকারী মানুষেরা এক সময় পৃথিবীর আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেই।’