২০১৫ সালের ৬ই আগস্ট আমি দক্ষিণ কোরিয়া পৌঁছালাম। দেশটির রাজধানী সিউলের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত গিয়াংগি প্রদেশের গোয়াংজু শহরের মানবাধিকারবিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠানে এক বছরের ফেলোশিপ নিয়ে এসেছি। সপ্তাহ তিনেক পরে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক কিম-ইয়াং রে আমাকে বললেন, সামনের উইক-এন্ডে শহরের বাইরে তাদের একটা শিক্ষক সমাবেশ আছে, তিনি ওখানে বক্তৃতা দেবেন, যদি আমি ফ্রি থাকি আমি গেলে তিনি খুশি হবেন। দুদিনের ট্যুর …
শহরের বাইরে, পাহাড়ি গ্রাম, মেঘের দেশ … শুনেই রাজি হয়ে গেলাম। পরদিন শনিবার, ২৯শে আগস্ট ইয়াং রে, রিনি আর আমি দুপুরে রওনা দিলাম। গাড়ি চালাচ্ছিলেন ইয়াং-রে, সামনে তাঁর পাশে আমি বসেছি, যেতে-যেতে পথে ছবি তুলতে সুবিধা হবে, আর নানা বিষয়ে গল্প করা যাবে বলে।
গোয়াংজু শহর ছাড়িয়ে যতই গভীরে যাচ্ছি সবুজের প্রাচুর্য বাড়ছে, নানা জাতের গাছপালা, খোলা প্রান্তর, ঢেউ খেলানো পাহাড়, যতদূর চোখ যায় শুধুই পাহাড় আর পাহাড়, পাহাড়ে ঝুঁকে আছে মেঘের ঠোঁট, মনে হচ্ছে এই বুঝি চুমু খাবে। আমি লক্ষ করলাম, আমাদের গাড়ি চলছে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে। গতি আমার সব সময়ই ভালো লাগে, আর সেই গতির সঙ্গে যদি যোগ হয় অমন মন-মাতানো সবুজ-পাহাড়-মেঘের আদর, তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
সাঁই সাঁই ছুটে চলছে একেকটা চমক লাগানো মডেলের গাড়ি, পথচলতি কোনো জনমানুষ নেই কোথাও, যেন বন্ধনহীন বনের পাখির মতো উড়ে চলছে গাড়িগুলো। কোথাও-কোথাও পথ ঢুকে যাচ্ছে পাহাড়ে, পাহাড়ের তলে সুড়ঙ্গ কেটে তৈরি করা হয়েছে টানেল। এরকম পাঁচটা টানেল আমরা পার হলাম। গাড়িতে জিপিএস সিস্টেম আছে, রেকর্ড-ভয়েসে একটা সুন্দর নারীকণ্ঠ মাঝে মাঝে ড্রাইভিংয়ে গাইড করছে ইয়াং-রে’কে। এক ঘণ্টার ওপর উচ্চ গতিতে ভ্রমণ শেষে আমরা পৌঁছে গেলাম মনপাগল করা এক গ্রামে। চারদিকে পাহাড়, মাঝে ভিউকার্ডের ছবির মতো সুন্দর একটি উপত্যকা। এই ভ্যালিতেই গড়ে উঠেছে ছোট্ট এক গ্রাম, নাম তার গোচাং। ওরা বলে কান্ট্রি সাইড। আমাদের বাংলাদেশের গ্রামের সঙ্গে এর কোনো সাদৃশ্য নেই, নামেই শুধু গ্রাম। নাগরিক সমস্ত সুযোগ-সুবিধাই এখানে আছে। তবে আমাদের গ্রামগুলোর সঙ্গে এক জায়গায় মিল আছে, সেটা হচ্ছে প্রচুর গাছপালা, আর নিরিবিলি, ছোট-ছোট বাড়ি, কোথাও আকাশস্পর্শী ভবন নেই, যার ফলে এখানে বিশাল একটা আকাশ দেখা যায়, প্রকৃতিটা সবুজে ভরপুর।
এসেই উঠলাম ‘গোচাং কান্ট্রি সেনুনছান ইয়ুথ হোস্টেলে’। জায়গাটি পড়েছে উত্তর জল্লা প্রদেশের সেনুনছান অঞ্চলে। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে পীত সাগর। ওরা বলে পশ্চিম সাগর, ইংরেজিতে ‘ইয়েলো সি’।
গোয়াংজুতে আসার পরদিন, আমাদের বিভাগের বুজাংনিম, হান-কি ইয়ং-কে আমার কবিতার বই মায়াদ্বীপ উপহার দিয়েছিলাম। কোরিয়ান ভাষায় পরিচালককে বলে বুজাংনিম। আমি একজন লেখক, এই পরিচয় পেয়ে বুজাংনিম খুব খুশি হয়েছিলেন। এ-কথা অফিসে রাষ্ট্র হতে বেশিদিন সময় লাগেনি। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক কিম-ইয়াং রে’ও জেনে গেছেন। সেই থেকে ইয়াং-রে, হান-কি ইয়ং কোথাও প্রোগ্রাম থাকলেই বলেন, ‘ফ্রি আছো? হাতে কাজ না থাকলে চলো … ।’ এতে আমার সুবিধাই হয়েছে, বিনে পয়সায় অনেক জায়গায় ঘোরার সুযোগ পাচ্ছি, আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ হচ্ছে।
কোরিয়াতে সৃষ্টিশীল কোনো লেখকের একক বই থাকা মানে অনেক বড় বিষয়। অনেকের কবিতা অ্যান্থলজিতে স্থান পায়, কিন্তু একক বই তাঁদেরই হয়, যারা খুব ভালো লেখেন। এখানে শুনে যা বুঝলাম, আমাদের দেশের মতো না – যা খুশি লিখলাম, প্রকাশককে টাকা দিলেই একটা বই প্রকাশিত হয়ে গেল। সৃষ্টিশীল গ্রন্থের মান নিয়ন্ত্রণ একটি বড় বিষয় কোরিয়াতে।
ইয়াং-রে নিজে থেকেই বললেন, ‘চলো ঘুরে আসি …।’ আমরা প্রথমেই এখানকার খুব প্রাচীন একটি মন্দিরে গেলাম, নাম সেনুনছান টেম্পল। পথে যেতে-যেতে দেখলাম বাঁ দিকে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার জলে তৈরি হয়েছে ছোট এক জলের ধারা, ওপর থেকে নেমে আসছে … জল-কলকল ধ্বনি, পাখির ডাক, দুপাশে প্রাচীন সব গাছ ওপরের দিকে শাখায়-শাখায়, পাতায়-পাতায় মিতালি করছে, অনেকটা তোরণের মতো তৈরি হয়েছে। মন বলছে – আহা! এই তো তপোবন! শুনলাম আশেপাশে অনেক বৌদ্ধ-সন্ন্যাসী বাস করেন, সাধনা করেন; পথে তাঁদের দু-একজনের সাক্ষাৎ মিলল। সবাই মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মানের সঙ্গে ওনাদের অভিবাদন করছেন।
বৌদ্ধ-সন্ন্যাসীদের পোশাক-আশাক আলাদা। তবে আমাদের বাংলাদেশে, ভারতে কিংবা নেপালে যেরকম দেখে অভ্যস্ত সেরকম নয়।
পোশাক-আশাকে ওদের অনেক স্মার্ট মনে হলো, মুখের প্রশান্তির ভাবটা অবশ্য একইরকম।
বৌদ্ধরা সাধারণত শান্তিপ্রিয় হয়। যদিও আমি কখনো মিয়ানমার আর শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ-সন্ন্যাসীদের দেখিনি। আমার শ্রীলঙ্কান ও মিয়ানমারের বন্ধুদের কাছে শুনেছি, ওখানকার অনেক বৌদ্ধ-সন্ন্যাসীর মধ্যে উগ্রতার বিষয়টি আছে। অনেকটা জায়গাজুড়ে সেনুনছান টেম্পল। ভেতরে ঢুকেই বেশ প্রশান্তি লাগছে। পাহাড়ের পাদদেশে মন্দির, সবুজে ঢাকা, কাঠ ও পাথরে নির্মিত মনকাড়া সব স্থাপত্যশৈলী। বিস্ময় জাগে, এত প্রাচীনকালে, যখন আধুনিক কোনো প্রযুক্তিই আবিষ্কৃত হয়নি, মানুষ কেমন করে এমন সুন্দর, দীর্ঘস্থায়ী স্থাপত্য নির্মাণ করতে পারল! অনেকক্ষণ আমরা মন্দির এবং এর চারপাশ ঘুরে-ঘুরে দেখলাম। এক জায়গায় মজার একটি দৃশ্য আমার নজর কাড়ল, পাহাড় থেকে চুঁইয়ে-চুঁইয়ে গড়ানো জল পাথরে নির্মিত ছোট-ছোট চৌবাচ্চায় ধরা আছে। একেবারে বিশুদ্ধ পানীয় জল, এত স্বচ্ছ আর সুস্বাদু! একেবারে প্রাকৃতিক মিনারেল ওয়াটার।
পশ্চিম সাগরে সূর্যাস্ত দেখতে যাব, তাই আমরা মন্দিরে আর বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। ওখান থেকে ফিরে একটি রেস্তোরাঁয় একটু আগেভাগেই রাতের খাবার সারতে হলো। কারণ সূর্যোদয় দেখে এসে হাতে সময় তেমন থাকবে না, এর পরেই ইয়াং-রে’কে শিক্ষক সমাবেশে বক্তব্য দিতে হবে। তাই বিকেল সাড়ে ৫টায় আমরা ডিনার সেরে ফেললাম। প্রচুর খাবার ছিল, সব কোরিয়ান ট্র্যাডিশনাল খাবার – তেওকগালবি (গ্রিল করা গালবি প্যাটিস), ওরি ট্যাং (হাঁসের স্যুপ) এবং ইউকজিওন (প্যান-ভাজা পেটানো গরুর মাংস)।
কোরিয়ানরা অবশ্য সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে ডিনার করে। এটা আমি পৃথিবীর অনেক দেশেই দেখেছি। এতে ভালো দিক হচ্ছে, রাতের খাবারের পরে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে অনেকটা সময় পাওয়া যায় খাবার হজম করতে, যেটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট গাড়িতে চড়ে আমরা সমুদ্রসৈকতে এলাম। সুন্দর, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সৈকত, কোথাও সামান্য কাগজের টুকরোও নেই। আমরা একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে বসলাম, যদিও মানুষজন খুব বেশি ছিল না, পাশেই একটা গাড়ি-বাড়ি নজরে পড়ল। গাড়ি-বাড়ি মানে গাড়িটাই বাড়ি, এর ভেতরে কিচেন, বসার সোফা পাতা। সামনে তাঁবু খাটানো, পুরো পরিবার চলে এসেছে সাগর পাড়ে উইক-এন্ডের দুদিন কাটাতে, রাতেও এখানেই কাটাবে ওরা। আমি মনে-মনে আমাদের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সঙ্গে তুলনা করছিলাম, রাত ৯টার পরে যেখানে কোনো নিরাপত্তা থাকে না।
হলুদ সাগরের সৈকতে বসে দুই যুগ আগের একটা ঘটনা মনে পড়াতে হঠাৎ আমার হাসি পেল খুব। ১৯৯২ সালের কথা – সরকার আমিন, শিবলী সাদিক, উত্তম সেন, জাহাঙ্গীরভাই আর আমি কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে আমিন ভাই, শিবলীভাই আর আমি তখন কবিতার তরুণ-তুর্কি, আর উত্তমদা শিল্পকলার শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীর ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি করছেন, আমরা সবাই ছাত্র। রাতের বেলা, তখন ৯টা কি সাড়ে ৯টা হবে, আমরা কক্সবাজার সৈকত ধরে হাঁটছি। আমার কি খেয়াল হলো, হঠাৎ মনে হলো – প্রকৃতির কাছে এলে প্রাকৃতিক হতে হয়, শিবলীভাইয়ের কাছে কাপড়-চোপড় গছিয়ে দিয়ে আমি নেমে গেলাম সাগরে। এদিকে অনেকক্ষণ পরে আমিনভাইয়ের ডাকাডাকিতে জলমানব ডাঙ্গায় এসে দেখি শিবলীভাইয়ের মুখ ভার, কথা বলছেন না, ছিনতাইকারী, নাকি পুলিশের পাল্লায় যেন পড়েছিলেন …
দক্ষিণ কোরিয়ার অর্ধেকেরও বেশি পাহাড়, প্রায় পঞ্চান্ন ভাগ পাহাড়ি অঞ্চল। তিন দিকেই সাগর – পশ্চিমে পশ্চিম সাগর (ইয়েলো সি), পূর্বে পূর্ব সাগর (জাপান সি), দক্ষিণে পূর্ব চীন সাগর আর উত্তরে উত্তর কোরিয়া। ভাবলে বিস্ময় জাগে, ওরা এরকম পাহাড়ি একটা দেশকে তার বিরূপ প্রকৃতিকে তার জায়গায় থাকতে দিয়েও কীভাবে এমন ঈর্ষণীয় উন্নয়ন করল, সমৃদ্ধ একটা দেশে পরিণত করল! সূর্যটা রং ছড়াতে-ছড়াতে পশ্চিমে ধীরে ধীরে নামতে নামতে পাহাড়ের আড়ালে হঠাৎ নাই হয়ে গেল। ওইদিকে চীনের একটা অংশ, আমরা যখন ফিরে আসছি ইয়ুথ হোস্টেলে, আকাশে চাঁদ দেখা দিয়েছে, চারদিকে হুহু বাতাস, ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। মনে হচ্ছে শীতের
শুরু-সময়।
সন্ধ্যার পরে ইয়াং-রে শিক্ষক সমাবেশে প্রায় দেড় ঘণ্টা বক্তব্য রাখলেন। তার আগে অন্য আরেকজন বক্তব্য রেখেছিলেন, তাঁর নাম পরে জেনেছি – পাক-জুন ছং। ওই ভদ্রলোকের বলার ভঙ্গি ও প্রেজেন্টেশন পদ্ধতি খুব ভালো লেগেছে, আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি দরাজ গলায় গণসংগীত গেয়ে উঠছিলেন। ভাষা না বুঝলেও গানের সুর, গলার আবেগ ও দেহের ভাষা আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করছিল। এখানে পুরো লেকচারই হচ্ছিল কোরিয়ান ভাষায়। পরে কিম ইয়াং-রে আমাকে তার সারমর্ম বলেছিলেন। ১৯৮০ সালে গোয়াংজুতে যে
গণতান্ত্রিক-আন্দোলন হয়েছিল, তার স্পিরিট কিভাবে স্কুলপর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায়,
সে-বিষয়ে দুদিনব্যাপী এ শিক্ষক সম্মেলন। আশপাশের প্রদেশের বিভিন্ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৩৫ জন শিক্ষক এ-সম্মেলনে অংশ নেন। মনে হলো, ইয়াং-রে’র বক্তব্যও বেশ ভালো হয়েছে। কারণ বক্তব্যের মাঝে মাঝেই অংশগ্রহণকারীরা করতালি দিয়ে উঠছিলেন, আর মাঝে মধ্যে সমস্বরে আশ্চর্যবোধক শব্দ করছিলেন – ওওওও!
রাত সাড়ে ১০টার দিকে ইয়ুথ হোস্টেলে আমরা যার যার রুমে চলে গেলাম। মেঝেতে ঢালাও বিছানা পাতা, এক রুমে চার-পাঁচজন করে। ইম-দং হো, খন-হিউক মিন, অন্য আরেকজন শিক্ষক আর আমি এক রুমে। আমরা শাওয়ার নিয়ে মেঝেতে বসে আড্ডা জমিয়েছি, কোরিয়ান আঞ্চলিক পানীয় ‘মাকালু’ আর ‘কাস’, আর কিছু স্ন্যাকস নিয়ে দারুণ আড্ডায় মশগুল হয়ে পড়লাম। রাত ১টার দিকে পাশের রুমে চলা শিক্ষকদের অন্য একটি আড্ডা থেকে একজন এলেন, বললেন, ‘চলো পাশের রুমে, তোমার সঙ্গে এখানকার শিক্ষক-পার্টিসিপেন্টরা পরিচিত হতে চাইছেন।’
আমি গেলাম পাশের রুমে, আমার সঙ্গে ইম-দং হো। সবার সঙ্গে পরিচিত হলাম, ইম-দং হো দোভাষীর কাজ করছিলেন, তাঁদের কথা আমাকে, আর আমার কথা তাঁদের অনুবাদ করে দিচ্ছিলেন। তাঁরা আমাকে তাঁদের স্থানীয় পানীয় ‘সজু’ দিয়ে আপ্যায়িত করলেন। আমাকে কিছু বলতে বলা হলো। আমি তিনটি বিষয় নিয়ে কথা বললাম। ১৯৫২-র ভাষা-আন্দোলন, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ আর কবি রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উৎস যে আমাদের দেশের মানুষের ভাষার জন্য আত্মত্যাগের ফল, এটা জেনে ওঁরা খুব আশ্চর্য হলেন। দুজন ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ওই দুজনও খুব সামান্য জানেন। তবে তাঁরা ভারত চেনেন, তাঁরা অবশ্য বলছিলেন ‘ইন্দি’। আমি যখন বললাম, আমাদের বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এশিয়ায় প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কেউ কেউ বললেন, ‘তিনি তো ইন্ডিয়ার।’ আমি তাঁদের ভুল ভাঙিয়ে দিয়ে বললাম – রবীন্দ্রনাথ যতটা ইন্ডিয়ার, ততটাই বাংলাদেশের। কারণ যখন তাঁর সাহিত্যচর্চা করেছেন, তাঁর জীবদ্দশায় একটাই দেশ ছিল আমাদের। পরে ভাগ হয়েছে। বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়া – এই দুই দেশের জাতীয় সংগীতও রবীন্দ্রনাথের লেখা। আমি আরো বললাম, দেশ ভাগ হয়েছে, কিন্তু রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ এই তিন কবিকে আমরা ভাগ হতে দিইনি। দুই দেশে তাঁরা এখনো সমান সম্মানের পাত্র।
এখানে এসে দারুণ একটি তথ্য জানলাম। দক্ষিণ কোরিয়ায় ওদের মাধ্যমিক ক্লাসে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা পাঠ্য। রবীন্দ্রনাথকে ওঁরা বলেন ‘থাকুর’। একজন শিক্ষক বলছিলেন, ১৯১৭ সালে রবীন্দ্রনাথ কোরিয়া নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন, যখন জাপান কোরিয়া দখলের পাঁয়তারা করছিল। ওই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ কোরিয়ার পক্ষে কণ্ঠ তুলেছিলেন। এটা আমার জানা ছিল না। শুনে ভীষণ ভালো লাগলো। তখনো কোরিয়া আলাদা দেশ হয়নি, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া একটাই দেশ ছিল। কোরিয়া নিয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা কবিতাটির নাম ছিল ‘Lamp of the East’। তাঁর কবিতায় তিনি কোরিয়াকে ‘প্রাচ্যের প্রদীপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। কবিতাটির কয়েকটি চরণ এমন –
এশিয়ার স্বর্ণযুগে, কোরিয়া ছিল –
প্রদীপ বাহকদের মধ্যে একটি
এবং সেই প্রদীপটি আবারও –
জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় রয়েছে
প্রাচ্যকে আলোকিত করার জন্য।
আড্ডার পরে আমরা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সামনে রেখে একসঙ্গে ছবি তুললাম। আমার উদ্দেশে পাক-জুন ছং একটি গণসংগীত গাইলেন। রাত ২টার দিকে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমাদের রুমে ফিরে এলাম। গোয়াংজু শহরে এই সময় গরমে রাতে এসি ছেড়ে ঘুমাতে হয়। আর এখানে বেশ পৌষ-শুরুর ঠান্ডা, রাতের বেলা কম্বল গায়ে শুতে হলো। পাহাড়ে অনেক গাছপালা থাকাতে রাতের বেলা ঠান্ডা পড়ে, সকালে ঘাসগুলো কুয়াশায় ঢাকা থাকে। রুমে এসেই শুয়ে পড়লাম, কারণ পরদিন সকালে জাগতে হবে ভোর ৫টায়, পাহাড়ে হাইকিং-এ যাওয়ার জন্য।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.