গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব-২০১৮

বাংলাদেশের শিল্পকলা একাডেমিতে গত ৫ থেকে ১৫ অক্টোবর ২০১৮, ১১ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো ‘গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব-২০১৮’। শিরোনাম ‘সাংস্কৃতিক উৎসব’ হলেও এ-আয়োজন নাট্যোৎসব হিসেবেই প্রতীয়মান সর্বত্র। প্রতিদিন সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলে নিয়মিত নাট্য-প্রদর্শনী হয়। এছাড়া প্রতিদিন বিকেলে পরিবেশনা-সংস্কৃতির অঙ্গাঙ্গি পথনাটক, মূকাভিনয়, আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্য প্রভৃতি উন্মুক্ত মঞ্চে পরিবেশিত হয়। আয়োজকদের ভাষ্যমতে, এবারের উৎসবে আড়াই হাজার সংস্কৃতিকর্মী অংশগ্রহণ করেছেন। সপ্তমবারের মতো ছিল এ-উৎসব আয়োজন। প্রতিবছর দুই বাংলার সংস্কৃতিকর্মীদের সমন্বয়ে ‘গঙ্গা-যমুনা উৎসব পর্ষদে’র অধীনে এ-আয়োজন হয়ে থাকে। এবারের উৎসবে সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন, শিল্পকলা একাডেমি এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড।

৫ অক্টোবর ২০১৮ তারিখ সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মূল হলে সপ্তমবারের মতো ‘গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব’ উদ্বোধন করেন দুই বাংলার দুই নাট্যকৃতি বিভাস চক্রবর্তী ও মামুনুর রশীদ। উপস্থিত ছিলেন দুই বাংলার সংস্কৃতি-নাট্যমোদীরা। উদ্বোধনী পর্বে বক্তব্য রাখেন নাট্যজন আতাউর রহমান, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ ও লিয়াকত আলী লাকী। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। আরো বক্তৃতা করেন উৎসব পর্ষদের আহবায়ক গোলাম কুদ্দুছ ও সদস্য সচিব আকতারুজ্জামান। উদ্বোধনীর দিন মূল হলে ভারতের ড্যান্সার্স গিল্ডের নৃত্যনাট্য তোমারই মাটির কন্যা এবং স্টুডিও থিয়েটার হলে চন্দ্রকলা থিয়েটারের তন্ত্রমন্ত্র নাটক প্রদর্শিত হয়।

কলকাতার অনীক নাট্যদল ১৯৯৮ সালে কলকাতায় শুরু করে এ-উৎসব। ১৭ বছরের ধারাবাহিকতায় সম্প্রসারিত রূপে বাংলাদেশে প্রথম আয়োজিত হয় ২০১২ সালে। ভারতের নদী ‘গঙ্গা’ এবং বাংলাদেশের ‘যমুনা’ পৃথক খ–র নদী নৈর্ব্যক্তিকতায় সাংস্কৃতিক মিলন বন্ধনের ঐক্যে এর নামকরণ করা হয় ‘গঙ্গা-যমুনা নাট্যোৎসব’। প্রথমদিকে এ-উৎসব শুধু নাটককেন্দ্রিক থাকলেও এখন শুধু দুই বাংলার নাগরিক পরিবেশনা-সাংস্কৃতিক নানা বিষয় নিয়ে উদযাপিত হয়ে থাকে।

এবারের উৎসব-আয়োজনে ছিল অন্যান্য বছরের চেয়ে ভিন্নমাত্রা। দুই বাংলায় সংস্কৃতিকর্মীদের মিলনমেলায় পরিণত করাই ছিল আয়োজকদের অভীষ্ট। ছয় বছর ধরে অভিন্ন সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা বিনিময় ও সম্প্রীতির বন্ধনকে দৃঢ় করতে ঢাকা ও কলকাতায় দু-জায়গাতেই আয়োজিত হয় এ-উৎসব।
নাট্য-প্রদর্শনী মূল ইভেন্ট হলেও নাগরিক পরিবেশনা সংস্কৃতিচর্চার প্রায় প্রতিটি শাখা নিয়ে কাজ হয়েছে। এবারের উৎসবে দুদেশের প্রায় শখানেক দল অংশগ্রহণ করে। ভারতের চারটি দল; ঢাকা ও ঢাকার বাইরের ২৬টি নাট্যদল অংশগ্রহণ করে। ৩০টি মঞ্চনাটক, নয়টি পথনাটক, ১৮টি নৃত্য, ১৮টি দলের সংগীত, ১৮টি আবৃত্তি নিয়ে ছিল এবারের আয়োজন। এছাড়া উৎসব নিয়ে একক আবৃত্তি ও একক সংগীত পরিবেশিত হয়। উৎসবের উদ্বোধনী আয়োজনের অতিথি আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘দুই বঙ্গের আত্মীয়তা শুধু ভাষার কারণেই নয়, সংস্কৃতির শেকড়ের কারণে। এ ধরনের সাংস্কৃতিক উৎসব দুই দেশের সংস্কৃতির আদান-প্রদানে সহায়তা করবে।’

‘গঙ্গা-যমুনা নাট্যোৎসব’ আয়োজনে ভারতের অনীক নাট্যদলের কর্ণধার অমলেশ চক্রবর্তী ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। অমলেশ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরে তারা কলকাতায় এ-উৎসব আয়োজন করে আসছিল। প্রতিবছরই বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দলকে তারা আমন্ত্রণ জানিয়েছিল নাট্য-প্রদর্শনীর জন্য। তাদের উৎসবে বাংলাদেশের অসংখ্য নাট্যদল অংশগ্রহণ করেছে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আকতারুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন ‘সময়’ নাট্যদল অন্যতম। সে-বন্ধুত্বের সূত্র ধরেই ২০১২ সালে বাংলাদেশে প্রথম আয়োজিত হয় এ-উৎসব। সে-বছর আহবায়ক হিসেবে অমলেশ চক্রবর্তী ও আকতারুজ্জামানের নামটি প্রধানরূপে দেখা যায়। প্রথমবারের মতো এদেশে আয়োজিত এ-উৎসবে নাট্যকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষেত হয়। তবে পরবর্তীকালে এদেশের প্রথিতযশা নাট্যকর্মীরাও এ-উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। অমলেশ চক্রবর্তী বছর দুই আগে প্রয়াত হয়েছেন। মাসকয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের গোলাম কুদ্দুছ অমলেশ চক্রবর্তী সম্মাননায় ভূষিত হন। দুই দেশের অভিন্নধারার সংস্কৃতি বিনিময় ও দীর্ঘ চার দশক ধরে ‘প্রগতিশীল’ সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অসামান্য অবদানের জন্য গোলাম কুদ্দুছকে এ-পদক প্রদান করা হয়।

দীর্ঘদিনের ‘গঙ্গা-যমুনা নাট্যোৎসবে’র আয়োজক অনীক নাট্যদল এবারের উৎসব উদ্বোধনীর পরদিন ৬ অক্টোবর শনিবার শিল্পকলা একাডেমির মূল হলে পরিবেশন করে নাটক বিষঘুম। নাটকটি রচনা করেছেন জ্যোতিষ্মান চট্টোপাধ্যায়, নির্দেশনা দিয়েছেন অরূপ রায়। তারা ইতোপূর্বে শকুন্তলাসহ নানা নাটক প্রদর্শন করেছে এদেশে। এবারের নাটকটি প্রসেনিয়াম মঞ্চে বাস্তববাদী ধারায় উপস্থাপিত। নাটকের গল্প ও প্রলম্বিত গতি নিয়ে দর্শকদের মধ্যে অনেকেই নেতিবাচক অনুভূতি প্রকাশ করেন। একইদিন এক্সপেরিমেন্টাল হলে প্রদর্শিত হয় থিয়েটারের মেরাজ ফকিরের মা। এ-নাটকটি বাংলাদেশে বহুল পরিচিত একটি নাটক। বাংলাদেশের প্রথিতযশা নাট্যজন আবদুল্লাহ আল মামুনের জনপ্রিয় নাটকগুলোর মধ্যে এটি একটি। আশি ও নববইয়ের দশকে এ-নাটকটির গ্রহণযোগ্যতা
ছিল তুঙ্গে। গ্রামীণ বাঙালি জীবনে ধর্ম নিয়ে অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও শঠতা-প্রতারণা নাটকটির পরতে পরতে। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনায় আবদুল্লাহ আল মামুন। এ-নাটকে ফেরদৌসী মজুমদার, ত্রপা মজুমদার, রামেন্দু মজুমদারসহ অনেক প্রথিতযশা নাট্যজন নিয়মিত প্রদর্শনীতে অভিনয় করে থাকেন।

৭ অক্টোবর রোববার মূল হলে প্রাচ্যনাট পরিবেশন করে এ ম্যান ফর অল সিজনস। ষোড়শ শতকের ইল্যান্ডের সমাজবাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে রচিত নাটক এটি। ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি ও পোপের মধ্যে বিবদমান সাংঘর্ষিক অবস্থাকে কেন্দ্র করে নাটকটি আবর্তিত। প্রাচ্যনাট এ-নাটকটি ২০০০ সালের দিকে মঞ্চে আনে। এ-নাটকের কেন্দ্রীয় টমাস মোর চরিত্রে অভিনয় করেন আবুল কালাম আজাদ। দীর্ঘদিন পর নাটকটি তারা পুনর্নির্মাণ করেছে। সম্প্রতি এ-উৎসবকে কেন্দ্র করে নাটকটির একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। নাটকটি অনুবাদ করেছেন শাহেদ ইকবাল এবং নির্দেশনায় ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। একইদিন এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে প্রদর্শিত হয় আরণ্যক নাট্যদলের নতুন নাটক দি জুবিলি হোটেল। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনায় ছিলেন মান্নান হীরা। এ-নাটকের কাহিনি মফস্বল শহরের একটি চায়ের দোকানকে ঘিরে। যেখানের আড্ডায় হারু ম-ল নামে এক প্রবীণ নাট্য-নির্দেশক ‘সুলতানা রাজিয়া’ নামে একটি নাটক করবেন বলে দীর্ঘদিন ধরে প্রস্ত্ততি নিতে  থাকেন। কিন্তু ২০ বছর পার হয়ে গেলেও নায়িকা চরিত্রে অভিনেত্রী পাওয়া যায় না। হঠাৎ এলাকায় ‘দি ঘোষ ম্যাজিক পার্টি’ নামে এক জাদুর খেলা এলে সেখানে নৃত্যশিল্পীকে সুলতানা রাজিয়া চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন তিনি। কিন্তু গোল বাধে অন্যত্র। বাউল, মমতা নানা বৈশিষ্ট্যের মানুষে ভরা কাহিনি। এরই মধ্যে মনোলোভা ধর্ষিত হলে ১৪৪ ধারা জারি হয়। ঘটনা তখন ভিন্নদিকে মোড় নেয়। জুবিলি হোটেল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ-ধরনের এক গল্প নিয়ে দি জুবিলি হোটেল নাটকটি আবর্তিত। এ-নাটকে মান্নান হীরা, তমালিকা কর্মকারসহ প্রতিথযশারা অভিনয় করেছেন।

৮ অক্টোবর সোমবার, প্রাঙ্গণেমোর পরিবেশন করে আওরঙ্গজেব। এ-নাটকটি প্রাঙ্গণেমোর নাট্যদলের প্রথম দিককার প্রযোজনা। অভিনয়, সংগীত, ডিজাইন ও নির্দেশনায় এ-নাটকটি প্রাঙ্গণেমোর নাট্যদলকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। অনেকদিন পর নাটকটির আবার প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হলো। মুঘল সাম্রাজ্যের শেষের দিকে আওরঙ্গজেব শাসনপর্বটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। নাটকটির কাহিনি রাজনীতিনির্ভর হলেও এতে গুরুত্ব পেয়েছে মানবিকতাবোধ। আওরঙ্গজেব চরিত্রের অভিনয় দর্শকহৃদয়ের অতলকে স্পর্শ না করে পারে না। সংলাপনির্ভর নাটকটির মাধ্যমে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারকে চরম এক বিষবাষ্প হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। নাটকটির রচনায় মোহিত চট্টোপাধ্যায় এবং নির্দেশনায় অনন্ত হীরা। এই দিনে এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে পরিবেশিত হয় ঢাকা পদাতিকের ট্রায়াল অব সূর্য সেন। নাটকটি ঢাকা পদাতিকের সাম্প্রতিক প্রযোজনা। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনায় মাসুম আজিজ। সূর্য সেনকে নিয়ে নতুন করে ভাবা কেন? পদাতিক নাট্যদল নতুন করে নতুন প্রশ্নের আলোকে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের এ-আত্মত্যাগীর পুনর্জাগরণ ঘটাতে চেয়েছে। ইতিহাস এখানে অবিবেচ্য; আন্দোলনের প্রেষণাই নাট্যগতির মূল। নাট্যকার ইতিহাস বর্ণনা করতে চাননি; প্রয়োজনানুসারে ইতিহাস উঠে এসেছে। আজকের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সূর্য সেনকে প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করিয়েছেন এ-নাটকে। উত্তর খুঁজেছেন এ-সময়ের আলোকে। সূর্য সেন চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন বর্ষীয়ান অভিনেতা নাদের চৌধুরী। একইদিন স্টুডিও থিয়েটার হলে পরিবেশিত হয় সংস্কার নাট্যদলের বশীকরণ। অতি হালকা ভাবনাও যে অসাধারণ আনন্দের শিল্পমার্গ হয়ে দর্শককে বশীভূত করতে পারে, তা নতুন করে দেখা গেল সংস্কার নাট্যদলের এ-নাটকে। রবীন্দ্রনাথের হাস্য-কৌতুকের সরলগল্প সৃজনশীলতার নৈপুণ্যে অনবদ্য প্রাণোদ্দীপ্ততায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। সংস্কার নাট্যদলের বশীকরণ নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন ইউসুফ হাসান অর্ক। নাটকের প্রেক্ষাপট কলকাতার বিংশ শতকের হিন্দু সমাজ। যেখানে একদিকে বিরাজ করছে ইয়ং বেঙ্গলের মতো পাশ্চাত্যবাদী বিজ্ঞানমনস্কতার চর্চা, অন্যদিকে গোঁড়া সনাতন ধর্মের ভক্তিবাদ-বিশ্বাসী আচার। সে-সময় যুক্তিবাদী অন্নদা ও ভক্তিবাদী আশুর কৌতুকপূর্ণ  নানা ঘটনা, উপঘটনা ও জটিলতার মধ্য দিয়ে দুই নারীতে বশীকরণের হাস্যাত্মক চিত্রই এ-নাটক। মূলত বিংশ শতকের সমাজবাস্তবতাকে নানাভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয়েছে বশীকরণে। উন্নত শিল্পরুচি, পরিমিতিবোধ, কালারফুল ও লাস্যময়ী মোহনীয়তা বিধৃত হয়েছে নাটকে।

৯ অক্টোবর মঙ্গলবার মূল হলে পরিবেশিত হয় ভারতের প্রাচ্যনাট্যদলের লালসালু। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র লেখনীর নাট্যরূপ দিয়েছেন কৌশিক চট্টোপাধ্যায় এবং নির্দেশনায় অবমত্মী চক্রবর্তী। উপন্যাসে মজিদ নামে এক বুভুক্ষু মানুষ বাঁচার তাগিদে শস্যবহুল মহববতনগর গ্রামে পরিত্যক্ত একটি কবরকে মাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গড়ে তোলেন নিজের আধিপত্য ও ক্ষমতার বলয়। যদিও উপন্যাসের শেষে সে-আধিপত্যের ভিত টলে যায়। কিন্তু তার ধর্মবিশ্বাস আর ভ-ামির অনবদ্য চিত্র আমাদের সামনে অনবদ্যভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে। ধর্মপালন নিন্দনীয় নয়, কিন্তু ধর্মকে আশ্রয় করে ভ-ামি নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। ভারতের প্রাচ্য নাট্যদলের লালসালু ছিল একটু ভিন্ন প্রকৃতির। উপন্যাসটির গল্প-কাঠামোর বহিরাঙ্গ ঠিক রেখে উপন্যাসকে ছাপিয়ে চলে গেছে ভিন্ন আরেক মাত্রায়। উপন্যাসে বিধৃত মজিদ চরিত্রের ভ-ামির স্থলে ধর্মের নামে নানা ভ-ামিই শৈল্পিকমাত্রায় ফুটে উঠেছে এ-নাটকে। উপন্যাসের গল্পের বাঁক, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতগুলো পুরো বাদ দিয়ে নির্দেশক ভারতীয় মাজারপ্রথায় মুসলিম জীবনবাস্তবতাকেই তুলে ধরতে প্রয়াসী ছিলেন, যা ছিল আমাদের কাছে ভিন্নমাত্রার এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয়। মজিদ চরিত্রে বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাস্তববাদী অভিনয় দর্শকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা অর্জন করে। একইদিন এক্সপেরিমেন্টাল হলে লোকনাট্যদল (বনানী) প্রদর্শন করে তাদের নাটক ঠিকানা। নাটকটি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত। উৎপল দত্তের রচনায় নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন প্রণবানন্দ চক্রবর্ত্তী। এছাড়া স্টুডিও থিয়েটার হলে প্রদর্শিত হয় জাগরণী থিয়েটারের আমি ও শ্যামা। একজন শিল্পীর আত্মত্যাগকে কেন্দ্র করে নাটকটি আবর্তিত। শিল্পত্বের আবেগে যেন ভালোবাসাও গৌণ হয়ে দাঁড়ায়। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনায় অনিকেত পাল।

১০ অক্টোবর বুধবার মূল হলে মঞ্চস্থ হয় ঢাকা থিয়েটারের ধাবমান। সেলিম আল দীন-রচিত এ-নাটকটি ঢাকা থিয়েটার ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মঞ্চে আনে। নির্দেশনায় প্রথিতযশা মঞ্চাভিনেত্রী শিমূল ইউসুফ। এক ষ-মোষের বিয়োগান্ত পরিণতিই এক নাটকের মূল বিষয়বস্ত্ত। অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য ষ-মোষটি পালাতে থাকে। তিন দিন তিন রাত ধরে পালাতে পালাতে উপলব্ধি করে, পালানোর মধ্যে মুক্তি নেই। মানবপিতার স্নেহময়ী হাত তাকে স্নেহের ছায়ায় ঢেকে রাখে না। বরং নির্মম সত্য বরণ করে নেওয়ার মধ্যেই মুক্তি। মৃত্যুও প্রকৃত অর্থে মুক্তি। নৃত্য-গীত, অভিনয়, বর্ণনা-বন্দনা মিলে অসাধারণ এক শৈল্পিক প্রযোজনা।

একইদিন এক্সপেরিমেন্টাল হলে পরিবেশিত হয় শব্দনাট্যচর্চা কেন্দ্রের চম্পাবতী। নাটকটি বাঙালি জীবনের অস্পৃশ্য জাতিগোষ্ঠী বেদে সম্প্রদায়ের জীবনসংগ্রাম, প্রেম-বিরহগাথা নিয়ে। কবি জসীমউদ্দীন ১৯৫১ সালে বেদের মেয়ে গীতিনাট্য রচনা করেন। এটিকে নবনাট্যায়ন করেছেন সৈয়দ শামসুল হক। জসীমউদ্দীনের লেখায় বেদে সমাজের জীবনচিত্র প্রাধান্য পেলেও সৈয়দ শামসুল হক প্রধান চরিত্র চম্পাবতী শিরোনামে নামকরণের নাটকে বেদেনি চম্পার জীবন-প্রেম-বিরহই প্রাধান্য পেয়েছে। নাটকটির নির্দেশনায় খোরশেদ আলম। একইদিন স্টুডিও থিয়েটার হলে পরিবেশিত হয় নাট্যযোদ্ধার নাটক অসমাপ্ত। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনায় ফয়সাল আহমেদ।

১১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার মূল হলে নাগরিক নাট্যাঙ্গন পরিবেশন করে ক্রীতদাসের হাসি। শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাস অবলম্বনে এর নাট্যরূপ দিয়েছেন হৃদি হক এবং নাটকটি নির্দেশনায় লাকী ইনাম। উপন্যাসটিতে সামন্ততান্ত্রিক বাগদাদের পটভূমিতে পূর্ব পাকিস্তানের নির্যাতিত মানুষের শোষণ ও নিপীড়নের রূপক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে যেন। অনবদ্য এক শৈল্পিক পরিবেশনা এটি। নাগরিক নাট্যাঙ্গনের ইতোপূর্বে অসংখ্য নাটক অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। একইদিন এক্সপেরিমেন্টাল হলে পরিবেশিত হয় বিবর্তন যশোরের মাতব্রিং। অরণ্যচারী মানুষের জীবনসংগ্রাম, প্রেম-ভালোবাসা নাটকটির পরতে পরতে। নৃত্য, গীত, অভিনয় ও নাটকীয়তায় পূর্ণ অনন্যসাধারণ এক নাটক এটি। নাটকটি রচনা করেছেন সাধনা আহমেদ এবং নির্দেশনা দিয়েছেন ইউসুফ হাসান অর্ক। এছাড়া স্টুডিও থিয়েটার হলে পরিবেশিত হয় নাটক কেনারাম বেচারাম। নাটকটির নির্দেশনায় কাজল মজুমদার।

১২ অক্টোবর শুক্রবার, ভারতের বহরমপুর কলাকেন্দ্র পরিবেশন করে তাসের দেশ (নৃত্যনাট্য)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তাসের দেশ অবলম্বনে নৃত্যনাট্যটির নির্দেশনা দিয়েছেন অরিন্দম ব্যানার্জি। একইদিন এক্সপেরিমেন্টাল হলে প্রদর্শিত হয় দেশ নাটকের আলোড়ন সৃষ্টিকারী নাটক নিত্যপুরাণ। নাটকে মহাভারতের একলব্যের পুরাণগাথা নতুন যুগের দৃষ্টিতে নবতর ব্যাখ্যায় অনবদ্যভাবে তুলে ধরেছেন নাট্যকার। নাটকটি যেন মহাভারতের এক নতুন পাঠ। নাট্যকার নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন প্রচলিত ইতিহাস ও তার ব্যাখ্যাকে। মঞ্চ, অভিনয়, সংগীত সবকিছু মিলে এক অসাধারণ পরিবেশনা। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনায় মাসুম রেজা। স্টুডিও থিয়েটার হলে পরিবেশিত হয় স্বপ্নদলের চিত্রাঙ্গদা। নাটকটি বাঙলা নাট্যাঙ্গিকে উদ্ভাসিত। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা অবলম্বনে রচিত নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন জাহিদ রিপন।

১৩ অক্টোবর, শনিবার একাডেমির মূল হলে প্রদর্শিত হয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি-প্রযোজিত নাটক হ্যামলেট। নাটকটির মূল নাট্যকার শেক্সপিয়র, অনুবাদ সৈয়দ শামসুল হক এবং নির্দেশনা দিয়েছেন আতাউর রহমান। একইদিন এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে প্রদর্শিত হয় সিরাজগঞ্জের তরুণ সম্প্রদায়ের নাটক অসমাপ্ত। নাটকটিতে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি ভিন্ন দৃষ্টি ও আঙ্গিকে ফুটে উঠেছে। নাটকটি রচনায় মাহফুজা হিলালী এবং নির্দেশনায় আমিনুর রহমান মুকুল। স্টুডিও থিয়েটার হলে প্রদর্শিত হয় অবয়ব নাট্যদলের ফেরিওয়ালা। নাটকটিতে অস্পৃশ্য মানুষের জীবনচিত্র অত্যন্ত স্পর্শকাতরতায় ফুটে উঠেছে। নাটকটি রচনায় আসাদুজ্জামান দুলাল এবং নির্দেশনায় শহিদুল হক শ্যানন।

১৪ অক্টোবর রোববার মূল হলে প্রদর্শিত হয় মহাকাল নাট্য-সম্প্রদায়ের নাটক শ্রাবণ ট্র্যাজেডি। সম্প্রতি প্রযোজিত এ-নাটকটি বাংলাদেশের নাট্যমহলে বেশ আলোচিত। আনন জামানের রচনায় এ-নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন আশিকুর রহমান লিয়ন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলনের পুরোধা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার হৃদয়বিদারক ঘটনাকে অবলম্বন করে উপস্থাপিত এ-নাটক। এ নাটকে দলমত নির্বিশেষে নতুন কালে নতুন বাস্তবতায় খুনিদের দাঁড় করানো হয়েছে আরেক জনতার ট্রায়ালে। আলো, সংগীত, অভিনয় মিলে অনবদ্য নাটকটি। একইদিন এক্সপেরিমেন্টাল হলে প্রদর্শিত হয় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নাটক গ্যালিলিও। মুক্তজ্ঞান আর অন্ধবিশ্বাস-অজ্ঞতার দ্বন্দ্বে বিয়োগান্ত পরিণতির শিকার ‘গ্যালিলিও’ চরিত্র বিশ্বে অত্যন্ত পরিচিত। বের্টল্ট ব্রেশটের দ্য লাইফ অব গ্যালিলিও গ্যালিলি অবলম্বনে গ্যালিলিও শিরোনামে নাটকটির অনুবাদ করেছেন আবদুস সেলিম। জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের বর্ষীয়ান অভিনেতা আলী জাকের। অনবদ্য প্রাণোদ্দীপ্ত সাত্ত্বিক বিশ্বাসে প্রোথিত গভীরতায় তাঁর অভিনয়। এক্সপেরিমেন্টাল হলের কানায় কানায় পূর্ণ দর্শকের উপস্থিতিতে প্রদর্শিত হয় নাটকটি। নাটকটিতে অধ্যক্ষ, পোপ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন এ-সময়ের সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। আশির দশকের জনপ্রিয় এ-নাটকটি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় পুনরায় মঞ্চে এনেছে। নাটকটি প্রথম নির্দেশনা দিয়েছিলেন আতাউর রহমান। নতুন নির্মিত এ-নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন পান্থ শাহরিয়ার। এদিন স্টুডিও থিয়েটার হলে পরিবেশিত হয় নাট্যদলের ইতিবৃত্ত নাটকটি।

১৫ অক্টোবর, সোমবার সমাপনী দিনে মূল হলে থিয়েটার আর্ট ইউনিটের মর্ষকাম নাটকটি পরিবেশিত হয়। স্থান-কালের গ– পেরিয়ে রাষ্ট্রনীতিকদের চিরন্তন নিগ্রহের ব্যঙ্গরসাত্মক চিত্র মর্ষকাম। নাটকটি রচনা করেছেন আনিকা মাহিন এবং নির্দেশনা দিয়েছেন রোকেয়া রফিক বেবী। জানা যায়, ‘মর্ষকাম’ শব্দটি যৌন মনোবিজ্ঞানের পরিভাষা হিসেবে নিপীড়িত মনোবৃত্তিতেই সাধারণত এ-শব্দের ব্যবহার হয়; কিন্তু নাটকে ‘মর্ষকাম’ শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। নাট্যকার ‘মর্ষকাম’ ব্যঞ্জনায় আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রনীতি-নীতিকদের নিগ্রহমূলক ব্যাখ্যা বুঝিয়েছেন। রাষ্ট্রক্ষমতার সবাই যেন বিদেশি সাহায্যের নামে মর্ষকামী হয়। সমকালীন রাষ্ট্রনৈতিক আন্তর্জাতিক কৌশলে স্বেচ্ছা-নিপীড়িত হওয়ার প্রবণতা। ভৌগোলিক পরিম-লকেও ছাপিয়ে হাজার বছরের জীবনযন্ত্রণার এক অভেদ্য সুর এতে চিত্রিত। অত্যন্ত চমৎকার প্রযুক্তির ব্যবহার, নৃত্য-গীত ও অভিনয়ে ফুটে উঠেছে এ-নাটক। একইদিন এক্সপেরিমেন্টাল হলে পরিবেশিত হয় ভিশন থিয়েটারের নৈশভোজ। মনোজ মিত্রের রচনায় নির্দেশনা দিয়েছেন গোলাম সারোয়ার সিক্ত। এছাড়া স্টুডিও থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হয় রঙ্গপীঠের প্রযোজনা মহেশ নাটক। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্পের নাট্যরূপ দিয়েছেন সাজ্জাদ হোসেন। নাটকটির নির্দেশনায় গোলাম জিলানী। এছাড়া প্রতিদিন উন্মুক্ত মঞ্চে পথনাটক, মূকাভিনয়, আবৃত্তি, সংগীত ও নৃত্য পরিবেশিত হয়।

সমাপনী আনুষ্ঠানিকতার আলোচনায় উঠে আসে গঙ্গা যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব শুধু সাংস্কৃতিক উৎসবই নয়, এটি দুই বাংলার মেলবন্ধন। দেশ আলাদা হলেও দুই বাংলার সংস্কৃতির শিকড় একই সূত্রে প্রোথিত। এসব বিবেচনায় এ-উৎসবের অনিবার্যতা অবশ্যম্ভাবী  বলেই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন বক্তারা। ১২ অক্টোবর, শুক্রবার সকাল ১০টায় শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার কক্ষি অনুষ্ঠিত হয় ‘গঙ্গা-যমুনাপাড়ের সংস্কৃতি ও একটি অনুসন্ধান’ শীর্ষক সেমিনার। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন অনন্ত হীরা। যে-কোনো উৎসবই নানা অভিজ্ঞতা বয়ে নিয়ে আসে। নামসর্বস্ব নয়, সাংস্কৃতিক উৎসবে সংস্কৃতির নানা শাখাকে অন্তর্ভুক্ত করাই বেশি গুরুত্ববহ। অন্যকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে আত্মপরিচয় যেন ক্ষুণ্ণ না হয়। এদেশের রয়েছে হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। হাজারো অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশই কাম্য হওয়া উচিত। বাংলাদেশের নাট্যজগতের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটুক তা আমরা প্রত্যাশা করি।