যা কিছু শুনেছেন আপনারা – ঘটনা সত্য, একবিন্দুও মিথ্যা নাই এতে; মিথ্যা শোনেননি আপনারা। ঘটনাটি ঘটেছে আমার জীবনে, অর্থাৎ গল্পটি আমার নিজের – আমি নিজেই আপনাদের শোনাবো…।
অবশ্য, আমি শুনেছি; আপনারাও নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন – আমি আমার নিজের যে-গল্প শোনাতে চাই, এ-ধরনের গল্প প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সৃজিত হয়। কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে এই গল্পের সৃজন ঘটে, সে অন্য কাউকে তার গল্প শোনায় না। গল্পটি সে গুম করে ফেলে। কেন গুম করে নিজের গল্প – তা আপনাদের সবারই জানা; সমাজের ভয়ে, লোকলজ্জার ভয়ে। কিন্তু আমি কাউকে পরোয়া করি না। আমি গল্পটি শোনাতে চাই…।
আপনাদের বলি, শুনুন দয়া করে। আমার নাম ফুলমতি। জানি, নামটি আপনারা পছন্দ করলেন না। তা না-করারই কথা। কেমন সেকেলে নাম! নামটি আমার নিজেরও না-পছন্দ। আমি যদি ইশকুলে পড়তাম, আমার বয়েসি অনেক মেয়েই হাইস্কুলে পড়ে – আমি নিজের নাম বদলে রাখতাম – ফুল্লরা ইয়াছমিন। নামটা চমৎকার না? কিন্তু ইশকুলে যেহেতু পড়িনি – নাম বদলের সুযোগ হয়নি। মা আমাকে ফুলমতি নামেই ডাকে। শুধু ফুল বা মতি বলে ডাকে না। আমি নদীর ধারে থাকলে মা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যখন ফুলমতি বলে জোরে জোরে ডাকে, তখন কিন্তু ভালোই লাগে। তখন আর নিজের নামটিকে
না-পছন্দের বলে মনে হয় না। দাদি আমাকে কখনো ফুল, আবার কখনো মতি বলে ডাকে। কুসুমফুল বলেও ডাকে
কখনো-সখনো। দাদি তখন ‘চোখ-বাঁধা-বুড়ি’ সেজে আমাকে ডাকে – ‘আয়রে আমার কুসুমফুল…।’ আমি দাদির কপালে টোকা মেরে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াই। দাদি তার দু-হাত পেছনে নিয়ে আমাকে জড়িয়ে বলে – ‘এই তো আমার মতি, আমার কুসুমফুল…।’
আমার শরীরের রং নাকি কুসুমফুলের মতো হালকা সোনালি – দাদি তাই আমাকে কুসুমফুল বলে ডাকে। অথচ কাণ্ডটা দেখুন – দাদি অন্ধ, নিজের ছায়াটা পর্যন্ত দেখে না; সে কীভাবে দেখলো – আমার শরীরের রং কুসুমফুলের মতো! আমি যদি বলি – ‘দাদি, তুমি তো অন্ধ, চোখে দেখো না – তুমি কী করে আমার শরীরের রং দেখলে?’ দাদি তখন ঠোঁট চেপে ধরে মিটিমিটি হাসে, বলে – ‘অন্ধরাও চোখে দেইখে। আমি যা দেইখি – তুই তা দেইখিস না…।’
কী জানি, কতকিছুই তো ঘটে দুনিয়ায়! আল্লাহর কুদরত বোঝার ক্ষমতা নাই কারো। তো, আমি যে-গল্পটি আপনাদের শোনাবো, এই গল্পটি সৃজিত হওয়ার ক্ষেত্রে আমার শরীরের রং যে কুসুমফুলের মতো, তার কিন্তু একটা বড় ভূমিকা আছে; সেই গল্প যথাসময়ে শোনাবো। এবং এটাও তো আপনাদের জানা কথা, কোনো কিশোরীর শরীরের রং কুসুমফুলের মতো হলে – তার জীবনে গল্প সৃজিত হবেই, আমার জীবনে যেরকম হয়েছে…।
দাদি যে অন্ধ, চোখে দেখে না কিছুই – দাদি কিন্তু তা মানতে চায় না। বলা ভালো – মানে না কিছুতেই। সারাদিন বাঁশের কঞ্চির লাঠিতে ভর করে টুকটুক করে হেঁটে বেড়ায় বাড়িতে। বাড়ির কুকরাগুলো কোথায় গেল, শেয়ালে ধরে কি না; হাঁসগুলো নদী থেকে ফিরলো কি না – এইসব দেখে দাদি। দাদিকে যদি বলি – ‘তুমি পথ দেখ কেমনে, হাঁটাচলা করো কেমনে?’ দাদি তার স্বভাবমতোই মিটিমিটি হাসে, বলে – ‘অন্ধরাও চোখে দেইখে…’।
আমরা তিন বোন – ভানুমতি, আলোমতি আর আমি ফুলমতি। ভানুবু-আলোবুর বিয়ে হয়েছে। ভানুবুর সল্লা, আলোবুর বিলছায়া। আমাদের আরেকটা বোন ছিল – সবার বড়ো, লীলাবতী। লীলাবু বেঁচে নেই। আমার এখন যে-বয়স, তেরো কি চৌদ্দ, ওই বয়সেই লীলাবু মারা গেছে। মা বলে – লীলাবুর জন্য কাঁদতে কাঁদতেই নাকি দাদির চোখ অন্ধ হয়েছে। তা হতে পারে – দাদি যে আমাদের কীরকম ভালোবাসে তা বলে শেষ করা যাবে না…।
লীলাবুর শরীরের রংও নাকি ছিল কুসুমফুলের মতো। আসলে লীলাবু আর আমি মায়ের শরীরের রং পেয়েছি। মায়ের শরীরেও, যৌবনকালে কুসুমফুলের আভা ফুটে উঠতো। আমি ছোটবেলায় মায়ের শরীরের সেই রং দেখেছি। এখন মায়ের শরীরের রং পোড়ামাটির মতো। বাবা বেঁচে নেই, মা এবাড়ি-ওবাড়ি কাজ করে কিছু চাল-খুদ পায়, মুরগির ডিম বেচে, হাঁসের ডিম বেচে কিছু রোজগার করে – তাই দিয়ে আমাদের সংসার চলে। দাদি অন্ধ। আমার কথা কিছু বলি নাই, এখন বলি – আমি বোবা, কথা বলতে জানি না জন্ম থেকেই। শিক্ষিত লোকেরা আমাকে বলে – বাক্প্রতিবন্ধী।
অন্ধ-প্রতিবন্ধীদের নিয়ে যার সংসার তার শরীরের রং পোড়ামাটির মতো হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। যখন আমার মনে হয়, আহারে, মায়ের শরীরের রং একদিন কুসুমফুলের মতো সোনাবরণ ছিল, তখন আমার চোখ ভরে জল আসে…।
সে যাক। শরীরের রং কুসুমফুলের মতো হলে গল্প সৃজিত হয়, যেমন আমার জীবনে হয়েছে; সেই গল্প আপনাদের অবশ্যই শোনাবো। তবে আমার মনে হয়, লীলাবুর জীবনেও হয়তো কোনো গল্প সৃজিত হয়েছিল, যা আমরা জানি না; না-হলে নদীপাড় থেকে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করতে করতে বাড়িতে আসতেই মেয়েটির ভবলীলা সাঙ্গ! বাবা তখন বেঁচে ছিল, বাড়িতেই ছিল সেই সাঁঝবেলা। সূর্য কেবল ডুবেছে – চারদিকে গোধূলি-আলোর ছড়াছড়ি, লীলাবু এসে আছড়ে পড়লো উঠোনে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই লীলাবুর প্রাণপাখি উড়ে গেল খাঁচা ছেড়ে। চোখের সামনে মেয়ের মৃত্যু দেখে বাবার কী মনে হয়েছিল, এখন আর তা বলার জো নেই; তবে এটা বলা যাবে, বাবার তখন মনেই হয়নি – বাড়ির বাইরে গিয়ে দেখবে – কী দেখে ভয় পেয়েছিল লীলাবতী – কেন সে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল…?
লীলাবু হাঁস আনতে গেছিল নদীপাড়ে। ধলেশ্বরীর একটি সোঁতা আমাদের গ্রামে, দেখুন – কী অর্বাচীনের মতো গল্প শোনাচ্ছি আপনাদের, আমাদের গ্রামের নামই তো এখনো বলি নাই। আমাদের গ্রামের নাম যোগীপাল। সোঁতাটি যোগীপালের উত্তর-পাশ দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে চলে গেছে। এটি ছোট ধলেশ্বরী নামে পরিচিত।
বই-পুস্তকেও নাকি নামটি আছে। তা থাক বা না-থাক, তাতে আমাদের গল্পের কিছু এসে-যাবে না। বর্ষাকালে নদীটি মূল ধলেশ^রীর মতোই ফুলে-ফেঁপে ওঠে, রাতে বাড়িতে বসেই নদীর ডাক শোনা যায়। কিন্তু এখন, জ্যাঠ-মাসের শুরুতে পানি নদীর তলানিতে ঠেকেছে। লীলাবু প্রত্যেকদিন সকালে বাড়ির হাঁসগুলোকে নদীতে নিয়ে যায়, নদীর যেখানে অল্পবিস্তর পানি আছে সেখানে ছেড়ে দেয়, সাঁঝের আগে আগে বাড়িতে নিয়ে আসে। সেদিনও লীলাবু হাঁসগুলোকে আনতেই গেছিল…।
হাঁসগুলোকে পানিতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য, কিংবা বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে লীলাবুকে, নদীতে যেখানে পানি – সেই পর্যন্ত যেতে হয় না। নদীর কাছাড় পর্যন্ত গেলেই চলে। সকালে, হাঁসগুলোকে পানিতে ছাড়ার সময়, নদীর কাছাড়ে গিয়ে লীলাবু বলে – ‘যারে যা, তোরা শামুক খেয়ে পেট ভরা।’ হাঁসগুলো লীলাবুর আদেশ শুনে প্যাঁকপ্যাঁক শব্দ তুলে পানির দিকে হাঁটা শুরু করে। হাঁসের প্রিয় খাদ্য শামুক। আর ছোট ধলেশ্বরীতে শামুকের কোনোদিনই অভাব হয় না। হাঁসগুলো সারাদিন নদীতে সাঁতার কাটে, জলক্রীড়া করে, যৌনসম্ভোগ করে আর উদরপূর্তি করে শামুক খেয়ে। সাঁঝের আগে আগে লীলাবু নদীর কাছাড়ে গিয়ে ‘তইতই’ ডাক দিতেই হাঁসের ঝাঁক ছুটে আসে। ঘিরে ধরে লীলাবুকে। কতগুলো বাড়ির পথে লীলাবুর সামনে হাঁটে, কতগুলো তার পেছনে…।
সেদিনও হাঁসের ঝাঁক লীলাবুকে ঘিরে ধরেছে। প্যাঁকপ্যাঁক শব্দ তুলে তাকে কুর্নিশ করছে – বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করবে, তখনই বাউকুড়ানি ঘিরে ধরলো তাকে…।
কে আমাদের গ্রামের ‘যোগীপাল’ নামকরণ করেছে – আমি এক বাকপ্রতিবন্ধী অশিক্ষিত কিশোরী, আমি তো জানিই না, আমার জানার কোনো সুযোগও নাই, গ্রামের কেউই তা জানে না; তবে আমার দাদি গ্রামের নামকরণ সম্পর্কে শাস্তর বলে। দাদি অন্ধ হলে হবে কী – সে অনেক শাস্তর জানে। দাদি বলে, এক সময়, তা বহুকাল আগে – বাংলাদেশের রাজা ছিলেন পালরা। সেই রাজাদেরই একজন – ‘যোগীপাল’ – শত্রুর আক্রমণে পরাস্ত হয়ে সপরিবারে নৌকাযোগে পালানোর সময়, যমুনা ও ধলেশ^রীর মোহনার কাছাকাছি এই জায়গাটিকে নিরাপদ মনে করে, এখানেই বসতি স্থাপন করেন। দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেন এখানে। এই গ্রামেই তাঁর মৃত্যু হয়। পরবর্তীকালে, তাঁর নামেই কেউ হয়তো গ্রামের নামকরণ করেন – যোগীপাল। গ্রামের এখানে-সেখানে এখনো প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের কিছু চিহ্ন আছে, যা দেখে, কোনো কোনো শিক্ষিতজন আমার দাদির শাস্তরকে সত্য-কাহিনি বলে মনে করেন। তো, এই ঐতিহাসিক যোগীপাল গ্রামের, ক্ষমা প্রার্থনা করছি আপনাদের কাছে, যারা এই গল্প শুনছেন – আমি এক অশিক্ষিত-বাকপ্রতিবন্ধী কিশোরী – কীভাবে বলছি গ্রামটি ঐতিহাসিক; ওই যে বললাম, দাদির কাছে শাস্তর শুনেছি – ওই শাস্তরই আমার গল্পের পুঁজি। যা-হোক, যোগীপালের মাইল-দুয়েক পশ্চিমে ধলেশ্বরী, আর দুই মাইল পরে যমুনা নদী; গ্রামের উত্তর পাশ দিয়ে পুবদিকে গেছে, বলেছি আগেই – ছোট ধলেশ্বরী। অর্থাৎ আমরা নদী-এলাকা, মানে চর-এলাকার বাসিন্দা। তবে যমুনা নদীতে, শ্যামশৈলে সেতু হওয়ার পর, কে কবে কল্পনা করতে পেরেছিল – সাতমাইল প্রশস্ত যমুনা নদীতে সেতু নির্মাণ করা সম্ভব – কিন্তু যমুনায় এখন সেতু – এটাই বাস্তবতা; চর-এলাকা এখন আর চর নাই। যোগীপালের পাশ দিয়েই সড়কপথ, রেললাইন। গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে, ঘরে ঘরে টেলিভিশন – দিনরাত চলে হিন্দি ছায়াছবি, জলসা-মুভিজে সিরিয়াল – কিরণমালা…। এখন আর আমাদের গ্রামে বাউকুড়ানি ওঠে না। কিন্তু লীলাবুকে সেদিন বাউকুড়ানি ঘিরে ধরেছিল, বলেছি আপনাদের। বাউকুড়ানি সাধারণত দুপুরবেলা ওঠে, কিন্তু সেদিন সাঁঝবেলায় বাউকুড়ানি উঠেছিল। লীলাবু বাউকুড়ানিকে পাত্তা দিচ্ছিল না। শুধু লীলাবু কেন – চর-গ্রামের কোনো ছাওয়াল-পাওয়ালই বাউকুড়ানিকে পাত্তা দেয় না, বাউকুড়ানিকে ভয় পায় না। কিন্তু সেদিনের সেই বাউকুড়ানিটা, যেটি লীলাবুকে ঘিরে ধরেছিল; প্রচুর দক্ষিণা বাতাস থাকার পরও সেখান থেকে সরছিল না। ঘূর্ণনরত ধূলির ঝাঁক লীলাবুকে শক্ত করে চেপে ধরছিল। বু’র শরীরে তখন কুসুমফুল ফুটতে শুরু করেছে। বুকে গজিয়েছে মাঝারি আকারের গাবের মতো গোল স্তন। বাউকুড়ানির ভেতর হাঁসফাঁস করতে করতেই লীলাবু টের পেল – কেউ তার স্তনে কামড় বসিয়েছে, স্তনদুটো যেন ছিঁড়ে ফেলছে; বুকে অসহ্য যন্ত্রণা, কিন্তু চিৎকার করতে পারছে না; তাকে যেন বোবায় ধরেছে…।
এখন কেউ কেউ বলে, সেদিন যারা চকে কাজ করছিল, বাউকুড়ানির ভেতর নাকি মেছোভূত ছিল। মেছোভূত নদীতে থাকে, একাকী কোনো কিশোরী-মেয়ে পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। ভরবাড়ি, নিকলা – আরো কোথাও কোথাও নাকি এ-ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আবার কেউ কেউ, তারাও সেদিন চকে ছিল, যারা ভূতের গল্প বলে, তাদের ভূতের গল্পটিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলে – ‘আরে দূর! কী যে কন না তোমরা? বাউকুড়ানির ভিতরে আছিলো জলিল মোল্লার ছোট পোলা ওমর মোল্লা, দেইখেননি তোমরা…?’
আসলে লীলাবুর কোন গল্পটি যে সত্য, কে জানে! সত্য গল্পও তো মিথ্যা হয়ে যায়। হয় কি না বলুন…?
আমার বাবা আমাকে কী-নামে ডাকতো তা আমার মনে পড়ে না। পুরোনাম ফুলমতি, নাকি ফুল কিংবা মতি; নাকি দাদির মতো কুসুমফুল বলে ডাকতো। যখন ভাবি, যখন বাবাকে মনে পড়ে – তখন, বাবা আমাকে কী নামে ডাকতো তা আর মনে করতে পারি না। তখন আমার বয়স ছয় কি সাত – একদিন ভোরে মা-দাদির বুক-চাপড়ানো কান্না শুনে ঘুম ভাঙে – শুনি বাবা খুন হয়েছে, লাশ পড়ে আছে টোকে…।
বাবার ছিল মাছ মারার প্রচণ্ড নেশা। তাও আবার রাতের বেলা। বৃষ্টি-বাদলা, অন্ধকার কোনোকিছুই মানতো না সে। সাপ-খোপ কিংবা ভূত-প্রেতের ভয় ছিল না তার। রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে বড়শি কিংবা ঝাঁকিজাল নিয়ে ছুটতো নদীতে। অন্ধকার রাতে বাঁশের বুন্দা নিয়ে যেতো। বুন্দা জ্বেলে রাখতো নদীর কাছাড়ে। মাছ পাক বা না-পাক, কুছ পরোয়া নাই – প্রত্যেক রাতেই মাছ মারতে সে যাবেই। রাত নামলেই নদী তাকে ডাকে। নদীর ডাক বাবা উপেক্ষা করতে পারে না। মা
দু-একবার বলেছে – নিশুতি রাতে ঘরে একাকী তার ভয় করে। মায়ের কথা শুনে বাবা বলতো – ‘মার ঘরে শুইয়ে থাক। আমি আইসে ডাইকে তুলবো…।’ বাবা শেষরাতে বাড়িতে আসতো…।
বাবা মাকে দাদির ঘরে ঘুমাতে বললেও মা তা করতো না। মা নিজের ঘরেই একাকী ঘুমাতো। আমি দাদির কাছে থাকতাম। দাদি শুয়ে শুয়ে শাস্তর শোনাতো। কত শাস্তর যে জানে দাদি…!
এক রাতে, তখন মধ্যরাত, বাবা তখনো পর্যন্ত একটা মাছও মারতে পারেনি, সব মাছ যেন আত্মগোপন করেছে নদীর তলদেশে, মেজাজ খিঁচড়ে গেছে বাবার। বড়শির ছিপ-সুতা গুটিয়ে দিয়ে, ঝাঁকিজাল ধুয়ে বাড়ির পথ ধরে সে…।
অন্ধকার রাত, বুন্দা জ্বেলেই রেখেছে বাবা। বুন্দার কেরোসিন কমে এসেছে, আলো কম। তবে পথ দেখতে অসুবিধা নাই। তাছাড়া পথ তো মুখস্থ। ক্ষেতের আলপথ ধরে দ্রুত হাঁটে বাবা। মাছ না-পাওয়ার রাগে তার মেজাজ তো বিগড়ে গেছেই, শরীরটাও থরথর করে কাঁপছে। বাড়ির কাছাকাছি যাওয়ার পর, ভূত দেখে মানুষ যেভাবে চমকে ওঠে – বাবাও সেরকম চমকে ওঠে। ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক। আরেকজন সিঁদ কাটছে…।
বাবার শরীরের কাঁপুনি থেমে যায়। সে কিছুক্ষণ নিশ্চল বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর দু-চার পা এগিয়ে আবার দাঁড়ায়। তখন তার চমকানোর পালা দ্বিগুণ, তিনগুণ … সাতগুণ, দশগুণ করে বাড়তে থাকে। সিঁদ-কাটার তদারকি করছে ওমর মোল্লা – কদিন পর না সে মেম্বার পদে ভোটে দাঁড়াবে! এখনই কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে। আর যে-লোকটি সিঁদ কাটছে, তার মাথা নিচের দিকে ঝুঁকে থাকায় তাকে চেনা যাচ্ছে না। ওমর মোল্লারই কোনো চেলাচামুণ্ডা হবে…।
বাবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে – ওমর মোল্লা তো পয়সাওয়ালা লোক। চোর না। তাছাড়া ঘরে চুরি করার মতো কিছু নাইও, একমাত্র তার বউ আয়নামতি ছাড়া। তাহলে কি আয়নামতিরে…!
হঠাৎ বাবার বুন্দার আলো ওমর মোল্লার চোখে পড়ে। কাঁপুনি শুরু হয়ে যায় মোল্লার। সে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘এই নূরু, লোকমান শালায় কি আইজ এহনই ফিরা আইলে…?’
– কই…?
– ওই যে বুন্দার আলো…।
– ঠিকই কইছেন তুমি। ওইডে লোকমানেই। চলেন কাইটে পড়ি…।
জাত-চোরের মতোই ওরা নিঃশব্দ-পায়ে কেটে পড়ে। ইস্সিরে! আরেকটু হলেই ধরা পড়ে যেতো। কিছুদূর যাওয়ার পর দাঁড়ায় ওমর মোল্লা। তাকে দাঁড়াতে দেখে নূরুও দাঁড়ায়। ওমর মোল্লা বলে – ‘লোকমান আমাগোর চিইনে ফেলে নাই তো…?’
– চিইননের তো কথা না। আপনের চোখ-মুখ-মাথা গামছা দিয়া প্যাঁচাইনে আছিল। আমার মাথা আছিল গর্তের মুহে। আর চিইনলেই কী? কিছু কইলে অর কল্লাটা নামায়ে দিমু…।
– ঠিকই কইছিস। লোকমান বাঁইচে থাকতে আয়নামতি আমার কাছে ধরা দিবানানে। সাতদিনের মধ্যেই কামডা সাইরে ফেলা…।
তার তিনদিন পরই বাবা খুন! রাতে মাছ মারতে নদীতে গেছিল। শেষরাতে বাড়ি আসেনি। ভোরবেলা খবর আসে বাবা খুন হয়েছে। লাশ পড়ে আছে টোকে। শুধু ধড়টাই আছে, মুণ্ডু নাই…।
বাবার মতো একজন নির্বিরোধী লোক, যে কারো সাতে-পাঁচে নাই, যে কি না মাছমারা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না, সেই লোকটি খুন হতে যাবে কেন – এ ছিল আমার বোধ-বুদ্ধির অতীত। অবশ্য তখন আমার বয়স মাত্র ছয় কি সাত – খুনের মতো একটি মর্মান্তিক ঘটনা কেন ঘটতে পারে – তা বোঝার মতো বয়স তখন হয়নি। মা-দাদি কিংবা ভানুবু-আলোবু কিছু টের পেয়েছিল না, তাও জানতাম না…।
বাবা খুন হওয়ায় আমরা একেবারে অথৈ সাগরে পড়লাম। বাবা মাছ মেরে বাজারে বিক্রি করে যা পেতো তাই দিয়ে চলতো সংসার। এখন বাবা নাই, রোজগারও নাই। আমাদের উনুনে একদিন আগুন জ্বলে তো আরেকদিন জ্বলে না। মা হাঁস-মুরগি পালে, কিন্তু ডিম বেচে কতটুকু আর কী করা যায়। মা তখন এবাড়ি-ওবাড়ি কাজ করা শুরু করে…।
আমার শরীরে যখন কুসুমফুল ফুটতে শুরু করে, তখন, একরাতে দাদি কাঁদতে কাঁদতে – শাস্তর বলার মতো করে – বাবা কেন খুন হয়েছে, কে খুন করেছে – আমাকে বলে…।
আমার মা যখন যোগীপালে বউ হয়ে আসে, ওমর মোল্লা তার আগে থেকেই বিবাহিত। ঘরে দু-বছরের কন্যাসন্তান। তাতে কী! লোকটা নোচ্চা কিসিমের। পরের বউ দেখলেই কার্তিক মাসের কুত্তার মতো ছো-ছো করে। আগেই বলেছি, মায়ের শরীরে কুসুমফুল ফুটতো। ওমর মোল্লার চোখ পড়ে মায়ের ওপর…।
আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বাজারে যাওয়ার পথ। ওমর মোল্লা দু-বেলা বাজারে যায়। বাজারে যেতে-আসতে আমাদের বাড়িতে ওঠে। দাদির সঙ্গে খোশগল্প করে। গল্প আর থামে না। সকালে এলে দুপুর গড়িয়ে যায়, বিকেলে এলে সন্ধ্যা নামে। দাদির সঙ্গে খোশগল্প একটা বাহানা মাত্র – আসল উদ্দেশ্য মাকে বশ করা। গল্প করতে করতে এক সময় বলবে – ‘খালা, নতুন ভাবিরে একটা পান সাইজে দিতে কও না। ভাবির হাতের পান যা মিঠা…!’
শুরুতে মা পান সেজে দিত। কিন্তু কিছুদিন যেতেই পান দেওয়া বন্ধ করে দেয় মা। পান নেওয়ার সময় ওমর মোল্লা যে-চোখে মায়ের দিকে তাকায়, মা তাতেই বুঝতে পারে – লোকটা নোচ্চা…।
তারপর একদিন ওমর মোল্লা বাবাকে বশ করার পথ ধরে…।
– লোকমান ভাইরে, একটা কথা কইতে চাইছেলাম…।
– কন না, কী কইতে চাও…।
– মাছ মাইরে, মাছ বেইচে আর কয় ট্যাহা পাও। ঘরে অ্যাহন নয়া বউ…।
– না, মাছ বেইচে খারাপ চলে না। তাছাড়া বউয়ের আর নতুন-পুরান কী? বউয়ে তো জাইনেই আইছে আমি মাছ মাইরে, মাছ বেইচে খাই…।
– আরে কথা এইডে না। বউয়ের কাছে, শালা-শালির কাছে একটা সন্মান আছে না? মাছ বেইচে খাবে জাইলারা। তুমি কেনে? তোমারে দুইডো গরু কিইনে দেই, দুইডো বড়োসড়ো ক্ষ্যাত রাইখে দেই। চাষবাস কইরে খাও…।
বাবা বোঝে, ওমর মোল্লার কোনো কুমতলব আছে। মোল্লাবাড়ির কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না – এটা যোগীপালের কে না জানে…!
তারপর, একদিন, ওমর মোল্লা মায়ের নামে বাজারে কুৎসা রটানো শুরু করে…।
– এই ছাদের, লোকমানের বউডির নাকি চরিত্র খারাপ …।
– কী কন তুমি চাচা! কে কইলে…?
– বাজারে শুইনে আলাম। কাবেলের চা-র দোকানে বইসে ওমর মোল্লা কইতেছে…।
– কী কইলে…?
– বিয়ার আগেই নাকি হেইডির প্যাটে বাচ্চা আইছিল…।
তারপর…!
তারপর লীলাবুর গল্প…।
তারপর…!
তারপর আমাদের ঘরে সিঁদকাটার গল্প…।
তারপর…!
তারপর বাবা খুন…।
তারপর…!
তারপর ফুলমতির গল্প…।
দাদি বলে, মায়ের শরীরে কুসুমফুল ফুটতো, লীলাবুর শরীরেও কুসুমফুল ফুটতো – কিন্তু আমার শরীরেই নাকি সবচেয়ে বেশি কুসুমফুল ফুটেছে। আমি কথা বলতে জানি না – কিন্তু আমার শরীর কথা বলে! আমার শরীর যে কথা বলে – তা আমি নিজেও ইদানীং অনুভব করি। কখনো-সখনো মনে হয় শরীরটা বুঝি আমার নিজের না, অন্য কারো…।
এই কুসুমফুলশোভিত শরীরটা নিয়েই হয়েছে যত যন্ত্রণা। সকালে হাঁস নিয়ে নদীতে যাই, সাঁঝের আগে আগে হাঁসগুলোকে বাড়িতে নিয়ে আসি; পথে কারো সঙ্গে দেখা হলেই – সে হোক জোয়ান-পোলা, হোক বুড়ো মানুষ; সবাই আমাকে চোখ দিয়েই কেটে কেটে খেতে শুরু করে। কেউ কেউ তাদের হাতের আঙুলগুলো মুঠো করে আমাকে দেখায় – বলে, ‘ফুলমতিরে, তোর মাই দুইডো বেশ বড়োসড়ো, ঠিক গাবের মতো। তুই দেখতেও খুব সোন্দর।’ আমি কারো কথায় কান দিই না। আপন-মনে হাঁটি। কেউ কেউ তো আরো এককাঠি সরেস। আমার হাত ধরার কিংবা বুকে হাত দেওয়ার চেষ্টা করে তারা। যেন, যোগীপালের যে-মেয়েটির বাবা নাই, দাদি অন্ধ, মা’টাও দিনের পর দিন রোগে-শোকে ভুগতে ভুগতে খরা-মৌসুমে জীর্ণশীর্ণ নদীর মতো দেখতে হয়েছে, তার শরীরে হাত দিলে আর দোষের কী? কিন্তু আমি কাউকে শরীরে হাত দিতে দিই না। কেউ হাত বাড়ালেই গোখরো সাপের মতো ফোঁস করে উঠি। তখন, ওই হাতগুলো মাথায় লবণ-দেওয়া জোঁকের মতো নুয়ে পড়ে…।
মা বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ। তার গুদগুদানি জ্বর ছাড়েই না। সঙ্গে কাশিও আছে। বাজারের দিলীপ ডাক্তারের ওষুধ খেলো কদিন, কোনো উজান-ভাটি নাই। গাঁয়ের টিকা-আপা মাকে দুদিন হাসপাতালে নিয়ে গেল। টিকা-আপার সন্দেহ, মার যক্ষ্মা হতে পারে। পরপর দুদিন মায়ের কাশি পরীক্ষা করা হলো – কিন্তু যক্ষ্মা ধরা পড়লো না। তাহলে মায়ের কী অসুখ করেছে? যক্ষ্মার চেয়েও বড় কোনো অসুখ…!
মা শয্যাশায়ী। হাঁস-মুরগিগুলো একসঙ্গে বিরতি নিয়েছে। ডিম পাড়ে না। এতদিন ডিম বেচেই চলছিল সংসার। এখন, আমাদের উনুনে আর আগুন জ্বলে না। বুড়ো দাদি ক্ষুধার কষ্টে কাহিল। অসুস্থ মা আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছে – এই যখন অবস্থা, একদিন সকালে হাঁস নিয়ে নদীতে যাচ্ছি, পথে ওমর মেম্বারের সঙ্গে দেখা। উল্টোদিক থেকে আসছে সে। আমাকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লো। সে দেখছেই – আমি হাঁস নিয়ে নদীতে যাচ্ছি, তবু বললো – ‘কোনে যাসরে ফুলমতি, এই বিহানবেলা?’ আমি তো বোবা, কথা বলতে জানি না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। হাঁসগুলো প্যাঁকপ্যাঁক করছে – নদীতে যেতে দেরি হচ্ছে, ওরা ক্ষুধার্ত…।
ওমর মেম্বারের চোখ আমার বুকের দিকে, সে বললো – ‘এইরে ফুলমতি, তোয়ার মাইয়ের নাকি খুব অসুখ, তাইলে তরা খাস কী…?’ তারপর পকেট থেকে একটা একশ টাকার নোট বের করে আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললো,
‘চাইল-ডাইল কিইনে নিয়া যাইস…।’ বলতে বলতেই ওমর মেম্বার যা করলো, আমি জানতাম সে এখন এটাই করবে, আমার বুকে হাত দিলো। ‘ইস! ফুলমতিরে, তোয়ার মাই দুইডো যা সুন্দর না…।’
আগেও, বলেছি আপনাদের; কেউ কেউ আমার বুকে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। তারা হাত বাড়ালেই আমি গোখরো সাপের মতো ফোঁস করে উঠতাম। কিন্তু সেদিন ওমর মেম্বার আমার বুকে হাত দিলো, আমি ফোঁসফোঁস করতে পারতাম, তার হাতে কামড় দিতে পারতাম; কিন্তু কিছুই করলাম না। কেন করলাম না? করলাম না, কারণ, আমিও তখন প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত ছিলাম…।
দুদিন পর দুপুরবেলা ফজিলা চকিদার আমাদের বাড়িতে এসে খবর দিলো – ওমর মেম্বার আমাকে ভোটঘরে যেতে বলেছে। চাল দেবে। ভোটঘর দশকীয়া। নদীর ওপার। আমি একটা ছালা হাতে ফজিলা খালার সঙ্গে বেরুচ্ছি – দাদি বললো, ‘কোনহানে যাসরে ফুল…?’
আমি ভেবেছিলাম দাদি ঘুমিয়ে আছে। তাই তাকে কিছু বলিনি। মায়ের ঘরে গিয়ে মাকে বলে যাবো ভাবছিলাম। কিন্তু দাদি দেখি ঘুমায়নি। ইশারা-ইঙ্গিতে বললাম – ভোটঘরে যাবো। ওমর মেম্বার যেতে বলেছে। চাল দেবে…।
দাদি আর কিছুই বললো না। এবার বোধহয় সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে…।
নদী পার হয়ে কিছুদূর যেতেই ফজিলা খালা বললো, ‘ওই যে ভোটঘর দেহা যায়, তুই যা ফুলমতি। মেম্বার বইসে আছে। আমার থানায় যেইতে হবি…।’
ভোটঘরে যাওয়ার পর চোখ কপালে উঠে গেল আমার। এ কী! ভোটঘর না বন্ধ। সব ঘরে বড় বড় তালা। ফজিলা খালা কী খবর দিলো আমাকে! চাল দিলে ভোটঘর বন্ধ থাকবে কেন? নাকি চাল দেওয়া শেষ করে সবাই চলে গেছে? ফজিলা খালা যে বললো – ওমর মেম্বার বইসে আছে, সে কই…?
দশকীয়া ভোটঘর নতুন হয়েছে, গাঁয়ের একপাশে। বাড়িঘরগুলো বেশ দূরে। দক্ষিণমুখো ভোটঘরের সামনের দিকটাই শুধু খোলা, বাদবাকি তিনদিকেই কুশালক্ষেত। রোদে-পোড়া দুপুরে ভোটঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আমার শরীরে মাঘ মাসের শীতের মতো কাঁপন ধরে গেল – আমি ঘুঘু মারার ফাঁদে পড়তে যাচ্ছি না তো…?
কী করবো এখন ভেবে পাচ্ছি না। কোথাও একটা লোকও নাই যে, তার কাছ থেকে খোঁজখবর নেওয়া যায় – আজ এখানে চাল দেওয়া হয়েছে কি হয়নি। দশকীয়া বাজারটাও বেশ দূরে। ওমর মেম্বার বাজারে গেছে কি না, তাই বা কে জানে…!
এতোক্ষণ লক্ষ করিনি, হঠাৎ চোখে পড়লো – কুশালক্ষেতের বাতরে বসে আছে একটা ভীষণদর্শন মর্দা শেয়াল, শেয়ালটার চোখ-মুখে যেন ওমর মেম্বারের চোখ-মুখ বসানো; কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এখনই হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর, ছিঁড়ে-খুঁড়ে খাবে আমাকে। আমি ভয়ে চিৎকার দিতে চাই, কিন্তু কেউ যেন আমার গলা চেপে ধরেছে; চিৎকার দিতে পারি না। কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে যাই। কতক্ষণ পড়ে ছিলাম বলতে পারবো না। হঠাৎ কানে আসে ওমর মেম্বারের গলা – ‘এইরে ফুলমতি, এইনে পইড়ে আছিস ক্যানে? কহন আইসেছিস…?’
মেম্বারের মুখের দিকে তাকিয়ে
থাকি। ঠিক যেন শেয়ালটারই মুখ…।
– কান্দিসনে আর। ভয়ের কিছু নাই। তোয়ার দেরি দেইখে একটু চা খেইতে বাজারে গেছিলাম। আয়। তোয়ার লেগে চাইল রাইখে দিছি…।
মেম্বার আগে, আমি তার পেছনে পেছনে হাঁটি। আমার চোখে তখনো শেয়ালটার মুখই ভাসছে। হঠাৎ শুনি মেম্বার বলছে, যদিও সে বলছে মনে মনে, তবু আমার কানে আসে – ‘ফুলমতিরে, বহুদিন, বহু চেষ্টা কইরেও তোয়ার মাডিরে কিছু কইরতে পারি নাই, কিন্তু তোয়ার বড়ো বোনডিরে খাইছি, আইজ তোয়ারে খাইয়ে ফেলামু…।’ আমি পেছন থেকে মেম্বারের শার্ট খামছে ধরি। ওদিকে কেন? ওদিকে তো কুশালক্ষেত…।
ওমর মেম্বার ঘুরে আমার দিকে তাকায়, সেই শেয়ালটার মতোই চোখ বড় বড় করে। তারপর আমার মুখ চেপে ধরে আমাকে নিয়ে কুশালক্ষেতের ভেতরে ঢোকে। আমি তার সামনে একটা ফোঁস করারও সুযোগ পাইনি…।
সেদিন সকালে হাঁস নিয়ে নদীতে যাওয়ার সময়, পথে ওমর মেম্বার আমার বুকে হাত দিয়ে আমাকে একশ টাকা দিয়েছিল, আজ সে আমার হাতে পাঁচশো টাকার একটি নোট দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছে। নোটটিতে বঙ্গবন্ধুর ছবি। বঙ্গবন্ধু কাঁদছে। আমি বঙ্গবন্ধুর চোখের পানি মুছে দিলাম। বললাম, তুমি কাঁদছ কেন, বাবা? দেখো, তোমার দেশে – তোমার মেয়েদের কী নির্মম পরিণতি…!
টাকাটা হাতের মুঠোয় ভরে বাড়ির পথ ধরলাম। হাঁটতে পারছি না। প্রচণ্ড ব্যথায় কোমর ভেঙে যাচ্ছে। জোর করেই হাঁটছি। লীলাবু বাড়িতে এসে চোখ বুজেছিল। আমারও যা হওয়ার বাড়িতেই হোক…।
উঠোনে পা দিতেই দাদি বললো, দাদি উঠোনেই বসে ছিল – ‘তোয়ার চাইলের ছালা কইরে ফুল? তোয়ার পায়জামায় রক্ত ক্যানে…?’
দাদির কথা শুনে রাগে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। চিৎকার করে বললাম – ‘দাদি, তুমি না অন্ধ। কিছুই দেখো না চোখে। আমার পায়জামায় রক্ত – তুমি দেখলে কীভাবে…?’
আমার চিৎকার শুনে দাদি বোকা বনে গেল। আমি দাদির সঙ্গে কখনো এভাবে কথা বলি না। তাছাড়া অন্ধ হলেও দাদি যে অনেককিছু দেখে, তার দিব্যদৃষ্টি আছে – সে তো আমরা জানি। এ নিয়ে বহুবার দাদির সঙ্গে কথা হয়েছে। তারপরও কেন চিৎকার করতে গেলাম? আসলে আমি কি আর তখন আমি আছি? আমি কি আর তখন ফুল আর মতি দিয়ে গড়া ফুলমতি আছি? আমি তখন…। তারপরও দাদিকে কষ্ট দেওয়ার কষ্টে আমার চোখে পানি এসে গেল। ঝাপসা চোখে পায়জামার দিকে তাকিয়ে দেখলাম – পায়জামা রক্তে ভেজা। পা বেয়ে রক্ত ঝরছে, সেই রক্তে ভিজছে উঠোন। তখন, যে-পথ দিয়ে আমি হেঁটে এসেছি, সেই পথের দিকে তাকিয়ে দেখি, পথজুড়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত…।
পাদটীকা
আমি থানায় মামলা করেছিলাম। পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে – সেদিন দশকীয়া ভোটঘরের কাছে কুশালক্ষেতে একটা মর্দা শেয়াল ঝাঁপাঝাঁপি করেছে বই আর কোনো ঘটনা ঘটেনি। ওমর মোল্লা একজন জনপ্রতিনিধি, রাজনীতি করেন – তার মতো একজন সম্মানীয় লোকের বিরুদ্ধে এরকম মিথ্যা অভিযোগ তুলে মামলা দায়ের করা একেবারেই অনভিপ্রেত। মিথ্যা মামলা করায় ফুলমতি নামের ওই মেয়েটিরই শাস্তি হওয়া উচিত…।
দেখুন আপনারা, গল্পটি কীভাবে মিথ্যে বনে গেল! আপনাদের বলি, আমি এখন পাঁচ মাসের পোয়াতি। আমার পেটের ভেতর একটা মানবশিশু মাঝেমধ্যেই যমুনার বাঘাড় মাছের মতো ঘাই মারে। এখন আমি যদি থানায় গিয়ে ওসি সাহেবকে পাঁচ মাসের পেটটি দেখাই, আমি জানি, আপনারাও জানেন – ওসি সাহেব বলবেন – নষ্টা মেয়েটি কার সঙ্গে কুকাজ করেছে, তার আমি কী জানি…?
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.