গীতি, প্রীতিবিষয়ক ব্যাপার 

মেঘাচ্ছন্ন মলিন ভোরে ঘুম ভাঙলো গালিবের। কদিন হলো শীতও জেঁকে বসেছে, প্রায়ই বৃষ্টিও হচ্ছে। আজো সম্ভাবনা আছে। আয়েশ করে আবার লম্বা ঘুম দেওয়ার ইচ্ছা, কিন্তু উপায় নেই। ক্লাস রয়েছে। এরপর যেতে হবে বেশ কিছুটা পথ। তাই গাড়িতে তেল ভরা জরুরি। এইসব নানা ব্যস্ততায় দিন কাটছে এখানে আসার পর। 

পছন্দ বা ইচ্ছে দুই-ই হয়নি, তাই বাড়ির সকলকে চিন্তা, হতাশায় রেখে সিঙ্গেল স্ট্যাটাস গালিব স্টুডেন্ট ভিসায় চলে এলো, ফল সেমিস্টারে এমএস করতে। এয়ারপোর্ট থেকে অনলাইনে ঠিক করা বাসায় শুভ পদার্পণ করলেও মনটা পড়ে আছে দেশে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সাজানো-গোছানো নিরিবিলি সুন্দর এক শহর প্রথম দেখে ভালোও লাগছে, এমন দ্বৈত অনুভূতি নিয়ে স্যুটকেস ভর্তি মশলাপাতি, শুকনো খাবার, কাপড়-চোপড় নিয়ে নতুন দেশে নতুন বাসায় এলো রাতে। তার হোমমেট আট মাস আগে আসা ঘনিষ্ঠ বন্ধু একই ইউনিভার্সিটিতে এমএস স্টুডেন্ট তমাল এয়ারপোর্ট থেকে নিজের গাড়িতে নিয়ে এলো মহাযত্নে। স্টুডেন্টরা অনেকেই এমন রাইড দেয় লেখাপড়ার পাশাপাশি। পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে পছন্দের ডিনার রেডি পেল গালিব। ভাত, মাছ, সবজি, ডাল। তবে প্রথম এই দেশের খাবার তেমন স্বাদ লাগলো না। কমলা, কিউই, পার্সিমন মিক্সড স্যালাদ অবশ্য উল্টো, দারুণ।

এরপর কয়েক মাসে বেশ চেনাজানা হয়েছে ছোট এই শহরের পথঘাট। বাসা থেকে ক্যাম্পাস হাঁটাপথ – মাত্র পাঁচ মিনিটের। তবে গাড়ি কেনার পরে হাঁটছে না। দিব্যি চলছে সংসার, কাছে-ধারে বেড়ানো, ক্লাস, লাইব্রেরি ওয়ার্ক, গ্রুপ স্টাডি, এক্সাম ইত্যাদি। গালিব এর মাঝে অল্প কয়েক মাস জব করেছিল সুপারশপে। ভালো লাগেনি বলে ছেড়েছে। পারিশ্রমিকের ডলার জমিয়ে হুটহাট সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কেনা। সেই থেকে রাইডও দিচ্ছে মাঝে মাঝে। বিভিন্ন দেশ থেকে হায়ার এডুকেশনে আসা স্টুডেন্টদের জন্য ইউনিভার্সিটির নিজস্ব কাজগুলি পাওয়া কঠিন। তাই কিছু বাড়তি ইনকামের জন্য বিকল্প কাজ। প্রায় সকলে পার্টটাইম জবে এনগেজড।

ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস লাগোয়া এই এলাকায় বাংলাদেশি স্টুডেন্টসহ ইন্ডিয়া, কেরালা, নেপাল ও এশিয়ান কান্ট্রিসহ অনেক দেশের মানুষ আছে। ছোট ছোট সাধারণ বাড়িগুলো অল্প ভাড়ায় মেলে। দেশের মফস্বলের পাড়ার মতোই এখানেও এ-বাড়ি ও-বাড়ি যাতায়াত, খাওয়া-দাওয়া হয় নানা উপলক্ষে। হাই, হ্যালো, ঘনিষ্ঠতা সব রকম সম্পর্কই হয় স্বাভাবিক সামাজিকীকরণ পরিক্রমায়। চেনা অনেকে পড়া শেষে অন্য স্টেটে ভালো চাকরি পেয়ে চলে গেছেন। সবার মতোই যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাওয়ার আশা গালিবেরও। এমএস শেষ করে দেশে ফিরে যাবে – এমনও ভাবনা আসে কখনো। অবশ্য বাবা-মায়ের ইচ্ছা এখানেই চাকরি করবে, থেকে যাবে। এভাবেই গ্রিন কার্ড, নাগরিকত্বসহ আরেক নতুন জীবন। টয়োটা ক্যাম্ব্রির স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়ে গালিব আকাশপাতাল ভাবছিল। 

লিভিং কস্টটা বাবা পাঠাচ্ছে। তাই যখন এক্সট্রা টাকা প্রয়োজন, তখনই হঠাৎ রাইড দেয়। এর মধ্যে গালিব পৌঁছেছে জায়গামতো। প্যাসেঞ্জার গীতি তারান্নুম অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠলেন স্মার্ট যাত্রী। গালিবের মন বলে, … এই পাবলিককে কি কিছুদিন আগে দেখেছি ইউনিভার্সিটি জব ফেয়ারে? শুভমিতা মনে এলো গালিবের – ‘দেখেছ কি তাকে ওই নীল নদের ধারে, বৃষ্টি পায়ে পায়ে?’

ড্রাইভ করতে করতে চোখে পড়ছে সবুজ পথের দুই ধারে এদেশের দৃষ্টিনন্দন ঘরবাড়ি। ফল সিজনে দেদার হলদে পাতা ঝরার দিন আসে, গরম কমে ওয়েদার চেঞ্জ হতে থাকে। এরপর শীত। উইন্টারেও বৃষ্টি হয় প্রায়ই। এখনো তাই মেঘ ছাওয়া গাঢ় অন্ধকার আকাশ, কিছু পরেই এলো মুষল বৃষ্টি। রাস্তার দুই পাশে বেশ দূরত্বে দৃষ্টিনন্দন কটেজের মতো বাড়িগুলি চুপচাপ ভিজছে। পেছনে বসা যাত্রী গান শুনছেন।

গালিবের মনে পড়ছে তাদের পুরনো টু ইউনিট দোতলা বাড়ির কথা। একই বিল্ডিংয়ে মুখোমুখি ফ্ল্যাটে নানা-নানি। বাবা-মায়ের সঙ্গে দাদা-দাদি। তিনতলার চিলেকোঠায় তাঁদের ছোট ছেলে স্থানীয় বেসরকারি কলেজের অধ্যাপক চিরকুমার পারতাস পাহলোয়ান পাভেলের রাজত্ব। অবশ্য গালিবেরও একচ্ছত্র আধিপত্য সেই রাজ্যে। অসমবয়সী চাচা-ভাতিজার চমৎকার বন্ধুত্ব। ছাদে নানা রকম ফুলফলের গাছের সঙ্গে গালিবের পছন্দ মনকাড়া চিলেকোঠাটি। বৃষ্টিমুখর কত দিন গালিব মহানন্দে ছাদে উঠে ভিজেছে শৈশবে, তারুণ্যে। আহা, আশপাশের চিলেকোঠা থেকে কখনো কোনো চন্দ্রমুখীই উঁকিঝুঁকি দেয়নি, যাকে দেখে অতরুণ কুমার চাচার ব্যাচেলর তরুণ ভাতিজার বুক ধুক্পুক্ করবে। তার বেলায় জনপ্রিয় গানটা প্রযোজ্যই হলো না … ‘বুক ধুকপুক চাঁদপানা মুখ চিলেকোঠা থেকে হাসছে! মেঘের নোলক চাঁদের পালক কাগজের খেয়া ভাসছে’ …

এখন চাচার সঙ্গে নিয়মিত না হলেও প্রায় দিনই ভিডিওকলে যোগাযোগ হচ্ছে, বাড়ির অন্যদের সঙ্গেও। সবার  চিন্তা, গালিবের বিয়ে নিয়ে। কবে ঘুচবে আইবুড়োত্ব! নানি-দাদির চিন্তা বেশি। প্রায়ই ওই প্রসঙ্গ আসে, কবে বিয়ে করবে, তাদের আশা পূর্ণ হবে কি না! নাকি চাচার দশা হবে? বেশ বয়সী তাদের এমন আশা ও চিন্তা দুই-ই স্বাভাবিক। এইসব অল্পস্বল্প প্যারা নিয়েই গালিবের প্রবাসজীবন চলছে।

গালিবের বাবা রিটায়ার করলেও মা এখনো চাকরিতে। গালিবের বিয়ে নিয়ে চিন্তাভাবনা থাকলেও দাদি, নানিই বলেন দেখে আপাতত দুজনেই চুপচাপ। তবে মেয়ে খোঁজেন। আজকাল ম্যাক্সিমামই এনগেজড থাকে বলে পাত্র-পাত্রী পাওয়া মহাকঠিন। কাউকে পেলেও এটা মেলে তো সেটা ম্যাচ করে না। কত রকম যে সমস্যা। বিয়ের জন্য মনের মতো কাউকে না পেলে কি-ই বা উপায়? এই পর্যন্ত তো দিব্যি হাসিখুশিতে গার্লফ্রেন্ড ছাড়াই কাটলো। গার্লফ্রেন্ড না থাকা  কম  যোগ্যতা – কখনো এমন মনেই হয়নি। ক্লাসমেট, কলিগ মেয়েরা বন্ধু হয়েছে অবশ্য। কিন্তু আরো গভীরে যাওয়া হয়নি। ভালো লাগেনি, তো যাবে কি? এখন হঠাৎ চিন্তাও হয়, কাউকে কখনো ভালো লাগবে তো?

ছিমছাম একটা ভিলার সামনে নেমে সারা পথ পেছনের সিটে বসে চুপচাপ ফোনে গান শুনতে শুনতে আসা গীতি তারান্নুমের মুখে হঠাৎ কথার খই ফোটে … ‘আরে, আপনার সঙ্গে কিছুদিন আগে পরিচয় হয়েছিল জব ফেয়ারে। তাই না?

‘জি, মনে হয়’ … গালিবের নিস্পৃহ নিরাসক্ত উত্তর। 

‘কিছু মনে করবেন না, আপনি কি সঙ্গে থাকবেন?’

‘আরে ব্যস! বলে কি গো! এজন্য  কি হেডফোন ছাড়াই  শুনছিল … ‘তুমি আসবে বলেই আকাশ মেঘলা বৃষ্টি এখনো হয়নি। তুমি আসবে বলে চৌরাস্তার পুলিশটা ঘুষ খায়নি।’

এবার গীতি তারান্নুমের কথায় গালিব মনে মনে আকাশ থেকে পড়ে, ‘সঙ্গে

থাকা? মানে কী?’ মুখে বলে …

– স্যরি, বুঝলাম না?

গীতি জানায়, … ‘ঝুম বৃষ্টি তো, তা-ই ভাবছি আপনার গাড়িতেই ব্যাক করতাম, আপনারও সুবিধা হবে স্টে চার্জসহ পে করে দেবো। ম্যাক্সিমাম ওয়ান, টু আওয়ার থাকার কথা। যদি আপত্তি না থাকে, বাসার ভেতরে আসুন। আমার সুন্দরী ফুম্মা ভালো মানুষ। আপনার পছন্দ হবে।’

চিন্তায় পড়ে গালিব, যাহ, আবারো আরেক প্যারা। ভালো মুশকিলে পড়া গেল দেখি! ফুপুকে পছন্দ মানে? তিনি কি অল্পবয়সী? এমন তো হতেই পারে। বাবার কাজিন, নিজের বোন হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। নানি, দাদিদের যুগে নাতি-নাতনির সমবয়সী সন্তানও অনেক সময় থাকতো। তাই বলে নিজের ফিয়ান্সের বদলে গীতির তাকে ফুপা বানিয়ে ছাড়ার মতলব নাকি?

তবে গালিব এর মধ্যে ক্যালকুলেশন করে ফেলেছে, ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে কি না – একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, এক ফ্যাকাল্টি, দুজনই বাংলাদেশি। সো এইসব দুশ্চিন্তা ভুলও হতে পারে। ফুপু যে বয়সেরই হোন, তাতে কি-ই বা সমস্যা? দেখা যাক তবে, লেটস সি। গালিবের প্রশ্ন,

– নিজের ফুপু?

– জি, একদম। ছোট ফুম্মা। 

ডোরবেল দেওয়ার আগেই দেখা যায় খোলা দরজায় ফুপু দাঁড়িয়ে। গীতির খুশি উপচে পড়ছে। দীর্ঘ হাগ শেষে এবার পরিচয় পর্ব …

– ফুম্মা, আমরা সেম ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট, উনি গালিব পাহলোয়ান, খুব ভালো। রাইড দেবেন ফেরার সময়ও, তাই তোমার অনুমতি ছাড়াই বাসায় আনলাম।

ফুপু হাসলেন … ‘ভালো করেছিস। বেশ তো, গালিব পাহলোয়ানের সঙ্গে চেনাজানা হবে।’

ফুম্মাকে সালাম দেওয়ার সময় ভালোভাবে তাকিয়ে সে আশাস্ত হয়, যাক ফুপা হওয়ার হানড্রেড পারসেন্ট চান্স নেই। ভাগ্যিস হুনজা জাতিগোষ্ঠী ওরিজিন নয় ফুপুর। তাহলে যে কী হতো। এই বয়সেও যা সুন্দরী। গালিবের বউ লাগবে গুণবতী, বেশি সংসারী, একটু রূপসীও, এমন ঘোষণা দেওয়া আছে। কিছুদিন আগে  চাচা মজা করে বললেন … ‘হুনজা ভ্যালির সুন্দরী দেখে ভুলিস না আবার! সত্তর বছর বয়সেও ওরা কিন্তু পুরো তরুণীরে!’

আহ্হারে ভোলার সুযোগ কই গো? হুনজারা সাধারণত নিজস্ব ভূখণ্ড ছেড়ে বাইরে যায় না। গিলগিট, বালটিস্থান, পাকিস্তান যাওয়ার সম্ভাবনা বিন্দুমাত্রও নেই গালিবের।

সে যাক, শংকর জাতিগোষ্ঠীর বাংলাদেশি রুট ফুপুর যে বয়স তাতে গীতির ফুপাজি হওয়ার চান্স বিন্দুমাত্র নেই। কিন্তু ফুপুর মনে তাকে আবার ভাতিজি জামাই করার ইচ্ছা জাগবে কি না কে জানে! তিনি গালিবের যত্ন করছেন অতিরিক্ত। এর আগে অবশ্য পরিচয় পর্বটা বিস্তারিতভাবে হলো। তার পুরো নামটা বলেছিল গীতিই। ফুপু বাড়িতে কেকে আছেন, বাড়ি কোন জেলায়, পাড়ার নাম অবধি জানতে চাইলেন কেন জানি!

মাইনাস টেম্পারেচারের বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা রাতে ফুপুর রান্না ভেজ খিচুড়ি, শামি কাবাব, চিকেন ভুনা, তেলাপিয়া বারবিকিউ দারুণ ডেলিশাস, ভারি জমেছে। চায়নিজ চায়ের গন্ধ, স্বাদ নিতে নিতে দেয়ালে ফ্রেমে সালোয়ার, কামিজ, ওড়না পরা অল্পবয়সী প্রিয়দর্শিনী ফুপুর ছবি দেখে বড়সড় ধাক্কা খেল গালিব। ছবির ওনাকে এতো পরিচিত লাগছে? ফুপুর নামটা জানা জরুরি! ডেজার্টভর্তি ট্রলিটা ঠেলে এনে পাশে বসলে তক্ষুনিই দুই পিস মিঠাইয়ে টুকরা প্লেটে নিয়ে গালিব চাইলো ফুপুর ফোন নম্বর।

‘ফুপু, সেভ করার জন্য নামটাও প্লিজ।’ তাকে তেমন না জেনেই ফুপুর সঙ্গে পরিচয়ের সময় দিব্যি খুব ভালো বিশেষণ দেওয়া এখন মুখোমুখি আয়েশ করে বসা গীতিই উত্তর দিলো, ‘পারিজাতপ্রীতি। আধুনিক, কাব্যিক নাম তাই না? আমার জাঁদরেল দারোগা দাদার বাবা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট খান সাহেব কলিমুদ্দিনের দেওয়া নাম।’

প্রীতি – গালিবের সামনে এক ট্র্যাজিক রূপকথা গল্পের ফ্ল্যাশব্যাক হচ্ছে! এজন্যই এতো ডিটেইলস জিগ্যেস করছিলেন? নামের শেষে পদবি শুনে যেন চমকে উঠলেন! ফুপুও গালিবের আগে থেকে জানা অনেক তথ্যই দিলেন এরপর। ঘটনাচক্রে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ে ফুপু এবং গালিবের চাচার পড়াশোনা। বাকি সব ব্যাপার তো এই যুগের পোলাপান গালিব ঢের আগেই বুঝে গেছে। চাচার একাকী থাকা যার কারণে তার নাম জানতো, চাচার অ্যালবামে তার ইউনিভার্সিটি লাইফের গ্রুপ ছবিতে অনেকবার দেখা সেই মানুষটির মুখোমুখি এখন সে। জীবন এক গল্পের বই কি এমনি এমনিই? ভাগ্যচক্রে ফুপুও এখন একা। এত বড় বাড়িতেও একা, বেশ দূরে অন্য দুই স্টেট থেকে আসে ছেলেমেয়েরা। ইউনিভার্সিটি অধ্যাপক ফুপা নেই, তবে এই শহরেই আছে তার শেষ শয্যা। ফুপু এসব শেয়ার করেননি, গীতিই এক ফাঁকে জানিয়েছে।

মিঠাইয়ের টুকরাসহ টেস্টি সব ডেজার্ট খাওয়া শেষ। কিন্তু এখন গালিবের স্বাভাবিকভাবেই চিন্তা হচ্ছে ফেরার সময় নিয়ে। বেশ রাত হয়ে গেছে অলরেডি। আর থাকা যায় না। ভেতরে ভেতরে রাগ হচ্ছে, খুব ভালোর বুঝলা কি তুমি গীতি তারান্নুম? তার মুখের দিকে তাকিয়ে গীতি আশ^স্ত করে … ‘এ-ই তো যাবো এখনই।’ কিন্তু ফুপুর অনুরোধ, আবদার … ‘আজ থেকে যা গীতি। এই রাতে এমন বৃষ্টিতে না-ই বা গেলি। তুমিও থাকো গালিব। বাগানের আউট হাউসে এখন টেন্যান্ট নেই। নিচেও বেডরুম রেডি আছে। যেখানে স্বাচ্ছন্দ্য লাগে থাকবে। আমরা ফুপু, ভাতিজি  ওপরে।’

কিন্তু কাছেই বন্ধু চন্দনের বাসায় যাওয়াই বেটার মনে হয় গালিবের। এই বৃষ্টিরাতে তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করে একা ফিরতে মন যেমন সায় দিচ্ছে না, তেমনি এখানে একা থাকাটাও অপছন্দের। যদিও ফুপু তাকে খুবই পছন্দ করছেন। চাচা প্রিয় বন্ধু ছিলেন, তাই সেও।

ঠোঁটকাটা গালিবের বলতে ইচ্ছে করে … ‘সবই তো বুঝলাম। তবে সেই প্রিয় মানুষটাকে আশাহত করলেন কেন? পারিজাতপ্রীতির কারণে পরিণয়হীন দেবদাসই রইলেন বেচারা পারতাস পাভেল।’ কিন্তু এসব বলা ঠিক নয়। নিজের বোধ, তাদের সমৃৃদ্ধ বনেদি পরিবারের এটিকেসি, শিক্ষা বাধা দেয়। তাছাড়া ইতোমধ্যে জেনেছে, গীতির দাদা যথেষ্ট রক্ষণশীল কড়া স্বভাবের ছিলেন। সম্ভবত ফুপুর ব্রিটিশ তাঁবেদার ডেপুটি দাদাও। এত বছর আগে একজন অল্পবয়সী মেয়ের পক্ষে চাইলেই এত বড় সিদ্ধান্ত একা নেওয়া কঠিন। সেই সময়ের প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। ভাবতে হতো পরিবার, সমাজ সবই। এটাও তো সে জানে, অন্যপক্ষের এইসব পারিবারিক ওজর-আপত্তি চিরকালের ভালো মানুষ সেই সময় বেকার চাচাসহ তাদের ভদ্র পরিবার যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। আর নিয়তির ব্যাপারটাও তো অস্বীকার করা যায় না। কাজেই কাকেই বা দোষ দেবে? 

যেমন আজকে এমন ঘটবে – আগে বিন্দুমাত্র জানতে পেরেছিল? এটাই ভবিতব্য। সে চন্দনের বাসায় যেতে চাইলে ফুপু আবার থাকতে বলেন। সব শুনে ফুপুরও পরিচিত চন্দনই চলে এলো। একতলায় লিভিংরুমে চিকেন স্যান্ডউইচ, কফি খেতে খেতে চারজনের গল্পকথায় উইকএন্ডের বৃষ্টিমুখর মাইনাস টেম্পারেচারের শীতার্ত রাত গভীর হয়। এর মধ্যে ফুপু চাচার ফেসবুক আইডি আছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। নেই শুনে আশ্চর্য হন, এই যুগেও পাভেল প্রাগৈতিহাসিক মানুষ?

হুম, চাচার স্মার্ট ফোনও নেই। শুনে গীতি হেসেই কুটিকুটি … ‘ওয়াও, পেনসিলভেনিয়া পাঠানো লাগবে ওনাকে। আমিশ পিপলদের সঙ্গে মিলবে ভালো।’

গালিবের রাগই হলো চাচার ওপর। আহা, বেশ হতো যদি এখন এই মুহূর্তে ফেসবুকে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারতো দুজনের! আসলে আগের যুগে এইসব হৃদয়-সংক্রান্ত ব্যাপার ছিল অন্যরকম আবেদনের। ছিল গভীরতা, কোমল মাধুর্য। উদাহরণ তার চাচা। আর এখন সাধারণ স্বাভাবিক হলো ব্রেকআপ। আবার দ্রুত নতুন রিলেশন হওয়াও মামুলি ব্যাপার। তবে ব্যতিক্রম এখনো আছে। গালিবের মনে হলো, দুজনের আনকমন নাম ও নামের অসাধারণ মিল তাদের সম্পর্ক তৈরির বেলায় বড় কারণ ছিল। 

তার সে-যুগের চাচার ফেসবুক আইডি না থাক, এ-যুগের গালিবের আছে। তাই এফবি ফ্রেন্ড হয়ে গেলেন ফুপু। তার ভাইঝিও। প্রীতি, গীতি দুজনেই এখন গালিবের এফবি বন্ধু। গীতি অল্পই পরিচিত ছিল, এখন ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব হলো ফেসবুকে। জানার সুযোগ হলো বেশি। কী জানি! কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়! গঙ্গা, সিন্ধু, নর্মদা, কাবেরী, যমুনা, শতদ্রু জল যেদিকে গড়ায় গড়াক! তখন দেখা যাবে! এখন তার চিন্তা আগামীকাল নিয়ে। ফিরে গেলেই বেটার ছিল! যা হওয়ার হয়েছে, ভেবে লাভ নেই। এখন জরুরি ঘুম। চন্দনসহ গ্রাউন্ড ফ্লোরে সুসজ্জিত বেডরুমে চলে এলো গালিব। অঝোর বৃষ্টির তীব্র শীতরাতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে আজকের পুরো ব্যাপারটা ব্যতিক্রমী এক গল্প মনে হয় গালিবের … জীবন তো এক গল্পের বই!