ছবি-ভাস্কর্যে নিত্যদিনের ভাবনার নতুন রূপ

গ্যালারি কলা কেন্দ্রে প্রায় সময় অভিনব প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়ে থাকে। মুক্তচিন্তার উন্মেষ, নতুনদের সুযোগ করে দেওয়া – এসবই তাদের নিত্য অনুশীলনের অংশ। এমনই একটি প্রদর্শনের আয়োজন হয়েছিল গত মার্চে। শিল্পী সুস্মিতা মুখার্জি মিষ্টির প্রথম এক প্রদর্শনী ‘পাঁচমিশালি’।

‘পাঁচমিশালি’ শব্দটি বাঙালির রান্নাঘর থেকে উঠে আসা একটি শব্দ। শুনতে পঞ্চব্যঞ্জনের কথা মনে হলেও পাঁচমিশালি মূলত নানা প্রকার দ্রব্যের সংমিশ্রণ। ভিন্ন ভিন্ন নানা প্রকার জিনিস মিলেও একটি ‘চমৎকার’ সৃষ্টি হওয়ার ঘটনাই হলো পাঁচমিশালি। নানা স্বাদ একসঙ্গে উপভোগ করার উপযোগিতা থাকে পাঁচমিশালি পদে। মানুষের জীবনে যেন তেমনি নানা চিন্তা-রস-ঘটনার স্বাদ আহরণ করে একটি জীবনের গল্প তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ছোটগল্প ‘জয়-পরাজয়’-এ বলেছিলেন, জীবন একটি পাঁচমিশালি রকমের জোড়াতালি। শিল্পী সুস্মিতা মুখার্জি মিষ্টির প্রদর্শনী ‘পাঁচমিশালি’ যেন এই উক্তিটি মনে করিয়ে দেয়। শিল্পী তাঁর আশেপাশে ও নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নানা গল্পের রূপ দিয়েছেন এই প্রদর্শনীতে।

সুস্মিতা মুখার্জি মিষ্টির জন্ম ১৯৯৬ সালে পুরান ঢাকায়। সেখানেই বেড়ে ওঠেন। পুরান ঢাকার জীবন, অলিগলি তাঁকে ছোটবেলা থেকেই ভাবিয়ে তুলত। শিল্পীর সঙ্গে আলাপে জানা যায় তাঁর শিল্পশিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠার গল্প, ছোটবেলা থেকে কী ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন সুস্মিতা, স্কুলে ছবি আঁকার সঙ্গে শিখেছিলেন ত্রিমাত্রিক মাধ্যমের কাজও। একটি প্রতিযোগিতায় তাঁর অতি চেনা পুরান ঢাকার ছবি আঁকেন, আর সেই ছবিটি অসম্পূর্ণ থাকার পরও পুরস্কারটি ওঠে তাঁর ঝুলিতেই। এই পুরস্কারপ্রাপ্তির ঘটনায় অনুপ্রাণিত হন সুস্মিতা। বোধহয় সেজন্যই শিল্পী হয়ে ওঠার পরও তাঁর চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু জীবনের অতিপরিচিত সাধারণ নানা গল্প। এসব গল্প ফুঠে ওঠে তাঁর ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্মে।

নিত্যদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ও চিন্তাভাবনা জাল বিস্তার করে থাকে সুস্মিতার ভাস্কর্যে এবং ছবিতে। ফর্মগুলি পুরান ঢাকার জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে থাকার স্পষ্ট পরিচয় দেয়।

এই প্রদর্শনীতে মোট ১১টি শিল্পকর্ম প্রদর্শন করা হয় – যার মধ্যে দুটি ইন্সটলেশন, একটি ড্রইং সিরিজ যা ইলাস্ট্রেশন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল ও আটটি ভাস্কর্য যার প্রতিটি আলাদা আলাদা গল্প বলে।

একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পরিচিত ফর্ম সুস্মিতার শিল্পকর্মকে করেছে সাবলীল। উদাহরণ হিসেবে তাঁর ‘রিকশা এক’ এবং ‘রিকশা তিন’ শিল্পকর্মের কথা বলা যেতে পারে। অতিপরিচিত রিকশা, যা বাংলাদেশের তথা ঢাকার ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলে আছে, তারই চমৎকার নান্দনিক রূপ যেন ভাস্কর্য দুটি। ভাস্কর্য দেখলে বোঝা যায়, বস্তুর ভারসাম্য নিয়েও
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন এই শিল্পী। মাধ্যম হিসেবে সরু লোহার তার ব্যবহার করেছেন আর রঙের যে-ছটায় রিকশার চিরাচরিত রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন তা এনে দিয়েছে রঙিন সুতার ব্যবহার। সুতাগুলি উলের সুতা। শিল্পী জানান, সুতা ব্যবহারের বিষয়টি মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন।

সুস্মিতার রিকশা নিয়ে কাজ করার গল্প খুব সাধারণ। একটি দুর্ঘটনায় উল্টে যায় শিল্পীকে বহনকারী রিকশা, আর তখনই তাঁর মনে উদয় ঘটে রিকশা অঙ্কন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টি।

সুস্মিতাকে বারবার দেখা যায় নিজের চারপাশকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে তাকে নতুন ও নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করতে। রিকশা ভাস্কর্যটি এর অন্যতম উদাহরণ। সুস্মিতা একটি বস্তুর মধ্যে অন্য একটি বস্তুকে খোঁজেন। সেই অদ্ভুত সাদৃশ্য তাঁর মধ্যে গল্পের অবতারণা করে। তিনি আরো গভীরে গিয়ে এই সাদৃশ্যের ব্যাখ্যা খুঁজে বেড়ান।

রিকশার মতোই অতিপরিচিত যানবাহন নৌকা। জলে ভাসমান নৌকাকে তিনি কড়াইয়ের বিপরীত চরিত্র অথচ সদৃশ বলে মনে করেন। কড়াইয়ের মধ্যে পানি থাকে, কখনো থাকে মাছ। নৌকার সঙ্গে কড়াইয়ের গঠন ও চরিত্রের সাদৃশ্য জীবনের প্রগাঢ় বাস্তবতাকে জানান দেয়। দৃশ্যত বস্তুবিশেষে সাদৃশ্য থাকলেও চরিত্রে ব্যাপক বৈপরীত্য থাকতে পারে – এমনসব গভীর চিন্তার প্রকাশে নৌকা নিয়ে করা কাজটি। নৌকার মতো দেখতে হলেও শিল্পী এর নাম দিয়েছেন কড়াই। ‘রিকশা’ সিরিজের ভাস্কর্যগুলির মতোই রঙিন উলের সুতা ও লোহার তার আর খুঁজে-পাওয়া লোহার কড়াই দিয়ে যে-ভাস্কর্য তৈরি করেছেন তাকে পাল তোলা নৌকা না বলে পারা যায় না।

‘আ কেইজ’ বা ‘একটি খাঁচা’ ভাস্কর্যটিতে বস্তুর ভরের একটি কাব্যিক রূপ দাঁড় করিয়েছেন শিল্পী। এখানেও শিল্পী নানা রকম নিরীক্ষা করেছেন। মনোমুগ্ধকর এই সকল ভাস্কর্য গ্যালারিতে উপস্থাপনের পর আলোছায়ার খেলা মিলে এক অন্য মাত্রা সৃষ্টি করেছে। দেয়ালের ছায়াগুলি দেখলে শিল্পীর দক্ষতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

সুস্মিতা পরিবেশ নিয়েও ভেবেছেন। পরিবেশে দূষণ তাঁকে এতটাই ভাবিয়ে তুলেছে যে, তিনি শিল্পকর্মের মাধ্যমে তা প্রকাশ করেছেন। পরিবেশ দূষণকারী পলিথিন দিয়ে বানিয়েছেন শিল্পকর্ম। প্লাস্টিক ও পলিথিন যেন পরিবেশের ক্ষতি করতে না পারে – তারই প্রচেষ্টা যেন এই শিল্পকর্মগুলি। অথবা একে একটি শৈল্পিক আন্দোলনও বলা যেতে পারে।

মানুষ যখন তার চারদিকে গভীরভাবে দেখতে শুরু করে তখন সে আরো বেশি করে নিজের হয়ে ওঠে। নিজের চিন্তাগুলি আরো গুছিয়ে সুন্দরভাবে করে এবং সেই নিজস্বতাকে নিয়ে সমাজজীবন ও পৃথিবীর হয়ে ওঠে একজন পরিপূর্ণ মানুষ। শিল্পী সুস্মিতা যেমন তাঁর কাজের মাধ্যমে নারী হয়ে উঠেছেন, তেমনি হয়ে উঠেছেন পরিবেশবাদী। সংস্কৃতির আচারে সহজলভ্য বস্তুর ব্যবহার তথা তাঁর কাজের মন্ত্রণা এসেছে হয়তো পারিবারিক চর্চা থেকেই। রান্নাঘরের ফেলে দেওয়া ডিমের খোসাকে গ্যালারিতে উপস্থাপনের জন্য রূপান্তর তারই প্রতিচ্ছবি।

সহজপ্রাপ্য উপকরণ দিয়ে ভাস্কর্য তৈরির ঘটনা নতুন নয়, মার্সাল ডুসম্পের কাজ থেকে এখনকার সময় পর্যন্ত বহু শিল্পী ফেলে দেওয়া বস্তুকে নতুন রূপে দেখেছেন, তবে সুস্মিতার শিল্পকর্মে রয়েছে অকপট সরলতা। তাঁর ভারসাম্য নিয়ে কাজ করার বিষয়টি মুগ্ধতা দিয়েছে। উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার, যা দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিলে আছে – সেই রঙের ব্যবহারে দিয়েছেন পরিমিতিবোধের পরিচয়। পুরনো জং-ধরা লোহার সঙ্গে রঙের এই ব্যবহারও পরিণত শিল্পচর্চা – দৃশ্যত উপস্থাপনা উদাহরণ।

শিল্পী সুস্মিতা মুখার্জি মিষ্টি ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  চারুকলা বিভাগ থেকে এমএফএ পাশ করেন। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পুরস্কারসহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা।