জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রাগ্ভাষ

উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁসের প্রাণপুরুষ ও মহীরুহ নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথ। সংস্কৃতির এমন কোনো দিক নেই, যেখানে তাঁর পদপাত ঘটেনি। চতুর্দশ শতাব্দীতে ইতালিতে যে নবজাগরণের সূত্রপাত, পরবর্তীকালে যা সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে, সেখানেও কোনো দেশে রবীন্দ্রনাথের মতো সর্বত্রগামী একক প্রতিভার  আবির্ভাব হয়নি। শেলি, কিটস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবি, কিন্তু  চিত্রকর নন, শেক্সপিয়র  নাট্যকার-কবি, কিন্তু  সংগীতরচয়িতা  নন, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বহুকিছু, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্মদাতা নন।

রবীন্দ্রনাথের  সামগ্রিক  প্রতিভার অন্য উজ্জ্বল বিচ্ছুরণ তাঁর গানে। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। ছোটবেলায় ওস্তাদের কাছে তালিম নিয়েছেন, এগারো বছর বয়সে শুরু করেছেন সংগীতরচনা (গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে) আর আরেকটু বয়স হলেই সেজদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গানে সুরারোপ করছেন। স্বামী বিবেকানন্দ (সে-সময় নরেন্দ্রনাথ দত্ত) তাঁর চব্বিশ বছর বয়সে যে-গানের বইয়ের সংকলন সঙ্গীতকল্পতরু বের করেন, সেখানে রবীন্দ্রনাথের একাধিক গান যুক্ত হয়েছে। একসঙ্গে দুজনে সংগীত পরিবেশন করছেন, তারও ইতিহাস আছে, যদিও পরবর্তীকালে তাঁদের সম্পর্কে চিড় ধরে।

১৮৭৮-এ বিলেত গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে তিনি পাশ্চাত্যসংগীতের ক্লাসে নিয়মিত যোগ দিতেন। ঠাকুর পরিবারের সাংগীতিক পরিবেশ এবং তাঁর এই সংগীতশিক্ষা, এই দুইয়ে মিলে রবীন্দ্রনাথের সংগীতপ্রতিভা বিকশিত হয়।

শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রবর্তিত হলে সেখানে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে গান ও ছবি আঁকা শেখার ব্যবস্থাও রেখেছিলেন তিনি। এর ফলে, এবং দেশি-বিদেশি অধ্যাপক ও ছাত্র পূরিত বিশ্বভারতীতে গানের সুরের ধারা বইতো। রবীন্দ্রনাথের সংগীতপ্রতিভা বিকাশের জন্য এক সূতিকাগার বিশ্বভারতী।  এখানে গান শিখে রবীন্দ্রসংগীতকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেন যে যে সংগীতশিল্পী, তাঁদের মধ্যে দুই স্বনামধন্য গায়িকা সুচিত্রা মিত্র আর কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।

রবিবাবুর গান থেকে রবীন্দ্রসংগীত, উত্তরণের পর্যায়

গোড়ার দিকে তাঁর গান যাঁদের গলায় গীত হতো, তাঁদের মধ্যে  কনক দাশ, সতী দেবী, সাহানা দেবী প্রমুখের ভূমিকা  অবিস্মরণীয়। তার আগে অবশ্য ব্রাহ্মসমাজের নানা অনুষ্ঠানে  তাঁর গান গাওয়া হতো, তবে তা ছিল নিতান্ত সীমিত পরিসরে, এবং পূজা পর্যায়ের বাইরের গান সেখানে পরিবেশিত হওয়া স্বাভাবিক কারণেই সম্ভব ছিল না। স্বামী বিবেকানন্দের কাছে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব গান শুনতে চাইতেন। স্বামীজী অন্যান্য গানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানও তাঁকে গেয়ে শুনিয়েছেন।

গোটা উনিশ শতকে রবীন্দ্রনাথের গান ছিল নিতান্তই একটি ক্ষুদ্র বলয়ে সীমাবদ্ধ। বিশ শতক থেকে তা ক্রমশ জনপ্রিয় ও প্রসারিত হতে থাকে। শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরা তো বটেই, বিভিন্ন সময়ে বহু লোককে রবীন্দ্রনাথ নিজে ও দিনেন্দ্রনাথ, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ প্রমুখ গান শিখিয়েছেন।

সেকালের রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীরা

সাহানা দেবী, সতী দেবী, অমলা দাশ, কনক দাশ, সুপ্রভা রায়, বিজয়া রায়, প্রতিভা বসু প্রমুখ শিল্পীকে রবীন্দ্রনাথ গান শিখিয়েছেন। এঁদের মধ্যে সাহানা দেবী (১৮৯৭-১৯৯০) ছিলেন কবি-গীতিকার অতুলপ্রসাদ সেনের বোন। ১৯০৫-এ মাত্র আট বছর বয়সে তিনি কালমৃগয়া গীতিনাট্যে ঋষিকুমারের চরিত্রের গানগুলো করে স্বয়ং কবিকে অবাক করে দেন। তাঁর প্রথম রেকর্ড ‘আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর  গান শুনে বলেছিলেন, ‘তুমি যখন আমার গান করো, শুনলে মনে হয় আমার গান রচনা সার্থক হয়েছে – যে গানে আমি যতখানি আছি ততখানি ঝুনু-ও (সাহানার ডাকনাম) আছে।’ সাহানার কণ্ঠে ‘মহারাজা বেওয়ারিয়া খোলো’ শুনে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘ওগো পথের সাথী, নমি বারম্বার’, আর ‘প্রেম ভগারিয়া’ শুনে লেখেন ‘যাওয়া-আসার এ কী খেলা’।

অমলা দাশ (১৮৭৭-১৯১৯) ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ছোট বোন। দিনেন্দ্রনাথেরও আগে তিনিই রবীন্দ্রনাথের গান লিখে রাখার কাজটি করতেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর দ্বৈতকণ্ঠে গানও আছে। গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি ১৯১৪ সালে প্রথম পুজোর সময় গানের রেকর্ড বের করা শুরু করে। সে-বছরই পুজোর সময় অমলার রবীন্দ্রসংগীত বের করে তারা। গানদুটি হলো ‘প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী’ এবং ‘হে মোর দেবতা’। গবেষক টুম্পা মুখোপাধ্যায় জানান, অবিবাহিতা অমলা অনেককেই রবীন্দ্রসংগীতে তালিম দিয়েছেন।

সতী দেবী (১৯১১-১৯৯০ তাঁরই মেয়ে অভিনেত্রী-সংগীতশিল্পী রুমা গুহঠাকুরতা) সত্যজিৎ রায়ের শ্যালিকা, অর্থাৎ বিজয়া রায়ের বড় বোন। রবীন্দ্রনাথের পরিচালনায় মায়ার খেলা অভিনীত হয় কলকাতার রক্সি হলে। তাতে তিনি ছিলেন। সাধিকা আনন্দময়ীকে গান শুনিয়েছেন তিনি। প্রথম রেকর্ড ‘হে ক্ষণিকের অতিথি’। কানন দেবীর ছবিতে নেপথ্য কণ্ঠদান করেছিলেন এই গুণী শিল্পী। বম্বের (অধুনা মুম্বাই) পৃথ্বী থিয়েটারের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, তিনিই সর্বপ্রথম রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষাকেন্দ্র খোলেন, ‘গীতালি’।

আর এক শিল্পী কনক দাশ (১৯০৩-১৯৮৮) ছিলেন সুকুমার রায়ের শ্যালিকা ও দেবব্রত বিশ্বাসের ভ্রাতৃবধূ। রবীন্দ্রনাথ এঁকেও গান শিখিয়েছেন। তাছাড়া ইন্দিরা দেবী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, দিলীপকুমার রায় প্রমুখের কাছেও তিনি তালিম নেন। পরবর্তীকালে আকাশবাণী কলকাতায় রবীন্দ্রসংগীতে অডিশন দিতে আসা শিল্পীদের পরীক্ষক হন তিনি।
১৯২৭-এ তাঁর প্রথম রেকর্ড বেরোয়, ‘কবে তুমি আসবে বলে’। সে-আমলে যাঁদের রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড বেরোয়, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল তাঁর, – ৬৮টি। দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে একাধিক গান আছে তাঁর।

সুকুমার রায়ের স্ত্রী, কনক দাশের বোন এবং সত্যজিৎ রায়ের মা সুপ্রভা রায় এতদিন কাব্যে উপেক্ষিতা হয়েই ছিলেন। তিনি নিজেও যে স্বতন্ত্র এক প্রতিভা, সম্প্রতি ড. টুম্পা মুখোপাধ্যায়ের গবেষণায় তা উঠে এসেছে। তিনি জানাচ্ছেন, সুপ্রভাকেও গান শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তবে তাঁর গানের রেকর্ড নেই, কোরাসে গলা মেলানোর উদাহরণ ছাড়া। সত্যজিৎ-জায়া বিজয়া রায়ও অশেষ সংগীতগুণী। ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সংগীতে পারদর্শিতা ছিল তাঁর। রবীন্দ্রগানেও।

এইসব শিল্পী গোড়ায় রবীন্দ্রসংগীতকে জনপ্রিয় করায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পাশাপাশি চলচ্চিত্র ও নাটক-গীতিনাট্যের মাধ্যমেও তা প্রসারিত হচ্ছিল। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমেও তা সারা উপমহাদেশে বিস্তৃত হয়। শিক্ষক শৈলজারঞ্জন ছুটিতে ময়মনসিংহে এসে, বা ছাত্রী সাবিত্রীকৃষ্ণন দক্ষিণ ভারতে তাঁর গান গেয়ে তাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। একে একে গড়ে ওঠা রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষায়তনের মাধ্যমেও তা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

শান্তিনিকেতন ও সেখানকার শিল্পীরা

শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম ও পরবর্তীকালে বিশ্বভারতীর মাধ্যমে অসংখ্য শিল্পী তৈরি হয়েছেন। প্রথমদিকে শান্তিদেব ঘোষ, অনাদিকুমার ঘোষ দস্তিদার, ইন্দিরা দেবী প্রমুখ। তৎসহ শৈলজারঞ্জন। রবীন্দ্রসংগীত শেখানো ও স্বরলিপি লিখে রাখার দায়িত্ব ছিল এঁদের। স্বরলিপি ধরে রাখায় দিনেন্দ্রনাথ অনন্য। ছিলেন সুধীরচন্দ্র করও।

এই পর্যায়েই কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা মিত্রের আবির্ভাব। প্রথমে ছাত্রী হয়ে, পরে কিংবদন্তি গায়িকা ও প্রখ্যাত সংগীতগুরু রূপে।

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২৪-২০০০)

তাঁর প্রকৃত নাম অণিমা। পিতৃগত পদবি মুখোপাধ্যায়। মা অনিলা দেবী ও বাবা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়ের পাঁচ মেয়ে ও তিন ছেলের মধ্যে তিনি সবার বড়। তাঁর জন্ম রামকিঙ্কর বেইজ, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, কলিম শরাফীর দেশ বাঁকুড়ায়। তাঁর বাবা ছিলেন বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগারকর্মী। সেই সূত্রে অণিমাদের শান্তিনিকেতনে বসবাস। সেখানকার উদার ও উন্মুক্ত পরিবেশ, বারো মাসে শান্তিনিকেতনের নিজস্ব তেরো পার্বণ তাঁর মানসগঠনে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। স্বভাবের দিক থেকে ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন আত্মমুখী (introvert), যদিও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে তিনি সহজ ও খোলামেলা। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘আমার আবদার করার, আমার নালিশ জানাবার, আমার অভিমান করার, আমার সমাধান খুঁজে দেবার মানুষ তিনি।’

রবীন্দ্রনাথ অণিমার নাম পালটে রাখলেন কণিকা। সেটা ১৯৩৫। আর অবনীন্দ্রনাথ তাঁকে ডাকতেন মোহর, আকবরী মোহর। সেই থেকে তিনি এই দুটি নামেই পরিচিত ও খ্যাত।

সংগীতসাধনা ও প্রথম রেকর্ড

মাত্র তিন বছর বয়স থেকে তিনি শান্তিনিকেতনবাসিনী। বলা যায়, জন্মাবধি গান শুনে আসছেন। বিশ্বভারতীতে তখন সংগীতচর্চা পুরোদমে চলছে। ধ্রুপদী সংগীতেরও তালিম দেওয়া হয়, হতো সেখানে। শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কাছে গান শিখে তাঁর সংগীতে হাতেখড়ি। তার আগে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কণিকার প্রথম পরিচয়ের ঘটনাটি স্মরণ করা যাক। কণিকা তাঁর আত্মজীবনী আনন্দধারায় যা লিখেছেন, সেই অনুযায়ী। শিশু অণিমা এক কালবৈশাখীর রাতে উত্তরায়ণে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য অতি মহৎ, – সেখানকার আমগাছ থেকে আম চুরি। কবির দৃষ্টি এড়ায়নি। কবি ডেকে জানতে চাইলেন তাঁর পরিচয়, এবং জেনে খুব খুশি হলেন যে আশ্রমবাসী সোনামুখীর মানুষ সত্যচরণবাবুর মেয়ে সে। সেই থেকে সখ্য, গান শেখানো। একদা যে রাণু মুখোপাধ্যায়কে (১৯০৬-২০০০) নিয়ে গান লিখেছিলেন কবি ‘ওগো তুমি পঞ্চদশী, পৌঁছিলে পূর্ণিমাতে’, সেই গান তিনি পরবর্তীকালে শেখালেন কণিকাকে। গানটি বেতারে প্রচারিত কণিকার প্রথম গান, যদিও প্রত্যক্ষভাবে নয়। ১৯৪০-এর ২৪শে জুলাই বোলপুরে টেলিফোন কেন্দ্রের শুভ উদ্বোধন হয়। সে অনুষ্ঠান কলকাতা বেতার সম্প্রচার করে বলেই কণিকার গান বেতারে পরিবেশিত হতে পেরেছিল।

যাই হোক, যে কণিকার গান এপার ও ওপার বাংলা, তথা সমগ্র বিশ্বে আদৃত, যাঁর গান মর্মে বেঁধে না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর, তাঁর সংগীতে যে নীরন্ধ্র সাধনা, তা আমাদের বিস্মিত না করে পারে না। ধ্রুপদী ও লঘু, দুটি ধারায় তালিম নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সংগীতগুরুদের দীর্ঘ তালিকা দেখলে আমরা অনুধাবন করতে পারবো, কতখানি নেপথ্যবিধান নিয়ে তিনি সংগীত-পরিবেশনায় নামেন। আদিতে রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেনই, সঙ্গে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইন্দিরা দেবী, রমা কর, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, অমিতা সেন, শান্তিদেব ঘোষ তাঁর সংগীতগুরু। তালিকাটি এখানেই শেষ নয়। শাস্ত্রীয় সংগীতে তিনি তালিম নেন হেমেন্দ্রলাল রায়, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডি. ডি. ওয়াজেলওয়ালা, পি. এস. চিনচেরি এবং ধ্রুবতারা যোশীর কাছে। তাছাড়া তিনি অতুলপ্রসাদী গানের চর্চাও করেছেন, রেকর্ড বের করেছেন হরেন্দ্রপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অধ্যক্ষতায়। প্রসঙ্গত, বিশিষ্ট অতুলপ্রসাদী, রজনীকান্তের গান ও দ্বিজেন্দ্রগীতির শিল্পী কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় ছিলেন হরেন্দ্রপ্রসাদের বাবা। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ তাঁকে শিখিয়েছেন ভজন। এছাড়াও তিনি গান শিখেছিলেন কমল দাশগুপ্ত এবং ফিরোজা বেগমের কাছে। তাঁরা কণিকাকে শেখান নজরুলগীতি।

কণিকার প্রথম রেকর্ড বেরোয় তাঁর মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে। ১৯৩৮ সালে। সেটা কিন্তু রবীন্দ্রসংগীত নয়। নীহারবিন্দু সেনের কথা ও হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের সুরে গেয়েছিলেন তিনি। গানদুটো হলো – ‘ওরে ওই বন্ধ হলো দ্বার’ এবং ‘গান নিয়ে মোর খেলা’। রবীন্দ্রনাথ স্বভাবতই এতে মনঃক্ষুণ্ন না হয়ে পারেননি। অচিরেই হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি থেকে তাঁর রবীন্দ্রসংগীত বেরোয়। রেকর্ডের এক পিঠে ছিল ‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে’, আর অন্য পিঠে ‘ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে’। তারপর তো রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে তাঁর জীবনভর অভিযান – গায়িকারূপে, শিক্ষিকারূপে, গবেষিকারূপে।

দেশে-বিদেশে অসংখ্যবার পরিবেশন করেছেন তাঁর মরমি গলার গান, মুগ্ধ করেছেন অগণিত শ্রোতাকে। বিশ্বভারতীর সংগীতভবনে শিক্ষকতার সূত্রে তৈরি করে গেছেন বহু শিল্পী। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রতি রোববার ‘সংগীতশিক্ষার আসর’ পরিচালনার মাধ্যমে গান শিখিয়েছেন। একক কণ্ঠ ছাড়াও দ্বৈতকণ্ঠে পরিবেশিত হয়েছে তাঁর গান। চলচ্চিত্রে নেপথ্যকণ্ঠ দিয়েছেন। অভিনয়ও করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে গবেষণামূলক বই লিখেছেন, লিখেছেন আত্মজীবনী, নাম আনন্দধারা।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বিশ্বভারতী এবং এইচএমভি যে নির্বাচিত শিল্পীদের নিয়ে বেশ কিছু রেকর্ড বের করে, সেখানে কণিকার ছিল সম্ভ্রান্ত অবস্থান। পরবর্তীকালে যখন এলপি রেকর্ডের আবির্ভাব হলো, তখন তাঁর বারোটি গানের সংকলন বেরোয়। তাছাড়া ‘পথের শেষ কোথায়’ নামে একটি অ্যালবাম বেরোয়, যেখানে একক, দ্বৈত ও সম্মিলিত কণ্ঠে গেয়েছিলেন সুচিত্রা মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও কণিকা।

জয়যাত্রায় যাও গো, ওঠো ওঠো জয়রথে তব

কণিকার তুমুল জনপ্রিয়তা রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলি একে একে প্রকাশিত হতে থাকলে। শ্যামাতে তিনি শ্যামার গানগুলি গেয়েছেন, আর শাপমোচনে মধুশ্রী তথ্য কমলিকা। এ-দুটির কাহিনি কবি নিয়েছেন বৌদ্ধ আখ্যান থেকে। কণিকার অভ্রান্ত স্বরক্ষেপণ, দরদি পরিবেশনা আর বেদনাপ্রকাশের গাঢ় ভাস্কর্যে তাঁর পরিবেশিত গানগুলি গীতিনাট্যদুটিকে চিরঅমর করে রেখেছে। বারবার শুনলেও যা একঘেয়ে লাগে না।

তাঁর কণ্ঠে অতুলপ্রসাদের গানও তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রা নিয়ে এসেছে। খুব বেশি অতুলপ্রসাদী গান করেননি ঠিকই, তবে সেসব গানের শুদ্ধ উচ্চারণ, মরমি উপস্থাপন শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। প্রায় ছয় দশক ধরে ব্যাপ্ত তাঁর সংগীতজীবন।

১৯৩৫-এ শারদোৎসবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এগারো বছরের কণিকা গান করেছিলেন। ১৯৩৭-এ তিনি কলকাতায় আসেন ‘ছায়া’ সিনেমাহলে সংগীত পরিবেশন করতে। ঐতিহাসিক যে-অনুষ্ঠানে তিনি গুরুদেবের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গাইলেন বর্ষামঙ্গলের গান ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’।

১৯৪১ কণিকার জীবনে মহাগুরুনিপাত, – রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ! শান্তিনিকেতনে তখন কবির স্মরণে গাওয়া হয়েছিল ‘সমুখে শান্তিপারাবার, ভাসাও তরণী হে কর্ণধার’। গানটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ডাকঘর নাটকের অন্তিম গানরূপে। কিন্তু তাঁর নির্দেশ ছিল, তাঁর মৃত্যুর আগে যেন সে-গানটি কখনো গাওয়া না হয়। বাইশে শ্রাবণ তেরশো আটচল্লিশের পরে এ-গান গাইবার ক্ষেত্রে আর বাধা থাকল না। শৈলজারঞ্জন মজুমদারের পরিচালনায় গানটি এ-সময় বৃন্দগান হিসেবে পরিবেশিত হয়। এখানে কণিকাও কণ্ঠ দেন। প্রসঙ্গত, ডাকঘর নাটকে একদা তিনি সুধা-চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন।

এর দু-বছর পর ১৯৪৩-এ তিনি বিশ্বভারতীর সংগীতভবনে যোগ দেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র উনিশ। ১৯৮৪-তে অবসরে যাওয়া পর্যন্ত তিনি সংগীতভবনে ছিলেন। পরে এখানে এমেরিটাস অধ্যাপক হন।

ইতোমধ্যে তিনি এইচএমভির শিল্পীতালিকায় স্থান পেয়েছেন। নিয়মিত তাঁর রেকর্ড বেরোতে থাকে এ-বছর থেকে। এখানে তাঁর প্রথম প্রকাশিত রেকর্ডের একপিঠে ছিল ‘এসো শ্যামল সুন্দর’, অন্যপিঠে ‘ওগো তুমি পঞ্চদশী’। শুরু হয় রবীন্দ্রসংগীতভুবনে তাঁর পদযাত্রা, যা আমৃত্যু বজায় ছিল।

আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমগ্র জীবনে রবীন্দ্রসংগীত, রবীন্দ্র গীতিনাট্য, অতুলপ্রসাদ, নজরুলসংগীত, ভজন, কীর্তন ইত্যাদি মিলিয়ে অসংখ্য গান রেকর্ড করেছেন। তবু তাঁর পরিবেশিত সমস্ত গানের মধ্যমণি হয়ে আছে তাঁর গাওয়া ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ, সত্যসুন্দর’ গানটি। কণিকা এবং এই গানটি যেন আইডেন্টিক্যাল। এমনকি শান্তিনিকেতনে তিনি যে-বাড়িটি করেন, তার নামও দিয়েছিলেন ‘আনন্দধারা’। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীর রবীন্দ্রসংগীতের ত্রিবেণীসঙ্গম-এ পাই, এটি কবির একটি ভাঙা গান। মালকোষ রাগে গানটির সুর করেছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার পণ্ডিত রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কণিকা গানটি বিভিন্ন সময়ে মোট তিনবার রেকর্ড করেছিলেন। তাঁর জীবনটাই ছিল যেন রবীন্দ্র অবগাহনে সিক্ত, স্নিগ্ধ আর সুরভিত আনন্দধারা!

রবীন্দ্রনাথের সব ধরনের গানেই তিনি পারদর্শী এবং চরম আবেদনময়। তা কি ব্রহ্মসংগীত, কি প্রেম পর্যায়ের গান, অথবা প্রকৃতি পর্যায়ের। শ্যামা নৃত্যনাট্যে শ্যামার গানগুলিতে কখনো বজ্রসেনের প্রতি তাঁর প্রেমিকসত্তা, কখনো প্রেমিক উত্তীয়ের প্রতি তাঁর নির্লিপ্তির প্রকাশ অনবদ্য। এই পর্যায়ে শ্যামার গান ‘এতদিন তুমি সখা চাহনি কিছু’র পরবর্তী অংশে যখন শ্যামা গেয়ে ওঠে, ‘রাজ অঙ্গুরী মম করিলাম দান,/ তোমারে দিলাম মোর শেষ সম্মান’ শুনে আমাদের শেক্সপিয়রকে মনে না পড়ে পারে না, ‘Frailty, thy name is woman’।

আবার অন্তিমে যখন শ্যামা তার অপরাধের জন্য বজ্রসেনের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, জীবনানন্দ-বর্ণিত ‘ছিন্ন খঞ্জনার মতো’ তাঁর আছড়ে পড়া কী অসাধারণভাবে সংগীতের মধ্য দিয়ে শ্রোতার মনে গেঁথে দেন তিনি, ‘তুমি ক্ষমা করো’ অংশটি তিনবার উচ্চারণের মধ্য দিয়ে। শ্যামায় তাঁর কণ্ঠের কোনো বিকল্প নেই, মনে হয় হবেও না ভবিষ্যতে। যেমন হবে না চিত্রাঙ্গদা চরিত্র গানের পর গানে মূর্ত করায়। কণিকার যাবতীয় গানের পরিবেশনা অন্তিমে এক আনন্দের প্লাবন ও পূর্ণতা এনে দেয়। এমন নয় যে, রবীন্দ্রসংগীতের অপরাপর শিল্পী, যেমন সুচিত্রা মিত্র, রাজেশ্বরী দত্ত, নীলিমা সেন, দেবব্রত-হেমন্ত-শান্তিদেব ঘোষে তা অনুপস্থিত। কিন্তু এ-কথা মানতেই হবে, কবি কিটস যাকে শিল্পে ‘ঋরহব বীপবংং’ বলেছেন, তা কণিকার মধ্যে পুরোপুরি পাওয়া যায়। কবিতা বা গান যেমন শিল্প, তেমনি গায়নকলাও শিল্প, গায়ক-গায়িকারাও শিল্পী।

কণিকা বহু গুণীর কাছে গান শিখেছিলেন, আর প্রথমদিকে তাঁর গলা অন্যান্য সঙ্গীতশিল্পীর তানেই বাঁধা ছিল। কিন্তু পরে সহসা তিনি এমন এক গায়কির আবাহন ঘটালেন, হ্যাঁ, তাকে আবাহন ছাড়া আর কী-ই বা বলা যাবে, যে তিনি অন্যসব রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীর থেকে স্বতন্ত্র হয়ে রইলেন। এমনকি তাঁর গণনাতীত শিষ্যের মধ্যে প্রমুখ যাঁরা, সেই মায়া সেন, বনানী ঘোষ, পাপিয়া সারওয়ার, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা প্রমুখ সেই বিশেষ পরিবেশনের বৈশিষ্ট্য আয়ত্ত করতে পারেননি বা চেষ্টাও করেননি; কেননা ওই গায়কি একমাত্র তাঁকেই মানায়। অন্যদিকে সুচিত্রা মিত্রের গায়কি তাঁর সেরা শিষ্যরা, – রমা মণ্ডল বা পূর্বা দাম রপ্ত করতে পেরেছিলেন।

নানান ধরনের গানে কণিকার পারদর্শিতা ও মুনশিয়ানা থাকলেও টপ্পা অঙ্গের রবীন্দ্রসংগীতে তাঁর প্রবণতা ও সে-জাতীয় গান অধিগত করার ক্ষমতা ছিল প্রশ্নাতীত।

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় : এলেম আমি কোথা হতে

কণিকার এই জগৎ, সংগীতের জগৎ, এর উৎস কী?

প্রাক-রবীন্দ্রনাথের গান এবং রবীন্দ্রসংগীত, এই দুই ভুবনের বার্তা কী? এর উত্তর পেতে গেলে আমাদের উনিশ শতকের বঙ্গীয় নবজাগরণের বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে খানিকটা অবগত হতে হবে।

ঐতিহাসিক সুশোভন সরকার নবজাগরণ বা রেনেসাঁসের কয়েকটি সময়বিভাগ করেছেন। এরই এক পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সমসাময়িকদের আবির্ভাব। মনে রাখতে হবে, সংগীত, চিত্রকলা বা সাহিত্য, কার্ল মার্কসের মতে, সমাজের উপরিকাঠামো। তাই রবীন্দ্রনাথের গান বা এমনকি সমগ্র সাহিত্যকর্মে যা পাই, তা একদিকে বিস্ময়কর, অন্যদিকে সীমাবদ্ধ, এই অর্থে যে, ‘হয় নাই সে সর্বত্রগামী’। এটি তাঁর শিল্পীজনোচিত বিষয় নয়, বাস্তবেই হয়নি। তার বাণীবন্ধে যা নতুন ও অভিনব, স্যোসুর-কথিত তা কেবল সময়ের সঙ্গে ভাষার বিবর্তনই নয়, (‘Stigmatized as the merely diacronic’) তদতিরিক্ত আরো অনেক কিছু। এখানেই তিনি অজরামর, এবং তিনি আবার এখানেই সীমাবদ্ধ। কোনো রবীন্দ্রসংগীতের আসরে আজো, তাঁর গানের তুমুল জনপ্রিয়তার দিনেও, দশ হাজার শ্রোতা এক আসরে মিলবে না, যা যাত্রাপালা বা লালনগীতির আসরে মিলবে। বর্তমান লেখক শান্তিনিকেতন পৌষমেলায় দিনদুপুরে মনসামঙ্গল পালা শুনতে দেখেছে কম করে ছ-হাজার শ্রোতাকে। অতএব উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁস বুর্জোয়া অবশ্যই।

তবে এতে আক্ষেপের নেই কিছু। আডর্নো আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, ‘বিটোফেন যদি বুর্জোয়া বিপ্লবের একটি সংগীতধর্মী প্রতিরূপ হয়ে থাকেন, তাহলে একই সঙ্গে তিনি এমন এক সংগীতের প্রতিরূপ, যা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত, যা নান্দনিকভাবে স্বশাসিত এবং যা কারো দাস নয়।’ এই নান্দনিকতা ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তিই পাই রবীন্দ্রনাথের লেখায়, গানে, ছবি আঁকায়।

এবং আহরণ, যা বহুমাত্রিক। রবীন্দ্রনাথের গানে বাউল কীর্তন যেমন, হিন্দুস্তানি থেকে ভাঙা গান (হিন্দি, মারাঠি, গুরুমুখী, কন্নড়, তামিল, রাজস্থানি), তেমনি পাশ্চাত্য সংগীত, সবকিছু থেকেই আহরণ করেছেন, সুর, ক্বচিৎ আবার বাণীও। তাই বিটোফেন বা শানবার্গ যেমন সমকালীন সমাজব্যবস্থার গতিশীলতাকে প্রতিফলিত করেন, বা তানসেন প্রতিফলিত করেন আকবরের যুগকে, রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক ভারতকে, তার নবজাগরণের পরশপাথরের সাহায্যে। আর যেহেতু তিনি আবার ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী, তাঁর রচিত ব্রহ্মসংগীতে রাজা রামমোহন রায়ের সংগীত-পরম্পরা। এইখানে মনে রাখা জরুরি, তিনি এগারো বছর বয়সে প্রথম যে-গানটি লিখলেন, ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’, (স্বামী বিবেকানন্দ গানটি শ্রীরামকৃষ্ণকে শুনিয়েছিলেন। এগারো বছরের বালকের লেখা গান, গাইছেন বাইশ বছরের যুবক (১৮৮৩), শুনছেন সাতচল্লিশ বছরের এক যুগপুরুষ!) সেটি একটি গুরুমুখী গানের আদলে। আরো স্মর্তব্য, কিশোর বয়সেই তিনি Spencer-এর The Origin and Function of Music দ্বারা প্রভাবিত হন। স্মর্তব্য, কবির স্বীকারেক্তি, ‘কবে যে গান গাহিতে পারিতাম না তাহা মনে পড়ে না’। এবং আরো। ১৮৮১-তে পাশ্চাত্য সুরে লিখিত বাল্মিকীপ্রতিভার প্রথম অভিনয় হচ্ছে জোড়াসাঁকোয়, বঙ্কিমচন্দ্র, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, তারকনাথ পালিতদের উপস্থিতিতে!

১৯১২-তে বিলেত গিয়ে তিনি যোগ দেবেন হ্যান্ডেল উৎসবে, আর লিখবেন, ‘আমার বিশ্বাস সংগীতেও আমাদের সেই বাহিরের সংশ্রব প্রয়োজন হয়েছে।’ (দ্র. ‘সংগীত’, ভারতী, অঘ্রান, ১৩১৯, রবীন্দ্রজীবনী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, খণ্ড ২, পৃ ৪০০)।

রেনেসাঁস, নান্দনিকতা, উপরিকাঠামো ইত্যাদির যোগফল স্বামী বিবেকানন্দও। তাই শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তিনি পরিচয় ঘটান রবীন্দ্রনাথের গানের; তাঁর মাত্র বাইশ বছর বয়সে সম্পাদিত সংগীতকল্পতরুতে তিনি রবীন্দ্রনাথের এগারোটি গান অন্তর্ভুক্ত করেন, যার মধ্যে একটি ছিল ‘কালী কালী বল রে মন’! কৌতূহলের বিষয়, যে ক্ষিতিমোহন সেন পরবর্তী জীবনে শান্তিনিকেতনের কণ্ঠলগ্ন হয়ে থাকবেন দীর্ঘদিন, তিনি প্রথম রবীন্দ্রসংগীত শোনেন বিবেকানন্দের গলায়। কাশীতে। স্বামীজী তাঁকে তিনটি রবিবাবুর গান শোনান। ১. এ কী এ সুন্দর শোভা, ২. মরি লো মরি, আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে, এবং ৩. সখী আমার দুয়ারে।

কণিকার উত্তরাধিকার এটাই। নেপথ্যের এই কাহিনি জানা থাকলে কণিকার গানের সমূহ তাৎপর্য ও মাত্রা আমাদের কাছে সহজেই ধরা দেবে।

অন্য অনন্য কণিকা

কণিকা যে কেবল রবীন্দ্রসংগীতই গাইতেন না, সেকথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। তাঁর কণ্ঠে বেশ কিছু ভজন পরিবেশিত হয়েছে। তাঁর রেকর্ডকৃত বিখ্যাত দুটি ভজন হলো – ‘প্রভু যায় ক্যায়সে’ ও ‘মেরা পূজা মুঝে দেখলাও রে’। তাছাড়া ‘প্যারে দরশন দিজো আয়ে’ – মীরার এই ভজনটি, আর তার সঙ্গে গুরু গোবিন্দ সিং-এর ‘জিন প্রেম কিও’ তাঁর গলায় অনন্ত মাত্রা পেয়েছে। গেয়েছেন অতুলপ্রসাদের গান, ‘রইল কথা তোমারি নাথ’, ‘ওগো নিঠুর দরদী’, বা কাঙাল হরিনাথের গান ‘যদি ডাকার মত পারিতাম ডাকতে’। নজরুলসংগীতের রেকর্ডও আছে তাঁর, – ‘হে বিধাতা হে বিধাতা’ মনে পড়বে আমাদের, বা ‘কেন আনো ফুলডোর’, অথবা ‘অতীতদিনের স্মৃতি কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’। ঠাকুরবাড়ির অনেকেই গান লিখতেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘হে অন্তর্যামী ত্রাহি’র রেকর্ড করেছেন তিনি। গেয়েছেন কীর্তন, ‘বৃন্দাবনবিলাসিনী রাই আমাদের’। বাংলা গানের জগৎকে এইভাবে জীবনভর ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছেন তিনি। রেকর্ডের সূচনা হয়েছিল আধুনিক বাংলা গান দিয়ে, যা তিনি পরেও একবার করেন, শ্যামল গুপ্তের কথায়, – ‘পত্র লিখি কাজল মেঘে’ এবং ‘সুরের পথে ঘুরে বেড়ায়’। একাধিক চলচ্চিত্রে নেপথ্য কণ্ঠদান আছে তাঁর, যেমন তথাপি (১৯৫০), নিমন্ত্রণ (১৯৭২), বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা
(১৯৭২)। শেষোক্ত ছবিটিতে আছে তাঁর বিখ্যাত গানটি, ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’। গানটি তাঁর কণ্ঠের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর এ-গানটি তাঁকে ১৯৭৩-এ বিএফজেএ পুরস্কার এনে দেয়।

আমরা সুচিত্রা-নীলিমা-কণিকা, এই ত্রয়ীর কথা জানলেও আরো একজন সমসাময়িক শিল্পী, শান্তিনিকেতনেরই আশ্রমকন্যা, রবীন্দ্রনাথের কাছেই যাঁর সংগীতশিক্ষার সূচনা, গেয়েছেন কবির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে, তাঁর নাম সেভাবে জানি না। পরবর্তীকালে তিনি অভিনেত্রী এবং চলচ্চিত্র-পরিচালক হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন। যাঁর সম্পর্কে তাঁর অন্যতম সংগীতগুরু শৈলজারঞ্জন বলেছিলেন, ‘নুকু যদি গান নিয়ে থাকতো, তবে আমার দুই ছাত্রীর স্থান হতো এক-ই আসনে।’ বিশ্বভারতীর অন্তিম পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন এই নুকু, অর্থাৎ অরুন্ধতী দেবী (চিত্রপরিচালক তপন সিংহের সঙ্গে বিয়ে হয়, প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর), আর কণিকা হন দ্বিতীয়। এঁরা দুজন নাচও শিখেছেন। কলকাতায় ‘গীতবিতান’ প্রতিষ্ঠার সময় অরুন্ধতী ও কণিকা মায়ার খেলায় অংশ নেন। অরুন্ধতী হন শান্তা আর কণিকা প্রমদা। প্রসঙ্গত, এ-বছর অরুন্ধতী দেবীরও জন্মশতবর্ষ।

কণিকার লেখকসত্তা

কণিকার লেখকসত্তাও কম মনোযোগ দাবি করে না। রবীন্দ্রনাথের গান শেখা ও শেখানোয় যেমন তিনি আত্মনিয়োজিত ছিলেন, তেমনি রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে তত্ত্বগতভাবে বিশ্লেষণাত্মক বেশ কিছু গ্রন্থ রয়েছে তাঁর। বইগুলির সহলেখক তাঁর স্বামী বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বইগুলো হচ্ছে – ১. রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভূমিকা, ২. রবীন্দ্রসঙ্গীতের নানা দিক এবং ৩. রবীন্দ্রসঙ্গীতের কাব্য ও সুর।

আমরা তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের নানা দিক গ্রন্থের সাতটি প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করে দেখাবো, কোন গভীরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা ছিল তাঁর।

‘রবীন্দ্রগান, সম্মেলককণ্ঠে’, এ-লেখাটির পেছনে কাজ করেছে একদিকে ইয়োরোপীয় কোরাস গানের ঐতিহ্য, অন্যদিকে ভারতীয় সংগীতে এর উৎস, যা প্রাচীনকাল থেকে বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণে লভ্য, বা পরবর্তীকালে তারানা, ভজন, ধামার, বা জারি, সারি, কীর্তন, নৌবাইচের ঐতিহ্য বহন করে। গণসংগীতের আর এক প্রস্থান কি শান্তিনিকেতনের বৈতালিক?

রবীন্দ্রনাথের ‘আনুষ্ঠানিক’ পর্যায়ের গানগুলি স্বতন্ত্র মনোযোগের দাবি রাখে বলে মনে করেন কণিকা। সমাজ ও জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে এর সামগ্রিক তাৎপর্য ধরা পড়ে। কবির গদ্যগান নিয়ে তাঁর ব্যাখ্যা, ছন্দ থেকে ছন্দমুক্তির সোপান বেয়েই তার আবির্ভাব। গানের রাগানুগ শাস্ত্রীয় তালের বৈচিত্র্য পার হয়ে সুরের মুক্তি-অভিযানকে তা চিহ্নিত করে। এখানে মুক্তক ও গদ্যছন্দের বিস্তার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এসেছে গীতিনাট্যের সংলাপের প্রসঙ্গ।

রুচির প্রশ্নে কোনো আপস চলে না। যেকোনো সংগীত, এবং অবশ্যই রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনের আগে মনকে শুদ্ধ করে নেওয়ার প্রস্তুতি চাই। এজন্য চাই মনের ভেতর কাব্য-উপলব্ধিময় গায়নবোধ। চারিত্রিক সৌকুমার্য রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীর প্রাক্-শর্ত। অভিনব কথা, কিন্তু যথার্থ। যথাযথ আবেগ তৈরির আবহ ছাড়া, ‘সকলি গরল ভেল’! কণিকা এখানে জোর দিয়েছেন ‘রুচিশীল গীতরুচি’র, সেজন্য দরকার রাবীন্দ্রিক রুচির অনুশীলন। এমনকি শ্রোতা ও অনুরাগীদের জন্য তিনি রবীন্দ্ররচনা পাঠ, তাঁর জীবনীপাঠ আবশ্যিক মনে করেন। এইভাবে প্রস্তুতি নিলেই সম্ভব রবীন্দ্রনাথের গানকে যথার্থভাবে আত্তীকরণ করা। নিঃসন্দেহে বড় গভীরভাবে ভাববার কথা।

কণিকার নান্দনিক বোধ যে কতটা ব্যাপ্ত ও বহুমুখী ছিল, তা তাঁর প্রবন্ধের পাঠ না নিলে বোঝা যাবে না। এই গ্রন্থেরই অন্তিম প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন ও আধুনিক বাংলা গান’-এ তিনি রবীন্দ্র-পরবর্তী সাহিত্যিক, গীতিকার ও কবিদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, সাধারণের মন জুগিয়ে চলা সংগীত যথার্থ গান নয়, কেননা সাধারণকে ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়ার সাধনাই তো সংগীতের।

তাঁর রচনা ভাবায়, বিশ্লেষণ উদ্বুদ্ধ করে, ধারণাসমূহ পাঠকের পরিশীলন ঘটায়।

কণিকার নাতিবৃহৎ একটি আত্মজীবনীও আছে, আনন্দধারা। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকেই আত্মজীবনী লিখেছেন, যেমন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, সন্তোষ সেনগুপ্ত, সুচিত্রা মিত্র, অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রানী চন্দ প্রমুখ।  শান্তিদেব ঘোষ ও তাঁর অনুজ সাগরময় ঘোষেরও পরোক্ষ আত্মকথা আছে।

শান্তিনিকেতনবাসীদের আত্মকথনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, সেখানকার সুধাঝরা দিনরাতের কথা, রবীন্দ্র-অনুষঙ্গ, তাঁদের আমলের শান্তিনিকেতনের উৎসব-অনুষ্ঠানের অমূল্য বিবরণ থাকে সবার লেখাতেই। ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা বলে চর্বিতচর্বণ নয়, বরং একে অন্যের পরিপূরক হয়ে দেখা দেয়। এভাবেও নানা রবীন্দ্রনাথের মালার সুবাস আর সৌন্দর্যে সিক্ত হয় পাঠক।

কণিকার আত্মজীবনীতেও শৈশব কৈশোর যৌবনে তাঁর দৈবী দিনযাপনের কথা, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আশ্রমিকদের সাযুজ্যে গড়ে ওঠা জীবন, ঋতুতে ঋতুতে জীবনের ছন্দ পরিবর্তিত হওয়া, এসবের বর্ণনা পাই।

বইটির অভিনবত্ব হলো, এটি কোনো ব্যক্তিবিশেষকে উৎসর্গ করা হয়নি, করা হয়েছে তাঁর ও তাঁর মতো অজস্রের সব হতে আপন শান্তিনিকেতনকে। বইটিতে কণিকার প্রবণতা, সহযাত্রী ও গুরুজনদের কথা, আশ্রমের অপার্থিব দিনযাপনের কথা আছে যেমন, তেমনি আছে শৈশব থেকে তাঁর অপার প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা, কান্নাহাসির দোলদোলানো মুহূর্তের সালতামামি। অকপটে তিনি লিখেছেন এক অন্ধ আশ্রমিক, কালুর তাঁকে প্রেম নিবেদনের কথা। স্বভাবতই তাতে সায় ছিল না কণিকার, এবং ভগ্নহৃদয় কালু মনস্তাপে আশ্রম ত্যাগ করে। আছে অরূপের কথা, যে হয়তো চেয়েছিল একটু কেবল পাশে বসার অধিকার, বা অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন। আছে পিয়ন হরিহরদার কথা, যার কাছ থেকে স্ট্যাম্প সংগ্রহ করতেন কণিকা। সুচিত্রা, নীলিমা ও অরুন্ধতীর সঙ্গে সখ্য, আর চীনা ভবনের অধ্যক্ষ তান উন সানের সেক্রেটারি হয়ে শান্তিনিকেতনে বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগমন, আর কণিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ের প্রসঙ্গ।

গুজব আছে, কণিকা ও সুচিত্রার মধ্যে রেষারেষি, দ্বন্দ্ব, প্রতিযোগিতা ও ঈর্ষা ছিল। এই কবিতাটি কিন্তু তার বিপক্ষে সাক্ষ্য দেয়, ‘নামেই শুধু মোহর নয়,/ তার গানেও লেগেছে নিখাদ সোনার ছোঁয়া/ আর তাই এক অনুরাগী শ্রোতার/ অভিনন্দন জানাই আমি তাকে।’ কবিতাটির অনুরাগী শ্রোতাটি স্বয়ং সুচিত্রা মিত্র!

আত্মজীবনীতে কণিকা তাঁর জীবনসঙ্গী সম্পর্কে লিখছেন, তিনি কলকাতায় এম কম পড়তেন। শান্তিনিকেতনে বাসকালে বাংলায় এমএ করেন। তারপর ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকা যান, লাইব্রেরিয়ানশিপ পড়তে। ফিরে এসে বিশ্বভারতী গ্রন্থাগারে যোগ দেন। গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন, বের করতেন উদীচী নামে এক রুচিস্নিগ্ধ পত্রিকা। অতএব
কণিকা-বীরেন্দ্র যে উভয়ে উভয়ের যোগ্য, ১৯৪৮-এ তাঁদের দাম্পত্যজীবনের সূচনা থেকেই তা বোঝা যাচ্ছিল।

কণিকা সাঁওতালদের সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও জিজ্ঞাসু ছিলেন বরাবর। শান্তিনিকেতনের আশেপাশে সাঁওতালপল্লিতে চলে যাওয়া, তাদের সান্নিধ্যে আসা, তাদের সংস্কৃতিকে জানা ও সম্ভ্রমের সঙ্গে উপলব্ধি করা ছিল তাঁর অন্যতম ভালোবাসা। এটা আরো কারো কারো ছিল। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রসুহৃদ শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের ছেলে সন্তোষচন্দ্র মজুমদার নিজ উদ্যোগে সাঁওতালি ভাষা শেখেন। বহু সাঁওতালি গানও তিনি সংগ্রহ করে অনুবাদ করেছিলেন। কণিকার
সাঁওতাল-অবহিতি ও সম্পৃক্তি এমন মাত্রায় ছিল যে, সত্যজিৎ রায় যখন আগন্তুক ছবিটি করেন, তখন সাঁওতালি নাচের দৃশ্যপরিকল্পনা কণিকাকে দিয়েই করিয়েছিলেন। সত্যজিৎ কণিকাকে দিয়ে তাঁর কোনো ছবিতে গান না গাওয়ালেও কণিকার গান নিয়ে তাঁর উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য, যিনি তাঁর কণ্ঠকে বীণার ধ্বনি বলে মন্তব্য করেছিলেন।

কণিকার সাঁওতালপ্রীতি তাঁকে কেবল গোরা সর্বাধিকারীর দেশ ঝাড়গ্রামে নিয়েই ছাড়েনি, সেখানকার সাঁওতাল সমাজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়েছে। কেবল তাই নয়, সেখানকার সাঁওতাল গাঁয়ের জনৈকা পার্বতীর সঙ্গে বুলবুলের সই পাতানোর (সাঁওতালদের মধ্যেও এই রীতি আছে। একে ওরা ‘ফুল পাতানো’ বলে। এর আনুষ্ঠানিকতা রীতিমতো উৎসবের চেহারা নেয়।) দৌত্যও তিনি করেছেন। বুলবুল, লেখক সমরেশ বসুর মেয়ে, সেবার কণিকার সফরসঙ্গী। ঘটনাটির অনুপুঙ্খ বিবরণ কণিকার সাঁওতালপ্রীতির অভ্রান্ত নিদর্শন।

স্ট্যাম্প জমানে, ধ্রুপদী ও রবীন্দ্রসংগীতপ্রিয় মানুষটির জীবনযাপন ছিল নিতান্তই আটপৌরে। ‘সাজতে ইচ্ছে করলে বেলফুলের কুঁড়ি বা রঙ্গনফুল হতো আমার কানের গয়না।’ তবে মজার কথা, ‘কোনও জায়গার নাম যদি খারাপ হত, আমি সেখানে কিছুতেই গান গাইতে যেতাম না!’ আর গলা বসে যাবে, বশে থাকবে না বলে কখনো টক খেতেন না তিনি।

হেমন্ত ও দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের ওপর তাঁর আজানুলম্বিত শ্রদ্ধা ব্যক্ত আত্মজীবনীটিতে। দুজনের সঙ্গেই তিনি দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছেন। দ্বিজেন শান্তিনিকেতনে কণিকার বাড়ির পাশেই বাড়ি করেছিলেন। জর্জদা, অর্থাৎ দেবব্রত বিশ্বাসের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ ছিল অপরিসীম। ‘উনি সকলের চেয়ে আলাদা। … তাঁর অন্তর ছিল বিরাট, এবং অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ।’ দেবব্রতর ‘তুমি রবে নীরবে’ আর ‘আমি চঞ্চল হে’ গানদুটি কণিকার কাছে এতটাই অসাধারণ অসামান্য এবং অনির্বচনীয় যে তিনি জানাচ্ছেন, তিনি কখনো এই দুটি গান গাইতেন না।

বাংলা সংগীতজগতের অন্যতম মহীরুহ সলিল চৌধুরীর প্রতিও তাঁর অপার শ্রদ্ধা প্রকাশিত। তাঁর কথা ও সুরে রেকর্ড করেও দ্বিধায় পড়ে তা প্রকাশের অনুমতি দেননি কণিকা। দিলে হয়তো আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে তাঁর অন্য একটি জগৎ খুলে যেত, যেমন হেমন্ত, দ্বিজেনকে পাই। আবার সুচিত্রা (তিনি গোড়ায় আইপিটিএ-র যুগে সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে গান করেছেন অবশ্য), নীলিমা, রাজেশ্বরী, চিন্ময়কে তো পাইও না!

কেবল গাইয়েদের সঙ্গেই নয়, কণিকার মনের প্রসারতা আর অনুসন্ধিৎসার ব্যাপ্তি তাঁকে কবিসাহিত্যিকদের সঙ্গসুখও কম দেয়নি। জীবনকে প্রসারিত করে দেখা, দৈর্ঘ্য প্রস্থ বেধ নিয়ে গভীরভাবে জীবনকে ভালোবাসার জন্যই এটা জরুরি। এবং তার তালিকাটি বিশাল। অন্নদাশঙ্কর-দিলীপকুমার রায়-বনফুল-সৈয়দ মুজতবা আলী-তারাশঙ্কর-আশাপূর্ণা দেবী-শিবনারায়ণ রায় যদি একপ্রান্তে থাকেন, তো অন্যপ্রান্তে আছেন সুনীল শক্তি শ্যামল বুদ্ধদেব গুহ তুষার তালুকদার নিমাই ভট্টাচার্য। তবে অলোকরঞ্জন আর শঙ্খ ঘোষ নেই বলে একটু আশ্চর্য লাগে। প্রথমজন ছোটবেলা থেকেই শান্তিনিকেতন-লগ্ন, আর দ্বিতীয়জন কর্মসূত্রে ও অহরহই শান্তিনিকেতনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তেমনি রামকিঙ্কর সম্পর্কে আরো খানিক জানার বাসনা পূরণ হয়নি। নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় বা দিনকর কৌশিকের সম্পর্কেও নীরব কেন তিনি? যেখানে স্বপনকুমার ঘোষ বা তানাজির প্রতিও যথার্থ মনোযোগ তাঁর? আছে বিশ্ববরেণ্য শিল্পী রবিশঙ্করের কথাও। আছে তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্রনির্মাতা গৌতম ঘোষের কথা, সমরেশ বসু আর ধ্রুবতারা যোশীর কথা। আর সমীহ ও স্বতন্ত্র করার মতো করে সন্তোষকুমার ঘোষ।

কিন্তু যা পাইনি তার হিসাব করতে না বসে পাওয়ার দিকগুলি যে আত্মজীবনীটির অনুলেখকের বদান্যতায়, সেই অলোকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যাক। আর পুলকিত হওয়া যাক আফ্রিকা থেকে আগত বায়জান-এর কথা ভেবে, যিনি কণিকার প্রশিক্ষণে গেয়েছেন ‘আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে’! এরকম বিদেশি ছাত্রছাত্রী আরো ছিল তাঁর, – ইউকা, আইলিন, আলমিরা ও অন্যান্য। এইভাবে কণিকা তাঁর গুরুদেবের গানকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছেন।

কণিকা : পুরস্কারের মালায়

সংগীতজগতে তাঁর অবদানের জন্য জীবনে প্রচুর পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ১৯৭৯-এ অর্জন করেন সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কার। ১৯৮৬-তে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কার দেয়। ১৯৯৮-তে পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতি-কেন্দ্র তাঁকে সম্মাননা দেয়। ১৯৯৯-তে তিনি পান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাবা আলাউদ্দীন পুরস্কার। ১৯৯৬, এশিয়ান পেইন্টস শিরোমণি পদক। আর তাঁর কাছে সবচেয়ে কাক্সিক্ষত ও শ্লাঘার পুরস্কার অবশ্যই বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন থেকে প্রদত্ত ‘দেশিকোত্তম’ তিনি লাভ করেন ১৯৯৭-তে। আগেই জানানো হয়েছে, বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা ছবিতে নেপথ্য গায়ক হিসেবে তিনি বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন, সংক্ষেপে বিএফজেএ অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিলেন। এছাড়া কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি.লিট দিয়েছিল। তালিকাটি দীর্ঘতর হতে পারা উচিত ছিল, কেননা তাঁর প্রবন্ধপুস্তক আর আত্মজীবনীর জন্য তিনি অনায়াসেই আনন্দ ও রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হতে পারতেন। যোগ্যতা থাকলেও তিনি তা পাননি, এটা মানতেই হবে। তবে সবসেরা পুরস্কার তো তিনি বহুবছর ধরে পেয়ে আসছেন, এবং যতদিন বাংলা সংগীত বেঁচে থাকবে, তিনি সেই পুরস্কার থেকে বিচ্যুত হবেন না। আর তা হলো, জনমানসে, বিশেষ করে সংগীতপ্রেমী মানুষের কাছে তাঁর শাশ্বত আসন। বাঙালি সুখেদুঃখে যেমন রবীন্দ্রনাথের গান গাইবে, সুখেদুঃখে তেমনি কণিকা-পরিবেশিত রবীন্দ্রসংগীত গাইবে। ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে’, অথবা ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ বা ‘প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী’ কিংবা ‘বরিষ ধরামাঝে শান্তির বারি’সহ তাঁর মোহন কণ্ঠের অজস্র গান না শুনে আর তাঁর কণ্ঠে কণ্ঠ না মিলিয়ে বাঙালির উপায় নেই।

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় : নব নব রূপে

শান্তিনিকেতনে তিনি অধ্যাপকরূপে যোগ দিয়েছিলেন। পরে সেখানকার অধ্যক্ষ হন। অন্তিমে হয়েছিলেন এমেরিটাস অধ্যাপক।

এছাড়াও তিনি ‘এলমহার্সট ইনস্টিটিউট অফ কমিউনিটি স্টাডিজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল দুস্থদের সেবা। প্রসঙ্গত, লিওনার্ড নাইট এলমহার্সট (০৬.০৬.১৮৯৩-১৬.০৪.১৯৭৪) এবং তাঁর স্ত্রী ডরোথি (১৯২৫-৬৮) শান্তিনিকেতনের উপকণ্ঠে শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠান গঠনে ভূমিকা নেন। এলমহার্সট ছিলেন ব্রিটিশ সমাজসেবী ও কৃষিবিদ। আমেরিকায় তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয়। ১৯২১-এ তিনি ভারতে আসেন, কবির একান্ত সচিবরূপে কাজ করেন। তাঁরই সহযোগিতায় ১৯২১-এ Institute of Rural Reconstruction সংস্থা গড়ে ওঠে। পরে ১৯২২ থেকে এর নাম হয় ‘শ্রীনিকেতন’। এর আদিরূপ ‘পল্লীসংগঠন কেন্দ্র’ (১৯২১) নামে পরিচিত ছিল। এলমহার্সটের উদ্যোগ ও আর্থিক সহায়তায় গ্রামে গ্রামে ব্রতীদল গঠন, সমবায় প্রথায় বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ, স্বাস্থ্যসমবায় গঠন, গ্রামীণ হস্তশিল্পীদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কাজ চলতে থাকে। এলমহার্সট কবিকে নিয়ে লেখেন ‘The Poet and Ploughman’।

কণিকা তাঁর গৃহেই এলমহার্সটের নামে এই জনহিতকর প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন। বহু গরিব ও দুস্থ মানুষের কল্যাণে তা অদ্যাপি নিয়োজিত।

তাছাড়া আছে ‘কণিকাধারা’। শান্তিনিকেতনের গায়নশৈলী, নাট্যধারা প্রচার ও প্রসার, বিশুদ্ধ সংগীতচর্চার লক্ষ্য নিয়ে যা পরিচালিত হতো। তাঁর প্রয়াণের পর এখনো হয়। কণিকার এই সাংস্কৃতিক দিকগুলো নিয়ে আমাদের অবহিতি অত্যন্ত কম। আসলে তাঁর সমগ্র জীবন রবীন্দ্রনাথ নামক এক অনন্ত প্রতিভাবানের জন্য নিবেদিত ছিল। তিনি ‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়’ (এছাড়া আর কোনো পথ নেই), উপনিষদের এই বাক্যটির জ্বলন্ত উদাহরণ।

কণিকা : জন্মশতবর্ষে ও তার পর

১২.১০.২০২৩-এ কণিকার শতবর্ষে পদার্পণের দিনটি ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে যাপিত হয়। ওইদিন কণিকার অপ্রকাশিত গানও অবমুক্ত হয়। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা কণিকা স্মারক বক্তৃতা দেন। সভাপতি ছিলেন বরেণ্য চলচ্চিত্রকার ও কণিকার ওপর মোহর তথ্যচিত্রনির্মাতা গৌতম ঘোষ। এছাড়া ০৭.০৪.২০২৪-এ ‘কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ ও বাংলাদেশের ‘সুরের ধারা’র (রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার প্রতিষ্ঠান) শিল্পীদের গান পরিবেশিত হয়। ঘোষণা দেওয়া হয় বৎসরব্যাপী শতবার্ষিক কর্মসূচি।

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে সারা বছরের কর্মসূচি

সমগ্র বছর জুড়ে দেশে-বিদেশে কণিকার জন্মশতবর্ষ পালনের ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কণিকার ভাগিনেয় প্রিয়ম মুখোপাধ্যায়ের অধ্যক্ষতায় মূলত যা পরিচালিত হবে। কণিকাকে নিয়ে আর্কাইভ নির্মিত হবে। একদিকে সেখানে থাকবে কণিকার দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্র (পানের বাটা, শাড়ি, চশমা, পারফিউম ইত্যাদি), অন্যদিকে তাঁর ব্যবহৃত সংগীত যন্ত্রসমূহ। কণিকার সমসাময়িক আশ্রম-বুধজনদের ছবি। ভিডিও। তাছাড়া দেশবিদেশে তাঁকে নিয়ে হবে নানান অনুষ্ঠান, কর্মশালা, বইপ্রকাশ। তাঁর ওপর প্রিয়মের গবেষণাকর্মটিও প্রকাশিত হবে। এর সঙ্গে হয়তো আরো বহুকিছু যুক্ত হবে। আমরা সাগ্রহ প্রতীক্ষায়।

কণিকামঙ্গল-এর এখানেই ইতি। কেবল তাঁর জন্মবছরে অন্য যে যে বাঙালি সংগীতপ্রতিভার আবির্ভাব হয়েছিল, সেই সুচিত্রা মিত্র, সলিল চৌধুরী ও অরুন্ধতী দেবীকেও (অরুন্ধতী যদিও অভিনেত্রী ও চলচ্চিত্রপরিচালক হিসেবেই খ্যাতিলাভ

 করেন, তবু একদিকে কণিকার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা, বিশ্বভারতীতে গান শেখা ও বেশ কিছু রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড করার সূত্রে এই পঙ্ক্তিতে বসার যথার্থ যোগ্য) শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় : ব্যক্তিগত

ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, এবং ওঁর স্নেহলাভ আমার জীবনের অক্ষয় সম্পদ। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, মানিদা, দিনকর কৌশিক, শান্তিদেব ঘোষ, গোরা সর্বাধিকারী – এঁদের সান্নিধ্য যেমন পেয়েছি, কণিকারও তেমনি। যদিও বেশি গভীর, তা বলা যাবে না, তবে স্মরণযোগ্য ও আন্তরিক।

চোখে দেখার বহু আগে থেকেই তাঁর বাঁশি, অর্থাৎ গান শুনেছি। ১৯৬১ – বমি তখন দশ বছরের কিশোর। বাড়িতে সদ্য রেডিও এসেছে, রবীন্দ্রশতবর্ষের অনুষ্ঠান হবে বছরভর, সেজন্য। তখন টিভি দূর অস্ত। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে কণিকার গলার সঙ্গে পরিচয়। যেমন পরিচয় হেমন্ত, দেবব্রত, সুচিত্রা, চিন্ময়, সুমিত্রা, সুবিনয় বা রাজেশ্বরীর সঙ্গে। সন্তোষ সেনগুপ্তের পরিচালনায় শুনছি চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা, মায়ার খেলা। আকাশবাণী কলকাতায় সকালের খবর হতো সাড়ে সাতটায়। তারপরই পনেরো বা কুড়ি মিনিট বরাদ্দ ছিল রবীন্দ্রসংগীতের জন্য। এখনো আছে। তাছাড়া প্রতি শুক্রবার রাত নটায় রবীন্দ্রসংগীতের অনুরোধের আসর, এখনো আছে। সেখানে প্রায়শ কণিকার রেকর্ড বাজতো। ক্বচিৎ কোনো সিনেমা দেখতে গিয়ে নেপথ্যে তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হতাম। শুনেছি, সত্যজিৎ রায় তাঁর কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবির ‘এ পরবাসে রবে কে’ কণিকাকে দিয়ে গাওয়াতে চেয়েছিলেন। যে-কোনো কারণেই হোক, তা বাস্তবায়িত হয়নি, যেমন ঋত্বিক ঘটকের কোনো ছবিতেও নেপথ্য কণ্ঠদানে তিনি নেই। পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রসদনে ও জোড়াসাঁকোর প্রভাতী অনুষ্ঠানে তাঁকে পেতাম না, কেননা, তিনি সেদিন তো শান্তিনিকেতনছাড়া হতে পারবেন না। তাই তাঁকে চাক্ষুষ দেখা হচ্ছিল না।

আকাশবাণী কলকাতা থেকে বহু বছর ধরে প্রতি রোববার প্রচারিত হতো ‘সংগীতশিক্ষার আসর’। সেখানে দীর্ঘদিন গান শেখাতেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। পরে একে একে সুচিত্রা মিত্র আর কণিকা, সুবিনয় রায়, সুমিত্রা সেন প্রমুখ। সংগীতশিক্ষার আসর ওরফে রবীন্দ্রসংগীতশিক্ষার আসর সেটা। গান জানি না; কিন্তু ওঁদের মতো গুণী শিল্পীর গান শেখানো শোনার জন্য প্রায় নিয়মিত রেডিওর সামনে বসতাম। বিশ্বভারতী ত্রৈমাসিক পত্রিকার শেষ প্রচ্ছদে রবীন্দ্রসংগীতের নতুন নতুন রেকর্ডের তালিকা দেখে বড়ভাই অন্য শিল্পীর সঙ্গে কণিকার গানের রেকর্ডও কিনে নিয়ে আসতো। এই ছিল কণিকার সঙ্গে পরিচয়ের প্রাথমিক পর্যায়।

তাঁর সঙ্গে দেখা ও যৎসামান্য পরিচয় ১৯৭৫ নাগাদ। সেবার বসন্তোৎসবে শান্তিনিকেতন যাই, এবং উৎসবের দিন দুপুরে  কণিকার আবাসে। পরিচয়পর্ব শেষ করে কিছুক্ষণ বসি। ঘরে তিলধারণের স্থান নেই। শান্তিনিকেতনের মানুষজন ও সেইসঙ্গে কলকাতা ও অন্যান্য জায়গা থেকে যাঁরা এসেছিলেন, তাতে বাড়িটি উপচে পড়ছিল। অতএব তাঁর সঙ্গে কথা বলা অসম্ভব জেনে তাঁকে প্রণাম করে চলে আসি।

এর বেশ কয়েক বছর পর, সালটা ঠিক মনে পড়ছে না, বসন্তোৎসবে ফের যাই তাঁর কাছে। সেবারও যথারীতি ভিড়। তবে আমার পরিচিত তুষার তালুকদার, যিনি সে-সময় কলকাতার পুলিশ কমিশনার, আমাকে সুযোগ করে দেন কণিকার সঙ্গে কথা বলার। নিজ হাতে মিষ্টি খেতে দিলেন আমাকে। আমি আপ্লুত। কার কার গান তাঁর ভালো লাগে জানতে চাইলে দুজনের নাম বিশেষ করে উল্লেখ করেছিলেন, হেমন্ত এবং রাজেশ্বরী। জানতে চাইলাম, রবীন্দ্রনাথকে স্বপ্নে দেখেন? বললেন, হ্যাঁ, দেখেন। কী দেখেন? আমার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বললেন, তা আপনাকে বলবো কেন? ঠিক এই উত্তর প্রতিভা বসুও আমাকে দিয়েছিলেন। বুঝলাম, ‘সে আমার গোপন কথা’ ঠিকই কিন্তু তা কাউকে শোনানো যাবে না! সেদিন তিনি তাঁর বোন আর ভাগ্নে প্রিয়মের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন।

এরপর একবার পূজাবকাশে সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে অবকাশ যাপনসূত্রে ‘আনন্দধারা’য় গিয়ে দেখি, তিনি দিল্লি গেছেন কোনো এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সঙ্গে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। বন্যা তখন শান্তিনিকেতনে কণিকার বাড়িতে থেকে গান শিখছিলেন। সঙ্গে সদ্যোজাত সন্তান ও তার দেখভালের জন্য আয়া। সে-সময় থেকেই বন্যা কলকাতায় পরিচিত নাম, আকাশবাণীতে সংগীত পরিবেশনের সূত্রে। কণিকার এই কৃতী ছাত্রী বর্তমানে ঢাকায় অনবদ্য এক রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন।

সেবার দেখা হলো না। আমার স্ত্রী কণিকার গানে পাগল, দেখার ইচ্ছে ছিল তাঁকে। দুর্ভাগ্য, ক্যান্সার হলো তার। কণিকার ‘চয়নিকা’, চারটে ক্যাসেটের অ্যালবাম, সদ্য বেরিয়েছে তখন, নিত্য শুনতো সে। ১৯৯৬-এর ১৩ই ফেব্রুয়ারিতে মারা যায় সে। কবিতা লিখতো। দেশ, জিজ্ঞাসা, কবি ও কবিতা, ঢাকার বিচিত্রা, রোববার, সন্ধানী, ভারতবিচিত্রা ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত বেরোত তাঁর কবিতা। সেবার বসন্তোৎসবে ফের শান্তিনিকেতনে। আমার স্ত্রীর কবিতার বই উপহার দিলাম তাঁকে। জানতে চাইলেন, তাকে আনিনি কেন। বললাম। পরম আত্মীয়ের মতো আমার পিঠে হাত বোলাতে লাগলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলেন অসুখের কথা। তিনি নিজেও তখন রোগে কাহিল, হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন। কাজের লোক এসে তাঁর হাতে মিষ্টির প্লেট দিলে তিনি তাঁর হাত দিয়ে আমাকে তা পরিবেশন করলেন। বিহ্বল হলাম তাঁর এই আতিথেয়তায়। ‘অতিথিদেবো ভব’, – অতিথিকে দেবতাজ্ঞান করবে, উপনিষদের এই বাক্য তাঁর মধ্যে মূর্ত হতে দেখলাম সেদিন।

পরে আর একবার দেখা হয়েছিল। প্রায়ই আত্মার টানে শান্তিনিকেতন চলে যেতাম। সেবার গিয়ে দেখি, কী এক উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে সংবর্ধনা দেবে। তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এসেছেন। কণিকা আসতেই পায়ে হাত দিয়ে তাঁকে প্রণাম করলাম। আমাকে চিনতে পেরেছেন দেখলাম। কুশল জানতে চাইলেন। যেতে বললেন বাড়িতে। যাওয়া হয়নি, পরদিন ভোরে কলকাতায় চলে এসেছি বলে। সেবারই শেষ দেখা।

না, শেষ দেখা দেখি, যখন তাঁর মরদেহ রবীন্দ্রসদনে আনা হয়। অঝোরে কাঁদছেন বন্যা, মুখে তাঁর একটিই শব্দ, ‘মা, মা!’ অগণিত দর্শক। অদূরে সুনীলজায়া স্বাতীদি, নতমুখ ও নির্বাক। অতঃপর তাঁকে শকটে তোলা হলো, শান্তিনিকেতন নিয়ে যাওয়ার জন্য। তদারকিতে শ্রদ্ধেয় স্বপনকুমার ঘোষ, বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগারিক এবং শান্তিনিকেতনের সর্বজ্ঞ বলা যায় যাঁকে। মৌন, গম্ভীর ও অশ্রুসজল।

তার পর থেকে তাঁর গানে আর লেখার মধ্যে খুঁজি তাঁকে। যত দিন যাচ্ছে, হৃদয়ঙ্গম করি, সত্যিই, অবনীন্দ্রনাথ-আখ্যায়িত ‘আকবরি মোহর’ তিনি।