পর্ব : ১৪
সারাদিন অবন্তির সঙ্গে যোগাযোগ হলো না বলে মন খারাপ লাগছিল ঋভুর। কথা তো হয়ইনি, এমনকি মেসেজেরও উত্তর দেয়নি অবন্তি। আজকে ও ব্যস্ত
থাকবে, জানে ঋভু। তাই বলে এতটা? অংশুও সারাদিনে একবার খবর নিল না! অবশ্য ছুটির দিনে সেও নানা পারিবারিক
বিষয়-আশয় নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ওদের জীবন আমার থেকে আলাদা, অন্যরকম – ভাবলো ঋভু। ওদের পারিবারিক জীবন আছে, আমার নেই। ওদের ভাইবোন আছে, তাদের সঙ্গে সুখদুঃখ ভাগ করে নেওয়ার অবকাশ আছে, এমনকি
মান-অভিমান-ঝগড়াঝাটি করারও সুযোগ আছে, আমার এসবের কিছুই নেই। যদি আমারও অনেকগুলি ভাইবোন
থাকতো, আমিও কি ওদের মতো হতাম? নিদেনপক্ষে নীলু যদি বেঁচে থাকতো, এরকম গা-ছাড়া হয়ে থাকতে পারতাম আমি? কে জানে!
পরদিনও অবন্তির কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না, কিন্তু অংশু ফোন করলো সন্ধ্যার আগে আগে, জানতে চাইলো – কী করছিস?
– শুয়ে-বসে সময় কাটাচ্ছি।
– আমার বাসায় চলে আয়।
– নারে বাসায় যাবো না।
– আরে আয়। অপলা বলেছে, সে তার প্রেমিকের সঙ্গে সময় কাটাতে চায়।
– তোর উপস্থিতিতে আমাদের জমবে নারে। তাছাড়া, তোর কাছে বললো কেন? বলতে হবে আমাকে। আমি কোনো ঘটকের মধ্যস্থতায় প্রেম করি না।
– ও আচ্ছা! জানলাম। অপলাকে বলে দিস কথাটা।
– তুই বলে দিস। তোকেই যেহেতু বলেছে।
– আচ্ছা বলবো। ইয়ে, অবন্তির ব্যাপারেও কি একই কথা প্রযোজ্য?
– কোন কথা?
– এই যে ঘটকের মধ্যস্থতায় …
– ওর সঙ্গে তো আমার প্রেমই হবে না।
– হবে না! চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত?
– আমার কোনো খোঁজই নিচ্ছে না সুসান। মেসেজেরও উত্তর দিচ্ছে না। প্রেম হবে কীভাবে?
– ও একটু ঝামেলায় আছে। তোকে বলবে।
– তুই জানলি কী করে?
– সকালে ফোন করেছিলাম।
– ও! কী বললো?
– পারিবারিক সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে আলাপ চলছে আজকে।
– আর কালকে?
– মানে?
– কালকে কী হয়েছিল ওর?
– কালকে তো সবাই এসেছে …
– তো? তাই বলে কথা বলা যাবে না?
– সময় পায়নি। শুভ ভাই ছাড়া পেয়েছে। অবন্তি জানতো না। হঠাৎ ভাইকে দেখে অবন্তি একটু …
– হুম, বুঝলাম। এই কথাটা আমাকে বললেই হতো।
– বলবে নিশ্চয়ই। তুই আজকে ফোন করেছিলি?
– না। কালকে টেক্সট করেছিলাম। উত্তর দেয়নি।
– আজকে একটু ফোন কর।
– না থাক। সম্পত্তির ভাগাভাগি খুব ঝামেলার ব্যাপার। এর মধ্যে ফোন করতে চাই না।
– তাহলে আমরা কোথাও বসি।
– কোথায় বসবি?
– যে-কোনো জায়গায়।
– ভালো লাগছে না। তুই বরং বাসায় চলে আয়। অপলাকে নিয়েই আয়।
– আচ্ছা আসছি।
অংশু এলো ঘণ্টাখানেক পর, একাই। বললো, অপলা এলো না। ও নাকি জা’দের সঙ্গে শপিংয়ে যাবে।
দেখলি তো, আমার জন্য অপলার কোনো প্রেম নেই! –
কৃত্রিম অভিমানের সুরে বললো ঋভু।
– কী করে বুঝলি?
– আরে প্রেম থাকলে তো প্রায়োরিটি লিস্টে আমার নাম আগে থাকতো, শপিং থাকতো পরে!
– বাঁচলাম।
– মানে?
– নিজের বউ নিজের বন্ধুর সঙ্গে প্রেম করে বেড়াচ্ছে, ব্যাপারটা ঠিক হজম করা যায় না।
– হা হা হা … তাহলে তোর বদহজমের ব্যবস্থা করছি। দাঁড়া।
– দাঁড়াতে পারবো না দোস্ত। বসতে দে আর গলা ভেজানোর ব্যবস্থা কর।
– ব্যালকনিতে যা, আমি আসছি।
করিমকে নির্দেশনা দিয়ে ব্যালকনিতে এসে ঋভু বললো, তোর সঙ্গে একটা জরুরি আলাপ আছে। তার আগে বল, সেদিন বাসায় না ঢুকে চলে গেলি কেন?
– কোনদিন? – ভীষণ অবাক হয়ে বললো অংশু।
– পরশু রাতে।
– তুই দেখেছিলি আমাদের?
– হ্যাঁ। দেখবো না কেন?
– কখন দেখলি?
– সুসানকে যখন এগিয়ে দিতে গেলাম, তখন দেখলাম তোর গাড়ি দাঁড়ানো।
– গাড়ি দেখেই চিনলি?
– না চেনার কী হলো? বাসায় এলি না কেন সেটা বল।
– অবন্তিকে বেরোতে দেখে ভাবলাম, এখন যদি যাই তাহলে তুই হয়তো বিব্রত হবি।
– তোর কাছে বিব্রত হওয়ার কী আছে?
– অপলাও তো সঙ্গে ছিল।
– অপলার কাছেই বা বিব্রত বোধ করার কী আছে? তোদের কাছে তো আমার গোপন কিছু নেই।
– না মানে, আমাদের বাসা থেকে বেরোনোর সময় অবন্তি বললো, তোকে নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে যাবে …
– মাঝপথে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হতে পারে না?
– তা পারে। ওটা ভেবে দেখিনি।
– আচ্ছা, এই প্রসঙ্গ শেষ।
– না, শেষ হবে কেন? তোদের মধ্যে কী কথা হলো শুনবো না?
– কথা বিশেষ কিছু হয়নি। অন্য কিছু হয়েছে।
– বিস্তারিত বল না গাধা।
গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে দুষ্টুমির হাসি হাসলো ঋভু। বললো, তা তোমাকে বলা যাবে না চান্দুজি।
– কেন? বলবি না কেন?
– বললে তুই সুসানের দিকে কুদৃষ্টিতে তাকাবি।
– ইতিমধ্যেই তাকাইনি তা তোকে কে বললো? ওরকম টসটসে আঙুরের মতো …
– এই খবরদার। বাজে কথা বলবি না।
– তোর প্রেমিকা বা বউ হলে বলবো না। তার আগে তো ও যে-কোনো নারী!
– ও হ্যাঁ, তুই তো আবার নীতিবান পুরুষ। বন্ধুর ইয়ের দিকে তাকাস না।
– অবশ্যই। আমি আমার নীতিতে অটল।
– আমি কিন্তু নীতিবান না …
– কী বলতে চাস?
– বলতে চাই, আমি কিন্তু অপলাকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই বলতে পারি, ভাবতেও পারি।
– খবরদার। একদম খুন করে ফেলবো।
– হা হা হা … সেইরকম পত্নীপ্রেম!
– অপলার মতো বউ তো পাও নাই হে বেল্লিক, বুঝবা কেমনে?
ঋভু মিটিমিটি হাসছিল। অংশু ধমক দিয়ে বললো, হাসি বন্ধ কর গাধা। তোর জরুরি কথা বল।
– ও হ্যাঁ। অপলার কথা ভাবতে ভাবতে ভুলেই গিয়েছিলাম।
– আবার?
– আচ্ছা, বলছি, বলছি। আমার প্রথমবারের নেপাল ভ্রমণের কথা তোর মনে আছে?
– হ্যাঁ আছে। না বলে গিয়েছিলি। ফিরে এসেও অনেকদিন চেপে ছিলি। অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর জানতে পেরেছিলাম। হঠাৎ ওই প্রসঙ্গ কেন?
– কারণ আছে।
– কী সেটা?
– পোখারায় এক ইতালিয়ান মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল।
– হতেই পারে। তাতে কী হলো?
– আরে পুরোটা শুনবি তো!
– হ্যাঁ বল।
– ওর নাম আরিয়ানা। ও আর আমি একসঙ্গে ছিলাম।
– একসঙ্গে মানে?
– মানে এক হোটেলে, এক রুমে, এক বিছানায়। এত খুলে বলতে হয় কেন গর্দভ?
– বলিস কী! এই প্রসঙ্গে তো কোনোদিন কিছু বলিসনি।
– বলার প্রয়োজন হয়নি।
– এখন কী প্রয়োজন পড়লো?
– এত বছর পর মেয়েটা আবার আমাকে খুঁজে বের করেছে।
– আচ্ছা! কীভাবে খুঁজে পেল?
– তা এখনো জানি না।
– তোর সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করেছে?
– ই-মেইলে।
– কবে?
– যেদিন সুসান এলো।
– কাকতালীয় ব্যাপার!
– হ্যাঁ। সত্যিই কাকতালীয়।
– নেপাল থেকে ফেরার পর তোর সঙ্গে একেবারেই যোগাযোগ ছিল না?
– না, ছিল না।
– কী বলিস! এরকম একটা সম্পর্ক হওয়ার পর যোগাযোগ না থাকার কী হলো?
– প্রথম বছর দুয়েক ছিল। তারপর কী করে যেন হারিয়ে গেল।
– কী করে হারালো মানে?
– তখন তো আমার সেলফোন ছিল না। ই-মেইলে যোগাযোগ হতো। কী কারণে যেন মেইল চেক করতে ইচ্ছে করতো না। একসময় পাসওয়ার্ডও ভুলে গেলাম। অনেকদিন পর নতুন ই-মেইল আইডি খুললাম। ওর সঙ্গে আর যোগাযোগ করা হয়ে উঠলো না।
– এটা একটা কথা হলো?
– তখন যে আমি খুব খারাপ সময় পার করছিলাম। মার সঙ্গে সম্পর্ক চূড়ান্ত খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। কিছুই ভালো লাগতো না।
– এক মিনিট। তোর কী হয়েছে বল তো? হঠাৎ করে এতদিনের পুরনো প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছিস যে!
– নতুন করে কিছুই হয়নি। মেয়েটার সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, আমরা একসঙ্গে এক সপ্তাহ ছিলাম, সুসান কিন্তু এসব জানে না।
– আমিও জানতাম না। জানার দরকারই বা কী?-Ñ দরকার হতো না। কিন্তু আরিয়ানা আবার যোগাযোগ করেছে যে!
– কী বলেছে?
– ও একবার বাংলাদেশে আসতে চায়। আমার কাছে সময় চেয়েছে।
– তুই ওকে না করতে পারিসনি, এই তো?
– কী করে না করি?
– ঠিকই আছে। না করা যায় না। কবে আসবে বলেছে কিছু?
– আমি আগামী মাসে আসার কথা বলেছি। তারিখ বলিনি এখনো।
– আর অবন্তির ব্যাপারটা?
– মানে?
– মানে, ওর কথা কিছু ভেবেছিস?
– ভেবেছি তো বটেই।
– কী ভেবেছিস?
– বিয়ের কথা বলছিস তো?
– হ্যাঁ।
– মনস্থির করতে পারিনি।
– কেন? এখনো সংশয়?
– ওকে নিয়ে সংশয় নেই, আমি নিজেকে তৈরি করতে পারছি না। মনে হচ্ছে, নতুন করে বাঁধা পড়ে যাওয়া আমার জন্য ভালো কিছু হবে না।
– তাহলে কী করবি?
– আমার একটু সময় দরকার।
– ভাবার জন্য?
– না, কেবল ভাবার জন্য নয়। আরিয়ানার কথা শুনে মনে হয়েছে, ও বাংলাদেশে আসতে চায় আমাকে কিছু বলার জন্য। হয়তো বিশেষ কিছু। ওর কথাটা আমি শুনতে চাই।
– হ্যাঁ, তা তো শুনতে চাইতেই পারিস।
– সুসানকে আরিয়ানার কথাটা বলতেও চাই।
– এখনই বলিস না।
– কেন?
– মানুষের জীবনে তো গোপন অধ্যায় থাকেই। হয়তো অবন্তির জীবনেও আছে। সবই বলতে হবে এমন কোনো কথা তো নেই।
– সব তো বলা হবেও না। আরিয়ানার কথা বললেও হয়তো অনেক কিছু গোপন রয়ে যাবে।
– আরো কিছু আছে নাকি?
– হুম আছে। শুনতে চাস?
– না থাক। ওসব শুনে কী হবে? পেছনের ঘটনা পেছনেই পড়ে থাকুক।
– কিন্তু আমার যে মাঝে মাঝে সামনে টেনে আনতে ইচ্ছে করে!
– না আনাই ভালো। বিশেষ করে নতুন কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাইলে অতীতটাকে অতীত হিসেবে রাখাই ভালো।
– হয়তো তোর কথাই ঠিক।
– পরশু রাতের পর অবন্তির সঙ্গে তো তোর যোগাযোগই হয়নি। ও কী ভাবছে আন্দাজ করতে পারছিস?
– না, পারছি না। তুই কিছু জিজ্ঞেস করিসনি?
– নাহ। ফোন করলাম, ও খুব ব্যস্ত ছিল। পরে কথা বলবে বলে ফোন ছেড়ে দিয়েছে।
– হুম।
– দাঁড়া। এখন একবার ফোন করে দেখি।
– এখন? কী দরকার?
ঋভুর কথা শুনলো না অংশু, ফোন করলো। ওপাশ থেকে অবন্তি বললো, কী রে অংশু, কী খবর?
– তোর খবর বল। ঝামেলা মিটেছে?
– কিসের ঝামেলা?
– ওই যে বললি, সম্পত্তি ভাগাভাগি …
– ঝামেলা তেমন হয়নি। ভালোয় ভালোয় মিটে গেছে। এখন সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে।
– আর তুই?
– আমি মাথাব্যথার কথা বলে রুমে এসেছি।
– ভালো করেছিস। তোকে তো পাওয়াই যাচ্ছে না। আমরা মিস করছি তোকে।
– বহুবচনে বলছিস কেন? বল তুই মিস করছিস!
– আরে না। ঋভু তোর বিরহে কাতর হয়ে আছে।
– তোকে বলেছে?
– হ্যাঁ বলেছে। তোর কী অবস্থা?
– বুঝতে পারছি নারে।
– কেন? সেদিনের পর কিছু ভাবিসনি?
– ভেবেছি। অনেক ভেবেছি।
– ভাবাভাবির ফলাফল কী?
– তোর বন্ধুরটা আগে বল।
– না, তোকে আগে জিজ্ঞেস করেছি, তুই আগে বল।
– ধরে নে ইতিবাচকই। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। তোর সঙ্গে আমার কিছু আলাপ আছে।
– বল।
– ফোনে বলা যাবে না। কালকে তোর সঙ্গে দেখা হতে পারে?
– হ্যাঁ পারে। একা? নাকি দুজন?
– না, একা।
– একা আসিলে তোমাকে পস্তাইতে হইবে সুন্দরী …
– কী হেতু পস্তাইতে হইবে জনাব?
– ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের কাছে হরিণশাবক আসিলে পস্তাইবে না?
– তোমার এইসব বৃহৎ বুলি বহুত শুনিয়াছি বালক। মুখে মুখে হাতিঘোড়া মারো, প্রকৃতপক্ষে তুমি হইতেছ একটি ভেড়াবিশেষ!
– ভেড়া? ভেড়া! তুই আমাকে এরকম অপমান করতে পারলি?
– ভেড়া তো বিশিষ্ট উপকারী জন্তু। উহার মাংস খাওয়া যায় এবং লোম দ্বারা পোশাক ও চামড়া দ্বারা জুতা তৈরি করা যায়।
– ফাজলামো রাখ। কোথায় কখন দেখা হবে বল।
– তুই বল। কখন ফ্রি থাকবি, কোথায় এলে তোকে পাওয়া যাবে জানি না তো।
– আচ্ছা, একটু পরে জানাচ্ছি তোকে।
ফোন ছেড়ে দিয়ে অংশু বললো, শুনলি তো?
– শুনবো কীভাবে? কথা তো বললি তোরা।
– ও হ্যাঁ, তাই তো। তোর মতোই ওর অবস্থা। ইতিবাচক কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় লাগবে।
– স্বাভাবিক। ও তো চলে যাবে দুদিন পরেই, এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন।
– দুদিন নয়, পাঁচদিন। ও যাবে বৃহস্পতিবার।
– ওই একই কথা।
– সিদ্ধান্ত নিতে পাঁচদিন লাগে না। তুই তো আর নতুন-পরিচিত কোনো মানুষ না, ও তোর সবই জানে। তুইও ওর সব জানিস।
– নারে, ও আমার সব জানে না, আমিও ওর সব জানি না। কিন্তু ওটা ব্যাপার না। সব না জেনেও সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
– তাহলে? দুজন দুজনকে তো চিনিস ভালো করে।
– বললাম তো একবার, সমস্যা ওকে নিয়ে নয়, নিজেকে নিয়েই। আমি এখনো জানি না, সংসার করার মতো যথেষ্ট মানসিক প্রস্তুতি আমার আছে কি না। আমার ধারণা, সুসানের সমস্যাও নিজেকে নিয়েই। ও-ও বোধহয় প্রস্তুত না।
– সংসার করার চিন্তাটা বাদ দে। তাহলেই সহজ হয়ে যাবে।
– বাদ দেবো? বিয়ে করবো আর সংসার করবো না!
– টিপিক্যাল সংসারী হবি না নিশ্চয়ই! তার দরকারও নেই।
– সংসার তো সংসারই।
– নারে, সেরকম নয়। লোকজন সংসারের ঘেরাটোপে আটকা পড়ে। তারা টাকা-পয়সার কথা ভাবে, ভবিষ্যতের কথা ভাবে, সঞ্চয়ের কথা ভাবে, ছেলেমেয়ের কথা ভাবে। তোদের তো এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।
– তা হবে না। কিন্তু এগুলো নিয়ে না ভাবলে সময় কাটাবো কী করে? বোরিং হয়ে যাবে না?
– তুই একটা আজব চিড়িয়া ঋভু। দুজন মিলে সময় কাটানোর প্রসঙ্গ শুধু এগুলোই?
– কী জানি! আমার তো অভিজ্ঞতা নেই। তোরা কী নিয়ে আলাপ করিসরে?
– একসময় টাকাপয়সা-বাড়ি-গাড়ি-সম্পদ নিয়ে আলাপ করতাম। এখন করি না। ছেলেমেয়েদের নিয়ে মাঝেমধ্যে কথা বলি অবশ্য।
– আর?
– নানা বিষয়ে গল্প করি। বিষয়ের অভাব আমাদের কখনোই হয় না। তোদেরও হবে না।
– ঋভু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললো, আমি যখন রিনিকে বিয়ে করেছিলাম তখন আসলে কোনো প্রস্তুতিই আমার ছিল না। না মানসিক, না শারীরিক। আমি তখন খুব ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। মা প্রায় জোর করেই …
– জানি তো।
– না, শোন। মা বোধহয় ভেবেছিল, আমাদের ছিঁড়ে যাওয়া সুতোটা বউ এসে জোড়া লাগিয়ে দেবে। ওটা যে হওয়ার নয়, তা বোঝেনি।
অংশু চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর ঋভুই ফের বললো, বিয়ে তো করলাম। কিন্তু আমি ওর সঙ্গে কথা বলার কোনো বিষয়ই খুঁজে পেতাম না। রিনিও তো একটু চুপচাপ ধরনের ছিল। দুজনের মধ্যে যোগাযোগটা আর হয়ে উঠলো না। মার আকাক্সক্ষা পূরণ হলো না, আমিও নিঃসঙ্গই রয়ে গেলাম, আর মেয়েটা শুধু শুধু কষ্ট পেল।
– আজকে ঘুরেফিরে কেবল পুরনো দিনের কথা বলছিস ঋভু।
– হ্যাঁ। এত কথা তো বলি না। এখন এমন একটা সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি, একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যখন জরুরি হয়ে গেছে, ফিরে ফিরে তাই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছে। রিনির সঙ্গে আমার ওই যোগাযোগহীনতাই আসলে বিচ্ছেদের দিকে নিয়ে গেছে আমাদের।
– সেজন্য ভয় পাচ্ছিস? যদি সুসানের সঙ্গেও ওরকম হয় এই ভয়?
– সম্ভবত।
– আমার মনে হয় না সেরকম কিছু হবে। তোরা দুজন ভালো বন্ধুও তো। তবে হ্যাঁ, যেহেতু এখনো তোর মনে প্রশ্ন রয়ে গেছে, একটু সময় নে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।
– কিন্তু সুসান তো চলে যাবে।
– তাতে কী? এখন তো আর আগের যুগ নেই। চলে গেলেও যোগাযোগ তো থাকবেই। দুজনে যদি একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারিস, তাহলে ও ফিরে আসবে।
– হুম। দেখা যাক। কালকে তো তোর সঙ্গে ওর দেখা হবে। ও কী বলে জানাবি তো?
– হ্যাঁ জানাবো।
– আজকে তাহলে তুই যা। আমি একটু নিজের মতো সময় কাটাই।
– তোর আজকে মনটা ভালো নেই, বুঝতে পারছি। কোনো পরামর্শ দেবো না, তুই তো সবই বুঝিস। তোর এই একা থাকা আমার ভালো লাগে না।
– আমি জানি অংশু। তোর অনুভূতি বুঝতে পারি। হয়তো পজিটিভ কোনো সিদ্ধান্তই নেবো। চিন্তা করিস না।
অংশু উঠে ঋভুকে আলিঙ্গন করলো, বললো, কালকে তোকে হাসিমুখে দেখতে চাই। তোকে এরকম দেখে গেলাম, বাসায় গিয়েও আমার ভালো লাগবে না।
ঋভু মøান হাসলো, বললো, ঠিক হয়ে যাবে। ভাবিস না।
অংশু যাওয়ার পর আরো মন খারাপ লাগতে লাগলো ঋভুর। মনে হতে লাগলো – কী অসহনীয় একেকটা দিন, কিছুতেই পার হতে চায় না। কাজকর্মে ব্যস্ত থাকলে এতটা খারাপ লাগে না; কিন্তু তার তো কাজও নেই। কালকে অফিসে যাবে ঠিকই, কিন্তু সেখানেও এমন কোনো কাজ নেই যা নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকা যাবে। হয়তো মনই বসবে না কোনোকিছুতে। কী করবে সে?
রুমে গিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসলো ঋভু। লাভ হলো না। করার মতো কিছু খুঁজেই পেল না।
কী মনে করে ই-মেইল খুললো ঋভু এবং দেখলো বেশ কিছু মেইলের সঙ্গে আরিয়ানারও তিনটে চিঠি। লজ্জা পেল সে। গত তিনদিনে একবারও মেইল চেক করা হয়নি। পুরনো অভ্যাস। ছুটির দিনে সে ইন্টারনেটের ধারেপাশে যায় না। এমনকি ফোনও বেশিরভাগ সময় নীরব করে রাখে। কিন্তু ওটা তো তার স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ, আর এখন সময়টি অন্যরকম। আরিয়ানার সঙ্গে যোগাযোগটা চলছে মেইলেই। একদিন মাত্র ফোনে কথা বলেছে। সুসানের সঙ্গেও কথা চলছে ফোনে। এই সময় এত উদাসীন থাকা উচিত হয়নি।
এক এক করে তিনটি চিঠিই পড়লো ঋভু। প্রথমটিতে স্বাভাবিক গল্পসল্প, দ্বিতীয়টিতে উত্তর না পাওয়ার জন্য হালকা অনুযোগ, তৃতীয়টিতে উৎকণ্ঠা : পারভেজ, কী হয়েছে তোমার? কোনো সমস্যা হয়নি তো? কথা বলছো না কেন?
ঋভু ভাবলো, আরিয়ানা চাইলেই একটা ফোন করতে পারতো। করেনি। তাহলে কি সেও আমার মতো এইসব প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি? কথায় কথায় ফোন করা, টেক্সট মেসেজ পাঠানো, মেসেঞ্জারে-হোয়াটসঅ্যাপে-ভাইবারে নক করা, এসব কি ওরও পছন্দ নয়? বেশ হয় তাহলে। দুজনের বেশ মিলে যায়।
ঋভু দুঃখ প্রকাশ করে লম্বা এক চিঠি লিখলো। সে যে এখনো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি, এখনো রয়ে গেছে আগের দিনের মানুষের মতো, এখনো প্রতিদিন মেইল চেক করার কথা তার মনেই পড়ে না, বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে, অকপটে সব জানালো। সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করলো মনোহর ভঙ্গিতে। লিখলো, এতদিন পর আরিয়ানার খোঁজ পেয়ে কতটা ভালো লাগছে তার, অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে ওর দেখা পাওয়ার জন্য। শেষে লিখলো, কবে আসছো তুমি? কিছু ঠিক করেছ?
উত্তর আসতে দেরি হলো না। আরিয়ানা চিঠি পড়ে স্পষ্টতই খুশি। লিখলো, তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। ফ্রি আছো তুমি? কথা বলতে পারবে?
ঋভু জানালো, সম্পূর্ণ ফ্রি আছে সে, দীর্ঘক্ষণ কথা বলতেও অসুবিধা নেই।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠলো ফোন।
রিসিভ করতেই আরিয়ানা বললো, তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।
– কেন? ভয় কিসের?
– ভেবেছিলাম, আবার বোধহয় তোমাকে হারিয়ে ফেললাম!
– কী যে বলো! খুব হারানোর ভয় বুঝি তোমার?
– হ্যাঁ। একবার হারিয়ে ফেলেছিলাম যে! কতগুলো বছর যে তোমাকে খুঁজেছি।
– আর হারাবে না আরিয়ানা। আর কখনোই হারাবে না। – ভেজা কণ্ঠে বললো ঋভু। তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। সে যখন একটা আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছিল, কোথাও স্বস্তি পাচ্ছিল না, তখন কোন দূর দেশে কোনো এক প্রেমময় তরুণী তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল; অথচ সে জানতোই না। কী অদ্ভুত এই জীবন!
আরিয়ানা হাসলো ওপাশ থেকে। বললো, আমিও তোমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে আছি।
– কবে আসছো?
– তুমিই না তারিখ দিতে চেয়েছিলে!
– আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে আসতে পারবে?
– হ্যাঁ পারবো।
– আচ্ছা। ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করেছ?
– অলরেডি নিয়ে ফেলেছি।
– বাহ। এখন শুধু টিকিট করা বাকি?
– হ্যাঁ। ওটা দু-একদিনের মধ্যেই করে ফেলবো। তারপর তোমাকে জানাবো।
– খুব খুশি হলাম।
– তোমার বাসার আশেপাশে আমার জন্য একটা হোটেলে রুম বুক করে রেখো। নাকি আমিই করবো এখান থেকে?
– হোটেলে উঠবে কেন?
– তাহলে কোথায় উঠবে?
– আমার বাসায়!
– বাসায়! কেউ কিছু মনে করবে না?
– মনে করার মতো কেউ নেই তো!
– ও! তাই বলো।
– তুমি একা আসছো?
– না। আরেকজন সঙ্গে থাকবে।
– তার কোনো আপত্তি নেই তো?
– না। বরং তোমার বাসায় থাকতে পারলে সে বেশি খুশি হবে।
– মানে? কে সে? চিনি আমি?
– এখন বলবো না। এলেই দেখতে পাবে।
– কৌতূহল হচ্ছে তো।
থাকুক একটু রহস্য। অপেক্ষা করো। বেশিদিন তো বাকি নেই।
– হুম। ঠিক আছে। দেখি তুমি কী রহস্য নিয়ে আসছো আমার জন্য।
– রহস্য তো একটা কিছু আছেই। কিন্তু তুমি অবাক হবে নাকি বিরক্ত হবে বুঝতে পারছি না।
– বিরক্ত হবো না আরিয়ানা।
– কীভাবে নিশ্চিত হলে? ব্যাপারটা যদি তোমার জন্য আনন্দদায়ক না হয়?
– তাও বিরক্ত হবো না।
– সে কি! তা কেমন করে সম্ভব?
– নিশ্চয়ই তোমার জন্য ব্যাপারটা আনন্দের, নইলে তো আর নিয়ে আসতে না। তোমার আনন্দের কোনোকিছুতেই আমি বিরক্ত হবো না।
– আর যদি দুঃখের হয়?
– তাও না। তোমার সবকিছুই আমার আরিয়ানা। দুঃখ হোক আর আনন্দ, আমি সেটাকে নিজের বলেই গ্রহণ করবো। বিরক্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
মিথ্যে বলছিল না ঋভু। সে আসলে ভেসে যাচ্ছিল পুরনো দিনের আবেগে। সেই পোখারায়, আরিয়ানার সঙ্গে আকস্মিক অথচ তুমুল প্রেমে মেতে উঠতে উঠতে তার যেমন মনে হয়েছিল, এই মেয়েটি যদি চায়, তাহলে ওর জন্য সব ছেড়ে দিতে পারি আমি।
একটুক্ষণ চুপ করে রইলো আরিয়ানা। তারপর যখন কথা বললো, তখন তার কণ্ঠ ভেজা এবং ভারী, বললো, এত প্রেম
কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে পারভেজ? আমাকে খোঁজোনি কেন?
– এসো। এলেই সব বুঝতে পারবে, জানতে পারবে। আমার জীবন সরলপথে চলেনি আরিয়ানা।
– আমার জীবনও সরলপথে চলেনি পারভেজ। জীবন বোধহয় সরলপথে চলার জিনিসও না।
– হ্যাঁ, সেটাই। এসো, আমরা না হয় দুঃখের গল্পই করবো।
– না, সব গল্প দুঃখের হবে না। আমাদের তো সুখের স্মৃতিও আছে।
– তা আছে। ঠিক আছে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সব গল্পই হবে।
– ঠিক আছে। তোমার ওখানে নিশ্চয়ই অনেক রাত এখন। ঘুমাবে না?
– একটু পর ঘুমাবো। তুমি ছাড়বে এখন?
– হ্যাঁ, ছাড়ি। তুমি ওরকম নীরব হয়ে থেকো না। সময় পেলে দু-এক লাইন লিখো।
– আচ্ছা, লিখবো। এখন ছাড়ছি তাহলে। গুড নাইট।
– গুড নাইট।
– ফোন ছেড়ে ব্যালকনিতে এলো ঋভু। আকাশে আজ
চাঁদ-তারা কিছু নেই, ঘন মেঘে ছেয়ে আছে সব। হয়তো বৃষ্টি হবে অথবা ধারেকাছে কোথাও ইতোমধ্যেই হয়েছে। একটা ঠান্ডা হাওয়া আসছে দক্ষিণ দিক থেকে। ওদিকে বাগান। বিদ্যুতের আলোতে আলোকিত হয়ে আছে। গাছের পাতায় পাতায় আলোর নকশা, মাটিতে নকশার ছায়া। তারও ওপাশে নীলু ঘুমিয়ে আছে, অপূর্ব নিরাপদ তন্দ্রা, যার নাম লেখা হয়েছিল জলের অক্ষরে। কার নাম জলের অক্ষরে লেখা হয়নি? কার নাম মুছে যাবে না? ঋভু এখন সেরকম একটি নাম খুঁজছে। (চলবে)
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.