মুক্তিযুদ্ধ ও এক বীরাঙ্গনার আখ্যান

তালাশ উপন্যাসের শুরুতেই বোঝা যায় ঔপন্যাসিক শাহীন আখতার একজন বীরাঙ্গনাকে নিয়ে লিখতে বসেছেন, যাঁর নাম মরিয়ম; প্রকারান্তরে মেরী। শুরুর দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেই তিনি মরিয়মের অনুভূতি এভাবে প্রকাশ করেছেন, ‘শুধু যুদ্ধ নয়, যুদ্ধহীন শান্তির সময়ও নারীর জীবনকে যদি ভাবা হয় চার চাকার গাড়ি, তবে দেহ তার সারথি। নিয়মের বাঁধানো সড়ক থেকে দেহ একচুল সরে গেলে আস্ত গাড়িটাই গর্তে, আবর্জনায় মুখ থুবড়ে পড়ে। জীবনের পতন ঘটে। নারী পতিত হয়।’

এক নিরন্তর তালাশের গল্প নিয়ে তালাশ উপন্যাস। গবেষক মুক্তির হাত ধরে মেরী বা মরিয়ম নিজেকে খুঁজছেন। শুধু ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নয়, মরিয়ম চলে যাচ্ছেন আরো পেছনে। ফুলতলি গ্রামে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। উঠতি যৌবনকাল পর্যন্ত গ্রামে থাকা। হয়তো মরিয়মকে গ্রাম ছাড়তে হতো না যদি দূরসম্পর্কের আত্মীয় জসিমুল হকের সঙ্গে ইংরেজি সিনেমা দেখতে গিয়ে তিনদিন পালিয়ে থেকে কলঙ্কে না জড়াত। 

১৯৬৪ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ও ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর হিন্দুরা দলে দলে ভারতে চলে যায়। অনেকে হিন্দুদের জায়গা নামমাত্র দামে কিনে নেয়, অনেকে আদালত থেকে কাগজপত্র তৈরি করে বিনা দামেই দখল করতে শুরু করে। মরিয়মের বড় মামা গোলাম মোস্তফা তাদের  একজন। ঢাকা শহরে হিন্দুদের জায়গাজমি জলের দামে বা বিনা পয়সায় দখল করে তিনি লাখপতি। মরিয়মের বাবা কফিলউদ্দিন আহমেদ ছিলেন ফুলতলি গ্রামের কৃষক। কিছুতেই গ্রাম ছাড়বেন না। পরে বড় শ্যালক গোলাম মোস্তফার পীড়াপীড়িতে ঢাকার রায়েরবাজারে তিনি জলের দামে, শুধুমাত্র এক বছরের পাট বিক্রির টাকা দিয়ে, বিশাল একটা জায়গা কিনে ফেলেন। সেখানে তিনি আবার গ্রামের আদলেই একটা বাড়ি করেন। ইটের গাঁথুনির ওপর টিনের চালাঘর। পাশে রান্নাঘর। খোলা উঠোন। উঠোনের মাঝখানে টিউবওয়েল। টিউবওয়েলের পাশে টিনের বেড়ার গোসলখানা। গ্রাম ছাড়ার পর মরিয়মের সেই বাড়িতেই স্থান হয়।

মূলত রায়েরবাজারে সেই বাড়ি দিয়েই মরিয়মের শহরের জীবনের গল্প শুরু। রায়েরবাজারে উঠে আসার আগে অবশ্য মরিয়ম গ্রামের স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করে এসেছিলেন। লেখাপড়ায় বরাবরই তিনি ভালো ছিলেন। খুব কম লেখাপড়া করেই তিনি বিএ পাশ করেন। জসিমুল হকের প্রেম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঢাকায় এসে তিনি নতুন করে প্রেমে পড়েন আবেদের। লেখকের ভাষায় আবেদ সম্বন্ধে মরিয়মের অনুভূতি এমন ছিল, ‘জসিম ছিল সম্ভাবনাময় চারাগাছ। আর সে মনে করে আবেদ হচ্ছে আগামী সিজনে ফল দেবে এমন এক পরিণত বৃক্ষ। সুযোগ পেলেই তাতে চড়ে বসা যায়। তারপর সে ফল যা ফলাবে, সব মরিয়মের। সেই মতে ’৬৯-৭০, এই দুই বছর আবেদ স্বপ্ন দেখায়, মরিয়ম দেখে …।’

মরিয়ম একসময় জসিমুল হকের মতো আবেদের কাছ থেকেও দূরে সরে যান। এখানে জসিমুল বা আবেদ কেউ দোষী নয়, দোষ সময় ও প্রকৃতির। জসিমুল হকের সঙ্গে মরিয়মের বিচ্ছেদের জন্য পরোক্ষভাবে সমাজব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন লেখক। তবে আবেদের সঙ্গে বিচ্ছেদের ঘটনাটা লেখক অন্যভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। লেখকের ভাষায়, ‘রক্তের ভেতর দিয়ে আত্মসমর্থনের নতুন অধ্যায় সূচিত হলো। মরিয়ম অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে। এ-অবস্থায় আবেদকে শুধু প্রেমিক ভাবা তার পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও নিজের জন্য একটা চাকরি, বাসা, বউ, বাচ্চা – এসবের ভেতর আবেদ নেই। ক্ষমতা, রাষ্ট্র, আন্দোলন নিয়ে এখন তার কারবার।’

লেখক এখানে আবেদকে মরিয়মের ব্যাপারে মোটেও দোষারোপ করেন না। বরং স্পষ্ট ভাষায় লেখেন, ‘প্রথম ক’টি সপ্তাহ আবেদ দিশেহারা। মরিয়মের কাছে এলে মন পড়ে থাকে বাইরে, আর বাইরে গেলে মনটা পড়ে থাকে মরিয়মের কাছে। একদিকে দেশ, অন্যদিকে নারী।’ আবেদ থেকে মরিয়মের চিরতরে বিচ্ছেদ হওয়ার ঘটনাটা অতি সাধারণভাবে লেখক ব্যক্ত করেন। তিনি লেখেন, ‘আবেদ আর মরিয়মের পায়ে পায়ে রাস্তাটা গিয়ে পলাশিতে পড়ে। সেখানকার ফুটপাতে প্রথম দিনের সেই মুচি জুতো সেলাইয়ের সরঞ্জাম নিয়ে আজও বসে আছে। তার পাশেই একটা খালি রিকশা। মরিয়ম ’৬৯ থেকে ৭১, একটা আনন্দ আর বেদনাময় অধ্যায় সমাপ্ত করে রিকশায় উঠে বসে।’ লেখক সমাপ্তিটা আরেকটু টেনে ধরেন এভাবে, ‘আবেদ মঞ্চে ওঠে। শ্রোতারা করতালি দেয়। মেরী বাচ্চা প্রসব করে, অবয়বহীন, রক্তপিণ্ড, বাবাছাড়া।’

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগে মরিয়মের জীবনকাহিনি মূলত  এটুকু। যদিও সমান্তরালে উঠে এসেছে দেশের উত্তাল সময়ের ঘটনা – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার কথা। সঙ্গে শত শত মিছিলের গল্প। লেখক সহজ ভঙ্গিতে বলেন, ‘তখন যে বাস্তবতা, তা যুদ্ধের। প্রচণ্ড জোরে অদূরে একটা গোলা ফোটে। জানালার শার্সি ভাঙার ঝনঝন আর্তনাদে ভ্রƒণের খোলস ভেঙে মরিয়ম ছিটকে পড়ে মেঝেতে। তখনো সে চলাচলের শক্তিরহিত, চেতনাহীন। খাটের তলার জমাট অন্ধকার সেই কখন থেকে কোল পেতে বসে রয়েছে। আরেকটা বোমা ফোটার সাথে সাথে মরিয়ম অবয়বহীন রক্তপিণ্ড পেছনে ফেলে অন্ধকারের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঢাকা শহর তখন জ্বলছে।’

দুই

মরিয়মের নতুন গল্প শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ও তাঁর বেঁচে থাকার সংগ্রাম নিয়ে। লেখক যুদ্ধের শুরু বা পঁচিশে মার্চ রাতের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘সেকেন্ড ক্যাপিটালের দর্শকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে একটি বীভৎস হত্যাকাণ্ডের। এদিকে আক্রমণকারীরাও সশস্ত্র, উদ্যত, অস্থির। বেতারযন্ত্রের মারফতে মিনিটে মিনিটে আবদার আসছে – ইমামের কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে, আর কতক্ষণ অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু পিআইএর স্পেশাল ফ্লাইটটির যত দ্রুত করাচির আকাশসীমানায় পৌঁছে যাওয়ার কথা, তত দ্রুত পৌঁছোচ্ছে না যেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাতে সাওয়ার।’

মরিয়ম দুর্বল শরীর নিয়েই ২৭শে মার্চ সকালে যখন ঘরছাড়া মানুষের কাফেলায় যোগ দেয়, তখন থেকেই উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের অনাবিষ্কৃত কাহিনি এগিয়ে চলতে শুরু করে। লেখকের ভাষায়, ‘হাজি সাহেবের নেতৃত্বে মরিয়মসহ পনেরো-কুড়ি জনের দলটা যখন বুড়িগঙ্গা পার হয়, তখন কয়েকটা শবদেহ ভেসে যাচ্ছিল তাদের পাশ দিয়ে। এদের চলায় জীবিতদের মতো তাড়া নেই। ছোট ছোট ঢেউয়ের তালে ভাসছে। কোথাও আটকে পড়ছে জলজ গুল্ম। এ-দৃশ্য আকাশ থেকে দুরবিন-চোখে দেখছে একদল শকুন। তখনো এদের পাখা টানটান, ধারালো চঞ্চু সাঁড়াশি-আঁটা, নখগুলো ভাঁজের ভেতর। অপেক্ষাকৃত নিচ দিয়ে ওড়াউড়ি করছে কতগুলো মাংস-লোভী কাক।’ লেখক যেন এতটুকু বর্ণনা দিয়েই ঢাকা শহরের ২৫শে মার্চ ও ২৬শে মার্চের পরিস্থিতি সুচারুভাবে তুলে এনেছেন। কাহিনি এগিয়ে যায়।

মরিয়মের নয় মাসের শেকড়হীন জীবনের শুরুতেই নতুন একজন মানুষের উপস্থিতি – এর ভেতর দিয়ে লেখক পাঠককে অন্য একটা গল্পের দিকে টেনে নিয়ে যান। সেই গল্পের শুরু রমিজ শেখকে দিয়ে। লেখকের বর্ণনায়, ‘২৫ মার্চ রাত আসে। কুকুরের আগাম বিপদসঙ্কেত জানানো সত্ত্বেও মরিয়মকে খাটের তলায় লুকোতে হয়। রমিজ শেখ রবিনসন ক্রুশোর মতো আসে জনবিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে।’ এখানে লেখক আরো যোগ করেন, ‘মরিয়মের জীবনে পুরুষের ভূমিকা দ্বৈত। সৌভাগ্যের সাথে তার দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে আসে – যুদ্ধ কি শান্তি যে-কোনো সময়। তারা আসে কুয়াশার ভিতর থেকে স্বপ্নের চাদর উড়িয়ে।’

মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় মাস। মরিয়মের জীবনে আসা তৃতীয় পুরুষ রমিজ শেখের সঙ্গে বিচ্ছেদ। শুধু রমিজের সঙ্গে বিচ্ছেদ নয়, মরিয়ম নিজেও ব্যবচ্ছেদ হতে শুরু করেন পাকিস্তানি আর্মিদের হাতে। রমিজ শেখ ও মরিয়ম দুজনই পাকিস্তানি আর্মির হাতে ধরা পড়েন। রমিজ শেখকে পাকিস্তানি আর্মি নির্যাতন করে মেরে ফেলে। কিন্তু মরিয়মের শুরু হয় দুঃসহ জীবন।

পাকিস্তানি আর্মি ও তাদের দোসরদের দ্বারা রমিজ শেখের নির্যাতনের বর্ণনা লেখক এভাবে দেন, ‘এখানে রমিজ শেখকে একবার সোজা করে, পরের বার উল্টিয়ে ঝুলিয়ে প্রতিবার একই জবানবন্দি নিতে মেজর সাহেব অশেষ আনন্দ পাচ্ছেন। ফাঁকে ফাঁকে নবরত্ন অপেরার সিরাজদ্দৌলা পালাটাও টিকিট ছাড়া তার দেখা হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধের উৎসবহীন দিনে মেজরের জন্য এসব উপরি পাওনা।’

লেখক রমিজ শেখের মৃত্যুর বর্ণনা দিয়েছেন খুব নির্মোহভাবে, যেন কাছ থেকেই দেখছেন। তিনি মৃত্যুর মধ্যে এক চিত্রকল্প তুলে ধরেছেন, ‘পিঠে গুলি লাগার পর রমিজ শেখের দৌড়ানোর গতি হঠাৎ বেড়ে যায়। কারণ পায়ের দড়ি ছিঁড়ে যাওয়ার পর তার দৌড়টা আর ঠ্যাং-বাঁধা মোরগের মতো থাকে না, বাঘের তাড়া করা হরিণের লাফে রূপান্তরিত হয়।’

মরিয়মের পাশাপাশি বহু বীরাঙ্গনার গল্প উঠে এসেছে লেখকের বর্ণনায় বহুবার। শ্যামলী রহমান, বিন্দুবালা, টুকি, পারুল, অনুরাধা ও আরো অনেক। পাকিস্তানি ক্যাম্পে তাঁদের দুঃসহ জীবনযাপনের বর্ণনা দেন, ‘অনাহারক্লিষ্ট দুর্বল শরীর, ঘনঘন সে দম নেয় – হাঁপায়। দেয়ালে নাক ঘষতে ঘষতে বলে, এঁরাম, কুমড়োর গন্ধ। শোভা রানী তখন গর্ভবতী। … গণধর্ষণের ফলে জবা নামের হাসিখুশি মেয়েটি সবার চোখের সামনে স্পটেই মারা যায়। শেষ সৈন্যটি শরীরের ওপর থাকতেই ওর দম বেরিয়ে যায়। তারপর মাঝখানে একটা দিন গিয়ে রাত হয়েছে, ডেডবডি সরাতে কেউ আসে না। কম্বলের নিচে পচে উঠছে তাদের রাতদিনের সঙ্গী, ফুলের মতো মেয়ে জবার শরীর …।’

পাকিস্তানি সেনারা বন্দি নারীদের শাড়ি খুলে নিয়েছিল, পরনে কাপড় রাখতে দেয়নি। লেখক জৈতুন বিবির মুখ দিয়ে তুলে ধরেন, ‘যিখান থিকে পাক সেনারা এয়েছ্যাল, অইখেনের বিডিরা শুইনছি শাড়ি পরতো না, মুসলমানী লম্বা কুর্তা দিতো। শাড়ি হচ্ছে গে হিন্দুর পোশাক।’

তিন

মরিয়মের নতুন গল্প শুরু হয় বিজয়ের দিনের পূর্বক্ষণ ও পরক্ষণের সময়টা নিয়ে। লেখকের বর্ণনায়, পক্ষ-বিপক্ষ তখনো একটা বড় ব্যাপার – যুদ্ধবন্দি মেয়েদের কাছে। স্বাধীনতার পর বিভাজন-রেখাটি মুছে গিয়ে সবাই বিপক্ষে চলে যায়। অনুরাধার এই ভবিষ্যদ্বাণীটি আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মাসাধিককাল আগের কথা। 

পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্প থেকে মরিয়মের মুক্তির দিনটাকে লেখক আনন্দ ও বেদনা – এই দুই অনুভূতিতে ফুটিয়ে তুলেছেন, ‘এই চার দিনে এক বেলাও খাবার জোটেনি।

বাথরুমের কল ছেড়ে দুদিন শুধু পানি খেয়েছে। তারপর কলেও পানি নেই। পানি-বাতি সব বন্ধ। জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজাতে গেলে জিব জড়িয়ে আসে। খিদা-তৃষ্ণার বোধটা ধীরে ধীরে শরীর থেকে চলে যাচ্ছিল। এই বুঝি শেষ, না-খেয়ে মরতে হবে। এই অবস্থায় জয়বাংলা সেøাগানটা আরো নিকটে চলে এলে মরিয়ম বলে, তখন যে কী অনুভূতি হচ্ছিল তা বোঝাতে পারবো না। আরি আল্লা, তাইলে আমরা বেঁচে গেছি, বোমার আঘাতে বা না-খেয়ে আমাদের মরতে হবে না! শরীরে তখন অসুর ভর করে। ও বাবা ও ভাই চিৎকার করে করে মরিয়ম তখন দরজায় লাথি মারছে। বাইরে থেকেও একই তালে চিৎকার আসে, ও মা, ও বুইন, আমরা আসছি, আমরা আসছি। মা-মা, এই যে আমরা আসছি, এই যে আমরা আসছি।’

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বীরাঙ্গনাদের অনুভূতি তুলে ধরতে গিয়ে লেখক বলেন, ‘শুরুতে পত্রিকায় বিয়ের বিজ্ঞাপন দেখে পুরুষের দল চিল-শকুনের মতো হামলে পড়েছিল। অনেক আবেদন-পত্রের ইনভেলপ বেবি নিজের হাতে খুলেছে। সময়টা ’৭২ সালের এপ্রিল মাস। তখনো মেয়েগুলোর পুরুষভীতি প্রবল। বিয়ে তো বিয়ে, কথা বলায়ও চরম অনীহা। তারা আবেগশূন্য আর পাথর হয়ে গিয়েছিল। অগত্যা পাল্টা প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিয়ের আবেদনকারীদের বিরত রাখা হয়েছিল।’

যুদ্ধের পর মরিয়মের পুনর্বাসনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক বলেন, ‘কফিলউদ্দিন আহমেদের এখনো দেখা নেই। বংশের বাতিই সব, জীবিত মেয়ের কোনো দাম নেই, এতোবড় একটা যুদ্ধের পরও? লাখ লাখ মানুষ মারা গেল, সেবাসদন আর অন্যসব জায়গায় বীরাঙ্গনাদের বাচ্চা হয়েছিল আর কয়টা। তাদের বিদেশ না পাঠালে স্বাধীন দেশটার চলছিল না নাকি? তারা পাকিস্তান জালিমের বাচ্চা শুধু, বাঙালি মেয়ের নয়? খোঁচাখুঁচি করার ফলে জরায়ু আহত হয়েছে তো মরিয়মের একার, মেজর ইশতিয়াক যে শরীর নিয়ে এসেছিল সেই শরীরেই ফিরে গেল। সামান্য টোল কোথাও পড়েনি। … মাঝখানে কত মানুষ মারা গেল, কত মেয়ে নির্যাতিত গেল, কত ঘর পুড়লো, কটা ব্রিজ আর কালভার্ট উড়ে হলো – মরিয়ম বীরাঙ্গনা অফিসে জনে জনে জিগ্যেস করে আর আঙুল গুনে হিসাব করে। সকালের দিকে সংখ্যাটা গণনাযোগ্য মনে হলেও দুপুর নাগাদ সে খেই হারিয়ে ফেলে।’

চার

পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে ফিরে এসে স্বাধীন দেশে শুরু হয় মরিয়মের নতুন জীবন। অন্যভাবে বললে, মরিয়মের নতুন জীবনের নতুন সূচনা হয় স্বাধীন দেশে। তিনি নিজেকে বা নিজের সত্তাকে খুঁজে বের করায় উদ্যমী হন। তিনি আবেদকে খোঁজেন। পেয়েও যান। কিন্তু তিনি দেখেন, সেই পুরনো আবেদ আর নেই। সে যে এক নতুন আবেদ।

আবেদ সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক বলেন, ‘এক অবাঙালির সওদাগরি অফিসের মালিক এখন আবেদ। প্রাক্তন মালিককে ভারত হয়ে পাকিস্তানে ভেগে যেতে সাহায্য করার বিনিময়ে তার পরমাসুন্দরী মেয়েকে সে বিয়ে করেছে। অর্থাৎ যুদ্ধজয়ের পর পুরো রাজত্বসহ এক রাজকন্যা তার ভাগে। অথচ যুদ্ধে সুমন আর মন্টুও গিয়েছিল। একজন নোংরা তোয়ালেতে মুখ মুছছে, আরেকজন ফিরে আসেনি। দুজনই আবেদের অনুজ, পরম শিষ্যের মতো ছিল। সুমনকে অবাক করে দিয়ে মরিয়ম বলে যে, যুদ্ধের আগে তাদের সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে। সুতরাং আবেদের ব্যক্তিগত জীবন জানার তার দরকার নেই। মরিয়ম শুধু তার ঠিকানাটা চায়। সে নিজে এখন একজন বীরাঙ্গনা। … জাতির গর্ব, স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র নারী…।’ মরিয়ম নিজেকে নিয়ে গর্ব করে বললেও আবেদের অফিসে গিয়ে দারোয়ানের মুখে যখন শোনে, ‘স্যার খুব ভালো আর পরোপকারী। বীরাঙ্গনা  … স্যারের চেত-ঘিন কিছু নাই, নইলে ওই মাগিগো হাতের খানা খায় – কন?’ তখন মরিয়মের হুঁশ ফেরে।

মরিয়মের নতুন যুদ্ধ শুরু হয়। একদিকে বীরাঙ্গনার পরিচয়, অন্যদিকে ‘খানকি মাগি’! এখন মরিয়ম বেশ্যার আসন আলোকিত করে একজন পুরুষের ঘর করেন। পাকিস্তানি আর্মি আর পাকিস্তানি মেজর ইশতিয়াক বাদে তাঁর অন্য আরেক বাঙালি পুরুষ। মমতাজ তার নাম। মমতাজ নামটাকে মরিয়ম আগে মেয়েদের নাম বলে ভাবতেন। কিন্তু এই মমতাজ পুরুষের নাম। মমতাজের সঙ্গে মরিয়মের বিয়ে হয়। কিন্তু সেই মমতাজও একদিন চলে যায়।

লেখকের ভাষায়, ‘সময় ভয়ানক প্রতারক। মরিয়মের জন্য নতুন কোনো স্বপ্ন দুপুর-বিকেলগুলোতে আর রচিত হয় না। তবে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় একা বসে থাকার জন্যই হোক কিংবা তার মাত্রাতিরিক্ত সাজসজ্জার কারণেই হয়তো হবে, সে একসময় পথচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এও নতুন করে স্বপ্ন দেখার প্রথম ধাপ, যার অর্থ বয়সটাকে এই প্রেমিক-প্রেমিকার স্তরে নামিয়ে আনা। কিন্তু তার দিকে পুরুষগুলোর ইশারা-ইঙ্গিত সব একমাত্রিক। তারা শুধু পাঁচ মিনিটের একটা সঙ্গম চায়, দশ-বিশ টাকার বিনিময়ে।’ লেখক সত্যি তখন মরিয়মকে নিয়ে এক ভয়ানক সময়ের দিকে এগিয়ে যান।  কিন্তু তারপরও লেখক মরিয়মকে দিয়ে স্বপ্ন দেখান, মরিয়ম কাম নয়, স্বপ্ন চান – তা শপ উইন্ডোর নিñিদ্র কাচের ভেতর দিয়ে হলেও। এবার আবেদ জাহাঙ্গীর নয়, আবেদ সামির নামে এক নতুন কবি বা লেখক পুরুষ তাঁর জীবনে আবির্ভূত হয়। যুদ্ধজয়ের পর স্বাধীন দেশের তিন-সাড়ে তিন বছর।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের পর দেশের চিত্র পুরো পালটে যায়। বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র উঠে যায় তৎক্ষণাৎ। তখন বীরাঙ্গনাদের কী হয়? আটাশ বছর পর বীরাঙ্গনাদের নিয়ে গবেষণারত মুক্তির প্রশ্নের জবাব আসে, ‘প্রসটিটিউশন …!’ লেখকের ভাষায় বীরাঙ্গনাদের ফিরিস্তি, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেসব যেসব মেয়ে বিদেশ চলে গিয়েছিল দালালদের খপ্পরে পড়ে, তারা চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল। আত্মহত্যা করেছে কেউ কেউ।’ 

মরিয়মের জীবনে আবেদ জাহাঙ্গীর আবার ফিরে আসে। যুদ্ধের আগে উত্তাল দিনগুলির সেই আবেদ। আবারো আবেদ চলে যায়। এই চলে যাওয়া নিয়ে মরিয়ম একবার হাসে, একবার কাঁদে। ভাবে, ইতিহাসের প্রহসন আর তাঁর ব্যক্তিগত জীবন মেশিনের সুতোর মতো একে অন্যের গায়ে জড়িয়ে গেছে যেন।

মরিয়মের বয়স বাড়ে। ট্র্যাভেল এজেন্সিতে চাকরি করা মরিয়মের মাথার চুল তখন অর্ধেকের বেশি মেহেদিরঞ্জিত। বয়স চল্লিশ। তখনই এক নতুন পুরুষ তাঁর সঙ্গী হয়। দেবাশীষ নামে তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট। তাও আবার বিয়ে করা বর হয়ে। পাড়ার লোকেরা দেবাশীষকে মুসলমান বানিয়ে জোর করে কাজী ডেকে বিয়ে দেয়। দেবাশীষের মুসলমান নাম হয় আবেদ ইশতিয়াক। কিন্তু দেবাশীষ পুরুষ-আসক্ত।

মুক্তিযুদ্ধের ছাব্বিশ-সাতাশ বছর পর। মরিয়মের ঠিকানা খুঁজে মুক্তি তাঁর বাড়িতে আসে। কিন্তু মুক্তি মরিয়মের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তোতলায়, ‘আপনাদের আত্মত্যাগ ছাড়া দেশ স্বাধীন হইতো না। আপনারা বিশেষ কিছু … মানে।’ কিন্তু শেষবার, আটাশ বছর পর যখন মুক্তি আসে, তখন মরিয়ম আর এক বীরাঙ্গনা টুকির সঙ্গে নিরুদ্দেশ। লেখক লিখেছেন, ‘মরিয়ম ও টুকি নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার বছরখানেক পর, রায়েরবাজারের বাড়ির জায়গায় একটা চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠে গেছে। তাতে পাশাপাশি একজোড়া কালো গেট। সাং ফুলতলি, ডাকঘর সাহারপাড় ঠিকানাসহ কফিলউদ্দিন আহমেদের নাম মুছে লেখা হয়েছে রত্না ও ছন্দ – আলাদাভাবে দুটো গেটে যমজ দুই বোনের নাম। মেরী ওরফে মরিয়ম কোথাও নেই।’

শাহীন আখতারের তালাশ উপন্যাস শেষ হয় মরিয়ম ও টুকির অলীক নৌযাত্রায়। এই অলৌকিক নৌকাযাত্রার নাম মৃত্যু। কিন্তু ওরা এক অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্নালোকে চলে যায়। উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে এসে লেখক মুক্তিযুদ্ধের ঊনত্রিশ-ত্রিশ বছর পর মরিয়মের জীবনচিত্র তুলে ধরতে গিয়ে দেশের পুরো সমাজব্যবস্থায় হতাশার চিত্র, পাশাপাশি আশার একটা ক্ষীণ চিত্রও ফুটিয়ে তোলেন। উপন্যাসের শেষটা এমন, ‘অনুরাধা শাদা রুমাল নেড়ে দূরের এক বেলাভূমি থেকে হাতছানি দিয়ে তাদের ডাকছে। মুর্দার গাম্ভীর্য ঝেড়ে ফেলে মরিয়ম এখন বেশ উৎফুল্ল। আরেকটু এগোলে হয়তো রমিজ শেখকে পাওয়া যাবে। এদিকে তরতর করে চালকহীন নৌকাটা চলে গেছে অনুরাধার নিকটে। শূন্যে ঝুলে থাকা একটি বরফশীতল হাত মরিয়ম  হয়ে ধরতেই গলুই বেয়ে অনুরাধা পাটাতনে উঠে আসে। তারপরও একজন আরেকজনের হাত ছাড়ে না। ইশ কতদিন পর দেখা। পানিতে ভাসতে ভাসতে অনুরাধার সারা গায়ে শেওলা পড়ে গেছে। তবে তাদের দুটি হাতই এখন সমান উষ্ণ। অনুরাধাও প্রাণবন্ত সেই কিশোরী। মরিয়ম নিজেকে নিজে দেখতে পাচ্ছে না। তার সামনে পেটিকোট-ব্লাউজ ছাড়া খালি একটা শাড়ি পরনে টুকি বেগম …। … পৃথিবীর আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। টুকির চোখে পেছনে ফেলে আসা সেই স্থলাভূমি, যা রক্তিম দিগন্তে মাথার চুলের মতো ভাসছে। অনুরাধা সেদিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, কি সুন্দর আমাদের দেশটা!

টুকির মুখ থেকে আঁচল সরে যায় – যে-দেশের জন্য আমরা শরীরের রক্ত দিছিলাম।’

পাঁচ

মুক্তিযুদ্ধ-আশ্রয়ী উপন্যাস হিসেবে শাহীন আখতারের তালাশ নিঃসন্দেহে স্বতন্ত্র ও অনন্য। উপন্যাসের কাহিনিবিন্যাস সুন্দর। উপন্যাসে প্রধানত দুটো পর্ব। দুটি পর্বের প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে তিনি একটা শিরোনাম দিয়েছেন, যা পাঠককে গল্পের ভেতর ঢোকার পথটা খুব সহজ করে দিয়েছে। উপন্যাসের সময়টাকেও লেখক ভাগ করেছেন সেই শিরোনাম দিয়ে। যেমন – ‘জলাভূমির গোলকধাঁধা’ অধ্যায়কে মরিয়মের জীবন তথা উপন্যাসের ভূমিকা হিসেবে ভাবা যায়। যদিও এর পরবর্তী অধ্যায়ের নামই ‘মরিয়ম ওরফে মেরীর জীবন কথা’। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অধ্যায় দিয়ে বোঝা যায়, লেখক ২৫শে মার্চ কালরাত দিয়ে একটা যুদ্ধের ভেতর ঢুকছেন। তারপর একেকটা অধ্যায়ের একেকটা শিরোনাম দিয়ে লেখক যুদ্ধের সময়কালকে ভাগ করেছেন। ‘অন্তর্বাস, শাড়ি ও সতীত্ব’, ‘অনুরাধার ডায়েরি’, ‘লাল গোলাপ, ‘সিল্ক শাড়ি ও ধবধবে শাদা বিছানা’ বা আরো বেশ কিছু অধ্যায় দিয়ে লেখক মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্পে বীরাঙ্গনাদের দুঃসহ জীবনের চিত্র তুলে ধরেছেন। আবার ‘যোদ্ধা’, ‘উদ্ধার পর্ব’ বা আরো কিছু অধ্যায়ে মরিয়মের ছোট ভাই মন্টু ও মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের ঘটনা উঠে এসেছে।

উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব যুদ্ধের পরবর্তী স্বাধীন দেশের গল্প। এই গল্পের ব্যাপ্তি আটাশ থেকে ত্রিশ বছর। এখানেও লেখক একেকটা অধ্যায়ের একেকটা শিরোনাম দিয়ে পাঠককে সরাসরি গল্পের ভেতর নিয়ে গেছেন। ‘একটি আদর্শ জাদুঘর’ শিরোনামের অধ্যায় দিয়ে উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বের শুরু। ‘পেটকাটা মানুষ ও জাগ্রত যুবসমাজ’, ‘পিতাপুত্র’ বা আরো কিছু অধ্যায়ে যুদ্ধ-পরবর্তী অস্থির সময় উঠে এসেছে। লেখক এই অস্থির সময়ের বর্ণনায় অদ্ভুত রকম নির্মোহ ও নিরপেক্ষ ছিলেন। ‘ফেরা’, ‘স্বর্ণযুগ’, ‘মা-মেয়ে টেইলারিং’সহ আরো কিছু অধ্যায় শুধুই যুদ্ধোত্তর সময়ে মরিয়মের গল্প। আবার ‘রাধারানী একপ্রকার ভালো আছে’, ‘আরেকটি গণআদালত না হয় মুক্তিযুদ্ধ’ বা আরো কিছু অধ্যায়ে লেখক মরিয়মকে একটা স্থিতিতে নিয়ে যান। জীবনের স্থিতি। কিন্তু ‘জীবনের শেষ কোথায়’ বা ‘তালাশ’ অধ্যায়েই লেখক মরিয়ম ওরফে মেরীকে একটা পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যান।

ছয়

শাহীন আখতার তালাশ উপন্যাসে মরিয়মকে কেন্দ্র করে পুরুষ চরিত্রগুলি সামনে নিয়ে এসেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা-উত্তর সময় তো আছেই, দেশ স্বাধীনের পর আরো আটাশ-ঊনত্রিশ বছর লেখক কাহিনি টেনে নিয়েছেন। এখানে মন্টু চরিত্রের কথা না বললেই নয়। মরিয়মের ছোট ভাই। একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। কিন্তু লেখক তাঁর চরিত্রটি কেন জানি খুব একটা টেনে নিয়ে যাননি। এমনকি গবেষক মুক্তির চরিত্রটিও। কেন টেনে নেননি, তা লেখকই বলতে পারবেন। তবে আমার মনে হয়, তিনি বীরাঙ্গনাদের চরিত্রগুলির বিস্তৃত বর্ণনার গুরুত্ব দিতে গিয়ে এমনটা করেছেন।

সাত 

উপন্যাসের ভাষা চমৎকার, বুননও। উপন্যাসের বুনন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণ কাহিনি নিয়ে লিখেও একটা উপন্যাস বুননের কারণে যুগোত্তীর্ণ হয়। শাহীন আখতার তালাশ উপন্যাসে অসাধারণ কিছু মানুষের গল্প বলেছেন। যে মানুষগুলির আত্মত্যাগে আমরা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি।

তালাশ উপন্যাসে আমাকে যা সবচেয়ে আকর্ষণ করেছে তা হলো, ভাষার ব্যবহার ও বর্ণনার বৈচিত্র্য। স্থানে স্থানে প্রকৃতির বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক এমন কিছু উপমা ব্যবহার করেছেন, যা মোহিত করেছে। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারিনি, লেখক উপন্যাসের বর্ণনায় হঠাৎ হঠাৎ ইংরেজি শব্দ কেন ব্যবহার করেছেন, যেখানে তিনি যথার্থ বাংলা শব্দই ব্যবহার করতে পারতেন। চরিত্রের সংলাপে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার তেমন অসংগত মনে হয় না। ভাষা-বর্ণনায়? মাঝেমধ্যে তিনি ভাষা ও বর্ণনায় এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন যে তা ঘটনাকে ছাপিয়ে গেছে। কখনো কখনো কাহিনিকেও এলোমেলো করে দিয়েছে। তিনি এসবে আরেকটু পরিমিতিবোধ দেখাতে পারতেন।  

তবে সব মিলিয়ে আমার মনে হয়, শাহীন আখতারের তালাশ উপন্যাস একটি অসাধারণ আখ্যান। আমাদের বীরাঙ্গনাদের অনাবিষ্কৃত কাহিনি তিনি খুব সুচারুভাবে তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাস মুক্তিযুদ্ধ ও বীরাঙ্গনাদের আখ্যান হিসেবে বাংলা উপন্যাসে একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হিসিবে গণ্য হবে বলে আশা করি।