জলের অক্ষরে লেখা

পর্ব : ৫

ডিনারের পর অবন্তি যখন গভীর মনোযোগ দিয়ে ঋভুর সংগ্রহ করা ছবিগুলো দেখছিল আর ঋভু গিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়েছিল, অংশু দূরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্যটির দিকে কতক্ষণ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল। ঋভু ফিসফিস করে কথা বলছিল আর অবন্তি কান নামিয়ে এনেছিল ওর কাছে। কী সুন্দর একটা দৃশ্য, কী দারুণ মানানসই একটা জুটি! কেন যে ওরা জুটি বাঁধলো না, আশ্চর্য! ওদেরকে একটু নিজের মতো করে থাকতে দেওয়া দরকার, এই বিবেচনায় অংশু ফিরে গেল ব্যালকনিতে। এই মাত্র ভরপেট খেয়ে এসেছে, তবু বোতল থেকে এক পেগ পানীয় ঢেলে নিল গ্লাসে। বাইরে মন খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো সুন্দর আবহাওয়া। মনোরম, মায়াময়, তবু কেমন যেন বিষণ্ন। বৃষ্টি ঝরছে ঝিরিঝিরি, শীতল একটা হাওয়া বইছে। জুনের গা-পোড়ানো গরম ছিল কয়েকদিন আগেও, বাইরে বেরুলে শরীর জ¦লে যেত, অথচ এখন এই শীতল হাওয়া এতই আরামদায়ক লাগছে যে মনে হচ্ছে, মায়ের আদর-স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে সে, প্রশান্ত হয়ে উঠছে শরীর-মন। ভেজা গাছের পাতাগুলোতে আলোছায়ার বিবিধ নকশা – বনভূমির ভেতর দিয়ে জোৎস্নাপ্লাবিত রাতে হেঁটে যেতে যেতে যেরকম দৃশ্য দেখা যায়, সেরকম। ধীরে ধীরে চুমুক দিতে দিতে অংশু ভাবছিল, এই শহরের অনেক বদনাম – এতো ভিড়, এতো শব্দ, এতো কোলাহল, এতো দূষণ! তবু এই শহর অনেক সময়ই অসামান্য সুন্দর সব নৈসর্গিক দৃশ্য উপহার দেয় – নিসর্গ তো সবসময়ই উদার, উপহারপ্রবণ। কিন্তু সেগুলো দেখার জন্য একা হতে হয়, গভীরভাবে তাকানোর মতো চোখ আর মন থাকতে হয়।

নিজেদের মতো কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে, দীর্ঘ-প্রতিক্ষিত চুম্বন বিনিময় করে ঋভু আর অবন্তি ব্যালকনিতে ফিরে এলে অংশুর ধ্যান ভেঙে গেল, হেসে বললো – তোদের আসতে দেরি দেখে আমি আরেক পেগ মেরে দিয়েছি।

বেশ করেছিস! – বললো ঋভু।

ডিনারের পর কেউ ড্রিংক করে, জীবনে এই প্রথম দেখলাম। – অবন্তি ফোড়ন কাটলো।

যে পারে সে সবসময়ই পারে। তুই নিবি নাকি আরেক রাউন্ড?

না। চল, বেরুবো এখন।

আহা, আরেকটু বস না। তুই না খেলি, আমরা একটু খাই।

তুমিও খাবে? – অবন্তি জিজ্ঞেস করলো ঋভুকে।

তুমি অনুমতি দিলে …

ও বাব্বা! এখনই অনুমতি লাগছে! ক’দিন পর না নিষেধাজ্ঞা জারি হয়! – এবার ফোড়ন কাটতে ছাড়লো না অংশু।

কথাবার্তা কোনদিকে যাচ্ছে পরিষ্কার বুঝতে পারলো অবন্তি, বললো – এই তুই থাম। আরেক পেগ গলায় ঢেলে চল। হাভাতে কোথাকার!

থাক। খেলাম না। এতো কটূকথা শুনে আর খাওয়ার ইচ্ছা নাই।

ওরে আমার সোনা রে! লাগ কলেছ! খাও বাবু, খাও!

ইস! তোর মুখে কথাটা কী যে সুন্দর শোনালো! আবার বল না! মারবো এক থাপ্পড়। উঠবি নাকি বসবি বল?

উঠছি – বলে আরেক পেগ গ্লাসে ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে বললো – চল যাই।

কালকের প্রোগ্রাম কী?

সকালে ঠিক করবো। বাসায় বসার সিদ্ধান্তটা খুব ভালো ছিল রে ঋভু। ক্লাবে বসলে এরকম অদ্ভুত একটা পরিবেশ মিস করতাম। থ্যাংকস।

বিদায় নিয়ে বেরুলো তারা। ঋভু নিচে নামলো না। দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখলো। গেটের কাছে গিয়ে দুজনেই হাত নেড়ে বিদায় জানালো ওকে।

রাস্তা ভেজা, নির্জন, ফাঁকা। বৃষ্টিভেজা রাস্তায় নিয়নবাতির আলোয় অদ্ভুত মায়াময় এক আভা খেলা করছে।

অবন্তি বললো, গ্লাসটা নামিয়ে দে অংশু। বাইরের বাতাসটা সুন্দর।

হ্যাঁ, দিচ্ছি।

নিঃশব্দে গাড়ি চালাচ্ছিল অংশু। এতো চুপচাপ সাধারণত থাকে না সে। বেশ অনেকক্ষণ পর বললো – অবন্তি, তোকে একটা কথা বলবো?

অনুমতি নিচ্ছিস যে!

এ-কথা অনুমতি ছাড়া বলা যায় না।

আচ্ছা বল।

জীবনটা তোরই, সিদ্ধান্তও তোর। আমি কেবল বন্ধু হিসেবে বলতে পারি, তুই আর ফিরে যাস না।

দেশেই থাকতে বলছিস?

হুঁ।

কেন?

ঋভুকে বিয়ে করে ফ্যাল তুই।

বিয়ের জন্য দেশে থাকবো?

না। বিয়ে করে দেশে থাকবি।

একই তো কথা হলো।

না, একই হলো না। ঝামেলা করিস না। তুই ঠিকই বুঝেছিস। বিয়ের জন্য দেশে আসিসনি তুই, বিয়ে করেছিস বলে দেশে রয়ে যাচ্ছিস।

এমনভাবে বলছিস যেন তুই ঋভুর সঙ্গে আলাপ-টালাপ করে সব ঠিক করে রেখেছিস!

না, আলাপ করিনি। ইয়ার্কি করেছি, সিরিয়াসলি কিছু বলিনি।

তাহলে বলছিস কেন, বিয়ে করে ফ্যাল! ওর যদি ইচ্ছে না থাকে?

আমার ধারণা ওর ইচ্ছে আছে। না থাকলেও ইচ্ছে তৈরি হবে।

কী দেখে তোর মনে হলো?

তা তোকে বলবো না। তবে আমার চোখ ভুল দেখে না।

এতো শিওর?

হ্যাঁ।

এসব তোর কল্পনা।

আমার কাজই তো কল্পনার। শূন্য জায়গার মধ্যে আমি একটা স্ট্রাকচার কল্পনা করি। নইলে কি ডিজাইন করতে পারতাম?

তা ঠিক। আর্কিটেক্টদের আমার ঈর্ষা হয়। কী করে পারিস বল তো?

প্রসঙ্গ পাল্টাস না।

আচ্ছা পাল্টাবো না। বল, কী বলবি।

তুই রাজি?

এখনই বলতে পারছি না।

কেন?

দেশে সেটল করার মতো কোনো প্রস্তুতি আমার নেই।

কিসের প্রস্তুতির কথা বলছিস?

সব প্রস্তুতিই। এই বয়সে এখানে এসে মনের মতো চাকরি পাবো?

তা পাবি।

যদি না পাই?

না পেলে করবি না।

তাহলে কী করবো?

বিয়ে করে সংসার করবি, বাচ্চাকাচ্চা বড়ো করবি। কত মেয়ে করছে না?

সেই মানসিক প্রস্তুতি যে আমার নেই!

প্রস্তুতি নিতে কতক্ষণ?

এতো সহজ নারে ব্যাপারটা। আমি দীর্ঘদিন সংসারের বাইরে। একা থাকি। নিয়ম-টিয়ম মানি না। ইচ্ছে হলে খাই, না হলে খাই না। এরকমই অভ্যাস হয়ে গেছে।

সবটাই তো অভ্যাস। অভ্যাস কি পাল্টানো যায় না?

যায়। তবে কঠিন। হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। আর তাছাড়া …

তাছাড়া?

ঋভুকে নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। ওর মধ্যে আশ্চর্য এক উদাসীনতা আছে। আজকে কী হলো কালকে তা ভুলে যাবে। তোর যে মনে হচ্ছে, ও বিয়েতে রাজি হবে, সেটা হয়তো এখন দেখে মনে হচ্ছে। কালকে দেখে মনে নাও হতে পারে।

হ্যাঁ, স্বীকার করছি, ও একটু আনপ্রেডিক্টেবল। আমি কি ওর সঙ্গে কথা বলবো?

বলতে পারিস। কিন্তু আমার সঙ্গে এ-বিষয়ে তোর কথা হয়েছে সেটা বলা যাবে না।

আচ্ছা।

আরেকটা কথা। তুই তো আমাকে দেশে থাকতে বললি, ওকে একবার বলে দেখিস তো, আমার সঙ্গে বাইরে গিয়ে থাকতে রাজি হবে কি না!

হবে না।

কীভাবে বুঝলি?

ঋভু দেশ ছেড়ে থাকতে পারে না।

তাহলে আমি কেন ওর জন্য সব ছেড়ে আসবো?

এটা তো ইগোর কথা হলো। এরকম ইগো থাকলে বিয়েটিয়ে হবে না।

ইগো হবে কেন? প্রশ্নটা কি যৌক্তিক না?

যৌক্তিক। কিন্তু ইগোসেন্ট্রিক।

আচ্ছা, মানলাম। ওকে একটু জিজ্ঞেস করিস।

আচ্ছা করবো।

আর হ্যাঁ। যদি সত্যিই ফিরে আসি, চাকরি খুঁজে দেওয়ার দায়িত্বটা তোর। আমি ঘরে বসে থাকতে পারবো না।

আচ্ছা। ওটা দেখা যাবে।

দেখা যাবে বললে হবে না।

আগে সিদ্ধান্ত নে। চাকরি কোনো ব্যাপার না।

কত সহজেই বলে ফেললি! এই দেশে তুই এখন বেশ প্রভাবশালী মানুষ, বোঝা যাচ্ছে।

অংশু কোনো কথা বললো না। তার মুখ গম্ভীর। যেন কিছু নিয়ে খুব গভীরভাবে চিন্তা করছে। ফাঁকা রাস্তা, তবু গতি বেশি তোলেনি অংশু। হুহু করে হাওয়া বইছে, জানালা খোলা বলে দুজনেরই চুল উড়ছে হাওয়ায়। কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছে শহরটাকে। কে বলবে, দিনের বেলায় এই শহরে কোটিখানেক লোক চলাফেরা করে? অবন্তি বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। এই কুড়ি বছরে অনেক বেশি বদলে গেছে শহরটা। সবুজের পরিমাণ কমেছে, বেড়েছে কংক্রিটের জঞ্জাল। অনেক বড়ো বড়ো অট্টালিকা, নতুন নতুন রাস্তা, প্রচুর শপিংমল এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ চোখে পড়ে এখন। মানুষও বেড়েছে অনেক। দিনের বেলায় কেবল গিজগিজ মানুষের ভিড় দেখা যায়। বাইরে বেরোতে ভয় লাগে। এরকম শহরে বসবাস করাই তো কঠিন। অথচ তার ছোটবেলায় ছিমছাম এক শহর ছিল এটা। এতো গাড়িও দেখা যেত না তখন, ভিআইপি সড়ক বলতে কিছু ছিল না, রিকশায় করে সারাশহর ঘুরে বেড়ানো যেত। সারা শহরে গাছ ছিল – রাস্তার পাশে, আইল্যান্ডে, বাসাবাড়িতে। একটা মায়া-মায়া ছায়া-ছায়া ভাব ছিল। এমনকি যখন সে দেশ ছেড়েছিল তখনো এতো ব্যস্ত ছিল না এই শহর। আর এখন, কী শ্রীহীন হয়ে উঠেছে! সবুজের চিহ্ন নেই অধিকাংশ জায়গায়, শহরজুড়ে কেবল নির্মাণযজ্ঞ আর বিকট শব্দ। কিন্তু মানুষ নির্বিকার! কীভাবে পারে মানুষ এতো রয়েসয়ে থাকতে? কিন্তু এই বর্ষণমুখর গভীর রাতে, বৃষ্টিভেজা নির্জন রাস্তায়, হুহু করে বয়ে চলা শীত-শীত হাওয়ার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে মনে হচ্ছে, এই শহরে কোনো গ্লানি নেই, বেদনা নেই, কোথাও কোনো কালো দাগ লেগে নেই।    

কতক্ষণ কেটেছিল এইসব ভাবতে ভাবতে সে জানে না। হঠাৎই অংশু ডাকলো – তোর ফেরার টিকিট যেন কবে?

এই তো আর দিন দশেক।

খুব বেশি সময় নেই। এর মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সিদ্ধান্ত নিলেও তো আমাকে ফিরতেই হবে।

কেন?

আমি তো ছুটি নিয়ে এসেছি, কিছুই গুছিয়ে আসিনি। বাংলাদেশে যদি থাকতেই হয় তাহলে তো ওখানকার চ্যাপ্টার ক্লোজ করে আসতে হবে।

হুম। তা ঠিক। আচ্ছা, দেখা যাক। তুই ভাবতে থাক। আমিও ঋভুর সঙ্গে কথা বলে দেখি।

পৌঁছে গেল তারা। রাত প্রায় দেড়টা এখন, সঙ্গত কারণেই সব নিঝুম। তবে ভাবি বোধহয় জেগেই ছিল, দরজা খুলে বললো, তোমার ভাই এতোক্ষণ জেগেই ছিল। ভাগ্যিস ঘুমিয়ে পড়েছে, নইলে আজ বকা খেতে।

নিজের ঘরে যেতে যেতে অবন্তি বললো – কেন, বকা খাওয়ার মতো কী করেছি?

ভাবিও এলো পিছে পিছে, বললো – এই যে এতো রাত করে বাড়ি ফিরছো!

খিলখিল করে হেসে উঠলো অবন্তি, বললো – বকাটা খেলে মন্দ হতো না। কতদিন কেউ বকে না!

আফসোস করো না। আজকে বকা জমিয়ে রেখে ঘুমিয়েছে, তার মানে কালকে বকবে।

আবার হেসে উঠলো অবন্তি।

হাসছো কেন?

মজা লাগছে ভাবি। মনে হচ্ছে, আমি সেই ছোট্ট মেয়েটিই রয়ে গেছি।

বড়ো হয়েছ নাকি?

না ভাবি, তোমাদের কাছে বড়ো হইনি, নিজের কাছে হয়েছি। অনেক চড়াই-উতরাই তো পার হয়ে এলাম। বিদেশে এতো বছর ধরে একা একা থাকি। সেখানে দিনই কি, রাতই কি! কোথায় গেলাম, কী করলাম, কখন ফিরলাম – এসব দেখার কেউ নেই তো!

কেন যে একা থাকার জীবন বেছে নিলে!

সংসার করার চেষ্টা করেছিলাম ভাবি, জানোই তো। হলো না।

হুম। তোমার সঙ্গে তো গল্পই হয় না। কী হয়েছিল আজো জানা হয়নি।

ওসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না।

ঠিক আছে, বলতে হবে না। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার অন্য একটা বিষয় নিয়ে আলাপ আছে।

কী ব্যাপার বলো তো?

এখন বলবো? মাত্র তো এলে। ফ্রেশ হয়ে নাও। খাবে তো!

না, খাবো না। খেয়ে এসেছি। এখনই বলো, অসুবিধা নেই। নাকি ঘুম পাচ্ছে তোমার? রাত তো অনেক হলো।

না, ঘুম পায়নি। রাত জাগার অভ্যাস হয়ে গেছে।

এই অভ্যাসটা হলো কী করে বলো তো!

শহরটাই পাল্টে গেছে অবন্তি। আগে আমরা এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তাম, এখন কোনো বাসায় কেউই এতো তাড়াতাড়ি ঘুমায় না।

কিন্তু কেন?

জানি না কেন! হয়তো লাইফস্টাইল পাল্টেছে। আমাদের সময় তো সন্ধ্যা হলেই বাড়ি ফেরার নিয়ম ছিল। এখন ছেলেরা সন্ধ্যায় বাইরে বেরোয়, ফেরেই এগারোটার পর। তারপর খাওয়া-দাওয়া। এ-দেশে আবার মধ্যরাতে টিভিতে টক শো হয়। তোমার ভাই বসে বসে দুই দলের ঝগড়াঝাঁটি দ্যাখে। এখন অবশ্য আর দুই দল নেই। সবাই একদল। তাও দ্যাখে। রাত একটা বেজে যায় এমনিতেই।

আজব! এসবের কোনো দরকার আছে? ঘুমানোর আগে ঝগড়াঝাঁটি দেখার কী হলো? মাথা গরম হয়ে যায় না? ঘুম হয়?

আল্লায় জানে, কী মজা পায়!

বাদ দাও। কী বলতে চেয়েছিলে, বলো।

হ্যাঁ। বিষয়টা জমিজমা সংক্রান্ত। তোমার ভাই তোমার সঙ্গে আলাপ করবে, কিন্তু তার আগে আমার কিছু কথা আছে।

জমিজমা! ওগুলোর আমি কী বুঝি?

না বুঝলেও শুনতে হবে।

আচ্ছা বলো।

এই বাড়িটা তো বাবার নামে। গ্রামের বাড়ি, জমিজমাও। তোমাদের মধ্যে এখনো ভাগ হয়নি। তোমার ভাই প্রায়ই বলে, আমার তো বয়স হয়ে যাচ্ছে, যার যার অংশ তাকে বুঝিয়ে দিতে পারলে বাঁচি।

ভাইয়ার এরকম মনে হওয়ার কারণ কী? মেজো ভাইয়া কোনো সমস্যা করছে? নাকি ছোট ভাইয়া?

আরে না। সমস্যা না। কিন্তু সবারই তো আলাদা জীবন, সংসার, বাচ্চাকাচ্চা। ভাগবাটোয়ারা হয়ে যাওয়াই ভালো না?

হ্যাঁ, তা ভালো। কিন্তু ছোট ভাইয়া বেরুবে কবে?

এই তো, ওর সাজার মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সম্ভবত বছরখানেকের মধ্যে ছাড়া পাবে।

হুম। ওর বউ-বাচ্চারা?

আছে। বাচ্চারা তো বড়োই হয়ে গেল। পনেরো বছর তো আর কম কথা নয়!

ওদেরকে এতোদিন ধরে দেখাশোনা কে করেছে?

তোমার ভাইয়ারাই করেছে।

হুম। তা তুমি কী বলতে চেয়েছিলে?

আমার বলার কথা হলো, নিয়মমাফিক তোমার যা পাওয়ার কথা, তুমি সেই অংশ ছেড়ো না।

কিন্তু আমি জমিজমা দিয়ে কী করবো? এই বাড়ির অংশ দিয়েই বা কী করবো?

কী করবে সেটা পরের ব্যাপার। কিন্তু নিজের অধিকার ছেড়ো না।

আমি অধিকার না ছাড়লে তোমার কী লাভ ভাবি? ছেড়ে দিলেই তো লাভ, তোমরা ভাগে বেশি পাবে।

জানতাম এই প্রশ্নটা তোমার মনে আসবে, কিন্তু তুমি চেপে যাবে। তা না করে যে প্রশ্নটা করেছ সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ।

বারে! প্রশ্ন মনে এলে চেপে যাবো কেন?

সবাই যায়। ভাবে, কোনো দুরভিসন্ধি আছে আমার।

না, আমি তা ভাবছি না। সত্যিই আমি বুঝতে পারছি না, তুমি কেন এমন চাইছ!

আমার লাভ আছে, তবে অন্যভাবে।

কীভাবে?

আমার ভাইয়েরা পৈতৃক সম্পত্তির অংশ আমাকে দিতে চায় না। এ নিয়ে কথা তুললেই খোঁটা দিয়ে বলে, তোর ননদকে তোরা দিয়েছিস?

ও তাই বলো! আমি নিলে তুমি ভাইদের বলতে পারো, হ্যাঁ দিয়েছি।

হ্যাঁ।

নিজের অংশটাও বুঝে নিতে পারো।

হ্যাঁ।

আচ্ছা ভাবি, এসব দিয়ে কী হয়?

কোন সব দিয়ে?

এই যে এতো সম্পত্তি, টাকা-পয়সা, জমিজমা …

এটা একটা কথা হলো? ছেলেমেয়েরা আছে না? ওদের জন্য কিছু রেখে যেতে হবে না?

না রেখে গেলে কী হবে? ওরা নিজেরা করে নিতে পারবে না?

পারবে, কিন্তু কষ্ট হবে। আবার না-ও পারতে পারে।

কেন মনে হচ্ছে যে, না-ও পারতে পারে?

আচ্ছা বলো তো, এই বাড়িটা যদি বাবা তোমাদের জন্য না রেখে যেতেন তাহলে কি তোমরা এতোটুকু ওপরে উঠতে পারতে? সংসারের ঘানি টানতে টানতেই তো জীবন শেষ হয়ে যেত।

খুব কি ওপরে উঠেছি আমরা?

উঠেছ। তোমরা ভাইয়ারা যথেষ্ট উঁচুতে পৌঁছেছে। তারচেয়ে বড়ো কথা, সৎভাবে জীবনযাপন করতে পেরেছে। তুলনামূলক নিশ্চিন্তে জীবন কেটেছে। একজন সাধারণ মানুষ তো এটুকুই চায় জীবনের কাছ থেকে।

কিন্তু এক ভাই তো জেলে পচছে …

সেটা তো ওর ভুলে। বেশি উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল ওর। নইলে কেউ এরকম ব্যবসায় জড়ায়?

বোঝেনি হয়তো।

তা হতে পারে। কিন্তু পার্টনারদের চরিত্র না জেনে, ব্যবসার ধরন না বুঝে এসবের মধ্যে ওর জড়ানোই উচিত হয়নি। ধরা পড়লো ও একা। ওর পার্টনাররা কিন্তু বহাল তবিয়তে আছে।

কিন্তু ওর ব্যবসা করার ভূত চেপেছিল কেন বলো তো? তোমরা নিষেধ করোনি?

করেছি। শোনেনি। তখন দেশে অনেক মানুষ চোখের পলকে বড়লোক হয়ে যাচ্ছিল, এখনো হচ্ছে, এসব দেখে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেনি। ওরও বড়লোক হওয়ার জেদ চেপেছিল।

ব্যবসা তো অনেকেই করে কিন্তু সবাই তো জেলে যায় না।

হ্যাঁ, যাদের বুদ্ধি আছে তারা যায় না। এদেশে কজন বড়লোকই বা সৎপথে ধনসম্পত্তি বানিয়েছে! বেশিরভাগই তো চুরিচামারি করে। কিন্তু ধরা পড়েছে কজন?

ভাবি, তুমি অনেক বুদ্ধিমতি। অনেক কিছু ভাবো, জানো, বোঝো। আমি এতোটা ভাবিনি।

না অবন্তি, আমার অতো বুদ্ধি নেই। আমি কেবল কয়েকটা অপশন থেকে একটা বেছে নিয়েছি।

মানে?

মানে … জীবন তো সবাইকে কতগুলো অপশন দেয়, তাই না?

হ্যাঁ, তা দেয়।

আমাকেও দিয়েছিল। যেমন তোমার ভাইকে বিয়ে না করে অন্য কাউকে বিয়ে করা। অথবা, গৃহিণীর জীবন বেছে না নিয়ে নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করা …

এটা নিয়ে আমারও প্রশ্ন আছে ভাবি। তুমি কেন ক্যারিয়ারের দিকে গেলে না? কেন গৃহিণীর জীবন বেছে নিলে?

আমার ভালো লাগে তাই।

শুধু এটুকুই?

এটুকু কি যথেষ্ট না?

যথেষ্ট। কিন্তু আমি জানতে চাইছি, অন্য কোনো কারণ ছিল কি না!

তোমাকে একটা উদাহরণ দিই। মেজোর কথাই ধরো …

মেজো ভাইয়া না ভাবি?

দুজনের কথাই বলছি।

তুমি এখনো মেজোই ডাকো নাকি?

হ্যাঁ। মেজো, ছোট …

মজার তো! ওরাও বড়ো হয়নি!

আমি যখন বউ হয়ে আসি, তখন তোমরা কত ছোট! এখন তোমরা যদি বড়ো হয়ে থাকো, আমি তো তাহলে বুড়ি হয়ে গেছি!

অতো ছোট ছিলাম না কিন্তু ভাবি।

ছোটই। তুমি তখন স্কুলে পড়ো, ছোট পড়ে কলেজে, মেজো পড়ে ইউনিভার্সিটিতে। সবাই আমার বয়সে ছোট, সম্পর্কেও ছোট। কী যে খুশি হয়েছিলাম দেবর-ননদ পেয়ে!

তুমি একটু অন্যরকম ভাবি। সবাই খুশি হয় না।

যেসব পরিবারে অভাব থাকে সেসব পরিবারের বউরা এসে এতো মানুষ দেখলে খুশি হয় না। আমার খুশি না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। বাবা-মা খুবই সুন্দর করে এ-বাড়ি এই সংসার গুছিয়ে রেখেছিলেন। ক্রেডিট আমার না অবন্তি, বাবা-মায়ের।

যদি অভাব থাকতো …

আমিও স্বার্থপর হতাম। তোমার ভাইকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম।

হা-হা-হা …

হাসছো কেন?

তুমি যে এতো সোজাসাপ্টা কথা বলছো, আমি যদি তোমাকে খারাপ ভাবি?

এতোদিন পর আর কতটুকুই বা খারাপ ভাববে?

না ভাবি। তুমি যতই বলো, সব কথা বিশ^াস করার কারণ নেই। অতো স্বার্থপর হলে আমরা এতো আদর পেতাম না। যাকগে, মেজো ভাইয়ার প্রসঙ্গে কী যেন বলতে চেয়েছিলে …

 দুজনই সরকারি কর্মকর্তা। একেক সময় একেক জায়গায় পোস্টিং হয় কিন্তু কখনোই একই জেলায় পোস্টিং হয় না।

কেন?

হবে কী করে? দুজন তো একই ক্যাডারের।

ও! একই ক্যাডারের হলে এক জেলায় পোস্টিং হয় না?

কোনো নিয়ম আছে কি না জানি না। কিন্তু ওদের কখনো হয়নি।

আচ্ছা!

তো, দুজন থাকে দুই জেলায়। ছুটি পেলে একজন যায় আরেকজনের কাছে। ছেলেমেয়েরা কিছুদিন মায়ের কাছে থাকে কিছুদিন বাবার কাছে। এটা কোনো জীবন হলো, বলো?

ওরা ঢাকায় পোস্টিং নিতে পারে না?

হয়তো পাবে। মেজো বোধহয় এ-বছরই পাবে। বউয়ের পেতে আরো দু-এক বছর দেরি হবে।

কিন্তু এই উদাহরণ তো তোমার সামনে ছিল না।

ছিল না, কিন্তু আমি কল্পনা করতাম …

কী কল্পনা করতে?

এই ধরো, যদি আমিও চাকরি করি তাহলে আমরা দুজনেই ব্যস্ত হয়ে পড়বো। ছেলেমেয়েরা আমাদের খুব একটা পাবে না। দুজনের চাকরি যে একইরকম হবে তারও নিশ্চয়তা নেই। হয়তো দুজনকে দু-জায়গায় থাকতে হবে … এসব ভাবতে আমার ভালো লাগতো না।

কিন্তু ভাইয়ার সঙ্গে যদি তোমার মিলমিশ না হতো? যদি ভাইয়া খারাপ মানুষ হতো?

ওটা বছরখানেকের মধ্যেই বোঝা যায়। খারাপ হলেও চেনা যায়, ভালো হলেও চেনা যায়। খারাপ লোক হলে তোমার মতোই সিদ্ধান্ত নিতাম।

মানে ছেড়ে চলে যেতে?

অবশ্যই।

তার মানে আমি ভুল করিনি?

নিশ্চয়ই করোনি। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা তুমিই ভালো জানো।

অবন্তির মনে পড়ছিল অপলার কথা। অংশুও একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল। সচেতনভাবে সংসারজীবন বেছে নিয়েছে অপলা। আচ্ছা, বাংলাদেশের শিক্ষিত মেয়েরাও কি একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করে? সংসার কি তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি পায়? সে নিজে তাহলে অন্যরকম কেন?

নাহ, অনেক রাত হলো। খিদে লেগেছে? খাবে কিছু? – ভাবির কথায় সম্বিৎ ফিরলো।

আরে না। এটা খাওয়ার সময় নাকি?

তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো।

তোমার সঙ্গে গল্প করতে কিন্তু বেশ লাগছিল।

গল্প তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছে না। যে-কদিন আছো, আরো গল্প করা যাবে।

মনে থাকে যেন। রোজ রাতে গল্প চাই।

আচ্ছা আচ্ছা। কিন্তু আমার কথাটাও যেন মনে থাকে।

ওই সম্পত্তি?

হ্যাঁ।

আচ্ছা। তোমার কথা রাখবো। যদিও এগুলো দিয়ে আমি করবোটা কী বুঝতে পারছি না।

সেটা পরে ভেবে দেখো। এখন ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

আচ্ছা। গুড নাইট।

যাওয়ার আগে ভাবি প্রায় আকস্মিকভাবে অবন্তির মুখটা দু-হাতে ধরে কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো – গুড নাইট অবন্তি সোনা। হ্যাভ আ নাইস ড্রিম।

অবন্তি হচকচিয়ে গিয়েছিল। এমন নয় যে এই প্রথম ভাবি চুমু খেলো, আদর করে চুমু সে অনেকবারই দিয়েছে। কিন্তু সেটা তো সেই সুদূর ছোটবেলায়। কতকাল পর কেউ তাকে স্নেহের চুমু এঁকে দিলো কপালে। কান্না পেল তার। মায়ের কথা মনে পড়লো। বাবার কথা মনে পড়লো। সে ছিল তিন ভাইয়ের এক বোন, সবার ছোট, সবার আদরের। এইসব স্নেহ-ভালোবাসা-আদর ছেড়ে স্বেচ্ছায় সে দূরে চলে গিয়েছিল। কেন? একটা প্রধান কারণ ছিল ঋভু। ওর সেই ব্যাখ্যাহীন উদাসীনতার শাস্তি দেওয়ার জেদ চেপেছিল মনে। কিন্তু সেটা কি এতোই বড় ব্যাপার ছিল যে সব ছেড়ে চলে যেতে হবে? আর গেলেই কি চিরদিনের জন্য যেতে হবে? পড়াশোনার জন্য বাইরে যাওয়ার স্বপ্ন তার বরাবরই র্ছিল। সে গিয়েছিল পড়তেই। কিন্তু তারপর তো ফিরে আসা যেত। জেদ করেই তো সে বিয়ে করেছিল জামিলকে! হ্যাঁ, জেদই, ঋভুর ওপর জেদ। ভালোবাসা ছিল না জামিলের জন্য। ভুলটা ওখানেই হয়েছে। পরেও আর ভালোবাসতে পারেনি। বেছে নিয়েছে এক উন্মূল জীবন। এর কোনো মানে হয়?

বাইরে বোধহয় বৃষ্টি বেড়েছে। জানালার পর্দা সরিয়ে সøাইড খুলে দিলো অবন্তি। বাংলাদেশের বৃষ্টির মতো এতো আশ্চর্য সুন্দর বৃষ্টিপাত আর দেখেনি কোথাও সে। কেমন যেন মন কেমন করা, কেমন উদাসীন, ছন্দময়, নিঃসঙ্গ বৃষ্টিপাত। আর কী অদ্ভুত ব্যাপার, সে এখানে আসার পর থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। যেদিন এসে পৌঁছেছিল, এয়ারপোর্টের বাইরে এসেই চমকে উঠেছিল। এতো গরম! সে সইবে কেমন করে? তখন মনে পড়েছিল, সে তো গরমকালেই এসেছে। মে-জুন-জুলাই-আগস্ট জুড়েই বাংলাদেশে গরম থাকে। কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় ফেরার পথেই বৃষ্টি নামলো মুষলধারায়, শীতল হয়ে গেল আবহাওয়া। কী সৌভাগ্য তার!

জানালা ধরে দাঁড়িয়ে দূরে তাকিয়ে রইলো সে। বৃষ্টির ছাঁট আসছে। আসুক। ভিজিয়ে দিক তাকে। সবরকম ভাবালুতা সে বাদ দিয়েছে বহুদিন আগেই, বৃষ্টি এসে তার চোখের জল ঢেকে দিক। সে নিজের চোখের জল নিজেকেও দেখাতে চায় না। কোনো অনুতাপ নেই তার, কোনো দুঃখ নেই, কোনো খেদ নেই। এই জীবন তার বেছে নেওয়া। হ্যাঁ, একান্ত তারই। কেউ জোর করেনি। কোনো অনুতাপ নেই … নেই। (চলবে)