জাতির বিবেক : আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

বাংলাদেশে আজ পত্রিকার পাঠক/পাঠিকা এমন কেউ আছেন কি না, – গত অর্ধশত বছরের পত্রিকা-পড়ুয়াদের মধ্যে এমন কেউ ছিলেন কি না, – ১৯৪৮ সাল থেকে বাঙালির জাতীয়তাবাদের উৎসের কথা যাঁরা জানেন, তাঁদের মধ্যে এমন কেউ রয়েছেন কি না – যিনি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নাম জানেন না, তা বলা দুষ্কর। বরাবরই তাঁর সমালোচক ও নিন্দুক ছিলেন – তবে শেষ অবধি তাঁর গুণমুগ্ধের সংখ্যা বেসুমার, – অগণিত। 

নিজের প্রতিভা, লেখনী, চিন্তা-চেতনা, স্মৃতিক্ষমতা, নীতি ও মানবতা খাটিয়ে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী নিজেকে বাঙালি জাতির এক অনন্য বিবেকে উন্নীত করেছিলেন। সাহিত্য দিয়ে তাঁর অভাবনীয় যাত্রা শুরু হলেও, কলাম লিখে তিনি জনপ্রিয়তার শিখরে উঠলেও, তাঁর আবেদন দুটোকেই ছাড়িয়ে গেছে। বটবৃক্ষতুল্য এই মানুষটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ১৯৬৩ সালে ঢাকায় (অধুনালুপ্ত) দৈনিক জেহাদ পত্রিকায়। তাঁর সঙ্গে আমার শেষ যোগাযোগ হয় টেলিফোনে, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে (এপ্রিল ২০২২)। তিনি বৃহত্তর লন্ডনের উত্তর প্রান্তে আর আমি এই মহানগরীর দক্ষিণ প্রান্তে। গুরু-শিষ্যের মধ্যে প্রায় ৫৯ বছরের যোগাযোগ। [১৯শে মে ২০২২] তাঁর চিরবিদায়ের পরে-পরেই তাঁকে  নিয়ে লিখতে বসা আমার জন্যে যে কতটা হৃদয়বিদারক তা বলে বোঝাতে পারবো না। তবে যা করণীয় তা তো করতেই হয়।

আজ আমি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর জীবনবৃত্তান্ত লিখছি না; এই রচনা যদ্দিনে কালি ও কলমের পাতায় আলোর মুখ দেখবে তদ্দিনে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা, বেতার-টেলিভিশন ও সামাজিক মাধ্যমে তাঁর মৌলিক জীবন-তথ্যগুলো প্রচারিত হয়ে যাবে। তাছাড়া, নিজের অসংখ্য রচনা, বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারে তিনি নিজে এতো সাবলীলভাবে নিজেকে বর্ণনা করে গেছেন যে, এর তুল্য বিবরণ লেখা কঠিন। আমি কেবল এই অসামান্য বাঙালি ব্যক্তিত্বের আমার-দেখা কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরবার প্রয়াস করছি।  

তাঁর পিতা হাজি ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কংগ্রেসী ও মুসলিম লীগ আন্দোলনে জড়িত; – কমিউনিস্টদের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত যে মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন সেটা ছিল ব্রিটিশ আমলে সংস্কারকৃত ‘নিউ স্কিম’ বলে পরিচিত, যেখানে আধুনিক শিক্ষা দেওয়া হতো। ফলে গোঁড়া নয়, বরং চিরায়ত গ্রামবাংলার একটি অসাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডলে তাঁর শৈশবটি গড়ে উঠেছিল।

জমিদার পরিবারে জন্মালেও, চৌধুরী পদবিটি ছাড়া, আবদুল গাফ্ফারের ছোটবেলায় জমিদারনন্দনের স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না। তাঁদের সামন্ত পরিবারটি ক্ষয়িষ্ণু ছিল বলে কৈশোর উত্তীর্ণ হওয়ার পরেই তাঁকে জীবিকার জন্যে নামতে হয়েছিল। এ নিয়ে তাঁকে কখনো গরিমা বা খেদ – কোনোটাই প্রকাশ করতে শুনিনি। পেশাদার সাংবাদিক হলেও তাঁর আদর্শকে, মুক্তবুদ্ধিকে সহ্য করবেন এবং তাঁকে তাঁর উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেবেন – পত্রিকার এমন সম্পাদক/ মালিকেব অসফল সন্ধানে তিনি একের এক পত্রিকা বদল করেছেন। ঢাকায় থাকাকালে সংসার নির্বাহ করার জন্যে তিনি একটি ছাপাখানাও খুলেছিলেন, যা শেষে টেকেনি। স্বদেশে ও  বিলেতে সংবাদপত্রের ব্যবসার চেষ্টা করেছেন, সফল হতে পারেননি। এই লন্ডনে তাঁর এমন সময় গেছে যে, তিনি বড় মুদি আড়তে চাকরি করে সংসার চালিয়েছেন (তখন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এম আর আখতার মুকুল দর্জির কাজ করতেন)। সৎশ্রমে কোনো কুণ্ঠাবোধ করেননি তিনি। অর্থের বিনিময়ে তিনি লোকের জন্যে বেনামে সাহিত্য রচনা করে দিয়েছেন। মানবজীবনকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে তিনি সুষ্ঠুভাবে বেঁেচ থাকার চেষ্টা করে গেছেন। দারুণ কষ্টের দিনে তিনি একবার বালহ্যামে আমার কাছে এসে পরামর্শ করেছিলেন; তবু দেখেছি তিনি হতাশার কাছে হার মানেননি। উদ্ধারের পথ খুঁজেছেন; এর জন্যে লড়াই করেছেন। কেউ কেউ তাঁকে উপেক্ষা ও তাচ্ছিল্য করেছেন – কেউ কেউ তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলেছেন; কিন্তু তিনি নিজের ওপর বিশ্বাস বা আস্থা কোনোটাই হারাননি। তিনি ছিলেন এক সংশপ্তক।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রতিভা ছোটবেলাতেই লেখালেখিতে মগ্ন ছিল। তিনি কবিতা ও ছোটগল্প লিখতেন, পত্র-পত্রিকায় তাঁর রচনা প্রকাশিত হতো। কালজয়ী কিছু গল্প ছাড়াও একে একে তিনি লেখেন কয়েকটি অনবদ্য উপন্যাস।  তাঁর ৩০টি গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে – চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান, সম্রাটের ছবি, ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা ও বাঙালি না বাংলাদেশী। তিনি পলাশী থেকে ধানমন্ডি, একজন তাহমিনা ও রক্তাক্ত আগস্টসহ কয়েকটি পরিপূর্ণ নাটক লিখেছেন। তাঁর প্রবন্ধ – বিশেষ করে কলামের সংখ্যা আমার জানা নেই। একদিন গবেষকরা তা খুঁজে বের করবেন।

১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তান রাষ্ট্র বাঙালি নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছিল তখন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বুঝতে তিলমাত্র সময় লাগেনি যে, রাষ্ট্রভাষা বাংলার শহিদানের স্মারক গানের রচয়িতা হিসেবে তিনি হবেন ওদের জিঘাংসার প্রধান এক শিকার। তাই আত্মরক্ষার জন্যে তিনি সপরিবারে ভারতে চলে গিয়ে শরণার্থী হন এবং সেখানে কলম চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পাশে দাঁড়ান।

সৃজনশীল সাহিত্য তাঁর সহজাত বৃত্তি হলেও স্বদেশে ও পরবাসে অন্নদাতা সাংবাদিকতাই ক্রমে ক্রমে তাঁকে গ্রাস করেছিল। স্বাধীন ও মুক্ত স্বদেশের পরিস্থিতি নাজুক, সাংবাদিকতা পেশারও রেহাই ছিল না। পারিবারিক জীবনের দায়ভার তাঁর কাছে ছিল অপরিসীম। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী সেলিমা আফরোজ চৌধুরী দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে ১৯৭৪ সালে তাঁর উন্নততর চিকিৎসার জন্যে তিনি সপরিবারে বিলেতে এসেছিলেন। আশা ছিল, প্রিয়তমা স্ত্রী সুস্থ হয়ে উঠলে তিনি আবার সপরিবারে স্বদেশে ফিরে যাবেন। ফিরে যাবেন ফেলে আসা তাঁর সেই সাংবাদিকতা পেশায় – রচনা করবেন নতুন নতুন কবিতা, গল্প ও উপন্যাস; কিন্তু প্রত্যাশিত অনুকূল পরিবেশটি আর ফিরে আসেনি। পঙ্গু স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের প্রয়োজনে তিনি প্রবাসেই রয়ে যান। স্ত্রী সেলিমা আফরোজ মারা যান ২০১২ সালে। তখন তাঁর নিজের স্বাস্থ্যও ঢালের দিকে; এরপরে তাঁকে হুইলচেয়ারে বসে জীবন কাটাতে হয় – যদিও অদম্য ছিলেন বলে মানুষের ডাকে নানা জায়গায় গিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন। মর্মান্তিক যে, তিনি নিজে যখন মৃত্যুশয্যায় তখন সহসা তিনি কনিষ্ঠ কন্যা বিনীতা চৌধুরীকে হারান। পিতা হিসেবে কী নিদারুণ আঘাতই না গাফ্ফার চৌধুরীকে সইতে হয়েছিল! যদিও তখনো বিনীতার ভাই ও বোনরা – অনুপম রেজা চৌধুৃরী, তনিমা চৌধুরী, চিন্ময়ী চৌধুরী ও ইন্দিরা চৌধুরী – তাঁদের মরণাপন্ন পিতাকে ঘিরে ছিল।

বিলেতে বসে সংসারের ভার বহন করতে গিয়ে অমর একুশের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী নিজ পেশা সাংবাদিকতার ওপর পুরোটাই নির্ভর করতেন। এর পরিণাম ছিল, স্বদেশহারা এই প্রতিভাধরের সাহিত্য রচনার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। একদিন আমি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি আর সৃজনশীল সাহিত্য রচনা করেন না কেন? সংক্ষুব্ধ স্বরে গাফ্ফার ভাই বলেছিলেন, কী করে গল্প-উপন্যাস লিখবো, বলো! আমি তো আজকের ঢাকা শহরের রাস্তা-ঘাটের নামও জানি না। কথাটা শুনে আমি বেদনায় বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম।

যৌবনের শুরুতে সাংবাদিকতায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর হাতেখড়ি হয়। সেই কালের অনেক সাংবাদিককেই একরকম ছোটবেলাতেই হাতেখড়ি দেওয়া হতো, প্রায় স্কুলছাত্রের মতো। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের গোড়ায় যখন সাংবাদিকতায় আমার হাতেখড়ি হয় তখন একজন দুঁদে গুরু আমাকে বলেছিলেন, ‘মিয়া! আগের দিন হলে, একটা ভুলের জন্যে চেয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে কাজ করতে বলতাম।’ তবে সাংবাদিকতা পেশায় গাফ্ফার চৌধুরীর উন্নতি ঘটেছিল তড়িৎগতিতে। শুরুতেই পত্রিকায় (তখনকার দিনের প্রধান কাজ) ইংরেজি থেকে বাংলায় নির্ভুল অনুবাদ করা, সংবাদদাতা হিসেেেব খবর লেখা, খবরের সূচনা তৈরি করা, শিরোনাম লেখা, পৃষ্ঠা সাজানোসমেত সব কাজে তিনি দক্ষতার প্রমাণ দেন এবং বড় বড় সাংবাদিকের দৃষ্টি কাড়েন। তাঁর বিষয়-বাছাই ও বিবেচনা, বিশ্লেষণ, উপসংহার ছিল অন্যদের চেয়ে ভিন্ন ও বৈশিষ্ট্যময়। তাঁর লেখনীতে প্রতিভার ছোঁয়া ছিল। তাঁর সঙ্গে যখন আমার প্রথম পরিচয় হয় তখন তিনি দৈনিক জেহাদ-এর বার্তা সম্পাদক – বয়সে তিনি তিরিশেও পড়েননি। কিছু পরে তিনি সাপ্তাহিক সোনার বাংলা বের করেন, এর সম্পাদক হিসেবে। আমাকেও একজন সহকারী হিসেবে ডেকে নেন। তখন তাঁকে খুব কাছে থেকে দেখি। আমি দেখতাম, নিজের পত্রিকার উন্নতি করার চেষ্টায় তিনি লন্ডনের ডেইলি মেইলের মতো বিদেশি পত্রিকার পৃষ্ঠাসজ্জা পরীক্ষা করতেন, তখনকার দিনে এ ছিল এক দুঃসাহসিকতা। শেরে-এ-বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হকের মৃত্যুর পর – একটি খবরে তিনি শিরোনাম লিখেছিলেন – ‘আজ রাজপথে মহানায়কের মহাপ্রয়াণ’। কী অনবদ্য শিরোনাম! আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি খুন হওয়ার পরে, (টেলিপ্রিন্টারে)  দু-তিন বাক্যের একটি খবর ছিল যে, ‘বিধবা জ্যাকুলিন স্বামীর লাশটি দেখতে গিয়ে তাঁর ঠোঁটে শেষবারের মতো চুম্বন দিয়েছেন।’ গাফ্ফার ভাই প্রথমে আমাকে এর ওপর কিছু লিখতে বলেন, – সাপ্তাহিক পত্রিকার পাঠকের চাহিদা মেটানোর মতো করে। আবার সঙ্গে-সঙ্গে তিনি একনজর খবরটা দেখে চলে যান। আমার লেখা যখন মাঝপথে, তিনি ফিরে আসেন। আমাকে বললেন, ‘পড়ো!’ লেখাটি হাতে নিয়ে দেখি বিদায়ী চুম্বনের সেই খবরটি, বিস্তৃত দৃশ্যের মতো! পড়তে পড়তে শিহরিত হয়ে যাই, অজান্তে আমার দুচোখ অশ্রুতে প্লাবিত হয়ে পড়ে। কোথায় আমেরিকার ওয়াশিংটন আর কোথায় সেদিনের বাংলাদেশের ঢাকা! কী দুস্তর ব্যবধান! গাফ্ফার চৌধুরীর অনন্যসাধারণ কল্পনাশক্তি আর আবেগ সৃষ্টির প্রতিভার ছোঁয়ায় খবরটি একটি অনুপম সাহিত্যকর্ম হয়ে ওঠে।

এরকম নানা বৈশিষ্ট্যের কারণেই কাঁচা খবর লেখা বা সম্পাদনার চেয়ে, বিশ্লেষণী সাংবাদিকতায় তাঁর চাহিদা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে, যা ছিল সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের একটা সংমিশ্রণ; ললিত ভাষায় নিরস সংবাদের মূল্যায়ন। তিনি পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় জাতীয় নিবন্ধ লেখার দিকে ঝুঁকে পড়েন। সেই থেকে আরম্ভ হয় তাঁর কলাম লেখা। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক নিবন্ধ লেখার সুবাদে তিনি ক্রমে হয়ে ওঠেন এক কিংবদন্তি কলামলেখক। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া (রাজনৈতিক মঞ্চ/ মুসাফির), আবদুল গণি হাজারী (কালো প্যাঁচার ডাইরী), জহুর হোসেন চৌধুরী (দরবার-ই জহুর) প্রমুখ এই ধারায় তাঁর অগ্রণী ছিলেন। তবে কলাম সাংবাদিকতার প্রয়োজন বুঝলেও গাফ্ফার ভাই এর অনিত্যতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। আমি একে ‘পচনশীল সাহিত্য’ আখ্যা দিয়ে একদিন খাঁটি সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করতে তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘কী করবো, মিয়া! আমার (সাহিত্যের) প্রকাশকরা কি আমায় টাকা-পয়সা দেয়! সামান্য দিলেও, পুরোপুরি দেয় না।’

বলা বাহুল্য, পাঠক সমাজের কাছে তাঁর প্রাঞ্জল কলাম এতোটাই প্রিয় ছিল যে, স্বদেশ-বিদেশের সম্পাদক-প্রকাশকরা তাঁর লেখা পাওয়ার জন্যে সর্বপ্রকার চেষ্টা করতেন। তিনি কখনো একই সঙ্গে কয়েকটা পত্রিকায় কলাম লিখতেন। কাজটা যে কত দুষ্কর, একটু ভাবলেই বুঝতে পারা যায়। তাঁর কলামের অবশ্য একটা কাঠামো ছিল। একটা প্রসঙ্গ আলোচনার করার আগে এর সঙ্গে সাযুজ্য আছে এমন একটা গল্প, কাহিনি, ঘটনা বা একটা অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে তিনি সচরাচর শুরু করতেন; শিরোনামটি অবশ্যই হতো নজরকাড়া। তিনি অতীতের অনেক ব্যক্তিত্বের নাম উল্লেখ ও কথা উদ্ধৃত করতেন। নিন্দুকদের অভিযোগ ছিল, এর সব সঠিক নয়। বিলেতবাসী লেখক-সাংবাদিক আবদুল মতিন বেঁচে থাকতে একবার গাফ্ফার চৌধুরীর বাসার বেড়াতে যান। এই প্রসঙ্গে গাফ্ফার চৌধুরী তাঁকে ওপরতলায় নিয়ে সাজিয়ে রাখা তাঁর ডায়েরির খণ্ডগুলো দেখিয়েছিলেন। পরে, মতিন ভাই আমাকে ঘটনাটির বিবরণ দিয়ে বেশ খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘বুঝলেন! গাফ্ফার ওই ডায়েরিগুলো থেকে পুরানো ঘটনার বিবরণ ও উদ্ধৃতি দেয়।’ পরে আমি গাফ্ফার ভাইকে কয়েকবার বলেছি, ‘ডায়েরিগুলো একে একে ছাপতে শুরু করুন!’ উদাস স্বরে তিনি বলতেন, ‘দেখি!’ গাফ্ফার চৌধুরী কলাম লিখতে গিয়ে নানা বিষয়ে বেশ পড়াশোনা করতেন, যদিও গোয়েন্দা গল্প ছিল তাঁর প্রিয়তম। আর তিনি প্রবাসে থাকলেও বাংলাদেশ থেকে চিঠি, টেলিফোন, টেলেক্স ও ই-মেইলসহ নানা মাধ্যমে সমাজের নানা স্তরের মানুষ তাঁকে অজানা তথ্য জানাতেন। এবং বলাই বাহুল্য, তাঁর রাজনৈতিক কলামের মূল ও প্রধান উপজীব্য ছিল বাংলাদেশ।

তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। তিনি মানুষকে মনে রাখতেন। কারো সঙ্গে একবার পরিচিত হলে তিনি সহজে ভুলতেন না। এ-কারণে তাঁর অনুরাগী ভক্তের সংখ্যা ছিল অঢেল। কোনো আসরে গেলে তরুণ-তরুণীরা তাঁকে ঘিরে থাকতো, সশ্রদ্ধ প্রবীণরা অদূরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। অতীতের বহু ঘটনা তিনি মনে রাখতেন – পরে হুবহু বর্ণনা করতে পারতেন। এই গুণ তাঁর লেখাকে সমৃদ্ধ ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতো।

 সমাজের সঙ্গে তাঁর একটা গভীর রাখিবন্ধন ছিল। বিলেতবাসে তো বটেই, স্বদেশে সেই শৈশব থেকে তিনি ছিলেন সমাজ-সচেতন ও সক্রিয়। বাংলা ভাষার পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, নারী-পীড়নের বিরুদ্ধে, শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে, অনাচারের বিরুদ্ধে নানান ভাবে তিনি জড়িত ছিলেন। কখনো কারো ডাকের অপেক্ষায় বসে থাকতেন না, নিজেই অগ্রণী ভূমিকা নিতেন। গণসচেতনতা তাঁর কাছে ছিল মহার্ঘ। সম্প্রতি তাঁর কলামে চিত্রনায়িকা পরীমণির ঘটনার উল্লেখ তা আবার প্রমাণ করে। বিলেতে, রাজনীতি  তো বটেই, বাঙালিদের শিল্প-সাহিত্য, সংগীত, নাটক, পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশনসহ নানা কর্মকাণ্ডকে তিনি সমর্থন করতেন। নতুন লেখক-লেখিকাদের উৎসাহ জোগাতেন। আমার মনে পড়ে, আমি সাপ্তাহিক জনমতে নির্বাহীর দায়িত্ব নেওয়ার বেশ কিছু পরে, নিজ থেকে টেলিফোন করে তিনি বলেছিলেন, ‘কাদের, কাগজটা ভালো করছো!’ শুনে, আমার কী যে আনন্দ হয়েছিল!

রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতি তথা মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে তাঁর একটা প্রগাঢ় প্রত্যয় ছিল। সেই ভাবটা তাঁর একটি কবিতায় স্পষ্ট বলে মনে হয় – এতে দেশের জন্যে তাঁর কী ব্যাকুলতা!

মশাল কি নিভে গেলো বন্ধু

সূর্যের রঙ মাখা রোদ্দুর

রক্ত কি মুছে গেলো বন্ধু

এই ঘোর অমানিশা কদ্দুর?

মুক্তির মৃতদেহ বন্ধু

রমনার রাজপথে বেওয়ারিশ

অভিমন্যুরা আজ খঞ্জ

নিরস্ত্রীর হাত করে নিশপিশ।

চৌকির সিপাহিরা বন্ধু

বন্দুক হাতে নিয়ে শান্ত্রী

কলম লেখনী হলো স্তব্ধ

কবে হবে এই দেশে ক্রান্তি?

মশাল কি নিভে গেলো বন্ধু

রোদ্দর মুছে যাবে সন্ধ্যায়

রক্ত কি মুছে যাবে বন্ধু

জীবনটা কেটে যাবে তন্দ্রায়?

(আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ‘মশাল কি নিভে গেলো’, সংগৃহীত)

আমার অনূদিত এর  ইংরেজি রূপ, যা একদিন আমি তাঁকে পড়ে শুনিয়েছিলাম :

Has the Torch Blown

Is the torch blown out, my friend,

The sunshine , too, dyed in sun’s own colour,

Is the blood wiped away, friend?

How long is this severe dark-night is to be?

The corpses of liberty, friend,

Are left unclaimed on Ramna’s avenues;

The Abhimanyus are lame today Ñ

And hands of the unarmed edgy now.

Friend, the local sipoys

Stand guard with guns in their hands;

Pens and writing tools are silenced;

When would this country have a transition?

Is the torch blown out, friend?

Shall sunshine wipe off at dusk?

Would the blood be erased, friend,

Life be spent in slumber?

[Ramna – The old green belt, historic place, in Dhaka city. Abhimanyus – Heroes of ancient India. sipoys – soldiers]

(‘Modern Bengali Poetry, 1950s-1990s’, Quader Mahmud, অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি)

চেতনা ও নীতিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সম্পূর্ণ অভিন্নতা ছিল। বাঙালিত্ব ছিল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সহজাত বৃত্তি। মনুষ্যত্বের প্রতি প্রগাঢ় বোধের ভিতে, তিনি ছোটবেলা থেকে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ ছিলেন। একই সুবাদে গণতন্ত্রের দীক্ষা নিয়েছিলেন এবং সমাজতন্ত্রের প্রেরণা পেয়েছিলেন। এসব তাঁর জীবনদর্শনে, সামাজিক চেতনায় ও রচনায় প্রতিফলিত হতো – যা আমৃত্যু তাঁর সঙ্গে অটুট ছিল। স্বতঃই তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। ঘাতকদের হাতে জাতির পিতা সপরিবারে নিহত হওয়ার পর, যে গুটিকয় বাঙালি বিক্ষোভে লন্ডনের রাজপথে নেমেছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের একজন। জাতির পিতা সম্পর্কে তিনি বহু বক্তৃতা করেছেন, নানা সময়ে লিখেছেন, আত্মজীবনী লিখতে বঙ্গবন্ধুকে সাহায্য করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বহু কলাম/ প্রবন্ধ লিখেছেন, দুটি নাটক লিখেছেন, – সেই ১৯৭৭ সালে লন্ডনে তাঁর সম্পাদনায় ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় একটি পুস্তিকা (Sheikh Mujib/ A Commemorative Anthology, Edited by Abdul Gaffar Choudhury, January 1977, Radical Asia Books, London)। গত বছরের নভেম্বরে দৈনিক ইত্তেফাকে তিনি অকুণ্ঠভাবে লেখেন, ‘জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে যেন বিচ্যুত না হই – এই আমার প্রার্থনা।’

সাংবাদিকতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কাছে দলীয় আনুগত্যের কোনো মাধ্যম ছিল না; তিনি সাংবাদিকতাকে চাটুকারিতা বলে মানতেন না। তিনি যে-দলটির সমর্থক ছিলেন, এর প্রশংসা করেও, তিনি দরকারে এর সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি। এজন্য তিনি নিন্দা কুড়িছেন, তবু নিজ নীতিতে তিনি অটল ছিলেন। রাজনীতি নিয়ে আলোচনাকে তিনি গণতন্ত্রের জন্যে অমূল্য ও অপরিহার্য মনে করতেন। সমাজতন্ত্রকে তিনি মনে করতেন দুঃখী মানুষের সনদ।

শৈশবের মাদ্রাসা শিক্ষাকে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন; লন্ডন থেকে আমার বন্ধু (প্রয়াত) আমিনুল হক বাদশাকে নিয়ে তিনি মক্কায় গিয়ে হজও পালন করেছিলেন। আবার তিনি ধর্মান্ধতাকে সমূলে পরিহার করতেন। একটি উদাহরণ আছে। উত্তর লন্ডনের প্রকৃতি-সচেতন ডক্টর শফিউল্লাহ মৃত্যুর আগে নিজ পরিবারকে আদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন যে, তাঁর লাশ যেন দাহ করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর এ-কথা শুনে স্থানীয় কোনো ইমামই তাঁর জানাজা পড়াতে রাজি হননি। পরিবারটি নিরুপায় হয়ে পড়ে। তখন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী স্বেচ্ছায় ডক্টর শফিউল্লাহর জানাজা পড়িয়েছিলেন। গাফ্ফার ভাই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থানে দারুণ শঙ্কিত ছিলেন; তিনি বারবার সরকার ও জাতিকে এ-ব্যাপারে সাবধান করে গেছেন। বলেছেন, বাংলাদেশ যেন তালেবান রাজ্যে পরিণত না হয়। বলতেন, বাংলাদেশে ধর্মান্ধদের জনসমর্থন কম, তারা ভোট পায় যৎসামান্য।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কেবল সুলেখকই ছিলেন না, বলা দরকার – তিনি একজন সুবক্তাও ছিলেন বটে। তিনি যেমন সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখতে পারতেন, তেমনি তিনি গুছিয়ে বলতেও পারতেন। আমি তাঁর বহু বক্তৃতা শুনেছি। তাঁর উপস্থিত বুুদ্ধি, চিন্তার স্বচ্ছতা, ভাষার প্রাঞ্জলতা, বক্তব্যে বলিষ্ঠতায় বক্তৃতাগুলি সমৃদ্ধ হতো। তিনি প্রায়শ নতুন কথাও বলতেন; চমক দিতেন। এমনিভাবে একবার তিনি কলকাতা ও ঢাকার পরে লন্ডনকে বাংলা সাহিত্যচর্চার ‘তৃতীয় কেন্দ্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন – সম্ভবত যুক্তরাজ্য বাংলা সাহিত্য পরিষদের একটি সম্মেলনে।

সকল স্তরের সবার জন্যে তাঁর দুয়ার ছিল খোলা, তিনি ছিলেন কোটি কোটি বাঙালির ‘গাফ্ফার ভাই’। উত্তর লন্ডনে ম্যাথিউয়েন রোডে তাঁর বাড়িটি কেবল বিলেতবাসী বাঙালিই নয়, বাংলাদেশসমেত সারাবিশ্বের বাঙালিদের একটি তীর্থস্থান ছিল। লন্ডনে এলে তাঁরা গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে একবার যোগাযোগ না করে যেতে পারতেন না।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ইউনেস্কো পুরস্কারসমেত নানা সম্মাননা পেয়েছেন। আবার ব্রিটিশ সাহিত্যের মূলধারায় তাঁর অবদান না থাকলেও বিলেতের পূর্ব লন্ডনে বাঙালি-অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটস বরার (পৌরসভার) কাউন্সিল তাঁকে ‘ফ্রিম্যান অব টাওয়ার হ্যামলেটস’ উপাধি দেয়।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তারুণ্যের এক দুর্লভ ক্ষণে একটি অসামান্য গীতিকবিতা লিখেছিলেন; এর ওপর প্রথম সুর আরোপ করেছিলেন সুরস্রষ্টা আবদুল লতিফ ও দ্বিতীয়বার করেছিলেন অদ্বিতীয় সংগীতজ্ঞ শহিদ আলতাফ মাহমুদ। – এ সন্নিযোগে সৃষ্টি হয় অমর সংগীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি?’ এই গান অমর একুশের সকল আয়োজনে সহচর গীত, প্রভাতফেরির গান, ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্যে বরকত. সালাম, জব্বার, শফিক ও নাম-অজানাদের আত্মত্যাগের স্মারক, নিয়ত ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতির মর্মে বাজে – প্রতি বছর একই দিনে বিশ্বময় প্রতি বাঙালির অন্তরে, তাদের জনপদে, কণ্ঠে ধ্বনিত অনুরণিত হয় – এভাবে জীবদ্দশাতেই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী হয়ে ওঠেন জাতির বিবেক।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী মৃত্যুকে জয় করেছেন – আজ একথা বললে অত্যুক্তি হবে না।