ভূমিকা ও অনুবাদ : সুরেশ রঞ্জন বসাক
ভূমিকা
প্রাচীন পারস্যের সঙ্গে আমাদের আত্মিক সংযোগ পুরনো। মরমিবাদ বা সুফিবাদ বলতে আজ আমরা যা বুঝি তার অনেকটা প্রভাব এসেছে পারস্য-সাহিত্য থেকে। অন্যদিকে আমাদের নিজস্ব ঘরানার সহজিয়া ভাবধারাও কম প্রাচীন নয়। এই দুই ধারার মধ্যে অমিলের চাইতে মিল বেশি। উভয় পথের অভীষ্ট এক : স্রষ্টা। তাঁকে জানা, তাঁকে পাওয়া। সকল পথ ও মত সবশেষে এসে মিলেছে সেই কেন্দ্রে।
খৈয়াম, রুমি, হাফিজ আজ হাজার বছরের দূরত্বে অবস্থিত নন। তাঁরা আমাদের পঠন-পাঠনে ও মননে জায়গা করে নিয়েছেন লালন সাঁই, হাছন রাজা বা মনমোহনের মতো। খৈয়ামের রুবাইয়াৎ, হাফিজের গজল, রুমির মসনবি ও কবিতা এখন বিশ্বসাহিত্যের অংশ। বস্তুত বস্তুবাদী বিশ্বের আত্মার সংকটকালে তাঁরা রবীন্দ্রনাথ বা জিব্রানের মতো আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন।
ব্র্যাড গুচের বিখ্যাত বই The Life of the Sufi Poet of Love-এর মিকায় গুচ এক সিরীয় তরুণ সেবাস্টিয়ানের বয়ানে রুমির মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন এভাবে : ‘Rumi is in a small group of the greatest poets of all time, Why? Because, like Whitman, or like Shakespeare, he never tells his secret!’ কী তাঁর কবিতার গোপনীয়তা? তিনি প্রেমের কথা বলেন; স্রষ্টার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক প্রেমিক-প্রেমিকার। এ যেন আরেক রাধা-কৃষ্ণ, আত্মা-পরমাত্মার প্রেম।
এ-সম্পর্কে নিবেদন আছে, সমর্পণ আছে, আছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুযোগ-অভিযোগ, গুচ্ছ গুচ্ছ আনন্দ ও দুঃখ। তাঁর কবিতার কণ্ঠ কখনো একজনের, কখনো দুজনের, এবং কখনো বহুজনের। তিনি কখনো অতীব সরল, কখনো দুর্জ্ঞেয়। কখনো স্পষ্টবাক, কখনো হেঁয়ালিপূর্ণ। তাই তাঁর কবিতার ভাবরহস্য প্রগাঢ়ভাবে গোপন। শুধু রুমিপাঠের আনন্দটুকু বরাবর নির্মল ও সর্বজনীন। আর পাঠ-নিঃসৃত জ্ঞানটুকু নিতে পারলে এর তুল্যমূল্য অসীম।
রুমির দর্শনের ব্যাপ্তি ও গভীরতা কয়েকটি কবিতায় ধারণ করা অসম্ভব। তবু রুমিকে সাগরে যেমন মেলে, ফোঁটা ফোঁটা জলেও মেলে। রুমির কবিতার এই ফোঁটা ফোঁটা জলই আজকের এলিয়ট-কথিত নিষ্ফলা বিশ্বে মরূদ্যান। এজন্যেই বোধ হয় সাম্প্রতিককালে পশ্চিমা বিশ্বে রুমিচর্চার প্রবল পুনরুত্থান ঘটেছে।
পার্সিয়ান ও আফগানরা রুমিকে ডাকেন ‘জেলালুদ্দিন বালখি’ নামে। বাংলায় এসে রুমি জেলালুদ্দিন থেকে জালালুদ্দিন রুমি হয়ে গেছেন। তাঁর জন্ম ৩০শে সেপ্টেম্বর ১২০৭ খ্রিষ্টাব্দে পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্গত আফগানিস্তানের বালখিতে। এই সুফি কবি ও সাধকের মৃত্যু হয় ১৭ই ডিসেম্বর, ১২৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তুরস্কের কোনিয়ায়। মৃত্যুর আগের বারোটি বছর তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্য হুসাম চেলেবিকে ডিক্টেশনের মাধ্যমে সমাপ্ত করেন ছয় খণ্ডের মসনবি। এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যকীর্তি।
আমার অন্তঃস্থ আমি-কে আমি অতলান্ত দেখি
আমার অন্তঃস্থ আমি-কে আমি অতলান্ত দেখি।
দু-চোখ ছাড়াই আমি সবকিছু
স্পষ্ট দেখতে পাই।
তাহলে চোখ দিয়ে দেখবো বলে
হাপিত্যেশ কেন,
যখন তাঁর চোখ দিয়েই আমি পুরো বিকে দেখি?
মুহূর্তকালের সুখ
সে এক মুহূর্তকালের সুখ,
তুমি আর আমি যখন বারান্দায় বসে থাকি,
আপাতদৃষ্টিতে দুজন অথচ আত্মায় এক, তুমি আর আমি।
আমরা ঠাহর পাই, এখানে চলেছে বয়ে জীবনের জল, রূপশ্রী বাগান,
তুমি আর আমি, পাখিদের গান।
নক্ষত্রেরা অপলক দেখে যাবে আমাদের,
আমরাও তাদের দেখাবো কীভাবে
দুজনে হয়ে গেছি ক্ষীণ এক তৃতীয়ার চাঁদ।
দেহাতীত,
তুমি আর আমি,
শুধু আমি আর তুমি, নির্বিকার যে যা খুশি বলুক।
তুমি আমি হাসিতে গড়ালে
স্বর্গের শুক সারি কলকণ্ঠে গেয়ে উঠবে গান।
এক রূপে তুমি-আমি আছি পৃথিবীতে,
অন্য রূপে তুমি-আমি অন্তহীন সুখদ ওপারে।
প্রণয়ের কাছে আমি পরাভূত
চাঁদের ঐশ্বর্যে
আলোকিত সারাটা আকাশ।
অপার শক্তি তার,
আমি পড়ি প্রপাত ধরণিতলে।
তোমার প্রণয়ে আমি স্থিরপ্রতিজ্ঞ
বিসর্জনে প্রস্তুত এই পার্থিব জীবন,
তোমার সত্তার অপার ঔদার্যের পায়ে
আমি বাহিত ভারের অংশবিশেষ
আমি বাহিত ভারের অংশবিশেষ।
যথাযথ ভারসাম্যহীন বলে
আদিম গুহাবাসী নিদ্রার্থীর মতো
যা পাই হাতড়াতে হাতড়াতে
ঘাসেই ঘুমিয়ে পড়ি।
হাজার বছর ধরে আমি ধুলোবালি হয়ে
বাতাস যেমন চায় ভেসেছি, উড়েছি,
প্রায়শই ভুলে গেছি কী সে তুরীয় জীবন,
কেবল ঘুমোতে গিয়ে তার কাছে ফিরে গেছি। স্থান ও কালের চৌমাথার
অতিথিশালায় আমি আলতো ঝুলে থাকি।
আমি বিপুল চারণক্ষেত্রে হেঁটে যাই,
আমি সহস্র বর্ষের অমৃতের শুশ্রূষা করি।
সবাই তো তাই করে কোনো না কোনোভাবে। এবং সবাই জানে,
বাঁচার জন্যে সজ্ঞান সিদ্ধান্ত আর একান্ত স্মৃতি বড় ছোট্ট পরিসর।
রাত হলে প্রতিটি মানুষ ভালোবেসে অস্থানে আলো বিচ্ছুরণ করে।
দিন হলে কর্মে নিমগ্ন হয়।
বর্তমানে আমাদের যা যা কিছু আছে
বর্তমানে আমাদের যা যা কিছু আছে
তা কল্পনা নয়।
তা শোক নয়, সুখ নয়।
তর্জনী-উঁচানো রাষ্ট্র নয়,
উল্লাস নয়,
নয় বিষণ্নতা।
ওরা সব আসে আর যায়।
যা যায় না, তা উপস্থিতিটুকু।
আমার সর্বস্ব দিলাম।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.