জীবননৌকায় এক মোহময় ভ্রমণ 

খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার

ড. গোলাম কিবরিয়া ভূইয়া l উৎস প্রকাশন ষ ঢাকা, ২০২০ l ৫০০ টাকা

‘আমার গর্বের ধন ১৩৬০ বাংলার ৩রা আষাঢ় শুক্রবার দিন জন্মগ্রহণ করে’ – বাবা হাজী নুরুল ইসলাম ভুঁইয়ার দিনলিপির পাতায় ঠিক এমনি করেই লেখা ছিল প্রথম পুত্রের জন্মকথা। সেই পুত্র দিনে দিনে বড় হতে থাকে। খেলাপাগল, গানপাগল, সিনেমাপাগল সেই কিশোরকে দেখলে একালের সমাজটা হয়তো হায় হায় করে উঠত – গেল গেল রব তুলে। ছেলের মাথাটা গেল, ওর দ্বারা কিচ্ছু হবে না, নাম-নিশানাও থাকবে না … । তিতাস পাড়ের ছেলেটি কিন্তু হারিয়ে যায়নি, বরং সৌরভ ও আলো ছড়িয়ে চলেছে আটষট্টি পেরিয়েও। খেলাপাগল, গানপাগল, সিনেমাপাগল ছেলেটি যে বইপাগলও ছিল। খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার তাঁরই আত্মকথা। তিতাসের পাড় ছেড়ে কর্ণফুলীর মোহনায় থিতু হওয়ার গল্প; কিশোর কিবরিয়া থেকে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. গোলাম কিবরিয়া ভূইয়া হয়ে ওঠার গল্প। খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার আসলে সেই সাদামাটা কিশোরের মোহময় জীবনকাহিনি।

একান্নবর্তী পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। প্রতিবছর মামাবাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার দৃশ্য জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় পাঠকের সামনে। তিতাসের পাড়ে নোঙর ফেলে মাঝি মিষ্টি আনতে যায়। মা আঁচলের গিঁট খুলে মাঝিকে টাকা দেন, ঠিক যেমন করে পথের পাঁচালীর মা সর্বজয়া পয়সা বের করে দেন দুর্গাকে গুড় কেনার জন্য। অনুসন্ধিৎসু বালক প্রকৃতি থেকে পাঠ নেয় অনবরত। পাড়া-পড়শির বাসগৃহ, জীবনযাপনের নানা বৈচিত্র্য তাকে শেখায় সংস্কৃতির বিভিন্নতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। একালের ছেলেমেয়ের কাছে এসব অপার্থিব বা অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্য বলে মনে হতে পারে।        

মাত্র ছ-বছর বয়সে লগি হাতে নৌকার ভারসাম্য রাখতে পারা ছেলেটি জীবনভর পারিবারিক, সামাজিক, পেশাগত ও জাতীয় দায়-দায়িত্বে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে, যার বৃত্তান্ত উঠে এসেছে খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারে। জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সাঁতার শেখা দিয়ে পথচলা শুরু। কৃষিনির্ভর গ্রামে পিতৃব্যের ব্যবসাসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের ওপর ভর করে বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা সমকালীন অন্যদের তুলনায় অগ্রবর্তী ছিল। তার জন্য বাড়তি সমাদর পাড়ায়। তবে ভাবগরিমা ছিল না। বাড়ির বাঁধা কাজের লোক লালমতি কাকার কথা ভোলার নয়।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খাতায় প্রথম নাম ওঠে ছ-বছর বয়সে, ১৯৫৯ সালে। টিনের চাল ও বাঁশের বেড়া দেওয়া স্কুলঘরের ভেতরে প্রবেশাধিকার লাভ হয় বছরখানেক পর, স্কুলচত্বরের বটগাছতলা ও স্কুলের বারান্দায় পাঠগ্রহণের পালা সাঙ্গ হলে। বর্ষায় পড়া করার উপায় নেই। শিক্ষকরা তবু আগলে রাখেন ছেলেমেয়েদের পরম মমতায়। জীবনের প্রথম বছরে ডাবল প্রমোশন নিয়ে দু-বছরের পড়া এক বছরে শেষ করা হয়। অঙ্কটা শেষ অবধি আতংকই থেকে যায়। সমাজবিজ্ঞান, বিশেষত সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস, পাঠকদের ভাগ্য বলতে হয়।

কৈশোরের যাবতীয় খুঁটিনাটি সরল গদ্যে বর্ণিত হয়েছে খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারে। চলচ্চিত্রের দৃশ্যপটের মতো একের পর এক সব ভেসে ওঠে পাঠকের সামনে। তিতাস পাড়ের রামচন্দ্রপুর বাজারে স্থানীয় তাঁতিদের সমাগম, বাড়িতে সুতা রং করার বিশাল কর্মযজ্ঞ, কাজের লোকদের সঙ্গে মুটের কাজ করতে গিয়ে কিঞ্চিৎ মর্যাদাহানির আশংকা ও সেই সুবাদে দায়িত্ব পালন সত্ত্বেও ছোটচাচার কানমলা – সব গেঁথে যায় কিশোরমনে। প্রাথমিকের পালা সাঙ্গ হলে বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে শ্রিকাইল হাইস্কুলে নতুন নতুন বন্ধুলাভ একটু একটু করে কিশোরকে তাড়িয়ে নেয় নতুন জীবনের দিকে। বিস্ময়ের ব্যাপার, প্রতি শ্রেণিতে কোন বিষয়ে কত নম্বর পেয়েছেন, আরবি ও অংকে যথারীতি অকৃতকার্য হয়ে ক্রমিক নম্বর কত হয়েছে – সব মনে আছে আজো। শিক্ষকদের নামধাম, সেই বয়সে দেখা ক্রিকেট খেলার পরিপূর্ণ ফল, ধারাবিবরণী – কিছুই ভোলেননি। মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই প্রতিভাকে অবশ্য ‘ফটোগ্রাফিক মেমোরি’ বলেছেন নিজেই।

দিনব্যাপী স্কুলের মধ্যাহ্নবিরতিতে চাপকলের পানি দিয়ে গলা ভেজানো, পেট ভরা দুই-ই চলে। (এখন আমাদের মায়েদের সন্তানের টিফিন তৈরি নিয়ে ঘুম হারাম হওয়ার জোগাড়; প্রতিদিন এক খাবার তাদের মুখে রোচে না)। শ্রিকাইল বাজারে নারকেল মেশানো লজেন্স আসে আরো পরে। একটু মাথা ওঠার পর চলতি পথে পেয়ারা, কামরাঙা, আমলকী, হরীতকী সাবাড় করা শুরু হয়। গাঁয়ের লোক বাধা দেয় না; ছেলেপিলে খাচ্ছে, খাক না।      

ঘটনাবহুল সপ্তম শ্রেণি। এক সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডুবন্ত দুই কিশোরকে উদ্ধার করে বীরপুরুষ ও ‘ভগবানের দূত’ খেতাব পাওয়া তাঁর এক অমর কীর্তি। পাক-ভারত যুদ্ধ লেগে যায় সে-বছরই, ১৯৬৫ সালে। যুদ্ধের আঁচ পূর্ব পাকিস্তানে না লাগলেও অর্থনীতিকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। চিনির দাম আকাশছোঁয়া। ভোজ্যতেলেরও তাই। এসময় থেকেই ভেজাল মেশানোর হাতেখড়ি ব্যবসায়ীদের। পরিণামে অসংখ্য মানুষ রোগাক্রান্ত; পেটের পীড়া ও চর্মরোগ ঘরে ঘরে। এমন দুর্যোগের দিনে বড় বোনের বিয়ে। ধুমধামের কমতি নেই, আচার-আনুষ্ঠানিকতায় ছাড় নেই। নবাগত ভগ্নিপতির হাত দিয়ে বাড়িতে প্রথম মশার কয়েল এলো, নাটক হলো, পিকনিক হলো। হায় গ্রামবাংলা! কোথায় গেল সেই দিন!

একান্নবর্তী পরিবার একটা শিশুর জন্য কত বড় আশ্রয় হতে পারে,  খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারে তা অনেকবার বিবৃত হয়েছে। এমনকি হাঁড়ি-বাড়ি পৃথক হয়ে যাওয়ার পরও পরিবারের সদস্যদের হৃদ্যতা, বয়োজ্যেষ্ঠদের দায়িত্ববোধ, ছোটদের ভয়-মেশানো শ্রদ্ধা পারিবারিক মূল্যবোধকে অটুট রাখে। একালে আধুনিক সমাজে একান্নবর্তিতার চর্চা দুঃসাধ্যই বলা চলে। একান্ত ব্যক্তিগত ভোগবিলাসের স্বপ্নে ভর করে স্বার্থপরতায় মোড়ানো যে-জীবন আমরা বেছে নিই, একাকিত্বেই তার সমাপ্তি ঘটে।

নবম শ্রেণিতে স্কুলবদলের সূত্র ধরে প্রথমবারের মতো গ্রামছাড়া, মায়ের আঁচলছাড়া। রামচন্দ্রপুর বাজার তখন রীতিমতো শহর-বন্দর। তিতাসের বুকে এদিকটায় লঞ্চ ভাসে। বইঘর, ছাপাখানা, মিষ্টির দোকান, তামা-পেতলের হাঁড়ি-বাসন তৈরির কারখানা – কী নেই এখানে! উৎসাহ-আগ্রহ নিয়ে কিশোর উপভোগ করে যায় নতুন জীবনের যাবতীয় পরিবর্তন। মা-বাবা দূরগাঁয়ে; চাচা-চাচির স্নেহাশিস, যত্ন, সাহচর্যে তা মনেই হয় না। ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ুয়া চাচাতো ভাইয়ের বইয়ের সংগ্রহশালায় সোনার খনি পেয়ে যায় কিশোর। পরিচয় হয় মাসুদ রানার সঙ্গে। বেদুইন সামাদ, নীহাররঞ্জন, সমরেশ বসুদের সঙ্গেও পরিচয় ঘটে একে একে। বাড়ি ছাড়ার আগেই অবশ্য পড়া হয়ে যায় আরব্য উপন্যাস, বিশ্বনবী, মোস্তফা চরিত, বিষাদ সিন্ধু, রোকেয়া জীবনীসহ মেলা বই। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সত্যেন্দ্রনাথের কবিতা সব মুখস্থ। পড়ার বইয়ের বাইরে বই পড়ায় হাক্কু মামার অনুপ্রেরণার কথা ভোলার নয়। খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাসটা হয় বড় চাচাকে দেখে। দশ গ্রামে তিনিই প্রথম শিক্ষিত মানুষ। এই মানুষটার কাছে আজন্ম ঋণ লেখকের – যখন-তখন মনে করিয়ে দেন সে-কথা পাঠককেও। রেডিওতে গান শোনা, খেলার ধারাবিবরণী শোনা, বিকেলে খেলতে যাওয়া, সেতুর ওপর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া – সব চলে সমানতালে। স্কুলে যাওয়ার পথে ভয়াবহ নৌদুর্ঘটনার শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনি জানতে হলে ফিরে যেতে হবে খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারে। প্রথম সিনেমা দেখার লোভে বড় চাচাকে না বলে চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে লঞ্চে চড়ে নারায়ণগঞ্জ যাওয়া, জীবনে প্রথম শহর দেখা, মোটরগাড়ি ও ট্রাক দেখা, রেস্তোরাঁয় ভাত খাওয়া উত্তেজনায় টগবগ করা কিশোরের সেই গল্প না শুনলেই নয়।

মাধ্যমিকের আগেই শুরু হয়ে যায় আইয়ুববিরোধী আন্দোলন। গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে উত্তাপ। খবরের কাগজ আর বড় চাচার সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা হয় সমকালীন হালচাল। মাধ্যমিক পরীক্ষার কেন্দ্র টর্নেডোকবলিত মুরাদনগরে। গৃহশিক্ষক ও লালমতি কাকাকে সঙ্গে নিয়ে মুরাদনগরে গমন ও মাসখানেক অবস্থানের গল্প অনেকের কাছে পৌরাণিক বলে মনে হতে পারে। ঐচ্ছিক পরীক্ষার বিরতির আগে কুমিল্লায় গিয়ে সিনেমা দেখার দুঃসাহস দেখানো কিশোর পরীক্ষাশেষে বাল্যশিক্ষককে দেখতে গিয়ে ছারপোকার আক্রমণে ধরাশায়ী। এরপর বাড়ি ফেরা। অতঃপর অখণ্ড অবসর। খায়-দায়, ছিপ ফেলে মাছ মারে, রেডিও শোনে। ভয়েস অফ আমেরিকা, পিকিং রেডিও, রেডিও মস্কো। প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেয়, উত্তর লিখে খামে ভরে পাঠিয়ে দেয়। আগ্রহের কমতি নেই কোনো কিছুতে।     

চাঁদের মাটিতে পায়ের চিহ্ন এঁকে দেন আর্মস্ট্রং। একই সময়ে তদানীন্তন পাকিস্তানে প্রকাশিত হয় মাধ্যমিকের ফল। অঙ্ক বিষয়ে কোনোমতে পাশ মেলে। ফল মনের মতো না হলেও ভেঙে পড়ার পাত্র নয় সেদিনের কিশোর। বড় পৃথিবী ডাকছে হাতছানি দিয়ে। সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়ার সময় এখন। এবারের গন্তব্য ভিক্টোরিয়া কলেজ; হাজার যুবকের তীর্থভূমি। এ এক অন্য জগৎ, ভিন্ন পৃথিবী। বিশাল শ্রেণিকক্ষে  শিক্ষকদের পাণ্ডিত্যপূর্ণ পাঠদান, সহপাঠীদের সঙ্গে দিবারাত্রি মেলামেশা, ছাত্ররাজনীতির স্পর্শে আসা, ভালোমন্দের বোধ তৈরি হওয়া – ভাসিয়ে নেয় তাঁকে চেনা পৃথিবী থেকে। বড় চাচা মৃত্যুশয্যায়। পূর্বজীবনে ফিরে আসে যুবক বজ্রাহতের মতো। তাঁর চলে যাওয়া পুরো পরিবারে নিয়ে আসে বিষাদের ছায়া। তখন ১৯৭০ সাল। নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর ডিসেম্বরেই নির্বাচন। ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকবদল পর্যবেক্ষণ করেন লেখক গভীর মনোযোগ দিয়ে।

১৯৭১ সাল। পঁচিশে মার্চের কালরাত্রির পর গাঁয়ের পথে ঢল নামে মানুষের। ‘ক্লান্ত শ্রান্ত ক্ষুধায় আড়ষ্ট নারী পুরুষ বৃদ্ধ’ দেখে মন চঞ্চল হয় যুবকের। মস্কো রেডিওর প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিয়ে পুরস্কার হিসেবে পাওয়া দমিত্রি ফুরমানভের চাপায়েভ উপন্যাসের নায়ক তাঁকে যেন কানে কানে বলে যায় – বেরিয়ে পড়ো ঘর ছেড়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। এপ্রিলে যুবক ঘর ছাড়ে ঠিকই, ফিরে আসতে হয় সমন্বয়ের অভাবে। এরপর আগস্টে দ্বিতীয় চেষ্টা। এবার বিনিদ্র রজনী হেঁটে মেঠোপথ, খাল-বিল, নদী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ত্রিপুরা রাজ্য পর্যন্ত যাওয়া হয়। সেখানেও দিকনির্দেশনার অভাব; প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো কেউ নেই, অস্ত্র নেই। অতঃপর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে শত শত যুবকের সঙ্গে পনেরো দিনের অভিযানশেষে নিজ গাঁয়ে প্রত্যাবর্তন। নিজেকে প্রবোধ দেন – অস্ত্র হাতেই যুদ্ধ করতে হবে, তা তো নয়। সামাজিক দায়-দায়িত্ব পালন করেও দেশের জন্য কাজ করা যায়। এরপর আত্মনিয়োগ করেন মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায়। খাবার সরবরাহ, আশ্রয় দেওয়া, অস্ত্র লুকিয়ে রাখতে সাহায্য করা, পারাপার করে দেওয়া – কাজের শেষ নেই। নজরুলের ‘ভাব ও কাজ’ প্রবন্ধটির কথা মনে পড়ছে। অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে বিপ্লবে জড়িয়ে পড়তে বারণ করেছিলেন তিনি যুবকদের। খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারের লেখক অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে এক পাও কোথাও ফেলেছেন বলে মনে হয় না।   

১৬ই ডিসেম্বরের বিজয় মিছিলশেষে ১৯শে ডিসেম্বরে কলেজে যাওয়ার পথে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের ছবি ভাবিয়ে তোলে যুবককে। স্বাধীনতা তো এলো। দেশ গড়ার কী হবে? নতুন সরকারের পক্ষ থেকে আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে বলা হলেও কে শোনে কার কথা? এরই নাম কি স্বাধীনতা? উদ্ধত, বেপরোয়া, ক্ষমতার মোহে অন্ধ অনেক নব্য রাজনীতিক নয় মাসের লড়াই, ত্যাগ, ধ্বংস, রক্তপাতের কথা ভুলে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। যুদ্ধপরবর্তী পরীক্ষাসমূহে গণটোকাটুকি দিয়ে শুরু স্বাধীনতার অপব্যবহারের পালা। ছাত্ররাজনীতির কদর্য রূপ প্রত্যক্ষ হয় ধীরে ধীরে।

উচ্চমাধ্যমিকের পালা শেষ হলে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভাবনা চেপে বসে। খেলাপাগল যুবক খবরের কাগজে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়ার খবর দেখেই মনস্থির করে ফেলেন – চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ই হবে তাঁর পরের গন্তব্য। কুমিল্লার দিন ফুরোল। তিতাসকে বিদায় বলার সময় আজ। জীবনে প্রথম রেলগাড়িতে চড়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার সেই স্মৃতিও ভোলার নয়; যাত্রাপথের পুঙ্খানুপুঙ্খু বর্ণনা পাঠককে নিমিষেই তাঁর ভ্রমণসঙ্গী করে নেয়। লিখিত পরীক্ষাশেষে মৌখিক পরীক্ষার জন্য অপেক্ষার সময়টুকুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ইতিহাসের অধ্যাপক মোকাদ্দেসুর রহমানের আন্তঃবিভাগীয় ফুটবল খেলায় ছাত্রদের হয়ে অংশগ্রহণের দৃশ্য মোহিত করে চট্টগ্রামে সদ্য পা রাখা তরুণকে। অবশেষে তাঁর স্থান হয় ইতিহাসেই। না জানি কে কলকাঠি নাড়ছেন ওপর থেকে!

কলাভবনের তৃতীয়তলা, কক্ষ নম্বর ৩১৫। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস নিয়ে হাজির মোকাদ্দেসুর রহমান স্যার। গেল শতকের ষাটের দশকের শেষার্ধ হতে শুরু করে একুশ শতকের সূচনা অবধি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী মাত্রই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথমদিনের গল্পটা শুরু এভাবেই। খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারের লেখক ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করেছিলেন একইভাবে। সেই একই গল্প। শ্রেণিকক্ষ, ছাত্রাবাস, গ্রন্থাগার, খেলার মাঠ, সুযোগ পেলে সিনেমা – এই করে দিন যায়। তিলতিল করে বই জমান। সেকালে দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থীর কাছে যেসব বই ছিল আজ আমাদের শিক্ষকদের সংগ্রহেও সেসব বই নেই বললে ভুল বলা হবে না। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প ফুরোনোর নয়। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জীবনের গাঁটছাড়া বাঁধা হয়ে গেছে। সম্মান চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে ইতিহাস ছেড়ে নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে নাম লিখিয়েছেন অনেক ভেবেচিন্তে। গুছিয়ে পরিকল্পনার যে-বৃত্তান্ত তিনি দিয়েছেন খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারে, তা একুশ শতকের ছেলেমেয়েদের পথ দেখাবে। নিজেকে মেধাবী দাবি করেননি কখনো। তাই বলে আত্মবিশ্বাসের কমতি ছিল না। নিষ্ঠা, সততা আর স্বপ্ন তাঁকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে জীবনভর। বিচক্ষণতা তাঁর প্রধান সম্পদ। অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে মাত্র ২৪ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েই কিন্তু আকাশ ছুঁয়ে ফেলেননি তিনি। সবে তো পথচলা শুরু। এই পথের বাঁকে বাঁক কাঁটা বিছানো, বাঁক ঘুরতেই আশীর্বাদের আলো। এগিয়ে যান কাঁটা মাড়িয়ে আলো হাতে।  

ইংরেজি শিক্ষা ও বাংলায় মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ, ১৮৮৫-১৯২১ শীর্ষক পিএইচ.ডি অভিসন্দর্ভ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা একাডেমি থেকে। শতাধিক গবেষণা প্রবন্ধ, চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী, পূর্বকোণ ও অন্যান্য কাগজে ক্রীড়াবিষয়ক নিয়মিত লেখালেখি, সাহিত্য পত্রিকায় নানা বিষয়ে মৌলিক রচনা ও গ্রন্থ-আলোচনা, অল্পসংখ্যক ছোটগল্প আর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুবাদকর্ম রচনা তাঁর কর্মময় জীবনের মহান কীর্তি। দিনবদলের ভাবনায় ভরা তাঁর চিন্তাজগৎ। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক সংস্কারমূলক পরিবর্তন এসেছে তাঁর হাত ধরে। শিক্ষক রাজনীতির পঙ্কিলতায় হৃদয় ভেঙে গেলেও অবিচল আছেন সত্যের পথে। চাকরি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর গ্রহণ করলেও ভাবনারা আজো অবসরে যায়নি, অবসরে যায়নি কলমও। খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার শিরোনামটি লেখকের প্রিয় শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটি কালজয়ী গানের প্রথম কলি। হেমন্তের গানে ‘খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার’ বলতে বিশেষ করে নারীজাতির গণ্ডিবদ্ধ সংকীর্ণ জীবনের কথা বলা হলেও ড. গোলাম কিবরিয়ার খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার প্রকৃতপক্ষে অনেক বিস্তৃত, সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়ার গল্প; একটি পরিপূর্ণ জীবনভ্রমণের  গল্প।