কিংবদন্তির ইতিহাস ভাওয়াইয়া সংগীতসম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদ

মানবসমাজে এক-একজন মহাঐশ্বর্যে মহীয়ান অসাধারণ ক্ষণজন্মা মানুষ জন্মগ্রহণ করেন, যাঁরা আগামী প্রজন্মের ঠিকানা, আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। এমন মানুষই স্মরণীয়,  বন্দিত। এই সংকট সময়ে যা দিতে পারে অমৃতের  সন্ধান। তেমনিই কিংবদন্তির ইতিহাস – ভাওয়াইয়া সংগীতসম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদ। তিনি ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাতা হিরামন নেসা ও পিতা জাফর আলির সন্তান ছিলেন আব্বাসউদ্দীন। তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত আইনজীবী ও জমিদার।

মেধাবী ছাত্র আব্বাসউদ্দীনের ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা। স্কুলজীবন থেকেই আব্বাসউদ্দীন শিল্পী  হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। শিক্ষকদের আদরের ছাত্র ছিলেন তিনি। কারো কাছে কোনোদিন গানের তালিম নেননি। পল্লিগীতিতে তাঁর সাফল্য অসামান্য। পল্লিগ্রামের নির্ভেজাল জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আব্বাসউদ্দীনের প্রাণভোমরা ছিল ভাওয়াইয়া সংগীত। স্কুল থেকে ফিরতি পথে, গ্রামের পথে পথে আপন খেয়ালেই চলত সংগীতচর্চা। গ্রাম্যপথ, প্রকৃতিই ছিল তাঁর গান শেখার পাঠশালা। গ্রামের দিনমজুর, খেটে-খাওয়া মানুষের মুখনিঃসৃত নির্ভেজাল পল্লিগীতিই তাঁর সংগীতের উপাদান। ভাওয়াইয়া গান গাইতে গাইতে আপনমনে পথ চলতে ভালোবাসতেন। আব্বাসউদ্দীনের ভাষায় – ‘আমার গ্রামে ছিল বহু ভাওয়াইয়া গায়ক। সারাটা গ্রাম সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত গানের সুরে মুখরিত হয়ে থাকত। গ্রামের পূর্বে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। আমাদের আধিয়ারী প্রজারা হাল বাইতে বাইতে, পাট নিড়াতে নিড়াতে গাইত ভাওয়াইয়া  গান। সেই সব গানের সুরেই আমার মনের নীড়ে বাসা বেঁধেছিল ভাওয়াইয়া গানের পাখি।’ এভাবেই তিনি চাষির কণ্ঠের সুর অবিকল আয়ত্ত করেন।

বিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তাঁকে সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। সম্পূর্ণ নিজ প্রচেষ্টায় সংগীত রপ্ত করেছিলেন এই কিংবদন্তি গায়ক। ‘কোন বিরহির নয়নজলে বাদল ঝরে গো’ এবং ‘স্মরণ পারে ওগো প্রিয়’ গান দুটি অধ্যাপক বিমল দাসগুপ্তের সহযোগিতায় কলকাতা গ্রামোফোনে রেকর্ড করেন। একবার কাজী নজরুল ইসলামকে ছাত্রদের মিলাদ অনুষ্ঠানে কোচবিহারে নিয়ে এসেছিলেন আব্বাসউদ্দীন। তখন থেকে প্রবাদপ্রতিম শিল্পী কবি নজরুলের সান্নিধ্যে আসেন। নজরুল ইসলামকে তিনি কাজীদা বলে ডাকতেন। আব্বাসউদ্দীনের মিষ্টি কণ্ঠ শুনে কবি বলেছিলেন,‘তোমার গলার সুর কত মিষ্টি তুমি বুঝতে পারবে না যদি না রেকর্ডের মাধ্যমে শোনো। তুমি কলকাতা চলো, গান রেকর্ড করাবো তোমার।’ 

কাজী নজরুলের কথায় ও সুরে আব্বাসউদ্দীনের দরদি কণ্ঠে গাওয়া গান সহজেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে শ্রোতৃমহলে। আধুনিক গানের সংখ্যা তাঁর অজস্র। সেই সময়ে ইসলামি গানকে কণ্ঠে ধারণ করে তিনিই প্রথম সব ধর্মীয় গোঁড়ামি ভেঙে দিয়ে মুসলমান সমাজকে উদ্দীপ্ত করেন। পরবর্তীকালে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশজোড়া। স্বদেশি গান, ইসলামি গান, আধুনিক গান, উর্দু গান, পল্লিগীতি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, বিচ্ছেদী, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালাগান ইত্যাদি গেয়ে সবমহলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এই গুণী শিল্পী।

কবিগুরুর তিরোধানের দিন কলকাতা রেডিওতে শিল্পীর গান গাওয়ার ডাক পড়ে। সেদিন তিনি গেয়েছিলেন ‘ঝড়ের মেঘের কোলে/ বৃষ্টি আসে মুক্তকেশে আঁচলখানি দলে।’ তখন তিনি রাইটার্সে রেকর্ডিং এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করতেন।  

আব্বাসউদ্দীনের জীবন ছিল বর্ণময়। ছোটবেলা থেকেই গান-বাজনার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। ভিনগাঁও থেকে তখন মহররমের দল আসত। সেই বাজনা শুনে তাদের সঙ্গে তিনি চলে যেতেন। বাড়ির লোকে আবার ফিরিয়ে আনতেন। গ্রামের যাত্রাগানের ভক্ত ছিলেন। সারারাত জেগে যাত্রাপালা শুনতেন। এক যাত্রার দল তো তাঁর গান শুনে তাদের দলেই নিতে চেয়েছিল; কিন্তু আব্বাসউদ্দীনের পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে তাঁর পিতা রাজি হননি।

ছোটবেলায় বাড়িতে প্রথম কলের গান শোনার অভিজ্ঞতা থেকেই কলের গানে কণ্ঠ দেওয়ার ইচ্ছা জাগে ছোট্ট আব্বাসউদ্দীনের। শৈশবে বাড়ির ইঁদারায় শব্দের প্রতিধ্বনি তাঁর কাছে কলের গানের মতো মনে হতো। কলের গানের অনুকরণে ইঁদারায় মুখ ঢুকিয়ে গান গাইতেন।

আব্বাসউদ্দীন আহমদ বিষ্ণুমায়া, মহানিশা, একটি কথা এবং ঠিকাদারসহ বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন।

নদীবিধৌত বাংলার উত্তরের মাটি উর্বর। লোকসাহিত্যের উর্বর ভূমি উত্তরবঙ্গ, যা লোকসংগীতের বিপুল ঐশ্বর্যে মহিমান্বিত; অবশ্যই তা উত্তরের প্রাণের সংগীত, ভাওয়াইয়ার কল্যাণে, যা মানুষের অন্তরকে আবহমানকাল ধরে করেছে সমৃদ্ধ। ভাওয়াইয়া গানের পথিকৃৎ আব্বাসউদ্দীনই প্রথম গাঁয়ের মানুষের মেঠোসুরকে শহুরে মানুষের শৌখিন ড্রয়িংরুমে তুলে এনেছিলেন। দেশ ছাড়িয়ে লস অ্যাঞ্জেলস, শিকাগো, নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, টোকিও, মেলবোর্নসহ পৃথিবীর বহু দেশে তিনি এই ভাওয়াইয়া সংগীত  পরিবেশন করেন।

ভাওয়াইয়ার মূল উপজীব্য হলো ভাব বা প্রেম। তিস্তা নদীর চরে আপন খেয়ালে মোষের পিঠে চড়ে চলেছে মইষালের (যাঁরা মোষের গাড়ি চালায়, বা মোষ চড়ায়) দল। তাঁদের মনের উৎসারিত ভাব মাতৃভাষায় সংগীতের সুরমূর্ছনায় আকাশ-বাতাস প্লাবিত করে। তিস্তার চরের লোকমানুষের ভাষাই তো তাঁর মাতৃভাষা। যে-ভাষায় উথলে ওঠে প্রাণের সংগীত ভাওয়াইয়া, তাই তো তিনি গেয়ে ওঠেন – ‘কোন দ্যাশে যান মইষাল বন্ধু/ মইষের পাল লইয়া/ ওরে আইজ ক্যানেবা মইষাল তোমরা/ মইষের বাতান থুইয়ারে।’

ছেলেবেলায় নিজের অজান্তেই হয়তো আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে বাসা বেঁধেছিল সুর। গ্রামের সেই আদি সুরকে নিয়ে তাঁর ঘরকন্না, সংগীতচর্চা। আবার কাজী  নজরুল ইসলাম-রচিত বিখ্যাত ইসলামি গজল ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ তাঁর কণ্ঠে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পায় এবং এখনো জনপ্রিয়।

আবহমানকাল ধরে যা লোকমুখে প্রচলিত তা-ই লোকসংগীত। এসব সংগীতই আমাদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক, যা অমূল্য সম্পদ। জানা যায়,  উত্তরাঞ্চলের লোকসাহিত্যের উপাদানগুলো সর্বপ্রথম সংগ্রহ করেন স্যার জর্জ এব্রাহাম গ্রিয়ারসন। যদিও তিনি ইংরেজ ছিলেন, তবু বাংলা ভাষা ও লোকসাহিত্যের প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ এবং ভালোবাসা। গ্রিয়ারসন সম্পাদিত ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পঞ্চম খণ্ডে তিনি উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গার বহু গানের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যা পরবর্তীকালে আব্বাসউদ্দীন আহমদ কর্তৃক সংগৃহীত গানগুলোতেও পাওয়া গেছে।

আব্বাসউদ্দীনের কানে যে-সুর প্রথম ঝংকার তোলে তা ছিল ভাওয়াইয়া। তিনিই প্রথম ভাওয়াইয়া সংগীত রেকর্ড করে  জনমানসে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। জানা যায়, তাঁর প্রথম গান ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে’, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা  কান্দে রে’। যদিও তিনি ‘তোরষা নদীর ধারে ধারে ও/ দিদি লো মানসাই নদীর পাড়ে …’ ভাওয়াইয়া গানটি প্রথম গ্রামোফোনে রেকর্ড করেন; কিন্তু কোম্পানি গানে কিছু পরিবর্তন আনলে শিল্পী মর্মাহত হন। এই বিষয়ে তিনি আমার শিল্পী জীবনের কথা গ্রন্থে লেখেন, ‘খরস্রোতা ছোট্ট পাহাড়ি নদী তোরষা – কুচবিহারের পাদমূল ধৌত করে তরতর বেগে চলেছে। তারই তীরে তীরে গান গেয়ে চলেছে মোষের পিঠে করে দোতারা বাজিয়ে মেষ-চালক মৈশালের দল। তাদের কণ্ঠের সুর ছেলেবেলায় আমার কণ্ঠে বেঁধেছিল বাসা। তাদের মুখের ভাষাই আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষাকে অবিকৃত রেখে গান দিতে পারলাম না। মনে জেগে আছে ক্ষোভ।’ যদিও পরবর্তীকালে আব্বাসউদ্দীনের শর্তে রাজি হয়ে তাঁর মাতৃভাষাকে অবিকৃত রেখে গ্রামোফোনে গান রেকর্ড করা হতে থাকে।  

পল্লিকবি জসীমউদ্দীন-রচিত ‘আল্লা মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই …’ যার কণ্ঠে জীবন্ত হয়ে উঠেছে তিনি প্রবাদপ্রতিম  আব্বাসদ্দীন আহমদ। বাংলার কৃষিজ সংস্কৃতিতে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও তাপপ্রবাহের দরুন বৃষ্টির জন্য আকুতি শোনা যায় এমন সুরেলা সংগীতে। তাঁর রচিত গ্রন্থ থেকে জানা যায়, চিনের প্রধানমন্ত্রী একবার ঢাকায় এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে আব্বাসউদ্দীন ‘আল্লা মেঘ দে পানি  দে’ গানটি পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানশেষে রাত ৯টায় মুষলধারে বৃষ্টি নামে। গানশেষে হলের বাইরে গিয়ে শ্রোতারা তো অবাক! কারণ সেদিন সন্ধ্যার আকাশ ছিল তারকাখচিত, মেঘমুক্ত। চিনের প্রধানমন্ত্রী সেদিন ঢাকা ছাড়ার আগে বলে গিয়েছিলেন, ‘এদেশের অনেক কিছুই হয়তো ভুলে যাব; কিন্তু স্মৃতির মণিকোঠায় একটি চিত্র বহুদিন দাগ কেটে থাকবে। সেটা হচ্ছে – ‘তোমাদের দেশের শিল্পী গান দিয়ে আকাশের পানি আনতে পারে।’

আব্বাসউদ্দীন নিছক গায়ক ছিলেন না, সে-সময়ের সংগ্রামকেও ধারণ করেছিলেন তিনি এই বলে – ‘ওঠ রে চাষী জগৎবাসী ধর কষে লাঙল।’ 

১৯৩১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতায় ছিলেন, রাইটার্স বিল্ডিংয়ে অস্থায়ী পদে, পরবর্তীকালে কৃষি দফতরে চাকরি নেন। জানা যায়, তিনি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রিত্বের সময় রেকর্ডিং এক্সপার্ট হিসেবে সরকারি চাকরিতে যুক্ত হন। দেশভাগের পর স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে যান। সেখানে সরকারের প্রচার দফতরে অ্যাডিশনাল সং-অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি করেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট রাত ১২টার পর ঢাকা বেতার থেকে প্রথম সংগীত পরিবেশন করেন আব্বাসউদ্দীন। 

বিভিন্ন সময়ে তিনি আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন এবং বাংলা লোকসংগীত সম্পর্কে তাঁর ভাষণ ও গান আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসাধন্য হয়েছে।       আব্বাসউদ্দীনের একমাত্র গ্রন্থ আমার শিল্পী জীবনের কথা প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি  মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরম্যান্স, শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার  এবং স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়া আরো অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় তিনি সম্মানিত। ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রবাদপ্রতিম এই শিল্পীর জীবনাবসান ঘটে।