সাম্প্রতিক নাট্যচর্চায় বঙ্গবন্ধুর জীবনচরিত

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নাট্যচর্চায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে নাট্য-প্রযোজনার প্রবণতা অত্যন্ত আনন্দদায়ক। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর  বলিষ্ঠ  রাজনৈতিক  নেতৃত্ব  পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনা ও নিপীড়ন থেকে বাঙালিকে স্বাধিকার অর্জনের পথ দেখিয়েছে। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে এই বাংলার জনগণ ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে ‘জাতির পিতা’ উপাধিতে ভূষিত করে। আপামর বাঙালির প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে প্রাণ দিতে হয় এদেশেরই একদল বিপথগামী-উচ্ছৃঙ্খল সেনাসদস্যের হাতে। ইতিহাসের বর্বরতম সেই হত্যাযজ্ঞ বাঙালিকে আজো কাঁদায়, ভবিষ্যতেও কাঁদিয়ে যাবে।

স্বাধীন বাংলাদেশে, বিশেষ করে ’৭৫-এর হত্যাযঞ্জের পর, মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য নাটক নির্মিত হয়েছে। কিন্তু প্রায় সব নাটকেই শেখ মুজিবুর রহমান চরিত ছিল প্রচ্ছন্ন, বা বিস্মৃত। কিছু সংখ্যক নাটকে অপ্রধানভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে শুধু প্রসঙ্গ এসেছে; কিন্তু যিনি এ স্বাধীন দেশের স্থপতি, তাঁকে নিয়ে উল্লেখ করার মতো বা পূর্ণাঙ্গ কোনো নাটক রচিত হয়নি দীর্ঘ সময়ে। ব্যর্থতার সেই গণ্ডি ভেঙে গত প্রায় দুবছর ধরে শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মনির্ভর নাট্যপ্রযোজনা। সম্প্রতি এর পরিসর আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলাতেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নাটক নির্মিত হতে যাচ্ছে।

দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। বিরূপ সেই সময়ে প্রথমে যাত্রাপালাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনচরিত উঠে আসে। এরপর পেরিয়ে যায় প্রায় তিন যুগ। বাংলাদেশের নাট্যচর্চা নানা নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর এদেশের নাটক ছাড়া সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর জীবন, চেতনা-কর্ম-দর্শন ও বিয়োগান্ত পরিণতির চমৎকার সাহিত্যিক বিকাশ ঘটেছে। অসংখ্য প্রকাশনা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। শুধু মঞ্চনাটকের ক্ষেত্রেই ছিল এর ব্যতিক্রম। দীর্ঘ সময়ে গ্রুপ থিয়েটারভুক্ত দলগুলোতে বঙ্গবন্ধুর জীবনীনির্ভর একক কোনো নাট্য-প্রযোজনার তথ্য পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশের শিল্পচর্চার দায়বদ্ধ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী। দীর্ঘদিন পর গত কয়েক বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা মাত্রায় বেশ কিছু কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। নাটক রচনা, নির্মাণ ছাড়াও নৃত্যনাট্য, সংগীত, চলচ্চিত্র ও চিত্রকলায় শিল্পকলা একাডেমীর অবদান উল্লেখযোগ্য, যা ইতঃপূর্বে লক্ষ করা যায়নি।

শিল্পকলা একাডেমী সম্প্রতি আয়োজন করে ‘মুক্তিযুদ্ধের নাট্যোৎসব’। এতে ঢাকার ও ঢাকার বাইরের জেলা শহরের বেশ কয়েকটি নাট্যদল অংশগ্রহণ করে। দলগুলোর প্রযোজনায় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট উঠে এলেও বঙ্গবন্ধুর দর্শন-আদর্শ কিংবা বিয়োগান্ত ঘটনাবলি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্যনির্ভর নাটক লক্ষ করা যায়নি। চলতি বছর  এ-আয়োজনে   দেশের   বিভিন্ন স্কুল-কলেজকেও সম্পৃক্ত করা হয়।

শিল্পকলা একাডেমির নিজস্ব অর্থায়নে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম শিশুশিল্পীনির্ভর নাটক মুজিব মানেই মুক্তি নির্মিত হয়েছে। নাটকটির আখ্যান রচনা ও নির্দেশনা লিয়াকত আলী লাকীর। এ-নাটকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি অপশাসন, মুক্তিযুদ্ধের বীভৎস জীবনবাস্তবতা, বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরে দেশগঠন এবং এ-মহাপ্রয়াণ উঠে এসেছে। নাটকটির প্রযোজনা নিয়ে লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘ইতিহাসনির্ভর নাট্য নির্মাণ চিরকালই কঠিন কাজ। আর একজন মহাপুরুষের সংগ্রামী জীবন নিয়ে শিল্প নির্মাণ আরো কঠিন। ইতিহাসের শিল্পিত উপস্থাপন ও জাতির পিতার একটি জাতি ও দেশ নির্মাণ এবং তাঁর মহাপ্রয়াণে নিরীক্ষাধর্মী শিল্পশৈলী, নানা ইমেজ ও কোরিওগ্রাফির ভেতর দিয়ে উপস্থাপনাই এ-প্রযোজনার মূল কর্ম। ইতিহাসের সত্যের চেয়ে শিল্পের সত্য অনেক বেশি শক্তিশালী। একটি আবেগাশ্রিত কাব্যিক শিল্প উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি এই কাজটির মাধ্যমে।’

এ-সময় শিল্পকলা একাডেমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নৃত্যনাট্যও পরিবেশন করে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক টার্গেট প্লাটুন নামে আরেকটি নাটকও প্রযোজনা করে প্রতিষ্ঠানটি। মামুনুর রশীদের রচনা ও নির্দেশনায় এ-নাটক মঞ্চস্থ হয়। এতে পাকিস্তানের শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন জীবনবাস্ততা দেখানো হয়। তবে গীতলরীতির নাটকটির বেশিদিন প্রদর্শনী হয়নি।

মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের শ্রাবণ ট্র্যাজেডি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও তাঁর বেদনাবিধুর পরিণতি নিয়ে বাংলাদেশের নাট্যচর্চার মূল স্রোতধারায় প্রথম স্বতন্ত্র নাটক। এটি রচনা করেছেন আনন জামান এবং নির্দেশনা দিয়েছেন আশিকুর রহমান লিয়ন। এক মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের ট্র্যাজিক পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে এ-নাটকে। নামকরণের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ-চেতনার সঙ্গে শেখ মুজিবের চেতনার সাদৃশ্য উপলব্ধি করা যায়।

সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার শোক-আখ্যান শ্রাবণ ট্র্যাজেডি। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে ঘটে যাওয়া ইতিহাসের বর্বরোচিত ঘটনা এর আখ্যানভাগ। নাটকের দৃশ্যে ফুটে ওঠে – সেদিন রাতে জাতিবিনাশী শব্দে খুনি মেজরদের চোয়াল নড়ে ওঠা। উচ্চারিত হতে থাকে মানবতাবিরোধী চক্রান্ত। বিস্তার হতে থাকে ষড়যন্ত্রের জাল। মিথ্যার মায়া যেন এক মুঠো মার্বেলের মতো ছড়িয়ে দেওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে। যড়যন্ত্রশেষে শুরু হয় খুনিদের অভিযাত্রা জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি অভিমুখে, ধানমণ্ডির দিকে। তাদের অভিলাষ, ইতিহাস থেকে মুছে দেবে শেখ মুজিব-অধ্যায়।

শ্রাবণ ট্র্যাজেডি নাটকে ইতিহাসের নানা চরিত্রকে সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে প্রতীকীভাবে হাজির করা হয়েছে। খুনিদের দাঁড় করানো হয়েছে মঞ্চের আদালতে।

এই নাট্যবৃত্তে নানা ভাঙাগড়া আছে। নাটকটিতে নতুন প্রজন্মের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়েছে –

যে কোল ছিল রাষ্ট্রের শিথান – সে কোল বিদ্ধ হলো খুনিদের বুলেটে। … মা তখন শ্রাবণ হয়ে ভিজছিল শ্রাবণে। জানো নাকি মানুষ শ্রাবণ কতখানি শ্রাবণ হলে বত্রিশ নম্বর বাড়িটির সিঁড়ির রক্তচিহ্ন মুছে দেয়া যাবে?

নাট্যকার আনন জামান বলেন, ‘ক্ষমতার চেয়ার লুট করতে রাজনৈতিক আর সামরিক বেনিয়াদের হাতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের মানুষদের খুন হতে হলো। ক্ষমতার মসনদের দীঘল ছায়ায় খুনি আর তার দোসররা আড়াল করলো তাদের শরীর। শ্রাবণ ট্র্যাজেডি নাটকে সত্য বলার জন্য সেই সকল খুনিকে ধূসর অতীত থেকে তাড়িয়ে আনা হয়েছে বর্তমানের রঙ্গমঞ্চে। ক্ষমতার খইলোভী রাজনৈতিক-সামরিক প্রভুদের ষড়যন্ত্রের সকল সুতা একটি একটি করে খুলে নিগূঢ় সত্য উন্মোচনের অভিপ্রায় রচিত হয়েছে নাটকটিতে। কোনো প্রকার রাজনৈতিক অভিসন্ধি সিদ্ধির জন্য নয়, ইতিহাস পাঠের জটিল আবর্ত থেকে নিরপেক্ষ সত্য রচনা করবার চেষ্টা করেছি।’ (স্যুভেনির)

মুজিব মানেই বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রতীক। এক মহাকাব্যিক ট্র্যাজিক চেতনা নাটকের পরতে পরতে। নাটকটির এ-পর্যন্ত ত্রিশের বেশি মঞ্চায়ন সম্পন্ন হয়েছে। সম্প্রতি নাটকটি পুস্তকাকারেও প্রকাশিত হয়েছে। বিয়োগান্ত এ-নাটকের সংলাপে সংলাপে যেন ক্ষুব্ধতা –

যে মানুষটা একটি পরাধীন ভূখণ্ডের মানচিত্রের রেখাগুলিকে মুক্তি দিয়েছিল – সাত কোটি মানুষকে ডাক দিয়ে শিখিয়েছিল এবারের সংগ্রাম – স্বাধীনতার সংগ্রাম – স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচনের রাষ্ট্রপতি যে মানুষটা – সেই মানুষটার পরিজন যখন থই থই রক্তের মধ্যে লাশ হয়ে পড়ে থাকে – আর মানুষটা বিশাল বুকের ক্যানভাসে স্টেনগানের ব্রাশ নিয়ে পড়ে থাকে সিঁড়িতে …

বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে সম্প্রতি ‘দৃশ্যকাব্য’ প্রযোজনা করে বাঘ শিরোনামে নাটক। রচনায় নাসরীন মুস্তাফা এবং নির্দেশনায় ড. আইরিন পারভীন লোপা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে বান্দরবান সফরে গিয়েছিলেন। সেখানকার নৃগোষ্ঠীর এক নেতা বঙ্গবন্ধুকে একটি বাঘের ছানা উপহার দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সে-বাঘটিকে ঢাকা চিড়িয়াখানায় দান করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শহিদ হলে তাঁর সেই বাঘটির ঠাঁই হয় ঢাকা চিড়িয়াখানার মাটির নিচের এক বদ্ধ কক্ষে। এ নিয়ে হাইকোর্টে মামলা হয়েছিল ১৯৯০-৯১ সালের দিকে। তাতে বাঘটির মুক্তি দাবি করা হয়। সে-খবর প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক সংবাদে। এ-বিষয় নিয়েই বাঘ নাটকের আখ্যানের সূত্রপাত।

নাট্যদৃশ্যে ফুটে ওঠে – এক বদ্ধ ঘরে দীর্ঘদিন ধরে বন্দি বাঘ। চিড়িয়াখানার মাটির নিচে প্রায় ষোলো বছর ধরে নির্মম কষ্টে কোনোরকম বেঁচে আছে বাঘটি। এর অবর্ণনীয় কষ্টে বেঁচে থাকার মূল কারণ সে ছিল বঙ্গবন্ধুর বাঘ। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে ইতিহাস নিশ্চিহ্নকরণের যে-ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তার প্রতীকী ভাবনা নাটকটিতে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর জীবনসংগ্রাম ও প্রতিকূলতা উঠে এসেছে বাঘে।

ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধুর জীবনীনির্ভর নাটক প্রযোজনা করেছে নাট্যাধার। নাটকের নাম ৩২ ধানমণ্ডি এবং। এটি একটি স্বতন্ত্র নাট্যপ্রযোজনা। রচনা আহমেদ কবীরের এবং নির্দেশনা দিয়েছেন পারভীন সুলতানা রাশা। ২০১৯ সালে এটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়। নাটকটিতে মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাদের সামাজিক ঠিকানার সংকট সৃষ্টি হলে বঙ্গবন্ধু তাঁদের ঠিকানা লিখতে বলেন ‘৩২ ধানমণ্ডি’। এ-নাটকে বঙ্গবন্ধুর মানবিকবোধ ও বলিষ্ঠ জীবনচেতনা ফুটে উঠেছে।

নাট্যাধার আরো একটি পালা প্রযোজনা করে বাংলার মহানায়ক নামে। মিলন কান্তি দে-রচিত এ যাত্রাপালার নির্দেশনা দিয়েছেন মোস্তফা কামাল যাত্রা। এতে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন, দেশাত্মবোধ, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা – এমন বিষয়গুলো তুলে ধরার পাশাপাশি প্রতিবিপ্লবীদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে তাঁকে হত্যার ঘটনাক্রমও চিত্রায়িত হয়েছে। মিলন কান্তি দে-রচিত যাত্রাপালাটি প্রথম প্রযোজনা করেছিল ঢাকার দেশ অপেরা। যাত্রাটি ঢাকার শিল্পকলা একাডেমীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও প্রদর্শিত হয়েছে। দেশের বাইরে কলকাতাতেও এ-যাত্রাপালা পরিবেশিত হয়েছে। নাট্যাধারের এ-প্রযোজনায় পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করেছেন জামাল হোসাইন মঞ্জুর। যাত্রা আঙ্গিকে আধুনিক প্রসেনিয়াম মঞ্চে মোস্তফা কামালের নির্দেশনায় এটি মঞ্চস্থ হয়েছে।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে প্রবাসী লেখক খান শওকত রচনা করেছেন অসংখ্য মঞ্চনাটক। নাটকগুলো বাংলাদেশ ও কলকাতায় মঞ্চস্থ হয়েছে। বাংলাদেশের শিখা প্রকাশনী প্রকাশ করেছে তাঁর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত নাট্যগ্রন্থ। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরেও বঙ্গবন্ধুনির্ভর নাট্যপ্রযোজনা বেড়েছে। সম্প্রতি নেপাল ও বাংলাদেশের কুষ্টিয়াতে বঙ্গবন্ধুর জীবনীনির্ভর নাট্য অত্যন্ত আলোচনা তৈরি করেছে। এগুলো ছাড়াও যাত্রাপালায় বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে মন্মথ রায়ের আমি মুজিব নই, নরেশ চক্রবর্তীর সংগ্রামী মুজিব, সত্যপ্রকাশ দত্তের বঙ্গবন্ধু মুজিবুর, ব্রজেন্দ্রকুমার দে-র মুজিবের ডাক, সাধন চক্রবর্তীর শেখ মুজিব, মৃণাল করের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তাঁর মৃতদেহের সৎকার নিয়ে প্রহসন বাঙালি হৃদয়ের মর্মমূলে আঘাত হানে। মনকে বেদনায় ভারাক্রান্ত করে তোলে তাঁর দাফনে সাবান ও কাফনের কাপড় জোগাড় করা কষ্টকর হয়ে ওঠার বিষয়টি। একটি জাতিরাষ্ট্র নির্মাণে অগ্রণী পুরুষের অন্তিম শয়ান মুহূর্তের এমন নির্মমতা খুবই দুঃখজনক। শিল্পকলা একাডেমী সম্প্রতি এমন বিষয় নিয়ে জনকের অনন্তযাত্রা শিরোনামে নাট্য প্রযোজনা করেছে। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনা মাসুম রেজার।

শিল্পকলা একাডেমী সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৬৪টি জেলায় নাট্যপ্রযোজনার উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ঢাকার মূল কেন্দ্র প্রযোজনা করেছে এ-নাটক। এটি রেপার্টরিভিত্তিক প্রযোজনা। বঙ্গবন্ধুকে তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরাই এ-প্রযোজনার উদ্দেশ্য। 

বঙ্গবন্ধু-প্রতিষ্ঠিত মসজিদের ইমামের ফজরের নামাজ পড়তে গিয়ে বুকে ধক্ করাকে কেন্দ্র করে নাটকের গল্পের শুরু। ইমাম বুঝতে পারেন, এটি কোনো অশনিসংকেত। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালের ভোররাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর তার লাশ মেজর হায়দার আলীর দায়িত্বে টুঙ্গিপাড়ায় দাফনের জন্য পাঠানো হয়। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের আর সবার লাশ ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হলেও আন্দোলনের ভয়ে জাতির পিতার লাশ পাঠানো হয় টুঙ্গিপাড়ায়। তাড়াহুড়ো করে বিনা গোসলে সেই মহান পুরুষের মরদেহ কবরে নামিয়ে দিতে বাধা দেন ইমাম। তিনি জানান, হয় শেখ মুজিবকে শহিদী মর্যাদা দিতে হবে অথবা তাঁকে গোসল করিয়ে জানাজা পড়িয়ে কবরে নামাবেন। অবশেষে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত হয়, তাঁকে শহিদী মর্যাদা দেওয়া হবে না। ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকে প্রতিবাদের ঝড়। সরকারের বিশ মিনিট বেঁধে দেওয়া সময়ে গোসলের ভালো সাবান জোটে না। অবশেষে কাপড় কাচার সাবান ও রিলিফের জন্য বরাদ্দ শাড়ির সাদা অংশ পেঁচিয়ে কবরস্থ করার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। জানাজায় দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদের আবেগে নাটকটির সমাপ্তি ঘটে।

নাটকটিতে অত্যন্ত চমৎকার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। সে দ্বন্দ্ব ও সংলাপের চাতুর্য দর্শকের হৃদয়ে আনন্দ-আবেগ সঞ্চার করে। নাটকে চরিত্র রূপায়ণে প্রত্যেকেই বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। এটা সম্ভব হয়েছে হয়তো ঢাকার প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন দলের নামকরা অভিনেতারা অভিনয় করেছেন বলেই। মৌলভি আব্দুল হালিম চরিত্রে আরণ্যক নাট্যদলের প্রথিতযশা অভিনেতা আজিজুল হাকিম অভিনয় করেছেন। হালিমের স্ত্রী চরিত্রে মুনিরা বেগম মেমী থিয়েটারের নন্দিত অভিনেত্রী। এছাড়া সাজ্জাদ আহমেদ, সৈয়দা শামছি আরা সায়েকা, শামীম সাগর, কামাল বায়েজিদ, রামিজ রাজু, খন্দকার তাজমি নূর, মারুফ কবির, সায়েম সামাদ, সাইফুল জার্নাল, মাঈন হাসান, নিয়াজ মোহাম্মদ আরিক, নাজমুল আলম লিমন, সজীব বিশ্বাস, শেখ নাইমুর রহমান, ইব্রাহিম হোসাইন, আরিফুল ইসলাম, আহমেদ ফারদিন প্রমুখের অভিনয় প্রশংসা দর্শক-প্রশংসা অর্জন করেছে।

নাটকটি প্রসেনিয়াম মঞ্চে বাস্তববাদী ধারায় উপস্থাপন করা হয়েছে। সেট নির্মাণে নেওয়া হয়েছে প্রতীকবাদের আশ্রয়। মঞ্চের পেছনে বড় বড় দরজার সাজেশন নাটকের সমস্ত সময় জুড়েই ছিল। বড় বড় দরজা নাটকের শেষ দৃশ্যে কবরকে কেন্দ্র করে স্থাপনার চরিত্রকে প্রকাশ করেছে। নাটকের ছোট   ছোট   ঘটনার   দৃশ্য   নির্মাণে  স্থান-কাল-সময় বা দৃশ্যপ্রেক্ষিতে সুস্পষ্টতা তৈরি হলে সাবজেক্টে ঐক্য আরো গভীর হয়ে উঠত। নান্দনিক বিন্যাসের চেয়ে গল্পের আবেগ তৈরিই বেশি কার্যকর হয়ে উঠেছে।

থিয়েটার গল্প ছাড়াও প্রকাশীয় রূপ-রীতি, মঞ্চদৃশ্য, অভিনয়, আলোকসম্পাত, পোশাক, কোরিওগ্রাফিসহ দৃশ্যরূপের নানা সুসমন্বয় ও নান্দনিক পরিবেশনের ওপর নির্ভরশীল। এমন অজানা হৃদয়স্পর্শী সত্য ইতিহাস বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষেরই জানা থাকা প্রয়োজন।

সম্প্রতি প্রদর্শিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবনীনির্ভর আরেকটি নাটক – ক্রান্তদর্শী শেখ মুজিব। নাটকটির রচয়িতা ও নির্দেশক ড. জাহারাবী রিপন। প্রযোজনা করেছে প্রগতি নাট্যম। নাটকের গল্পকথনে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত থেকে শুরু করে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময়সীমাকে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে রাজনৈতিক সহকর্মীদের নিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। গৃহাভ্যন্তর ও বারান্দায় টানটান উত্তেজনা। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি মুসাবিদার কাজ চলছে। ধীরে ধীরে নেমে এলো কালরাতের অন্ধকার। বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হলো বিমানযোগে পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে তাঁকে বন্দি করে রাখা হলো লায়ালপুরের মিয়ানওয়ালি কারাগারে। কারাগারে কঠোর সতর্কতা ও গোপনীয়তা রক্ষা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হয়। বিচারের নামে প্রহসন – তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার গোপন ষড়যন্ত্র। এই ক্রান্তিকালে বঙ্গবন্ধুর বোধ ও বিশ্বাসে কেবল মাতৃভূমির মানচিত্র – তাঁর দিব্য চোখে ভেসে ওঠে নির্যাতিত রক্তাক্ত বাংলার ছবি। যুদ্ধক্ষেত্রে যুবকের অফুরান প্রাণশক্তি – বাঙালির শৌর্য ও বীরত্বকে তিনি প্রত্যক্ষ করেন।

নাটকের প্রয়োগকৌশলে চরিত্রাভিনয় রীতিকে গ্রহণ না করে বর্ণনাত্মক বাংলা নাট্যরীতি অনুসরণ করা হয়েছে। নাটকের মঞ্চসজ্জা নিরাভরণ। এখানে জেলখানা বোঝানোর জন্য  দু-তিনটি উঁচু টোল বা প্লাটফর্ম ব্যবহার করা হয়েছে সাজেস্টিভ ফ্রেম হিসেবে। তবে নাট্যদৃশ্যের প্রয়োজনে ফুল আসে, ফেস্টুন আসে, ব্যানার আসে, পতাকা আসে, লাঠি আসে – প্রভৃতির সম্মিলনে নাটক বা নাট্যদৃশ্য হয়ে ওঠে বর্ণনাময়। অত্যন্ত সাজেস্টিভ পোশাক-পরিচ্ছদ। নাটকে বঙ্গবন্ধু চরিত্রে দুজন অভিনয় করেছেন। কোরিওগ্রাফি ও আবহসংগীতনির্ভর এ-নাটকে সাদমান সাঈদ, জাকারিয়া রনি, মো. ইবনে সাকিব, জিনিয়া আহমেদ ইশা, সানজিদা আক্তার সানজু, স্টার খান, সৈয়দ আমান, প্রসেনসিৎ বড়ুয়া প্রিন্স প্রমুখ প্রাণবন্ত অভিনয়ের চেষ্টা করেছেন। সবার প্রচেষ্টায় এর মধ্য দিয়ে জাতীয় নেতার এক রূপরেখা অঙ্কিত হয়েছে। নাটক জীবনের কথা বলে। সুন্দরের কথা বলে। সমাজ-সভ্যতা বিনির্মাণে নাটক অগ্রণী। সেখানে ইতিহাসের সত্য অনির্বাণ ঝরে পড়বে – সেটাই স্বাভাবিক। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তার স্থপতি। তাঁর জীবনের বিয়োগান্ত ঘটনা যেমন আমাদের পীড়িত করে, তেমনি তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও জীবনাদর্শ আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাঙালি মানসের মৌল শক্তি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে হাজারো নাটক নির্মিত হোক। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ুক ইতিহাসের সত্য। তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হোক আগামী প্রজন্ম।