মা, প্রিয় মা : ফরাসি ভাষার কথা

ভাষান্তর : জি এইচ হাবীব

আধুনিক ফরাসি ভাষার সঙ্গে তার মায়ের সম্পর্ক বড় নিবিড়। সত্যি বলতে কী, মাকে নিয়ে ভাষাটির একটি আচ্ছন্নতা আছে। লোকে হয়তো মনে করে, এমন একটি দৃশ্যত চোস্ত ভাষার অনেক আগেই পরিণত দশায় পৌঁছানোর কথা ছিল। শত হলেও ভাষাটির বয়স এক হাজার বছরেরও বেশি, অন্য কিছু ভাষার সঙ্গেও সেটা ওঠাবসা করেছে, বিশ্বের নানান জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু না; ভাষাটি ভালো করে খেয়াল করুন, দেখবেন, সেটা এখনো তার মায়ের স্কার্ট আঁকড়ে ধরে আছে।

আর সেই মা হচ্ছে লাতিন।

জুলিয়াস সিজারই ফরাসির প্রথম বীজ বপন করেন। প্রথম খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তিনি ও তাঁর বাহিনী গঅল দখল করে নেন। ফ্রান্স তখন সেই নামেই পরিচিত ছিল। তিনি এলেন, কথা বললেন, ও জয় করলেন, এবং যখন রোমানরা পাঁচ শতক পরে বিদায় নিল, তখন তারা যে-মানুষগুলোকে রেখে গেল তারা লাতিনে কথা বলতো। মানে, সৈনিক আর বণিকের লাতিন – স্থানীয় লোকজন আগে যে কেল্টিক ভাষায় কথা বলতো সেই গঅলিশ-প্রভাবিত লাতিন। যে-লাতিন শুনে কোনো রাশভারি ক্লাসিসিস্ট মোটেই সুখী হবেন না। তারপরেও, যতই ভেজাল-মেশানো হোক, সেটাকে লাতিন বলে চেনা যেত ঠিকই। আর এভাবেই ফরাসির জন্মের সূত্রপাত ঘটল।

আগের পাঁচ শতকে কেল্টিককে উচ্ছেদ করে দিয়ে পরবর্তী পাঁচ শতক লাতিন গঅলের উত্তরাঞ্চলে আধিপত্যের জন্য জার্মানিকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলো। আরো ঠিক করে বললে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল নতুন শাসকদের মুখের ভাষা ফ্র্যাংকিশ। ক্লোভিস, বেঁটে পেপিন আর শার্লামেনের মতো প্রখ্যাত মধ্যযুগীয় নৃপতিরা সবাই দ্বিভাষিক ছিলেন : ফ্র্যাংকিশ ছিল তাঁদের মাতৃভাষা এবং তাঁরা গৃহশিক্ষক রেখে লাতিন শিখেছিলেন। যে-কোনো সামাজিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চাকাক্সক্ষা বিশিষ্ট  মানুষই  তাই  করতেন।  আর  এদিকে,  সাধারণ, গরিব-গুর্বো লোকজন সেই ভাষাতেই বাতচিত চালিয়ে গেলেন যা কি না তখন ছিল আসলেই বড্ড বাজে লাতিন। এতটাই বাজে যে সেটা lingua romana rustica বা ‘গেঁয়ো রোমান ভাষা’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। জুলিয়াস সিজার যদি দেখতে পেতেন, তিনি যে-ভাষা প্রবর্তন করেছিলেন সেটার কী হাল হয়েছে, তাহলে তিনি তাঁর কবরেই ভিরমি খেতেন। ছয়টি লাতিন কারকের মাত্র তিনটে অবশিষ্ট ছিল; নিউট্রাল শব্দগুলো ম্যাসকুলিনে পরিণত হয়েছে; এবং কয়েকটি কারক এমন বদলে গেছে যে তাদের চেনাই ভার। বেশ খানিকটা আগে গুঁড়ি মেরে ঢুকে-পড়া কয়েক ডজন কেল্টিক শব্দের সঙ্গে (charrue, মানে ‘plough’; mouton, মানে ‘sheep’) এবার শয়ে শয়ে ফ্র্যাংকিশ শব্দ বানের পানির মতো প্রবেশ করতে থাকলো (auberge, ‘inn’; blanc, ‘white’; choisir, ‘choose’)।

যখন পুরো একটি জাতির মুখের ভাষা তার শাসকদের ভাষার চাইতে আলাদা হয়, তখন শেষ অবধি এক পক্ষকে পিছু হটতে হয়। এক্ষেত্রে সেটি ছিল শাসকপক্ষ : দশম শতকের হিউ কাপে(ত)-ই ছিলেন প্রথম ফ্র্যাংকিশ নৃপতি, যিনি ফ্র্যাংকিশ না বলে তাঁর জনগণের ভাষায় কথা বলতেন (স্কুলে শেখা খাঁটি লাতিনের পাশাপাশি)। কাজেই কৃষকদের ভাষা শেষ অবধি রাজকীয় ভাষায় পরিণত হলো। সেই lingua romana rustica পরিণত হলো `lingua Romana‘ বা রোমক ভাষায়। আমরা সেটাকে এখন প্রাচীন ফরাসি নামে জানি, যদিও ‘ফরাসি’ বা ‘French’ (franceis, françoix, français) তকমাটি প্রচলিত হতে আরো বেশ কিছু শতক লেগেছিল।

কিছুদিন পর, ইতালিতে রেনেসাঁসের সূচনা হলো, শেষ অবধি যা গোটা পশ্চিম ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। পুরো এলাকা ধ্রুপদী প্রাচীন যুগ বা ক্ল্যাসিকাল অ্যান্টিকুইটির প্রভাবাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল এবং পশ্চিম ইউরোপীয় সব ভাষা রোমকদের আর তাদের ভাষার মোহে পড়ে গেল। এক্ষেত্রে সবাইকে ছাড়িয়ে গেল যে-ভাষা, সেটি ফরাসি। সে তার মায়ের মতো হতে চাইল, তা সেটা যতভাবে সম্ভব। অ-লাতিনীয় উৎস থেকে আসা শব্দ – বিশেষ করে জার্মানিক শব্দগুলো – তাদের আগের মর্যাদা হারাল।Sur (sour) কে হটিয়ে তার জায়গায় এলো লাতিন acide। জার্মানিক বংশগৌরবের দোষে দুষ্ট maint (many)-কে ম্লান করে দিলো beaucoup।

বহুকাল ধরে বিস্মৃত শব্দগুলোকে লাতিন টেক্সট থেকে বের করে নিয়ে এসে নবজীবন দান করা হলো। Célèbre, génie আর partriotique-কে মার্কামারা ফরাসি শব্দ বলে মনে হলেও আসলে ভাষাটির বিকাশের এই পরবর্তী অধ্যায়ে সেগুলোকে সরাসরি লাতিন থেকে আমদানি করা হয়েছিল। লাতিন masticare (chew) যা ‘গেঁয়ো রোমক’ বা rustic Roman  হয়ে mâcher-এ পরিণত হয়েছিল, সেটাকে এবার mastiquer হিসেবে পুনরুজ্জীবিত করা হলো। আর fragilis (breakable) – যেটাকে ছেঁটে ভৎল্গষব করা হয়েছিল – সেটা fragile হিসেবে নতুন করে জন্মলাভ করল (ইংরেজি ভাষা অবশ্য সেগুলোকে masticate, frail, fragile-এ রূপান্তরিত করে নিয়েছে)।

মায়ের মতো হতে হলে কেবল একই রকম ধ্বনি থাকাই যথেষ্ট নয়, দেখতেও একই রকম হতে হবে – তার মতো স্কার্ট পরতে হবে, তার ওষ্ঠরঞ্জনী লাগাতে হবে, ইত্যাদি। ফরাসি ভাষা নিঃশব্দ ব্যঞ্জনবর্ণে ভর্তি, আর সেগুলো তার লাতিন মা থেকে পাওয়া উত্তরাধিকার। হাজার হাজার c, d, f, h, l, p, r, s, t, x এবং z আমরা কাগজে দেখি; কিন্তু সেগুলোর উচ্চারিত হতে শুনি না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, temps (time, weather)-এর উচচারণ tã (তাঁ)-এর মতো; এই অনুনাসিক্য ধ্বনির জন্যই ã-এর ওপরে ‘টিলডে’ চিহ্নটি দেওয়া হয়েছে। Tant (so much)-এর উচ্চারণও একদম এক। কিন্তু আগের শব্দটি এসেছে লাতিন tempus আর পরেরটি tantus থেকে – যে কারণে বানানও দুরকম। (বেশ কিছু ক্ষেত্রে ইংরেজিও একই কাজ করেছে। যেমন, debt-এর b কখনোই উচ্চারিত হতো না, যদিও সেটা এসেছে লাতিন debere, মানে `owe’ থেকে)। আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, homme (man, human being), যার শুরু h দিয়ে; কিন্তু ফরাসিরা তা উচ্চারণ করতে পারে না। তার কারণ যে-লাতিন শব্দ থেকে সেটা এসেছে – homo – তারও শুরু h দিয়ে।

অবশ্য এসব নীরব ব্যঞ্জনধ্বনিকে উচ্চারিত হতে শোনা যায় যদি সেসবের পরে স্বরধ্বনি দিয়ে শুরু-হওয়া কোনো শব্দ থাকে। যেমন, , prenez (take) সাধারণত ‘prnay’-এর মতো শোনালেও, prenez-en (take some) শোনায় অনেকটা prnay-zã-র মতো। আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, les (plural ‘the’) শব্দে s সাধারণত উচ্চারিত হয় না; কিন্তু les amis-এ (the friends) সেটি উচ্চারিত হয় : ‘lez-ah-mee’। এখানেও লাতিন উঁকি দিচ্ছে: ষবং হচ্ছে লাতিন নির্দেশক ((demonstrative) illos/ illas (those)-এর অনুবর্তন (continuation), এবং প্রধানত অনুচ্চারিত ফরাসি বহুবচনগুলো সেসব লাতিন শব্দের উচ্চারিত অন্তিম s-এর অনুবর্তন।

তবে ফরাসিরা যখন বেশ আনুষ্ঠানিক পরিবেশে কথা বলে, তখন পরিস্থিতি বদলে যায়। তখন, অকস্মাৎ, সাধারণত শ্বাসরোধ হয়ে-থাকা এসব ব্যঞ্জনধ্বনির বেশকিছুকে উচ্চারিত হতে শোনা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তখন তারা tu as attendu (you have waited)-এর s-ও উচ্চারণ করে; কিন্তু দৈনন্দিন কথোপকথনের সময় এমন কাজ করার কথা তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না – তা অপ্রতিরোধ্য রকমের স্বতন্ত্রভাবে উচ্চারিত হয়। এবং সম্ভবত তা যে স্বতন্ত্রভাবে উচ্চারিত হয় তার কারণ কাজটা করা খুব কঠিন : বক্তাকে কথা বলার সময় শব্দটির বানান মনে মনে ভেবে নিতে হয়। অন্যভাবে বলতে গেলে, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ফরাসিভাষীকে সর্বক্ষণ মা লাতিনের প্রতিমূর্তিটিকে স্মরণে রাখতে হয়, কারণ ফরাসি ভাষাটিকে সেই মাতৃমূর্তির কথা ভেবেই গড়ে তোলা হয়েছে, এবং তার বানানের পোশাকেই সজ্জিত করা হয়েছে।

এটা যদি মাতৃ-আসক্তি না হয় তাহলে তাকে আর কী বলা যেতে পারে?

পাদটীকা

ইংরেজি ভাষাকে সবচাইতে বেশি শব্দ ধার দিয়েছে লাতিন, তার পরের স্থানেই রয়েছে ফরাসি। আটপৌরে ‘air’ আর ‘place’ থেকে শুরু করে আরো রাশভারী ‘maître d’ (হোটেল ব্যবস্থাপক) এবং ‘je ne sais quoi’ (অনির্বচনীয় কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্য)-এর মতো হাজার হাজার ফরাসি শব্দ বা অভিব্যক্তি রয়েছে ইংরেজিতে।

যে (ফরাসি) শব্দটি ইংরেজি ভাষা ‘ধার’ নিতে পারত : Terroir, কোনো ফসল ফলানো হয়েছে এমন কোনো স্থান, যা তার ভৌগোলিক, ভূতাত্ত্বিক এবং জলবায়ুজনিত বৈশিষ্ট্যের জন্য অনন্য। শব্দটি সাধারণত সুরা-সমঝদারেরা ব্যবহার করলেও সেটা অন্য যে-কোনো উৎপন্ন দ্রব্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। শব্দটি ইংরেজি ভাষায় প্রবেশোন্মুখ হয়ে আছে, অন্তত খাদ্যরসিকদের মধ্যে।

লেখক-পরিচিতি গাস্তঁ দোরেন একজন ভাষাতাত্ত্বিক, সাংবাদিক এবং বহুভাষাবিদ। তিনি ওলন্দাজ, লিম্বার্গিশ, ইংরেজি, জর্মন, ফরাসি এবং হিস্পানিতে কথা বলতে পারেন, পড়তে পারেন আফ্রিকানস, ফ্রিসীয়, পর্তুগিজ, ইতালীয়, কাতালান, ডেনিশ, নরওয়েজীয়, সুইডিশ এবং লুক্সেমবুর্গিশ। ওলন্দাজ ভাষায় তিনি দুটো গ্রন্থ রচনা করেছেন – অভিবাসীদের ভাষা নিয়ে রচিত Nieuwe tongen (New Tongues),, এবং Taaltoerisme (Language Tourism), যে-বইয়ের ওপর ভিত্তি করে ইংরেজিতে রচিত হয়েছে Lingo : A Language SpotterÕs Guide to Europe বইটি (বক্ষ্যমাণ রচনাটি এই ইংরেজি বইয়েরই একটি অধ্যায়ের তরজমা), এবং তৈরি হয়েছে Language LoverÕs Guide to Europe নামে একটি অ্যাপ। লেখার অবসরে গাস্তঁ দোরেন গান গাইতে পছন্দ করেন, এবং অবশ্যই তা বহু ভাষায়। নেদারল্যান্ডসের আমার্সফুর্টে তিনি সস্ত্রীক বাস করেন।