বিদেশি সাহিত্য ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার সাক্ষাৎকার এবং ঘোষণা

আজো স্পেনের জনপ্রিয়তম সন্তান ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। ১৯৩৬ সালের আগস্ট মাসে ফ্রাঙ্কোর পুলিশ নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করে মাঠে ফেলে চলে গিয়েছিল, সমাধিস্থ পর্যন্ত করা হয়নি। ফ্যাসিস্টদের জঘন্যতম একটি অপরাধ গৃহযুদ্ধের শুরুতেই ঘটে গেল। বিশ্ববাসী ধিক্কার জানায় এবং বরণ করে নেয়  স্পেনের  অপরাজিত বিবেককে।

লোরকা ছিলেন রিপাবলিক সমর্থক মাত্র, সক্রিয় রাজনীতি তিনি করতেন না, অথচ ‘লাল বুদ্ধিজীবী’ তকমা দিয়ে তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো।

আমরা কেন পড়ি তাঁর রচনা?

কবি, নাট্যকার, সংগীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, নাট্য-পরিচালক – এককথায় সংস্কৃতির সমস্ত শাখায় তাঁর বিচরণ; সৃজনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির বিকাশ-সম্পর্কিত জ্ঞাতব্য বিষয় আমাদের খুবই অনুসন্ধিৎসু করে তোলে। স্প্যানিশ ভাষায় তাঁর সমগ্র রচনাবলিতে আছে মণিমুক্তো, যা সৃষ্টিশীল  জগতের  কঠিন পথে হীরকদ্যুতির কাজ করে। মাত্র ৩৮ বছরের জীবনে এত কাজ  যিনি করেছেন তাঁর প্রতিটি কথাই অমূল্য রত্ন মনে হয়।                              – প্রবন্ধকার

পুরাতনী গানের প্রতিযোগিতা সম্পর্কে

প্রিয় বন্ধুরা আমার, আমি তোমাদের বলছিলাম যে, পুরাতনী গানের উৎসব হবে অনন্য। আমি কল্পনা করতে পারছিলাম যে, লা এপোকা (যুগ) পত্রিকার সম্পাদক এদগার্দো নেভিলের মতো মানুষ, যারা এর বিরোধিতা করেছিল, তারা এখন কোনো এক কোণে বসে নিজেদের নখ কামড়াচ্ছে।

সৌভাগ্যবশত অনুষ্ঠান এঁদো পুকুরে ডুবে যায়নি, চাঁদ আর বৃষ্টির আলোছায়াতে জমে উঠেছিল যেমন ষাঁড়ের লড়াই হয় আলো আর ছায়াতে।

এখন স্বপ্নের মতো মনে হয় (এত দূরের মনে  হতো কেন?) প্রতিভাদীপ্ত মাকারোনা এবং ‘পোয়েন্তে হেনিল’-এর সেই বৃদ্ধ গানওয়ালা, তিনি তো পুরাতনী গানের সর্বশ্রেষ্ঠ স্তম্ভ। ‘পোম্বো’র  চমৎকার নথিলেখক রামোন বলছিলেন যে, উৎসবের একমাত্র খামতি ছিল ভালো গায়কের অভাব, সত্যিই এখন এই জগতে সেটা বড় দুর্বলতা। আমরা সবাই তার জন্যে খুব দুঃখ করি, যেমন হেরেস-এর মহান গিটারবাদক অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। পাড়ার এক ভদ্রলোক গতকাল বলছিলেন : ‘উৎসব শেষ হয়ে গেছে’, ঠিকই বলেছেন। মানুষজন ছাড়াও কথাটা বুঝেছে মেঘের দল।

১৮ই জুন, ১৯২২

মারিয়ানা পিনেদা : ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার একটি নাটক

– ফেদেরিকো আমাকে বলো …

– হ্যাঁ, তিনি ওড-এর নায়িকা নন। একেবারেই না। মারিয়ানা বুর্জোয়া নায়িকা। গীতিধর্মী। শেষে যখন বুঝতে পারলেন যে, তাঁর প্রেমিক স্বাধীনতার প্রশ্নে তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তখন তিনি স্বাধীনতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেলেন।

– বলো, বলো, ফেদেরিকো …

– উনিশ শতকের এই ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কেউ কিছুই বলেনি। তাঁর কথা কেউ ভাবেনি। তাঁকে জনসমক্ষে তুলে ধরার দায়িত্ব ছিল আমার। এটা অবশ্যকরণীয় কর্তব্য ভাবতাম। কারণ এই চরিত্র গীতিধর্মী। এতে ওড নেই। নেই সেনা। সংবিধানের সৌধ নেই (এসব সৌধ মারাত্মক – ছেলেবেলা থেকেই কথাটা শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়তাম – সংবিধান, সংবিধান, সংবিধান)।

– আরো কিছু বলো ফেদেরিকো …

– নাটক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন তিনটি ভাষ্য আছে। প্রথমগুলো থিয়েটার হিসেবে সম্ভাবনা তৈরি করে না। একেবারেই অনাটকীয় … আমি যেটা করেছি তাতে নাটক আছে, যুগের সঙ্গে মানিয়ে যায়। এতে দুটো স্তর আছে : একটি সবার বোধগম্য, পরিসর অনেক প্রশস্ত এবং বিনোদনযোগ্য। দ্বিতীয়টিতে দুটো পটভূমি আছে – দর্শকদের একাংশ এটা ধরতে পারবেন।

ফ্রান্সিস্কো আইয়ালা

১লা জুলাই, ১৯২৭।

মারিয়ানা পিনেদা

[মারগারিতা সিরগুর কোম্পানি ‘তেয়াত্রো ফোন্তালবা’তে ‘মারিয়ানা পিনেদা’ নাটকটির অভিনয় শুরু করবেন। উদ্দীপিত গ্রানাদার নাট্যকার ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা এই নাটক নিয়ে আত্মসমালোচনা আমাদের পাঠিয়েছেন। সেটি নিম্নরূপ]

লোকে যাকে যুক্তি বলে আমার নাটকে তা নেই; কিন্তু উপস্থাপনায় অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাবে। গ্রানাদায় বড় জীবন্ত এই বিষয়, তাই পাঁচ বছর আগে এটা লিখেছিলাম। মুখ্য বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত চরিত্র আর ঘটনা ‘রোমান্স’-এর আকারে আমার শৈশব ঘিরে থাকত।

মহাকাব্যের ঘরানায় নাটকটি লেখার চেষ্টা করিনি। আমার মনে হয়েছিল যে, মারিয়ানায় থাকবে গীতলতা, সারল্য আর জনপ্রিয়তা। সেজন্যে আমি সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য নিইনি, নিয়েছি রূপকথা, যেমন মিষ্টি করে বলে রাস্তাঘাটের কথকরা।

আমার কাজটি পথপ্রদর্শক হবে – এমন কখনো ভাবিনি। আমার ‘মারিয়ানা’কে বলব খুব ‘অমিতব্যয়ী’ এক নারী। নাটকে এমন এক অনুরণন থাকবে যাতে মনে হবে না যে, তিনি খুব অপরিহার্য এক চরিত্র। নাটকের মধ্যে উদ্ভাবন আছে, ‘মারিয়ানা পিনেদা’র মন একেবারেই ভিন্ন, এই যুগে তাঁর কদর নেই; কিন্তু আমার প্রিয় বিষয় এটি। এর মধ্যে থাকবে সৌন্দর্যবোধ আর রোমান্টিকতা। তবে বলা যাবে না যে, এটি রোমান্টিক নাটক, কারণ আজ কেউ নিষ্ঠাভরে পুরনো গল্প নিয়ে ভাবে না, অতীতের ঘটনা নিয়ে নাটকের কথা বলছি। দুটো পথের কথা আমি ভেবেছিলাম : এক. জনপ্রিয় হবে যেমন রাস্তার পোস্টারে দেখা যায় (দন রামোন খুব সফল এই ব্যাপারে) আর অন্যটি হচ্ছে, আমি ভেবেছি, রাতে যেমন স্বপ্নের মতো দৃশ্য দেখা যায়, চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত এবং শিশুর মতো সরল এক পরিমণ্ডল।

যে-দুটো বিষয়ে আমি খুবই খুশি তা হলো, সালভাদর দালির অলংকরণ আর মারগারিতা সিরগুর সহযোগিতা।

এবিসি

১২ই অক্টোবর, ১৯২৭

নাটক দেখে লেখকদের প্রতিক্রিয়া

গার্সিয়া লোরকা এবং মারিয়ানা পিনেদার দর্শক-সমালোচক

[অভিনয়ের পরদিন যেন বিয়ের পরদিন। এমন দিনে আমার দায়িত্ব সাক্ষাৎকার নেওয়া, অনেক সময় কাজটা বড় করুণ – অসফল হলে অসুস্থ মানুষের খোঁজ নেওয়ার মতো। অন্যদের ক্ষেত্রে  আগের দিনের সফল মানুষ সম্পর্কে আমার বিনীত নিবেদনের কথায় সায়, এই কাজ করতে গিয়ে আমি লক্ষ করেছি যে, সফল লেখকেরা কম কথা বলেন কিংবা কিছুই বলেন না, সমালোচক এবং দর্শকের সামনে গোটা কাজটার প্রস্তুতি নিয়ে কিছুই বলতে চান না, সাধারণত এঁরা নিজেদের লক্ষ্যাভিমুখে খুব সচেতন থাকেন। এরকম ভিভেস, কিনতেরোরা, গেররেরোরা …। কিন্তু প্রাণপ্রাচুর্যে উচ্ছল, অসম্ভব প্রতিভাদীপ্ত যিনি আমার প্রশ্ন শুনে রাগ করবেন না, তিনি গ্রানাদার যুবক, তাঁর এই ‘নতুন’ ধরনের নাটক নিয়ে কথা, নাটকে তাঁর পরিমিতিবোধ, সংযম এবং নৈপুণ্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কাছে আমি তিনটি ছোট প্রশ্ন রেখেছিলাম যাতে মন্তব্যগুলো দেওয়া হয়েছিল : ‘খুশি’ (দর্শক),  ‘কৃতজ্ঞ’ (সমালোচকদের প্রতি) এবং ‘অতৃপ্ত’ (ছয় বছর আগে রচিত নাটক দেখে মন ভরেনি সৃজনশীল যুবকের, তাঁর অন্তরে একটা কিছু মোচড় দিচ্ছে বোধহয়, তাঁর কণ্ঠস্বর তেমন উচ্চকিত নয়)।

– থিয়েটার হোক কিংবা গ্রন্থ, আমার কাছে লেখাটা এক খেলা, আমার কাছে মজা, শুধু বিনোদন। এই খেলায় স্বাভাবিকভাবেই আমি চাই মজা, উৎকণ্ঠা নয়। তাই আপনাকে গুরুগম্ভীর কিছু বলতে চাই না, কোনো জটিলতায় জড়াতে চাই না। লেখক, সমালোচক, শত্রুমিত্র কারো সঙ্গেই বিতর্কে যাব না, তাতে আবার অন্য এক মজার খেলা শুরু হয়ে যাবে।

– দর্শকদের আপনি আমার হয়ে বলতে পারেন যে, আমি তাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে বেসামাল হয়ে যাইনি। তাই তাদের  শুভেচ্ছা জানাতে বেরিয়ে এসেছিলাম শান্তভাবে। তারা যখন হাততালি দিচ্ছিল, আপনি তো দেখেছেন, সবাই দেখেছে, স্টল এবং বক্সে (দামি আসনে) আমি চেনা মুখ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। কারণ আমি ছিলাম ‘খুশি এবং আত্মবিশ্বাসী’। যেহেতু সাফল্য দেখা যাচ্ছে, অন্যসব বয়স্ক লেখকের মতো অনেক বিষয়ে অসন্তুষ্ট হলেও দর্শকদের  প্রতিক্রিয়া জানতে চাইছিলাম এবং করতালি সবার মতো আমাকেও উৎফুল্ল করেছে বইকি। ঠিক আছে, আপনি তো দেখেছেন যে, আমার কাছে আকর্ষণের অর্থ হলো আনন্দ। আমি খেলার ছলে যা রচনা করেছি তাতে দর্শকদের এত উল্লাস; এই আনন্দের সঙ্গে অন্যকিছুর তুলনা চলে না।

সমালোচকদের জন্যে আমি শুরুতেই বলি যে, আমার চেনা কয়েক হাজার ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মারিয়ানা পিনেদা আছে। বীরাঙ্গনা মারিয়ানা, মা মারিয়ানা, প্রেয়সী মারিয়ানা, সুচিশিল্পী মারিয়ানা; এমনকি গ্রাম্য মারিয়ানা, যে সন্তানদের জামা-প্যান্ট সেলাই করে, বাড়িতে যারা নেমন্তন্ন খেতে আসবে তাদের জন্যে সুপ রান্না করে। কিন্তু আমি ‘এসব’ করতে চাইনি। পছন্দ করার সময় আমি বেছে নিলাম প্রেমিকা মারিয়ানাকে। এই দৃশ্যগুলো এত উচ্চকিত, নাটকীয় যে, কিছু কিছু দৃশ্য চাপা পড়ে যায়, যেমন মারিয়ানা পিনেদা প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে যখন সন্তানদের থেকে বিদায় নিচ্ছে, দৃশ্য আছে অবশ্যই কিন্তু তেমন গুরুত্ব পায়নি। অন্য অনেক দৃশ্যের মতোই আছে, তবে আমি সেগুলোর প্রাসঙ্গিকতা এনেছি। আমার নাটকে কিছু দৃশ্য না থাকলেও দর্শক কল্পনা করে নিতে পারেন এবং এই নাটকের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। মাতৃস্নেহ নেই? না, নাটকে তা নেই। যা আছে তা হলো, আমার মুখ্য চরিত্রের মধ্যে অন্যবিধ প্রেমের প্রতি অধিকতর আসক্তি দেখা যায়, সেই প্রেম আরো জোরালো; ভালোভাবে বললে বলতে হয় যে, মারিয়ানা পিনেদা স্বয়ং স্বাধীনতার প্রতিরূপ, স্বাধীনতার প্রতি প্রেমের প্রশ্ন অবান্তর, তিনি মুক্তির শহিদ নন, ওই  মহৎ আবেগের থেকে তুচ্ছতর আবেগের কাছে তাঁর দায় নেই, ‘নিজের মধ্যে অবিস্মরণীয় অপরাজেয় স্বাধীনতা’র বোধ। তাঁর মধ্যে আছে স্বাভাবিক সন্তানস্নেহ, তাঁর মুখেই একথা আছে, উদারপন্থী চক্রান্তকারীদের অভিযোগের উত্তরে তিনি বলেন : ‘আমার সন্তানরা আমাকে খাটো করুক তা আমি চাই না! আমার সন্তানদের নাম হবে চাঁদের পূর্ণ আলো। তাদের মুখ উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে, বাতাসে কিংবা বয়সে তা মুছে যাবে না! গ্রানাদার সমস্ত রাস্তায় যদি তা বলে বেড়াই, এই নামটি উচ্চারণ করতে ভয় পাবে মানুষ।’ আমার নাটকে মারিয়ানার উদারতা কি খর্ব হয়েছে? সেও একমত অবশ্যই। আমার তো মনে হয় তেমন হয়নি। পেদ্রোসা যখন তাকে আটক করে – সে স্কারপিয়া না, পেদ্রোসা -, আমার মারিয়ানা চিৎকার করে, আত্মাভিমানে আঘাত লেগেছে, তার স্বাধীনতাস্পৃহার প্রতি অবজ্ঞা : ‘আমি বন্দিনী! বন্দিনী আমি! ক্লাভেলা! এই শুরু হলো আমার মৃত্যু।’

সংবিধানপন্থীরা যেভাবে  উদার মারিয়ানা পিনেদাকে আবিষ্কার করেছে তাতে আমার বিশ্বাস নেই। আনাতোল ফ্রাঁস অনেক বাইজান্টাইন সাধুসন্তের অস্তিত্ব নেই বলে প্রমাণ করেননি? আমরা কি জানি না যে, লেফটেন্যান্ট রুইস বীর হিসেবে কখনোই পরিচিত হননি; কিন্তু তাঁকে নিয়ে একটা ‘মিথ’ সৃষ্টি করা হয়েছিল, সত্যিকারের বীর নায়ক ভেলার্দে এবং দাওইসদের পাশে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিল সেনাবাহিনী, আমাদের পদাতিক বাহিনীতে তিনি যেন গৌরবের অংশ থেকে বঞ্চিত না হন। তাছাড়া আমার মারিয়ানা হুদিত-এর চেয়ে জুলিয়েট-এর কাছাকাছি, স্বাধীনতার ওড-এর চেয়ে তিনি অধিকতর স্বাধীনতার প্রতিলিপি।

বিষয় এবং ভঙ্গিতে কী আছে? বেশ! যা আছে দৃশ্যে তার চেয়ে বেশি কিছু নেই। যতটা চেয়েছিলাম ততটা করতে পারিনি – নাটকের পটভূমিটা, তার রোমান্টিক চরিত্র, কিন্তু তাতে শ্লেষ আছে … আছে অতীত, মারিয়ানা পিনেদার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে আমি রেখেছি তোররিহোসকে গুলি করার ঘটনা, না আমার একটুও দ্বিধা ছিল না। থিয়েটারে অতীত খুব সুন্দরভাবে ব্যবহার করা যায়, বিশেষত যখন নাটকটি ঐতিহাসিক নয়, কাব্যিক। সঠিকভাবে নির্বাচিত অতীত একটা যুগের সংক্ষিপ্ত রূপ তুলে ধরতে পারে। আমার নাটকে অবশ্য খুব বেশি অতীতকে টানাটানি করা হয়নি … কিছু অনুচ্ছেদ আছে পরিশীলিত প্রকাশভঙ্গির প্রয়োজনে, আর কিছু একেবারে সাধারণ, তাই না? আমি বলব, ঠিক আছে! এই অসম অবস্থায় বৈপরীত্যটা স্পষ্টভাবে উঠে আসে, এটা থিয়েটারের আরেক সুন্দর কৌশল। শেষের দৃশ্যগুলো দীর্ঘ? ঠিকই, আমি দিতে চেয়েছি একটি চরিত্রের প্রেম, স্বাধীনতা আর জীবনের যন্ত্রণা … এগুলো তো দীর্ঘই, এমনকি সাধারণ বিচারে অস্বস্তিকর, যেমন এক চূড়ান্ত মুহূর্তে ক্লিওপেট্রার মৃত্যু ঘটে; কিন্তু আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ : ভাববেন না যে, আমি নিজেকে শেক্সপিয়ারের সঙ্গে তুলনা করছি। ব্যাপারটা কী জানেন? তাঁকে আমি মনে করি আদর্শ, এক মডেল। একজন যদি তেমন চেষ্টা করে তাহলে তাঁকে বিদ্রƒপ করা হাস্যকর, তার মানে আমার নাটকে ধ্রুপদী থেকে লোপে* পর্যন্ত সব নাটকের ছায়া থাকতে পারে, চিরায়ত নাটকের কাব্য – দুই ধারায় প্রবাহিত – শিষ্ট এবং জনপ্রিয় – গোঙ্গোরা* পর্যন্ত বলা যায়। সেজন্যে রোমান্টিক নাটক হলেও আমাদের রোমান্টিক ধ্রুপদী ঘরানা এতে নেই, তাতে নেই গার্সিয়া গুতিয়েররেস*, হার্তসেনবুশ*, এমনকি সোরিইয়াও* নেই। আঃ! তাই বলছি ‘চরমপন্থা’ পছন্দ করলেও সেদিকে যাইনি, ওটা অবশ্য এখন অতীত। আর আমি অগ্রবর্তীদের (ভ্যানগার্ড) কেউ নই।

পরিশেষে আমার কাজ নিয়ে স্বীকার করছি যে, আজ আমার স্পষ্ট মতামত বলে কিছু নেই, যা ছিল নাট্য-প্রযোজনার সময় তা এখন অনেক দূর মনে হচ্ছে। আবার যদি ওটা লিখতে বসি তাহলে অন্যরকম কিছু লিখব, সম্ভাব্য হাজার রকম পথ আছে। তাই আমি বিশ্বাস করি যে, সমালোচকরা ভিন্ন ভিন্ন চোখে কাজটার বিচার করতে পারেন, প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা।

বিদায় নেওয়ার সময় ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে বললেন : আধুনিক যুগের প্রথায় ‘ইন্টারভিউ’-এর জন্যে টাকা দেওয়া হয়। এত কথা বলার জন্যে আপনি আমাকে টাকা দেবেন, আর বলি যে, মার্গারিতা সিরগু আমার নাটকে অসামান্য অভিনয় করেছেন। স্পেনের সমস্ত নামিদামি কোম্পানি নাটকটি প্রত্যাখ্যান করার পর তিনি এই কাজ করার সাহস দেখিয়েছেন বলে আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।

উত্তরে আমি বললাম : আপনার বন্ধুত্বপুর্ণ কথার জন্যে টাকা দেওয়া যায় না, এর দাম হলো মজা, কারণ যা বলেছেন তা সত্যি এবং যথাযথ।

হুয়ান গোনজালেস ওল্মেদিইয়া

১৫ই অক্টোবর, ১৯২৭

টীকা

১. ষাঁড়ের লড়াইয়ের দর্শকদের আসনে দুটো ভাগ থাকে যাকে বলা হয় ‘আলো’ আর ‘ছায়া’।

* এঁরা স্পেন তথা ইউরোপের বহু আলোচিত কবি ও নাট্যকার।