অজন্তার ঐশ্বর্যে

অজন্তার প্রথম গুহায় প্রবেশ করে বিস্মিত হই। ধরেই নিয়েছি, এটা কোনো গুহা নয়, বরং শিল্পকর্মের গুহাঘর বা শিল্পকর্মের গ্যালারি বলা চলে। পাথুরে পাহাড় কেটে তৈরি বুদ্ধের মূর্তিসহ নানা শিল্পকর্ম বা ‘রিলিফওয়ার্ক’ এবং গুহার ছাদে-সিলিংয়ে আঁকা বিভিন্ন শিল্পকর্ম বা ‘ফ্রেসকো’ দেখে অবাক না হয়ে পারি না। তবে শিল্পকলার ভাষায় এসব শিল্পকর্মকে ‘রিলিফওয়ার্ক’ বা ‘ফ্রেসকো’ বলা হলেও এগুলো অনেকটা ভাস্কর্য রীতিতে তৈরি। সে হিসেবে সহজ ভাষায় ভাস্কর্য রীতির শিল্পকর্ম বলা যায়। আরো চমকলাগা গুহার দেয়ালে আঁকা রঙিন চিত্রগুলো। বিস্ময় আরো জাগে, যখন জানি এই গুহা বা শিল্পকর্ম খ্রিষ্টপূর্ব দুশো থেকে সপ্তম শতাব্দীর ভেতর বৌদ্ধ ভিক্ষু বা সন্ন্যাসীরা তৈরি করেছেন। নির্মাণের এতো বছর পরে এসেও এসব চিত্রকর্ম বা শিল্পকর্ম এখনো দ্যুতি ছড়াচ্ছে। এ-দ্যুতিময় শিল্পযজ্ঞ যখন দেখি, তখন সঙ্গে আছেন বন্ধু মানিক।

আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তথ্যমতে, অজন্তায় গুহার সংখ্যা ২৯টি। এর মধ্যে ১৫ ও ১৫এ – দুটি মিলে একটি। সে হিসাবে ৩০টি ধরা নেওয়া যেতে পারে। আমরা যখন প্রথম গুহার সামনে আসি, তখন সকাল। সকালে আসার কারণ কম ভিড়ে বেশি সময় নিয়ে দেখা।

অজন্তার খোদাই করা গুহাগুলো কোনোটি চৈত্য বা উপাসনালয়। কোনোটি বিহার বা সংঘারাম। চৈত্য গুহাগুলো উপাসনার জন্য আর গুহাবিহারগুলো বৌদ্ধ ভিক্ষু বা সন্ন্যাসী বা শ্রমণদের আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সে হিসেবে অজন্তার প্রথম গুহাটি বিহার।

প্রথম বলতে নির্মাণের সময় অনুয়াযী প্রথম নয়, পাহাড়ের শুরুর দিক থেকে প্রথম। এ-গুহাবিহারটি ৬০০ থেকে ৬৪২ খ্রিষ্টাদ্ধের ভেতর (চালুক্য রাজাদের আমলে) মহাযানি যুগে নির্মিত। গুহাটির সামনে বারান্দার মতো। বারান্দার সামনে ছয়টি এবং পাশে দুটি স্তম্ভ। স্তম্ভগুলো আটকোনাকৃতি ও গোলাকার। প্রতিটি স্তম্ভের ওপরের অংশে খোদাই করা বুদ্ধের ছোট ছোট মূর্তিসহ নানা রকম মূর্তি – হাতি-ঘোড়া, ফুল, লতাপাতা ইত্যাদি কারুকার্য। এসব কারুকার্য দেখে সত্যিই অবাক হই। 

বারান্দা দেখে জুতা খুলে প্রবেশ করি মূল গুহায়। ভেবেছি ছোটখাটো হবে; কিন্তু না, বেশ বড় এ-গুহাবিহারটি। চারপাশে একনজর চোখ বুলিয়ে বিস্ময় জাগে। পাথরের পাহাড় কেটে কেটে তৈরি বুদ্ধের মূর্তি, দেয়ালজুড়ে রঙিন চিত্রকর্ম আর নানা শিল্পকর্ম দেখে মনে মনে প্রশ্ন করি, কীভাবে বৌদ্ধভিক্ষু ও শিল্পীরা এই অনিন্দ্যসুন্দর কাজগুলো করেছেন?

গুহার ভেতর আলো কম। আবার অন্ধকারও নয়। গুহার মুখ দিয়ে কিছুটা প্রাকৃতিক আলো আসছে। এছাড়া অল্প আলোর ছোট ছোট টর্চ বা ফ্ল্যাশলাইট আছে, যেগুলো গুহার দেয়ালচিত্র ও শিল্পকর্মের ওপর আপতিত। তাও আবার সব শিল্পকর্মের ওপর নয়, অর্থাৎ দর্শনার্থীরা অনেকটা অন্ধকারে থেকেই উপভোগ করেন গুহার শিল্পকর্মগুলো। এছাড়া গাইডের হাতেও আছে ছোট্ট টর্চলাইট, যার সাহায্যে তিনি ছবির ওপর আলো ফেলে দর্শনার্থীদের ছবির বিষয়বস্তু বর্ণনা করেন। আলো-আঁধারি এ-ব্যবস্থার কারণ সম্পর্কে জানা গেল, যেন অতিরিক্ত আলোর তাপে গুহার চিত্র বা শিল্পকর্মের কোনো ক্ষতি না হয়। যদিও এরই মধ্যে অজন্তার অনেক গুহার অনেক চিত্র নষ্ট হয়ে গেছে নানা কারণে।

গুহার মধ্যিখানটা খোলামেলা। চারপাশে একাধিক স্তম্ভ। এসব স্তম্ভ কিন্তু গুহার ছাদ ঠেক দেওয়ার জন্য নয়। কারণ পুরো গুহাটিই পাহাড় কেটে তৈরি। তাই এর ছাদ এক অর্থে যে-পাহাড় কেটে গুহাটি তৈরি করা হয়েছে সে-পাহাড়। সে হিসাবে স্তম্ভগুলো না করলেও চলত। পরক্ষণেই মনে হলো, সম্ভবত অজন্তার শিল্পীরা এগুলো নির্মাণ করেছেন একটি ঘরের অবকাঠামোগত সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য। এসব স্তম্ভের পাশ দিয়ে করিডোরের মতো কিছুটা হাঁটার জায়গারেখে করা হয়েছে দেয়াল। এ-দেয়াল জুড়ে অজন্তার শিল্পীরা চিত্রকর্ম এঁকেছেন। এসব দেয়ালের মাঝে মাঝে ছোট ছোট কক্ষের দরজা। গুহার দিকে মুখ করে তাকালে সামনের যে দেয়াল, তার ঠিক মাঝবরাবর কিছুটা ফাঁকা জায়গা। এই  জায়গাটি পার হলে আরেকটি কক্ষ। এ-কক্ষেই আছে বুদ্ধের আসন পেতে বসা বিশাল মূর্তি। বুদ্ধ তাঁর ডান হাতের আঙুল দিয়ে বাম হাতের আঙুল ধরে আছেন। অর্থাৎ গুহায় ঢুকলে সামনে বুদ্ধের বিশাল মূর্তি আর চারপাশের ছোট ছোট কক্ষ মূলত বৌদ্ধভিক্ষু বা সন্ন্যাসী বা তাঁদের শিষ্যদের আবাসস্থল।

অজন্তা গুহার অধিকাংশ চিত্রকর্ম বা শিল্পকর্ম বুদ্ধের জীবনী বা বুদ্ধের জাতক কাহিনিনির্ভর। মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, বুদ্ধ পূর্ব পূর্ব জন্মে যেসব লীলা করেছেন, জাতিস্মর মহাপুরুষ-কথিত সেসব কাহিনিই জাতকের গল্প বা কাহিনি হিসেবে ধরা হয়। কথিত আছে, এমন গল্পের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। তেমনই কয়েকটি জাতক কাহিনির বর্ণনা আছে এ-গুহাবিহারের দেয়ালজুড়ে। এরই একটি দীর্ঘ কাহিনি – ‘মহাজনক’। সংক্ষেপে ‘মহাজনক’ জাতকের কাহিনি হলো –

মিথিলার পিতৃহীন রাজকন্যা সীবলী। রূপে-গুণে অনন্য। তিনি ঘোষণা করলেন, যে তাঁর সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন, তাঁকেই তিনি বরের মালা পরাবেন। এভাবে একে একে অসংখ্য রাজপুত্র, পণ্ডিত বা বিদ্যান রাজকন্যার প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে অপমানিত হয়ে ফিরে গেলেন; কিন্তু রাজাশূন্য মিথিলা রাজ্য এভাবে আর কতদিন চলবে? অবশেষে মিথিলার মহামন্ত্রী বললেন, ‘রাজকুমারী, আমি জানি তোমার প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে পারবেন না। বরং আমি স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করি। এরপর সেখান থেকে তুমি যাকে ইচ্ছে পছন্দ করে মালা দিতে পারো।’ সীবলী হেসে বলেন, ‘তা তো হয় না মহামন্ত্রী। আমি আমার প্রতিজ্ঞায় অটল।’

এরপর মহামন্ত্রী রাজপরিবারের গ্রহাচার্যকে ডেকে আনেন রাজকন্যার ভাগ্যে বর আছে কি না দেখার জন্য। গ্রহাচার্য বলেন, ‘বর আছে এবং তিনি দেখতে সুন্দর ও জনক হওয়ার উপযুক্ত; কিন্তু সীবলী তাঁকে আগলে রাখতে পারবেন না।’ রাজকন্যা বলেন, ‘জগতের সব রাজপুত্র, যাঁরা আমাকে দেখেছেন আর যাঁরা দেখেননি, তাঁরা সবাই আমার জন্য পাগল, আর আমি যাঁকে পাব তাঁকে আগলে রাখতে পারব না, কিন্তু কেন?’ গ্রহাচার্য বলেন, ‘এটা হবে তোমার অহমিকার দণ্ডভোগ। যেসব পাণিপ্রার্থীকে তুমি অপমানিত করেছ তাঁদেরই অভিশাপ লাগবে তোমার কপালে।’ গ্রহাচার্য আরো বলেন, ‘মহামন্ত্রী আপনি রাজহস্তীকে সাজিয়ে রাজপথে ছেড়ে দিন। রাজহস্তীই নির্বাচন করবে রাজকন্যার বর।’ রাজকন্যা হেসে বলেন, ‘তাহলে আমার প্রশ্নের উত্তর?’ গ্রহাচার্য বলেন, ‘সে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন।’

রাজহস্তী ছাড়া হলো মিথিলার রাজপথে। সেই পথে শুয়ে ছিল ধুলাময় ছেঁড়া পোশাক পরা এক যুবক। তিনি সামান্য বণিক। বাণিজ্যযাত্রায় সমুদ্রের ঝড়ে সব হারিয়ে এখন ভিখিরি। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলেন, আজ তিনি পথের ভিখিরি। তাঁর মা আছেন সুদূর চম্পানগরে। মায়ের কাছে শুনেছিলেন যে, তিনি রাজকুমার। তাঁর বাবাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছে অন্যরা। পরে তাঁর গর্ভবতী মা তাঁকে নিয়ে পালিয়ে বাঁচেন। আশ্রয় নেন অনেক দূরে। সেখানেই ছেলেকে তিনি বড় করেন। গোপন রাখেন পিতৃপরিচয়।

রাজহস্তী এসে দাঁড়ায় যুবকের সামনে। সঙ্গে মহামন্ত্রী। যুবকের নাম-পরিচয় জানতে চান মহামন্ত্রী। যুবক বলেন, ‘নাম মহাজনক। জাত ক্ষত্রিয়। পিতার পরিচয় জানি না। মা গোপন রেখেছেন।’ মহামন্ত্রী যুবককে খুলে বলেন রাজকন্যার কথা। রাজি হন যুবক। তাঁকে আনা হয় রাজ্যে। সীবলীর প্রশ্নের উত্তরও তিনি দেন। সম্পন্ন হয় বিয়ে।

বিয়ের পর মহাজনক তাঁর মাকে আনতে চম্পানগরে লোক পাঠান। মা এসে দেখেন এটা সেই রাজ্য, যেখান থেকে তিনি পালিয়েছিলেন আর যাকে তাঁর ছেলে বিয়ে করেছে সে সম্পর্কে তারই বোন। রাজমাতা এ-তথ্য গোপন রাখলেন। ছেলেকে তিনি সুখী দেখতে চান। আবার এ-পাপ সহ্যও করতে পারছেন না। তিনি ডেকে পাঠান গ্রহাচার্যকে। রাজপরিবারে এই গ্রহাচার্য আছেন দীর্ঘদিন। তিনি রাজমাতাকে দেখে চিনে ফেলেন।

রাজমাতা ডেকে পাঠান পুত্রবধূকে। বলেন, ‘তোমাদের সন্তান দেখতে চাই।’ রাজকুমারী চেষ্টা করেন; কিন্তু রাজকুমার থাকেন অন্য ধ্যানে। তাঁর এ জগতসংসার ভালো লাগে না। একদিন তিনি গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসীজীবন শুরু করেন। রাজকুমারী অনেক বাধা দিলেও তাতে কাজ হয় না। তারপর একদিন রাজকুমারীও সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করেন। গ্রহাচার্য বলেন, ‘তাঁরা দুজনেই সিদ্ধিলাভ করবেন আর রাজকুমারীর আশাও পূর্ণ হবে। তবে এ-জন্মে নয়। বহু পরজন্মে মহাজনক রাজবংশে জন্ম নেবেন সিদ্ধার্থ গৌতম রূপে। অন্যদিকে সীবলী জন্ম নেবেন যশোধরা রূপে। তাঁদের ছেলে হবে। নাম হবে রাহুল।’ 

মহাজনকের এ-কাহিনিচিত্রটি আছে প্রথম গুহার একপাশের দেয়ালে। এর পাশে আছে সঙ্গপাল জাতকের কাহিনি। সংক্ষেপে এ-কাহিনি হলো – 

বারানসি মহারাজের পুত্র রূপে জন্ম নিলেন বোধিসত্ত্ব। তিনি উপযুক্ত হলে কাশীরাজ রাজ্যের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে একটি নির্জন হ্রদের তীরে ছোট্ট ঘর বানিয়ে সন্ন্যাসী জীবনযাপন করতে লাগলেন। সেই হ্রদে বাস করতেন নাগরাজ সঙ্গপাল। তিনি প্রতিদিন ওই সন্ন্যাসীর কাছে ধর্মকথা শুনতে আসতেন। এরই মধ্যে একদিন বোধিসত্ত্ব পিতাকে দেখতে এসে নাগরাজ সঙ্গপালকে দেখতে পান। তখন বোধিসত্ত্বের বাসনা জাগে নাগরাজ হওয়ার। পরজন্মে বোধিসত্ত্ব ঠিকই নাগরাজ হয়ে জন্মান; কিন্তু নাগলোকের বিলাস, নাগরাজ প্রাসাদের ঐশ্বর্য কিছুই তাঁর ভালো লাগে না। অতঃপর বোধিসত্ত্ব বুঝলেন, দূর থেকে মনে হয়েছে নাগলোকে অনেক সুখ, আসলে তা নয়, বরং ভোগে সুখ নেই, ত্যাগেই সুখ। বোধিসত্ত্ব ঠিক করলেন, জগতের কল্যাণে আত্মোৎসর্গ করবেন। তিনি নাগলোক ত্যাগ করে গ্রামের পথে একটি পিঁপড়ের ঢিবির ওপর বিশ্রাম নিতে থাকেন আর মনে মনে বলেন, ‘আমার দেহের চামড়া দিয়ে যদি কোনো চামড়া ব্যবসায়ী লাভবান হয় হোক।’ এরই মধ্যে কয়েকজন শিকারি সে-পথ দিয়ে যাওয়ার সময় নাগরাজকে দেখতে পায় এবং তাঁকে বন্দি করে। তারা নাগরাজের নাক দড়ি দিয়ে বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যায় রাজপথ ধরে; কিন্তু নাগরাজ কোনো প্রতিবাদ করেন না। এরপর আলারা নামে একজন সমৃদ্ধিশালী স্বর্ণের দামে বোধিসত্ত্বকে উদ্ধার করে তাঁর রাজপ্রাসাদে নিয়ে যান। সেখানে বোধিসত্ত্বকে রাজ অতিথি করে রাখা হয়। সেখানে তিনি প্রায় বছরকাল থাকেন। এ-সময়ে আলারা বোধিসত্ত্বের কাছে ধর্মের কথা শোনেন এবং তিনিও বুঝতে পারেন ঐশ্বর্যে শান্তি নেই। শেষ পর্যন্ত বোধিসত্ত্বের কাছে তিনিও সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।

আরেকটি কাহিনির নাম – ‘অবলোকিতেশ্বর পদ্মপাণি’। এর ঘটনাসংক্ষেপ এমন –

অবলোকিতেশ্বর একজন বোধিসত্ত্ব। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, এ-বিশ্বের সব জীবের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি ব্যক্তিগত নির্বাণ লাভে সচেষ্ট হবেন না। জগতের সব পাপী-তাপীকে নিয়েই তাঁর মুক্তির অভিযাত্রা। এজন্য তাঁর চরিত্রে একটা বৈপরীত্য আছে – সব পাওয়া, সব হারানো। 

এসব কাহিনিচিত্র ছাড়াও এই গুহায় অজন্তার শিল্পীরা তুলে ধরেছেন শিবি, বুদ্ধ ও মার, কৃচ্ঞা-রাজকুমারী, খুসরৌ-শীরীন ও চম্পেয় জাতকের কাহিনি। অজন্তার শিল্পীরা এসব কাহিনি বর্ণনা করেছেন খণ্ড খণ্ড চিত্রের মধ্য দিয়ে। সেটা কখনো পাশাপাশি, আবার কখনো ওপর-নিচে এঁকে। দেয়ালের পাশাপাশি কাহিনিচিত্র আছে গুহার ছাদ জুড়েও। অবশ্য সব কাহিনিচিত্র এখন আর স্পষ্ট নেই। অনেক কাহিনিচিত্রই নষ্ট হয়ে গেছে। যেটুকু আছে সেগুলো আঁকা হয়েছে প্রায় ১৪০০ বছর আগে – এ-গুহার নির্মাণের সময় অনুযায়ী ৬০০ থেকে ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। অথচ এখনো কি দারুণ বর্ণনাময়। শুধু চিত্রই নয়, ভাস্কর্য রীতির শিল্পকর্মগুলোও অনেক বর্ণনাত্মক। 

এই গুহার অন্যতম আকর্ষণ হলো চার হরিণের এক মাথা বিশিষ্ট শিল্পকর্ম। এটি একটি স্তম্ভের একেবারে ওপরের অংশে আছে। শিল্পকর্মটি খুব বড় নয়। চারকোনা একটি বাক্সের ভেতর। এর দুপাশে আছে দুটি করে চারটি মূর্তি। হরিণের ঠিক নিচে স্তম্ভের দুই কোণে আছে একটি করে দুটি মূর্তি। দেখলে মনে হবে, মূর্তি দুটি তাদের হাত ও পিঠ দিয়ে দিয়ে ওপরের ছাদ ঠেক দিয়ে রেখেছে। সত্যিই ছোট্ট হলেও চার হরিণের এ-শিল্পকর্ম দেখে অনুমান করা যায় অজন্তা শিল্পীদের ধৈর্য্য ও নৈপুণ্য।

শুধু পাথর কেটে শিল্পকর্মই নয়, দেয়ালের কাহিনিচিত্রে যেসব রাজদরবার, আসবাব, তৈজসপত্র, কাঠের কারুকার্য, পোশাক, গহনা বা নারীদের সাজপোশাক অজন্তার শিল্পীরা নিপুণভাবে এঁকেছেন, তা দেখে মনে হয়, এগুলো সে-সময়ের জীবন্ত কোনো মডেলের অনুকরণে বা বাস্তবচিত্র অবলম্বনে করা। অবশ্য ইতিহাসের পাতায় অজন্তার অনেক আগেও সভ্যতা বা সংস্কৃতির নানা দৃষ্টান্তের নমুনা রয়েছে। হয়তো সেসবই পরম্পরা বা ইতিহাসের মাধ্যমে অজন্তার শিল্পীরা জেনেছেন এবং সে অনুযায়ী এঁকেছেন। শিল্পের ইতিহাসে সে-ব্যাখ্যাও আছে।

ছবি : লেখক