ফ্লোরিডায় আদিবাসী শিল্পী উইন্ডড্যান্সার ও জ্বরতপ্ত পৃথিবী

দিনচারেক ধরে ফ্লোরিডায় আমেরিকার আদিবাসীদের মিউজিক ফেস্টিভাল নিয়ে মজে আছি। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন যুক্তরাষ্ট্রে ‘নেটিভ আমেরিকান’ বা ‘আমেরিকান ইন্ডিয়ান’ নামে পরিচিত। এদের নৃত্যগীতের এই বিচিত্র জলসাটি আয়োজিত হয়েছে মেলবোর্ন শহরের প্রান্তিকে, উইকাহাম নামক বিরাট পার্ক সংলগ্ন গাছ-বিরিক্ষ-হ্রদ ও হরিণে ভরপুর একটি উপবনে। আদিবাসীদের হরেক কিসিম গোত্র থেকে আগত নানা ধরনের সমঝদাররা উপবনে ক্যাম্পিংয়ের কায়দায় তাঁবু খাটিয়ে দিন গুজরান করছেন। আমি তাদের সঙ্গে শরিক হয়ে হালকা একটি তাঁবুতে ডেরা বেঁধেছি। 

 সকাল ও দুপুরে আয়োজিত পরপর দুটি নৃত্যগীতে ভরপুর অধিবেশনের পর, আমি ফুড-কার্টের সামনে পাতা চেয়ারে বসে স্যান্ডউইচের সঙ্গে এক পেয়ালা আইস-টি পান করি। তারপর ফিরে যাই তাঁবুতে। বিকালের ওষুধ-বিসুদ তাড়াহুড়া করে গিলে অতঃপর ফের রওনা হই, মিউজিক মাইফেলের মূল মঞ্চের দিকে। ওখানে উইন্ডড্যান্সার নামে সুখ্যাত একজন নেটিভ আমেরিকান শিল্পীর নৃত্যগীতের কথা আছে। এ-প্রোগ্রাম মিস করার প্রশ্নই ওঠে না। 

যাওয়ার পথে শাপলা পুকুরের মতো ছোট্ট হ্রদটি ঘুরে যাই। পাড় থেকে সামান্য দূরে ঘন ঘাসে ছাওয়া ফুট তিনেক উঁচু ডাঙার ঢালুতে একসারি গর্ত। প্রতিটি গর্তের মুখে বসে রোদ পোহাচ্ছে ভারি দেহের বেশ কয়েকটি স্থলচর কচ্ছপ। তাদের গলার নিচে ছড়ানো গুচ্ছ গুচ্ছ লেটুস পাতা। 

আদিবাসী নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে দীর্ঘ জীবনের প্রতীক কচ্ছপদের কদরদানি প্রচুর। আন্দাজ করি, মিউজিক মাইফেলে আগত কোনো আদিবাসী হয়তো কচ্ছপদের লেটুসপাতার প্রসাদ জুগিয়ে গেছেন। বিশাল একটি বুদবুদ পালের মতো ভেসে আসে। বুদবুদের সাবানগোলা ত্বকে আলো পড়ে ফুটে উঠেছে রামধনুর আভা। বর্ণাঢ্য গোলকটি ওক গাছের কাণ্ডে ধাক্কা খেয়ে বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে ধেয়ে আসে, পরপর খানিক ছোট সাইজের বুদবুদ-বৃত্ত। আমি ঘুরে ঘাড় বাঁকিয়ে রামধনুময় বৃত্তের উৎস খুঁজি।

হ্রদের জলঘেঁষে পা ছড়িয়ে দীর্ঘ ঘাসে বসেছেন মানুষটি। তাঁর কামানো মস্তকের তালুতে বৃত্তাকার শেইপের একগুচ্ছ চুল। তাতে সজারুর কাঁটা দিয়ে তৈরি সবুজ রঙের একখানা পাখা আটকানো। আদিবাসী এই ভদ্রসন্তানের হাতে জায়ান্ট সাইজের আতশি কাচের মতো দেখতে একটি ফ্রেম। তা বালতির সাবানগোলা জলে চুবিয়ে তিনি আয়েশ করে ফুৎকারে সৃষ্টি করছেন রংধনু-প্রতিফলিত বুদবুদ। 

তাঁর ঢোলা পিরহানের পিঠে বড় বড় হরফে কিছু লেখা। আমি বাক্য-দুটো আগ্রহ নিয়ে পাঠ করি, ‘রিলিজড্ ফ্রম প্রিজন ইন টু থাইজেন্ড ফাইভ। সিন্স দেন লস্ট ইন্টারেস্ট ইন ভায়োলেন্ট ক্রাইম।’ মানুষটি জেল খেটে ছাড়া পেয়েছেন দু-হাজার পাঁচ সালে, অর্থাৎ পুরো চোদ্দো বছর তিনি মুক্ত হালতে বিরাজ করছেন এবং আগ্রহ হারিয়েছেন হিংসাত্মক অপরাধে। ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য, তবে এ-ধরনের ব্যক্তিগত ঘোষণা শার্ট বা জ্যাকেটের পিঠে লিখে কাউকে ঘোরাফেরা করতে আমি ইতিপূর্বে দেখিনি! পুরুষটি নির্ঘাৎ ব্যতিক্রমী চরিত্রের। ভাবি, কাছে গিয়ে তাঁকে ‘হ্যালো’ বলে শুভেচ্ছা জানাবো।

‘মিঁয়াও মিঁয়াও’ আওয়াজে দীর্ঘ ঘাসের গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে আসে একটি মার্জার। সবুজাভ রঙে লোম রাঙানো বিড়ালটি বেজায় সুদর্শন। সে চোখের তারায় কৌতূহল ফুটিয়ে দরাজ স্বরে ফের ‘মিঁয়াও’ বলে লাফিয়ে ওঠে বুদবুদ-ওড়ানো মানুষটির কোলে। তিনি ঘুরে তাকিয়ে ভারি মিঠে করে হেসে বলেন, ‘আই অ্যাম ইনোসেন্ট নাউ।’ 

 আমি এগিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে বলি, ‘আই অ্যাম সো গ্ল্যাড টু ফাইন্ড আউট দ্যাট ইউ আর ইনোসেন্ট। আর ওই যে হিংসাত্মক অপরাধের ব্যাপারে আপনি আগ্রহ হারিয়েছেন, এটা আমি খুব আপ্রিসিয়েট করি। অ্যাজ আ  ম্যাটার অব ফ্যাক্ট, আমি নিজেও একজন ননভায়োলেন্ট ব্যক্তি। আই অ্যাম শিওর, আই ক্যান বি আ ফ্রেন্ড অব ইয়োরস।’ 

আমরা পরিচিতি হই। করোটিতে সজারু কাঁটার পাখাওয়ালা পুরুষটির নাম নাথানিয়েল কলবার্ট। তাঁর শরীরে আদিবাসী মোহাক গোত্রের বেশ খানিকটা রক্ত আছে। তিনি বলেন, ‘পুরো পাঁচ বছর মেয়াদ খেটে বেরোনোর পর থেকে আমি সাত্ত্বিক হালতে দিনযাপন করছি।’ তারপর জানতে চান, ‘আর ইউ ইন্টারেস্টেড টু হিয়ার মাই সাইড অব দি স্টোরি?’ আমি ‘অবকোর্স’ বলে আগ্রহ দেখাই, তবে  সঙ্গে সঙ্গে একটি অজুহাতও হাজির করি, বলি, ‘লুক, মূল মঞ্চে বিকালের অনুষ্ঠান শুরু হতে যাচ্ছে, এটা মিস করতে চাই না, পরে না হয় আপনার সঙ্গে কথা বলবো।’ আমার অজুহাতে নাথানিয়েল কিছু মনে করেন না, বলেন, ‘আই আন্ডারস্ট্যান্ড ইয়োর ইন্টারেস্ট ইন মিউজিক। হয়তো আমাদের ফের দেখা হবে, তখন না হয় কথা বলা যাবে।’ 

আমি উঠে পড়ি। নাথানিয়েল পেছন থেকে বলে ওঠেন, ‘ওয়েট আ মিনিট প্লিজ, কোথাকার লোক আপনি – জানতে একটু কৌতূহল হচ্ছে যে।’ আমি জবাব দিই, ‘বাংলাদেশ।’ তিনি ফের জানতে চান, ‘ওয়াজ বাংলাদেশ নৌন অ্যাজ বেঙ্গল ইন দ্য পাস্ট?’ আমি সম্মতিসূচকভাবে মাথা হেলাই। 

তিনি মিঠে হেসে বলেন, ‘দেয়ার ইজ অ্যান ইন্টারেস্টিং কোইন্সিডেন্স। আমার বিড়ালটিও বেঙ্গল প্রজাতির। ডু ইউ থিংক অরিজিন অব দিস ক্যাট ইজ অলসো ফ্রম বেঙ্গল?’ এ-প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই, তাই অপারগতা প্রকাশ করে ফের গুডবাই বলি। নাথানিয়েল পেছন থেকে আওয়াজ দেন, ‘দিস ইজ দ্য বেস্ট ক্যাট ইন দিস হৌল ওয়ার্ল্ড, এভরিবডি লাভস্ হার।’ 

মঞ্চ থেকে বাঁশরী ও ঢোলকের আওয়াজ ভেসে আসছে, তাই আমি জোর কদমে ওদিকে এগোই। দু-পা সামনে বাড়তেই দেখি, ঘাস মাড়িয়ে খুব অন্তরঙ্গভাবে পরস্পরের কাছাকাছি হয়েছে দুটি স্থলকচ্ছপ। এদের দিনযাপনে প্রণয়-পিরিত কিংবা ডেটিং প্রথা প্রচলিত আছে কি না, বলা মুশকিল, তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এরা তাই করছে।

মঞ্চে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য কোনাকুনি ফাঁড়ি-পথ ধরতেই, আধ-জংলা ট্রেইলে মাটিতে প্রোথিত একটি নারীমূর্তি দেখে থমকে দাঁড়াই! ‘ফরেস্ট স্পিরিট’ নামে এই ভাস্কর্যটির প্রতিকৃতি আগেও দেখেছি, আন্দাজ করি, শিল্পকর্মটি হয়তো কোনো অরিজিনালের নকল। 

ঘটনা যা-ই হোক, তার অভিঘাত ঠিকই আমাকে স্পর্শ করে। দিন-কে-দিন জঙ্গল যেভাবে উজাড় হচ্ছে, এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমেরিকার আদিবাসী সমাজ। বনানীকে তাঁরা প্রাণহীন স্রেফ কাঠ বিবেচনা করেন না। তাঁদের কাছে বন-জঙ্গলেরও আছে আত্মা এবং তা বুলডোজারে বিক্ষত হলে ব্যাপকভাবে সাফার করে তরুলতা। কাউকে হত্যা করে লাশ গুম করলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সেরকম একটি অরণ্যকে উৎপাটন করলে তার আহত আত্মা আশ্রয় নেয় চাপ-চাপ মাটির তলায়, তার কবরের ওপর জমতে থাকে শ্যাওলার সবুজ স্তর। 

 আধ-জংলা ট্রেইল থেকে বেরিয়েই চলে আসি, মঞ্চ ঘিরে জড়ো হওয়া দর্শক-শ্রোতা ও তামেশগীরদের পরিসরে। এখানেও আসরের মধ্যিখানে প্রচুর জায়গা খালি রেখে স্থাপন করা হয়েছে আরেকটি প্রস্তরমূর্তি। তার চতুর্দিকে তাজা পত্রালি দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে বেদি। এই ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে গ্রিক আর্থ গডেস বা পৃথিবীর অধিষ্ঠাত্রী দেবীর রূপকলার অনুকরণে। অনুমান করি, আদিবাসী নেটিভ আমেরিকানদের মিউজিক মাইফেলের হিল্লা ধরে এ-উপবনে আজ জড়ো হয়েছেন কিছু প্রকৃতি ও পরিবেশ সচেতন শিল্পী। নেটিভ আমেরিকানরা যে সমমনা ভিন্ন সংস্কৃতিকে তাঁদের প্ল্যাটফর্মে অন্তভুর্ক্ত করছেন, এ-বিষয়টি আমার ভালো লাগে।

হরেকরকমের পাখির পালকের শিরোভূষণ পরে মঞ্চে এসে দাঁড়ান এড উইন্ডড্যান্সার। মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্য থেকে আগত এ নৃত্যশিল্পী ও বংশীবাদকের শরীরে বইছে নাটিচোক ও চিরোকি সম্প্রদায়ের মিশ্রিত শোণিত। তাঁর কাছে রাখা বিশাল একটি ঢোলক থেকে সৃষ্টি হচ্ছে নেপথ্যসংগীত। এড উইন্ডড্যান্সার তাতে বাঁশরীর ধ্বনিকে অনায়াসে মেশান। 

তাঁর সুরধ্বনিকে যেন শরীরে ধারণ করে জমায়েতে নেমে আসে হরিণের শিং হাতে এক নারী। তার চোখমুখ লাল ও কালো রঙের যুদ্ধসাজে রঞ্জিত। মৃগশিংয়ের আংটায় আটকানো একটি বড়সড় ঝিনুক, তাতে পুড়ছে সেইজ গ্রাস। মেয়েটি মৃদুপায়ে হাঁটতে হাঁটতে ঈগল-পালকের পাখা দিয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে সুগন্ধি ধোঁয়া, এবং বংশীবাদনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে জপছে ‘টুসওয়ে চা … টুসওয়ে চা।’ 

আমার পাশের চেয়ারে বসা একজন আদিবাসী পুরুষ হাত জোড় করে ফিসফিসিয়ে বলেন, উইন্ডড্যান্সার জন্মভূমির বন্দনা করছেন। তাঁর বংশীবাদন ও সুগন্ধি ছড়ানো মেয়েটির চ্যান্টিং মৃদু হতে হতে এক পর্যায়ে থেমে যায়। তবে নেপথ্যসংগীতকে বহাল রেখে উইন্ডড্যান্সার দর্শক-শ্রোতাদের তাঁর ভাষায় ‘আহানে-আসটে’ বলে গুডমর্নিং জানান। বিকাল গড়িয়ে যাচ্ছে, তাই এ-সম্ভাষণে কারো কারো কপাল কুঁচকে ওঠে। আমার পাশে বসা মানুষটি জিভ কেটে বলেন, ‘জিসাস ক্রাইস্ট, উইন্ডড্যান্সার ইজ মিক্সিং আপ থিংকস্ … আই … আই, মাত্র চার মাস আগে তাঁর স্ট্রোক হয়েছে, এখন মঞ্চে না নেমে একটু রেস্ট নিলেই পারতেন।’ 

উইন্ডড্যান্সার আরেকটু বাঁশি বাজিয়ে ফের কথা বলেন। জাহাজ ভাসিয়ে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকার উপকূলে আসার আগে এতদ অঞ্চলের আদিবাসীরা এই ভূখণ্ডকে ‘নিজি’ বা ‘কচ্ছপ দ্বীপ’ নামে অভিহিত করত। স্প্যানিশ অভিযাত্রীদের হাতে-লেখা সে-জামানার কাগজপত্রেও এ-ভূখণ্ডকে আমেরিকা নয়, বরং ‘ইসলা তরতুগা’ বা ‘কচ্ছপ দ্বীপ’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। তিনি এবার লঘুচালে নৃত্যে মেতে নিজি দ্বীপের যে-বাতাস নিত্যদিন আমাদের নিশ্বাস-প্রশ্বাসে জোগাচ্ছে বেঁচে থাকার সঞ্জীবন, তাকে প্রণতি জানান। তাঁর নৃত্যভঙ্গিতে আছে এমন এক ধরনের আবেশ, যা আমাদের ক্রমশ আচ্ছন্ন করে দিতে থাকে। 

রীতিমতো সম্মোহিত হয়ে তাকিয়েছিলাম, আপাত ম্রিয়মাণ তবে উইন্ডড্যান্সারের বলিষ্ঠ উপস্থাপনার দিকে। কেমন যেন ঝিমুনির মতো এসেছিল। মারাকাসের ঝনৎকারে জেগে উঠি ধড়মড় করে। বিকালের দিককার ওষুধ হালফিল আমার কাল হয়েছে, সেবন করলেই সমগ্র সত্তা নিস্তেজ হয়ে আসে। 

দেখি, মঞ্চে লালসালুর আলোয়ান উড়িয়ে নৃত্যে মতোয়ারা হয়েছেন উইন্ডড্যান্সার। পাশের চেয়ারে বসা মানুষটি ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘দ্যাখো, কী সুন্দরভাবে তিনি তাঁর কোরিওগ্রাফে ফরেস্ট ফায়ারকে ফুটিয়ে তুলছেন … ম্যান, আওয়ার প্ল্যানেট ইজ ওয়ার্মিংআপ এভরি সিঙ্গেল ডে …। সামথিং মাস্ট বি ডান।’ নৃত্যের কোরিওগ্রাফে এমন কিছু আছে যে, মনে হয় রোগ ও জরাজনিত ক্লান্তি ঝেড়ে আমিও উঠে দাঁড়াই, পৃথিবী উত্তপ্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে – অস্ট্রেলিয়া থেকে ক্যালিফোর্নিয়া অবধি সর্বত্র অরণ্যে জ্বলছে যে অহেতুক  অগ্নি, তার প্রতিরোধে বিহিত কিছু খুঁজি।

মঞ্চ থেকে উইন্ডড্যান্সার নেমে আসেন জমায়েতে। তাঁর নৃত্যভঙ্গিমাকে ধারণ করতে পারলে দারুণ হয়, কিন্তু খুঁজে পাই না ক্যামেরা। মাজুল হয়ে মঞ্চের শিরানায় টানানো বিরাট স্ক্রিনে ফুটে ওঠা তথ্যের দিকে নজর দিই। ১৯৭০ সাল থেকে বনানী পুড়ে ছারখার হওয়ার উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা যাচ্ছে যে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে প্রায় পঞ্চাশ বছরে চারশো গুণের মতো। ২০১৮ সালে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ঘটেছে ৫৮ হাজার ৮৩টি দাবানলের ঘটনা। এতে পুড়েছে ২.৭ মিলিয়ন একরের মতো বনাঞ্চল, ফসলি জমি ও জনপদ। পুড়ে ধ্বংস হয়েছে ১৮ হাজার ৭৩৩টি দালানকোঠা।

 উইন্ডড্যান্সার এবার নৃত্য থামিয়ে চ্যান্টিংয়ের কায়দায় জপে যাচ্ছেন আমাদের এ-গ্রহের উত্তপ্ত হয়ে ওঠার কারণ। জমায়েত থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দুটি কিশোরী মেলে ধরে একটি স্কার্ফ। তাতে ম্যাজিক মার্কার দিয়ে লেখা, ‘উই ওয়ান্ট হট ডেট, নট হট প্ল্যানেট।’ 

ডেটে পুরুষ ও নারীর আচরণ হয়ে উঠুক অন্তরঙ্গতায় উষ্ণ, এটি কামনা করে উইন্ডড্যান্সারও বলেন, ‘কিন্তু যে-জননী আমাদের সৃষ্টিতে পালন করেছেন ধাত্রীর ভূমিকা, লুক গাইজ, তাঁর শরীর জ্বরতপ্ত, উই মাস্ট বি ডুু সামথিং অ্যাবাউট ইট।’ নেপথ্য থেকে কারা যেন উলুধ্বনি দিয়ে ওঠে। আর আমার খেয়াল হয়, ছোট্টমোট্ট ক্যামেরাটি আমার কব্জিতে স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকানোই আছে, খামোকা আমি এতক্ষণ পকেটে খুলিবিলি করে খুঁজছিলাম।

এবার উইন্ডড্যান্সার পেছনে সরে পর্দার সঙ্গে মিশে গিয়ে কেষ্ট ঠাকুরের কায়দায় বাঁশি বাজান। শরীরে বর্ণাঢ্য চাদর জড়িয়ে মঞ্চে আসে তিন তরুণী। তারা শাল উড়িয়ে জ্বরতপ্ত জননীর শরীরে সুবাতাস ছড়ায়। সমগ্র জমায়েত উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে তাদের স্বাগত জানায়।

 বিরতির পর সান্ধ্য-অধিবেশনে এসে ঝিম ধরে বসে ছিলাম। চতুর্দিকে আনেকটা আমাদের মশালের কায়দায় জ্বলছে টিকি টর্চ। গায়ে শাল প্যাঁচিয়ে বিকালের অধিবেশনে ড্যান্স করা মেয়েগুলো জমায়েতের ভেতর দিয়ে হাঁটাচলা করছে। লিড ড্যান্সার মেয়েটি আইসক্রিমের কোন চুষে খাচ্ছে। তার সাথি বালিকা দুটো তাকে ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে হেসে ওঠে ফিনকি দিয়ে। 

মেয়ে দুটি কৃষ্ণাঙ্গ, আমি ইতিপূর্বে কাল গাত্রবর্ণের কোনো আদিবাসী নেটিভ আমেরিকান দেখিনি। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের হেরিটেজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে আফ্রিকা থেকে জোর খাটিয়ে ধরে আনা ক্রীতদাসদের কাহিনি। যতটা জানি, নেটিভ আমেরিকানরা কখনো ক্রীতদাস প্রথা মেনে নেয়নি। তাদের গাত্রবর্ণ ও চেহারাসুরত আফ্রিকানদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ঠিক বুঝতে পারি না, এ মেয়ে দুটো খাঁটি নেটিভ আমেরিকান ড্যান্স ট্রুপের সদস্য হলো কীভাবে? ভাবি, এ-প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে।

মঞ্চে শিল্পীদের আসতে দেরি হচ্ছে, তবে পর্দার আড়াল থেকে বেজে যাচ্ছে শ্রুতি-উদ্দীপক সংগীত। দখিনা বাতাসে ড্রাগনের কল্পিত জিহ্বার মতো আধো অন্ধকার শূন্যতায় ভাসছে মশালের দীর্ঘ শিখা। ভারি খিন্ন লাগে। বিরতির  সময় তাঁবুতে ফিরে গিয়েছিলাম। আমার লটবহরের বেশ খানিকটা গাড়িতেই রাখা আছে; কিন্তু কিছুতেই গাড়ির চাবিটি খুঁজে পাই না। আজ ক্যামেরা ও চাবি সময়মতো খুঁজে না পাওয়ার মতো দুটি ঘটনা ঘটল। ভীষণ আপসেট লাগে। একাকী ঘুরে বেড়ানো আমার অনেকদিনের স্বভাব। ভাবি, এ-ধরনের জীবনযাপন হয়তো আমি আর বেশিদিন ধরে রাখতে পারব না, বিস্মৃতির জাঁতাকলে পিষে দিক্ভ্রান্ত হালতে ঘুরপাক করব অভীষ্ট সরণিতে। 

 মশালের রহস্যময় আলো মেখে আমার সামনে এসে দাঁড়ায় রামোনা ও ল্যারি। সান্তা ফে শহরের আদিবাসী মেয়ে রামোনা আমার পূর্বপরিচিত। ল্যারির সঙ্গে গতকাল আমার কথাবার্তা হয়েছে। এ-তরুণের শরীরে আছে বেশ খানিকটা আদিবাসী রক্ত। ল্যারির বাবা আমেরিকার এক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, তবে তার জননী অস্ট্রেলিয়ার একটি আদিবাসী গোত্রের কন্যা। তাদের সঙ্গে ফের দেখা হয়ে যাওয়াতে খুশি হই। সঙ্গে সঙ্গে একটা বিষয়ে খেয়াল করি, এদের আজ বেশভূষার বদল হয়েছে ব্যাপকভাবে। ল্যারির পনিটেইলের গোড়ায় আস্ট্রেলিয়ান কাকাটিল পাখির পালক গাঁথা। তার ঢোলা টি-শার্টের ডিজাইনটিও বিচিত্র। তাতে সুইমিং পুল, লাক্সারি কটেজ ও টেনিস লনের নকশার নিচে লেখা ‘হোয়াইট ফেলা ড্রিমস্’, বা ‘শ্বেতাঙ্গ মানুষের স্বপ্ন’। রামোনাও পরেছে ট্রাইবাল মোটিফের সিøভলেস টপ। তার হারের বৃহৎ টারকুইজ পাথরে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে মশালের লকলকে শিখা। ‘ইউ টু লুকস্ ফেবুলাস’, বলে আমি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি। ল্যারি হাসিমুখে জানায়, ‘উই হ্যাভ বিন সিয়িং ইচ আদার অ্যাজ উই উয়ার ড্রাইভিং থ্রু অ্যান্ড ভিজিটিং নেটিভ আমেরিকান হট স্পটস্ … গেস হোয়াট, উই জাস্ট ডিসাইডেড টু গিভ ইট আ ট্রাই।’ 

না বোঝার ভান করে আমি প্রশ্ন করি, ‘হোয়াট ডাজ ইট মিন গাইজ, কুড ইউ টেল মি মোর?’ লাজুক হেসে গণ্ডদেশে ব্লাশের আভা ছড়িয়ে রামোনা জবাব দেয়, ‘উই আর অফিসিয়ালি ডেটিং … ইটস্ গোয়িং টু বি আ ফার্স্ট ওভার নাইট ডেট … লাইক সিøপ ওভার।’ আমি হাত বাড়িয়ে তাদের দুজনের কব্জি চেপে ধরে অভিনন্দন জানাই। ল্যারি চটজলদি বলে ওঠে, ‘ইয়েস, উই আর ডেটিং দিস ইভেনিং বাট ইউ আর ভেরি মাচ ইনক্লুডেড। প্লিজ জয়েন আস ফর ক্যাম্পফায়ার।’ আমি তাদের ‘থ্যাংক ইউ গাইজ’ বলি। 

রামোনা হাত বাড়িয়ে আমার কাঁধ স্পর্শ করে বলে, ‘প্লিজ ডু কাম, ইউ উড বি আ লাভলি অ্যাডিশন টু আওয়ার ক্যাম্পফায়ার।’ আমি তার কব্জিতে আন্তরিকভাবে চাপ দিতে গিয়ে খেয়াল করি, তরুণীটির বাহুতে উল্কি করে আঁকা দুটি মেয়ের চিত্র। ট্যাটুতে নারী দুটি বাঁশরী ও গিটার বাজিয়ে গান করছে। তারা ‘সি ইউ সুন’ বলে হাত ধরাধরি করে চলে যায়। আমি বসে বসে রামোনার বাহুতে উল্কি করে আঁকা চিত্রটির কথা ভাবি, কারা এই লাকি সিঙ্গারস্ ডুয়ো, যাদের চিত্র একটি গুণমুগ্ধ মেয়ে তার শরীরে আঁকিয়ে নিয়েছে।

 গোধূলিতে মাইফেল আরো জমজমাট হয়ে উঠেছিল; কিন্তু বসে থাকতে অস্বস্তি হয়। আমার মধ্যে গাড়ির চাবিটি খুঁজে না পাওয়ার টেনশন তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলে। গাড়িতে আমার খাবার-দাবার ছাড়া ওষুধপথ্যও রাখা আছে। এর একটা বিহিত করতে উঠে পড়ি। তাঁবুর পরিসরে ফিরে এসে দেখি, গাড়ির বনেটের ওপর ধাতব কি-রিংটি গোধূলির জাদুময় আলোয় ঝলমল করছে।

সন্ধ্যার বেশ খানিকটা পর তাঁবুতে ফিরে প্রস্তুতি নিই ক্যাম্পফায়ারে শামিল হওয়ার। ল্যারি কুক-আউটের উদ্যোগ নিচ্ছে, গ্রিলে ভাজা হবে আস্ত বেরাকুডা মাছ। আমারও উচিত কিছু খাবার নিয়ে এ-সামাজিক অগ্নিযজ্ঞে যোগ দেওয়া; কিন্তু আমার গাড়ির কুলারে যে খাবারের স্টক আছে, তা পার্টিতে নিয়ে যাওয়ার মতো না। এসব খাবার গ্রিল করা মাছের সঙ্গে ঠিক ম্যাচ করবে না। গাড়ি হাঁকিয়ে শহরে গিয়েও কিছু কিনে আনতে ইচ্ছা হয় না। অবশেষে খুঁজে-পেতে রামের একটি পাইট পাই। কিছুদিন আগে আমি পানামাতে কন্সালট্যান্সি করছিলাম। ফেরার দিন হোস্ট আমাকে শিশিটি উপহার দিয়েছিলেন। ‘রন আবুয়েলা’ নামে রামের এ-পানামেনিয়ান ব্র্যান্ডটির কমপ্লেক্স ক্যারেক্টার ও বোল্ড ফ্লেভারের জন্য সুনাম আছে। বোতলটি জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে চলে আসি ল্যারির ক্যাম্পিংলটে।

 ওখানে অগ্নিযজ্ঞ রীতিমতো জমে উঠেছে। ল্যারি ব্রাশ দিয়ে বিরাট আকারের বেরাকুডা মাছটির গতরে লেপছে মশলা ছড়ানো অলিভ অয়েল। রামোনা যবগুলোর বাকল ছাড়িয়ে রাখছে বাস্কেটে। পিকনিক টেবিলে বাঁধাকপিটি কুচি কুচি করে কাটছেন নাথানিয়েল কলবার্ট। তাঁর নিমায় গাঁথা বড়সড় একটি বোতাম, তাতে লেখা ‘আই অ্যাম আউট অব দি প্রিজন, উইশ নট টু গো ব্যাক দেয়ার অ্যাগেইন।’ 

আমাকে দেখতে পেয়ে সবজি কুটা থামিয়ে হেসে তিনি বলেন, ‘মাই গুড ফ্রেন্ড ফ্রম বাংলাদেশ, বলছিলাম না – আমাদের ফের দেখা হয়ে যেতে পারে।’ আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলি, ‘লুকিং ফরোয়ার্ড টু টক উইথ ইউ নাথানিয়েল।’ তিনি উঠে আমাকে উষ্ণ হাগে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘সো নাইস টু সি ইউ হিয়ার, সুলতান।’ বিড়ালটি ‘মিঁয়াও’ ধ্বনিতে যেন আমাকে ওয়েলকাম করে। দেখি, টেবিলের প্রান্তে একটি ঝুড়িতে তুলতুলে কম্বল মোড়া হয়ে বসে আছে সবুজ রঙে লোম রাঙানো বেঙ্গল প্রজাতির বিলাইটি।

আমি কুক-আউটে কোনো খাবার না নিয়ে আসার জন্য অপারগতা জানিয়ে রামের বোতলটি ল্যারির দিকে বাড়িয়ে দিই। সে তা আগুনের আলোয় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বলে, ‘মাই গুডনেস, দিস ইজ টুয়েলভ ইয়ার্স ওল্ড রন আবুয়েলা ফ্রম পানামা। প্রের্ফাড ড্রিংক অব পাইরেটস্।’ 

হাতের যবগুলো বাস্কেটে রেখে রামোনা বোতলটি দেখতে এগিয়ে আসে। আমি আমতা আমতা করে বলি, ‘পানীয়টি জলদস্যুদের প্রিয় হলেও, এটা পানে আমাদের মতো আম-আদমিদেরও আমোদ হবে প্রচুর।’ রামোনা খুশিমুখে আমার সঙ্গে একমত হয়ে বলে, ‘আই অ্যাম শিওর দিস ড্রিংকস্ উইল ইগনাইট সাম পিওর জয়।’ 

আমি বলি, ‘রন আবুয়েলার সঙ্গে মিক্স করার মতো কোনো ধরনের ফ্রুট সোডা আমার কাছে নেই।’ ল্যারি এগিয়ে এসে বলে, ‘হু কেয়ার্স অ্যাবাউট মিক্সিং ফ্রুট সোডা। ম্যান, দিস ক্যান বি এক্সপিরিয়েন্সড অ্যাট ইট বেস্ট বাই ড্রিংকিং স্ট্রেইট।’ সে রামোনার কাছে জানতে চায়, তার তাঁবুতে শট-গ্লাস জাতীয়  কিছু আছে কি না। সে নেতিবাচকভাবে ঠোঁট ওল্টায়। আমি অতঃপর তাদের ভরসা দিয়ে বলি, ‘লুক গাইজ, পানামার আদিবাসীরা রাম পান করে চামচ দিয়ে স্যুপ খাওয়ার মতো।’ ল্যারি তার ক্যাম্পার ভ্যানে ফিরে গিয়ে কিচেন থেকে নিয়ে আসে কাঠের গর্তওয়ালা একটি চামচ।

দুই-তিন চামচ পানেই আমাদের দারুণ আমেজ আসে। দেখি, ল্যারি গ্রিলে পুড়তে থাকা মাছ ধারালো ছুরিকায় কেটে তাতে গুঁজছে রসুনের কোয়া, কাটা পেঁয়াজ ও হালাপিনো মরিচের টুকরা। পাশে দাঁড়িয়ে রামোনা মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মূর্তিটি দেখার মতো তার দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নাথানিয়েল লাভা-রক কুঁদে তৈরি ছোট্ট একটি পাইপ বাড়িয়ে দেয়। ধূমপানে পরিসরে ছড়ায় হাওয়াইয়ান উইডের পানজেন্ট অ্যারোমা। পিকনিক টেবিলে বসে ধূমপান করতে করতে তার সঙ্গে আমারও গালগল্প জমে ওঠে। 

তরুণ বয়সে সার্জারিতে মৃত্যু হয় নাথানিয়েলের মায়ের। ময়নাতদন্তে অস্ত্রোপচারের প্রসিডিউরে কিছু গাফিলতি ধরা পড়ে। মাকে সমাহিত করে ক্রুদ্ধ নাথানিয়েল সার্জনকে আক্রমণ করে আহত করেছিলেন। এ-ভায়োলেন্ট ব্যবহারের জন্য তাঁর পাঁচ বছরের জেল হয়। তবে তাঁর পিতা সার্জনকে ছেড়ে দেননি। বছরের পর বছর মামলা করে অবশেষে ম্যাল প্র্যাকটিসের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে আদায় করেন বেশ বড় অংকের টাকা।

 গ্রিলড ফিশের সঙ্গে আধপোড়া যব ও বাঁধাকপির কৌলসøা দিয়ে পিকনিক টেবিলে খাবার মোটামুটি ভালোই জমে। আমি ল্যারির অস্ট্রেলিয়াতে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই। দেশটির উষর মরুস্ক্যাপ ও সাব-ট্র্যপিক্যাল আবহাওয়া তার খুব ভালো লাগে। আমেরিকার মূলধারায় ল্যারি কেন জানি ঠিক অ্যাডজাস্ট করতে পারে না। তাই বারবার সে ফিরে যায় অস্ট্রেলিয়াতে, মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার হিসেবে টেম্পোরারি কিছু কাজ করে সে তার ভ্রমণের খরচ জোগায়। 

মায়ের আদিবাসী ট্রাইবের সঙ্গেও ল্যারির সুন্দর সম্পর্ক, তারা খুবই অতিথিপরায়ণ। জানতে চাই, তার অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী মায়ের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান বাবার যোগাযোগ হয়েছিল কীভাবে? কোনো দ্বিধা না করে পুরো ঘটনাটি ল্যারি খুলে বলে। তার বাবা অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত একটি মার্কিন সামরিক স্থাপনায় কাজ করতেন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। যখন তাঁদের দেখা হয়, তখন তাঁর মা বয়সে ছিলেন কিশোরী। আড়ালে-আবডালে কিছুদিন তাঁরা ডেটও করেন। পরে ক্যালিফোর্নিয়াতে ফিরে তাঁর বাবা মাকে স্টুডেন্ট ভিসার স্পন্সরশিপ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসতে সাহায্য করেন। অতঃপর বছর দুয়েকের ভেতর ল্যারি জন্মের সম্ভাবনা দেখা দিলে তাঁরা বিয়ে করেন।

রামোনার তাড়ায় ল্যারি ডেজার্ট তৈরির উদ্যোগ নেয়। মাছের লেজে কেউ আগ্রহ দেখায়নি। তা পাতে পেয়ে বিড়ালটি চেটেপুটে খেয়ে নাথানিয়েলের গতরে খোশমেজাজে লেজ ঘষে। ল্যারি মার্শমেলো গ্রিল করে তা চকলেট বারের ওপর লেপ্টে দিচ্ছে। 

আমি নাথানিয়েলের পেশা ও হবি সম্পর্কে জানতে চাই। ইউরোপিয়ান ক্লাসিক্যাল মিউজিকে তাঁর হাতেখড়ি বাচ্চা বয়সে। কারাবরণের আগে বছর কয়েক গানের স্কুল ও প্রাইভেট মিউজিক টিচারের কাছে প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। কারাগারে তাঁর বাবা হামেশা সিডি ও বাদ্যযন্ত্র জুগিয়ে তাঁর অনুশীলন জারি রাখতে সাহায্য করেছেন। ছাড়া পেয়ে নাথানিয়েল আরো তিনজন কারামুক্ত সংগীতশিল্পীর সঙ্গে মিলেঝুলে ছোট্ট একটি ব্যান্ড তৈরি করে নিয়েছেন। ক্রিসমাস বা থ্যাংকস্ গিভিংয়ের পরবে তাঁরা জেলখানায় ফিরে গিয়ে কয়েদিদের জন্য বাজান ধ্রুপদী সংগীত।

কারাগারে তাঁরা সচরাচর ফরাসি মিউজিক কম্পোজার অলিভার ম্যাসিয়েনের (১৯০৮-৯২) কোয়ার্ট্রটে বাজিয়ে থাকেন। ধ্রুপদী সংগীতের এ-মায়েস্ত্রো নাকি কারাবাসের সময় এই কোয়ার্ট্রটেটি কম্পোজ করেছিলেন। নামজাদা এ-ফরাসি কলাকারের সুনাম আমি শুনেছি। শৌখিন বার্ড ওয়াচার ও হাইকারদের কেউ কেউ তাঁর হাতে সৃজিত সংগীতালেখ্যের কদরদানি করে থাকেন। শুনেছি যে, এই বিখ্যাত অর্গানবাদক পাখি পর্যবেক্ষণ করতে ভালোবাসতেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইউটা অঙ্গরাজ্যে তিনি নাকি হাইকও করেছিলেন, ব্রাইস ক্যানিয়নের শিলাময় দৃশ্যপট তাঁর এতো ভালো লেগেছিল যে, তিনি এই অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে সৃষ্টি করেছিলেন মিউজিক কম্পোজিশন। 

কিন্তু এসব তথ্য হচ্ছে বার্ড ওয়াচার বা হাইকারদের সঙ্গে আড্ডাচ্ছলে শোনা কথা। তাঁর রচিত কোনো সোনাটা বা সিম্ফনি আমার মনোযোগ দিয়ে শোনার সুযোগ হয়নি। তাই নাথানিয়েলকে অনুরোধ করি, ‘টেল মি মোর অ্যাবাউট ইয়োর এক্সিপিরিয়েন্স অব প্লেইং ম্যাসিয়েনস কোয়ার্ট্রটে ইন প্রিজন।’

 খুব গুছিয়ে কথা বলেন নাথানিয়েল, জানতে পারি, ১৯৪০ সালে ফরাসি দেশ নাৎসি জার্মানির করতলগত হলে অলিভার ম্যাসিয়েন কারাবরণে বাধ্য হন। জেলখানায় কাকতালীয়ভাবে তাঁর জুটে গিয়েছিল চারটি বাদ্যযন্ত্র তথা পিয়ানো, চেলো, ক্লারিয়েনেট ও ভায়োলিন। তিনি নাকি এগুলোকে ভিত্তি করে তৈরি করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কারা-কোয়ার্ট্রেট বা চারজনে বাজানোর উপযোগী সংগীত কম্পোজিশন। চারজন সংগীতমনস্ক কয়েদিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তিনি নাকি জেলখানায় এটা বাজিয়েও ছিলেন। এ-কোয়ার্ট্রেট ইংরেজিতে ‘এন্ড অব টাইম’ বলে পরিচিত। ব্যাকগ্রাউন্ড শোনার পর কারাবন্দিরা নাকি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে এটি শুনে থাকে।

 ক্যাম্পফায়ারের আগুন নিভু নিভু হয়ে আসছে। ল্যারি পোড়া মার্শমেলো মেশানো চকলেট ভেঙে ভেঙে রামোনাকে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে। ব্যাকপ্যাক থেকে ক্লারিওনেট বের করে নাথানিয়েল জানতে চান, ‘আর ইউ রেডি টু এনজয় সাম ম্যাসিয়েন …?’ 

আমি ঘাড় হেলিয়ে সায় দিই। তাঁর বাদনে আমাদের অগ্নিকুণ্ড ঘিরে রাতটি নিবিড় হয়ে আসে। ল্যারি ও রামোনা পরস্পরকে জড়িয়ে ঘাসে গড়াগড়ি দিচ্ছে। তাদের চুমোর বহর দেখে মনে হয়, দুজনেই আতঙ্কে আছে, ভবিষ্যতে যদি এ-ধরনের অন্তরঙ্গতার সুযোগ না ঘটে। ক্লারিওনেটের সুরধ্বনি একটু গভীর হয়ে আসতেই অদূর বনানীতে দুটি প্যাঁচা হুট হুট করে আওয়াজ দেয়। বিড়ালটি নাথানিয়েলের গতর-ঘেঁষা উষ্ণতা ছেড়ে পিকনিক টেবিলের ওপর উঠে অন্ধকার বনানীর দিকে চেয়ে হাই তোলে।

– নিবন্ধে ব্যবহৃত সব ছবি লেখকের