পাঠকনন্দিত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর উপন্যাসে নাগরিক জীবন, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষের কথা, বিবৃত হয়েছে। একটি পরিবার বিস্তৃত আঙ্গিকে তাঁর চরিত্রসমেত কাহিনিতে উপজীব্য হয়ে ওঠে। চরিত্রের বাস্তবতায় সমস্যা, অভ্যাস, জীবনাচরণ এবং যৌনতা প্রাসঙ্গিকভাবে প্রকাশিত। তাঁর কাহিনির বৈশিষ্ট্য ইংরেজি স্মার্ট বুকের মতো ‘স্টোরি অ্যাজ ইট ইজ হার্ট ব্র্রেকিং।’ কিংবা ‘বিউটিফুল স্টোরিজ অ্যাবাউট লাইফ অ্যান্ড লস।’ চরিত্রের মুখের ভাষা-সরসতা, চরিত্রের নাম এবং সংলাপে হুমায়ূন আহমেদ গতানুগতিকতা থেকে মুক্ত, আলাদা। এই মৌলিকতার জন্যই তরুণ, যুবসমাজ, শিক্ষিত সমাজ তাঁর উপন্যাসপাঠে উদ্বুদ্ধ। পঞ্চাশের দশকে জনপ্রিয়তায় শরৎচন্দ্র যেভাবে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই জনমত বিচারে এ-যুগে এসে হুমায়ূন আহমেদ আবার সেই জনপ্রিয়তার মানদণ্ডে এপার-ওপার বাংলার লেখকদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই যুগস্রষ্টা এবং যুগোত্তীর্ণতায় হচ্ছে তাঁর আধুনিকতা। এই আধুনিকতার মাপেই তিনি মানবপ্রেমী, রসিক, দেশপ্রেমী এবং মননশীলও বটে।
নন্দিত নরকে উপন্যাসটি এখানে আলোচ্য বিষয়। একজন লেখকের প্রকৃত মেধা তাঁর সৃষ্টিগত সাহিত্যের সৃষ্টির মধ্যে দর্শন হয়ে কাজ করে। হুমায়ূন আহমেদ একজন প্রকৃত কথাকার। তিনি মননশীলতার মাধ্যমে লেখক হয়ে ওঠেন। একজন লেখক অবশ্যই পাঠকও বটে। সেই লেখক তাঁর নিজের গ্রন্থের প্রথম পাঠক। এমন পাঠাভাস্যের পরীক্ষায় হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রথম বই নন্দিত নরকে প্রকাশ করেন। এই উপন্যাস তাঁর প্রথম হলেও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। অথচ বঙ্কিম তাঁর প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনীতে (১৮৬৫) সফলতা বা জনপ্রিয়তা পাননি, পেয়েছিলেন বিষবৃক্ষ ও কৃষ্ণকান্তের উইলে। রবীন্দ্রনাথও তাঁর প্রথম উপন্যাসে জনপ্রিয়তা পাননি, পেয়েছিলেন চোখের বালি, ঘরে বাইরে, গোরা এবং শেষের কবিতাসহ অন্যান্য উপন্যাসে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকেই খ্যাতি লাভ করেন। কী ছিল তাঁর সেই তরুণ বয়সের বিস্তৃত কাহিনিবিন্যাসে, সেটা অবশ্যই ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আহমদ শরীফ উপন্যাসের ভূমিকাতে যা বলেছেন তার অংশবিশেষ – ‘পড়ে আমি অভিভূত হলাম। গল্পে সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছি একজন সূক্ষ্মদর্শী শিল্পীর একজন কুশলী স্রষ্টার পাকা হাত। বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে এক সুনিপুণ শিল্পীর এক দক্ষ রূপকারের এক প্রজ্ঞাপন দ্রষ্টার জন্মলগ্ন যেন অনুভব করলাম।’ তরুণ লেখকের প্রতি বিজ্ঞ পণ্ডিতব্যক্তির এমন মুগ্ধতাবোধ হয়তো একসময় বইটি পড়তে আমাদের উৎসাহিত করেছিল। তখন পড়েছিলাম গল্পের টানে। আবার পড়লাম গল্পের সঙ্গে বাস্তবতার বুনট অনুভবের উদ্দেশ্যে।
একটি পরিবারের কাহিনি ধরে গল্পের সূত্রপাত। মেয়েটি রাবেয়া – গড়ন-গঠনে যুবতী স্বভাবের, আচরণে-মনে বুদ্ধির অভাব। অপ্রকৃতিস্থ। মেয়েটি বাইরে যায়। কে কখন তাকে কিছু খারাপ কথা বলেছে, সে তার অর্থ বোঝে না। পরে বাড়িতে এসে ছোট বোন রুনুকে বলতে গেলে গল্পের কথক ভাই তাকে থামিয়ে দেয়। রাবেয়া এই পরিবারের বড় সন্তান। কথক (পুত্র) বলেছে, রাবেয়া তার এক বছরের বড়। কিন্তু রুনু ভাই-বোনের মধ্যে ছোট। তারা চার ভাই-বোন মা-বাবার সংসারে বেশ সংগ্রাম করেই বেড়ে উঠেছে। একটি মধ্যবিত্ত সংসারের অর্থনীতি, কর্মনীতি এবং তার গতি-প্রকৃতির মধ্যে যে জটিলতা বা আবর্ত তার সবই গল্পের কথকের মাধ্যমে বিবৃত হয়েছে। রুনু-মন্টু এরা পিঠাপিঠি। পরে জানা গেল, মন্টু রুনুর চাচাতো ভাই বলেই এদের মধ্যে খুনসুটি চলে। রুনু একবার মন্টুর খাতায় দু-লাইন ছড়া লিখে দেয়। ‘মন্টু ভাইতো মারলেন মস্ত বড় সাপ/ চার হাত লম্বা সেটি কি তার প্রতাপ।’ এই সাপটি মেরেছিল তাদের বাড়ির পোষা কুকুর পলা। এরপরই এই পলা নামের কুকুরটি একদিন দুপুর থেকে উধাও হয়ে যায় – হারিয়ে যায়। কথক গল্পের ভেতর রুনুকে বেশ যত্নের সঙ্গে উপস্থাপন করেছে। তার মেধা তার স্মৃতি তার অবস্থান সবই ভালো। সে-কারণেই কথক রবীন্দ্রনাথ আর টমাস হার্ডির গল্পও তাকে শোনাতে চায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব পড়াশোনার নানা ব্যাখ্যার পর আবার রাতে মশারি টানানোর প্রসঙ্গটিও কথার ফাঁকে চলে আসে। সাধারণ পরিবারের ঘরের স্বল্পতার কথাও বাদ পড়ে না। ‘দাদা আপা আমার গায়ে ঠ্যাং তুলে দিয়েছে। রাবেয়া ঘুমের ঘোরে পা তুলে দিয়েছে রুনুর গায়ে। বেশ স্বাস্থ্য রাবেয়ার। স্বাস্থ্যবতী মেয়েদের হয়তো ভরা যৌবনের মেয়ে বলে।’ রাবেয়া বাড়ির মানুষদের একটি আলোচ্য বিষয়। গল্পের মধ্যে তার প্রতি ফোকাসটা বেশি। পরিবারের ঘাড়ে চরিত্রটি একটি বোঝা। বাবা চরিত্রের কর্মযোগ্যতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে লেখক পরিবারটির একটি চেহারা দাঁড় করিয়েছেন। ‘প্রথম জীবনে ছিলেন স্কুল মাস্টার। প্রাইভেট স্কুল। মাইনের ঠিক ছিল না। আমরা সব তাঁর মাইনের উপর নির্ভর করে আছি দেখে মাস্টারি ছেড়ে ঢুকলেন ফার্মে। বারো বছরে ক্যাশিয়ার থেকে অ্যাকাউন্ট্যান্ট হলেন। মাইনে সাড়ে তিনশ।’ পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাবা-মা এবং মাস্টারসহ তিনজন এবং মন্টুসহ সন্তান চারজন। মোট সাতজনের মধ্যে মন্টু চাচাতো ভাই হয়েও সে সাতজনের একজন। এদের যৌথ কিংবা সামষ্টিক জীবনব্যবস্থার কথা গল্পের ঘটনাক্রম। প্রথমত পরিবারটি সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে। এই সংগ্রাম নিয়তির বিরুদ্ধে, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে এবং নানাবিধ সমস্যার বিরুদ্ধে। পরিবারটি নিয়তিতাড়িত এবং কেন্দ্রীয় সংগ্রামী চরিত্রের নাম রাবেয়া।
মেয়েটির বয়স এবং শরীর বাড়ছে, কিন্তু বুদ্ধি বাড়ছে না। সে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়ে। নিজের জীবন-সম্পর্ক-লিঙ্গজ্ঞান,
সমাজ-মানুষ সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। তাই মেয়ে হিসেবে লজ্জাবোধ তৈরি না হওয়াতে সে যে-কোনো স্থানে,
যে-কারো সঙ্গে চলে যেতে পারে। এটাই পরিবারের মানুষদের চিন্তার বিষয়। বড় সন্তান হিসেবে তার বোধ সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভুলে যাওয়া। তার নির্বুদ্ধিতা পরিবারের সুস্থ মানুষদের কষ্ট দেয়। ‘বড় ডাক্তার যদি কিছু করতে পারে। কিন্তু আমাদের পয়সা নেই। আমার ছোট হয়ে যাওয়া শার্ট মন্টু পরে। আমরা কাপড় কিনি বৎসরে একবার রোজার ঈদে।’ এখানে দারিদ্র্য বিবৃত করেছেন। উপন্যাসের চরিত্র বড় ছেলে। সে কথক। পরিবারটি একটি সমাজের চিত্র এবং সাক্ষী হয়ে কাহিনিতে গুরুত্ব পেয়েছে। মোটা দাগে বলতে হয়, পরিবারটিকে ডিসপ্লে করা হয়েছে। মধ্যবিত্ত এই পরিবারটির সামগ্রিক আচরণ ভদ্র – সবকিছুতেই তারা মান্যতা বুঝে চলে। এক্ষেত্রে কথক (খোকা) ধৈর্যশীল এক বিশ্লেষক। তাই কথককে বেশির ভাগ সময়ে লেখকও মনে হয়েছে। তারা যে-বাড়িতে থাকে তার অদূরেই একটি থানা। থানা থেকে মাঝে মাঝে ঘণ্টা বাজার শব্দ শোনা যায়। থানার সঙ্গে লেখকের পারিবারিক জীবনের সম্পর্ক থাকলেও গল্পের বাবা কিন্তু অ্যাকাউন্ট্যান্ট। মাস্টার কাকা শরীফ আকন্দ একটি অদ্ভুত চরিত্র – লজিং মাস্টার। পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। ‘সেই থেকেই তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন। বাবা স্কুলের মাস্টারি যোগাড় করে দিয়েছেন; তাঁর একার বেশ চলে যায় তাতে তিনি জন্ম থেকেই আমাদের স্মৃতির সঙ্গে গাঁথা।’ কাহিনির ভেতরই জানা গেছে মাস্টার চরিত্রটি গল্পের বাবা চরিত্রের সমবয়স্ক। তিনি অবিবাহিত বোহেমিয়ান টাইপের আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। একান্ত চিন্তামগ্নতার মধ্যে তাঁর বিচরণ। তিনি
নীতি-নৈতিকতার মধ্যে থাকতে চান। উপদেশ দেওয়ার শিক্ষকসুলভ চরিত্র তাঁর রয়েছে। অসম সঙ্গপ্রিয়তা তাঁর চরিত্রের দোষগুণ। চরিত্রটি উপন্যাসের রহস্য এবং অউন্মোচিত বোধের।
রাবেয়া চরিত্রটি উপন্যাসের মূল দিগ্দর্শন অর্থাৎ কেন্দ্রীয় চরিত্র। তার ভূমিকা সংলাপের চেয়ে আচরণে প্রধান। সেই আচরণ কাহিনিতে বিষাদ এনেছে। ‘আমার মনে পড়ল রাবেয়া একদিন হারিয়ে গিয়েছিল। চৈত্র মাস। কলেজ থেকে এসে শুনি রাবেয়া আর নেই। তার যাবার জায়গা সীমিত।’ এই ঘটনা একটি দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে – এই ভাবনাতে মায়ের কান্না আর বিলাপে বাড়ির বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। এসব দুঃসংবাদ এলে এ-বাড়ির সকল সদস্য বিষণ্নতায় ভোগে। সবাই আল্লাহর আহাজারি করে। কপালের জোরে এই বিপদটিও কেটে গেল। ‘রাবেয়া ফিরে এল রাত ৮টায়। সঙ্গে মাস্টার কাকা। বুকের উপর চেপে বসা দুশ্চিন্তা নিমিষেই দূর হলো। মাস্টার কাকা বললেন, ওকে আমি স্কুলের কাছে পাই। হারিয়ে গেছে আমি জানতাম না।’ এসব শোনার উৎসাহ আমার ছিল না। পাওয়া গেছে এই যথেষ্ট।’ এমন পারিবারিক সমস্যা এবং আবদ্ধ আনন্দবোধে দম আটকে আসে। গল্পের মধ্যে কথাকার চরিত্রের বেদনাও প্রবল।
একটি পারিবারের মূল চরিত্র বাবা-মা। তাঁদের জীবনযাপনের সঙ্গে সন্তানদের জীবন সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। দারিদ্র্যের মধ্যে শুধুদারিদ্র্য থাকে না, কষ্ট, অপ্রাপ্তি, গুরুত্বহীনতা, ইচ্ছে পূরণে অসংগতি প্রভৃতি প্রকট হয়ে ওঠে। তারপরও চরিত্রগুলোর মধ্যে কষ্টসহিষ্ণুতা আতিথিপরায়ণতা এবং উন্নত জীবনের বাসনা তাদের উজ্জীবিত রাখে। বাবা-মায়ের কষ্টে কথকের মন কাঁদে। আবার সে আশায় বুকও বাঁধে। ‘বয়স হয়েছে, ভাঙ্গা চাকার সংসার টেনে অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন, দেহ মন শান্ত তো হবেই তার এমন অসহায় ভাবটা আমার ভালো লাগে না। খুব শিগগিরই হয়তো আমি একটি ভালো চাকরি পাব।’ কথক গল্পের কাহিনির বিস্তারে পরিবার, ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে নানা সূত্রে সম্পর্ক ঘটিয়েছে। পাশের বাড়ি শান্তি কটেজের পরিবারটি বেশ অর্থশালী এবং শিক্ষিত। তাদের পরিবারে বাবা-মা, ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার। অবস্থা অনেক ভালো বলে সেই বাড়িতে আভিজাত্যের ছাপ রয়েছে। তা দেখে রাবেয়া এবং রুনু মুগ্ধ হয়। পরিবারটির সদস্যরা ব্যবহারের দিক থেকে অনেক ভালো বলে মাঝে মাঝে তাদের গিফট দেয়। বাড়িতে বাবা-মা গিফট দেখে তাদের
দু-বোনকে বকা দেন। রাবেয়া বলে, আমরা চেয়ে নিই নাই, তারা দিয়েছে। ও বাড়ির মেয়েটির নাম শীমু এবং ছেলেটির নাম হারুন। শীমু রুনুর বন্ধু, সমবয়স্কা। মেয়েটির গড়ন এবং বডি ল্যাংগুয়েজ ভালো। কথকের দৃষ্টিতে সে এককথায় ভালো মেয়ে। শীমুরও কথককে বেশ পছন্দ। কিন্তু কথক ছোট বোনের বান্ধবী বলেই শীমুর প্রতি স্বাভাবিক আচরণ করে। হারুন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। উদার মনের ছেলে। সে রাবেয়ার অসহায় অবস্থা বুঝে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ‘হারুনের মা বলে, হারুনের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আপনার মেয়ে রাবেয়াকে বিয়ে করতে চায়।’ এই কথাটি রাবেয়ার পরিবারের কাছে অপমানজনক মনে হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যে হারুনের বিয়ে হয়ে যায়। তার স্ত্রীর নাম নাহার। কথক তাকে নাহার ভাবি বলে সম্বোধন করে। নাহার খুব সুন্দরী। তাকে রেখে হারুন জার্মানিতে চলে যায়। সে সবার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে এবং আড্ডা দেয়। একদিন নাহার ভাবির পরিবারের সবাই মিলে আনন্দভ্রমণে যায়। সেই কথা জেনে রুনুরও খুব ইচ্ছে জাগে কক্সবাজারে যাবে। অভিজাত পরিবারটির কার্যক্রম দিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারটির মনের বাসনা জাগানো হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ইচ্ছে হলেও উপায় থাকে না। যাকে বলে সাধ ও সাধ্যের অমিল। এতে মানুষের ভোগবাদী বাসনারই প্রকাশ ঘটেছে।
এরই মধ্যে গল্পের কথক খোকা তার চাকরিপ্রাপ্তির তথা অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা শোনায়। চাকরি হচ্ছে কলেজের প্রভাষক, রসায়ন শাস্ত্রের। এই খবরে বাড়িতে সবার মধ্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। মাস্টার কাকা মিষ্টি এনে সবাইকে বিতরণ করেন। ‘কাকা বললেন, সুখ আসতে শুরু করলে সুখের বান ডেকে যায়।’ এমন দিনে কথাকারের শীমুর কথা মনে পড়ে। অথচ সে শীমুকে ভালোবাসার কথা বলতে পারে না। কি করে সে বলবে, কারণ শীমুকে দেখার পূর্বে ভালোবাসা সম্পর্কে তার ধারণা ছিল ফ্রয়েডীয়। ‘ভালোবাসার উৎস কী আমি জানি না। আশফাক বলত, ভালোবাসা নিছক কামনা। যৌন আকর্ষণের পরিভাষা।’
উপন্যাসে সুখ-দুঃখের টানাপড়েন রয়েছে। অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক এক জীবন-দর্শন। রাবেয়ার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবরে পরিবারটি আবার দুমড়েমুচড়ে যায়। সে যেহেতু প্রতিবন্ধী, তাই তার পক্ষে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করা সম্ভব হয়নি। এবার অ্যাবরশনের ঝামেলা। এই ঘটনাটি গল্পের কঠিন বাস্তবতা। যেটি পাঠকহৃদয়ে মানবিকতার জন্ম দিয়েছে। এই দৃশ্য বড় দুঃখের, কষ্টের, লজ্জার, ক্ষোভের। অ্যাবরশনে রক্ত ঝরেছে বেশি, তাই রাবেয়াকে আর বাঁচানো যায়নি। ‘আর কী আশ্চর্য বেলা নটায় চুপচাপ মরে গেল রাবেয়া।’ বৃহত্তর গল্পের কাহিনি এ-পর্যন্ত এসে প্রায় শেষ। তবে গল্পের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। শেষ অংশে ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট। এবার রাবেয়ার এমন মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তির অনুসন্ধান। এই অনুসন্ধানে সবাই বিফল হলেও গল্পের সাহসী চরিত্র মন্টু বিফল হয়নি। মন্টু এই পরিবারের সন্তানের মতো। তার বাবা-মার মৃত্যুর পর সে চাচা-চাচির সংসারে মানুষ। অর্থাৎ সে রাবেয়ার চাচাতো ভাই। রাবেয়ারা তিন ভাইবোন মিলে তাকে আপন ভাইয়ের মর্যাদায় রেখেছিল। মন্টুও এই পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞ। খুব স্পষ্টবাদী ছেলে, ঠিক যেন শ্রীকান্ত উপন্যাসের ইন্দ্রনাথ। সে সব বোঝে সব জানে সব পারে। কাহিনির এই পর্বের বিষয়টি রহস্যময়। রাবেয়ার হত্যাকারীর গল্প। কে সেই হত্যাকারী? ‘মন্টু দিনেদুপুরে অনেক লোকজনের মধ্যে ফালাফালা করে ফেলল মাস্টার কাকাকে একটা মাছ-কাটা বঁটি দিয়ে। মন্টু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা ওকে আমি মেরে ফেলেছি।’ মাস্টার কাকাকে পরিবারের কেউ রাবেয়ার শ্লীলতাহানির জন্য সন্দেহ না করলেও মন্টু কেন জানি তাকেই সন্দেহ করেছিল। ‘মন্টুকে থানায় নিয়ে যাচ্ছে সবাই।’ মন্টু নির্বিকার। তার চেহারার মধ্যে কোনো অপরাধবোধ নেই। মন্টুর মধ্যে সাহস এবং নিষ্ঠুরতার প্রমাণ আনতে গল্পের হাস্নাহেনা গাছের ভেতর তার সাপ মারার কথা এসেছে।
গল্পে মোট চারটি মৃত্যুর তথ্য আসে – সাপ, রাবেয়া, মাস্টার কাকা এবং মন্টুর ফাঁসি। এই চারটি হত্যার দুটিই মন্টু ঘটিয়েছে। মাস্টার কাকা ওরফে শরীফ আকন্দ অবিবাহিত বয়স্ক পুরুষ। মানুষ যত জ্ঞানী হোক ধার্মিক হোক মাস্টার হোক বয়স্ক হোক সে তার যৌন চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই মানুষ। ‘আগে কপাট মার কামের ঘরে/ মানুষ ঝলক দিবে রূপ নিহারে’ (লালন)। সেক্সকন্ট্রোল, যা মাস্টার কাকা চরিত্রটি করতে পারেনি। বারো বছর সে আর মাস্টার কাকা একসঙ্গে এক ঘরে কাটিয়েছে। মন্টু হয়তো সেই মাস্টারের মন্দ চরিত্রের প্রমাণ পেয়েছিল। অর্থাৎ মাস্টার চরিত্রের পারভার্সন মন্টু জানে। আবার ডাক্তার ডাকতে যাওয়ার সময় মন্টুর সঙ্গে মাস্টার কাকা গিয়েছিলেন। তখন মাস্টার ডাক্তারকে গোপনে সত্যটি বলে দিতে পারে, যা মন্টু শুনে ফেলেছিল। তা না হলে এভাবে মন্টু নিশ্চিতভাবে মাস্টারকে খুন করতে যাবে কেন! মন্টু চরিত্রের ভেতর এসব মনোবিকলন চরিত্রটিকে আইন হাতে তুলে নিতে বাধ্য করেছিল। নাহার ভাবির উক্তি – ‘কাকাই হয়তো দায়ী ছিলেন, মন্টু জেনে ছিল। অবশ্য মন্টু বলেনি কিছুই।’ রাবেয়ার মৃত্যুতে মন্টুর নীতিবোধ আক্রান্ত হয়। তার মধ্যে প্রবলভাবে ন্যায়বোধ জেগে ওঠে, তাই মাস্টার কাকাকে হত্যা করতে তার বাধেনি। একটি হত্যা অন্য হত্যার জন্ম দিয়েছে। মন্টুর বিচার হয়েছে, সে যতদিন হাজতে থেকেছে কথক এবং তার বাবাসহ পরিবারটি তাকে বাঁচানোর এবং ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করেছে। এক কাকডাকা ভোরে মন্টুর শেষ পর্যন্ত ফাঁসি হয়। এই হচ্ছে ক্রাইম অ্যান্ড পানিসমেন্ট। ‘কাকা বলেছিলেন, এ ছেলে হবে সাহসী, বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও প্রেমিক’।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.