টোবা টেক সিং

অনুবাদ : ফাহমিদা আক্তার

দেশভাগের দুই বা তিন বছর পর, ভারত ও পাকিস্তান সরকারের মনে হয়েছিল যে, বেসামরিক বন্দিদের স্থানান্তরিত করার পাশাপাশি পাগলা গারদে আশ্রিত বন্দিদেরও স্থানান্তর করা উচিত। অর্থাৎ তাঁরা তাগিদ অনুভব করেছিলেন, ভারতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে মুসলমান পাগলদের পাকিস্তানে পাঠানো উচিত এবং পাকিস্তানি আশ্রয়স্থল থেকে হিন্দু ও শিখদের ভারতে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

তবে এটি একটি ন্যায়সংগত পদক্ষেপ ছিল কি না, সে-বিষয়ে বিতর্ক আছে। তা সত্ত্বেও এ-বিষয়ে বেশ কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং স্থানান্তরের দিন ধার্য করা হয়। বেশ কিছু প্রাথমিক তদন্তের পর, ভারতে যাদের আত্মীয় ছিল তাদের সেখানে পাঠানো হয় এবং বাকিদের সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যেহেতু পাকিস্তান থেকে হিন্দু বা শিখ সম্প্রদায়ের অধিকাংশই ভারতে চলে গিয়েছিল, তাই সেখানে তাদের ধরে রাখার কোনো প্রশ্নই ওঠেনি। সকল হিন্দু ও শিখ পাগলকে পুলিশি হেফাজতে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে সীমান্ত এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।

ভারতে এ-বিষয়ে কী হয়েছে, জানা নেই। কিন্তু এখানে – লাহোর পাগলাগারদে, বদলির খবরে কয়েদিদের মধ্যে কৌতূহলোদ্দীপক ও সরস আলাপের শুরু হয়। একজন লোক, যিনি প্রায় বারো বছর ধরে প্রতিদিন জমিদার পাঠ করে আসছেন, তাঁকে তাঁর এক বন্ধু প্রশ্ন করে :

‘মৌলভি সাহেব, এই পাকিস্তান জিনিসটা কি?’

‘ভারতের একটি জায়গা যেখানে দাড়ি কামাবার ক্ষুর তৈরি হয়’, তিনি অনেক চিন্তাভাবনার পর এই উত্তর দেন।

তাঁর বন্ধু উত্তরে সন্তুষ্ট হয়েছে বলে মনে হলো।

এক শিখ পাগল আরেক শিখ পাগলকে জিজ্ঞেস করল, ‘সর্দারজি, কেন আমাদের হিন্দুস্তানে পাঠানো হচ্ছে? আমরা তো তাদের ভাষায় কথা বলতে জানি না।’

‘কিন্তু আমি হিন্দুস্তানিদের ভাষা জানি’, প্রথমজন মৃদু হাসি দিয়ে উত্তর দিলো। আরো বললো, ‘হিন্দুস্তানিরা শয়তান, তারা অহংকারী ভঙ্গিতে ঘোরাঘুরি করে…’

একদিন সকালে গোসল করার সময় একজন বন্দি গর্জে ওঠে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ!’ এত জোরে সে চিৎকার দিয়েছিল যে, সে মেঝেতে পিছলে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।

কিছু বন্দি কিন্তু সত্যিকারের উন্মাদ ছিল না। তাদের মধ্যে অনেক খুনি ছিল। এদের আত্মীয়রা পাগলখানা কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিয়ে তাদের সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করে, যাতে তারা অন্তত ফাঁসি থেকে বেঁচে যেতে পারে। এই ধরনের লোকগুলি কী ঘটছে, সে-সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করতে পেরেছিল এবং পাকিস্তান বিষয়ে অল্পস্বল্প জানত। তবে তাদের কাছে সব তথ্য ছিল না। শুধুমাত্র সংবাদপত্রের ওপর ভিত্তি করে অনেক কিছু জানা যেত না। আবার পাগলাগারদের প্রহরীদের বেশিরভাগ ছিল নিরক্ষর, তাই তাদের সঙ্গে কথা বলেও খুব কম তথ্য পাওয়া যেত। তারা শুধু জানত যে, একজন ব্যক্তি আছেন, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নামে, যিনি কায়েদ-ই-আজম নামেও পরিচিত, তিনি মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান নামে একটি পৃথক দেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। পাকিস্তান কোথায়? এর সীমানা কতদূর? তারা এসব জানত না। এই কারণেই সেসব বন্দি, যারা সম্পূর্ণরূপে পাগল ছিল না, তারা নিজেদের নিয়ে বেশ দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। তারা বুঝতে পারেনি যে, তারা কি পাকিস্তানে ছিল, না ভারতে? আর তারা যদি এখন পাকিস্তানেই থাকে, তাহলে এটা কীভাবে সম্ভব যে, অল্প কিছুক্ষণ আগেও তারা ভারতে ছিল। অথচ তারা আদৌ তাদের এই আশ্রয়স্থল থেকে একবারের জন্যও নড়েনি।

একজন পাগল ‘হিন্দুস্তান-পাকিস্তান’ নাকি

‘পাকিস্তান-হিন্দুস্তান’ এই পুরো বিষয়ের গোলকধাঁধায় আরো দিশেহারা হয়ে পড়ে। একদিন মেঝে ঝাড়ু দেওয়ার সময়, সে হঠাৎ তার কাজ থামিয়ে একটি গাছে চড়ে বসে, যেখানে সে প্রায় দুই ঘণ্টা অবস্থান করে। সে-সময় সে পাকিস্তান বনাম হিন্দুস্তান বিষয়ে বিস্তৃত ও অবিরাম বক্তৃতা দিতে থাকে। রক্ষীরা নিচে নামার নির্দেশ দিলে সে আরো উপরে উঠে যায়। যখন তাকে জোর করে নামানোর হুমকি দেওয়া হয়, তখন সে বলে, ‘আমি পাকিস্তানে বা হিন্দুস্তানে থাকতে চাই না – আমি এই গাছেই থাকব।’

তার এই উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হলে সে নিচে নেমে আসে। তারপর তার হিন্দু ও শিখ বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে সে কাঁদতে শুরু করে। ভারতে তাদের আসন্ন প্রস্থানের কথা ভেবে তার মন বিষাদে ভরে ওঠে।

একজন এমএসসি ডিগ্রিধারী মুসলমান বেতার প্রকৌশলী, যে অন্যান্য পাগলের থেকে একটু ভিন্ন প্রকৃতির – সে তার বেশিরভাগ সময় পার করতো বাগানের একটি নির্দিষ্ট জায়গাকে ধরে চুপচাপ সামনে ও পিছনে হেঁটে। সে হঠাৎ তার কাপড় খুলে রক্ষীদের দিয়ে দেয়। তারপর সে উলঙ্গ হয়ে বাগানে ঘোরাঘুরি শুরু করে।

চিনিওট-এর একজন বেশ স্বাস্থ্যবান মুসলমান, যিনি একসময় মুসলিম লীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন আর দিনে অন্তত পনেরো-ষোলোবার গোসল করতেন, হঠাৎ করেই তিনি একেবারে গোসল করা ছেড়ে দেন। তার নাম মোহাম্মদ আলী। একদিন তিনি ঘোষণা দিলেন যে, তিনি কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তাকে অনুসরণ করে, তার নিকটবর্তী একজন শিখ পাগল নিজেকে ঘোষণা করলেন মাস্টার তারা সিং হিসেবে। রক্তপাত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু সৌভাগ্যবশত দুজনকেই বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করে আলাদা আবাসে বন্দি করে রাখা হয়।

এখানে লাহোরের এক তরুণ হিন্দু আইনজীবী ছিল। সে প্রেমে অসফল হয়ে উন্মাদ হয়ে যায়। অমৃতসর এখন ভারতের অংশ হয়ে গেছে জেনে সে গভীরভাবে শোকাহত হয়ে পড়ে। কারণ এই শহরেরই একটি হিন্দু মেয়ের প্রেমে পড়েছিল সে। যদিও এই তরুণ আইনজীবীকে মেয়েটি প্রত্যাখ্যান করেছিল; কিন্তু মেয়েটিকে সে আজো ভোলেনি – মানসিক ভারসাম্যহীনতার এই অবস্থাতেও। সে অভিশাপ দিতে থাকে মুসলমান ও হিন্দু – উভয় সম্প্রদায়ের নেতাদের, যারা প্রকৃত অর্থে দায়ী ছিল হিন্দুস্তানকে দুই ভাগে ভাগ করার জন্য। যাদের কারণে তার প্রিয়তমা হিন্দুস্তানি হয়ে যায়, আর সে হয়ে পড়ে পাকিস্তানি।

অন্য বন্দিরা আইনজীবীকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা তাকে আশ্বস্ত করে যে, তাকে হিন্দুস্তানে পাঠানো হবে, যেখানে তার প্রিয়তমা আছে। কিন্তু সে লাহোর ছেড়ে যেতে ইচ্ছুক ছিল না, কারণ সে অনুমান করতে পেরেছিল যে, অমৃতসরে তার ওকালতির অনুশীলন ভালো হবে না।

ইউরোপীয় ওয়ার্ডে দুজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাগল ছিল। ইংরেজরা হিন্দুস্তানকে স্বাধীনতা দিয়ে চলে গেছে শুনে তারা খুব বিচলিত হয়ে পড়ে। বেশ কয়েকটি গোপন বৈঠকে তারা এই পাগলাগারদে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসে। ইউরোপীয় ওয়ার্ড কি থাকবে, না যাবে? তাদের কি ব্রেকফাস্ট মিলবে আগের মতো? ডাবল রুটির বদলে তাদের কি ব্লাডি ভারতীয় চাপাতি খেতে বাধ্য করা হবে?

একজন শিখ, যে পনেরো বছর ধরে এই পাগলখানায় আছে, তার মুখ থেকে ক্রমাগত আজব ভাষায় বিড়বিড় শোনা যেত : ‘ওপার দি, গুর গুর দি, আনক্স দি, বে ধায়ানা দি, মুং দি ডাল দি, অফ দি লালটেইন।’ সে রাতে ও দিনে, কখনোই ঘুমাতো না। প্রহরীদের মতে, গত পনেরো বছরে সে এক মুহূর্তের জন্য ঘুমায়নি। এমনকি সে শোয়ওনি কখনো। মাঝে মাঝে সে দেয়ালে হেলান দিয়েছে মাত্র।                          

খুব বেশি দাঁড়িয়ে থাকার কারণে তার পা এবং গোড়ালি ফুলে গিয়েছিল। কিন্তু শারীরিক অস্বস্তি অনুভব করা সত্ত্বেও সে কখনো শুয়ে বিশ্রাম নিত না। সে অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে পাকিস্তানি এবং হিন্দুস্তানি পাগলদের এই আশ্রয়স্থল থেকে স্থানান্তর বিষয়ে সব কথা শুনত এবং যখন একজন সহ-বন্দি এ-প্রসঙ্গে তার মতামত জানতে চাইতো, তখন সে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিত, ‘ওপার দি, গুর গুর দি, আনক্স দি, বে ধায়ানা দি, মুং দি ডাল অফ দি পাকিস্তান গভর্নমেন্ট …।’

কিন্তু পরে ‘অফ দি পাকিস্তান গভর্নমেন্ট’ কথাগুলি প্রতিস্থাপিত হয় ‘অফ দি টোবা টেক সিং গভর্নমেন্ট’ দ্বারা।  তারপর সে অন্য পাগলদের জিজ্ঞাসা করতে শুরু করে – ‘টোবা টেক সিং

কোথায়, যেখানে ওর বাড়ি ছিল।’ কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারেনি। আর যদি কেউ টোবা টেক সিং-এর বর্তমান অবস্থা বের করার চেষ্টা করতো, তবে সে আরো বিভ্রান্তির ভেতর পড়ে যেত। শিয়ালকোট, যা একসময় হিন্দুস্তানে ছিল, এখন

শোনা যাচ্ছে সেটা পাকিস্তানের হয়ে গেছে – কে বলতে পারে যে লাহোর, যা আজ পাকিস্তানে আছে, আগামীকাল তা হিন্দুস্তানে চলে যাবে না? এমন কেউ কি এই নিশ্চয়তা দিতে পারে যে, পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান – দুটোই একদিন হারিয়ে যাবে না?

এই লোকটির চুল পাতলা এবং রুক্ষ হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু সে কদাচিৎ স্নান করত, তার চুল আর দাড়ি একসঙ্গে জট পাকিয়ে আঠালো হয়ে গিয়েছিল, যা তাকে একটা ভয়ংকর চেহারা দিয়েছিল। অথচ সে ছিল এক নিরীহ মানুষ। পনেরো বছরে সে একবারও অন্য বন্দিদের সঙ্গে ঝগড়া করেনি। পুরনো রক্ষীরা শুধু জানত যে, সে টোবা টেক সিং থেকে এসেছে, যেখানে তার অনেক জমি ছিল। সে ছিল একজন সচ্ছল জমিদার। তারপর কোনো রকম পূর্বাভাস ছাড়াই সে একসময় পাগল হয়ে যায়। তার আত্মীয়রা তাকে লোহার মোটা মোটা শিকল দিয়ে বেঁধে এই পাগলাগারদে নিয়ে আসে, আর এখানে ভর্তি করায়।

তারা প্রতি মাসে একবার তার সঙ্গে দেখা করতে আসতো, তার ভালোমন্দের খোঁজখবর নিত, তারপর চলে যেত। তাদের এই পরিদর্শন নিয়মমাফিক চলতে থাকে পাকিস্তান-হিন্দুস্তান বিষয়ক বিশৃঙ্খলা শুরুর আগে পর্যন্ত। এই গণ্ডগোলের পর থেকে তাদের আসা বন্ধ হয়ে যায়।

তার নাম ছিল বিশন সিং, কিন্তু লোকে এখন তাকে টোবা টেক সিং বলে ডাকে। এটা স্পষ্ট যে, সময়ের চলমানতা বিষয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু প্রতি মাসে তার আত্মীয়স্বজন যখন তার সঙ্গে দেখা করতে আসত, তখন সে নিজে থেকেই প্রস্তুত হতো তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। সে প্রহরীদের বলতো, তার ‘সাক্ষাৎপ্রার্থীরা’ আসছে। সে সাবান দিয়ে শরীর ঘষে খুব ভালোভাবে গোসল করতো, চুলে তেল মাখিয়ে চিরুনি দিয়ে তা পরিপাটি করার চেষ্টা করতো। তারপর তুলে রাখা পোশাকগুলি পরিধান করে তার পরিজনদের সঙ্গে দেখা করতে যেত। তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে সে চুপ করে থাকতো। মাঝে মাঝে অবশ্য সে বিড়বিড় করে বলতো, ‘ওপার দি, গুর গুর দি, আনক্স দি, বে ধিয়ানা দি, মুং দি ডাল, অফ দি লালটেইন…’

তার একটি মেয়ে ছিল, যে প্রতি মাসে এক আঙুল পরিমাণ বেড়ে বেড়ে এখন পনেরো বছরের যুবতী। বিশন সিং ওকে চিনতো না। শৈশবে যখনই তার বাবাকে দেখতো, তখনই সে কাঁদত। আর এখন, যখন সে যুবতী, তখনো তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়ায় তার বাবার জন্য।

পাকিস্তান আর হিন্দুস্তানের ভেতর ঝামেলা শুরু হওয়ার পর বিশন সিং অন্য পাগলদের প্রশ্ন করতে শুরু করে, ‘টোবা টেক সিং কোথায়?’ তাদের কাছ থেকে সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে তার কৌতূহল কিংবা ক্রোধ আরো বেড়ে যায়। তার ‘সাক্ষাৎপ্রার্থীরা’ও আর আসছিল না। আগে, সে তার আত্মীয়দের আসন্ন পরিদর্শন টের পেত। কিন্তু এখন তার ভেতরের আওয়াজও স্তব্ধ হয়ে গেছে, যেখান থেকে সে শুনতে পেত তার আত্মীয়দের আসার পূর্বাভাস।

সে প্রতীক্ষায় ছিল তার দর্শনার্থীদের, যারা তার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল – যারা তাকে ফল, মিষ্টি আর পোশাক উপহার দিত। সে নিশ্চিত ছিল যে, তারা তাকে বলতে পারবে টোবা টেক সিং কোথায়। এর অবস্থান পাকিস্তানে, নাকি ভারতে? এছাড়াও সে বিশ্বাস করতো যে, তার পরিবার টোবা টেক সিং থেকেই এসেছিল, যেখানে তার জমি ছিল।

এই পাগলাগারদে এমনও এক পাগল ছিল, যে নিজেকে ঈশ্বর হিসেবে দাবি করতো। বিশন সিং তাকে একদিন টোবা টেক সিং সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। লোকটা বিকটভাবে হেসে উঠল : ‘এটা পাকিস্তান বা হিন্দুস্তান – কোনোটাতেই নয়।’ সে আরো বলল : ‘কারণ আমি এখনো এ-বিষয়ে কোনো আদেশ দিইনি।’

বিশন সিং এই ‘ঈশ্বরের’ কাছে আদেশ দেওয়ার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করে, যাতে টোবা টেক সিং বিষয়ক প্রশ্নের নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু সে খুব ব্যস্ত ছিল। সে বললো, গুরুত্ব দেওয়ার মতো এখনো আরো অনেক আদেশ তার বাকি আছে দিতে। অবশেষে বিশন সিং যেন মেজাজ ধরে রাখতে পারলো না। ‘ওপার দি, গুর গুর দি, আনক্স দি, বে ধিয়ানা দি, মুং দি ডাল, অফ ওয়ে গুরু, রাখালসা, অফ ওয়াহে গুরু জি ফাতাহে!’ সে চিৎকার করে আরো বলে উঠল, ‘যে-কথা বললে সমৃদ্ধি আসে, স্যাট সিরি আকাল!’

সে সম্ভবত বলতে চেয়েছে যে, লোকটি যদি একজন শিখ ঈশ্বর হতো – মুসলমান ঈশ্বর না হয়ে, তবে সে তাকে সাহায্য করতো।

বদলির কয়েকদিন আগে, বিশন সিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে এক পুরনো মুসলমান বন্ধু। তাকে দেখেই বিশন সিং চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। প্রহরী তাকে আটকায় এবং বলে : ‘সে এখানে তোমাকে দেখতে এসেছে – এই তোমার বন্ধু ফজল দীন।’ বিশন সিং তার বন্ধুর দিকে অল্প কিছুক্ষণ তাকিয়ে তার চিরাচরিত অর্থহীন কথাগুলি বলতে শুরু করে। ফজল দীন এগিয়ে এসে তার কাঁধে একটা হাত রাখে। 

‘আমি অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম তোমার সঙ্গে দেখা করব। তবে আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম। তোমার পরিবারের সবাই স্বেচ্ছায় হিন্দুস্তান চলে গেছে, সবাই ভালো আছে … আমি যেভাবে পেরেছি তাদের সাহায্য করেছি। তোমার মেয়ে রূপ কৌর …’ – সে বাক্যের মাঝখানে একটু বিরতি দেয়।

‘রূপ কৌর?’ বিশন সিং কি যেন মনে করার চেষ্টা করে। 

‘হ্যাঁ … সে … সেও ভালো আছে’, ফজল দীন কিছুটা থেমে থেমে উত্তর দিলো। ‘সেও অন্যদের সঙ্গে চলে গেছে।’

বিশন সিং নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে।

ফজল দীন আবারো বলতে শুরু করে, ‘তারা আমাকে অনুরোধ করেছিল তোমার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। ইদানীং আমি জানতে পারি যে, তোমাকেও হিন্দুস্তানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভাই বলীর সিং আর ভাই বাধওয়া সিংকে আমার সালাম জানিও এবং বোন অমৃত কৌরকে শুভেচ্ছা দিও। ভাই বলীরকে বোলো যে, আমি ঠিক আছি। সে যে গরু-দুটি রেখে গেছে, তার মধ্যে একটি বাচ্চা দিয়েছে। দুটো বাছুর ছিল … একটি জন্মের ছয়দিন পরে মারা যায় …, আমার যদি আরো কিছু করার থাকে তবে তাদের বোলো, আমি তা করার জন্য প্রস্তুত আছি। এখানে, তোমার জন্য আমি কিছু মিষ্টি নিয়ে এসেছি।’

বিশন সিং মিষ্টির ঠোঙা নিয়ে কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সিপাহির হাতে তুলে দেয়।

‘টোবা টেক সিং কোথায়?’ সে তখন ফজল দীনকে প্রশ্ন করে।

‘টোবা টেক সিং কোথায়?’ ফজল দীন বিস্ময়ের সঙ্গে পুনরাবৃত্তি করে, তারপর বলে, ‘আগে যেখানে ছিল সেখানেই আছে।’

বিশন সিং আবারো জিজ্ঞেস করে, ‘এটা কি পাকিস্তানে, নাকি হিন্দুস্তানে?’ 

‘হিন্দুস্তানে। … ঠিক আছে, না, না, পাকিস্তানে, আমি মনে করি।’ ফজল দীন উত্তর খুঁজতে খুঁজতে বিচলিত হয়ে পড়ে।

বিশন সিং আবারো তার সেই অর্থহীন বুলি বিড়বিড় করতে করতে চলে যায় : ‘ওপার দি, গুর গুর দি, আনক্স দি, বে ধিয়ানা দি, মুং দি ডাল, অফ দি পাকিস্তান অ্যান্ড হিন্দুস্তান অফ দি, দুর ফি টেমুহ্!’

বদলির সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। দু-পাড়ের পাগলদের তালিকা বিনিময় করা হয় এবং স্থানান্তরের দিন নির্ধারণ করা হয়।

খুব ঠান্ডা হাওয়ার একটি দিনে, হিন্দু আর শিখ পাগলে ভর্তি ট্রাক লাহোরের পাগলা গারদ ত্যাগ করে। তাদের সঙ্গে ছিল পুলিশ এবং কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ওয়াগাহ্-তে, উভয় পক্ষের সুপারিনটেনডেন্টরা মিলিত হন এবং প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে প্রকৃত স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা সারারাত ধরে চলতে থাকে।

ট্রাক থেকে পাগলদের বের করে ভারতীয় আধিকারিকদের হাতে তুলে দেওয়া একটা দুরূহ কাজই ছিল বটে। তাদের মধ্যে অনেকেই ট্রাকগুলি থেকে নামতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল। যারা ওপারে যেতে সম্মত ছিল না, তারা বন্যভাবে দৌড়ে পালাচ্ছিল। প্রহরী এবং অন্য কর্মকর্তাদের পক্ষে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে। অনেকেই উলঙ্গ ছিল, তাদের উপর জোর করেও কোনো পোশাক চাপানো যাচ্ছিল না। তারা সঙ্গে সঙ্গেই তা ছিঁড়ে ফেলছিল। অনেকে গালিগালাজ করছিল, কেউ অভিশাপ দিচ্ছিল। একজন বা দুজন গান গেয়ে উঠছিল। কেউ বা আবার একে অন্যের সঙ্গে মারামারি শুরু করে দেয়। অন্যরা কাঁদছিল কিংবা বিলাপ করছিল। বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। মহিলারাও একটা সমস্যা ছিল, এদের চিৎকারও ভয়াবহ ছিল। ঠান্ডা হাওয়ায় তাদের প্রায় প্রত্যেকের দাঁত ঠক্ ঠক্ আওয়াজ তুলে কাঁপছিল।

পাগলদের অধিকাংশই এই স্থানান্তরের পক্ষে ছিল না। কারণ তারা বুঝতে পারেনি তাদের এক জায়গা থেকে উপড়ে অন্য জায়গায় নিয়ে ফেলার কারণ কি। পুরো পাগল না হওয়া দু-একজন লোক চিৎকার করে ওঠে, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ!’ তারা আরো বলে ওঠে – ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ!’ আর এতে মুসলমান এবং শিখ – উভয় সম্প্রদায়ের লোকই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আর তাদের মধ্যে জেগে ওঠা এই বিরোধ অনেক কষ্টে প্রশমিত করা হয়।

এরপর বিশন সিং-এর পালা এলো বর্ডার পার হওয়ার। তখন একটি খাতায় যে কর্মকর্তা তার নাম লিখছিল, তাকে বিশন সিং জিজ্ঞেস করলো, ‘টোবা টেক সিং কোথায়? পাকিস্তানে, না ভারতে?’

কর্মকর্তা হাসলেন। তিনি বললেন, ‘পাকিস্তানে।’

একথা শুনে বিশন সিং পিছন দিকে লাফ দিয়ে বাকি সঙ্গীদের দিকে দৌড়ে গেল, যারা প্রতীক্ষারত ছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে ধরে ফেলে এবং চেক পয়েন্টে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। সে তীব্রভাবে তাদের প্রতিরোধ করে।

‘টোবা টেক সিং এখানে!’ সে চেঁচিয়ে উঠল। ‘ওপার দি, গুর গুর দি, আনক্স দি, বে ধায়ানা দি, টোবা টেক সিং ও পাকিস্তান মুং দি ডাল দি!’

কর্তৃপক্ষ তাকে নানা যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে। ‘দেখো, টোবা টেক সিং এখন হিন্দুস্তানের ভেতর। আর যদি এখনো সেটা সেখানে না থাকে, তবে আমরা জায়গাটাকে অবিলম্বে সেখানে পাঠিয়ে দেব।’ কিন্তু সে অবিচল ছিল এবং যেখানে সে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে এক চুলও নড়লো না। প্রহরীরা বল প্রয়োগের হুমকি দিলে সে সীমানার মাঝ বরাবর একটা জায়গায় নিজের অবস্থান এমনভাবে নেয় যে, পৃথিবীর কোনো শক্তিই তাকে সেখান থেকে যেন নড়াতে না পারে।

যেহেতু সে বরাবরই একজন নিরীহ মানুষ ছিল, তাই তাকে জোর করা হয়নি এবং স্থানান্তর অব্যাহত থাকার সময় তাকে সেই স্থানে থাকতে দেওয়া হয়।

সূর্য ওঠার আগে, এক গগনবিদারী তীব্র চিৎকার বের হয় বিশন সিংয়ের কণ্ঠ থেকে। অথচ সে এই পুরো সময় শান্ত এবং অবিচল ছিল। বেশ কয়েকজন আধিকারিক ও প্রহরী তার দিকে ছুটে এলো। তারা দেখতে পেল, যে-লোক পনেরো বছর ধরে দিনরাত নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সে এখন মাটিতে সোজা হয়ে শুয়ে আছে। তার একপাশে – তারের বেড়ার ওপারে হিন্দুস্তান আর তারের বেড়ার এপারে পাকিস্তান। মাঝখানে, এক টুকরো জায়গা, যার কোনো নাম নেই, সেখানে শুয়ে আছে টোবা টেক সিং।

লেখক-পরিচিতি

উর্দু ভাষার লেখক সাদত হাসান মান্টো (১৯১২-৫৫) বিবেচিত হন ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকার হিসেবে। ক্ষুরধার গল্পবর্ণনশৈলী আর বিষয়ের মাঝে জীবনের নিদারুণ সত্যের স্পষ্টতা – তাঁর ছোট গল্পকে দিয়েছিল অনন্য উচ্চতা। সামাজিক নানা প্রথার সমালোচনা, মানব-প্রকৃতির জটিলতা উন্মোচন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশভাগসৃষ্ট দুর্ভোগ, এবং এরই ক্রমপরিণতিতে লাখো মানুষের শিকড় উৎপাটনসহ ইত্যাদি সমকালীন বিষয়ের সাহসী ও সত্যনিষ্ঠ উপস্থাপনা গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর গল্পে। তবে ছোটগল্প ছাড়াও তিনি বেতার ও চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য রচনা করেছেন, একটি উপন্যাস ও নানা ব্যাপ্তির বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। ছোটগল্পে অশ্লীলতার অভিযোগে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় তিনবার। তীব্রভাবে ভারতভাগের বিরোধিতা করলেও ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের লুধিয়ানার পাপরউদি গ্রামে জন্মগ্রহণকারী এই লেখক নিজেও বাস্তুচ্যুত হন দেশভাগের কারণে। তারপর তিনি তাঁর স্ত্রী ও তিন কন্যাসহ স্থায়ীভাবে পাকিস্তানের লাহোরে বসবাস শুরু করেন। সেখানেও তিনবার তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে গল্পে অশ্লীলতা-বর্ণনের অভিযোগে। শাসক, সমাজ কিংবা সমকাল মান্টোকে সেভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং তিনি নিগৃহীত হয়েছেন বারবার। জীবনের শেষ পর্যায়ে লাহোরে অবস্থানকালে, প্রকৃত বন্ধুর সংকট এবং অর্থাভাব – দুটোতেই ভুগেছেন নিদারুণভাবে। একসময়ে অধিক ও সস্তা মদ্যপানে ঝুঁকে পড়লে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন মান্টো ১৯৫৫ সালের ১৮ই জানুয়ারি। মাত্র ৪৩ বছর বয়সের জীবদ্দশায় যে-গল্পসমূহ সাদত হাসান মান্টো রচনা করে গিয়েছেন, সেগুলি আজো ভারতীয় ছোটগল্পের ভুবনে বাস্তবতা চিত্রায়ণে অনন্য ও দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী।