ধ্যানমগ্নতা

একা ঘরে কিংবা বাইরের নিরিবিলি পরিবেশে কে যেন প্রায়ই আমার সঙ্গে চুপিচুপি কথা বলে। বেশ মায়াজাগা কণ্ঠ, যদিও পুরোটাই বিভ্রম। যেমন আজো চুপ করে ঘরে বসে আছি। জানালা দিয়ে একফালি আলোয় অজস্র ধূলিকণা উড়ছে। অকস্মাৎ টের পাই কেমন খসখস শব্দ। বলি, ‘কে?’

– আমি। কী করছো?

– ভাবছি।

– কী?

– জানি না, তবে ভাবনা আসে।

– আমার কাছে এসো।

– তোমাকে তো দেখা যায় না।

– ভালো করে খোঁজ করো।

চারপাশে তাকিয়ে বললাম, ‘নেই।’

ও খলখল করে হেসে ফেলে।

– হাসছো কেন?

– তোমার ভাবনাবিলাস দেখে।

চেপে রাখা নিশ্বাসটা গম্ভীর শব্দে গড়িয়ে পড়লো। কোনো একটা দুর্বোধ্য ইশারা দৃষ্টিপাতে এমনই চমক ঢেলে দেয় যে, নিতান্ত ছেলেমানুষের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকাই। বলি, ‘তুমি কি আছো?’

সাড়া নেই। আত্মপ্রকাশের অনিবার্য তাগিদ থেকে কিছু বলতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু কি লাভ, বিভ্রম নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটির চেয়ে বরং বাজারে যাই। সেই কখন যে হাতে বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে স্ত্রী।

বাইরে বেরোলাম। বেশ ঝরঝরে লাগে। কেউ একজন যদি সামনে সটান দাঁড়িয়ে বলে, ‘কী নাম আপনার?’ গড়গড় করে অনেক কিছুই বলা যাবে, তবু বুকের উদ্দাম সাহসটুকু কণ্ঠস্বরে এসে কেন যে ম্রিয়মাণ হয়ে যায় …

মেঘের ভেতর জমে থাকা শেষদুপুরের রোদটা গড়িয়ে পড়লো সামনে। উজ্জ্বল আলোয় রাস্তাঘাটের অপ্রসন্নতা মুহূর্তেই ধুয়ে যায়। মনের ভেতর বিচলিত বোধ সহসা মোচড় দিয়ে কীভাবে যে নতুন আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলে।

বাজারে ঢোকার মুখে আজো সেই দৃশ্য। ভ্যানগাড়ির ওপর চা আর সস্তা কেক-বিস্কিট বিক্রি করছে মহিলাটি। বেশ মায়াজাগা গোলগাল মুখ। বলি, ‘চা দাও।’

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। কিছু না বলে চোখ দুটি সরু করে চুলার গর্তে ঘনঘন ফুঁ দিতে থাকে। ঈষৎ বাঁকা পিঠ আরো বেঁকে ক্রমঃনিঃশেষ হয়ে লুটিয়ে পড়ার আগেই মোচড় দিয়ে দাঁড়ায়। তখনই দুটি খালি কাপ এনে রাখে একজন কিশোর। পরনে ময়লা গেঞ্জি আর অবিন্যস্ত ছেঁড়া হাফপ্যান্ট। মহিলা ওর গালে জোরেশোরে চড় বসিয়ে বলে, ‘দেরি করলি ক্যা হারামির বাচ্চা।’ যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে পুরু ঠোঁট জোড়া আলতো নাচিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ছেলেটি।

শেষদুপুরের রোদটা ফিকে হয়ে আসছে। অবোধ কিশোরের পুরু ঠোঁটে নামলো কেমন প্রকৃতিদগ্ধ ছায়া। অল্প অল্প কথা বলছে, কাজ করছে, আগের মতোই গা-সওয়া, যদিও সেঁটে থাকা ছায়াটি দৈনন্দিন ঘটনাপ্রবাহের মাঝে তখনো স্থির টলমল, মিলিয়ে যেতে পারছে না।

চায়ের কথা বেমালুম ভুলে সোজা হাঁটা দিই। ডানে-বাঁয়ে ব্রেকহীন গাড়ির মতো মানুষ ছুটছে। ট্রাফিক সিগন্যালের সামনে দীর্ঘ যানজট। পাশের সরু গলিতে ঢুকে পড়ি। এদিকে গ্যাঞ্জাম কম হলেও গনগনে উষ্ণতায় শরীর কেমন তড়পাচ্ছে। বুক মোচড় দিয়ে একটু কান্না আসছে কি? এলেই-বা, প্রকৃতির ধূলিঝড় কিংবা ধ্যানমগ্ন চোখের জল তো টপটপ করে গড়াতে থাকবে আপন নিয়মেই।

বাজার নিয়ে বাসায় ফেরার পর মনে হলো, কিছু একটা বুঝি কেনা হয়নি। হাত থেকে কখন যে খসে গেছে বাজারের লিস্ট,  কপালের ইতস্তত ঢেউয়ের মতো ভাঁজটা মুহূর্তেই মিলিয়ে যায় স্ত্রীর কণ্ঠে, ‘কী ভাবছো?’

– দেখো তো সব ঠিক আছে কি না।

– দেখছি, চা খাবে?

– এখন চা … আচ্ছা দাও।

– তোমার কী হয়েছে?

– কিছু না।

ঘরে যেতেই পা দুটো কেন জানি অনাবশ্যক জড়িয়ে আসছে। বুকটাও দুলে উঠলো কয়েকবার। এরপর যা কিছু ঘটবে, সবটাই ইচ্ছাশক্তির প্রতিকূলে, কিন্তু কেন এমন হয়? স্ত্রী এসে চা দিয়ে গেল। লেখার টেবিলে বসে দু-কলম লেখার পর অকস্মাৎ কলমের খোঁচায় কাপটি কাত হয়ে যায়। লেখার পৃষ্ঠায় রক্তরেখার মতো ছড়িয়ে পড়ে চা। তখনই আড়াল থেকে খলখলে হাসি একটু একটু কাছে আসার পর আশ্চর্য শূন্যতার ভেতর মুখ তুলে তাকাই। গা শিউরে দিয়ে সেই মানবী-ছায়া বুঝি ঘুরঘুর করছে। বলি, ‘কে!’

– আমি।

ঘরের শূন্যতা মোচড় দিয়ে জাগলো কেমন মরীচিকা ঢেউ। অতঃপর ঢেউ থেকে ঢেউয়ের উত্থানে ঈষৎ তর্জন-গর্জন

থাকলেও ঘরের শূন্যতায় আলোকিত চোখের প্রকট অন্ধ-ঘোর নিয়ে বলি,‘কিছু বলবে?’

– হ্যাঁ।

– কী?

– আমাকে তোমার সঙ্গে বাজারে নিলে না কেন?

– তোমার ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই।

– তুমি কি আগ্রহের বাইরে আর কিছু করো না?

– করি, কখনো-বা।

ও খলখল করে হেসে ফেলে।

– হাসছো কেন?

– তুমি যে স্বার্থপরের মতো নিজেকে লুকোচ্ছে, তাই –

– লুকোচ্ছি! কী জানি –

ফের খলখলে হাসি। লঘু থেকে ক্রমশ উচ্চস্বর। বিব্রত হয়ে বলি, ‘তুমি আমার কাছে বারবার আসো কেন?’

– আমি আসবো কেন, তুমিই তো তোমার অনুভবের সঙ্গে আমায় জড়িয়ে নিয়েছো।

– আমি!

হাসিটা লঘু থেকে ধীরে ধীরে কেমন অনুচ্চারিত বিস্ময় দিয়ে মিলিয়ে যেতেই চমকে উঠি। কার সঙ্গে কথা বলছি! কেমন যেন চেনা-চেনা কণ্ঠ, আবার অচেনা। রীতিমতো গোলকধাঁধা। তবু নারীকণ্ঠের আত্মবিশ্বাস এতটাই প্রবল যে, এটিকে নিছক বিভ্রম ভাবতেও কষ্ট হয়। মানুষের জানার ভেতর কত যে অজানা রহস্য! সর্বনাশা পচন কিংবা স্খলনের অর্বাচীন মুহূর্তগুলো নিকেশ করে আমূল বোধ জল-জোছনার মতো জাগিয়ে বলি, ‘তুমি কি আছো?’

সাড়া নেই …

যেটুকু ছিল, সেটিও মিলিয়ে গেছে অবোধ শিশুর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকার মতো। একটা দাগ নয়তো উপহাসের ব্যঙ্গাত্মক রেখার মতো কিছু কি রেখে গেল? গলিত লাভার মতো সঞ্চরণশীল উত্তাপে-উত্তাপে ঘেমে উঠি, ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। ঘরের চিলতে আলোয় অজস্র ধূলি। সেদিকে তাকিয়ে চলমান ঘটনার বিপরীতে, কোনো একটা রোমাঞ্চকর ভাবনায় নিজেকে ঠেলে দিই। এতে হয়তো ‘রেটিকুলার অ্যাকটিভেটিং সিস্টেমে’ কোনো সমস্যা হলে কেটে যেতে পারে।

পাশের পুরনো ইংরেজি ম্যাগাজিনটা উল্টেপাল্টে অকস্মাৎ একটি ছবির দিকে দৃষ্টি পড়ে। ল্যাপটপে স্মিত হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে একজন মডেল। পরনে গাঢ় নীল স্কার্ট। নিচের শিরোনাম – Find a role model. এরপর, Finding out why she loves her career as much as she does might help you crystallize what’s missing from yours …

লেখাটা বেশ কয়েকবার পড়তে পড়তে ঘুম এসে যায়। ঘুম ভাঙে অনেক বেলা করে। স্ত্রী কাজের বুয়ার সঙ্গে এটা-ওটা নিয়ে কথা বলছে। আমাকে বেরোতে দেখে বললো, ‘কোথায় যাচ্ছো?’

– একটু হেঁটে আসি।

– একা একা কার সঙ্গে কথা বলছিলে?

– কখন?

– ঘুমানোর আগে।

মুচকি হেসে বলি, ‘নিজের সঙ্গে।’

ও তাকিয়ে থাকে, কিছু বলে না। কর্মহীন জীবনের একবুক অসাড়তা নিয়ে কেন যে বিপরীত লাগে সবকিছু। পত্রিকায় মোটা দাগের একটা চাকরি জুটেছিল, সেটা ছিল সৃষ্টিশীল লেখার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাংঘর্ষিক। ছেড়ে দিয়ে এখন ভাড়ার টাকায় দিন গুনছি। যোগ্যতার প্রতিকূলে নানারকম জীবনমথিত ঘটনার সবাক চিত্র উদ্দেশ্যহীন ভবঘুরে বানালেও জীবন তো আর থেমে থাকার জিনিস নয়।

ওর অনড় দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলি, ‘কী ভাবছো?’

– দেখছি।

– কী?

– তোমার মুখ-চোখ, একটু অন্যরকম।

মুচকি হেসে বেরিয়ে পড়ি। আপাতত গন্তব্য নেই, তবে হাঁটার ভেতর একটা ছন্দ আসে। অন্যান্য দিনের মতো নয়, ছন্দে ছন্দে পুরো অনুভবে রৌদ্রছায়ার কী রোমান্টিক খেলা। এরকম সরস আনন্দে, ইংরেজি ম্যাগাজিনের সেই শিরোনামের মতো এখন যদি ছায়ামানবী এসে গদগদ কণ্ঠে বলে, ‘Find a absolute (not role) model’ … অথচ মূর্তমান সত্যের বিপরীতে পদচিহ্নহীন ধোঁয়াশাটুকু আড়ালেই থেকে যায়। অপরাপর যা কিছু, সবটাই জাগতিক।

সেই ভ্যানগাড়ির চা-দোকানিকে গিয়ে বলি, ‘চা দাও।’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কিশোর ছেলেটি চায়ের কাপ ধরিয়ে দেয়। পরপর কয়েক চুমুক গলা দিয়ে নামার পর অকস্মাৎ ঝিমুনি এলো। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে, শরীরকে আংশিক বাঁকিয়ে, ধীরে ধীরে
দৃষ্টি-বোজা পলক চটকে চারপাশে তাকাই। যা কিছু দেখছি, তাৎক্ষণিক অন্যমনস্কতায় সবটাই এলোমেলো। মানুষের মুখ আর অঙ্গভঙ্গির মনস্তাত্ত্বিক বিচারে কেবলই ঝড়ের প্রাবল্য, অজস্র ধূলি উড়ছে। অদম্য ঝিমুনিতে মাথা নুইয়ে মহিলার ছোট্ট টুলটিতে বসে পড়ি। মহিলা মুখ ঘুরিয়ে দেখলো, কিছু বললো না। একসময় ঘুমের রাজ্যে টুপ করে মিশে যাই।

সম্ভবত মধ্যরাত। কৃষ্ণপক্ষের অনুজ্জ্বল চাঁদটাকে ভেঙে ভেঙে পাতলা মেঘের দল ছুটছে। বাজারের পাশে জনমানবশূন্য রাস্তাটির ওপর চাঁদের লোহিত আলোটা কাঁপছে সম্ভবত মেঘের কারণেই। যখন চারপাশে কেউ থাকে না, তখন নিজেকেই চোখে পড়ে বেশি। উপলব্ধির জগৎটাকে রেখাঙ্কিত করা যায় নিরুপদ্রবভাবে। আর চোখ দিয়ে যদি ফোকাসের মতো গলে পড়ে অব্যক্ত দহন, বেশ বুঝতে পারি … এই নিমজ্জমান আলো-আঁধারির রাস্তায় এটি আরো আলোকিত হতে থাকবে –

বাজারের শেষ প্রান্তে উঁচু জায়গায় কুপি বাতির আলো নিভু-নিভু করছে। হালকা আলোয় স্পষ্টত কিছু মানুষের কম্পমান ছায়া অনুসরণ করে এগিয়ে যাই। গুনগুন করে কথা বলছে দুজন বৃদ্ধ। পাশে পেছন ফিরে বসে আছে একজন মহিলা। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে ঝট করে তাকায় বৃদ্ধ, ‘খারে চান?’

– কী করছেন এখানে?

– বই রইছি, ঘুম আয় ন।

– বাসা কই আপনার?

– বাসা ছ্যালো, অন নই। পাহাড়ের মাডি পইরে

ছাওয়াল-পাওয়াল বুউ বেবাখথিরে ঘুমোর মধ্য চাপাদি শ্যাষ খরি দ্যাছে।

একেবারে বোধশক্তিহীন সরল বর্ণনা। পুরো বাস্তবমুখী, যেন এমনটি হবেই, না চাইলেও হবে, হতে থাকবে। … কিংবা কষ্টের ব্যাপারটি অবান্তর। শত শত পদচিহ্নের ক্ষতরূপ নিয়ে নিঃসাড়ে পড়ে আছে মধ্যরাতের বাজার, তার কোলেই হয়তো জুটে যায় কিছু উত্তাপহীন নিরাশ্রয় মানুষ। এবার মহিলার দিকে তাকিয়ে বলি, ‘সে কে?’

বৃদ্ধ ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে বললো, ‘খার খথা খন, খাউরে তো দেহি ন।’

– এই যে বসে আছে।

– খই, দেখতো হারি ন।

মহিলা ধীরে ধীরে সামনে ঘুরতেই আমি বাকরুদ্ধ পাথর। বেশ চমৎকার মুখ, ঠোঁটে স্মিত হাসি। ম্যাগাজিনের সেই মডেল কন্যার মতো, পার্থক্য কেবল সাজসজ্জা ও পরিবেশ। হাসিটা প্রসারিত করে বললো, ‘কেমন আছো?’

গদগদ কণ্ঠে বলি, ‘ওহ তুমি, এখানে বসে আছো, আজ তোমাকে খুঁজে পেয়েছি।’

– না, পাওনি।

– পাইনি মানে, এই তো তোমাকে দেখছি, কী সুন্দর!

– তুমি যা দেখছো, তা তোমার সৃষ্টিগত ভাবনার নির্যাস।

– নির্যাস!

অবাক হই, কী বলছে সে? স্পষ্ট দেখার ভেতর বিভ্রম থাকবে কেন? শরীরে অস্বস্তি মোচড় দেয়। কুপিবাতির আগুন কি দাউ-দাউ করে জ্বলছে … আগুনের স্ফুলিঙ্গে মানুষ যেমন জড়সড় বাঁকা, তেমনি একটা স্বস্তিহীন চঞ্চল পরিস্থিতির ভেতর আশ্রয় নয়তো আশ্রয়ের ধ্রুবজ্যোতি সমূলে আঁকড়ে ওর একটি হাত চেপে বলি, ‘এতকিছু বুঝি না, তুমি চলো।’

– কী করছ!

– যাবে না?

– ওই ব্যাটা কই যামু তর লগে, হাত ছাড়!

ঘুম কেটে যায়। চমকে উঠি। চা-বিক্রেতা মহিলাটি তীর্যকভাবে তাকিয়ে দ্রুত হাত ছাড়িয়ে নেয়। পাশে কিশোর ছেলেটি পুরু ঠোঁট প্রসারিত করে খিলখিল করে হাসছে।