নারী ও সময়ের গল্প

ভাদ্রের শেষ, আকাশে রোদ ঝলমল করছে।

গোটা মছলন্দপুরের মাঠে সবুজ বরণ ধান ঝলমল করছে, বাঁশবনের পাতায়, গাছপালার ডালে-পল্লবে গাঢ় সবুজ, হালকা সবুজ থমথম করছে। রোদের ছটায় ঝিলিক মারছে, পুকুরগুলিতে বড় বড় পদ্মপাতা বাতাসের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। বড় পুকুরের অন্য পাশে নিরিবিলি পদ্মফুল ফুটেছে, আঙিনাতে স্থলপদ্ম, শিউলি ফুল ঝরছে শিউলিতলায়, মধুমতির পানিতে রং ফিরেছে; নীলপানি কাচবরণ হয়েছে। তাই সোনার মছলন্দপুর সবুজ হয়েছে, ধীরে ধীরে রুপোর বরণে নদীর কূলে কূলে কাশফুল ফুটেছে। ঝরঝরা সোনারঙা মাটি চিকচিক করছে কাচ-বালির সংমিশ্রণে। আকাশে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি, জড়াজড়ি। মানুষের মনে কেন যেন আনন্দ থই থই করছে। কামারখালীতেও কি এক মিহি আনন্দধ্বনি, রাশি রাশি ফুলের পাপড়ির মতো আশীর্বাদ হয়ে ঝরে পড়ছে যেন। (মাশুল)

শাহনাজ পারভীনের মাশুল উপন্যাসের এই অনুচ্ছেদটি যে-কোনো পাঠককে লেখিকার রচনাশৈলীর শক্তিমত্তা সম্পর্কে আস্থাশীল করে তুলবে। ভালো লাগার একটি আবেশ নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে যাবে পাঠকের ইন্দ্রিয়কে। এই আবেশ নিয়েই পাঠক অগ্রসর হতে থাকবেন উপন্যাসের কাহিনি ও গতিপথের সহযাত্রী হয়ে।

মূলত তিনটি পরিবারকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসের ঘটনাবলি আবর্তিত হলেও দুটি পরিবারই পাল্টাপাল্টি করে প্রাধান্য লাভ করেছে। প্রাসঙ্গিক এবং অনিবার্যভাবেই আরো কিছু আপাতবিচ্ছিন্ন ঘটনা সংযুক্ত হয়ে উপন্যাসের বৃত্ত-পরিধিকে বিস্তৃত করেছে। উপন্যাসটি সম্পর্কে আত্মকৈফিয়ত দিতে গিয়ে লেখিকা লিখেছেন : ‘এটি আমার লেখা প্রথম উপন্যাস। … প্রথম লেখা উপন্যাসের জন্য রয়েছে হৃদয় ছোঁয়া ভালোবাসা। আশির দশকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে লেখা …। উপন্যাসটিতে তৎকালীন সমাজব্যবস্থা, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ছাত্র রাজনীতি, ত্রিমুখী প্রেমের জীবনমুখী দ্বন্দ্ব, মধ্যবিত্ত পরিবারের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কিছু বাস্তব চিত্রের বিচিত্রতা উঠে এসেছে।’ এর পরের বিষয়গুলি পাঠককে জানতে হবে উপন্যাসটি পাঠের মাধ্যমে।

আলোচনায় প্রবেশের আগে উপন্যাসের কাহিনির সংক্ষিপ্ত একটি আভাস জেনে রাখা জরুরি। কাহিনিটি এমন : একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের দাপুটে, চঞ্চল, সংগীতপ্রিয় একটি মেয়ে মুমু। সে শিপলু নামে খানিকটা মাস্তান ধরনের এক ছাত্রনেতার প্রেমে পড়ে। চারিত্র্য বৈশিষ্ট্যের বিচারে এই জুটির মধ্যে বিশেষ কোনো সাদৃশ্য না থাকলেও প্রজাপতির প্রদীপশিখার মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো মুমু আকণ্ঠ ডুবে যায় শিপলুর মোহবৃত্তে। মেয়ের এই মনোভাব আঁচ করতে পেরে পরিবার মুমুকে বিয়ে  দেয় কায়েস নামে পুলিশের এক সাব-ইন্সপেক্টরের সঙ্গে। এই বিয়ে মেনে নিতে পারে না মুমু। দিন কয়েকের মধ্যেই সুযোগ মতো পালিয়ে গিয়ে সে বিয়ে করে শিপলুকে। উপার্জনহীন শিপলুর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে মুমু বুঝতে পারে জীবন ও জগতের রূঢ় বাস্তবতা। এর মধ্যেই দুটি কন্যাসন্তানের মা হয় মুমু। দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে শিপলু। বারবার পেশা পরিবর্তন করে কোথাও স্থিতিলাভ ঘটে না তার। ক্রমে সে প্রবেশ করে নিষিদ্ধ জীবনের কদর্য অন্ধকারে। শিপলুর উপেক্ষা, জীবনের নানা টানাপড়েন সইতে না পেরে মুমু আত্মহত্যা করে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, মুমুর লাশ থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তার পূর্বতন স্বামী কায়েসকেই আসতে হয় পুলিশের কর্মকর্তা হিসেবে। মুমু তার ভুলের মাশুল দিয়েছে, অথচ এমনটি সে চায়নি, কল্পনাও করেনি, কায়েসের এই হৃদয়বিদারক খেদোক্তির মধ্য দিয়েই উপন্যাসের যবনিকাপাত ঘটে।

উপন্যাসের এই যাত্রাপথের দুধারে পথচলতি মানুষের মতো কিংবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের মতো আরো নানান
ঘটনা-দুর্ঘটনার সঙ্গে পরিচয় ঘটে পাঠকের। পাঠক পথ হাঁটতে থাকেন। একটি একটি ঘটনা ঘটতে থাকে সিনেমার পর্দায় দেখা ছবির মতো। মুমু-কায়েস-শিপলু – উপন্যাসের প্রধান এই তিনটি চরিত্রের পরিবার-পরিজনেরা এক এক করে এসে হাজির হতে থাকে কাহিনির বাঁকে বাঁকে। অনেক চরিত্রের দেখা মেলে এই উপন্যাসে। কোনো চরিত্র দু-একবার উঁকি দিয়েই মিলিয়ে যায়, কোনো চরিত্র কিছুটা পথ চলার পর অদৃশ্য হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে পৌঁছায় সেই মুমু-কায়েস-শিপলু। কায়েস মুমুর বিবাহিত স্বামী হলেও সে নায়ক চরিত্র হয়ে উঠতে পারেনি। শিপলুকেও নায়ক বলা যায় না। মাশুলকে একটি নায়িকাপ্রধান উপন্যাস বলা যেতে পারে।

শাহনাজ পারভীন পূর্বেই স্বীকার করে নিয়েছেন, এটি তাঁর প্রথম লেখা উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস প্রথম সন্তানের মতোই।
সে-কারণে এই উপন্যাসকে ঘিরে লেখিকার বিশেষ আবেগ, উচ্ছ্বাস, ভালোলাগা ও ভালোবাসা রয়েছে। প্রথম উপন্যাস হলেও তিনি নিশ্চয়ই মনে মনে একটি পূর্বপ্রস্তুতি নিয়েই লেখায় হাত দিয়েছেন। প্রথম উপন্যাস হিসেবে এটি লেখিকার আত্মপরীক্ষার একটি নমুনাও। মূলত এই উপন্যাস লেখার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই তিনি পরবর্তী উপন্যাসগুলি লিখতে প্রয়াসী হয়েছেন। প্রথম লেখা হিসেবে উপন্যাসে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি-ঘাটতি এবং দুর্বলতা রয়েছে। সব লেখকের এটা থাকেও। তবু প্রথম লেখা লেখককে মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব বহন করে। অর্থাৎ শুরু থেকে একজন লেখক কিভাবে নিজেকে ভেঙেছেন, গড়েছেন, পরিবর্তন করেছেন, মত ও পথ বদল করেছেন এইসব বিচারের ক্ষেত্রে প্রধান মাপকাঠি তাঁর প্রথম লেখা। এসব কথা স্মরণে রেখেই একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার দু-একটি জিজ্ঞাসা এবং উপলব্ধি লেখিকা এবং অন্যান্য পাঠকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে  চাই। এটাকে মতবিনিময় বললেও ভুল হবে না।

মাশুল উপন্যাসে অনেক ঘটনারই সমাবেশ ঘটেছে। কিন্তু কাহিনির ঠাসবুনন বলতে যা বোঝায়, সেই বুননের গাঁথুনি সর্বত্র নিবিড় হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে পাঠক কোনো কোনো ক্ষেত্রে পূর্বানুমান করার ফাঁক-ফোকর খুঁজে পান। পূর্বেই বলেছি,
এ-উপন্যাসে নায়ক হয়ে ওঠার মতো কোনো বলিষ্ঠ পুরুষ চরিত্র নেই। পুরো উপন্যাসকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করার মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চরিত্র শিপলুও নয়, কায়েসও নয়। নায়িকাপ্রধান এই উপন্যাসের নারী চরিত্র মুমু কিছুটা বেপরোয়া, দুঃসাহসী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং বাঁধনছেঁড়া মানসিকতার হলেও অধিকাংশ নারী চরিত্রই একরৈখিক, সমান্তরাল, প্রচলিত সমাজ ও জীবন ব্যবস্থায় আত্মসমর্পিত। গতানুগতিক জীবনপ্রবাহে অভ্যস্ত তারা। কোনো রকম পরিবর্তন বা ভাঙাগড়ার প্রবণতা তাদের
চিন্তা-চেতনায় কাজ করে না।

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের একটি ক্রান্তিকালকে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখিকা। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কিছু চিত্র উপন্যাসে বিধৃত হলেও এই ছাত্র-আন্দোলনের কোনো ইতিবাচক সম্ভাবনার আভাস উপন্যাসে মেলে না।

উপন্যাসে ছোট ছোট অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে একের পর এক। একটি ঘটনার পর আরেকটি ঘটনা ঘটার মধ্যে সাহিত্যের পরিভাষায় যাকে উল্লম্ফন বলে, সেটার গতি সর্বত্র রক্ষা পায়নি। সংলাপগুলি আরো পরস্পর ঘনিষ্ঠ হওয়া দরকার। তাছাড়া দুটি চরিত্র যখন পরপর সংলাপ বিনিময় করছে তখন তাদের পারিপার্শ্বিক আবহ, চোখের চাহনি, মুখের ভঙ্গিমা, আবেগের উচ্ছলতা, দুঃখের বিষণ্নতা, ক্রোধের উন্মত্ততা কীভাবে ক্রিয়াশীল থেকেছে সে-সম্পর্কে লেখিকার বিবরণ, বিশ্লেষণ এবং বিশদ মন্তব্য থাকলে সংলাপগুলো আরও প্রাণবন্ত হতো বলে আমার ধারণা।

প্রথম উপন্যাস হিসেবে মাশুল-এ কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি অবশ্যই আছে এবং সেটা থাকাই স্বাভাবিক। আমার ধারণা, লেখিকা তাঁর পরবর্তী উপন্যাসে পূর্ববর্তী ঘাটতি, দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন বা হবেন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা এবং পরিপক্বতা দিয়েই নিজেকে পরিমাপ এবং নির্মাণ করতে পেরেছেন।