না-বলা কথা

লাউঞ্জের বাইরে বেরিয়ে বাবাইকে হাত নাড়তে দেখে এতক্ষণকার যাবতীয় উৎকণ্ঠা দূর হলো। প্রথমত এই আমার পয়লা আকাশপথে ভ্রমণ, তার ওপর সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে সম্পূর্ণ অজানা দেশে! টানা বারো ঘণ্টা একনাগাড়ে বসে থেকে হাতে-পায়ে যেন খিল ধরে যাওয়ার জোগাড়। আমার পাশের সিটে এক সাদা চামড়ার মাঝবয়েসি বিশালবপু সাহেব বসে ছিলেন। শুরু থেকেই আমার জড়সড় ভীতিবিহ্বল অবস্থা দেখে তিনি হয়তো কিছু আন্দাজ করে থাকবেন। মৃদু হেসে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেছিলেন, গোয়িং ফার?

কী উত্তর দেবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। ‘ফার’ বললে কি ঠিকঠাক বোঝানো যায়? আমার কাছে এ-যাত্রা তো যাকে বলে একেবারে ‘ফার’-এর সুপারলেটিভ ডিগ্রি! এতদিন পর্যন্ত আমার দৌড় একবার গয়া, পিতৃদেবের পিণ্ডদানের উদ্দেশ্যে, আরেকবার মেজো শালির পীড়াপীড়িতে দিল্লি­ হয়ে মানালি। প্রথমটা ট্রেনের আন-রিজার্ভড কম্পার্টমেন্টে দেহাতি মানুষদের সঙ্গে গুঁতোগুঁতি করে যাওয়া-আসা। দ্বিতীয়টা অবশ্য বউয়ের প্রেস্টিজ বাঁচাতে থার্ড-এসিতে দিল্লিযাত্রা। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি!

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ভদ্রলোক আরেকটু হেসে বলেছিলেন, ফার্স্ট টাইম অ্যাব্রড আই প্রিজিউম! ডোন্ট অর্ডার ফর ভেজ ফুড। দে সার্ভ রাবিশ ভেজ!

তারপর সারাটা পথ ভদ্রলোক রাশি রাশি খেলেন আর নাক ডাকিয়ে ঘুমুলেন। আকাশললনা-পরিবেশিত খাবার তো ছিলই, তার সঙ্গে ভদ্রলোকের হস্ত-তল্পি থেকে বেরোতে লাগল গাদা গাদা চকলেট, চিপস, স্যান্ডউইচ, মায় একছড়া পক্ব কদলি পর্যন্ত।

তাতে অবশ্য আমার সুবিধেই হলো। সারাটা যাত্রাপথ ওর মুখ বন্ধ, হয় খাওয়ার জন্যে, নয়তো ঘুমের জন্যে। ফলে অস্বস্তিকর কৌতূহল থেকে অব্যাহতি। এয়ারবাস থেকে নামার সময় ডাকঘরের অমলের মতো সুর করে লোকটার কানে কানে বললাম, আকাশভ্রমণে যে এত সুখ, তা তোমার কাছে শিখে নিলুম।

লোকটা বুঝতে না পেরে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে আমার দিকে তাকাল।  বললাম, আই এনজয়েড ইয়োর কম্পানি ভেরি মাচ। ইটস মাই ফরচুন টু হ্যাভ অ্যা নাইস কো-ফ্লায়ার লাইক ইউ!

একগাল হেসে ভদ্রলোক বাঘের মতো বিশাল লোমশ থাবা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ! মোস্ট অব দ্য পিপল ডোন্ট লাইক মি ফর মাই স্নোরিং, ইভেন মাই ওয়াইফ!

ভদ্রলোকের করমর্দনের আতিশয্যে আমার চক-ডাস্টার ধরা আঙুলগুলো মড়মড় করে উঠলেও অতিকষ্টে হাসিমুখে বিদায় জানাতে হলো।

টিকিট পাওয়ার পর থেকেই মনের মধ্যে নানারকম দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছিল। তারপর থেকে যাত্রার দিন যত এগোচ্ছিল, নানারকম কাল্পনিক বিভ্রাটজনিত ত্রাস আমাকে ততই গ্রাস করছিল। যদি ঠিক সময়ে এয়ারপোর্টে না পৌঁছতে পারি, যদি পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে ইমিগ্রেশনে কোনো গোলমালে পড়ি, যদি মাঝ-আকাশে প্লে­নটা হাইজ্যাক হয়ে যায়, যদি নেমে লাগেজ খুঁজে না পাই, যদি আমাকে রিসিভ করতে ঠিক সময়ে বাবাই এয়ারপোর্টে না আসতে পারে – ‘যদি’র সে এক মস্ত লিস্টি।

আমার অবস্থা দেখে তো বেণু হেসে খুন। মাঝে মাঝেই টিপ্পনি কেটেছে, তোমাকে দেখে কে বলবে ছেলের কাছে যাচ্ছ। মনে হচ্ছে, আসলে তুমি সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে যাচ্ছ!

এমন টিপ্পনি কাটার হক বেণুর নিশ্চয় আছে। তার ভাইবোনেরা তা বলতে বিদেশ যাচ্ছে, নিজের ছেলে পাঁচ বছরে বারসাতেক এদেশ-ওদেশ করে ফেলেছে। নিজেও গেল বছর মেজো বোনের সঙ্গে ছেলের কাছে ঘুরে এসেছে। মেজো শালি নিজে দিল্লি­ ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়, ভায়রাভাই সায়েন্টিস্ট। ফলে নানারকম সেমিনার-সিম্পোজিয়াম উপলক্ষে বিদেশ যাওয়া ওদের কাছে জল-ভাত।

আমি গরিবগুর্বো আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় নিতান্ত অকুলীন এক গ্রাম্য স্কুলের শিক্ষক। আমার শ্বশুরমশাই রিটায়ার্ড হেডমাস্টার কালাচাঁদ বাড়ুজ্জে এখনো মাঝে মাঝে হাত কামড়ান আমার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্যে। ছাত্র হিসেবে আমার ট্র্যাক রেকর্ড দেখে তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, ভবিষ্যতে আমি নিশ্চয় বড় কেউকেটা একটা কিছু হবো। কিন্তু অমন ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে হাড়-হাভাতে আদিবাসীদের মধ্যে আমার এই স্বেচ্ছা-নির্বাসন তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি। এই নিয়ে কালাচাঁদ এবং তাঁর কন্যারত্নের আজো আফসোসের শেষ  নেই।

বাবাই কানাডা যাওয়ার পর থেকে আমাকে ওখানে যাওয়ার জন্যে সাধাসাধি করেছে। কিন্তু নানা কারণ দেখিয়ে প্রতিবারই আমি এড়িয়ে গেছি। বেণু রাগ দেখিয়ে বলেছে, বন্যেরা বনে সুন্দর –

বাবাইয়ের রিসার্চ-স্কলারশিপ মঞ্জুর হতে এখনো কিছুটা সময় লাগবে বলে সম্প্রতি পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশনের পরে ওদেশেই একটা পার্টটাইম চাকরিতে ঢুকেছে। মাত্র মাসচারেক হলো।

স্বোপার্জিত টাকায় সে এবার একেবারে প্লে­নের টিকিট কিনে পাঠিয়েছে, যাতে বাজে অজুহাত দেখানোর সুযোগ না পাই।

আচমকা মেয়েটার ওপর চোখ আটকে গেল। বাবাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

হঠাৎ আমার হৃৎপিণ্ড যেন স্তব্ধ হয়ে এলো। অবিকল সেই চেহারা। তেমনি দুর্গাপ্রতিমার মতো টানাটানা চোখ, চিবুকের নিচে সুঁচালো ডৌল, এমনকি হাসিটাও হুবহু একইরকম। যেন সাতাশ বছর আগেকার সালোয়ার-কামিজের মেয়েটাই জিন্স-টিশার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে, একরত্তি বয়েস বাড়েনি!

কাছে আসতে বাবাই আলাপ করিয়ে দিলো, আমার বান্ধবী জিনি।

মেয়েটা হাই বলে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাসল। একই রকম সাজানো দাঁতের সারি। সেরকমই নিচের পাটির একটা দাঁত আরেকটার ঘাড়ে ওঠা, ঠোঁটের নিচে একটা বাদামি তিল। আমার সবকিছু কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল। আমি কাঁপাকাঁপা হাতে মেয়েটার বাড়িয়ে দেওয়া শঙ্খের মতো সাদা নিটোল হাতখানা ধরে ‘হাই’য়ের উত্তরে কী বলব ভেবে পেলাম না। আমার বুকের মধ্যে এক ভয়ানক তোলপাড় শুরু হলো। বহু বছর আগের এক বর্ষণক্ষান্ত বিকেলের নরম রোদ্দুরে তার কান্নাভেজা চোখদুটো মনে পড়ে গেল।

শরতের বৃষ্টিস্নাত ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস। পিজির মার্কশিট নিতে সেই  শেষবার আমার ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া।

মেইন বিল্ডিংয়ের পেছনে বিস্তীর্ণ পতিত জমিতে মেঘভাঙা সোনালি রোদমাখা রাশি রাশি কাশফুল। পুজোর ছুটির আগে সুনসান ক্যাম্পাস। ছাতিম গাছটার তলায় বাঁধানো বেদিতে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরা সেই বিষাদপ্রতিমার টুলে পাতা থেকে চুঁইয়েপড়া ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির ওপরে বেলাশেষের আলো পড়ে মুক্তোর মতো ঝলকাচ্ছিল। মুখখানা গোধূলির অস্তরাগে রক্তিম। উদ্গত কান্নাকে প্রাণপণে আড়াল করতে ওর ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপছিল। গভীর দলিতাঞ্জন চোখে টলটলে জল নিয়ে নীরবে সে আমার চোখে নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিল।

– কী হলো বাবা, অমন করে কী দেখছ?

বাবাইয়ের কথায় লজ্জা পেয়ে জিনির হাত ছেড়ে দিলাম।

গত মাসে বাবাই একটা গাড়ি লিজ নিয়েছে। লেফট-হ্যান্ড ড্রাইভিং, এদেশে এটাই রীতি। মাল্টি-লেন রাস্তা তেলের মতো মসৃণ। পাশ দিয়ে দুরন্ত গতিতে হুস্হুস্ করে একের পর এক গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। জিনি আমার পাশে বসে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল। অথচ আমি ওর কথায় মন দিতে পারছিলাম না। বাইরেটা বেশ ঠান্ডা। তবু জিনির পাশে বসে আমি কুলকুল করে ঘামতে লাগলাম।

বাবাই নতুন গাড়ি চালাতে শিখেছে। হাইওয়েতে চালাতে বুঝি অসুবিধা হচ্ছিল।  হঠাৎ জিনি বলল, সোম, উইল ইউ প্লি­জ স্টপ দ্য কার?

রাস্তার পাশে দাঁড় করানো হলো গাড়ি। মিষ্টি হেসে জিনি বলল, সোম, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, লেট মি ড্রাইভ প্লি­জ। সিট বিসাইড ড্যাড অ্যান্ড টক টু হিম।

মেয়েটার ভদ্রতাবোধ দেখে অবাক হয়ে গেলাম। বাবাইকে যেন বুঝতে দিতে চায় না যে, ও খারাপ ড্রাইভ করছে। আরো একটা ব্যাপারে চমৎকৃত হলাম। ও ‘ইয়োর ড্যাড’ না বলে শুধু ‘ড্যাড’ বলল। গাড়ি চলল ঝড়ের গতিতে।

আমাদের পৌঁছে দিয়ে জিনি ফিরে যাওয়ার সময় মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করল, আংকল, হাউ লং আর ইউ স্টেয়িং হিয়ার?

তারপর আমার চোখে চোখ রেখে রহস্যময় হেসে বলল, ইফ ইউ ওন’ট মাইন্ড, আই’ল বি কামিং টু নো অ্যাবাউট ইয়োর স্কুলস!

দুদিনেই আমি যেন হাঁপিয়ে উঠলাম। বাবাই সাতসকালে উঠে কোনো রকমে ব্রেকফাস্ট সেরে অফিসে বেরিয়ে যায়, ফিরতে ফিরতে গভীর রাত। আমি একা একা সারাদিন হেঁটে অচেনা ছোট্ট শহরটা ঘুরে দেখি। সন্ধেবেলা একলা ঘরে টিভি চালিয়ে টুকটাক রান্না করি, খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন পর্যন্ত পড়ে ফেলি, তবু সময় যেন কাটতে চায় না। মাঝে মাঝে জিনির কথা মনে পড়ে। জিনির কথাই কি? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি। 

কয়েকদিন পরে বাবাই অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমিও বেরোনোর জন্যে তৈরি হচ্ছি, এমন সময় একটা ফোন এলো। জিনির। বলল, আংকল। প্লি­জ স্টে অ্যাট হোম, অ্যা’ম কামিং।

মনটা বেশ খুশি খুশি হয়ে উঠল। একটু অস্বস্তিও হলো। ও নিশ্চয় জানে,  এ-সময়ে বাবাই ঘরে থাকে না।

মিনিট দশেক পরে ডোরবেল বাজতে দরজা খুলে দেখি হাসিমুখে জিনি দাঁড়িয়ে। ওর পেছনে আরেকজন কেউ।

জিনি তাঁর হাত ধরে সামনে টেনে এনে বলল, আংকল, দিস ইজ মাই মম!

ঘরের মধ্যে ভূত দেখলেও বুঝি এতটা অবাক হতাম না। এই প্রৌঢ় বয়সেও আমার হৃৎপিণ্ড যেন লাফিয়ে উঠল। 

মনে হলো, যেন টাইম মেশিনে চড়ে আমি পেছনের দিকে ছুটতে শুরু করেছি। ফেলে আসা সময় যেন আমাকে তীব্রভাবে পেছনপানে টানছে।

দুই

ছোটবেলায় বাবার ওপর আমার খুব রাগ হতো। এত কাজ থাকতে কী দরকার ছিল পুলিশে চাকরি নেওয়ার? পুলিশের ছেলে হওয়ার কারণে জ্ঞানোন্মেষের পর থেকে আমাকে কম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি। পুলিশ মানেই অসৎ – সামাজিক পরিমণ্ডলে এই বদ্ধমূল ধারণার কারণে অনেক তির্যক মন্তব্য হজম করতে হয়েছে আমাকে।

অথচ বাবার মতো সৎ এবং নীতিনিষ্ঠ মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। পুলিশি দস্তুরে অনভ্যস্ত আমার বাবার সঙ্গে নিজের দফতরের ঊর্ধ্বতন কিংবা অধস্তন, কারো সঙ্গে বনিবনা হতো না। বাবা তাই কোথাও থিতু হতে পারত না। আজ দার্জিলিং, তো কাল পাথরপ্রতিমা। মা মাঝে মাঝে রেগে বলত, তিনটে বেড়ালছানা আমাকে গছিয়ে দিয়ে উনি দেশোদ্ধার করে বেড়াচ্ছেন!

বাবা হেসে বলত, ভাগ্য আমাকে ঘাড় ধরে গোটা রাজ্যটা চিনিয়ে ছাড়ছে। ছোটবেলায় ভূগোলে কাঁচা ছিলাম কি না!

তখন আমি বেশ কিছুটা বড় হয়েছি। পুরুলিয়া বিদ্যাপীঠের শেষ ধাপের ছাত্র, কঠোর অনুশাসনের আশ্রমিক জীবন।

প্রতিদিন বিকেলে স্কুলের সামনের মাঠে আমরা ফুটবল খেলতাম। দু-একজন তরুণ মহারাজও মাঝে মাঝে ধুতিতে মালকোচা মেরে আমাদের সঙ্গে মাঠে নেমে পড়তেন।

সেদিন সকাল থেকে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, সারামাঠ জল-থইথই। খেলুড়েদের দু-একজন বলল, চল সিনেমা দেখে আসি। নিশিপদ্ম বলে একটা হেব্বি বই লেগেছে!

সন্ধেবেলা সিনেমা দেখে ফেরার সময় দূর থেকে দেখলাম হোস্টেলের গেটের সামনে পুলিশের জিপ। বাবা তখন আড়সাতে পোস্টেড। আমার তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া। কোনোদিকে না তাকিয়ে মুখ নিচু করে হোস্টেলে ঢুকতে যাব, এমন সময় জিপের মধ্যে থেকে কমল মিত্রের মতো জলদগম্ভীর গলায় বাবা বলল, দাঁড়াও। কোথায় গিয়েছিলে?

সত্যি কথাই বললাম।

বাবা বলল, আজ রাতে তোমার বইখাতা, জামা-কাপড় সব গুছিয়ে রাখবে। কাল সকালে থানার জিপ এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। মহারাজের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে।

বাতাসে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে মান্ধাতার আমলের জিপ বেরিয়ে গেল।

পরদিন সকালে সত্যি সত্যিই থানার জিপ এসে হাজির। আমি বাধ্য ছেলের মতো যাবতীয় স্থাবর সম্পত্তিসমেত পুলিশের জিপে চেপে বসলাম। অযোধ্যা পাহাড়ের মাথায় একটা ছোট্ট গ্রামের শেষ প্রান্তে পৌঁছে জিপ থামল।

একখণ্ড রুক্ষ টাঁড় জমির ওপর খাপছাড়াভাবে তৈরি অত্যন্ত দীনহীন কয়েকটা কুটির। মাটির দেয়াল, খাপরার চাল, জানালার কোনো বালাই নেই। দরজা বলতে বুনো গাছের ডালপালা দিয়ে তৈরি ঝাপ।

যাদুগোড়া আবাসিক প্রাইমারি স্কুল। জিপের শব্দে ছোট ছোট কয়েকটা আদিবাসী বাচ্চা বেরিয়ে এসে অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে রইল।

হেডমাস্টার রামলাল মুর্মু ‘কাকের মতো কালো এবং বকের মতো শীর্ণ’। কম কথার মানুষ, আমাকে মাঠের শেষ প্রান্তে একটেঁড়ে একটা ঘর দেখিয়ে দিলেন।

ভেতরে ঢুকে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। এবড়োখেবড়ো মাটির মেঝে, কোনোরকম আসবাবের বালাই নেই।  শোয়ার জন্যে শুধু একটা মাদুর আর একখানা মশারি আমার জন্যে বরাদ্দ। রাতে আলোর জন্যে একটা হারিকেন। এক রাতের মধ্যেই আমার বাবা এতসব ব্যবস্থা করে ফেলেছে ভেবে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু পরে দেখেছিলাম, অন্য আবাসিকদের জন্যেও অভিন্ন ব্যবস্থা।

রামলাল মুর্মু ছাড়া বাকি দুজন টিচার এই স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র। একটু বেলা হতে তারা এসে হাজির হলেন। এরা সকলেই স্বেচ্ছাশ্রম দেন। সরকারি অনুদানবঞ্চিত স্কুলটা চলে কিছু শুভানুধ্যায়ী মানুষের দানে, যাদের বাচ্চারা এখানে পড়ে, তারাও সাধ্যমতো ক্ষেতের চালডাল আনাজপাতি দিয়ে যান।

ছোট ছোট শীর্ণকায় বাচ্চাগুলোর কারো ইজেরে দড়ি নেই, কারো গলায় গুচ্ছের তাবিজ, কারো নাক দিয়ে শিকনি গড়াচ্ছে। আমাকে ওরা এমন অবাক হয়ে দেখছিল, যেন কোনো ভিনগ্রহের জীব এসে হাজির হয়েছে।

দুপুরে অ্যালুমিনিয়ামের থালায় খেতে দেওয়া হলো জলের মতো পাতলা ডাল, তেল-মশলাবিবর্জিত আলু-সয়াবিনের তরকারি আর মোটা চালের ভাত। সেই সামান্য খাবার বাচ্চাগুলো এমন পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেতে লাগল, যেন অমৃত খাচ্ছে। কেউ কেউ জমিয়ে রাখা সয়াবিন বড়িগুলো শেষে এমনভাবে চুষতে লাগল, যেন খাওয়ার আনন্দ শেষ হতে দিতে চায় না।

স্কুলে একটামাত্র টিউবওয়েল। খেয়েদেয়ে উনুনের ছাই দিয়ে প্রত্যেকেই নিজের থালা মেজে লাইন দিয়ে ওই টিউবওয়েলের জলে ধুয়ে নিয়ে এলো।

সামনের ছোট্ট জমিতে নানারকম সবজি চাষ করা হয়েছে। শিক্ষকদের সঙ্গে বাচ্চারাও সেসব দেখাশোনা করে। কোদাল দিয়ে পাথুরে মাটি কোপানো থেকে শুরু করে গাছে জল দেওয়া কিংবা ঘাস পরিষ্কার করা, সবেতেই শিক্ষক-ছাত্র কোনো ভেদ  নেই। কচি কচি হাতে তারা নিজেদের জামা-কাপড় নিজেরাই কাচে, ঘরদোর পরিষ্কার করে। 

অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ওদের সকলের সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গেল। এত অল্প উপকরণ নিয়ে মানুষ যে এত আনন্দে বাঁচতে পারে, ওদের সঙ্গে না থাকলে আমি জানতেই পারতাম না। আমিও ওদের সঙ্গে বন থেকে রান্নার জ্বালানি কুড়িয়ে আনি, কাঠের উনুনে বড় বড় হাঁড়িতে পালা করে রান্না করি, বাসন মাজি, মাটি কোপাই, এমনকি টয়লেট পর্যন্ত পালা করে পরিষ্কার করি। 

ওদেরকে কেউ ঘুম থেকে ডাকে না, পড়তে বসতে বলে না। তবু ওরা নিয়ম করে ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে। হাত-মুখ ধুয়ে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রার্থনাসংগীত গায়। তারপর নিজেরাই পড়তে বসে। খাবার ঘণ্টা পড়লে লাইন দিয়ে থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। থ্রি-ফোরের বাচ্চারা পালা করে খাবার পরিবেশন করে, সবশেষে নিজেরা নেয়।

ওরা বাড়ি যেতে চায় কি না জানতে চাইলে এমন সজোরে অসম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে, যেন আমিই ওদের ধরেবেঁধে বাড়ি পাঠাতে চাইছি।

একদিন আমার প্রশ্ন শুনে রামলাল মাস্টার হেসে বললেন, ঘর গেইলে খাত্যে কে দেবেক?

কয়েকদিন যেতে না যেতেই আমার মনে হতে লাগল, যেন আমার অন্য কোনো জীবন নেই। আমি যেন অনন্তকাল ধরে ওদের সঙ্গেই আছি। নগরজীবনের ছোঁয়াচবর্জিত মানবসভ্যতার প্রাগূষাকালের এই শান্ত, সমাহিত, নিরুদ্বেগ পরিমণ্ডলেই যেন আমি আজন্ম লালিত। দিনগুলো যেন স্বপ্নের মধ্যে কেটে যাচ্ছিল।

একমাস পরে বাবা এলো। বিনা ভূমিকায় আমাকে বলল, ভেবে দেখো, কোন জীবন তুমি চাও।

আমি মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

বাবা আবার বলল, জন্মসূত্রে তুমি যেসব বাড়তি সুযোগ-সুবিধে পেয়েছ, সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে চাও, নাকি এদের মধ্যে এদের মতো করে থেকে যেতে চাও?

আমি বললাম, আমি যদি এদের সঙ্গেই থেকে যেতে চাই?

বাবা হাসল। বলল, আমি কোনো মতামত দেবো না। সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে। শুধু একটা কথা তোমাকে মনে করিয়ে দেবো, এদের মতো হাজার হাজার অনাহারক্লিষ্ট শিশু ভারতের অজস্র গাঁ-গঞ্জে ছড়িয়ে আছে। আমাদের সামর্থ্য কম, তাই সবাইকে দেখতে পারি না। কিন্তু তুমি যদি এদের সত্যিকারের ভালোবেসে থাকো, তবে এই মানুষগুলোকে সাহায্য করার জন্যে আগে নিজেকে তৈরি করতে হবে। মনে রেখো, নিজে সবল না হলে দুর্বলের পাশে দাঁড়ানো যায় না।

আমি বই-খাতা গুছিয়ে নিয়ে বাবার সঙ্গে আবার হোস্টেলে ফিরে চললাম।

তিন

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে দেখলাম, এ এক হট্টমালার দেশ। এতদিন ছেলেদের স্কুলে, ছেলেদের কলেজে পড়েছি। এই প্রথম আমার ক্লাসঘরে মেয়েদের সঙ্গে সহাবস্থান। এখানে ভর্তি হওয়ার পর শুরু থেকেই একটা মজার ব্যাপার লক্ষ করতাম। প্রায় সব ছেলেরই লক্ষ্য হলো, যে করেই হোক, একটা মেয়েবন্ধু জুটিয়ে ফেলা, যেন মোক্ষলাভের ওটাই একমাত্র উপায়।

ব্যতিক্রম শুধু আসাদ আলি। আলকাতরার চাইতেও কয়েক পোঁচ কালো গায়ের রং, রোগাভোগা প্যাকাটির মতো  চেহারা, মাথার চুলগুলো সজারুর কাঁটার মতো খাড়া খাড়া, কণ্ঠস্বর পুরুষহাঁসের মতো ফ্যাঁসফেঁসে। পাজামা আর লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি পরে ক্লাসে আসত, পায়ে হাওয়াই চটি। সারাক্ষণ খুব দুঃখী দুঃখী মুখ করে ঘুরে বেড়াত সে। মুর্শিদাবাদের কোনো অজপাড়াগাঁয়ে ওর বাড়ি, গ্রাম্য লব্জ বেরিয়ে পড়ার ভয়ে খুব কম কথা বলত।

ইউনিভার্সিটিতে এসে আমি পড়লাম মহা আতান্তরে। অযোধ্যা পাহাড়ের সেই আদিবাসী স্কুলে এক মাসের জীবন আমার মনে এমন গভীর ছাপ ফেলেছিল যে, বন্ধুদের কোনো হই-হট্টগোলে যোগ দিতে পারি না। মেয়েদের দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারি না। ক্লাসের কোনো মেয়ে পড়াশোনোর বিষয়ে কথা বলতে এলেও যেন সংকোচে মাটির সঙ্গে মিশে যাই। এমনকি সবাই যখন তেড়েফুঁড়ে আসাদের  পেছনে লাগে, তখনো ওদের সঙ্গে যোগ দিতে পারি না। বরং আসাদের জন্যে ভারি কষ্ট হতো আমার।

কয়েকদিন যেতে না যেতেই ক্লাসে আমার নাম হয়ে গেল ‘বেম্মোচারি মহারাজ’! সে-নাম ক্লাসের গণ্ডি ছাড়িয়ে হোস্টেল পর্যন্ত এমন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল যে আমার আসল নাম চাপা পড়ে গেল। টিচাররা পর্যন্ত ক্লাসে আমাকে মাঝে মাঝে ‘ব্রহ্মচারী’ বলে ডাকতে শুরু করলেন। দিনে দিনে আমি হয়ে উঠলাম সকলের হাসির খোরাক।

এরই মধ্যে একদিন ক্লাসে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। এসএনজি ছিলেন আমাদের ডিপার্টমেন্টের অত্যন্ত নামকরা প্রফেসর। খুব রাশভারী মানুষ, চমৎকার পড়াতেন। স্যারের ক্লাসে সকলে মন্ত্রমুগ্ধ। সেদিন স্যার ডাইভার্সিটি অ্যান্ড ক্লাসিফিকেশন অব ফ্লাওয়ারিং প্ল­ান্টস পড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ আমার মাথায় কী যে ভূত চাপল, আমি বললাম, স্যার, এ-বিষয়ে এক মার্কিন গবেষক সম্প্রতি একটা নতুন স্পিসিসের সন্ধান পেয়েছেন, যেটা প্রচলিত এই ক্লাসিফিকেশনের কোনো ক্লাসে ফিট করে না। তাই তিনি –

স্যার প্রথমে আমার মুখের দিকে কঠিন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। রাগে স্যারের মুখ লাল হয়ে উঠল। অন্যদের দিকে তাকিয়ে বিদ্রƒপাত্মক স্বরে বললেন, ব্রহ্মচারী মহারাজ বোধহয় দৈববলে এই নতুন তথ্যটি জেনেছেন। নাকি স্বপ্নাদ্য বিদ্যা, মহারাজ?

সারাক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ল। আমার অবস্থা তখন ধরণী দ্বিধা হও গোছের। তবু আমি মিনমিন করে বলার চেষ্টা করলাম, স্যার এই আবিষ্কারের জন্যে ওই গবেষকের নাম এ-বছর নোবেল প্রাইজের জন্যে নমিনেশন পেয়েছে।

স্যার হাসতে হাসতে বললেন, এটাও কি দৈবলব্ধ জ্ঞান?

আবার ক্লাসে হাসির হুল্লোড় উঠল।

যে-বই থেকে আমি তথ্যটা পেয়েছিলাম সেটা মাত্র দিন-তিনেক আগে বাবা ডাকযোগে আনিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমার বাবার এই এক বাতিক ছিল। আমি কী পড়াশোনা করছি, সেটা জেনে নিয়ে সে-সম্পর্কিত দেশ-বিদেশের লেটেস্ট বই বা জার্নাল সংগ্রহ করা।

একপ্রকার নিরুপায় হয়েই ঝোলা থেকে বইখানা বের করে নির্দিষ্ট চ্যাপ্টারটা খুলে স্যারের সামনে ধরলাম। সারাক্লাস রুদ্ধ নিশ্বাসে অপেক্ষা করছে, এই বুঝি আমার ফাঁসির হুকুম হয়!

পড়তে পড়তে কিন্তু স্যারের মুখের ভঙ্গি বদলাতে শুরু করল। স্যার অপ্রস্তুত মুখে বললেন, বইটা আমাকে দিন-দুয়েকের জন্যে ধার দাও।

তারপর সেদিনকার মতো পড়ানো মুলতুবি রেখে বইখানা বগলদাবা করে স্যার ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন।

রাতারাতি আমি সকলের কাছে ‘বেম্মোচারি মহারাজ’ থেকে ‘বুনো রামনাথ’ হয়ে গেলাম।

একদিন আসাদ আমাকে চুপি চুপি বলল, তোকে একটা কথা বলব, তুই কিন্তু রাগ করতে পারবি না।

আমি হেসে বললাম, তুই রাগের কথা বলবি, অথচ আমি রাগ করতে পারব না?  ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক মনে হচ্ছে! তা বলে ফেল, তোর রাগের কথা!

– তোর নোটগুলো আমাকে দিতে হবে।

আমি হো-হো করে হেসে উঠলাম। বললাম, নোট নিবি, এতে রাগ করার কী আছে?

– না, মানে নোটটা ঠিক আমার জন্যে চাইছি না। আরেকজন নেবে, দু-একদিনের মধ্যে কপি করে ফেরত দেবে বলেছে।

আমার হাসি পেয়ে গেল। বললাম, দেবো, কিন্তু তার আগে বলতে হবে কার উপকার করার জন্যে তোমার এই মহান দৌত্যকর্ম।

আসাদ কিছুতেই নাম বলতে চায় না। অনেক পীড়াপীড়ির পর সে যার নাম বলল শুনে আমার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার জোগাড়। যে সুন্দরীতমার জন্যে ক্লাসের প্রায় সব ছেলে প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার জন্যে তৈরি, সে চেয়েছে আমার নোট!

শুরু থেকেই দেখে আসছি, সে ক্লাসে কোনো ছেলের সঙ্গে কথাবার্তা তো বলেই না, মেয়েদের সঙ্গেও বেশ দূরত্ব রেখে চলে। ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াত করে নিজেদের গাড়িতে। ওকে নিয়ে তাই ছেলেদের মধ্যে কৌতূহলের শেষ নেই। কেউ বলে, ওরা নাকি একসময়ে গুপ্তিপাড়ার জমিদার ছিল। কেউ বলে ওর বাবা আইএএস, কারো খবর, মা ডাক্তার। আড়ালে সকলেই ওকে ‘ঘমন্ডি প্রিন্সেস’ বলে গায়ের ঝাল মেটায়।

আমি অবাক হয়ে আসাদকে বললাম, নোটটা ওর দরকার এবং সে-কথা তোকে বলেছে? ক্লাসে এত ছেলেমেয়ে থাকতে শেষে তোকে?

আসাদ চোখ মটকে হেসে বলল, বুঝিস না, আমি হচ্ছি এই ক্লাসে সবচেয়ে নিরাপদ গরু! না আছে আমার চাট মারার মতো লম্বা ঠ্যাং, না গুঁতোনোর মতো বাঁকা শিং। তাছাড়া তুই যে আমার জিগরি দোস্ত, একথা সবাই জানে। এসব বিবেচনা করেই ও আমাকে ধরেছে। ও যদিও তোকে নাম বলতে বারণ করেছে, তবু না জানিয়ে থার্ড পারসনকে তোর নোট দিলে কেয়ামতের সময় কী জবাব দেবো বল? আসল কথাটা তাই তোকে জানিয়ে রাখলাম। দেখিস, কথাটা আবার পাঁচ কান করিসনে যেন।

আসাদের মাধ্যমে নোট দেওয়া-নেওয়া চলতে লাগল। আমি রাত জেগে বাবার পাঠানো বিভিন্ন জার্নাল আর বই ঘেঁটে পড়ানো বিষয়ের ওপর নতুন নতুন নোট  তৈরি করি, আর আশায় থাকি, ও-তরফ  থেকে একটা শুকনো ধন্যবাদ অন্তত আসবে। কিন্তু কোথায় কী? বৃষ্টি দূরে থাক, নিদাঘ-দগ্ধ আকাশে মেঘের একটু আভাস পর্যন্ত চোখে পড়ে না।

সেবার আমরা সবাই লোকাল এক্সকার্সনে চলেছি, গন্তব্য বলগনা চটি।  বর্ধমান স্টেশন থেকে দুই বগির ন্যারো  গেজ ট্রেন। আগে থেকেই সেখানে হাঁস, মুরগি, ছাগল, গোয়ালাদের বড় বড় খালি দুধের ড্রাম, এমনকি রাশি রাশি ঘাসের বোঝা মজুত হয়ে আছে। তারই মধ্যে কোনোক্রমে ঠাসাঠাসি করে শরীর গুঁজে দেওয়া! ট্রেনটা ছাড়ার মুখে দেখি ময়ূরকণ্ঠী নীল শাড়ি, কপালে নীল টিপ, তিনি আসছেন। ওকে দেখে সবাই অবাক। ঝাঁ-চকচকে গাড়ি ছেড়ে শেষ পর্যন্ত এই লড়ঝড়ে ট্রেনে? তাও আবার ওই  পোশাকে?

কম্পার্টমেন্টে তখন তিল ধারণের জায়গা নেই। আমি কোনোক্রমে দরজার পাশে একটা সিট পেয়েছিলাম। এদিকে-ওদিকে তাকাতে তাকাতে আমাকে দেখতে  পেয়ে অসহায়ভাবে আমার কাছে এসে ও বলল, একটু ধরবে? উঠতে পারছি না যে!

ওর বাড়িয়ে দেওয়া ফর্সা নিটোল হাতখানা ধরতেই আমার সারাশরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। নিজে উঠে ওকে বসতে বললাম। এখানে ভদ্রতা করার কোনো সুযোগ নেই দেখে নিরুপায় হয়ে ও বসল বটে, কিন্তু ভিড়ের চাপে আমি রইলাম ওর মুখের ওপর ধনুকের মতো বেঁকে। প্রতি মুহূর্তেই প্রমাদ গুনছি, এই বুঝি ধমকে আমাকে সোজা হতে বলে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু চোখে চোখ পড়লেই দেখছি ও আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। সন্দেহ হলো, ভুল দেখছি না তো?  বারকয়েক চোখ কচলে নেওয়ার পরেও দৃশ্যপট বিশেষ বদলাল না দেখে নিজের গায়ে চিমটি কাটতে ইচ্ছে হলো।

ট্রেন থেকে নামার পর কিন্তু সে আবার অচেনা মানুষ হয়ে গেল। সারাদিন আমার দিকে একবার তাকাল না পর্যন্ত। বন্ধুরা ওকে নিয়ে নানারকম মশকরা করতে লাগল। পুরো দিনটা কেমন যেন ঘোরের মধ্যে কেটে গেল আমার। কী কী ডেটা কালেকশন করার কথা ছিল, আর কী কী যে করলাম, মনে করতে পারলাম না। ফেরার সময় দেখলাম, স্টেশনের বাইরে ওদের গাড়ি অপেক্ষা করছে। 

ফিরতি-ট্রেনে আসাদ আমার পাশে বসে কানে কানে বলল, তোরা হিঁদুরা কি একেই পাণিপীড়ন বলিস?

মুখখানা অত্যন্ত নিরীহ করে রাখলেও ওর চোখের কোণে ফিচলেমি উছলে পড়ছিল। আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলাম।

পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট বেরোল। অন্যান্য পেপারে ভালো নম্বর পেলেও এসএনজির পেপারে এত কম নম্বর পেয়েছি যে ফার্স্ট ক্লাসটা ফস্কে গেছে। বাবার মুখটা মনে পড়ে আমার ভারি কষ্ট হতে লাগল। বাবা নিশ্চয় ভাববে, এখানে এসে আমি বখে গেছি।

তনিমা এসএনজির পেপারে হায়েস্ট নম্বর পেয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। 

সেদিন আসাদ আমার নোট নিতে এলে আমি খাতার মধ্যে লিখলাম, তুমি এসএনজির পেপারে কি আমার তৈরি করা নোট লিখেছিলে?

একটা পাতা জুড়ে বড় করে লেখা একটা মাত্র শব্দ ‘হ্যাঁ’ নিয়ে খাতা ফেরত এলো। এরপর আমি নিজে নোট লেখা বন্ধ করে রাত জেগে স্যারদের দেওয়া মান্ধাতা আমলের নোট মুখস্থ করতে শুরু করলাম।

কয়েকদিন বাদে ক্লাস শেষ করে হেঁটে হোস্টেলে ফিরছি, আড়চোখে দেখলাম ইউনিভার্সিটির গেটের বাইরে ঝাঁকড়া বকুল গাছটার তলায় ওর গাড়িটা দাঁড়িয়ে। পাশ কাটিয়ে চলে আসছিলাম। হঠাৎ জানালার কাচ নামিয়ে ও ডাকল, তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে।

খুব অবাক হলাম। ক্লাসে কিংবা রাস্তায়  যে কখনো আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি, আমার সঙ্গে তার কী কথা থাকতে পারে! খারাপ রেজাল্টের জন্যে সমবেদনা?

কাছে যেতে বলল, গাড়িতে উঠে এসো, তোমাকে আমি হোস্টেলের গেটে নামিয়ে দেবো।

আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম অন্যরা আমাদের লক্ষ করছে। বাধ্য হয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।

তনিমা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, আমার ওপর রাগ হচ্ছে?

– কেন?

– তোমার তৈরি করা নোট লিখে আমি হায়েস্ট নম্বর পেলাম, অথচ –

– আমি হয়তো ঠিকঠাক লিখতে পারিনি।

– তা নয়। সবাই জানে, এসএনজি আসলে ভীষণ ইগোইস্টিক। তিনি সকলের কাছে খালি আনুগত্য চান। তুমি খাতা রিভিউ করাও।

আমার প্রচণ্ড অভিমান হলো। কিন্তু  সেটা যে কার ওপর, বুঝে উঠতে না পেরে ওকে বললাম, তোমার কথা যদি শেষ হয়ে থাকে তবে আমাকে এখানে নামিয়ে দাও।

ও খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি দেখলাম, অপমানে ওর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। চোখের কোনায় স্পষ্ট টলটলে জল। গাড়ির দরজা খুলে যখন বেরোচ্ছি, ও বলল, আমি আগেই বুঝেছিলাম, তুমি ব্রহ্মচারী নও। আজ জানলাম, তুমি বুনো রামনাথও নও! তুমি আসলে জ্ঞানের দম্ভে অন্ধ এক দুঃখবিলাসী!

 ও ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। পেছন ফিরে তাকানোর সাহস হলো না আমার, হনহন করে হোস্টেলের পথ ধরলাম।

চার

ভেবেছিলাম, ওই পর্ব বুঝি সেদিনই শেষ হয়ে গেছে। একসঙ্গে ক্লাস করলেও  কেউ কারো সঙ্গে কথা বলা দূরে থাক, পরস্পরের দিকে তাকাই না পর্যন্ত।

একদিন ক্লাস শেষ করে বেরোতে যাব, এমন সময় ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট শম্ভুদা এসে বললেন, এসএনজি তোমাকে ল্যাবরেটরিতে ডাকছেন।

ভয়ে ভয়ে গিয়ে দেখি ল্যাবে স্যার একা, গম্ভীর মুখে জার্নালের পাতা ওলটাচ্ছেন। মুখ না তুলে বললেন, তোমার কি ধারণা আমি ইচ্ছে করে পার্ট ওয়ানে  তোমাকে কম নম্বর দিয়েছি?

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম।

স্যার আবার বললেন, কথাটা তুমি আমাকে বলতে পারতে! হেড একজামিনারকে নালিশ করার কী হয়েছিল?

আমি তখনো স্যারের কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। তিনি বললেন, আমি তোমাদের খাতা দুটো আরেকবার  দেখলাম। তোমার আর তনিমা সান্যালের উত্তরগুলো হুবহু। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমাদের মধ্যে কেউ একজন  আরেকজনের খাতা থেকে কপি করেছ। যাই হোক, আমি তোমাকে বেনিফিট অব ডাউট দিলাম। খুব শিগগির তুমি রিভাইজড মার্কশিট পেয়ে যাবে।

ল্যাব থেকে বেরিয়েই করিডোরে আসাদের সঙ্গে দেখা। আমাকে দেখেই ঝাঁঝিয়ে উঠল, এতক্ষণ কোথায় ছিলি? আমি তোরে হন্যে হয়ে খুঁজছি। তনিমা বলল এই খাতাটা নাকি তোর আজই দরকার?

আমি দেখেই বুঝলাম ও-খাতা আমার নয়।

আসাদ কেমন সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল, তোদের মধ্যে যখন কথাবার্তা হচ্ছে, এই কাবাবমে হাড্ডি মাঝখানে  রেখে নলচের আড়ালে তামুক খাওয়ার কি দরকার? আমি কি তোদের ডাকপিয়ন?

খাতাটা নিলাম। খুলে দেখি ও লিখেছে, কাল তিনটের সময় কৃষ্ণসায়রে একবার আসতে পারবে? খুব দরকার।

আমার নিজের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই শুরু হলো। আমার বাবার স্বপ্ন, সেই আদিবাসী স্কুলে আমার সংক্ষিপ্ত দিনযাপন, নিজের আদর্শ এবং সংকল্প – সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। সারারাত ঘুমুতে পারলাম না।

পরদিন কৃষ্ণসায়রে গিয়ে দেখি ও দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দুজনে নিরিবিলিতে বসলাম।

বললাম, হঠাৎ জরুরি তলব? এবার আমার প্রতি নতুন কী উপদেশ?

নিজের বলা কথাগুলো আমার নিজের কানেই কেমন যেন রূঢ় শোনাল। আমার চেহারাতেও হয়তো আমার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং নিদ্রাহীনতার ছাপ পড়েছিল।

ও কোনো কথা বলল না। আমার দিকে একবার চোখ তুলে তাকাল শুধু। ওর সেই ব্যথাতুর বিষণ্ন দৃষ্টির কাছে আমার নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম আমরা।

ওঠার সময় ও বলল, এসএনজির সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে? এবার কিন্তু তুমিই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট!

আমি চমকে উঠলাম। বললাম,

এ-কথা তুমি জানলে কী করে?

ও বলল, হেড একজামিনার একসময় আমার দাদুর ছাত্র ছিল।

পার্ট টু পরীক্ষার শেষদিনে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে দেখলাম তনিমা করিডোরে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমাকে দেখে ‘পরীক্ষা কেমন হয়েছে’ জিজ্ঞেস না করে বলল, আমার একটা ছোট্ট রিকোয়েস্ট আছে। আজ তোমাকে একবার আমার সঙ্গে যেতে হবে।

– কোথায়?

– আমাদের বাড়িতে।

–  হঠাৎ? কোনো উপলক্ষ আছে?

তনিমা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ওরকম পুলিশি জেরা করো না তো! আজ  তোমাকে আমার বাবা-মার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো, এটাই উপলক্ষ। তোমার আপত্তি আছে?

আমি হেসে বললাম, এমন মহান উদ্দেশ্যের পেছনে কোনো কারণ আছে নিশ্চয়?

ও বলল, আছে, তবে তা তোমাকে এখন বলা যাবে না।

 বিশাল বাড়ির পোর্টিকোয় গাড়ি থেকে নামতেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো।

একটা সাজানো-গোছানো হলঘরের গদিমোড়া সোফায় আমাকে বসিয়ে ও গেল বাবা-মাকে ডাকতে।

একজন সম্ভ্রান্ত চেহারার ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে আমাকে আপাদমস্তক মেপে নিয়ে কেমন অবজ্ঞার স্বরে বললেন, অ, তুমিই সে?

খুব অবাক হলাম। নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত রেখে বিনীতভাবে বললাম, মাফ করবেন। আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

তিনি বাঁকা হেসে কেমন টেনে টেনে বললেন, তোমার পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট নিয়ে কী যেন গোলমাল হয়েছিল, তাই না?

ছাত্রজীবনে আমার দুর্বলতম জায়গায়  যেন হাতুড়ির আঘাত পড়ল।

আমি চুপ করে রইলাম। এবার তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাদের পারিবারিক পরিচয় নিতে লাগলেন। বাবা পুলিশে আছেন শুনে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, আইপিএস?

আমার মনটা হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে উঠল। এতক্ষণের সংযমের বাঁধ ভেঙে গেল। আমি ভদ্রলোকের চোখে চোখ রেখে বললাম, না। আমার বাবা অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে চাকরি শুরু করেছিলেন। ঘষে ঘষে এখন সার্কল ইন্সপেক্টর। আর আমার ঠাকুর্দা ছিলেন টুলো পণ্ডিত। ভাটপাড়ায় আমাদের আদি নিবাস।

ভদ্রলোক কিন্তু দমলেন না। ফলাও করে নিজেদের বংশগাথা পেড়ে বসলেন।

আমি পাথরের মতো মুখ করে শুনতে লাগলাম। অবশেষে ঝুলি থেকে বেড়ালটা বের হলো। এক এনআরআই ডাক্তারের সঙ্গে ওঁর একমাত্র কন্যার এনগেজমেন্ট হয়ে রয়েছে। সামনের অঘ্রানেই বিয়ে। অতএব –

আমি তনিমার জন্যে অপেক্ষা না করে উঠে পড়লাম।

পরদিনই হোস্টেল ছেড়ে বাড়ি ফিরে এলাম।

প্রতি সপ্তাহে ওর চিঠি পাই, কিন্তু উত্তর দিতে সংকোচ হয়। আমি যে ওর জন্যে নিতান্তই অযোগ্য, এ-কথা আমার চাইতে ভালো তো আর কেউ জানে না।

রেজাল্ট বেরোনোর পর মার্কশিট নিতে ইচ্ছা করেই দুদিন দেরি করে ইউনিভার্সিটিতে গেলাম। গিয়েই আসাদের সঙ্গে দেখা। ও একটা পেপারে ব্যাক  পেয়েছে, আবার পরীক্ষা দেবার জন্যে ফরম ফিলআপ করতে এসেছে।

আসাদ হঠাৎ রহস্যময় হেসে বলল, আমি গত দুদিন ধরে তনিমাকে ক্যাম্পাসে  দেখছি। জিজ্ঞেস করলে বলছে, মার্কশিট নিতে এসেছে। কবার করে মার্কশিট নিচ্ছে  খোদায় মালুম! দেখ না, আজ আবার এসেছে!

অফিসঘরের দিকে এগোতে গিয়ে  দেখি তনিমা ছাতিম গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে। আমার হৃৎপিণ্ডের সব রক্ত যেন হঠাৎ চলকে মুখে উঠে এলো।

একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। গাছের পাতা থেকে তখনো টুপটুপ করে জল পড়ছে।

তনিমা আকুল হয়ে বলল, কী করেছি আমি? চিঠির পর চিঠি দিয়েছি, উত্তর নেই। মার্কশিট নিতে আসবে ভেবে প্রতিদিন আসছি, অথচ তোমার আসার নাম নেই!

বৃষ্টিস্নাত মুখের ওপর গোধূলির আলো, কপালের ওপর নেমে আসা অগোছাল চুলের আগায় সূর্যাস্তের আলোয় ঝলকানো বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির জল, আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। 

ও অধৈর্য হয়ে বলল, শোনো, আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। এখন শুধু তোমার মতামত জানতে চাই, আজ এক্ষুনি!

আমার চেতনাজুড়ে এক মহাপ্লাবন শুরু হলো। ক্ষতবিক্ষত হৃদয় থেকে ক্ষরিত বেদনার স্রোতে আমার চিন্তাভাবনা এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল।

সেদিন সেই আদিবাসী স্কুলে দাঁড়িয়ে বলা বাবার কথাগুলো মনে পড়ে গেল।

আমি পাথরের মূর্তির মতো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ও কী বুঝল কে জানে, থরো থরো হাতে আমার হাতখানা চেপে ধরে মুখের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইল। ওর গভীর কালো চোখ থেকে অবিরল মুক্তোর মতো অশ্রুকণা ঝরে পড়তে লাগল।

ধীরে ধীরে দিনমণি অস্ত গেল। চরাচর জুড়ে নেমে আসা আধো-অন্ধকারে গা ডুবিয়ে আমরা দুই যক্ষ-যক্ষিণী পাষাণ মূর্তির মতো নিশ্চল বসে রইলাম।

পাঁচ

জিনি বলল, আমার মোবাইলটা বোধহয় গাড়িতে ফেলে এসেছি। তোমরা কথা বলো, আমি এখনি আসছি।

তনিমা দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, খুব অবাক হয়েছ মনে হচ্ছে? আসলে এখানে প্রবাসী বাঙালিদের একটা ফেসবুক গ্রুপ আছে। সেই সূত্রেই আমার এবং জিনির সঙ্গে সোমশুভ্রের আলাপ। তারপর যখন জানলাম, সে তোমার ছেলে –

আমি দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললাম, ভেতরে এসো।

তনিমা বিষণ্ন হেসে আস্তে আস্তে বলল, এত দেরিতে ডাকলে, এখন কি আর আসা যায়?

পরক্ষণে জিনির পায়ের শব্দ পেয়ে গলার স্বর বদলে বলল, আমরা মা-মেয়েতে ঠিক করেছি, আপনাকে আজ একটা ছোট্ট আউটিংয়ে নিয়ে যাব। সোমশুভ্রকে বলা আছে। আমরা বরং গাড়িতে অপেক্ষা করছি, আপনি তৈরি হয়ে আসুন। আমি তৈরিই ছিলাম। তবু কেন জানি না স্থাণুর মতো বসে রইলাম। বাইরে বারবার গাড়ির হর্ন বাজতে লাগল।