পাতাদের সংসার

অনেকদিন আগে পথিক এ-বাড়িতে প্রথম এসেছিল নিতান্তই খেয়ালের বশে। তখন তার ছিল হাঁটার ‘ব্যারাম’, অন্তত লোকে তাই বলতো। শহরময় অবিরাম হেঁটে বেড়াতো সে, মনে হতো যেন নিজের নামকরণের সার্থকতা প্রতিপন্ন করতে চাইছে – পাঁচ-দশ মিনিটের বেশি বসতো না কোথাও, যেন উদ্ভ্রান্তের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে কোনো কিছু, এমনই ছিল তার হাঁটার ভঙ্গি। আসলে কী খুঁজতো সে? তার হারিয়ে ফেলা শান্ত-নিরুদ্বেগ-ছিমছাম শহর? সে-শহর তো ছিল শৈশবে, কৈশোরে; পথিক যখন খুঁজতে বেরিয়েছে, ততদিনে তা বদলাতে শুরু করেছে দ্রুতগতিতে। গ্রাম থেকে স্রোতের মতো মানুষ এসে ভিড় জমাচ্ছে এখানে – যেন কেউ তাড়া করেছে তাদের, এমনই সন্ত্রস্ত ভঙ্গি; সেসব মানুষকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য দালান উঠছে, অট্টালিকা উঠছে, টিনের ঘর উঠছে, তৈরি হচ্ছে বস্তিও; আর যার যেমন সামর্থ্য সে সেখানেই মাথা গুঁজে দিচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে গাছপালা, হারাচ্ছে শহরের সবুজ-শান্ত রূপ, বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা, বিপণিবিতান, স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল। কোথাও নিশ্বাস ফেলার মতো ফাঁকা জায়গা আর থাকছে না। এত কিছুর ভিড়ে সে সেই ছিমছাম শহরকে খুঁজে পাবে কীভাবে?

অবশ্য পথিক যে কিছু খুঁজতো তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। হয়তো বেকার জীবনের ভার সে বইতে পারছিল না। শহরে তখন বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, পথিকও ছিল তাদেরই একজন। অবশ্য এই বেকারত্ব তার ইচ্ছাকৃতও হতে পারে, কারণ সে ছিল সচ্ছল পরিবারের সন্তান, হাতখরচের জন্য তাকে অত চিন্তা করতে হতো না। তার বন্ধুরা যখন চাকরির সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরতো, তখনো পথিক নির্বিকারই ছিল। তবু, ততদিনে তার জানা হয়ে গিয়েছিল – বেকারত্ব একটা অভিশাপ। এমনকি সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের জন্যও। টাকা-পয়সার জন্য না হলেও ব্যস্ত থাকার জন্যই একটা কাজ দরকার। তার সেরকম কোনো কাজ ছিল না বলে সে হেঁটে বেড়াতো। কিংবা তাই বা কীভাবে বলা যায়? বেকাররাই তো সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। সদা-সর্বদা ব্যস্ত। তাদের নির্দিষ্ট কোথাও পাওয়া যায় না, সবসময় কিছু না কিছু নিয়ে মেতে আছে তারা, কখন কোথায় থাকে তারও কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। অবশ্য সবাই পথিকের মতো হেঁটে বেড়ায় না। অনেকেই চুপ করে ঘরের কোণে বসে থাকে। কিন্তু সে তো পথিক, নামের সঙ্গে স্বভাবের মিল সবার না থাকলেও তার ছিল।

হাঁটতে হাঁটতেই এই বাড়িটির সন্ধান পেয়েছিল পথিক। শহরটা তার হাতের তালুর মতো চেনা হয়ে গিয়েছিল। এত হাঁটলে তা না হয়ে পারে? শুধু বড় রাস্তায়ই নয়, সে হাঁটতো গলিপথ ধরেও। সেজন্যই হয়তো এই বাড়িটির দেখা পেয়েছিল সে। একটা গলির বেশ খানিকটা ভেতরে এই বাড়ি। পথিক হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনে থমকে দাঁড়িয়েছিল। বৈশাখের এই তপ্ত দুপুরে ঝিঁঝি পোকার ডাক! তাও এই শহরে! কোত্থেকে আসছে? একটু এগোতেই সে পাখির ডাকও শুনতে পেলো। আশ্চর্য! এখনো এগুলো আছে? কোথায়? কেন এতদিন এদের সঙ্গে দেখা হয়নি তার? আরেকটু এগোতেই বাড়িটি চোখে পড়ে। গেটটা খোলা। এগিয়ে গিয়ে গেটে দাঁড়ায় পথিক। কেউ নেই। আরেকটু এগিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে সে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না জেনেও নিজেকে সামলাতে পারে না। অবাক হয়ে দ্যাখে, বিশাল এক বাড়ি, গ্রামের উচ্চবিত্ত পরিবারের সমৃদ্ধ বাড়ির মতো; শহরে এত বড় বাড়ি সাধারণত চোখে পড়ে না। বাড়ির এক প্রান্তে একটা দোতলা দালান, বাকিটা জুড়ে বাগান, বাগানের মাঝখান দিয়ে পথ, গেট থেকে দালান পর্যন্ত। বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁসে বড় সব গাছ। ফল ও ফুলের। বাগানজুড়ে সবজি আর ফুলের গাছ। যেন এক কৃষক যত্ন করে সাজিয়েছেন তাঁর বাড়ির উঠোন গাছপালা দিয়ে। ঝিঁঝির ডাকের রহস্য বোঝা গেল। এত গাছ থাকলে ওরা তো থাকবেই। ঝিঁঝি থাকবে, পাখি থাকবে, নানা ধরনের পতঙ্গ থাকবে। ওরা যে গাছদের আত্মীয়স্বজন! কিন্তু কোনো মানুষ নেই কেন? গেট খোলা, দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বাসার দরজাও খোলা, এরকম খোলামেলা রেখে এ-বাড়ির মানুষ এত নিশ্চিত থাকে কী করে? কৌতূহলভরে আরেকটু এগোলো সে। এবার চোখে পড়লো, একজন কিশোরী ফুলগাছের গোড়ায় পানি ঢালছে। দুপুরবেলায় গাছে পানি দিতে নেই, দিতে হয় সকালে, কথাটা কি মেয়েটিকে বলা ঠিক হবে? নাহ্, এমনিতেই সে অনেক অনধিকারচর্চা করে ফেলেছে, এবার ফিরে যাওয়া উচিত। কিন্তু তার এত ভালো লাগছে পুরো পরিবেশটা, যেতেই ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া ওই জলের প্রবাহ দেখে তার খুব পিপাসাও পেয়েছে। পানি সে এখন পায় কোথায়? মেয়েটির কাছে চাইবে? ইতস্তত করতে লাগলো পথিক। আর তখনই মেয়েটি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, ফিরে তাকালো তার দিকে। কিন্তু অনাহূত আগন্তুক দেখে যতটুকু অবাক হওয়ার কথা ততটুকু হলো না। এমনকি কোনো প্রশ্নও নেই তার চোখে। যেন বাড়ির মধ্যে একজন অচেনা লোকের দাঁড়িয়ে থাকা খুবই স্বাভাবিক। অস্বস্তি কাটাতে পথিক বললো – আমাকে এক গস্নাস পানি খাওয়াতে পারেন?

প্রথমে কিশোরী মনে হলেও উঠে দাঁড়ানোর পর বোঝা গেছে, কৈশোর পেরিয়ে এসেছে মেয়েটি। তাই ‘তুমি’ বলতে গিয়েও বললো না সে।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আসুন, ভেতরে আসুন।

না না, ভেতরে যাবো না। এখানেই দাঁড়াই।

সে কী! রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকবেন কেন? আসুন, ভেতরে আসুন।

পথিক আরেকবার অবাক হলো। অচেনা একজন মানুষকে কত সহজেই না ভেতরে যেতে বলছে মেয়েটি! কোনো ভয় নেই, শঙ্কা নেই, সংশয়-সন্দেহ নেই। সে যে খারাপ মানুষ হতে পারে, কোনো দুরভিসন্ধি থাকতে পারে তার, এরকম কোনো চিন্তাও বোধহয় আসেনি মেয়েটির মাথায়। তাকে অনুসরণ করে পথিক দেখলো বারান্দায় বেতের চেয়ার ফেলে সুন্দর বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বোঝাই যায়, এ-বাড়ির বাসিন্দারা বেশ শৌখিন, এবং এখানে প্রায়ই বসেন।

আপনি বসুন, আমি আসছি – বলে মেয়েটি চলে গেলে সে এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসলো।

ভেতর থেকে একটা পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল এবার – কে রে সিঁথি?

জানি না বাবা।

কার কাছে এসেছে?

তাও জানি না।

এ কেমন কথা! জিজ্ঞেস করবি না?

এবার কোনো জবাব শোনা গেল না।

সিঁথি! খুব সুন্দর নাম তো! ভাবছিল পথিক। এই সময় দরজার কাছে হুইল চেয়ারে একজন প্রৌঢ়কে দেখা গেল।

কে তুমি বাবা?

জি আমার নাম পথিক।

পথিক! বাহ্! খুব সুন্দর নাম। তা, কার কাছে এসেছ?

কারো কাছে নয়।

তাহলে?

এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনে কৌতূহলবশত ঢুকে পড়েছি। আমি লজ্জিত ও দুঃখিত।

বেশ করেছ। লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আজকাল আর কেউ ঝিঁঝির ডাক শুনতে আসে না। তুমি এসেছ, আমি খুশি হয়েছি।

কিন্তু এ-বাড়িতে এত ঝিঁঝি এলো কোত্থেকে? অন্য কোথাও তো এরকম দেখি না।

গ্রাম থেকে ঝিঁঝিপোকা ধরে এনে এ-বাড়িতে ছেড়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, তোরা সুখেই থাকবি। কথার বরখেলাপ করিনি। ওরা বোধহয় সুখেই আছে। দেখছো না, ছানাপোনা দিয়ে নিজেদের রাজত্ব বানিয়ে ফেলেছে! একসঙ্গে সবাই যখন ডাকতে শুরু করে তখন কান পাতাই দায়। অবশ্য আমাদের অসুবিধা হয় না, অভ্যাস হয়ে গেছে কিনা!

সে ভীষণ অবাক হলো – ঝিঁঝিপোকাও ধরা যায়?

যাবে না কেন? চাইলে সবই ধরা যায়।

ওরা না মাটির নিচে থাকে?

হ্যাঁ। খুঁজলে ওদের বাসা পাওয়া যায়।

জানতাম না ব্যাপারটা।

কতকিছু আমাদের না-জানা থেকে যায়! তা তুমি কী করো বাবা? পড়াশোনা?

পড়াশোনা শেষ করেছি। এখন কিছুই করি না, শুধু হেঁটে বেড়াই।

হেঁটে বেড়াও! কেন? কী খোঁজো?

কিছু খুঁজি না। দেখি।

কী দ্যাখো?

সবই দেখি। সবচেয়ে বেশি দেখি মানুষ।

মানুষ! বাহ্! দারুণ ব্যাপার তো! নামের সঙ্গে তোমার কাজ তো খুব মিলে গেছে দেখছি। তা, দেখে কী বুঝলে?

কিছুই বুঝলাম না। সবকিছু অচেনা লাগে। সবচেয়ে বেশি অচেনা লাগে মানুষকে। মনে হয়, এ আমার শহর নয়। অথচ ছোটবেলা থেকে আমি এখানেই আছি।

প্রৌঢ় কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর একগুচ্ছ প্রশ্ন করলেন। সবই ব্যক্তিগত। মা-বাবার কথা, ভাইবোনের কথা, কে কী করেন, বাসা কোথায়, ভাড়া বাসা না নিজেদের বাড়ি, গ্রামের বাড়ি আছে কি না ইত্যাদি। পথিক সব প্রশ্নেরই উত্তর দিলো। এতসব ব্যক্তিগত তথ্য জানাতে একটুও সংকোচ হলো না। মনে হলো, এঁরা অন্যরকম, এঁদের কাছে সব কথা বলা যায়।

সব শুনেটুনে তিনি বললেন – তোমার জীবনে অনেক দুর্ভোগ আছে। ভয় পেয়ো না। এক বিখ্যাত দার্শনিক বলেছেন, জীবনের বেদনা যত বেশি, প্রতিদানও তত বেশি। কথাটা আমি বিশ্বাস করি।

ততক্ষণে মেয়েটি পানি নিয়ে এসেছে। সঙ্গে নাস্তা। দেখে সে বললো : আমি তো শুধু পানি চেয়েছি।

শুধু পানি কি দেওয়া যায়? নিন, একটু খেয়ে নিন।

সিঁথির বাবা বললেন – নাস্তা দিলি কেন মা, এখন তো দুপুরের খাবার সময়।

না না, আমি খাবো না।

তাই কি হয়? ভরদুপুরে এসেছ, না খাইয়ে তোমাকে ছাড়ি কীভাবে? আমারও খাওয়ার সময় হয়েছে। যা তো মা, টেবিলে খাবার দে। একসঙ্গে খেয়ে নেবো।

ফের ‘না’ বলার সুযোগই পেলো না পথিক।

খেতে খেতে অনেক গল্প করলেন প্রৌঢ়। তাঁর জীবনের গল্প। সব আর স্মৃতিতে জমা হয়ে নেই পথিকের, তবে কিছু কথা খুব মনে পড়ে এখনো। তিনি বলছিলেন – তোমার মতো আমার একটা ছেলে থাকলে বেশ হতো।

আপনার ছেলে নেই বুঝি?

আছে। তিন তিনটে ছেলে আছে। দুজন দেশ ছেড়ে চলে গেছে। এ-দেশের নাকি কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আরেকজনও যাবো-যাবো করছে। এখানে বড় চাকরি করে, তবু নাকি তার মন বসে না। ওদের মা নেই, মারা গেছেন বছর-দুয়েক হলো। আমার অবস্থা তো দেখছোই। ওই অতটুকু এক মেয়েই সব সামলাচ্ছে।

বাবা! আমি কিন্তু আর অতটুকু নেই। বড় হয়ে গেছি।

হ্যাঁ, কত্ত বড় হয়েছিস! কেবল তো কলেজ ছাড়লি!

তাতে কী! দুদিন পরই তো ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাবো।

তাতে কী আর বড় হবি? এখনো তো চুলে বেণি বাঁধিস!

বেণি বাঁধলে বুঝি বড় হওয়া যায় না?

নাহ্। বেণি বাঁধে খুকিরা। তুইও খুকিই রয়ে গেছিস।

পথিক চুপচাপ বাপ-মেয়ের খুনসুটি দেখছিল। হঠাৎই মুখ ফসকে বলে ফেললো – আপনার ছেলেরা দেশ ছেড়ে যেতে চায় কেন? এখানে কী সমস্যা?

উন্নত জীবনের আশায়। চোখে রঙিন স্বপ্ন।

এখানে উন্নত জীবন হয় না?

হবে না কেন? হয়। কিন্তু কারো কারো কাছে তা মনে নাও হতে পারে। শোনো, আমিও একদিন মা-বাবাকে ছেড়ে গ্রাম থেকে শহরে চলে এসেছিলাম। আমারও অনেক রঙিন স্বপ্ন ছিল, উন্নত জীবনের আশা ছিল। গ্রামে কিন্তু আমাদের কম ছিল না, প্রচুর সম্পত্তি ছিল বাবার। তিনি চেয়েছিলেন আমি ওখানেই থেকে যাই। সম্পত্তি দেখাশোনা করি; কিন্তু আমার ছিল পড়াশোনার ঝোঁক। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে এলাম শহরে। সেই যে এলাম, আর ফিরিনি। আমি ছেড়ে এসেছিলাম আমার মা-বাবাকে, গ্রামকে; আমার ছেলেরা এখন আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে, দেশ ছেড়ে যাচ্ছে। ঘুরেফিরে সেই একই গল্প।

তার একটু মন খারাপ হলো; কিন্তু এই মন খারাপের কোনো মানে হয় না। অচেনা একটা পরিবারের সদস্যরা কে কী করবে না করবে, তাতে তার কী যায়-আসে?

গল্প শুনতে শুনতে খাওয়া শেষ হলো, তবু গল্প আর শেষ হয় না। সিঁথি এবার শাসন করে তার বাবাকে – অনেক হয়েছে। এবার চলো তো! একটু ঘুমাবে।

আজ না-হয় না ঘুমালাম! – বাচ্চাদের মতো আবদার করলেন বাবা।

না, অনিয়ম করা চলবে না। সেই ভোরে উঠেছ, প্রতিদিনই তো এই সময়ে ঘুমাও … পথিক বিব্রত বোধ করছিল। মনে হচ্ছিল, একটা অচেনা পরিবারের নিত্যদিনের রুটিনের মধ্যে সে এক বেমানান প্রশ্ন হয়ে বসে আছে। বাপ-মেয়ের কথার মধ্যেই সে তাই বললো – আমি তাহলে উঠি।

এখনই যাবে? আরেকটু থাকো না!

আপনার বিশ্রামের সময় হয়েছে। আজ যাই?

তাহলে আরেকদিন আসবে, বলো!

জি আসবো।

কালই আসবে।

জি আচ্ছা।

তুমি তো হেঁটেই বেড়াও, প্রতিদিনই একবার আসতে পারো না?

হ্যাঁ, তাও পারি।

তাহলে তাই এসো।

আচ্ছা।

বিদায় দেওয়ার সময় সিঁথি বললো – বাবাকে তো খুব বললেন, প্রতিদিন আসবেন। সত্যিই আসবেন তো?

কোন সূত্রে আসবো?

আজকে যেমন কোনো সূত্র ছাড়াই এলেন, সেরকম আসবেন।

প্রথম দিন সূত্র ছাড়া আসা যায়। তাই বলে প্রতিদিন?

প্রতিদিন আসবেন পরিচয়ের সূত্রে। পরিচয় তো হলো, নাকি?

তা হলো। আচ্ছা আসবো।

এসব অনেক দিন আগের কথা। সে সত্যিই প্রতিদিন যেত। বাড়িটি যেন এক শুশ্রূষার মতো, এলে মন শান্ত হয়ে যায়। বাড়ির গেট সবসময়ই খোলা থাকে, বাসার দরজাও। যদিও দারোয়ান আছে, আছে গৃহকর্মীরাও কিন্তু তাদের যে কাজ কী, বোঝাই যায় না। কী সহজ মানুষ এরা! কী সরল! শহর থেকে যখন আস্থা-বিশ্বাস হারিয়ে গেছে, তার বদলে জায়গা করে নিয়েছে সন্দেহ-অবিশ্বাস, তখনো এরা মানুষের প্রতি এত অবিচল আস্থা রাখে কীভাবে, ভেবে সে অবাক হয়। সিঁথি আর বাবার সঙ্গে গল্প করেও আনন্দ খুব। এই পরিবারের প্রায় সবকিছুই জানা হয়ে গিয়েছে তার। এক সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারান সিঁথির বাবা, তার দু-বছর পর আকস্মিক হার্ট-অ্যাটাকে চলে যান ওর মা। তারপর থেকেই এই পরিবারের ছন্দ হারিয়ে গেছে। ছন্দ-হারানো পরিবারটি এবং তাদের বাড়িটি যদি এত মনোরম সুন্দর হয়, তাহলে আগে তা কেমন ছিল ভেবে কূল পায় না সে। কলহদীর্ণ এই শহরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা এই বাড়িটি যেন এক স্বর্গোদ্যান। সেই ছন্দহীন সময়ে দাঁড়িয়ে বাবা যে-সমস্ত স্মৃতিচারণ করেন, তার পুরোটা জুড়েই সংগীতের মূর্ছনা। অন্তত আবিদের তাই মনে হয়। গল্প যা করার বাবাই করেন, পথিক আর সিঁথি তাঁর মনোযোগী শ্রোতা।

সিঁথি চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে, খুব একটা কথা বলে না। তার যাবতীয় কথাবার্তা ওই গাছগুলোর সঙ্গে। ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে সে, বিড়বিড় করে কী যেন বলে, আলতো করে পাতায় হাত বুলায়, ফুলে হাত বুলায়, যেন নিজের শিশুসন্তানের গায়ে হাত বুলাচ্ছে, এমন ভঙ্গি। যত দিন যায় সে তত সুন্দর আর স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে। তার চোখদুটো ভেজা ভেজা, যেন এক্ষুনি অশ্রম্নপাত হবে, তার মুখম-লে কোমল বিষণ্ণতা, তার দীর্ঘ রেশমি চুল যখন বাতাসের সঙ্গে লুটোপুটি খেলে ওর মুখের ওপর এসে পড়ে, তখন পথিকের মনে হয় – এমন অনির্বচনীয় রূপ সে আর দেখেনি কোথাও, কখনো। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সে। ওই কোমল মায়াময় হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে পথিকের মনে হয়, এমন স্নিগ্ধ-সুন্দর মানুষের সান্নিধ্যে চৈত্রের খরতপ্ত দুপুরেও হেমন্তের শিশিরসিক্ত সকাল নেমে আসে; কিন্তু মেয়েটিকে ঠিক বুঝে ওঠা যায় না। সারাক্ষণ এত মগ্ন হয়ে কী যে ভাবে, তার তল পাওয়া যায় না। হয়তো সেজন্যই, তাকে অনেক কথা বলার ইচ্ছা হলেও বলা আর হয়ে ওঠে না পথিকের।

তারপর অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। কয়েক বছরে অনেক ঘটনাও ঘটেছে। শহরটা আরো বদলে গেছে, মানুষ আরো অচেনা হয়ে গেছে, মানুষের চোখে আর মায়া-মমতা-স্নেহ-ভালোবাসার দেখা মেলে না, সেখানে এখন ভয় শঙ্কা সন্দেহ অবিশ্বাস ক্রূরতা নিষ্ঠুরতা লোভ হিংসা ঘৃণা …। এরকম একটা শহরের বাসিন্দাদের ব্যক্তিগত জীবনও সুস্থির থাকে না। পথিকের জীবনও থাকেনি। চাকরি করতে মন চায়নি বলে বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে যৌথভাবে একটা ব্যবসা দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছিল সে। পারেনি। বন্ধুর ক্ষতি হয়নি, সে সবকিছু নিয়ে চলে গেছে, পথিকের পুরোটাই গচ্চা গেছে। আর হবেই-বা না কেন? ব্যবসা করার ধাঁচই যে তার ভেতরে নেই। আর এ-বাড়ি? এ-বাড়ির সবুজ প্রাঙ্গণ আরো গাঢ় সবুজ হয়েছে, পাখি ও পতঙ্গদের আনাগোনা আরো বেড়েছে, বৃক্ষ আর পাখিদের সঙ্গে সিঁথির সম্পর্ক আরো নিবিড় আর গভীর হয়েছে। বাড়ির ছোট ছেলেটাও পাড়ি জমিয়েছে আমেরিকায়। বোন আর বাবার চোখের জলের কোনো মূল্যই দেয়নি সে। সিঁথি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে একের পর এক বর্ষ পার হয়েছে। বাবা আরো বৃদ্ধ হয়েছেন। এখন তার সকল চিন্তা জুড়ে কেবল সিঁথি। মেয়েটা বিয়ে করতে চায় না, বাবাকে একা ফেলে রেখে কোথাও যেতে চায় না; কিন্তু তিনি আর কদিন! চলে গেলে একা একা কী করবে সিঁথি? এইসব দুশ্চিন্তার কথা বলেন তিনি। বলেন, তুমি ওকে একটু বোঝাও।

কিন্তু পথিক কাকে কী বোঝাবে? সিঁথি আছে তার বৃক্ষ-সন্তানদের নিয়ে। গাছের পাতায় পাতায় তার স্নেহস্পর্শ লেগে আছে। একেকটা স্পর্শ যেন একেকটা গল্প, একটা পাতাকে স্পর্শ করলে অন্যগুলোও দুলে ওঠে, যেন ডাকে তাকে, বলে – আমাকেও আদর করো। হাত তো বেশি উঁচুতে যায় না, যতদূর যায় সে সবগুলো পাতার গায়েই হাত বুলিয়ে দেয় এবং অনুভব করে – ওরাও তাকে ফেরত দিচ্ছে আদর-মমতা-প্রেম। একেকটা পাতার বয়স কত? এক বছর? প্রতি শীতে যখন পাতাঝরার মৌসুম আসে, তখন মৃত্যু-সম্ভাবনায় কী যে মলিন হয়ে থাকে ওরা! সিঁথি তখনো হাত বুলিয়ে দেয়, যেন বৃদ্ধ কোনো স্বজনকে শেষ বিদায় জানাচ্ছে, এমন ভঙ্গিতে। শীত শেষ হয়ে যখন বসন্তের বাতাস ওঠে, কবিরা লেখেন গান বা কবিতা, তখন সে দেখতে পায় – পাতাগুলো এক এক করে ঝরে যাচ্ছে বৃন্ত থেকে। জীবনাবসান। মন খারাপ হয় তার। তবে বেশিদিন থাকে না মন খারাপ। নতুন কচি সবুজ পাতা জন্মায়, আবার তাকে দুলে দুলে ডাকে। এইভাবে পাতাদের সঙ্গে তার সংসার পাতা আছে। দীর্ঘকাল। এই মেয়েকে অন্য কোনো সংসার করার কথা বলা যায়?

তবু পথিক দু-একবার বোঝাতে চেয়েছে। কিন্তু সিঁথি বলেছে  – এরকম বুড়ো, অসুস্থ, নিঃসঙ্গ একজন মানুষকে রেখে কোথায় যাবো? যাওয়া যায় বলুন?

না, যায় না। অন্তত সিঁথির মতো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। নইলে কত মানুষই তো যায়, নিজের স্বার্থেই যায়, এ-বাড়ির ছেলেরাও তো গেছে, কিন্তু সিঁথি যেতে পারে না, পারবে না।

দিন যায়, বাবার শরীর ভেঙে পড়তে থাকে, বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হন তিনি। একসময় বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ছেলেদের খবর দেওয়া হয়, কিন্তু তাদের সময় নেই আসার। সবাই খুব ব্যস্ত। পথিকই ছেলের ভূমিকা পালন করে। হাসপাতালের সমস্ত ঝুটঝামেলা সে একাই সামলায়। বাবা অনেকবার ছেলেদের দেখার আকাঙক্ষা ব্যক্ত করেন; কিন্তু একসময় বুঝে যান, এ-জীবনে আর তা হওয়ার নয়। সিঁথির জন্য দুশ্চিন্তায় তিনি আরো ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। মারা যাওয়ার আগে পথিকের হাত ধরে বলেন, আমার মেয়েটা একা হয়ে গেল। সম্ভব হলে তুমি ওর পাশে থেকো।

পথিক তাঁকে কিছু বলতে পারেনি। সে তো পাশেই থাকতে চেয়েছে। যখন সিঁথি বলতো, বিয়ে হলে বাবাকে ছেড়ে দূরে চলে যেতে হবে, তখন সে বলতে চেয়েছে – দূরে যাবে কেন, এখানেই থাকবে তুমি, আমিও এসে থাকবো তোমার পাশে। বলতে পারেনি। এতগুলো বছর পার হয়ে গেছে, কিছুই বলতে পারেনি সে। তার একটি কারণ হয়তো এই যে, নিজেকে কখনো সিঁথির যোগ্য বলে মনে হয়নি তার। আরেকটি কারণ, সিঁথি যে কী চায়, বা আদৌ কিছু চায় কি না সে তা বুঝতেই পারেনি কোনোদিন।

বাবা মারা যাওয়ার পর ছেলেদের খবর দেওয়া হলো। তারা জানালো, তারা না আসা পর্যন্ত যেন বাবাকে সমাহিত করা না হয়। তিন মাস ধরে তিনি হাসপাতালে, কতবার দেখতে চেয়েছেন ছেলেদের, তাদের আসার সময় হয়নি। এখন মৃত বাপকে দেখার জন্য তারা আসছেন! লাশ হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হলো।    পথিকই দৌড়াদৌড়ি করে সব কাজ করলো। চারদিন পর তিন ছেলে এসে হাজির হলো। এ কদিন সে সিঁথির আশেপাশেই ছিল, ছেলেরা আসার পর চলে গেল। কোনো প্রশ্নের জন্ম দিতে চায় না পথিক। সে কে, সিঁথির সঙ্গে তার কী সম্পর্ক, কেন এ-বাড়িতে তার অবাধ যাতায়াত – এসব প্রশ্ন উঠলে সে কোনো উত্তর দিতে পারবে না। সিঁথিও পারবে না। খামোকা ঝামেলা বাড়বে।

সমাহিত করার সময় অবশ্য সেও রইলো। পাড়া-প্রতিবেশী অনেকেই যেহেতু এসেছে, তাকে আলাদা করে লক্ষ করবে না কেউ। কিন্তু সিঁথির চোখ এড়ানো গেল না, অনেক মানুষের ভিড়ে এক ফাঁকে কাছে এসে নিচুস্বরে জানতে চাইলো – কদিন ধরে আসছেন না কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?

না, সমস্যা হয়নি। তোমার ভাইদের মুখোমুখি হতে চাই না।

কেন?

নানান প্রশ্ন করবে, উত্তর তো দিতে পারবো না।

ও!

সিঁথির ভাইরা চলে গেল মাসখানেক পর। এর মধ্যে পথিক আর ওদিকে যায়নি। কয়েকবার ফোনে সিঁথির সঙ্গে কথা হয়েছে অবশ্য। টুকটাক কথা। কী-ই বা বলা যায় এই শোকের সময়? ভাইরা চলে যাওয়ার পর সিঁথি ফোন করে জানালো। বললো – এখন তো আসতে পারেন!

সে গিয়ে দেখলো, পুরো বাসায় সিঁথি একা। অবশ্য দারোয়ান আর গৃহকর্মীরা এখনো আছে, কিন্তু আপনজন বলে কেউ নেই। বুক দুলে উঠলো তার। এই শূন্য বাসায় মেয়েটা থাকবে কী করে? কথাটা জিজ্ঞেসও করলো সে। চুপচাপ স্বভাবের সিঁথি, স্নিগ্ধ-বিষণ্ণ সিঁথি, যে কোনোদিনই বেশি কথা বলেনি, আজ হঠাৎই যেন তার কথার স্রোত বেরিয়ে এলো। বললো – এ-বাসায় থাকবো না তো!

থাকবে না! কোথায় যাবে?

যাবো কোথাও। কোনো বাসা ভাড়াটাড়া নিতে হবে …

কিন্তু কেন? – ভীষণ অবাক হয়ে জানতে চাইলো পথিক।

এই বাড়ি ভাইয়ারা ডেভেলপারদের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। তারা দুমাস সময় দিয়েছে আমাকে। এ-বাড়ি ভাঙা হবে, গাছগুলো কেটে ফেলা হবে, এখানে উঠবে বহুতল ভবন।

এই বাড়ি ডেভেলপারদের হাতে চলে গেছে! কথাটা শোনার পর নিজেকে নিরাবলম্ব মনে হলো পথিকের। এ-বাড়ি তার নয়, কী হলো না হলো তা নিয়ে তার কিছু যাওয়া-আসার কথাও নয়, কিন্তু তার অনুভূতিটা হলো হঠাৎ আশ্রয় হারানোর মতো। দীর্ঘদিন, এই এতগুলো বছর, এই বাড়ি নিয়ে সে এক ঘোরের মধ্যে ছিল। এক অমোঘ টানে সে বারবার ফিরে এসেছে এখানে। যেন তার জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল এই বাড়ির সঙ্গে। সেটা আর থাকবে না? সে তাহলে কোথায় যাবে প্রতিদিন? কার কাছে? সিঁথিই বা কোথায় যাবে? যে-পাতাদের সঙ্গে সে সংসার পেতেছিল সেই পাতাগুলো কেউ এসে ছিঁড়ে নিয়ে যাবে! ‘সংসার না বৈরাগ্য, কী জীবন হয় ছেঁড়া পাতার?’ নীরবে ভাবছিল সে এসব কথা, আর সিঁথি বলে চলছিল – বাবার হাতে গড়া এই বাড়ি, মায়ের যত্ন দিয়ে গড়া এই সংসার ভেসে যাবে। কোথাও তাদের স্মৃতিচিহ্ন থাকবে না, কোথাও তাদের স্পর্শ থাকবে না। আমি দেখেছি, কত যত্ন নিয়ে বাবা এই বাড়ি গড়ে তুলেছিলেন; দেখেছি, কী পরম মমতায় মা এই গাছগুলোকে লালন-পালন করতেন; সেসবের কোনো মূল্যই দেয়নি ভাইয়ারা। এখানে আমি জন্মেছি, বড় হয়ে উঠেছি; ভাইয়াদের জন্ম, বেড়ে ওঠাও এখানেই। আমাদের সবার সম্মিলিত স্মৃতি ধরে রেখেছিল এই বাড়ি। আর এখন, ভাইয়ারা বলে, আমি যেন তাদের কাছে চলে যাই! কেন যাবো? কী আছে আমার ওখানে? কে আছে? যারা স্মৃতির মূল্য বোঝে না, তারা সম্পর্কের মূল্যও বোঝে না। অতীত যাদের কাছে মৃত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎও তাদের কাছে মৃতই। যারা অবলীলায় বাড়িটা তুলে দিয়ে গেল আগ্রাসী ব্যবসায়ীদের কাছে, আমি কোন ভরসায় তাদের কাছে যাবো? এখানে এখন নতুন বিল্ডিং হবে, কাজ শেষ হওয়ার পর অর্ধেক পাবো আমরা, বাকি অর্ধেক ডেভেলপাররা। আমাদের এই বাড়ি, একান্তই আমাদের বাড়ির অর্ধেকটার মালিক হয়ে যাবে তারা। ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি করে দেবে অন্য মানুষের কাছে। তখন মালিক হবে সেই অচেনা মানুষেরা। সেই নতুন বাড়ি তো আমার চিরচেনা বাড়ি নয়। সেখানে কোনো গাছ থাকবে না, পাখি থাকবে না, ঝিঁঝি পোকার ডাক থাকবে না, বাবার স্মৃতি থাকবে না, মায়ের স্পর্শ থাকবে না। সেই বাড়িতে আমি ফিরবো কীভাবে? ফিরবো না, আর কোনোদিন ফিরবো না। এই যে চলে যাচ্ছি, যেতে বাধ্য হচ্ছি, এটাই আমার শেষ যাওয়া। আপনি যাবেন আমার সঙ্গে?