পুনরুদ্ধারের অগ্রযাত্রা

চিরচেনা বাংলার বর্ণনার সঙ্গে নগর ঢাকাকে মেলাতে গেলে দেখা যায় ঢাকা একটু ভিন্ন। সুজলা-সুফলা বাংলার প্রাণ-নগরী ঢাকা শহরে আবাদ হয়েছে কয়েক কোটি মানুষের। সেই কোটি মানুষের শহরে, ইট-কংক্রিটের জঙ্গলে ‘বপন’ প্রদর্শনীটি ক্ষণিকের জন্য আমাদের দিয়ে গেছে সোঁদা মাটি আর শেকড়ের ঘ্রাণ। ভাবার্থে শেকড়ের কথা বললেও অলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ‘বপন’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি নিজেদের শেকড়ের সন্ধানে আমাদের প্রকৃতপক্ষে ভাবিত করে তুলেছিল শিল্পীদের উপস্থাপনা ও বিষয়বস্তুর আলোকে। একচিলতে হাহাকার, টুকরো মাটির খোঁজ আর যাপনের করাঘাতে জীবনকে ঐতিহ্য রসের জারণে বারবার ফিরে ফিরে দেখাই এই প্রদর্শনীর মূল উপজীব্য।

আমাদের ব্যস্ত জীবনে সবকিছুই উপলক্ষনির্ভর। সেই উপলক্ষের খোঁজেই অনেকটা সময় কেটে যায় আমাদের। ছয় জন শিল্পীর সম্মিলিত শিল্পকর্ম এবং সেই কাজের বিষয়বস্তু আমাদের জন্য একটা ক্ষণিকের উপলক্ষ হয়ে ধরা দিয়েছে বাংলার সোনালি অতীত ও ঐতিহ্যকে অনুভব উপভোগ করার। কৃষিনির্ভর বাংলাকে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা ও উপস্থাপনের এই অভিনবত্বকে সাধারণ দর্শক যেমন স্বাগতম জানিয়েছে তাদের উপস্থিতির মাধ্যমে, ঠিক তেমনি ঢাকার শিল্পাঙ্গনে এটি একটি নতুন গুঞ্জনেরও সুর তুলেছে। শুধু অতীতকে রোমন্থন করেই ক্ষান্ত হননি শিল্পীরা, বরং সময়ের সঙ্গে তৈরি হওয়া একটা বাস্তব সমস্যার পেছনের কারণ, প্রতিকারের পন্থা এবং ভবিষ্যতের রূপরেখাও উঠে এসেছে তাঁদের শিল্প-উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে।

প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত শিল্পকর্ম এবং শিল্পীদের নিজেদের কাজের বক্তব্য আমাকে বারবার মনে করাচ্ছিল এস এম সুলতানের হাহাকারের কথা। তারেক মাসুদের নির্মিত আদম সুরতের একটা বিশেষ অংশে কৃষকদের নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘একটা প্রহসন চলছে এদের নিয়ে, এটা বেশ লাগে ভালো। আমি ততোই এদের মাসলস বড়ো করি আর মজবুত করি, যে তোমরা মোটে ভয় পাবা না। তোমরা টিকে থাকবে। তোমরাই মাটির প্রকৃত অধিকারী। মাটির সাথে সম্পর্ক তোমাদের, ওদের নয় যারা তোমাকে উপহাস করে।’

কথাগুলো আরো ৩৮-৪০ বছর আগের। কিছু প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়ে আরো খারাপের দিকে যাওয়া ছাড়া ভালো হয়নি একটুও। তাই তো হারিয়ে যাচ্ছে কৃষির মাহাত্ম্য, কৃষকের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা। এই প্রদর্শনীটি আমাদের একটু হলেও নতুন করে ভাবাচ্ছে বিষয়টা নিয়ে। উদ্বুদ্ধ করছে নিজেদের আত্মোপলব্ধিকে জাগ্রত করার জন্য।

কৃষকের নিপীড়ন, বাজারজাতকরণে সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মিদশা, উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে ভোক্তার সম্পর্কের দূরত্ব, নানান প্রতিবন্ধকতায় শস্যের হারিয়ে যাওয়া, কৃষক শ্রেণির অবহেলা, সবুজের রোমন্থন – এমন অনেক বিষয় উঠে এসেছে শিল্পীদের শিল্পকর্মগুলোতে। বীজ, শস্য, অঙ্কুরোদ্গম এমনকি কৃষিতে ব্যবহৃত ছোট ছোট আনুষঙ্গিক জিনিসও হয়ে উঠেছে তাঁদের শিল্পকর্ম। সরাসরি শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু হিসেবেও উপস্থাপিত হয়েছে তা কিছু কাজে। উপস্থাপিত হয়েছে রূপক প্রকাশের ভাষা হিসেবেও। যেমন শিল্পী গোলাম ফারুক সরকারের শিল্পকর্মে আমরা দেখতে পাই তিনি গরুর মুখে পরানো কাফাই দিয়ে তাঁর শিল্পকর্মটি নির্মাণ করেছেন। যেখানে তিনি কাফাইকে রূপক করেছেন বর্তমান সময়ের বাজার ব্যবস্থায় কৃষকদের বন্দি অবস্থাকে তুলে ধরতে। কাফাই যেমন গরুকে উৎপাদিত শস্য ভক্ষণ থেকে বিরিত রেখে তাকে কাজ করতে বাধ্য করায়, তেমনই এক অদৃশ্য কোনো কাফাই যেন বর্তমান কৃষক সমাজকে বন্দি করে রেখেছে নিজেদের উৎপাদিত শস্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে। শিল্পী নিজেকে সেই কৃষক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবেই দেখতে পছন্দ করেন। নিজের অবস্থান থেকে বোধহয় নিজের মুখেই কাফাই পরিহিত করে তোলা ফটোগ্রাফ এবং এর সঙ্গে নানান ছোট ছোট বিষয়কে যুক্ত করে, গোল্ড ফয়েল ব্যবহার করে নির্মাণ করেছেন আরেকটি শিল্পকর্ম। ব্যক্তি-অভিজ্ঞতায় উপলব্ধি হয় যে, ঝুলন্ত কাফাই এবং তার বিপরীতে ব্যবহৃত আলোর কারণে দেয়ালে যে ছায়ার একটা জটলা তৈরি হয়েছিল দর্শক মনে তা ঘটনার পেছনে থাকা অপ্রকাশিত সত্যের দিকে ইঙ্গিত দেয় পক্ষান্তরে।

শিল্পী বিপাশা হায়াৎও অন্যরকম একটি উপস্থাপনের মাধ্যমে এই প্রদর্শনীর সামগ্রিক ধারণার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। তাঁর উপস্থাপিত ‘বিলুপ্তি’ শিল্পকর্মটি উৎপাদক শ্রেণির প্রতি অবজ্ঞাকে বিলুপ্তির আশংকায় প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।  তিনিও তাঁর বক্তব্যকে উপস্থাপনের জন্য আশ্রয় নিয়েছেন রূপক দৃশ্যতার। তিনি কৃষক সমাজকে অবজ্ঞা  করা বা উপেক্ষাকে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর উপস্থাপনায়। এই উপস্থাপনায় তিনি বেছে নিয়েছেন হাঁড়িকে। শস্য উৎপাদনের পরবর্তী ধাপে আসে তার উপযোগের প্রসঙ্গ। উপযোগের প্রতিটি স্তরে অর্থাৎ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ থেকে শুরু করে সংরক্ষণ, সবকিছুতেই প্রয়োজন পড়ে হাঁড়ির। প্রয়োজন ও ব্যবহার ভেদে নানান তাদের আকৃতি, নানান তাদের গড়ন ও উপাদান। কিন্তু দৈনন্দিন নিত্যব্যবহারে চোখের সামনে থেকেও হাঁড়ি যেন অলক্ষেই থেকে যায়। এমনি এক উপলব্ধি থেকে হাঁড়ি, শস্যদানা ও জলরং ব্যবহারে চিত্র-নির্মাণের মাধ্যমে তিনি তাঁর উপলব্ধিকে উপস্থিত করেছেন দর্শকের সামনে। দাঁড় করিয়েছেন একটি বাস্তব প্রশ্নের মুখোমুখি – ‘কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?’

এমনি আরেকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই শিল্পী জাফরিন গুলশানের শিল্পকর্মগুলোর প্রয়াস। তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্নকে দর্শকের দিকে ছুড়ে দিয়েছেন। যে-প্রশ্নের উত্তর আসলেই আমাদের কাছে আছে কি না সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত লিখিত বক্তব্য থেকে পাওয়া যায় প্রশ্নটি, ‘কৃষিপণ্য শুধু সুপারশপে দেখে যে প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, সে কিভাবে এই বিচ্ছিন্ন সংযোগকে নির্ণয় করে?’

সামগ্রিক আলোচনায় খুবই সময়োপযোগী একটি জিজ্ঞাসা। আমরা কৃষির গুণগান করে কৃষককে মহৎ বানাতেই পারি; কিন্তু আমাদের সেই মহত্ত্বের ধারক কারা হবে? যে-কিশোরসমাজ জানেই না শস্যের বেড়ে ওঠার পেছনের হাহাকারের গল্প; দাদন, সেচ, ন্যায্যমূল্যের আকুতি কিংবা একটি কৃষক পরিবারের সারা বছরের অভিশপ্ত জীবনের গল্প – তাকে কোনটা জানানো বেশি জরুরি – কৃষির গৌরবগাথা, নাকি হাহাকার? এই জিজ্ঞাসাই শিল্পীর শিল্পকর্মের উপস্থাপন।

সুপারশপের কার্টে রাখা অঙ্কুরোদ্গমরত আলু কিংবা আগ্রাসনের প্রতীক সর্বগ্রাসী জিহবা, তাঁর এই বিষয়ের অনুষঙ্গের যোগ্য উপস্থাপনই বলা চলে।

এই গুরুগম্ভীর তাত্ত্বিক আলোচনায় সহজ ভাষায় বোঝানোর ও সহজবোধ্য উপস্থাপনের দায় থেকেই বোধহয় খন্দকার নাছির আহম্মদ ও সুমনা আক্তার তাঁদের উপস্থাপনায় অন্য একটি সারল্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। শিল্পী খন্দকার নাছির আহম্মদ কৃষক ও কৃষির ক্রান্তির গল্পের মাঝেই আমাদের প্রকৃতির অমোঘ নির্মাণের সৃষ্টিশীলতার আনন্দ দেখিয়েছেন। একটি বীজ থেকে নতুন প্রাণ সৃষ্টি হওয়ার যে তীব্র আনন্দ তার প্রকাশই এই শিল্পীর শিল্পকর্ম। তিনি দেখিয়েছেন সৃষ্টির অন্তর্নিহিত শক্তির তীব্রতা। একটি অঙ্কুরোদ্গমরত বীজকে প্রকৃতির কোনো শক্তি দিয়ে যে নিবৃত করা সম্ভব নয়,  সে তার শক্তিতে নিজেকে মেলে ধরবেই – তাই উপস্থাপন করেছেন তিনি জাংক মেটালের সাহায্যে তৈরি করা অঙ্কুরোদ্গম-বীজের মাধ্যমে।

অন্যদিকে শিল্পী সুমনা আক্তার তাঁর শৈশব স্মৃতিকে শহুরে বাস্তবতায় রোমন্থন করতে চেয়েছেন জানালার পাশের সবুজের সমারোহ দেখার আনন্দের মধ্য দিয়ে। কৃষি কিংবা কৃষকের অস্তিত্বের প্রশ্ন যতটা যৌক্তিকতা নিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে এই প্রদর্শনীর শিল্পকর্মগুলোতে ততোটা যৌক্তিকতা নিয়েই সুমনা আক্তার শহুরে কংক্রিটের হট্টগোলে সবুজের বেঁচে থাকার আনন্দকে উপস্থাপন করেছেন তাঁর শিল্পকর্মে। নাগরিক বাস্তবতায় সকালের শুরুতে জানালার বাইরে তাকালে পাশের দালানের বদ্ধ দেয়াল বা জানালার ভেতর আরো একটি বসত দেখার যে তিক্ত অভিজ্ঞতা তার সঙ্গে সবুজের সমারোহের চোখ-জুড়ানো প্রশান্তিকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করার মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছেন তাঁর শিল্পকর্ম। এরকম বলা যায়, শিল্পী জাফরিন গুলশান যে সংযোগের আশঙ্কা থেকে তাঁর প্রশ্নটি উপস্থাপন করেছিলেন, শিল্পী খন্দকার নাছির আহম্মদ এবং শিল্পী সুমনা আক্তারের শিল্পকর্মগুলি এই সংযোগের সমাধানের একটি সহজ পাথেয়।

‘চালের ক্রাইসোপিয়া’ নামে ছয়টি শিল্পকর্মের একটা সিরিজ নিয়ে এই প্রদর্শনীতে বিশেষভাবে নজর কেড়েছেন শিল্পী আনিকা তাসনিম অনুপ। এই তরুণ শিল্পীর উপস্থাপনাটি আলাদাভাবে নজর কাড়ার একটি বিশেষ কারণ হচ্ছে তাঁর বিষয়বস্তু নিয়ে ভাব-আবেগের পাশাপাশি একটি সমৃদ্ধ গবেষণা ও সেটিকে শিল্পকর্মের সঙ্গে সংমিশ্রিত করে উপস্থাপন করা। যেটি বেশ অভিনব এবং চিত্তাকর্ষকও বটে। এই শিল্পীর আগ্রহের একটি প্রধান জায়গা ছিল হারিয়ে যাওয়া শস্যের জাতের অনুসন্ধান ও তাদের পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় আলোকপাত করা। এছাড়াও হারিয়ে যাওয়ার পেছনের কারণগুলোকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে আসা। বিষয়বস্তুর অভিনবত্বের সঙ্গে মুগ্ধ করেছে তাঁর উপস্থাপনের জন্য নির্বাচন করা উপাদানসমূহ। চমক ছিল বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রদর্শনীতে রাখা বীজগুলো, যা প্রদর্শনীর চলমান সময়েই অঙ্কুরোদ্গম প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে।

অনেক অভিনবত্বের সমন্বয়ে শিল্পী গোলাম ফারুক সরকারের কিউরেশনে আয়োজিত ‘বপন’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি একটি সময়োপযোগী ও দর্শকনন্দিত উপস্থাপন। ভিন্ন ভিন্ন বয়সের ছয় জন শিল্পী তাঁদের আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতা ও বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে নির্মাণ করেছেন একটি নির্দিষ্ট সূত্রের নানান দৃশ্যগত উপস্থাপন। গোলাম ফারুক সরকার অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সব শিল্পকর্মকে নির্বাচিত উপস্থাপনের মাধ্যমে এই প্রদর্শনীকে আরো উপভোগ্য করে তুলেছেন। কিউরেটর ও শিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণ তাঁকে এই কাজে আরো সহযোগিতা করেছে বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু সব তৃপ্তির মধ্যে একটা বিষয় কিছুটা পীড়ার কারণ হিসেবে থেকে গেছে শেষ পর্যন্ত। শিল্পকর্মগুলোর উপস্থাপন ও অবয়ব আরো অনেক বড় একটি স্থানে উপস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিয়েছে বারবার। গোলাম ফারুক সরকারের অসামান্য কিউরেশনের পরেও শিল্পকর্মগুলোকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরস্পরের সঙ্গে জটলা করে আছে বলে মনে হয়েছে।

সর্বোপরি এই দলীয় শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা তাঁদের শিল্পের ভাষা দিয়ে পরস্পরের কাজের অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছেন। সম্পূর্ণ নতুন একটা আবহে ঢাকার শিল্পরসিকদের নতুন ধরনের শিল্পরসে তাঁরা জারিত করেছেন অনেকদিন পর। গত ৭ই জুন (২০২৪) শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি শেষ হয়েছে ১৫ই জুন। এই শিল্পীদের কাছে আরো নতুন ভাবনা-অনুষঙ্গী কাজের প্রত্যাশা রইল।