দীর্ঘ পথ। সামনে পা ফেলতেই পেছনে বেয়াড়া ধুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ছিল, কিছুক্ষণ পর আবার ধীরে ধীরে তা থিতিয়ে পড়ছিল। কিন্তু তারপরও ধোঁয়ার মতো একচিলতে ধুলো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। ধুলো এবং পায়ের নিচের পথের কথা মাথায় না এনে সে হেঁটে চলল। যদিও প্রতি পদক্ষেপে সে বন্ধুর পথের বৈরিতা হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছিল। এমন নয় যে সে নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল, উলটোভাবে বলা চলে, সে সরাসরি সামনের দিকে তাকিয়েই এগোচ্ছিল। ভাবখানা এমন যে, এখনই যে-কোনো সময় সে এমন পরিচিত কিছু একটা দেখতে পাবে, যা তাকে বন্ধু হিসেবে বরণ করবে এবং জানাবে যে, সে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। কিন্তু পথ বেড়েই চলল।

জোর কদমে হাঁটছে সে, তার বাঁ-হাত একসময়কার সাদা, বর্তমানে ছেঁড়াফাটা নোংরা কোটের পাশঘেঁষে সামনে-পেছনে অনায়াসে ক্রমাগত দুলছে। পিঠের কাছে বাঁধা পুঁটলিটির দড়ি কনুই বাঁকিয়ে সে ডান হাতে ধরে আছে। রং জ্বলে-যাওয়া লাল ফুল আঁকা কাপড়ে মোড়ানো পুঁটলিটি, তার হাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এদিক-ওদিক দুলছে। পুঁটলিটি ডিটেনশন ক্যাম্পে কাটানো বছরগুলোর তিক্ততা ও কষ্টের সব স্মৃতিকে যেন আগলে রেখেছে। মাঝে মাঝে সে পশ্চিম দিগন্তে

ঢলে-পড়া সূর্যের দিকে তাকাচ্ছিল। কখনো কখনো সে আড়চোখে তাকাচ্ছিল বেড়া-দেওয়া ছোট ফালি ফালি ফসলের জমিনের দিকে। ভুট্টা-মটরশুঁটি-সিমসহ নেতিয়ে-পড়া শস্য নিয়ে ওগুলো অন্য সবকিছুর মতোই যেন ছিল তার কাছে অচেনা। সমগ্র দেশটাকেই যেন বিমর্ষ এবং উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। কামাউয়ের কাছে এটা নতুন কিছু নয়। তার মনে পড়ল, এমনকি মাউ মাউ১ জরুরি অবস্থার আগেও অতিরিক্ত চাষ-করা গিকুদের২ জমিগুলোকে বেশি হতচ্ছিরি দেখাত শ্বেতাঙ্গ সেটলারদের এলাকার বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠের তুলনায়।

একটি পথ ভাগ হয়ে বাঁদিকে চলে গেছে। ক্ষণেক ইতস্তত করার পর সে মনোস্থির করল। হ্যাঁ, এই পথই তাকে উপত্যকা হয়ে গ্রামে নিয়ে যাবে। যখন সেই পথ ধরে সে  হাঁটতে লাগল, প্রথমবারের মতো তার চোখ কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যাক, শেষ পর্যন্ত বাড়ির কাছাকাছি আসা গেল, এই বোধ থেকে একজন উদ্বিগ্ন পথিকের ফাঁকা চাউনি কিছুক্ষণের জন্য হলেও দূর হলো। উপত্যকা ও এর গাছপালাগুলোকে, একে ঘিরে-থাকা এলাকা থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম মনে হচ্ছিল। এখানে সবুজ ঝোপঝাড় এবং গাছগাছালির সমারোহ। এটার একটাই অর্থ হতে পারে : হোনিয়া নদী এখনো বহমান। সে দ্রুত পা চালাল। নদীকে বাস্তবে চোখে না-দেখা পর্যন্ত এটা যে সত্যি বইছে, তা যেন তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। নদীটা ঠিকই সেখানে ছিল এবং বইছিল আগের মতোই। হোনিয়া, যে-নদীতে প্রায়ই সে গোসল করত, এর শীতল সচল জলে ঝাঁপাত ন্যাংটো হয়ে, তার হৃদয় জুড়াত পাথুরে পাহাড় ঘিরে এর সর্পিল গতি দেখে, মৃদু কলকল ধ্বনি শুনে। কেমন বিষাদময় এক উচ্ছ্বাস তাকে আচ্ছন্ন করল, কিছুক্ষণের জন্য সেই দিনগুলোর স্মৃতি তাকে অস্থির করে তুলল। সে দীর্ঘ এক নিশ্বাস ছাড়ল। সম্ভবত নদীটি তার এখনকার রুক্ষ চেহারার ভেতর সেই বালকটিকে না-ও চিনতে পারে, যার কাছে নদীর তীর ছিল দুনিয়ার সবকিছু। তবু যতই সে হোনিয়ার দিকে এগোচ্ছিল, ততই এটাকে তার খুব আপন বলে মনে হচ্ছিল; মুক্তির পর যা কিছু দেখেছে সেসব কিছু থেকে।

একদল নারী নদী থেকে জল তুলছিল। নিজের পাহাড়ের দুয়েকজনকে দেখে সে বেশ উচ্ছ্বসিত হলো। মাঝবয়সী ওয়ানজিকুও ওদের মধ্যে ছিল। সে গ্রেফতার হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে ওয়ানজিকুর বধির ছেলেটিকে নিরাপত্তারক্ষীরা গুলি করে হত্যা করেছিল। সারাক্ষণ মুখে লেগে-থাকা হাসি নিয়ে সবাইকে আদর-আপ্যায়ন করত বলে ওয়ানজিকু পুরো গ্রামবাসীর কাছে ছিল খুবই প্রিয়। তারা কি কামাউকে অভ্যর্থনা জানাবে? তারা কি তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেবে? তেমনটিই তো হওয়ার কথা। সে কি পাহাড়ের সবার কাছে খুব প্রিয় ছিল না? সে কি দেশের জন্য যুদ্ধ করেনি? দৌড়ে তাদের কাছে গিয়ে সে চিৎকার করে বলতে চাইল : ‘এই যে আমি। তোমাদের কাছে ফিরে এসেছি, দেখো।’ কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করল। সে পুরুষমানুষ কি না। 

‘তুমি ভালো আছো তো?’ কজনা প্রত্যুত্তর করল। অন্য নারীরা ক্লান্ত ও ধ্বস্ত চেহারায় তার দিকে চেয়ে থাকল মৌনতা নিয়ে, যেন তার কুশলবার্তার কোনো গুরুত্ব নেই। কেন? সে কি খুব দীর্ঘ সময় ক্যাম্পে কাটিয়েছে, তাই? তার উৎসাহে ভাটা পড়ল, এবং খুব ক্ষীণকণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করল : ‘তোমরা কি আমায় চিনতে পারছো না?’ আবার তারা তার দিকে তাকাল; তাকাল নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে। অন্য সবকিছুর মতো তারা তাকে চেনে, তার সঙ্গে সম্পর্ক আছে, এসব যেন ইচ্ছা করেই অস্বীকার করছে বলে তার ধারণা হলো। শেষ পর্যন্ত একমাত্র ওয়ানজিকু তাকে চিনতে পেরেছে বলে মনে হলো। কিন্তু তার কণ্ঠে

না-ছিল উষ্ণতা, না-ছিল উৎসাহ, জিজ্ঞেস করল : ‘ওহ্, তুমি, কামাউ? আমরা আরো ভেবেছি -।’ সে তার কথা শেষ করল না। কেবল এখনই সে অন্য কিছু একটা লক্ষ করল – বিস্ময়? ভয়? সে বুঝতে পারছিল না। সে তার দিকে তাদের চকিত চাউনি লক্ষ করল এবং নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারল যে, তার জানার বাইরে কিছু একটা গোপন বিষয় তাদের একসুতোয় বেঁধে রেখেছিল।

‘মনে হয়, আমি আর তাদের একজন নই!’ তিক্ততা নিয়ে ভাবল সে। তবে তারা নতুন গ্রাম সম্পর্কে তাকে একটা ধারণা দিয়েছিল। পাহাড়ের ওপর পাতলাভাবে ছড়ানো বিচ্ছিন্ন কুঁড়েঘরগুলোর অস্তিত্ব আর নেই।

তিক্ততা আর প্রতারণার অব্যক্ত এক অনুভূতি নিয়ে সে তাদের ছেড়ে এলো। পুরনো গ্রামটিও তার জন্য অপেক্ষা করেনি। হঠাৎ করেই সে তার পুরনো ঘর, বন্ধুবান্ধব ও পারিপার্শ্বিকতার স্মৃতিতে ডুবে গেল। সে তার বাবা, মা এবং – এবং – তার সম্পর্কে ভাবতেও সে ভয় পাচ্ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও, মুথোনি পুরনো দিনগুলোতে যেমন ছিল, তার স্মৃতিতে সেভাবেই ফিরে এলো। তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। তার ভেতর কামনার ভাব জাগল এবং অদ্ভুত এক উষ্ণ শিহরণ সে অনুভব করল। দ্রুত পা চালাল সে। স্ত্রীকে স্মরণ করার সঙ্গে সঙ্গে সে গ্রামের অন্য মেয়েদের কথা বেমালুম ভুলে গেল। মাত্র দু-সপ্তাহ সে তার সঙ্গে কাটিয়েছিল। তারপর ঔপনিবেশিক বাহিনী তাকে তুলে নিয়ে যায়। অন্যদের মতোই তাকে দ্রুত বাছাই করা হয়, আটক করা হয় এবং বিচার ছাড়াই ডিটেনশন ক্যাম্পে চালান করে দেওয়া হয়। সেই সময়টাতে সে শুধু গ্রাম এবং তার সুন্দরী বধূর কথা স্মরণ করেছিল।  

অন্যরা তার মতোই ছিল। তারা তাদের বাড়ি ছাড়া অন্য কোনো কিছু নিয়ে আলাপ করত না। একদিন সে মুরাঙ্গার অন্য এক বন্দির সঙ্গে কাজ করছিল। হঠাৎ সেই বন্দি, ন্জোরোগে, পাথর ভাঙা বন্ধ করল। সে গভীর এক শ্বাস নিল। তার ক্লান্ত চোখে ছিল লক্ষ্যহীন চাউনি।

‘বলি খারাপ কিছু কি ঘটেছে তোমার? কোনো সমস্যা?’ কামাউ জিজ্ঞাসা করে।

‘আমার স্ত্রী। আমি যখন তাকে ছেড়ে আসি তখন সে সন্তানসম্ভবা। জানি না তার কপালে কী ঘটেছে।’

অন্য একজন বন্দি যোগ করে : ‘আমি সদ্য জন্ম-নেওয়া বাচ্চাসহ আমার বউকে ছেড়ে এসেছি। আমরা সবাই কী সুখীই না ছিলাম। কিন্তু ঠিক সেই দিনটিতেই আমাকে গ্রেফতার করা হয় …’

এবং তারা বলে চলে। তারা একটি দিনের জন্য প্রতীক্ষা করছিল, যে-দিনটি তাদের বাড়ি ফেরার দিন। তখন নতুনভাবে জীবন শুরু হবে।

কামাউ তার স্ত্রীকে ছেড়ে এসেছে কোনো সন্তান হবার আগেই। এমনকি সে দেনমোহরের পুরো টাকাও শোধ করতে পারেনি। এখন সে বাড়ি যাবে। নাইরোবিতে একটা চাকরির জন্য আবেদন করবে এবং মুথোনির বাবাকে দেনমোহরের বাকি টাকা পরিশোধ করবে। জীবন সত্যি নতুন করে আবার শুরু হবে। তাদের একটি ছেলেসন্তান হবে। নিজ বাড়িতে তাকে বড় করে তুলবে। এই আশায় বুক বেঁধে সে আবার জোরে কদম চালাতে লাগল। সে দৌড়াতে চাইল, – উহু, তার প্রত্যাবর্তনকে দ্রুত করবার জন্য সে উড়ে যেতে চাইল। সে এখন পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি। মনে আশা, যেন সহসাই তার ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তারা কি তাকে প্রশ্নট্রশ্ন করতে পারে? করলে করুকগে : বাছাই, মারধর, রাস্তার কাজ করা, কাছে-থাকা আসকারি (গ্রামপুলিশ), কাজে ঢিলা দিলে যে তাকে কষে লাথি মারত, তার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ, – না এসব কিছুই তাদের বলা চলবে না। হ্যাঁ, সে প্রচুর অপমান সহ্য করেছে; কিন্তু প্রতিরোধ করেনি। কোনো দরকার ছিল? কিন্তু তার আত্মা এবং পৌরুষের সব তেজ বিদ্রোহ করেছে। প্রচণ্ড ক্রোধ এবং যন্ত্রণায় সে রক্তাক্ত হয়েছে। 

একদিন এইসব ওয়াজুনগু (শ্বেতাঙ্গ) বিদায় নেবে।

একদিন তার জনগণ স্বাধীনতা লাভ করবে। তখন, তখন – সে জানে না, সে কী করবে। সে যাই হোক, সে দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেকে আশ্বস্ত করল, আর কেউ কখনো তার পৌরুষকে অবজ্ঞা করতে পারবে না।

পাহাড়ের ওপর উঠে সে থামল। সবটুকু সমতলভূমি পাহাড়ের নিচে বিস্তৃত। তার সামনে নতুন গ্রাম – সারি সারি গায়ে গায়ে লাগানো মাটির কুঁড়েঘর, দ্রুত অস্তগামী সূর্যের নিচে যেন শুয়ে আছে। বিভিন্ন কুঁড়েঘর থেকে কালচে নীল ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরে উঠছিল। সৃষ্টি করছিল কালো কুজ্ঝটিকা, যা ঝুলে ছিল গ্রামের ওপর। দিগন্তে গাঢ় রক্তলাল ডুবন্ত সূর্য, আঙুলসদৃশ সরু রশ্মি বাইরের দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছিল, যা মিশে যাচ্ছিল দূরের পাহাড়গুলোকে ঢেকে-দেওয়া ধূসর কুয়াশার সঙ্গে।

নতুন অনেক মুখের সঙ্গে দেখা করতে করতে গ্রামের পথ ধরে সে ঘুরে বেড়ায়। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে সে নিজ বাড়ি খুঁজে পায়। উঠানের কাছে প্রবেশপথে সে থামে এবং বুকভরে লম্বা শ্বাস নেয়। এটা তার বাড়িতে ফেরার মুহূর্ত। তার বাবা একটি তেপায়া টুলের ওপর বসেছিলেন। যথেষ্ট বুড়িয়ে গেছেন তিনি। কামাউর এই বৃদ্ধের প্রতি করুণা হলো। কিন্তু অন্তত তিনি রেহাই পেয়েছেন – হ্যাঁ, ছেলের প্রত্যাবর্তন দেখতেই যেন রেহাই পেয়েছেন –

‘বাবা!’

বৃদ্ধ কোনো উত্তর করলেন না। তিনি এক আশ্চর্য ফাঁকা দৃষ্টিতে কামাউর দিকে চেয়ে রইলেন। কামাউ অধৈর্য। সে বিরক্ত ও অতিষ্ঠ বোধ করছিল। তিনি কি তাকে দেখেননি? নদীর তীরে যেসব মেয়েলোক সে দেখেছিল, তিনি কি তাদের মতো আচরণ করবেন?

রাস্তায় উলঙ্গ ও অর্ধউলঙ্গ শিশুরা একে অন্যের দিকে ধুলো ছুড়ে খেলা করছিল। সূর্য এরই মধ্যে অস্ত গেছে। মনে হচ্ছিল, চাঁদের আলো দেখা যাবে।

‘বাবা, তুমি কি আমায় মনে করতে পারছো না?’ আশার আলো তার নিভে যাচ্ছিল। সে ক্লান্ত বোধ করছিল। তখন সে খেয়াল করল, হঠাৎ তার বাবা গাছের পাতার মতো কাঁপতে শুরু করেছেন। যেন তিনি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সেই চোখে ভীতি ঠাওর করা যাচ্ছিল। তার মা এলেন, তার ভাইয়েরাও এলো। তারা তার চারপাশে জটলা সৃষ্টি করল। তার বুড়ি মা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন খুব।

‘আমি জানতাম, আমার ছেলে ফিরে আসবে। আমি জানতাম সে মরেনি।’

‘কেন, কে বলেছে আমি মারা গিয়েছি?’

‘ওই কারানজা, ন্জোগুর ছেলে।’

 আর তখনই কামাউ সব বুঝতে পারল। সে তার কাঁপতে-থাকা বাবাকে বুঝতে পারল। সে নদীর ধারে দেখা স্ত্রীলোকদের আচরণের অর্থ বুঝতে পারল। কিন্তু একটা বিষয় তাকে বেশ হতবুদ্ধি করল : সে কখনো কারানজার সঙ্গে একই বন্দিশিবিরে থাকেনি তো! তা যাই হোক, সে ফিরে এসেছে। এখন সে মুথোনিকে দেখতে চায়। কেন সে বেরিয়ে আসছে না? সে চিৎকার করতে চাইল, ‘আমি এসেছি মুথোনি, এই যে দেখো, আমি এখানে।’ সে চারদিকে তাকাল। মা তাকে বুঝতে পারলেন। তিনি তার স্বামীর দিকে ত্বরিত একনজর তাকিয়ে শুধু বললেন : ‘মুথোনি চলে গেছে।’

কামাউর মনে হলো শীতল কিছু একটা যেন তার পাকস্থলীতে জমা হচ্ছে। সে গ্রামের কুঁড়েঘর এবং বিবর্ণ ক্ষেতের দিকে তাকাল। অনেক কিছু জিজ্ঞেস করবার ইচ্ছা হলো তার, কিন্তু সাহসে কুলাল না। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে, মুথোনি চলে গেছে। যদিও নদীর তীরে দেখা নারীদের চোখের ভাষায়, তার বাবা-মার তাকানোর ভঙ্গিতে সে কিছুটা আঁচ করেছিল, মুথোনি নেই।

‘সে আমাদের কাছে কী লক্ষ্মী মেয়ের মতোই না ছিল।’ তার মা ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন, ‘তোমার জন্য সে অনেক অপেক্ষা করেছে এবং ধৈর্যের সঙ্গে এখানকার দুঃখকষ্ট সহ্য করেছে। তারপর কারানজা এসে জানাল যে, তুমি মারা গেছো। তোমার বাবা তার কথা বিশ্বাস করল। মুথোনিও বিশ্বাস করল এবং এক মাস ধরে কান্নাকাটি করল। কারানজা তখন ঘনঘন আমাদের এখানে যাওয়া-আসা করত। সে ছিল তোমার সমবয়সী, জানো তো। মুথোনি সন্তানের মা হলো। আমরা তাকে রাখতে পারতাম। কিন্তু কোথায় জমি? খাদ্য কোথায়? ভূমি-যৌথকরণের পর থেকে আমাদের শেষ নিরাপত্তাটুকুও ছিনিয়ে নিয়েছে। আমরা মুথোনিকে কারানজার সঙ্গে যেতে দিলাম। অন্য মেয়েরা তো আরো খারাপ কাজ করেছে – তারা শহরে গিয়েছে। কেবল দুর্বল এবং বুড়োরা থেকে গেল এখানে।’

সে কিছুই শুনছিল না। তার পাকস্থলীর শীতলতা ধীরে ধীরে বিতৃষ্ণায় রূপান্তরিত হলো। সব লোক, তার মা-বাবাসহ সবার প্রতি এক তীব্র ক্ষোভ সে অনুভব করল। তারা তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তারা তার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়েছে। কারানজা তো ছিল সবসময়ই তার প্রতিদ্বন্দ্বী। এটা ঠিক, পাঁচ বছর খুব কম সময় নয়। কিন্তু সে কেন চলে গেল? কেন তারা তাকে যেতে দিলো। সে কথা বলতে চাইছিল। হ্যাঁ, কথা বলতে এবং সবাইকে অভিশাপ দিতে – নদীপাড়ের নারীদের, গ্রাম এবং যারা সেথায় বসবাস করে। কিন্তু সে পারল না। এই দুঃসহ বিষয়টি তার কথা আটকে রেখেছিল।

‘তুমি – তোমরা আমার সন্তানটাকে দিয়ে দিতে পারলে?’ ফিসফিস করল সে।

 ‘শোনো বাবু, বেটা আমার -’

দিগন্তজোড়া বিশাল হলদে চাঁদ। প্রচণ্ড বিতৃষ্ণায় কামাউ অন্ধের মতো ঝড়ের গতিতে ছুটতে লাগল। হোনিয়া নদীর কাছে এসে তবে সে থামল।

কিন্তু নদীর তীরে দাঁড়িয়ে সে নদীকে দেখতে পেল না, তার বদলে দেখল তার সব আশাকে ধুলোয় মিশে যেতে। তরতর বয়ে চলেছে নদী, একঘেয়ে অবিরাম কুলকুল ধ্বনি তুলে। অরণ্যে ঝিঁঝিপোকা ও আরো কত কীট গুঞ্জন করে চলেছে বিরামহীনভাবে এবং ওপরে উজ্জ্বল চাঁদ ঝিকমিক করছে। সে তার কোট খুলতে চেষ্টা করল, আর তখন ছোট্ট পুঁটলিটি, যা খুব শক্ত করে বাঁধা ছিল, মাটিতে পড়ে গেল। ওটা নদীর ঢাল ধরে গড়িয়ে পড়তে লাগল। এবং কী ঘটছে, কামাউ তা বোঝার আগেই পুঁটলিটা নদীর স্রোতে দ্রুত ভেসে চলল। ক্ষণিকের জন্য সে হতবাক হয়ে পড়ল এবং ওটাকে উদ্ধার করতে চাইল। সে কী দেখাবে তার – আহ্, এত তাড়াতাড়ি সে ভুলে গেল? তার স্ত্রী তো চলে গেছে। এবং ছোট ছোট জিনিস, যেগুলো তাকে অদ্ভুতভাবে তার কথা মনে করিয়ে দিত, যা এতদিন সযত্নে সে আগলে রেখেছিল, চলে গেল। যে-কোনো কারণেই হোক, সে জানে না কেন, কেমন এক স্বস্তিতে সে নির্ভার বোধ করল। ডুবে মরার চিন্তা তার দূর হয়ে গেল। সে কোট পরতে পরতে নিজ মনে বিড়বিড় করতে লাগল, ‘কেন সে আমার জন্য অপেক্ষা করবে? কেন সব পরিবর্তন আমার প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করবে?’

টীকা

১. Kenya Land and Freedom Army (KLFA) বা Mau Mau : ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে কেনিয়ানদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র সংগঠন। এদের তৎপরতাকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি আরোপিত জরুরি অবস্থাকে এখানে Mau Mau emergency বা মাউ মাউ জরুরি অবস্থা বলা হয়েছে।

২. Gikuyu ev Kikuyu কেনিয়ার সবচেয়ে বড় জাতিগত গোষ্ঠী।

লেখক-পরিচিতি

কেনিয়ার লিমুরু শহরের কাছে কামিরিথুতে ৫ জানুয়ারি, ১৯৩৮ সালে নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও-র জন্ম। ঔপনিবেশিক আমলে ব্যাপটাইজ করে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল জেমস্ নগুগি।

তিনি উগান্ডার ম্যাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে ইংরেজিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এ-সময়ে, ১৯৬২-তে তাঁর লেখা The Black Hermit নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ’৬৪ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস Weep Not, Child প্রকাশিত হয়। এটা কোনো পূর্ব আফ্রিকান লেখকের ইংরেজিতে লেখা প্রথম উপন্যাস।

’৬৭-তে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো উপন্যাস A Grain of Wheat। এই উপন্যাসে ফ্যানোনিস্ট মার্কসিজমের প্রতি তাঁর আগ্রহ লক্ষ করা যায়। প্রচণ্ড বর্ণবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরোধী একজন লেখক হিসেবে তিনি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করেন। তিনি ইংরেজি ভাষা, খ্রিষ্টধর্ম এবং তাঁর নাম জেমস্ নগুগিকে ঔপনিবেশিক ক্ষতচিহ্ন আখ্যা দিয়ে তা ত্যাগ করেন এবং ফিরে যান নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও নামে; লেখালেখির কাজও করতে থাকেন মাতৃভাষা গিকু এবং সোয়াহিলিতে।

স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লেখালেখি ও নাটক মঞ্চায়নের কারণে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। বৎসরাধিককাল কারাবাসের পর তিনি দেশত্যাগ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন।

বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, অ্যার্ভিনের ‘ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্যে’র একজন বিশেষ অধ্যাপক (Distinguished Professor)।

উল্লেখ্য, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য একজন কথাশিল্পী হিসেবে তাঁর নাম প্রায়শই আলোচনায় উঠে আসে। ‘প্রত্যাবর্তন’ গল্পটি তাঁর Fighters and Martyrs গল্পগ্রন্থ থেকে নেওয়া ‘The Return’ গল্পের অনুবাদ। অনুবাদকর্মে বরাবরের মতো মূলানুগ থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে।