‘যাত্রা’পথের পাঁচালী

পথের পাঁচালীর সঙ্গে ওতপ্রোত একটি উপাদানের কথা আমরা ভুলেই থাকি। সচরাচর নয়, বরাবর। খোদ সত্যজিৎ রায় এই ছায়াছবির উদ্যোগ-নির্মাণ-উত্তর পর্ব নিয়ে অনেক জায়গায় বলেছেন, লিখেওছেন। বাংলায় ইংরেজিতে। এ নিয়ে আলাদা করে আলোকপাত করেননি। দেশদুনিয়ার শিল্পসংস্কৃতির কত সমঝদার পথের পাঁচালীর কত দিক নিয়ে কত আলোচনা করেছেন। সত্যজিতের জন্মশতবর্ষেও তার জের চলছে। অথচ বাংলা সংস্কৃতির, বা বলা ভালো যে লোকায়ত বঙ্গজীবনের এই অঙ্গ কীভাবে পথের পাঁচালীতে উঠে এলো তার সুলুকসন্ধান হলো না। এক শঙ্খ ঘোষ ছাড়া আর কেউ এদিকে নজর দেননি। মজার ব্যাপার, বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীতে তা অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিল। দুই বাঁড়ুজ্যের লেখাতেও লোকসংস্কৃতির এই অভিজ্ঞানটি বারেবারে উঠে এসেছিল। সবচেয়ে বড়ো কথা এই ছায়াছবির চিত্রনাট্য লেখার সময় বিভূতিভূষণের মূল রচনার বারো আনাই ছেঁটেকেটে ফেললেও এই অঙ্গটিকে একটুও অগ্রাহ্য করেননি সত্যজিৎ। বরং আরো বেশি করে জায়গা করে দিয়েছেন। তাকে পত্রেপুষ্পে বাড়তে দিয়েছেন।

আমরা যাত্রার কথা বলছি।

বলার আরো দুটো কারণ আছে। এক, আজ থেকে সত্তর বছর আগেকার বাংলায় যাত্রা কীভাবে হতো তা পথের পাঁচালীতে সংরক্ষণ করে রেখেছেন সত্যজিৎ। কলকাতার কাপ্তেনবাবুদের চোখে ‘ফাত্রা’ লোকের এই বিনোদন এর আগে যে সেলুলয়েডের দাক্ষিণ্য পায়নি তা একরকম হলফ করেই বলা যায়। দুই, বিভূতিভূষণ বা সত্যজিৎ নিছক স্বাদবদলের ফিকির খুঁজতে গিয়ে যাত্রার হাত ধরেননি। পথের পাঁচালীর আমলে অর্থাৎ কমবেশি একশ বছর আগেকার যুক্ত বাংলায় – বিশেষ করে ২৪ পরগনায় – গৈগেরামের যে চেহারা ছিল, তাতে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে যাত্রা ছিল সর্বব্যাপী। বৈষ্ণব ধর্মাচরণের  সঙ্গে তার নাড়ির যোগ। খ্রিষ্টীয় উনিশ শতকের গোড়া থেকেই সারা বাংলাজুড়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের পায়ের তলায় হারানো জমি একটু একটু করে ফিরে আসায় ঝুমুর-খেমটা-কবিগানের মতো জনপ্রিয় নাট্য আঙ্গিককে পেছনে ফেলে যাত্রার পায়াভারী হয়। নবদ্বীপের মতিলাল রায়ের দেখানো পথে কীর্তন গানের সঙ্গে গল্প জুড়ে জুড়ে পালা তৈরির চল হয়। মতিলাল ও তাঁর অনুসারীদের যোগসাজশে সেসব পালা বটতলার ছাপাখানার দৌলতে তামাম বাংলায় ছড়াতে থাকে। কলকাতার দেখাদেখি গ্রামে গ্রামে যাত্রার দল তৈরি হতে থাকে। যাদের নামডাক হয় তাদের কদর হয় তল্লাট জুড়ে। গণসংস্কৃতির আদল বদলাতে থাকায় জমিদার-নায়েবদের পিঠ চাপড়ানি পেতে অসুবিধে হয়নি যাত্রার। মন্দিরের আশপাশে, মেলার মাঠে যাত্রার আসর জাঁকিয়ে বসেছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের মুচিরাম গুড় ছেলেবেলায় যাত্রার দলের সঙ্গে চলে গিয়েছিল।

১৮৫০-র দশকের শেষাশেষি ট্রেন চলতে শুরু করলে লাইনের কাছাকাছি এলাকায় দূরদূরান্ত থেকে যাত্রার দলের আনাগোনা সহজ হয়। বিভূতিভূষণের লেখায় নিশ্চিন্দিপুরের যে-অবস্থান পাই – অর্থাৎ ‘নিশ্চিন্দিপুরের গ্রামের উত্তরে যে কাঁচা সড়ক ওদিকে চুয়াডাঙা হইতে আসিয়া নবাবগঞ্জ হইয়া টাকী চলিয়া গিয়াছে’ – সেই কাঁচা সড়কপথে যাত্রার দলের আনাগোনা ছিলই। রেললাইন পাতার পর ন-মাসে ছ-মাসে কলকাতা থেকে যাত্রার দল নিয়ে এসে আসর জমানো ওই গণসংস্কৃতির অনিবার্য শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আশপাশের গ্রামের সঙ্গে রেষারেষি তাতে ইন্ধন জুগিয়েছিল। মোটের ওপর নিস্তরঙ্গ পল্লীজীবনে অতি কাক্সিক্ষত এক ব্যতিক্রম ছিল এহেন আসর।

বিভূতিভূষণে যা ছিল

পথের পাঁচালীর দ্বাবিংশ আর ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদে যাত্রার কথা আছে। দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদের শুরুতেই বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন, ‘বারোয়ারি তলায় ঘাস চাঁচিয়া প্রকাণ্ড বাঁশের মেরাপ, বাঁশের সামিয়ানা টাঙানো হইয়াছে। যাত্রার দল আসে আসে – এখনও পৌঁছে নাই, সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গেলে, লোকে বলে কাল সকালের গাড়িতে আসিবে, সকাল চলিয়া গেলে, বৈকালের আশায় থাকে। অপুর স্নানাহার বন্ধ হইবার উপক্রম হইয়াছে। … রাত্রে অপুর ঘুম হয় না, বাঁধভাঙা বন্যার স্রোতের মতো কৌতূহল ও খুশির যে কী প্রবল অদম্য উচ্ছ্বাস! বিছানায় ছটফট, এপাশ-ওপাশ করে। যাত্রা হবে! যাত্রা হবে! যাত্রা হবে!’

ওই ‘যাত্রা হবে’র অনুবর্তনের মধ্যে গাঁথা আছে অপুর মতো অগুনতি শিশু-কিশোরের সেইসব দিনরাত। তা যে তাদের কাছে এক অসামান্য অনুভব তাও ধরা আছে বিভূতিভূষণের কলমে। ‘অপুর মনে হয়, যে পঞ্চাননতলায় সে দু-বেলা কড়িখেলা করে, সেই তুচ্ছ অত্যন্ত পরিচিত সামান্য স্থানটাতে আজ বা কাল নীলমণি হাজরার যাত্রার দলের মতো একটা অভূতপূর্ব অবাস্তব ঘটনা ঘটিবে, এও কি সম্ভব? কথাটা যেন তাহার বিশ্বাসই হয় না।’ এই বর্ণনা পড়তে গিয়ে শঙ্খ ঘোষের মনে পড়েছিল শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত। বালক শ্রীকান্তের স্মৃতিতে ‘ধন্য বীর, ধন্য বীরত্ব’র পরিহাস।

অপুর চোখ তেমন কোনো অসংগতি দেখেনি। তাই পথের পাঁচালীর ত্রয়োবিংশ অধ্যায় জুড়ে আছে পাঁচ গাড়ি সাজ নিয়ে নীলমণি হাজরার যাত্রার দলের নিশ্চিন্দিপুর এসে পড়া, সারাটা গ্রামের ওই বারোয়ারিতলায় ভেঙে পড়া, শুভঙ্করী আর্যাতে কিছুতেই অপুর মন না-বসা আর বারোয়ারিতলায় যাবার মুখে দুর্গার মুঠো খুলে অপুর হাতে চলে আসা। আনন্দ বসন্ত সমাগমে কিশোরী মনের দোর যে হাট হয়ে খুলে গেছিল ওই দু-পয়সার পালা তার সাক্ষী।

আরো আছে। হরিহরের সঙ্গে অপুর এতদিনকার নিবিড় সম্বন্ধের ডোর যেন খানিক ক্ষণের জন্য হলেও আলগা করে দিয়েছিল যাত্রা। অপুকে একেবারে একা করে দিয়েছিল। যাত্রার মতো গণবিনোদন কীভাবে শিশুমনকে ভাসিয়ে দিয়ে তার ইজারা নেয় তাও লিখেছিলেন বিভূতিভূষণ। ত্রয়োবিংশ অধ্যায়ের গোড়াতে ছিল, ‘যাত্রা আরম্ভ হয়। জগৎ নাই, কেহ নাই – শুধু অপু আছে, আর নীলমণি হাজরার যাত্রার দল আছে সামনে। সন্ধ্যার আগে বেহালায় ইমন আলাপ করে, ভালো বেহালাদার। পাড়াগাঁয়ের ছেলে কখনও সে ভালো জিনিস শোনে নাই – উদাস-করুণ সুরে হঠাৎ মন কেমন করিয়া উঠে – মনে হয় বাবা এখনও বসিয়া বাড়িতে সেই কী লিখিতেছে – দিদি আসিতে চাহিয়াও আসিতে পারে নাই। প্রথমে যখন জরির সাজপোশাক পরিয়া টাঙানো ঝাড় ও কড়ির ডুমের আলো-সজ্জার আসরে রাজা-মন্ত্রীর দল আসিতে আরম্ভ করে, অপু মনে মনে ভাবে এমন জিনিস তাহার বাবা দেখিল না! সবাই তো আসরে আসিয়াছে গ্রামের, তাহাদের পাড়ার কোনো লোক তো বাকি নাই! বাবা কেন এখনও …?’

সন্ধ্যায় শুরু হয়ে শেষ রাত্রি অবধি যাত্রা চলেছিল। যে-পালা গাওয়া হয়েছিল, তাতে নিমাই সন্ন্যাসের আবেশ নেই। আছে বাংলার চিরায়ত আখ্যানের অন্যতম আদিকল্প। মৈমনসিং গীতিকাতেও তার অনুবর্তন ঘটেছে। ‘হেথা ভালো মানুষ রইল ভাঙা ঘরে/ মন্দ যেজন সিংহাসনে চড়ে’র আদিসূত্রও এখানে। সেই পালায় বাংলার সঙ্গে কলিঙ্গের ধুন্ধুমার লড়াই হয়, মন্ত্রীমশাইয়ের ষড়যন্ত্রে রাজামশাইকে জায়াপুত্রকন্যা নিয়ে বনে চলে যেতে হয়, খিদের তাড়নায় বিষফল খেয়ে রাজকুমারী ইন্দুলেখা মরে যায়, ছোটোবোনকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে গান গেয়ে ওঠে রাজপুত্র অজয়। সেই গান শুনে অপু ‘আর থাকিতে পারে না, ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদে।’ যাত্রা ভাঙলে ‘পথে আসিতে আসিতে যে যেখানে কথা বলে, তাহার মনে হয় যাত্রার অ্যাকটো হইতেছে।’ পরের দিন ‘ঘাটের পথে যাইতে পাড়ার মেয়েরা কথা বলিতে বলিতে যাইতেছে, অপুর মনে হইল কেহ ধীরাবতী, কেহ কলিঙ্গদেশের মহারানি, কেহ অজয়ের মা বসুমতী।’ দিদি দুর্গার মধ্যে রাজকুমারী ইন্দুলেখার পূর্ণতর রূপ চিনতে চায় অপু।

আরো তিনদিন যাত্রা হয়েছিল। যে-ছেলেটি রাজপুত্র অজয় সেজেছিল তার সঙ্গে খুব ভাব হয়েছিল অপুর। সে অপুদের বাড়ির ছেলে হয়ে উঠেছিল। অজয়ের গান অপুর গলায় উঠে এসেছিল। অধিকারী সেই গান শুনে তারিফ করেছিল। তাকে নীলমণি হাজরার দলে আসতে বলেছিল। আনন্দে ও গর্বে অপুর বুকখানা দশহাত হয়েছিল। মনে হয়েছিল, ‘যাত্রার দলে কাজ করা মনুষ্য জীবনে চরম উদ্দেশ্য, সেকথা এতদিন সে কেন জানিত না, ইহাই তো আশ্চর্যের বিষয়।’

পাঁচদিন বাদে গাওনা শেষ হলে যাত্রার দল নিশ্চিন্দিপুরের পাট চুকিয়েছিল। যাত্রা তবু থেমে থাকেনি। বিংশ অধ্যায়ে বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন কীভাবে একমনে বসে খাতার পাতায় নাটক লেখার মকসো করেছিল অপু। তারপর ফুট কেটেছিলেন, ‘ঘটনা গত বৈশাখ মাসে দেখা যাত্রা পালা হইতে মূলত কোনো অংশেই পৃথক নহে।’

সত্যজিৎ যা করলেন

চিত্রনাট্য লিখতে বসে সত্যজিৎ যে উপন্যাস থেকে অনেকটাই সরে গেছিলেন তা সকলেই জানেন। বিভূতিভূষণ বেঁচে থাকতে থাকতেই সিগনেট প্রেস থেকে পথের পাঁচালীর যে কিশোর সংস্করণ বেরিয়েছিল আম আঁটির ভেঁপু নামে, তাকে রঙে-রেখায় সাজিয়েছিলেন সত্যজিৎ। এর সুবাদে পথের পাঁচালী তো বটেই, সমকালীন বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে এভাবেই পরিচয় ঘটেছিল সত্যজিতের। এই পরিচয় নিবিড় হয়েছিল পথের পাঁচালীর দীর্ঘ প্রস্তুতিপর্বে। লন্ডন থেকে জাহাজে চেপে বোম্বাই ফেরার পথে চিত্রনাট্য লিখবার আগে স্বপ্নে-দেখা ছায়াছবির নীল নকশা তৈরিই ছিল তাঁর কাছে। তাতে যাত্রার ভূমিকা ছিল বলবার মতো।

ওই চিত্রনাট্যেই হরিহর রায়ের সঙ্গে যাত্রার গাঁটছড়া মজবুত করে বেঁধে দিলেন সত্যজিৎ। বিভূতিভূষণ কোথাও লিখে যাননি যে, নিশ্চিন্দিপুর থেকে একেবারে কাশীতে গিয়ে লেখাপড়া করে আসা হরিহর যাত্রার পালা লিখবার চেষ্টা করছিলেন। স্রেফ যজমানি বা গোমস্তাগিরি নয়, লিখে রোজগার করার জন্য আটঘাট বাঁধছিলেন। বাপপিতেমোর পুঁথির পর পুঁথি ভরানোর পরম্পরাকে বজায় রেখে, ‘বংশের ধারা’কে ধরে রেখে লেখাপড়া নিয়ে থাকবার ‘মতলব’ ভাঁজছিলেন। পথের পাঁচালীর সতেরো মিনিটের মাথায় আমরা দেখতে পেলাম হরিহর ‘নতুন নতুন পদ, নতুন নতুন পালা’ লিখছিলেন। সর্বজয়ার সঙ্গে কথায়-কথায় বেরিয়ে এসেছিল সে-কথা। হরিহর আশায় ছিলেন যে, ‘একবার রটে গেলেই এই অধিকারীর দল সব পিল পিল করে ছুটে আসবে! বুঝলে না? তারা তো চাইছে সব নতুন জিনিস। কিন্তু পাবে কোথায়? নতুন জিনিস কি গাছের ফল? দেখলুম তো সব আজকালকার নতুন লিখিয়েদের, সব পুরোনো ভাঙিয়ে খাচ্ছে! সেই থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। আরে সেইসব যদি চলছে তো নিশ্চিন্দিপুরের হরিহর রায়ের নতুন খাঁটি জিনিস চলবে না?’

এভাবেই অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা হয়ে ওঠা যাত্রার সঙ্গে পরম্পরাগত পাণ্ডিত্যের একটা সেতু তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ। বিভূতিভূষণকে পাশ কাটিয়েই এটা করা হয়েছিল। এ-পথে সফল হলে সর্বজয়াকে যে আর পুঁইশাকের চচ্চড়ি রাঁধতে হবে না, এমন আশ্বাসও হরিহর দিয়েছিলেন। অবিশ্যি পুঁইশাকের চচ্চড়ির মতো উপাদেয় পদকে কৌলীন্যের খাতায় খামোখা নিচে নামিয়ে ঠিক করেননি সত্যজিৎ!

ঠাট্টার কথা থাক। আমাদের বুঝতে হবে যে, নিশ্চিন্দিপুর বা নিশ্চিন্দিপুরের মতো সম্পন্ন গ্রামের রোজকার জীবনে যাত্রার জায়গা ঠিক কোনখানে সেটা জানান দেবার জন্য কোমর বেঁধে লেগেছিলেন তিনি। সেই জন্যেই বিভূতিভূষণের ওপর কলম চালাতে বাধেনি তাঁর। যেমন প্রসন্ন গুরুমহাশয়ের মুদির দোকানের দৃশ্য। পুজোর সময় গ্রামে যে গুছিয়ে যাত্রা হবে সেই কথাটা পাড়ার জন্য মোটেই প্রসন্ন গুরুমহাশয়ের দ্বারস্থ হননি বিভূতিভূষণ। বরং উলটোমুখে চলে গুরুমহাশয়ের অপ্রসন্ন মুখে ‘হাসচো কেন খোকা, এটা কি নাট্যশালা?’ জুড়ে দিয়েছিলেন। তাতে যৎকিঞ্চিৎ সন্ত্রস্ত দেখিয়েছিল অপুকে। অন্যদিকে সত্যজিৎ ওই দোকানঘরের মধ্যে খালি পাঠশালা নয়, গাঁয়ের চণ্ডীমণ্ডপের জ্যান্ত আদল গেঁথে দিলেন। সত্যজিতের হাতে গড়া প্রসন্ন গুরুমহাশয়ের ‘নাট্যশালা’ নিয়ে বড়ো একটা আগ্রহ ছিল না। একবার ত্রৈলোক্যতারিণীর দলের কী একটা পালা দেখেছিলেন মনেও করতে পারেন না। কিন্তু পুজোর মরসুমে গ্রামে বাইরে থেকে যাত্রা আনার তোড়জোড় হলে তাঁকে নড়েচড়ে বসতেই হয়েছিল। এ-ব্যাপারে প্রধান উদ্যোক্তা খোদ বৈদ্যনাথ মজুমদার তাঁর পাশে বসে শুনিয়েছিলেন, ‘বুঝলে ভায়া, ওই নবাবগঞ্জের বাবাজিরা বালক-কীর্তনের দল আনচে। মনে করেচে নিশ্চিন্দিপুরকে খুব টেক্কা মেরে যাবে। আরে বাবা, বদ্যি মজুমদারকে চেনে না! এমন যাত্রার দল আনচি যে বাবার জন্মে কেউ কখনও দেকেনি!’

এই ত্রৈলোক্যতারিণীর দলের কথা বিভূতিভূষণ লিখে যাননি। সত্যজিৎ লিখলেন। ভালো মতন খবর নিয়েই লিখলেন। এখন শুনতে অলীক মনে হলেও এটা ঘটনা যে খ্রিষ্টীয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই কলকাতায় মেয়েদের যাত্রাদলের চল হয়েছিল। এইসব দলে নারী চরিত্রে নারীদেরই অভিনয় করতে দেখা যেত। শুধু তাই নয়, এসব দলে মালিক ছিলেন না, ছিলেন মালকিন। মূলত সোনাগাছির গণিকাদের মধ্যে উদ্যোগী কেউ কেউ এ-ধরনের দল চালাতেন। নিমতলা, জোড়াবাগানের মতো সোনাগাছি-লাগোয়া পুরোনো পাড়ায় এ-ধরনের অনেক দল ছিল – রাধাবিনোদিনীর দল, কটাগোলাপীর দল, ভবতারিণীর দল। এদের মধ্যে শোভাবাজার পাড়ার ত্রৈলোক্যতারিণীর দলের হাঁকডাক ছিল বেশি। তাদের নামকরা পালার মধ্যে ছিল বভ্রূবাহন, নলদময়ন্তী, অভিমন্যু বধ, চিত্রাঙ্গদা, অন্নপূর্ণা ইত্যাদি। প্রসন্ন গুরুমহাশয় তাঁর যৌবনে ত্রৈলোক্যতারিণীর দলের দুয়েকটা পালা দেখে থাকবেন এই ইঙ্গিত দিয়ে বৃহত্তর গ্রামসমাজে যাত্রার কদর যে অনেকদিনের সেই সূত্র দিয়ে রেখেছিলেন সত্যজিৎ। পাশাপাশি নিশ্চিন্দিপুর ও সংলগ্ন এলাকায় লোকসংস্কৃতির উদার ভুবনের গুণ গেয়েছিলেন।

যাত্রাকে দুর্গাপুজোর সঙ্গে জুড়ে দেওয়াতে একটু সুবিধেও হয়েছিল সত্যজিতের। কৃত্তিবাসী রামায়ণের সঙ্গে সর্বজয়ার দ্বিপ্রাহরিক সম্বন্ধ তাঁর চিত্রনাট্যে না থাকায় কোন প্রণোদনায় দুর্গার পুতুলের বাক্স থেকে রাংতা সরিয়ে মুকুট আর জাঁদরেল গোঁফ বানাবে বা ক্ল্যারিনেটের সুর কানে রেখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মহড়া দেবে অপু তার পটভূমি রচনা হয়নি। পথের পাঁচালীর একেবারে মাঝবরাবর মাচা বেঁধে শামিয়ানা টাঙিয়ে পৌরাণিক যাত্রাভিনয়ের সংক্ষিপ্ত দৃশ্যায়ন আর বাঁশের বেষ্টনীর বাইরে চাদর-মুড়ি-দেওয়া অপুর অবাক চোখের তারা সেই সুযোগ করে দিয়েছিল।

এর দরকারও ছিল। বিভূতিভূষণের লেখা ১৯২০-এর দশকের মাঝামাঝি শেষ হয়ে গেলেও ১৯৫০-এর দশকের দর্শকের কথা ভেবে পথের পাঁচালীকে খানিক একেলে করে নেবার তাগিদ থাকবে সত্যজিতের। উপন্যাসে নিশ্চিন্দিপুরের ব্যক্তিজীবনের কথা যেমন আছে, তেমনই আছে সামুদায়িক জীবনের পাঁচালী। আর পাঁচালী ও যাত্রা তো সহোদর। লোকজীবনের সহজিয়া সুরকে সেলুলয়েডে তরজমা করে নেবার জন্য যাত্রার চেয়ে সুলভ উপচার সত্যজিতের নাগালে ছিল না। আউটডোরের জন্য হরেকরকম কারিকুরি করতেই হতো ফিল্ম ইউনিটকে। একটা যাত্রাপালার খানিকটা  শুট করে মূল ছবির ছবির মধ্যে জুড়ে দেওয়া এমন কিছু শক্ত কাজ ছিল না। সেই সময়টা চিৎপুরের যাত্রাপাড়ার রমরমার সময় না হলেও নতুন করে গড়েপিটে নেবার সময়। দেশভাগের পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা উশুল করতে শুরু করেছে অপেরা পার্টি-মার্কা লাগানো সব কোম্পানি। পশ্চিমবঙ্গ-পূর্ব পাকিস্তানের সীমারেখা বরাবর যাত্রামোদী মানুষের উপনিবেশ গড়ে উঠছে। সুলভে মিলছে কলাকুশলী। কেউ কয়েক পুরুষের বৃত্তি নিয়ে এদেশে এসেছেন। কেউ পেটের টানে যাত্রাপাড়ায় আনাগোনা করছেন। নানান গতের যাত্রা দল তৈরি হচ্ছে। পথের পাঁচালীর ওপেনিং টাইটেলে যাত্রার দলের নাম লেখা আছে – নিউ বাণী অপেরা পার্টি। দল হিসেবে নামজাদা নয়। নামের মধ্যে ‘অপেরা’ ও ‘পার্টি’র সহাবস্থান দেখে মনে হয় চিৎপুরের দল নয়, হলেও বেশ পুরোনো। কারণ ততদিনে ‘পার্টি’ কথাটা বড়ো একটা ব্যবহার হতো না। তাছাড়া ‘অপেরা’র পাশাপাশি ‘কোম্পানি’ কথাটাও ব্যবসায়িক যাত্রাদলের নামের পাশে জুড়ে গেছে। তবে ঠিক কোথা থেকে এই যাত্রার দলকে টেনে এনেছিলেন পথের পাঁচালীর প্রোডাকশন ম্যানেজার অনিল চৌধুরী তা নিয়ে কোনো লেখালেখি আমাদের চোখে পড়েনি। অবিশ্যি পৌরাণিক পালায় সিদ্ধহস্ত কোনো কোম্পানিকে বায়না করে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করানো সেকালে এমন কিছু কঠিন কাজ ছিল না। বস্তুত বোড়ালের মতো সমৃদ্ধ গ্রামে এমনসব অপেরা পার্টির আনাগোনা লেগেই ছিল।

কী পালা উঠল সেলুলয়েডে? কোনো বৈষ্ণব রসাশ্রিত পালা নয়। উপন্যাসের অনুসরণ করে বাংলার নাড়িছেঁড়া কোনো আখ্যানও নয়। কোনো বিখ্যাত পালা তো নয়ই। সাধারণ এক পৌরাণিক পালা। প্রাক-১৯৪৭ পর্বের বাংলার যাত্রার অভিমুখ ছিল ভক্তিমূলক ও পৌরাণিক পালার দিকে। বাঙ্গালীর মতো পালা সাড়া জাগালেও ঐতিহাসিক পালা তখনো দানা বাঁধেনি। তার জায়গায় পৌরাণিক পালাই অপুর শিশুসত্তার ভেতরকার বাঁক বদলগুলোকে দেখানোর জন্য প্রশস্ত ছিল।

উত্তর রামায়ণে আছে কুশের সঙ্গে নাগ রাজকন্যা কুমুদবতী ওরফে সুজাতার বিয়ের গল্প। সেই গল্পকে আকর করে নাগেদের সঙ্গে ইক্ষ¦াকু বংশীয়দের হিংসা-প্রতিহিংসার পালা ফাঁদা হয়েছিল। কুশের মুখে কৌলীন্যের অহংকার, নাগাধিরাজের নিম্নবর্গীয় অস্মিতা, নাগরাজকুমারী সুজাতার সম্ভাব্য বৈধব্য ইত্যাদিকে ছাপিয়ে উঠে এসেছিল নাগ রাজপুত্র মহাকালের প্রতিশোধস্পৃহা। ‘মনে পড়ে লবানুজ কুশ, যুদ্ধক্ষেত্রে করেছিনু পণ, পদাঘাতে চূর্ণিব মস্তক? আজি তার মিলেছে সুযোগ’ বলে খোলা তলোয়ার হাতে কুশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি। দ্বৈরথের মধ্যে শেষ হয়েছিল দু-মিনিট ৩৭ সেকেন্ডের দৃশ্যায়ন।

কেমন ছিল তার পটভূমি? সন্ধ্যার পর পেট্রোম্যাক্স জ্বেলে অভিনয় হয়েছে পারম্পরিক ঢঙে। প্রবেশ-প্রস্থান হয়েছে দু-পথ দিয়ে। যথারীতি বেজেছে নেপথ্য সংগীত। ক্ল্যারিনেটের নেতৃত্ব মেনেছে ঢোল কিংবা বাঁশি। ক্ষণে ক্ষণে শোনা গেছে প্রম্পটারের গলা। বোঝা গেছে কুমুদবতীর ভূমিকায় পুরুষ অভিনেতাই প্রকট হয়েছেন। মিচেল ক্যামেরা হাতে কখনো লং শটে, কখনো ক্লোজ শটে, মূলত মিড-ক্লোজ শটে কুশীলবদের অভিব্যক্তি ধরেছেন সুব্রত মৈত্র। দুলাল দত্তের সম্পাদনাগুণে যাত্রাভিনয়ের পাশাপাশি দেখা গেছে অপুর বাক্সময় মুখমণ্ডল। অপুর আশেপাশে বসে থাকা দর্শকদের আবছা দেখা গেছে।

সংক্ষিপ্ত এই দৃশ্যায়নের পরেই আবার হরিহর রায়ের ভিটেয় ফিরে গেছে ক্যামেরা।

বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, অপুর মনোজগতের সঙ্গে তার কার্যপরম্পরার বাঁধন আরো মজবুত করার জন্যই যাত্রাকে কাজে লাগিয়েছিলেন সত্যজিৎ। গ্রামীণ কৌম জীবনের সঙ্গে আরো গভীর আত্মীয়তায় বাঁধতে চেয়েছিলেন। প্রথমে কলাভবনে গিয়ে ও পরে জাঁ রেনোয়ার শিক্ষানবিশি করতে করতে বাংলার গ্রামজীবনকে কাছাকাছি দেখে তাকে মর্যাদা দিতে শিখেছিলেন সত্যজিৎ। যে-সচল বাস্তবতার পটে বোনা হয়েছিল পথের পাঁচালীর নকশিকাঁথা তাতে যাত্রা বাদ পড়ে কী করে! পড়েওনি। মনে করে দেখুন, পথের পাঁচালীর ফিল্ম বুকলেটে অপুর যে-ছবি বেরিয়েছিল তাতে বালকের মাথা জুড়ে ছিল রাংতার মুকুট – তাঁর যাত্রাপথের পাঁচালীর অভিজ্ঞান। কোন দর্শনবিপর্যয়ে তা এতকাল নজরবন্দি হয়নি কে জানে! সত্যজিতের ছায়াছবির অন্তরঙ্গ পাঠ এমন আরো কত বিস্ময়ের ডালি সাজিয়ে রেখেছে। আমরা যেন যত্ন করে সেসবের হদিস রাখি। নইলে হারানো বাংলার হদিস একেবারেই অধরা হয়ে যাবে আমাদের কাছে।