‘আমরা ইতিহাস চর্চা করি বর্তমানকে বুঝে ভবিষ্যৎকে বিনির্মাণের জন্য’ – সম্ভবত এ-বিষয়ে সবাই একমত পোষণ করি। এ-কারণে জ্ঞানের সব শাখাতেই বহুল পরিচিত, স্বল্পপরিচিত, অপরিচিতদের একনিষ্ঠ কর্ম ও কর্মপদ্ধতি একটি সমাজের অবশ্যপাঠ্য হিসেবে গণ্য। চারুশিল্পকলার ক্ষেত্র এর চেয়ে কোনো অংশে ব্যতিক্রম নয়। পুঁজিতন্ত্রের উচ্চতম বিকাশে সমাজ এখন নানা ধরনের জটিল গতিপ্রকৃতিতে চলমান। দৃশ্যশিল্পকলায় এ-দেশের ক্রমযাত্রাপথের এমন এক সময়ে আমরা দাঁড়িয়ে, যেখানে বিবিধ বিচিত্র উপায় ও উপকরণ চর্চাকে অগ্রাহ্য করে এগোনোর কোনো উপায় নেই। কোনটা শিল্প, কোনটা শিল্প নয়, কে শিল্পী বা কে নন, কেন নন – সবকিছুই খুব সহজে নির্ণেয় নয়। উপরন্তু বিশ্বায়নের এই যুগে, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায়, জ্ঞানচর্চায় কিংবা ইনফরমেশনের সহজ বহুল প্রাপ্তিতে যে বিচিত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সংশেস্নষণ ঘটছে, সেই যৌগিক স্থান থেকে মৌলিকত্ব খুঁজে বের করাটা সত্যিই শ্রম ও গবেষণাসাপেক্ষ কাজ। এরই ধারাবাহিকতায় শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক (জন্ম : ১৯৩২, শরীয়তপুর, মৃত্যু : ২০০৫, ঢাকা) স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্ম অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকের একজন নিরীক্ষাধর্মী শিল্পী হিসেবে তাঁর কাজ বিশেস্নষণ করা যায়। গ্যালারি চিত্রকে ‘প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক’ শিরোনামের চিত্রপ্রদর্শনীতে (৩১ অক্টোবর-১৫ নভেম্বর পর্যন্ত) প্রদর্শিত ১২০টি কাজ তাঁর পরিবারের সংগ্রহে ছিল এতদিন, যেগুলোর অনেকগুলোই বিক্রির জন্য নয়। আবার নির্বাচিত কিছু শিল্পকর্ম বিক্রি হয়েছে। কাজেই যুক্ত হলো শিল্পীর বাজারমূল্য এবং শিল্পমূল্যের দ্বন্দ্ব। যে দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদে বস্ত্তর গতিশীলতা নির্ধারণ হয়। সম্ভবত এ-প্রক্রিয়ায় ইতিহাসসমেত শিল্পী হিসেবে আবদুর রাজ্জাকেরও পরিচয় ঘটে নতুন প্রজন্মের শিল্পী, শিল্পানুরাগী দর্শক, গবেষক, নব্য পুঁজিপতি শিল্প-সংগ্রাহকদের সঙ্গে।
এ পর্যায়ে আবদুর রাজ্জাকের কাজকে ও তাঁর পারদর্শিকতা সহজবোধ্য করা যায়, যদি জীবনে বেড়ে ওঠার দিকে প্রক্রিয়ায় আলোকপাত করা যায়। আবদুর রাজ্জাক জন্মেছেন শরীয়তপুরে, বাবা সদর আলী আমিন আহসানুল্লাহ প্রকৌশলী। বেড়ে ওঠা ফরিদপুরে। ফরিদপুর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন বিজ্ঞান বিভাগে, ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে। ১৯৪৯ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন। তাঁর সতীর্থ ছিলেন – আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, রশীদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী প্রমুখ। এ ব্যাচের উলিস্নখিত প্রত্যেকেই সুপ্রতিভায় বাংলাদেশের চারুশিল্প-আন্দোলনকে অগ্রসর করেছেন। কিন্তু সে-তুলনায় আবদুর রাজ্জাক যেন অনেকটাই স্বল্পআলোচিত। সম্ভবত কাজপাগল এ-মানুষটি আত্মপ্রচারবিমুখ – বলেন চিত্রক গ্যালারির পরিচালক মুনিরুজ্জামান। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন আবদুর রাজ্জাককে। রাজ্জাক স্যারের সঙ্গে স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ডিসপেস্ন বোর্ডে তিন হাজার একান্নজন জন ছাত্রীর অংশগ্রহণে বই নিয়ে কোরিওগ্রাফির কাজ করেছেন মুনিরুজ্জামান। ‘অসুস্থ হওয়ার পর যেখানেই গিয়েছেন আমি না গেলে স্যারের স্ত্রী স্যারকে যেতে দিতেন না’ – স্মৃতিচারণ করেন তিনি। আবদুর রাজ্জাক পরবর্তী সময়ে নিজ মেধায় আমেরিকার আইওয়া ইউনিভার্সিটিতে প্রিন্ট মেকিংয়ের ওপর মাস্টার্স করেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চোখ যেন মেধাবীদের সহজেই চিনতে পারত। রাজ্জাক দেশে ফিরে এলে ১৯৬৫ সালে ঢাকা চারুকলায় ভাস্কর্য বিভাগ চালু করার দায়িত্ব দেন জয়নুল আবেদিন। এখানে যখন আবদুর রাজ্জাক মনোনিবেশ করলেন, তৈরি করলেন হামিদুজ্জামান খান, শামীম শিকদার, লালারুখ সেলিম প্রমুখ কৃতী ভাস্করশিল্পীকে। পরবর্তী সময়ে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পাওয়ার সম্মান অর্জন করেন। আবদুর রাজ্জাক সম্পর্কে রফিকুন নবী বলেন, ‘ড্রইংয়ে অসাধারণ দক্ষতা ছিল রাজ্জাক স্যারের, ক্লাসে তা দেখাতেন হাতে ধরে। যাকে দেখাতেন, পুরোটাই শেষ করে দেখাতেন।’
আবদুর রাজ্জাকরা যে-সময়ে এদেশে শিল্প চর্চা করেছেন, সে-সময়ে প্রচুর বাস্তবজীবনের ছবি অাঁকার চর্চা হতো। নিসর্গ, মডেল নিয়ে অনুশীলন এবং একই সঙ্গে ইউরোপীয় বিমূর্তবাদের চর্চা। আবদুর রাজ্জাক সব ধরনের রীতিতে অনুশীলনের মাধ্যমে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন। জলরং যখন করেছেন, জলরঙের ব্যাকরণ মেনেছেন। কখনো ব্যাকরণ ভেঙেছেন নতুন কিছু সৃষ্টির তাগিদে। অ্যাক্রিলিক, তেলরং, ছাপচিত্র, ভাস্কর্য সব মাধ্যমে নিরীক্ষাধর্মী কাজ করেছেন। রিয়ালিজমের চর্চার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে একনিষ্ঠতায় এগিয়েছেন ফর্মে সরলীকরণের দিকে। একটা ধারাবাহিকতার প্রমাণ মেলে প্রদর্শনীর কাজগুলোর বৈচিত্র্যে।
তদানীন্তন আর্ট কলেজের প্রথম মাস্টার্স করা শিক্ষক হিসেবে তিনি ভাস্কর্য বিভাগটিকে এগিয়ে নেওয়ায় যে শ্রম-সাধনা ব্যয় করেছেন তা বাস্তবিকই কঠিন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মতো। কারণ বাংলাদেশে ভাস্কর্যকে মূর্তি হিসেবে দেখার মুসলমান সমাজে নেতিবাচক যে-দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান, সেটি খুব স্পর্শকাতর এবং গোঁড়া মৌলবাদিতার সঙ্গে সম্পর্কিত। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে তাই হয়তোবা তিনি সচেতনভাবেই খুব বাস্তবানুগ ফিগারেটিভ কাজ করেননি। প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া ভাস্কর্যগুলোও মূলত নানা ফর্ম বা আকৃতির সমন্বয় অর্থাৎ কম্পোজিশন। ‘প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের করা গাজীপুর চৌরাস্তায় ১৮ ফুট উচ্চতা ও ২৪ ফুট প্রস্থের ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ মনুমেন্টাল ভাস্কর্যটি যতদিন থাকবে, ততদিন বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিও সমুজ্জ্বল থাকবেন’ বলে মনে করেন প্রদর্শনীর আরেকজন আয়োজক এবং শিল্পী মোহাম্মদ জহির উদ্দিন।
পঞ্চাশের দশকের শিল্পীদের কাজে গ্রামবাংলা, নদী, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বারবার অনুশীলন হয়েছে। আবদুর রাজ্জাকও এর ব্যতিক্রম নন। বর্তমান সময়ের মেট্রোপলিটন শহরে বেড়ে ওঠা নানা প্রবণতামুখী শিল্পীদের সঙ্গে সে-সময়ের এক বড় পার্থক্য যেন এটিই। গ্রামে কিংবা মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা মানুষ যেন বারবার ফিরে যান তাঁর বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতায়। শিল্পীর কাজ তো জীবন সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতারই কথন। সুতরাং এই নদী-প্রকৃতি জীবন বিষয় চর্চার মধ্য দিয়ে তৎকালীন বাংলাদেশের ইতিহাস ও ক্রমবিবর্তন লিপিবদ্ধ হয়। কিন্তু এরই বৈপরীত্যে এ-দেশে শুরু হওয়া বিমূর্ত প্রকাশবাদের চর্চাকে গুরুত্ব সহকারে পাঠ করতে হয়। সে-সময়ের অন্য অগ্রজ শিল্পীদের মতো আমেরিকায় পড়তে যাওয়া আবদুর রাজ্জাকের মননে ও চর্চায় ধরা পড়ে এ-ধারার কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার ঘটনা। সে-সময়ে মার্ক রথকো, জ্যাকসন পোলক, উইলিয়াম ডি কুনিং, আরসাইল গোর্কি প্রমুখের কাজে রং, সারফেস, টেক্সচারের যে-পরিমিতিবোধের সঙ্গে স্বাধীনতার সংমিশ্রণ তা নতুন দ্বার উন্মোচন করে আমাদের দেশের শিল্পীদের সামনে। ‘বিমূর্ততার চর্চা না করতে পারলে যেন নিজেকে পিছিয়ে পড়া অনাধুনিক মনে হতো’ – মুর্তজা বশীর কোনো এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছিলেন বলে মনে পড়ে। তবে সম্ভবত মুসলিম অধ্যুষিত দেশ বলে বাস্তবধর্মী ফিগারেটিভ কাজের চেয়ে বিমূর্ত প্রকাশবাদ বেশ সফলভাবে আমাদের দৃশ্যশিল্পকলার অঞ্চলে সমাদৃত হয়ে উঠেছে। আবদুর রাজ্জাকের রং-রেখার ব্যাকরণসমৃদ্ধ ভাষা তাই এ-ক্ষেত্রকে যেন আরেকটি মাত্রা প্রদান করেছে। আবদুর রাজ্জাক সম্পর্কে জানা যায়, তিনি মৃদুভাষী, ধীরস্থির, বিনয়ী, সুবেশী, প্রচারবিমুখ কিন্তু ছাত্রদের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, শিল্পের প্রতি অকৃত্রিম প্রেম ছিল।
তিনি ছাপচিত্র মাধ্যমে যে-মুন্শিয়ানা অর্জন করেছিলেন, সেটি প্রত্যক্ষ হয় উডকাট, এচিং ও লিথোগ্রাফিগুলোতে। প্রতিটি ছাপচিত্র মাধ্যমের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে, প্রিন্টের নিয়ম মেনে সুনিপুণ কর্মের শিল্প হয়ে-ওঠা দৃশ্যমান। মুনিরুজ্জামান আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্মরণ করেন। ‘রাজ্জাক স্যার সে-সময়ে দেশের পক্ষের অধিকাংশ আন্দোলন, যেগুলোতে অন্য শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেছেন, সবসময় থাকতেন।’ যদিও এই প্রদর্শনীর কোনো কাজে দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে অাঁকা কোনো ছবি নেই। আবার, এটা অপরিহার্যও নয় যে, জাতীয় আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নেওয়া মানে চিত্রাঙ্কনের বিষয় সেগুলোও হতে হবে।
আবদুর রাজ্জাকের নানামুখী শিল্পচর্চার প্রবণতা তাঁকে ভবিষ্যতে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে। কারণ গুণীর মর্যাদা দিতে জানা একটি জাতির জন্য প্রগতিশীলতার পরিচায়ক। তাঁকে পাঠের জন্য আরো গবেষণা প্রয়োজন। r
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.