প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন ও প্রদোষে প্রাকৃতজন

রাজীব সরকার

বাংলার প্রাকৃতজন প্রধানত কৃষক। আবহমানকাল ধরে কৃষি এ-অঞ্চলে জীবিকার প্রধান অবলম্বন। এর বাইরে কুম্ভকার, তাঁতি, মাঝি, চন্ডাল, ডোম – বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করেছে সমাজের দলিত ও অন্ত্যজ শ্রেণিভুক্ত প্রাকৃতজন। চিরায়ত বাংলার প্রাকৃতজনের দর্শনচিন্তার প্রথম লিখিত রূপ দোহাকোষ ও চর্যাপদ। দোহা ও চর্যা-রচয়িতাদের প্রায় সবাই ছিলেন সমাজের নিচুতলার মানুষ। সরহপাদ, চাটিলপাদ, কঙ্কনপাদ, দারিকপাদ, ডোম্বীপাদ, তন্ত্রীপাদ, তাড়কপাদ – এঁরা সবাই সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এই রচয়িতাগণ তাঁদের রচনায় যে-মতবাদ প্রচার করেছেন, তা একান্তভাবে লৌকিক যা ব্রাহ্মণ্য মতবাদ ও একদা রাজানুকূল্যপ্রাপ্ত সংস্কৃত বৌদ্ধ মতবাদ উভয় দর্শন থেকে পৃথক। তাঁদের চিন্তা বস্ত্তবাদী লোকায়ত দর্শনেরই অন্তঃসার, যা একান্তভাবে দেহাত্মবাদী। ব্রাহ্মণ্যবাদী দর্শনের মতো পরমার্থবাদী দর্শন মানুষের মধ্যে তৈরি করেছিল কৃত্রিম বর্ণভেদ। এই বর্ণভেদকে টিকিয়ে রাখতে যাবতীয় কুপ্রথা ও অমানবিক আচরণ প্রয়োগ করেছে কর্তৃত্বশীল ব্রাহ্মণ্যবাদ। দোহা রচয়িতাগণ এই অমানবিকতার প্রাচীর ভাঙতে চেয়েছেন। অলৌকিক পরমার্থকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বস্ত্তবাদী ও যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্রকার-প্রবর্তিত জাতিভেদ ও আচারসর্বস্ব অমানবিক ধর্মীয় কুপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশ করেছেন অন্যতম দোহা-রচয়িতা সরহপাদ। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বৌদ্ধগান ও দোহা সংকলনে এর অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রচারকদের উদ্দেশে সরহপাদ বলেছেন –

ব্রাহ্মণ ব্রহ্মার মুখ হইতে হইয়াছিল, যখন হইয়াছিল, তখন হইয়াছিল, এখন তা অন্যেও যেরূপে হয়, ব্রাহ্মণও সেইরূপেই হয়, তবে আর ব্রাহ্মণত্ব রহিল কি করিয়া? যদি বল, সংস্কারে ব্রাহ্মণ হয়, চন্ডালকে সংস্কার দাও, সে ব্রাহ্মণ হোক; যদি বল, বেদ পড়িলে ব্রাহ্মণ হয়, তারাও পড়ুক। আর তারা পড়েও ত, ব্যাকরণের মধ্যে ত বেদের শব্দ আছে। আর আগুনে ঘি দিলে যদি মুক্ত হয়, তাহা হইলে অন্য লোক দিক না। হোম করিলে মুক্তি যত হোক না কেন, ধোঁয়ায় চক্ষের পীড়া হয়, এই মাত্র। তাহারা ব্রহ্মজ্ঞান ব্রহ্মজ্ঞান বলে। প্রথমত তাহাদের অথর্ববেদের সত্তাই নাই, আর অন্য তিন বেদের পাঠও সিদ্ধ নহে, সুতরাং বেদেরই প্রামাণ্য নাই। বেদ ত আর পরমার্থ নয়, বেদ ত আর শূন্য শিক্ষা দেয় না, বেদ কেবল বাজে কথা বলে।

বেদ তথা ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী এমন বক্তব্য সমাজের অভিজাত, উচ্চবর্গীয়দের প্রচারিত নীতি-আদর্শের বিরুদ্ধে প্রবল দ্রোহের পরিচায়ক। এই দ্রোহের মধ্যেই লুক্কায়িত বাংলার প্রাকৃতজনের দর্শন। বস্ত্তবাদী বলেই এই দর্শন ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে যুগান্তকারী প্রশ্ন উত্থাপনের সাহস প্রদর্শন করে –

কিন্তু যখন কোনো পদার্থই নাই, যখন বস্ত্তই বস্ত্ত নয়, তখন ঈশ্বরও ত বস্ত্ত, তিনি কেমন করিয়া থাকেন। ব্যাপকের অভাবে ত ব্যাপ্য থাকিতে পারে না। বলিবে, কর্তা বলিয়া ঈশ্বর আছেন, যখন বস্ত্তই নাই, তখন ঈশ্বর কি করিলেন?

এই দর্শনের রচয়িতাগণ শ্রমজীবী, সমাজের প্রান্তশায়ী মানুষ। প্রান্তে থাকে বলেই সমাজের অন্যায়-অবিচার তাদের গায়ে লাগে। তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় একটি পরিচিত চর্যাপদে – ‘যে বোঝে সে নির্বোধ, যে চোর সেই সাধু। প্রতিদিন শিয়াল যুদ্ধ করে সিংহের সাথে।’

প্রাকৃতজনের এমন বলিষ্ঠ জীবনদর্শনের অগ্রযাত্রার পথটি মোটেও মসৃণ ছিল না। কর্তৃত্বশীল শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু শাসক চরিত্রের পরিবর্তন হয়নি। প্রাকৃতজন তাই নিপীড়নের মুখোমুখি হয়েছে বারবার। দুর্বিষহ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা নিজেদের প্রাকৃত সত্তা তথা শ্রেণিগত বিচার-বিবেককে বিসর্জন দেয়নি। প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন বইয়ে যতীন সরকারের  পর্যবেক্ষণ –

দশম শতকের পর বাংলার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকরা। সে সময় তারা অবশ্যই নানাভাবে প্রাকৃতজনের ইহলৌকিক দর্শনের উপর আঘাত হেনেছে, ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাবধারার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। এরপর মুসলিম শাসন আমলে নিশ্চয়ই ইসলামী ভাবধারার প্রসার ঘটেছে। তবু, ব্রাহ্মণ্যবাদী ও ইসলামী শক্তির অধীন হয়েই যে এ দেশের প্রাকৃতজনকে তাদের নিজস্ব ভাবাদর্শ ও দর্শন পরিত্যাগ করতে হয়েছে তা নয়। কারণ, প্রাক-আধুনিক যুগে এ দেশে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীরাই শক্তিমান হয়ে উঠতে পারেনি। গ্রামকেন্দ্রিক কৃষিভিত্তিক জীবন ছিল যে জনসাধারণের, তাদের সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তির সম্পর্ক মোটেই শক্ত ও গভীর ছিল না। রাজা-রাজড়াদের সঙ্গে প্রজাদের সংযোগ ছিল কেবলমাত্র রাজস্ব আদান-প্রদানের সূত্রে। অন্যসব বিষয়ে গ্রামীণ সমাজের জনগণ ছিল একান্তভাবেই স্বাধীন।

প্রাকৃতজনের বিচিত্রমুখী অথচ স্বাধীন সত্তা বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিকাশ লাভ করেছে। এক অপরাজেয় মনোভাব বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে তাঁদের জীবনদর্শনে। প্রায় আটশো বছর আগে প্রাকৃতজনের জীবনদর্শনের এক অনবদ্য দলিল শক্তিমান কথাশিল্পী শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসটি। এ-উপন্যাসের অন্যতম বিশেষত্ব এই যে, বাংলা সাহিত্যে এর কোনো পূর্বসূরি নেই। প্রকরণ ও অভিনবত্ব – উভয় বিচারে প্রদোষে প্রাকৃতজন আমাদের কথাসাহিত্যে অনন্য সংযোজন।

এ-উপন্যাসে শওকত আলী বাংলাদেশের সমাজবিন্যাস, শ্রেণিসংগঠন ও শ্রেণিসংগ্রামের দ্বন্দ্বমুখর প্রকৃতিকে ঐতিহাসিক ও সমাজবিশ্লেষকের দৃষ্টিতে উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসের কালপরিধি দ্বাদশ শতাব্দীর অবসান থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর ঊষালগ্ন পর্যন্ত ব্যাপৃত। মহামতি অতীশ দীপঙ্করের নির্বাণ লাভের একশ বছর পর, কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ রচনাকালে, লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বের অন্তিমপর্বে এই উপন্যাসের পটভূমি স্থাপিত। সামন্ত শাসনের নগ্নরূপ, প্রাকৃতজনের প্রতিরোধ সংগ্রাম এবং বঙ্গদেশে তুর্কি আক্রমণের পূর্বাভাস – এই ত্রিবেণীসংগমে মিলিত হয়েছে উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। গৌড়ের রাজধানীকেন্দ্রিক উত্তরবঙ্গের ব্রাত্য ও শূদ্রদের ওপর পৌনঃপুনিক নির্যাতন ইতিহাসের ‘মাৎস্যন্যায়’ পর্বকে জীবন্ত করে তুলেছে। উপন্যাসের নায়ক শ্যামাঙ্গ পরিব্রাজকের ভূমিকায় বহুতলবিশিষ্ট জীবনের নানা মাত্রিকতা আবিষ্কার করে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জনপদে ঘুরতে ঘুরতে বৈচিত্র্যের মধ্যেও সে ঐক্যের সন্ধান পায় –

পুনর্ভবা, আত্রেয়ী, করতোয়ার উভয় তীরের বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগের জনপদগুলির তখন প্রায় এরূপই অবস্থা। গৌড়বঙ্গের রাজধানী লক্ষ্মণাবর্তীতে মহামহিম পরম ভট্টারক শ্রী লক্ষ্মণ সেন দেব সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। রাজসভায় উমাপতি, ধোয়ী এবং জয়দেবের কাব্যগীতির সুললিত মূর্ছনায় সভাস্থল বিমুগ্ধ। জয়দেবের কৃষ্ণলীলার বর্ণনা শ্রবণে সভাসদবর্গ তুরীয়ানন্দে বিহবল, ধোয়ীর পবনদূতের বর্ণনায় কামকলানিপুণা রমণীকুলে উল্লেখে শ্রোতৃবর্গ অহো অহো উল্লসিত স্বর উচ্চারণ করে উঠছেন। স্মার্ত পন্ডিতের ভাগবত বিশ্লেষণে মুহুর্মুহু প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সাধু সাধু রব। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সন্দেহ করা হচ্ছে, যবন কেন্দ্রগুলিতে কেন তাদের যাতায়াত, গূঢ় পুরুষেরা বিচিত্র সংবাদ আনছে। তথাপি প্রজাকুল সুখী। ব্রাহ্মণ সুখী, কায়স্থ সুখী, বৈশ্য সুখী। কেবল ব্রাত্য শূদ্রদের গৃহে অন্ন নেই, দেহে বস্ত্র নেই, মস্তকোপরি গৃহের আচ্ছাদন থাকে না। আজ যদি গ্রামপতি বসবাসের স্থান দিলেন, তো কালই বললেন, দূর হ, দূর হ, পামরের দল।

বর্বর রাষ্ট্রতান্ত্রিক শোষণের মধ্যেও আত্রেয়ীতীরের মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ সুন্দরের সাধনায় মগ্ন। শৈল্পিক সুষমার সঙ্গে বর্বর রাজতন্ত্রের বিরোধ চিরন্তন। তাই শ্যামাঙ্গের শিল্পসাধনাও প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়। বিল্বগ্রামের সামন্তপতি সুধী মিত্রের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত মন্দিরের গায়ে মৃৎফলকের কারুশৈলী গড়তে গিয়ে গুরু বসুদেবের নির্দেশ অমান্য করে শ্যামাঙ্গ। শাস্ত্রাচারবিরোধী স্বাধীনতা-স্পৃহা শ্যামাঙ্গের শিল্পীমানসকে গঠন করেছিল। মৃৎফলকে প্রচলিত পৌরাণিক দেব-দেবীর আখ্যান নয়, লোকায়ত প্রাকৃত জীবনের প্রতিফলন ঘটানোর প্রতিই আগ্রহী ছিল সে। ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতাপের যুগে ব্যাধ-তরুণীর প্রণয়দৃশ্য কিংবা ধীবর-রমণীর দেহসৌষ্ঠব অঙ্কন নিঃসনেদহে দুঃসাহসের পরিচয়। শ্যামাঙ্গের শিল্পিত স্পর্ধার উৎস তাঁর স্বাধীনচেতা শিল্পীমনা গুরু বসুদেবের তীব্র ধিক্কারেও বিচলিত নয় শ্যামাঙ্গ। তার প্রশ্ন –

শিল্পী কি ক্রীতদাস? রাজানুগ্রহ ব্যতিরেকে কি শিল্পীর অস্তিত্ব নেই? ধীমান বীটপাল কি রাজাদেশের দাস ছিলেন? প্রথা এবং অনুশাসন ছিন্ন করেন যে শিল্পী তিনি কি ক্রীতদাস হতে পারেন?

গুরু বসুদেব শিষ্য শ্যামাঙ্গকে পরিত্যাগ করেন। তাতে দমে যায় না শ্যামাঙ্গ। শিল্পীর অহংকারে সে গুরুকে জানিয়ে দেয় যে, গুরু ও গুরু-প্রদত্ত শিক্ষা উভয়কে পরিত্যাগ করেছে সে। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস ও তীব্র দ্রোহ শ্যামাঙ্গের শিল্পীসত্তাকে স্ফুলিঙ্গের মতো প্রজ্বালিত করে। শিল্প-সাধনায় তার আপসহীন যাত্রায় কোনো সঙ্গী পায় না শ্যামাঙ্গ। স্বাধীনচেতা শিল্পী শ্যামাঙ্গকে অাঁকড়ে ধরে নিঃসঙ্গতা, কিন্তু কোনো দুর্বলতা তাকে গ্রাস করতে পারে না।

শ্যামাঙ্গের নিঃসঙ্গ পদযাত্রা তাকে বিচিত্র অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। উপন্যাসে বিভিন্ন গ্রামের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা ঘুরেফিরে এসেছে। সেই জীবনযাত্রার অন্যতম অনুষঙ্গ প্রাকৃতজনের অন্তহীন উৎকণ্ঠা। সামন্তপতিদের অমানবিক নিপীড়ন এবং যবন তুর্কিদের ত্রাসসঞ্চারী অশ্বখুরধ্বনি তাদেরকে শঙ্কার ঘূর্ণাবর্তে নিক্ষেপ করে। সামন্ত-নৃপতিদের পাশবিক বর্বরতার এক মর্মন্তুদ চিত্র অঙ্কিত হয় পিপলীহাট গ্রামে। সামন্ত হরি সেনের অনুচর বজ্র সেন বিভিন্ন হাট থেকে অন্যায়ভাবে কর আদায় শুরু করে মন্দির নির্মাণের ‘মহৎ’ উদ্দেশ্যে। একপর্যায়ে পিপলীহাটে জেঁকে বসা ডোম সম্প্রদায়ের কয়েকজন নারীর সঙ্গে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয় বজ্র সেন ও তার সঙ্গীরা। ডোমনিদের সঙ্গে অশালীন আচরণের প্রতিবাদ করায় বৌদ্ধভিক্ষু চেতনানন্দকে তরবারি দিয়ে আঘাত করে। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে ডোমনিদের নেত্রী কুসুম ও তার সহচরীরা। বজ্রসেন ও তার সঙ্গীদের দেহ ছিন্নভিন্ন করে দেয় কুসুম ডোমনির দল। ডোমনিদের এই তীব্র প্রতিরোধ টনক নাড়িয়ে দেয় সামন্ত হরি সেনের। ব্রাত্য রমণীর এই দাবানলের মতো জ্বলে ওঠা প্রাকৃতজনের সংগ্রামমুখর জীবনেরই ধারাবাহিকতা। প্রাকৃতজনের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য সামন্ত হরি সেন যে অমানুষিক বীভৎসতার পরিচয় দেয়, মানব ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। কুসুম ডোমনির দুই শিশুপুত্রকে দ্বিখন্ডিত করা হয়। দুই শতাধিক সশস্ত্র যোদ্ধা দিয়ে ধরে আনা হয় কুসুম ডোমনিকে। প্রকাশ্য দিবালোকে অগণিত মানুষের সামনে –

কুসুম ডোমনিকে ধরে এনে সর্বসমক্ষে দাঁড় করানো হলো এবং ঘোষণা করা হলো – এই স্বৈরিণী সকল বিরোধের মূল, দেহের যে অংশের কারণে এই স্বৈরিণী পুরুষ সমাজে বিরোধ এবং লোভের বীজ বপন করে, শরীরের যে অংশ যথার্থই নরকের দ্বার, সেই অংশটি আমরা প্রজ্বলিত করে দেবো।

ঘোষণাটি সামন্ত হরি সেনের। ঘোষক কেবল বাক্যগুলি সত্যিকার উচ্চারণ ক’রে গেল। এবং তারপর সর্বসমক্ষে কুসুমকে নির্বস্ত্রা করে তার যোনিদেশে একটি উত্তপ্ত লৌহদন্ড প্রবেশ করিয়ে দেয়া হলো।

এমন নিষ্ঠুর পাশবিকতার মর্মান্তিক খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে। তটস্থ হয়ে যায় অন্ত্যজ শ্রেণির অসহায় মানুষ। এরপরও তারা নির্লিপ্ত থাকে না। এই অন্যায়ের প্রতিকার কীভাবে হতে পারে তা নিয়ে উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্ক হয় প্রাকৃতজনের মধ্যেই। সেখানেও তাদের গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। বসন্ত দাস এই কাহিনির অন্যতম স্মরণীয় চরিত্র। প্রাকৃত শ্রেণির জনগোষ্ঠী তার নেতৃত্বেই সমবেত হয় সামন্ত সেন রাজত্বের বিপক্ষে। উত্তেজিত জনতার কেউ কেউ যবন জাতিকে স্বাগত জানাতে প্রস্ত্তত। নিপীড়িত স্বধর্মী বৌদ্ধদের কণ্ঠেও একই সুর। কিন্তু এত সহজ সমাধানে আস্থা রাখতে পারে না বসন্ত। তাই –

মিত্রানন্দের লোকদের সঙ্গে তাকে দীর্ঘ আলাপে বসতে হচ্ছে। বোঝাতে হচ্ছে যবন জাতি বহিরাগত – তারা এলে তুমি আমি কেউ থাকবো না। আর জেনো, তারা শুধু রাজ্য জয়ই করছে না – ধর্মকে পর্যন্ত জয় করে নিচ্ছে। এ বড় চিন্তার কথা – এমতাবস্থায় আমাদের চিন্তা করা উচিত, আমরা কী করবো। এক সন্ত্রাসের হাত থেকে নিষৃকতি পাওয়ার জন্য যদি আমরা আরেক সন্ত্রাসের মধ্যে নিপতিত হই, তাহলে সেটা কোনো কাজের কথা নয়।

বসন্ত দাসের যুক্তি খন্ডন করতে পারে না ভিক্ষু মিত্রানন্দ ও নিরঞ্জন। হলায়ুধ মিশ্র ও সোমজিৎ উপাধ্যায়ের মতো বাকচতুর পন্ডিত রাষ্ট্রিক লাভালাভ বিশ্লেষণে ব্যস্ত। স্বধর্মী ভিক্ষু আর রাজশক্তির সন্ধি প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হওয়ার পথে। অথচ প্রাকৃতজন প্রতিবাদে সংঘবদ্ধ হয়েছে তাদের অন্তর্নিহিত শক্তির বলে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, এ-অঞ্চলে ইসলাম জনপ্রিয়তা পায় সুফি-দরবেশদের মানবতাবাদী প্রচারের গুণে। এরই সুফল ভোগ করে পরবর্তী সময়ে তুর্কি যবনেরা। এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট। প্রথমটি শান্তি ও প্রেমধর্মে বিশ্বাসী। দ্বিতীয়টি হিংস্রতা ও আক্রমণের অনুসারী। প্রাকৃতজনের আলোচনায় উপস্থিত দরবেশ তাই সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলে যে, তুর্কি যবনরা বর্বর এবং ধর্মজ্ঞান কোনো কিছুতে তাদের শ্রদ্ধা নেই। তাদের ডেকে আনা আর আত্মঘাতী হওয়া একই কথা। যবন তথা মুসলমানদের আগমন ভয়ংকর হবে জেনেও রাজশক্তি ও বৌদ্ধভিক্ষুরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি পারস্পরিক অনাস্থা ও ধর্মীয় কপটতার কারণে। রাজশক্তি নিশ্চিন্ত থেকেছে এই ভেবে যে, যবনরা এলেও ‘নীচ যে, সে সর্ব অবস্থায় নীচই থাকবে’ আর মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হবে শোষক শ্রেণি, ধর্ম তাদের যা-ই হোক। কারণ শোষণই তাদের প্রকৃত ধর্ম। এই রূঢ় বাস্তবতার পুনরাবৃত্তি বারবার ঘটেছে বাংলার ইতিহাসে। শাসকের নাম পরিবর্তিত হয়, তাদের শ্রেণি পরিবর্তিত হয় না। শোষিত বরাবরের মতো শোষিতই থেকে যায়। তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে না। ক্রমাগত নিপীড়ন ও লুণ্ঠন যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতজনের অনিবার্য বিধিলিপি।

দ্রোহের তীব্র সঞ্চার নিঃসঙ্গ শ্যামাঙ্গকে আবদ্ধ করে তোলে আরেক দ্রোহী নীলাবতীর বন্ধনে। নপুংসক, লম্পট স্বামী অভিমন্যুর স্ত্রী লীলাবতী স্বামীর সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন করে প্রথাগত শাস্ত্রধর্মকে উপেক্ষার মধ্য দিয়ে। লীলাবতীর আহবানকে উপেক্ষা করতে পারে না শ্যামাঙ্গ। লীলাবতীর প্রেম তার সৃষ্টিশীলতাকে আবার জাগ্রত করে। তার শিল্পীমানসে নারীর প্রতিরূপ আর লীলাবতী হয়ে ওঠে সমার্থক। লীলাবতীর মাঝে শ্যামাঙ্গ খুঁজে পায় চিরকালীন নারীত্বের মহিমা। তাই পুন্ড্রনগরে যবন হামলায় পরিত্যক্ত প্রাচীন এক বিহারের গায়ে প্রাপ্ত মৃত্তিকাফলকে লীলাবতীর দেহসৌষ্ঠব খুঁজে পায় শ্যামাঙ্গ। এই নারীমূর্তি যেন অবিকল লীলাবতী। নারীর পূর্ণ যৌবনপুষ্পিত দেহে একইসঙ্গে শক্তির দৃঢ়তা ও মাতৃত্বের কোমল সুষমা।

নির্ভীকতায় উজ্জ্বল লীলাবতী প্রথাগত শাস্ত্রীয় ধর্ম মানে না। কপট ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রাচারের জাল ছিঁড়ে সে পরিত্রাণ কামনা করেছে যবন ধর্মের কাছে। নারীত্বের ধর্মে বিশ্বাসী লীলাবতীর বলিষ্ঠ  উচ্চারণ –

আমার ধর্ম কোথায়? আমি তো বুঝি না, সত্য সত্যই আমার ধর্ম বলে কোনো বস্ত্ত কখনও ছিল কি না। যদি ছিল ধরে নিই তাহলে সে ধর্ম আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এমন বিবাহ দিয়েছে যা আমি চাইনি – সে ধর্ম আমার জীবনকে বিপন্ন করেছে, সে ধর্ম আমাকে পিতৃহীন করেছে – বলো, তাকে আমি ধর্ম বলবো?

শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রতি অনাস্থা লীলাবতীকে প্রাণিত করে শ্যামাঙ্গকে নিয়ে অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা করতে। শ্যামাঙ্গের সমস্ত দ্বিধা সে চূর্ণ করে। অবলীলায় শ্যামাঙ্গের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে, গর্ভে ধারণ করে শ্যামাঙ্গের সন্তান। অনাগত ভবিষ্যতের সোনালি স্বপ্ন তার চোখেমুখে।

স্বপ্ন শুধু লীলাবতী-শ্যামাঙ্গের চোখে নয়, বসন্ত, বিভাবতী, মায়াবতী, ছায়াবতী, কৃষ্ণার মতো প্রাকৃতজনের দৃষ্টিতেও। তাদের কেউ ক্ষেত্রকর, কেউ মন্দিরদাসী, কেউ ডোম, কেউ গৃহলক্ষ্মী। তাদের প্রত্যেকেই বেদনাঘন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। অথচ প্রত্যেকেরই স্বপ্ন ছিল স্বাচ্ছন্দ্যময় গৃহী জীবনযাপনের। স্ত্রী মায়াবতীর মায়ায় সংসারে স্থিত হতে চেয়েছিল বসন্ত। কিন্তু অন্তহীন নৈরাজ্য তাকে ঠেলে দিয়েছে জীবনের বৃহত্তর পথের অভিমুখে। ভিক্ষু মিত্রানন্দের সান্নিধ্য তাকে শেখায় – ‘মানবমুক্তির পথে যা অন্তরায় তা-ই অধর্ম এবং পরিত্যাজ্য।’ মানবতন্ত্রে তার দীক্ষা পূর্ণতা পায় কৃষ্ণার মতো এক মন্দিরদাসীর সাহচর্যে। কৃষ্ণার সঙ্গে মাত্র একটি নিশিযাপনের স্মৃতি কোনোদিনই মুছে যায় না বসন্তের হৃদয় থেকে। মানবধর্মের প্রকৃত শিক্ষা সে লাভ করে কৃষ্ণার উপলব্ধি থেকে –

আমরা মন্দিরদাসী, আমাদের গৃহ নেই, সংসার নেই, ভবিষ্যৎ নেই – তথাপি আমাদের মনে হয়েছে, অনাচারের অবসান হওয়া প্রয়োজন, অত্যাচার দূর হওয়া উচিত, মানুষের অপমান এবং লাঞ্ছনা আর সহ্য হয় না। যদি আমাদের নিষ্ফল জীবন মানুষের জন্যে কল্যাণময় ভবিষ্যৎ এনে দিতে পারে, তাহলেই মনে করব জীবন আমাদের সার্থক হয়েছে। কল্যাণ ও মঙ্গলময় সেই ভবিষ্যৎ আমাদের হবে না, হবে তোমাদের, যাদের গৃহ আছে – তথাপি আমরা মনে করব, আমাদের জীবন জগতের কাজে লাগল।

এমন নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ প্রাকৃতজনের ইতিহাসে বিরল নয়। তাদের জীবন সবসময় জগতের কাজে লেগেছে। সভ্যতার এতদূর অগ্রসরতা সম্ভব হয়েছে তাদের শ্রম ও ঘামের বদৌলতে। এই অকুণ্ঠ ত্যাগের স্বীকৃতি তারা কখনো পায়নি। তাদের ক্ষমতাকে কর্তৃত্বশীল শ্রেণি ভয় পেয়েছে। ছলে-বলে-কৌশলে তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে বিনাশ করতে চেয়েছে শাসকশ্রেণি। প্রাকৃতজনের অর্জন তাই বারবার লুণ্ঠিত হয়। শুধু বহিরাগত দস্যু নয়, ভেতরের শ্রেণিগত দস্যুর হাতেও অপহৃত হয় প্রাকৃতজনের সম্পদ। বসন্ত এই শৃঙ্খলিত কারাগার থেকে সবাইকে নিয়ে মুক্তির স্বপ্ন দেখে এবং যথার্থই শনাক্ত করে প্রতিবন্ধকতাকে –

যুগ যুগ ধরে নিজ নিজ গৃহেই অপহৃত হয়ে চলেছে তারা। গ্রামপতি নেয়, রাজপুরুষেরা নেয়, ব্রাহ্মণেরা নেয়, কায়স্থেরা নেয় – কে তাদের শ্রমলব্ধ উপার্জনের অংশ নেয় না? আশ্চর্যের বিষয়, এই চিন্তাটুকু মানুষ করতে চায় না।

যুগের তুলনায় প্রাগ্রসরচিন্তা বসন্তকে তার সহযাত্রীদের থেকে পৃথক করেছে। নতুন সমাজের ধর্ম, অর্থনীতির চরিত্র নিয়ে সে ভেবেছে। প্রিয়তমা স্ত্রী মায়াবতীর বাহুডোর ছিন্ন করে বৃহত্তর মানব সংসারের প্রতি নিজেকে নিবেদন করেছে। সে ক্ষেত্রকর, কিন্তু স্বভাবে বণিক। বিদ্যালাভের অধিকার সে পায়নি জন্মপরিচয়ের কারণে। নদী-তীরবর্তী এক উন্মাদ যোগীর কাছে সবার দৃষ্টির আড়ালে সে বিদ্যাশিক্ষা শুরু করে। সেই যোগী ব্রাহ্মণ্যবাদ-প্রবর্তিত শাস্ত্রাচারকে অস্বীকার করেছে। এমন খন্ড খন্ড প্রতিবাদ নানা স্থানে দানা বাঁধে। সংগঠিত বা পরিকল্পিত আন্দোলনের রূপ নেয় না প্রাকৃতজনের প্রয়াস। কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদের খবর ছড়িয়ে পড়ে আত্রেয়ী, করতোয়া ও পুনর্ভবা-তীরবর্তী গ্রামগুলোতে। প্রেরণা সঞ্চারিত হয় অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের মধ্যে। পিপলীহাটের চন্ডাল নারী এবং এক অজানা হাটে এক বয়স্কা মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী নারী অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যে নির্ভীক প্রতিবাদের স্বাক্ষর রাখে তা উজ্জীবিত করে অগণিত প্রাকৃতজনকে। প্রিয় বন্ধু মিত্রানন্দকে তাই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে প্রাকৃতজনের অমিত শক্তি সম্পর্কে অবহিত করে বসন্ত –

তোমার দেশের এক জননী দস্যু আক্রমণ কীভাবে প্রতিহত করতে পারে, সেটি তোমার দৃষ্টিগোচর হলো না। ভাব তো, যদি সকল প্রাকৃতজন একত্রে এই প্রকারই প্রতিরোধ করে, তাহলে কী হতে পারে? মিত্র, প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তোমরা কিছুই করতে পারনি। যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতজন এইভাবেই প্রতিরোধ করে। লাঞ্ছিত হয়, নিহত হয়, ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু তথাপি ঐ একইসঙ্গে সে প্রতিরোধ করতে ভোলে না – হয়তো বিচ্ছিন্ন, হয়তো একাকী এবং শস্ত্রবিহীন – তথাপি তার দিক থেকে প্রতিরোধ থেকেই যায়।

মিত্রানন্দকে এমন উদ্দীপনাসঞ্চারী কথা বসন্ত শোনায় বটে, কিন্তু সে নিজেও দ্বিধামুক্ত হতে পারে না। চিন্তার দ্বান্দ্বিকতা তাকে বিপর্যস্ত করে। একদিকে সামন্তপতিদের হাতে প্রতিনিয়ত নিপীড়ন, অন্যদিকে হিংস্র যবন দলের আসন্ন আক্রমণ – সব মিলিয়ে ধ্বংস ছাড়া সে সামনে কিছুই দেখতে পায় না। তাই প্রচন্ড আশাবাদের মধ্যেও নৈরাশ্য বসন্তকে গ্রাস করে। আত্মবিশ্লেষণ করে সে বলে –

আমি তো যুদ্ধ চাইনি, কোথায় যুদ্ধ? কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ? কিছুই জানি না – আমি সাধারণ মানুষ। কৃষ্ণাদেরও কি যুদ্ধ প্রয়োজন ছিল? আমি বুঝি না ভিক্ষু মিত্রানন্দ, কেন এই দ্রোহ উত্থাপনের প্রস্তাবনা, এতে তো মৃত্যু এবং ধ্বংস ব্যতীত অন্য কিছুই আমি দেখছি না।

এ যেন মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রারম্ভ দৃশ্য, যেখানে প্রতিপক্ষের সারিতে নিকটাত্মীয়দের দন্ডায়মান দেখে অর্জুন যুদ্ধ করতে অনীহা প্রকাশ করেছিল সারথী কৃষ্ণের কাছে। শেষ পর্যন্ত বসন্ত যুদ্ধ তথা শ্রেণিসংগ্রামের স্পৃহাকে বর্জন করেনি, অর্জুনও যেমন সরে আসেনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। বসন্তের আহবানে খন্ড খন্ড বিদ্রোহের চেতনা সঞ্চারিত হয় প্রাকৃতজনের মাঝে। কিন্তু পরিবার থেকে সমর্থন পায় না সে। স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, কোনো ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সে বসন্তকে দেবে না। স্ত্রী-সংসারের স্বপ্নে কিছুকাল বিভোর হয়ে থাকে বসন্ত; কিন্তু মনে শান্তি পায় না। প্রতিদিনই পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর যবন-আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। উদ্বাস্ত্তর মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। ভিক্ষু মিত্রানন্দ জীবন বিপন্ন করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যাচ্ছে। বিভাবতী, কৃষ্ণা, শুক্লার মতো ব্রাত্য নারীরা আত্মাহুতি দিচ্ছে। অথচ বসন্ত গৃহসুখে মগ্ন। নিজেকে ধিক্কার দেয় সে। স্ত্রীর কাছে নিজের লক্ষ্য ব্যক্ত করে –

…এই কি মানুষের জীবন? সুখ নেই, স্বস্তি নেই, গৃহ নেই, কেবলি প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে হচ্ছে – এর শেষ কোথায়? এ জীবন কি যাপন করা যায়? বলো, কতোদিন এভাবে চলবে? গ্রামপতি, সামন্তপতিরা যথেচ্ছ অত্যাচার করে যাবে, কেউ কিছু বলতে পারবে না – ওদিকে আবার যবনরা ধেয়ে আসছে, তাদের তরবারির নিচে কত মানুষের শির ছিন্ন হবে তাও কেউ বলতে পারে না। আমি চিন্তা করি এই অবস্থার পরিবর্তনের কথা।

স্থিতাবস্থার পরিবর্তনের কথা বসন্ত ভেবেছে, শুধু সে নয়, প্রাকৃতশ্রেণির অগণন মানুষ ভেবেছে। সেই ভাবনা কোনো সংহত বা সংগঠিত রূপ ধারণ করতে পারেনি। তাই সামন্তপতিদের পর প্রাকৃতজনের ওপরে নেমে আসে নতুন শাসক যবন শ্রেণির খড়্গ। বসন্ত দাসরা হারিয়ে যায়। যবনের আঘাতে মৃত্যু ঘটে স্বপ্নচারী শ্যামাঙ্গের। কিন্তু শিল্পী শ্যামাঙ্গের মৃত্যু হয় না। যবন ধর্ম গ্রহণ করে প্রাণরক্ষা ও সংসারধর্ম পালনের জন্য তাকে অনুরোধ করেছিল লীলাবতী। শ্যামাঙ্গ রাজি হয়নি। তার একমাত্র ধর্ম সে শিল্পী। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উত্থান-পতন তাকে স্পর্শ করেনি। উপন্যাসের শেষে লেখক বলেছেন, দৈহিক মৃত্যু শ্যামাঙ্গের প্রাপ্য ছিল। কারণ তৎকালীন সমাজ শ্যামাঙ্গের মতো মহৎ শিল্পীকে ধারণের জন্য যোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। তবে তার শৈল্পিক চেতনার অবসান ঘটে না। প্রাকৃতজনের নিত্যসংগ্রামী জীবনচক্রে মূর্ত হয়ে আছে শিল্পী শ্যামাঙ্গ। তাই কয়েক শতাব্দী পরও রাঢ়-বরেন্দ্র-বঙ্গ-সমতটের মৃৎশিল্পে লীলাবতীর ছায়া দেখা যায়, যার স্রষ্টা এক প্রাচীন শিল্পী শ্যামাঙ্গ। এভাবেই প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন প্রজন্মান্তরে প্রতিফলিত হয়ে চলে। শ্রেণিসংগ্রামের প্রয়াসে পূর্ণতা পায় তাদের জীবনবেদ। ইতিহাস এর সাক্ষী, সাক্ষী মহাকালও।