প্রাচ্যকলা : ঐতিহ্য ও আধুনিকতায়

প্রাচ্যের দেশগুলোয় দীর্ঘকাল ধরে চিত্রকলার যে-ঐতিহ্য বহমান, সেটি প্রাচ্যকলা নামে সুবিদিত। চীন, জাপান, ইরানসহ বৃহত্তর ভারতবর্ষ প্রাচ্যকলা চর্চাকারী প্রধান কয়েকটি দেশ। প্রাচ্যকলা হৃদয়বৃত্তিক ও কল্পনাপ্রবণ; এই চিত্রধারা সুললিত সৌন্দর্যবোধ প্রকাশে অকপট ও আপ্লুত।

প্রাচ্য-চিত্রকলার আদর্শ ও চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে শিল্পী মলয় বালা ও সতীর্থদের উদ্যোগে ২০০৯ সালে গড়ে ওঠে ওরিয়েন্টাল পেইন্টিং স্টাডি গ্রুপ। দেশ-বিদেশে এই গ্রুপ অনেক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে, পাশাপাশি আগ্রহী শিল্পী ও শিক্ষার্থীদের প্রাচ্যকলার নানা কলাকৌশল শেখানো ও এর তাত্ত্বিক-ভিত্তি নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় অষ্টম ওরিয়েন্টাল পেইন্টিং এক্সিবিশন।

ঢাকার প্রগতি সরণিতে অবস্থিত অবিন্তা গ্যালারি অব ফাইন আর্টস এগিয়ে এসেছে আমাদের স্বকীয় শিল্পের বিকাশমান নতুন আন্দোলনকে বেগবান করতে। ষাটজন শিল্পীর বিভিন্ন মাধ্যমের চিত্রকর্ম নিয়ে বৈচিত্র্যময় প্রদর্শনীতে সমকালীন শিল্পের গুণী অগ্রজ শিল্পীর সঙ্গে এ-সময়ের স্বনামধন্য কয়েকজন ও নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে। প্রবীণের সঙ্গে নবীনের এই যে মিথস্ক্রিয়া, তাঁদের চিত্রকর্মে পরিবর্তনের শুভযোগ তৈরি করেছে। সবমিলিয়ে শিল্পী, দর্শক ও শিল্পবোদ্ধারা নিশ্চয়ই এই সাফল্য বিবেচনা করবেন।

জলরং ও প্রাচ্যকলা মাধ্যমে ভিন্নতা সৃজনের প্রয়াসের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনজন শিল্পী পুরস্কৃত হয়েছেন এ-প্রদর্শনীতে। তাঁরা হলেন – আজমীর হোসেন, মুনমুন নাহার ও সামিনা জামান। আজমীর পেয়েছেন অবিন্তা গ্র্যান্ড পুরস্কার। তিনি কাগজে জলরঙে পাহাড়ের গান এঁকেছেন। আলো থেকে আঁধারের বাঁক পরিবর্তনের অনেকধাপ বা লেয়ার নিয়ে তিনি বাস্তব অনুষঙ্গে আধুনিক বিন্যাসে ব্যতিক্রমী ছবি আঁকেন। অবিন্তা এক্সিলেন্সি পুরস্কারপ্রাপ্ত স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী শিল্পী মুনমুন নাহার একটি আবদ্ধ দরজায় জড়িয়ে থাকা লতাগুল্মের ছবি এঁকে এর শিরোনাম দিয়েছেন ‘ট্রানজিট’। এটি আমাদের নাগরিক মননে দোলা লাগায়। সামিনা জাহানও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী। তিনি কাগজে জলরঙে জীবনচক্র নিয়ে ক্যালিগ্রাফির প্যানেল চিত্র এঁকেছেন। অবিন্তা এক্সিলেন্সি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী তাঁর নকশাধর্মী চিত্রপটে লিখেছেন – ‘নহে আশরাফ, যাঁর আছে শুধু বংশের পরিচয়, সেই আশরাফ জীবন যাহার পুণ্য কর্মময়।’

রেনেসাঁসের পর পাশ্চাত্যের বাস্তববাদী শিল্প ও প্রাচ্যের কল্পনাবাদী শিল্প আলাদা হয়ে গেছে। প্রাচ্যে মায়া বা হৃদয়জাত অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। পাশ্চাত্য বাস্তব ও বিজ্ঞাননির্ভর। যুগে যুগে শিল্পীরা ভালোবেসে নিসর্গের নানা অনুষঙ্গে অতুল সুন্দরীর অবয়ব, তার প্রসাধন, ছন্দিত দেহবল্লরী এঁকেছেন। এই আঁকায় আমাদের নারীরা মায়াবী-মায়াময়-কমনীয়, পশ্চিমে ওরা যেন তীব্র-তীক্ষè-ধারালো ও কামনামদির। এই প্রাচ্যকলা প্রদর্শনীতে সেই মায়াবী সৌন্দর্যময়ীরা শিল্পীদের হাত ধরে চিত্রপট হয়ে চিত্রশালার চার দেয়ালে নেমে এসেছেন। নিসর্গের অতুলনীয় সৌন্দর্যের সঙ্গে নারীত্বের মোহনীয় প্রেম নিয়ে যেমন আছেন অনেকে, তেমনি সস্নেহ শুচিতা ধারণ করে এখানে আছেন বাংলার আদর্শ কল্যাণীয়া নারীকুল।

প্রাচ্যশিল্প ভাবনায় পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। তার সাক্ষ্য দিচ্ছে স্বয়ং অগ্রজ শিল্পী আবদুস সাত্তারের চিত্রকর্ম। তিনি মানব অবয়বকে খ-িত করে মুখোশসদৃশ রূপ তৈরি করেছেন। এ-প্রদর্শনীতে থাকা তাঁর ‘অভিব্যক্তি’ শিরোনামের চিত্রকর্মটির অবয়ব প্রাচ্যদেশীয় হলেও যেন পাশ্চাত্যের অভিব্যক্তিবাদকে মনে করিয়ে দেয়। ঐতিহ্যবাহী চীনা কায়দায় প্রয়াত শিল্পী শওকাতুজ্জামানের শিরোনামহীন চিত্রকর্মটিতে পাহাড়ি ভূমিতে এক মোরগের ছবি এঁকেছেন। শিল্পী বিপদভঞ্জন কর্মকার ওয়াশ ও রেখায় মরমি সাধক ফকির লালন সাঁইয়ের প্রতিকৃতি তুলে ধরেছেন। নারী ও পুরুষের বিপরীত অবয়বের সঙ্গে ক্যাকটাস নিয়ে সম্পর্কের জটিলতা তুলে ধরে আমার আঁকা একটি চিত্রকর্ম এ-প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল। শিল্পী আফরোজা জামিল কংকা কাগজে অ্যাক্রিলিক রঙে অ্যাসিডদগ্ধ এক নারী-অবয়ব এঁকেছেন।

‘মেঘমল্লার’ শিরোনামে শিল্পী রশিদ আমিন জলরঙের স্বচ্ছ ওয়াশে এঁকেছেন হুলস্থূল বাতাসের পর নিসর্গের এলোমেলো রূপ। আলপ্তগীন তুষার ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে মায়াবিনী এঁকেছেন। আবদুল মোনেম মিল্টন তাঁর ‘ডেমোটিক থট’ শীর্ষক চিত্রে কালিকলমে এঁকেছেন ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের চার নারীর অবয়ব। এটির অংকনরীতি এদেশীয়, এ-মাটি হতে উত্থিত। জলরঙে আনিসুজ্জামান ফুলসহ ফুলদানি এঁকেছেন; তাঁর অংকনে পাশ্চাত্য রীতি, জলরং প্রয়োগে প্রাচ্যের স্নিগ্ধতা। সুশান্ত কুমার অধিকারীর বনলতা এ মাটির মেয়ে। ফিরোজ মাহমুদের চিত্রপটে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকের প্রতিকৃতি। মাসুদা খাতুন জুঁই গভীর এক ওয়াশে মধ্যবিত্ত এক নারীর ফিগার এঁকেছেন।

প্রদর্শনীর কিউরেটর শিল্পী মলয় বালা বৃক্ষের সঙ্গে মানুষের আন্তঃসম্পর্কের অভীপ্সাকে মনোরমভাবে তুলে ধরেছেন। জলভেজা কাগজে রঙের পিগমেন্ট ছড়ানো স্বতঃস্ফূর্ততায় বিকশিত হয়েছে জাহাঙ্গীর আলমের ‘চন্দ্রালোকে রাসলীলা’। প্রাচ্যের কিংবদন্তি নিয়ে অমিত নন্দী রচনা করেছেন ঐতিহ্যের বাগান। বাংলার পটচিত্র এঁকেছেন নাজির হোসেন। চীনা কায়দায় চায়নিজ কালি ও জলরঙে নিসর্গের ছবি এঁকেছেন সেদেশে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত শিল্পী নাজমুল হক বাপ্পি।

প্রাচ্যধারায় অন্যরকম এক কাজ করেছেন শিল্পী ফারিহা নুসরাত প্রাপ্তি। নিপীড়িত নারীর কুড়িটি আলাদা অবয়ব গড়ে নানা রঙের ছাট-কাপড়ের আবহে স্থাপন করেছেন শিল্পী; পটের মাঝখানে একটি কুলা যুক্ত করে তুলনামূলক বড় এক নারী-অবয়ব, তার বুকে ফুলের কোমল কোরক। নিপীড়িত হয়েও নারীর হৃদয়বৃত্তিক সৎ ও সুন্দর অনুভূতির ইতিবাচকতা তুলে ধরেছেন শিল্পী। নবীন শিল্পী হাসিবা ইয়াসমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ইমেজ ব্যবহার করে শিক্ষাক্ষেত্রে সন্ত্রাস ও ক্ষমতার অশুভ লড়াইকে চিত্রিত করে এই অবস্থার বিরুদ্ধে শিল্পিত প্রতিবাদ করেছেন। কেউ কেউ সংশয়বশত ভাবতে পারেন, এসব কাজে প্রাচ্যরীতির বৈশিষ্ট্য কোথায়! আমার বিশ্বাস এ-প্রদর্শনীর কাজগুলো দেখে একটু চিন্তা করলেই প্রশ্নকারীরা হয়তো নিজেরাই প্রাচ্যকলার ব্যাপ্তিকে খুব সহজে বুঝতে সমর্থ হবেন। বাংলাদেশ ওরিয়েন্টাল পেইন্টিং স্টাডি গ্রুপের এ-প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে প্রাচ্যশিল্পের সেই বিস্তৃতিই অনুভূত হয়েছে। অবিন্তা গ্যালারিতে আয়োজিত এ-প্রদর্শনী চলেছে গত ৪ আগস্ট শনিবার থেকে ১৩ আগস্ট সোমবার পর্যন্ত।