অনুবাদ : নাজিব ওয়াদুদ
ব্রিটিশ-ফিলিস্তিনি লেখক ইসাবেলা হাম্মাদের জন্ম লন্ডনের হ্যামারস্মিথে। পশ্চিম লন্ডনের একটনে তাঁর বেড়ে ওঠা। তাঁর বাবা ফিলিস্তিনের নাবলুসের মানুষ। লেবাননে আশ্রয় নিয়ে সেখানে ছিলেন অনেকদিন। পরে ব্রিটেনে অভিবাসী হন। ইসাবেলা হাম্মাদ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক করেন। পরে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে সাহিত্যের ওপর ফেলোশিপ এবং নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে এমএফএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ২০১৮ সালে ‘প্লিম্পটন প্রাইজ ফর ফিকশন’, ২০১৯ সালে মার্কিন ন্যাশনাল বুক ফাউন্ডেশনের ‘ফাইভ আন্ডার থার্টি ফাইভ সম্মাননা’, ‘ও’হেনরি প্রাইজ ফর শর্ট স্টোরি’ এবং ‘প্যালেস্টাইন বুক অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ২০১৯ সালে নিউইয়র্ক টাইমসের বর্ষসেরা গ্রন্থের তালিকাভুক্ত হয় তাঁর উপন্যাস দ্য প্যারিসিয়ান। একই বছর গার্ডিয়ান তাঁকে বছরের ‘রাইটার্স ফর এক্সেপশনাল ফার্স্ট নভেলস’ তালিকায় স্থান দেয়। ২০২০ সালে তিনি ‘লান্নান ফাউন্ডেশন লিটারারি ফেলোশিপ’, ‘বেটি ট্রাস্ক অ্যাওয়ার্ড’ এবং ‘স্যু কফম্যান প্রাইজ ফর ফার্স্ট ফিকশন’ অর্জন করেন। ২০২৩ সালে তিনি ‘গ্রান্টা বেস্ট অব ইয়ং ব্রিটিশ নভেলিস্টস’-এর তালিকায় স্থান লাভ করেন। অনূর্ধ্ব ৪০ বছরের ২০ জন উল্লেখযোগ্য ঔপন্যাসিকের এই তালিকা গ্রান্টা প্রতি ১০ বছর পরপর তৈরি ও প্রকাশ করে। ২০২৪ সালে তিনি ‘অ্যাসপেন ওয়ার্ডস লিটারারি প্রাইজ’ লাভ করেন। এছাড়া তিনি ম্যাকডাওয়েল-এর ‘জেরাল্ড ফ্রয়েন্ড ফেলোশিপ’ এবং নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘অ্যাক্সিন ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ’ পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ দুটি উপন্যাস – দ্য প্যারিসিয়ান (২০১৯) এবং এন্টার গোস্ট (২০২৩)।
লেখাটি তাঁর ‘The Revolutionary Power of Palestinian Theater’-এর বঙ্গানুবাদ। এটি Literary Hub-এ ২০২৩ সালে প্রকাশিত।
২০১৮ সালের অক্টোবরে রামাল্লায় ফিলিস্তিনি থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে জেনিন শরণার্থী শিবিরের ‘ফ্রিডম থিয়েটার’ পরিবেশন করেছিল রিটার্ন টু ফিলিস্তিন নামে ৪৫ মিনিটের একটি কোরিওগ্রাফিভিত্তিক কমেডি নাটক। নাটকটির কাহিনি অনুসারে জাদ নামে এক তরুণ পশ্চিম তীরের জেনিনে আসছিল। সে ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক। ফিলিস্তিনে থেকে যাওয়া তার পরিবারের লোকজনকে দেখতে আসছে সে। মঞ্চে কালো পোশাক পরা ছয়জন লোক এমনভাবে একটি লাইন তৈরি করেছিল যে তার মধ্য দিয়ে একটি গাড়ি, একটি চেকপয়েন্ট, শরণার্থী শিবিরের গেট এবং একটি ক্যাফের ছবি ফুটে ওঠে। মঞ্চের ডান দিকে বসেছিলেন বাদ্যশিল্পীরা, তাঁরা ছড়াচ্ছিলেন আতরের সুবাস আর চামচ ও ড্রাম দিয়ে বাজানো সুরের ঝংকার।
সামরিক দখলদারিত্বের অধীনে জীবনযাপন সম্পর্কে জাদ প্রথম যে-শিক্ষাটা পায় সেটা যাতায়াতের সময়-সংক্রান্ত। তেলআবিবের বেন গুরিওন বিমানবন্দর থেকে সে তার চাচাকে ফোন করে। চাচা তাকে জানালেন যে, পশ্চিম তীরের একজন ফিলিস্তিনি বাসিন্দা হিসেবে তার পক্ষে সেখানে গিয়ে তাকে স্বাগত জানানো সম্ভব নয়, তার সে অনুমতি নেই। তাকেই ট্যাক্সি নিয়ে চেক পয়েন্টে আসতে হবে। জেনিনে পৌঁছার পর চাচা-ভাতিজার সাক্ষাতের দৃশ্য উপস্থাপন করতে গিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি করা হয়। চাচা রাগের ভান করেন – ‘তুমি দেরি করে ফেলেছো!’ তিনি চিৎকার করে বলেন, ‘তুমি কি মনে করো তুমি ইউরোপে আছো? এখানে, আমরা আরব! আমরা সময়কে সম্মান করি!’ শ্রোতারা হাসতে শুরু করে। জাদ ঘাবড়ে যায়, তারপর সে বুঝতে পারে চাচা তার সঙ্গে মজা করছেন। তারা পরস্পরকে আলিঙ্গন করেন, দর্শকরা আনন্দে শিস দেন।
এই কৌতুকটা ‘আরব সময়’ নিয়ে, এটি একটি পরিচিত নিন্দাসূচক কৌতুক। সময়ানুবর্তিতা সম্পর্কে এই ‘স্টেরিওটাইপ’ তৈরি করা হয়েছে উপনিবেশিত বা নিপীড়িতের অবনয়নকে লক্ষ্য করে। বক্তার দিকে তাকিয়ে, বা ঔপনিবেশিকের
সময়-চেতনার বিরুদ্ধে উপনিবেশিতের প্রতিরোধ প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করে এটিকে সোজাসাপ্টা বর্ণবাদ বা অভ্যন্তরীণ বর্ণবাদ বলা যায়; এই স্টেরিওটাইপ কৌতুকের মাধ্যমে এটিই প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে যে, উপনিবেশিতের পশ্চাৎপদতার জন্য ঔপনিবেশিক শক্তি নয়, তাদের নিজেদের কর্মকাণ্ডই দায়ী। এভাবে এই স্টেরিওটাইপ ঔপনিবেশিক বা নিপীড়কের উদ্দেশ্যই পূরণ করে। তবে চাচার এই রসিকতার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভাগ্যের একটি চিত্র ফুটে ওঠে। সেটা হলো, তারা যখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায় তখন তাদের নিজস্ব সময়ের ওপর তাদের নিজেদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। প্রাচীর, বেড়া, চেক পয়েন্ট, রাস্তার মধ্যে ফ্লাইং চেক পয়েন্ট, এখানে-সেখানে পাহারারত ইসরায়েলি সৈন্যদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা তাদের যেখানে-সেখানে যখন-তখন থেমে যেতে, অপেক্ষা করতে বাধ্য করে। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে – তারও কোনো নিয়মনীতি নেই। তবে সবচেয়ে করুণ বিষয় ছিল দর্শকদের প্রতিক্রিয়া, যেন হাসির ফোয়ারা ছুটেছে। আসলে কৌতুকটা তাঁদের মনেই ছিল, সুতরাং মঞ্চের দৃশ্যের সঙ্গে তাঁরা সহজেই সম্পর্কিত হতে পারছিলেন। বরং এই কৌতুকটার মধ্যে তাঁরা যেন মুক্তির স্বাদ অনুভব করছিলেন।
১৯৪৮ সালের আগে, ফিলিস্তিনের পারফর্মিং আর্ট ‘হাকাওয়াতি’র মৌখিক ঐতিহ্য থেকে যাত্রা শুরু করেছে, যেখানে একজন কথক ও গায়েন জনপ্রিয় লোকসাহিত্যের ভাণ্ডার থেকে গল্প বলতেন; ছিল ‘সান্দুক আল-আজাব’ (বিস্ময়ের বাক্স) এবং ছায়া পুতুল থিয়েটার যা অটোমান সাম্রাজ্য জুড়ে জনপ্রিয় ছিল। আর এখন তো জেরুজালেম এবং জাফার কফি হাউস ও নাইট ক্লাবগুলোতে সংগীত, নৃত্য এবং আরো আরো পশ্চিমাশৈলীর নাট্য পরিবেশনার ছড়াছড়ি। ২০০৩ সালে সমাজবিজ্ঞানী সালিম তামারি জেরুজালেমের সংগীতজ্ঞ ওয়াসিফ জাওহারিয়াহর স্মৃতিকথা রচনা ও প্রকাশ করেন, তাতে নাকবাহ্ (১৯৪৮ সালের মহাবিপর্যয়)-পূর্ববর্তীকালীন জেরুজালেমের রাত্রিজীবনের উচ্ছ্বাস স্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়েছে।
১৯৭০-এর দশক ছিল শিল্প-নির্মাণ এবং ফিলিস্তিনি বিপ্লব – উভয় ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মিশরে ধ্রুপদী ইউরোপীয় শৈলীর থিয়েটার বিকাশ লাভ করে এবং ফিলিস্তিনে পৌঁছে দ্রুত তা শহুরে অভিজাত বিষয়ে পরিণত হয়। ১৮৫০-এর দশক থেকেই ফিলিস্তিনি সংবাদপত্রগুলোতে হাইফা, জাফা, নাজারেথ ও জেরুজালেমের স্থানীয় গোষ্ঠী এবং এ-অঞ্চলের বৃহৎ দুটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বৈরুত ও কায়রো থেকে আসা গোষ্ঠীগুলির অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন ছাপা হয়ে আসছে। শেক্সপিয়রের হ্যামলেট প্রথম আরবি ভাষায় পরিবেশিত হয়েছিল গাজায়, ১৯১১ সালে। প্রখ্যাত লেবানিজ অভিনেতা-পরিচালক জুর্জ আবিয়াদ প্রায়ই কায়রো থেকে ফিলিস্তিনে আসতেন (জাওহারিয়াহ ১৯০৮ সালের প্রথম দিকে শেখ সালামা হিজাজির সঙ্গে জেরুজালেমে গিয়েছিলেন) এবং তাঁর গোষ্ঠী ইউরোপীয় অনুবাদ ও মৌলিক আরবি উভয় ধরনের নাটকই মঞ্চস্থ করেছে। ১৯৪৮ সালের পর ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং স্থানীয় ফিলিস্তিনি সমাজ ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনি সাংস্কৃতিক জীবনও বিলুপ্ত হয়ে যায়। নতুন রাষ্ট্রে ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার ওপর ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসন জারি ছিল। গ্রিনলাইনের ওপারে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যোগাযোগ কার্যত অসম্ভব ছিল এবং যে-সামান্য নাট্যচর্চা ছিল তা সীমাবদ্ধ ছিল স্কুল এবং গির্জাগুলোতে।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল পশ্চিম তীর এবং গাজা দখল করে নেয়। এর ফলে ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ ‘পুনরায় একত্রিত’ হয় এবং থিয়েটার নতুন গতি লাভ করে। পুরনো দিনের ধ্রুপদী ভাণ্ডার থেকে পুনরাবৃত্তি করার পরিবর্তে নতুন নাট্যগোষ্ঠীগুলো সমন্বয় ও রূপান্তরের পথ বেছে নেয়। এই কাজটা শুরু হয়েছিল একজন আভাগার্দ ব্যক্তির হাত ধরে। এই নবতরঙ্গের প্রাণপুরুষ ফ্রাঁসোয়া আবু সালেম একজন জটিল ব্যক্তিত্ব। তাঁর জন্ম ১৯৫১ সালে জেরুজালেমে, বাবা ছিলেন একজন হাঙ্গেরিয়ান, মা ফরাসি। বাবা-মায়ের দেওয়া নাম ফ্রাঙ্কুইস গ্যাস্পার। তিনি জেরুজালেমেই বড় হয়েছিলেন যেখানে তাঁর বাবা একজন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতেন। তরুণ বয়সে তিনি ‘আবু সালেম’ উপনাম গ্রহণ করেন, যা তাঁর ইউরোপীয় পরিচয়কে অস্পষ্ট করে তোলে। অবশ্য অনেকের বিশ্বাস, তাঁর পিতৃপুরুষ আরব ছিলেন। বিষয়টি আজ অবধি রহস্যাবৃত থেকে গেছে।
আবু সালেম প্যারিসে নবপ্রতিষ্ঠিত ‘থিয়েটার দু সোলেল’-এ প্রখ্যাত নিরীক্ষাধর্মী নাট্যপরিচালক আরিয়েন মুনউচ্কাইনের সঙ্গে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই গোষ্ঠী পরিস্থিতিবাদ নিয়ে কাজ করছিল। তাদের এজেন্ডা ছিল পুঁজিবাদবিরোধী বিপ্লব। আভাগার্দ শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবীদের চর্চাকেন্দ্র ছিল এটি। ১৯৬৮ সালের মে-বিদ্রোহ সংঘটনে তাদের ভূমিকা ছিল। আবু সালেম জেরুজালেমে প্রত্যাবর্তন করেন ফিলিস্তিনি থিয়েটার তৈরির অঙ্গীকার নিয়ে। ১৯৭১ সালে তিনি ‘বালালিন’ (আক্ষরিক অর্থ ‘বেলুন’) নামে একটি থিয়েটার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনিদের দৈনন্দিন জীবনবাস্তবতাকে তুলে ধরা। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত নাটক আল-আতমেহ (অন্ধকার)। পরে এটি সালমা জায়ুসির আধুনিক আরবি নাটক সংকলনে স্থান পায়। নাটকটিতে অন্ধকার মঞ্চে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নিজেদের মধ্যকার বিভিন্ন আন্তঃসম্পর্কীয় নিপীড়ন, পেশা, সামাজিক পশ্চাৎপদতা, পিতৃতন্ত্র প্রভৃতির অন্ধকারত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। নাটক শেষ হয় দর্শক এবং শিল্পীদের সম্মিলিতভাবে মোমবাতি প্রজ্বালনের মাধ্যমে মঞ্চকে আলোকিত করে। এই নাটকের এটি ছিল প্রচণ্ড অভিঘাত। দর্শকরা এর আগে এরকম কিছু দেখেনি। তাঁরা আনন্দ পেয়েছিলেন।
অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং দর্শকদের মধ্যকার দূরত্ব ও নৈকট্য নিয়ে যেভাবে তারা খেলেছে তা দেখে মনে হয়, এখানে ব্রেখ্ট-এর প্রভাব রয়েছে। এর মাধ্যমে নাটকটি ব্রেখ্টীয় কায়দায় দর্শকদের নিপীড়ক সামাজিক কাঠামোর প্রতি প্রতিরোধপ্রবণ করে তোলে। ‘ফোরাম থিয়েটার’ বা ‘প্লে-ব্যাক’-এর পরবর্তী নিরীক্ষাগুলি ১৯৭০-এর দশকে শুরু হয়। এই পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে একটি গোষ্ঠী অভিনয় শুরুর আগে দর্শকদের কাছ থেকে সাক্ষ্য সংগ্রহ করে। এটি ব্রাজিলিয়ান নাট্যব্যক্তিত্ব অগাস্টো বোলের ‘থিয়েটার অফ অপ্রেসড’ দ্বারা অনুপ্রাণিত, যা রামাল্লার ‘ফ্রিডম থিয়েটার’ এবং ‘আশতার থিয়েটার’ উভয় গোষ্ঠীর কাছেই জনপ্রিয়।
শিল্পীরা সম্পূর্ণ আমদানি করা পশ্চিমা আঙ্গিক অথবা হাজার বছর ধরে অপরিবর্তিত স্থানীয় ঐতিহ্য – যে-কোনো একটিকে কেবল বেছে নিতে পারেন – এমন চিন্তা করা ভুল। এটি আসলে একটি ঔপনিবেশিক মনোভাব। বাস্তবে এসব পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টার শেকড় দেশীয় ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত। এ বিষয়ে ‘বালালিন’-এর কুশীলবরা অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। সম্প্রতি দিয়া বারগুতি ফিলিস্তিনের পারফর্মিং আর্ট এবং সুফি আচারের ঐতিহ্যের মধ্যকার সম্পর্ক অনুসন্ধান করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, মৌখিক আখ্যানের ঐতিহ্যগুলি ফিলিস্তিনিদের জন্য দীর্ঘকাল ধরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে, বিশেষ করে ১৯৪৮ সালের ধ্বংসযজ্ঞ এবং ফিলিস্তিনিদের আর্কাইভ ও লাইব্রেরিগুলি ইসরায়েল কর্তৃক ক্রমাগত ধ্বংস ও বাজেয়াপ্তের কারণে।
১৯৭০-এর দশকের মধ্যে, সমগ্র অঞ্চল জুড়েই, থিয়েটার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে। ১৯৬৭-পরবর্তী রাজনৈতিক থিয়েটারের খ্যাতিমান সিরীয় নাট্যকার সাদাল্লাহ ওয়ানুস, সেই সঙ্গে মুহাম্মদ আল-মাগুত এবং তৌফিক আল-হাকিমের নামও করা যায়। রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপ এড়াতে এবং দৈনন্দিন সমস্যা তুলে ধরতে তাঁরা তাঁদের নাটকগুলিতে প্রায়ই কূটাভাস, বিদ্রূপ এবং রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন।
১৯৭০-এর দশক ছিল শিল্প-নির্মাণ এবং ফিলিস্তিনি বিপ্লব উভয় বিবেচনাতেই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৭ সালে মাত্র ছয়দিনের মধ্যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে অপমানজনকভাবে পরাজিত হয় মিশরীয়, সিরীয় ও জর্ডানীয় বাহিনী। ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রামের অক্ষ পরিবর্তন করে দিয়েছিল এই যুদ্ধ, যার ফলে বৃহত্তর প্যান-আরবের কাছে ফিলিস্তিন আর কখনো গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করতে পারেনি। মিশরীয় প্রেসিডেন্ট গামাল আব্দুন নাসেরের ‘সম্মিলিত পুনর্জন্মের দর্শন’-এর জাঁকজমকপূর্ণ ঘোষণা এবং তার ফলে সৃষ্ট আশা সমগ্র অঞ্চল জুড়ে যে উদ্দীপনা তৈরি করেছিল তা বেলুনের মতো চুপসে যায়। এটা কোনো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছিল না। বিষয়টি এমন, দুর্বল কৌশল এবং অপর্যাপ্ত সামরিক অবকাঠামোর কারণে আরব বিমান বাহিনীকে ধ্বংস করার আগেই সেটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। ইসরায়েলিরা তাদের পদাতিক সৈন্যদের আকাশ থেকে ধ্বংস করার জন্য অগ্রসর হয়। এভাবে তারা শুধু পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম নয়, জর্ডান নদী এবং গোলান হাইট্স্ও দখল করে নেয়।
এই বিপর্যয়ের পরে ফিলিস্তিনিদের নতুন করে আত্মপরিচয় নির্মাণ করতে হয়। সৃজনশীল স্ব-নির্মিতির এই মুহূর্তে শৈল্পিক সৃষ্টি বিকাশ লাভ করে। দ্য রেচেড অফ দ্য আর্থ-এ ফ্রাঞ্জ ফ্যানন যে দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন তার সঙ্গে এই পরিস্থিতির মিল পাওয়া যায়। ফ্যানন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, অতীতচারী লোককাহিনির পুনরাবৃত্তি না করে উপনিবেশিত মানুষের উচিত তাদের শিল্পকর্মকে তাদের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে যূথবদ্ধ করা এবং সেই অনুযায়ী তার বিকাশ ঘটানো। তিনি বলেছেন, ‘অনেক কাল আগে এইসব ঘটনা ঘটেছিল’ – এই সূত্রের পরিবর্তে আমাদের বলতে হবে – ‘কোনো একসময় অন্য কোথাও এটা ঘটেছে, কিন্তু এই ঘটনা আজকে এখানেও ঘটেছে, এবং আগামীকালও ঘটতে পারে।’
এরকম ভাবা ভুল যে, শিল্পীরা কেবল সম্পূর্ণ আমদানিকৃত পশ্চিমা আঙ্গিক এবং হাজার হাজার বছর ধরে অপরিবর্তিত দেশীয় ঐতিহ্যের মধ্যে যে-কোনো একটিকে বেছে নিতে সক্ষম। আসলে এটি একটি ঔপনিবেশিক মনোভঙ্গি। শিল্প সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে – দেশীয় সময়ের সঙ্গে, আর সেটাই উচিত।
‘বালালিন’-এর পরে, তার মতো আরো অনেক গোষ্ঠী যেমন – ‘দাবাবিস’ (পিন), ‘সানাবিল’ (পেরেক), ‘বিলা-লিন’ (কোমলতাহীন) এবং এরকম আরো কিছু স্বল্পায়ু গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছিল। এরা ঐতিহ্যবাহী ক্ল্যাসিক আরবি ভাষার পরিবর্তে স্থানীয় ফিলিস্তিনি উপভাষা ব্যবহার করত। এই পর্যন্ত, এতটাই ফ্যানোনীয়, বিশেষ করে ১৯৬৭ সালের পরে কথ্য আরবি ভাষার প্রতি এই পক্ষপাতের পেছনে স্থানীয়করণের প্রভাব ছিল। আরবি উপভাষাগুলো শুধু একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত পারস্পরিকভাবে বোধগম্য Ñ যখন কিছু দল আঞ্চলিক এবং এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নাটক প্রদর্শন করেছে, তখন নিজস্ব উপভাষার ব্যবহার ফিলিস্তিনি বিশেষত্ব প্রকাশের প্রতি সাধারণ প্রতিশ্রুতিকে প্রতিফলিত করে।
সেই সময়ে, বিশে^র অন্যান্য স্থানের মতো, ফিলিস্তিনি নাট্য সম্প্রদায়কেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ করে দিয়েছিল। বালালিনের ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য রিহার্সাল করত এবং শেখ র্জারাহ্তে আবু সালেমের বাবা-মায়ের বাড়িতে পার্টি দিত, হাতে পোস্টার তৈরি করত এবং সকালের নাস্তার জন্য হোটেলে যাওয়ার আগে সেগুলিকে পুরনো শহরের দেয়ালে আঠা দিয়ে সেঁটে দিত। জেনিনের ফ্রিডম থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ানো মের খামিসও জনসমাজের ওপর জোর দিয়েছিলেন : ‘আপনার প্রয়োজন একটি সময়সূচি, শ্রমবিভাজন, দায়িত্বপরায়ণতা, এবং সংহতি – এটি একটি আদর্শ সমাজের বৈশিষ্ট্য। এই পথ ধরে, এই প্রক্রিয়ায় পুনর্নির্মিত হবে যোগাযোগের সেইসব মাল-মশলা যা সমাজ ভেঙে যাওয়ার কারণে ভেঙে গেছে।’ খামিস ছিলেন আরেক নাট্যব্যক্তিত্ব যিনি একইসঙ্গে স্থানীয়, আবার বহিরাগতও। তিনি প্রথম ইন্তিফাদার (আরবি শব্দ ‘ইন্তিফাদা’র অর্থ জাগরণ, বিদ্রোহ বা প্রতিরোধ আন্দোলন) পর কাজ শুরু করেছিলেন। ২০১১ সালে রহস্যজনক পরিস্থিতিতে তাঁকে হত্যা করা হয়। তিনি থিয়েটারকে, সম্ভবত বালালিনের চেয়েও অধিকতর মাত্রায়, ‘সাংস্কৃতিক ইন্তিফাদা’র একটি উপকরণ হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। যদি ফ্রিডম থিয়েটারের অধিকতর উগ্র বলয় থেকেও থাকে, তাহলে এটিকে তাদের নিজ নিজ ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে এবং বুঝতে হবে যে, খামিসের গোষ্ঠীটির অবস্থান ছিল শরণার্থী শিবিরে। আর বালালিনের কর্মীরা যদিও ফিলিস্তিনের বিভিন্ন জনসমাজের সদস্য, তবুও মনে রাখতে হবে, এর নেতৃত্ব ছিল শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে। ১৯৭৬ সালে ইসরায়েলিরা বালালিনের সদস্য মুস্তাফা আল-কুর্দকে কিছুকাল বিনা বিচারে আটক রাখার পর নির্বাসনে পাঠায়, তার পরপর বালালিন ভেঙে যায়। কেউ কেউ অবশ্য গোষ্ঠীটির বিলুপ্তির কারণ হিসেবে সদস্যদের মধ্যকার ব্যক্তিগত মতপার্থক্যকে দায়ী করেন। অন্যরা মনে করেন, এর অনেক সদস্য অল্পবয়সী ছিল, তারা বড় হয়েছে, বিয়ে করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছে, এভাবে ভেঙে পড়েছে। ফ্রাঁসোয় আবু সালেম পূর্ব জেরুজালেমের একটি পুরনো সিনেমা হলে ‘আল-হাকাওয়াতি থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; কিন্তু এই প্রকল্প মাত্র কয়েক বছর স্থায়ী হয়, তখন প্রথম ইন্তিফাদার সহিংসতার কারণে রাতে রাস্তায় হাঁটাচলা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।
থিয়েটার নিয়ে আমার উপন্যাস এন্টার গোস্ট লেখার সময় আমি বালালিনের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তাঁরা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন; কিন্তু তাঁদের কথায় দল সম্পর্কে সমালোচনা ছিল না। একজন বলেছিলেন বিষয়টা সম্পূর্ণ আবেগের ব্যাপার। তাঁর ভাষায় – ‘পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় এটি ছিল ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ বিপ্লবের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপক প্রসার ঘটে – কবিতা, থিয়েটার, উপন্যাস – আপনি জানেন সাহিত্য তখন সবেমাত্র বিকশিত হতে শুরু করেছে, যাকে বলে প্রতিরোধ সাহিত্য। আমি আমাদের এই প্রেক্ষাপটে স্থাপন করতে চাই।’ ‘আমরা ভেবেছিলাম আমরা নতুন কিছু সৃষ্টি করছি’, অন্য একজন বলেছেন, বেশ বিদ্রূপের সঙ্গে। – ‘পৃথিবীটাকে পাল্টে দিতে চেয়েছিলাম!’
থিয়েটার একটি স্বল্পায়ু শিল্প। সমকালে বেঁচে থাকার একটি পরীক্ষা এটি। পিটার ব্রুকের মতে, শর্তযুক্ত আবেগের সঙ্গে লড়াই। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে অর্থ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন প্রয়োজন হয়। অধিকৃত অঞ্চলে শিল্পকলার জন্য অর্থায়ন আন্তর্জাতিক দাতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এই ধরনের অর্থ সাধারণত সূত্র ধরে আসে। হাইফার ‘আল-মিদান থিয়েটার’ ইসরায়েলি রাষ্ট্রের বেসামরিক এলাকার মধ্যে সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত ও প্রধান ফিলিস্তিনি থিয়েটার। তারা ওয়ালিদ দাক্কা নামের একজন রাজনৈতিক বন্দির চিঠির ওপর ভিত্তি করে একটি নাটক প্রদর্শন করেছিল। এর ফলে ২০১৫ সালে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। হাইকোর্টে সফল আবেদন করার পরও ইসরায়েলি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রীয় অর্থসাহায্য বন্ধ করে দেয়।
থিয়েটারের প্রতি এই শত্রুতা সম্ভবত এর স্বল্পায়ু প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। একটি জীবন্ত, আবশ্যিকভাবে পুনরাবৃত্তি-অযোগ্য শিল্প-আঙ্গিক হিসেবে থিয়েটার অনিশ্চিত এবং এমনকি দ্রুত পরিবর্তনশীল হতে পারে।
থিয়েটারের প্রতিরোধী সম্ভাবনার জন্য তাদের তারুণ্যের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বালালিন-এর পুরনো সদস্যরা এখন হাসতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনিদের সমস্ত শিল্পের মধ্যে থিয়েটার একসময় ইসরায়েলি সেন্সরশিপের কারণে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অসলো চুক্তির (১৯৯৩-১৯৯৫) আগে, ইসরায়েলে প্রদর্শনের জন্য নাটকের স্ক্রিপ্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘নাটক ও চলচ্চিত্রের সেন্সরশিপ কমিটি’ এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সেন্সরশিপ কমিটির কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। আর অধিকৃত অঞ্চলে নাটকগুলিকে সামরিক সরকারের সেন্সরশিপ কমিটি থেকেও অনুমোদন নিতে হতো।
প্রথম ইন্তিফাদার সময় হ্যামলেট পশ্চিম তীরে নিষিদ্ধের তালিকায় ছিল, কারণ ‘টু বি অর নট টু বি’ বক্তৃতার অংশে কিছু লাইন ছিল এরকম – ‘সমস্যার সমুদ্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করো/ এবং তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদের শেষ করো।’ এই কথাটুকুকে তারা সহিংসতার প্ররোচনা হিসেবে বিবেচনা করেছিল। ১৯৮৪ সালের মে থেকে ১৯৮৭ সালের মার্চ পর্যন্ত হাওয়াকাতি থিয়েটার চৌদ্দ বার এবং ১৯৮৭ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তিন মাসে সাতবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। অভিযোগের মধ্যে ছিল ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যে হুমকি’ থেকে ‘অনুমতি না-নেওয়া’ পর্যন্ত।
১৯৮১ সালে মাহজুব, মাহজুব শিরোনামের একটি ব্যঙ্গ নাটক প্রদর্শনের অনুমতি পাওয়া গিয়েছিল। নাটকটি একজন সরল ফিলিস্তিনি কোলাবরেটরকে নিয়ে রচিত। পরে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ অনুমতি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল এই অভিযোগে যে, নাটকটি প্রদর্শনের সময় সেন্সরে জমা দেওয়া মূল পাঠ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। প্রদর্শনীর রাতে নাটকটি বন্ধ করার জন্য নিরাপত্তা বাহিনী নাজারেতে উপস্থিত হয় এবং গ্রেপ্তারের ভয় দেখায়। ১৯৭৬ সালে রাজনীতিবিদ এবং সাহিত্যসমালোচক হানান আশ্রাভি লিখেছিলেন, ‘কোনো থিয়েটার গ্রুপই তার দু-একজন সদস্যকে জেলে না রেখে কখনো অভিনয় করতে পারেনি।’
থিয়েটারের প্রতি এই শত্রুতা সম্ভবত এর স্বল্পায়ু প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত : একটি জীবন্ত, আবশ্যিকভাবে পুনরাবৃত্তি-অযোগ্য শিল্পআঙ্গিক হিসেবে থিয়েটার অনিশ্চিত এবং এমনকি দ্রুত পরিবর্তনশীল হতে পারে। এটি ‘অ্যাকশন’কে উসকে দিতে পারে। ইংলিশ শব্দ ‘অ্যাক্ট’-এর দ্বৈত অর্থ ফিলিস্তিনি প্রেক্ষাপটে জীবন্ত হয়ে ওঠে। এটি এমন একটি শিল্প ফর্ম যা পরিসর দখলে নেওয়া অবয়ব নিয়ে গঠিত। ইসরায়েলি দখলদারিত্বের মেরুদণ্ডই হচ্ছে সামরিক শাসন, আর এই দেহগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা হলো তার ক্ষমতার প্রধান কর্মকৌশল।
আজকাল শিল্পীদের, বিশেষত তরুণদের, কাজ কীভাবে রাজনৈতিক বাস্তবতার ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলতে পারে – এ নিয়ে কখনো কখনো অত্যধিক আশাবাদী হতে দেখা যায়। তারা হৃদয় ও মন পরিবর্তন করতে চায়, সহানুভূতি সৃষ্টি করতে চায়, মিথ্যা প্রচারণাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চায়, পররাষ্ট্রনীতি বদলে দিতে চায়। এই ধরনের বিস্ময়কর ঘটনা শেষ পর্যন্ত ঘটতেও পারে, কিন্তু নরম শক্তি সাধারণত শ্লথগতিসম্পন্ন হয়।
ফিলিস্তিনি অঙ্গীকারশীল শিল্পের পূর্ণ বিকাশকালে, পাশাপাশি স্নায়ুযুদ্ধ এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সমগ্র দক্ষিণ গোলার্ধ জুড়ে শৈল্পিক অঙ্গীকারের একটি সাধারণ ঢেউ বহমান ছিল, শিল্প এবং আন্দোলন বেশ অসাধারণ রকম প্রত্যক্ষ উপায়ে পরস্পরকে তৈরি এবং গঠন করেছিল। আজ পারফর্মিং আর্টগুলি প্রায়ই দর্শক-শ্রোতাদের সত্তরের দশকের মতো অনুপ্রাণিত করতে পারে না, তবে তারা এখনো নান্দনিকতা ছাড়াও অন্য অনেক কিছু দিতে পারে – সামাজিক
আত্ম-প্রতিফলনের একটি পরিসর, মানসিক আঘাতকে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করার সুযোগ, উষ্ণ চুলার চারপাশে একত্রিত হওয়ার আনন্দ – এই রকম আরো কিছু।
শিল্পী ভেরা তামারি আমাকে দৃশ্যশিল্পের প্রদর্শনী সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলেন, সেগুলি নিয়ে আমি এখনো ভাবি – তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা প্রায়ই বলে থাকেন যে, ১৯৬৭-এর পরে, ‘শত শত মানুষ’ এসব প্রদর্শনীতে ভিড় জমাতো। তামারি বালালিনের সদস্য এবং ‘লিগ অফ প্যালেস্টিনিয়ান আর্টিস্ট’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, এটি স্থানীয় এবং অভিবাসী ফিলিস্তিনিদের শিল্পকর্মের প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। পেশাদার গ্যালারি না থাকায় তারা স্কুল এবং পৌরসভা কেন্দ্রগুলিতে এসব প্রদর্শন করেছিল।
ছবিগুলি ছিল প্রতীকে পূর্ণ। ফিলিস্তিনি পতাকার রং শিগগিরই নিষিদ্ধ করা হবে (তরমুজ চিত্রিত করার অসম্ভাব্যতা নিয়ে চিত্রশিল্পীদের রসিকতা বিখ্যাত হয়ে আছে এখনো)। তামারি আমাকে বলেছিলেন, ‘দর্শনার্থীরা পেইন্টিংয়ের এত কাছে গিয়ে দেখছিল যেন তারা পেইন্টের গন্ধ শুঁকতে চায়।’ তিনি তাঁর মুখের সামনে তাঁর হাতের তালু এনে দেখাচ্ছিলেন আমাকে।
ক্যানভাসে নাক ঠেকিয়ে নিজেদের খোঁজার এই দৃশ্যটা আমার কাছে ব্রেখ্ট বা বোল, বা এমনকি ওয়ানুস বা মাগুতের চেয়েও সরল এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। এই উপস্থাপনা মানুষের একটি গভীর মৌলিক চাহিদার তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারে – সেটা হলো, নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা এবং নিজের স্বীকৃতির আনন্দ ও উজ্জ্বল আলোর অভিজ্ঞতা লাভ করা।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.