অনুবাদ : ভার্গব বন্দ্যোপাধ্যায়
ফার্ন হিল, দ্য ওকস্, হান্টারস্ লজ, দ্য পার্সোনেজ, দ্য পাইনস, ডাম্বারনি, ম্যাকিন্নন্স হল এবং উইন্ডারমেয়ার। ভারতের কোনো একটা পাহাড়ি শহরের চারপাশের অতিপ্রাচীন কয়েকটা বাড়ির নাম এগুলো। এগুলোর বেশির ভাগই ভেঙেচুরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাড়িগুলো অনেক পুরনো, একশ বছরেরও আগে তৈরি। সমতলের অসহ্য গরমের হাত থেকে রক্ষা পেতে ব্রিটিশরাই তৈরি করেছিল বাড়িগুলো। বর্তমানের পর্যটকরা পাহাড়ি শহরের বাজার এলাকা বা সিনেমার কাছেই থাকতেই পছন্দ করে। আর ওক, ম্যাপল ও দেবদারুর মধ্যে তৈরি ওই পুরনো বাড়িগুলোর বাসিন্দা হচ্ছে বুনো বিড়াল, পেঁচা, ছাগল ও অন্যান্য প্রাণী আর তার সঙ্গে মাঝে মাঝে সাময়িক অবস্থানকারী হচ্ছে খচ্চর চালক এবং কাঠকয়লা প্রস্তুতকারী মানুষেরা।
কিন্তু এসব অবহেলিত, সুরম্য ভবনের মধ্যে দেখা যায় একটা পরিচ্ছন্ন, রং-ফেরানো বাড়ি। বাড়িটার নাম মালবেরি লজ। আর এই বাড়িটায় অল্প কিছুদিন আগেও মিস ম্যাকেঞ্জি নামে একজন বয়স্ক, অবিবাহিত ইংরেজ রমণী বাস করতেন।
কয়েক বছর আগেও তাকে বয়স্ক বললে ঠিক বলা হতো না, কারণ তার বয়স ছিল আশি বছরের অনেক ওপরে। কিন্তু সেটা বোঝা যেত না। তিনি ছিলেন পরিচ্ছন্ন, প্রাণবন্ত এবং পুরনো হলেও ভালোভাবে সংরক্ষণ করা পোশাক পরতেন। সপ্তাহে একদিন দুই মাইল হেঁটে শহরে যেতেন মাখন, জ্যাম আর সাবান কিনতে। মাঝে মাঝে ছোট এক বোতল ওডি কোলনও কিনতেন।
তিনি তাঁর বালিকা বয়স থেকেই এই পাহাড়ি শহরে বাস করে আসছেন। সময়টা ছিল বোধহয় প্রথম মহাযুদ্ধের আগে। যদিও তিনি কখনো বিয়ে করেননি, সে-কারণেই তাঁর জীবনে একাধিকবার প্রেম এসেছে, তবুও তিনি উপন্যাসের হতাশ প্রেমিকাদের মতো ছিলেন না মোটেও। তাঁর বাবা-মা মারা গেছেন, তাও প্রায় তিরিশ বছর হতে চলল। তাঁর ভাই-বোনেরাও মারা গেছেন। ভারতে তাঁর কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। তিনি সামান্য একটা চল্লিশ টাকার মাসোহারা আর নিউজিল্যান্ড থেকে পাঠানো তাঁর কোন যৌবনকালের বন্ধুর উপহার প্যাকেটের ওপর নির্ভর করে বেঁচে ছিলেন।
অন্যান্য নিঃসঙ্গ প্রবীণ ব্যক্তির মতো তাঁরও একটা পোষা প্রাণী ছিল। মেটি ছিল হলুদ চোখওয়ালা একটা বড়সড় কালো বেড়াল। তাঁর ছোট্ট বাগানে তিনি ডালিয়া, ক্রিসেনথিমাম আর গ্লাডিওলাসের চাষ করতেন। তাঁর কিছু অর্কিডও ছিল। তিনি চারাগাছ, বুনো ফুল, বৃক্ষ, পাখি এবং কীটপতঙ্গ সম্বন্ধে অনেক খবর রাখতেন। এসব নিয়ে তিনি কখনো গুরুত্বসহকারে পড়াশোনা করেননি; কিন্তু তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে দীর্ঘকাল বসবাস করার ফলে তাদের প্রতি তাঁর একটা সহমর্মিতা তৈরি হয়েছিল।
খুব সামান্য কয়েকজন মানুষ তাঁর কাছে আসা-যাওয়া করতেন। মাঝে মাঝে স্থানীয় গির্জার পাদ্রি আসতেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। মাসে একবার করে আসত ডাকপিয়ন, তাঁকে নিউজিল্যান্ড থেকে আসা উপহারের প্যাকেট বা তাঁর মাসোহারার কাগজ দিতে। একদিন অন্তর আসত গোয়ালা, লেডি এবং তাঁর বেড়ালের জন্য এক লিটার করে দুধ দিতে। মাঝে মাঝে তিনি বিনামূল্যে একজোড়া করে ডিম পেতেন। কারণ ডিমওয়ালা মনে রাখতেন, তাঁর সৌভাগ্যের দিনে মিস ম্যাকেঞ্জি তাঁর কাছ থেকে একসঙ্গে অনেক ডিম কিনতেন। তিনি ছিলেন একজন হৃদয়বান মহিলা। গোয়ালা এখনো তাঁর মধ্যে বিশোর্ধ্ব এক পরমা সুন্দরী নারীর ছবি দেখতে পান, যেমনটি এক নয় বছরের বালক বিস্ময় এবং বিহ্বলতা নিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত তাঁর দিকে।
এখন সেপ্টেম্বর মাস, বর্ষার আয়ু ফুরিয়ে আসছে। মিস ম্যাকেঞ্জির বাগানে আপনা থেকেই ক্রিসেনথিমাম ফুটতে শুরু করেছে। তাঁর মনে হচ্ছে, আগামী শীতকাল খুব মারাত্মক হবে। কারণ তিনি লক্ষ করেছেন, দিন দিনই ঠান্ডা সহ্য করা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে উঠছে।
একদিন যখন তিনি তাঁর বাগানে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, দেখলেন এক স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে তাঁর কটেজের ঢাল থেকে বুনো ফুল তুলতে।
‘ওখানে কে?’ তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন। ‘এই ছেলে, তুমি ওখানে কী করছো?’
ছেলেটা সতর্ক ভঙ্গিতে পাহাড়ের গা বেয়ে পালাতে চেষ্টা করল; কিন্তু পাইন নিড্লে পা পিছলে সে মিস ম্যাকেঞ্জির নামটারশিয়াম বেডের ওপর এসে পড়ল।
যখন সে বুঝল পালানোর আর কোনো পথ নেই, সে গালভরা এক হাসি দিয়ে বলল, ‘সুপ্রভাত মিস।’
ছেলেটি ছিল স্থানীয় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র। তার পরনে ছিল উজ্জ্বল লাল রঙের কোট আর লাল-কালো দাগ দেওয়া টাই। ভারতের সকল বিনয়ী স্কুলছাত্রের মতো সেও সব ভদ্রমহিলাকে ‘মিস’ নামে সম্বোধন করে।
‘সুপ্রভাত’ – মিস ম্যাকেঞ্জি বেশ কড়াভাবে উত্তর দিলেন। ‘তুমি কি আমার ফুলের বেডের ওপর থেকে সরে দাঁড়াবে?’
ছেলেটি অতি সতর্কভাবে নমটারশিয়াম বেড থেকে সরে দাঁড়িয়ে মিস ম্যাকেঞ্জির দিকে তাকাল। চোখে তার করুণ দৃষ্টি, গালে টোল। তার প্রতি ক্রুদ্ধ হওয়া অসম্ভব।
‘তুমি না বলে আমার বাগানে ঢুকেছো’, মিস ম্যাকেঞ্জি বললেন।
‘হ্যাঁ মিস।’
‘তাহলে তুমি এখানে কী করছো?’
‘ফুল তুলছি, মিস।’ একগোছা ফান আর বুনো ফুল উঁচু করে দেখাল সে।
‘ওহ্’, মিস ম্যাকেঞ্জির রাগ অনেকটা নেমে গেল। বহুদিন হলো তিনি কোনো ছেলেকে ফুলের প্রতি আগ্রহী হতে দেখেননি। আর তার চেয়েও বেশি, স্কুল পালিয়ে সে ফুল সংগ্রহ করতে এসেছে।
‘তুমি ফুল ভালোবাসো?’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।
‘হ্যাঁ, মিস। আমি একজন বোটান – বোটানটিস্ট হতে চলেছি?’
‘তার মানে একজন বোটানিস্ট।’
‘হ্যাঁ, মিস।’
‘তাই, কথাটা কেমন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তোমার বয়সের সময়ে প্রত্যেকটি ছেলেই পাইলট, সৈনিক বা প্রকৌশলী হতে চায়। কিন্তু তুমি একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী হতে চাও। ভালো, ভালো। পৃথিবীতে এখনো কিছু আশা করার আছে দেখছি। আর তুমি কি এই ফুলগুলোর নাম জানো?’
‘এই ফুলটার নাম বুখিলো’ – ছেলেটি তার হাতের ছোট একটা সোনালি রঙের ফুল দেখিয়ে বলল। ‘এটা একটা পাহাড়ি নাম। এর অর্থ পূজা অথবা প্রার্থনা। এ-ফুল পূজায় দেওয়া হয়। কিন্তু আমি জানি না এটার …।’
সে একটা গোলাপি ফুল উঁচু করে দেখাল, যার পাতাগুলো নরম এবং হৃদপিণ্ডের মতো দেখতে।
মিস ম্যাকেঞ্জি বললেন, ‘এগুলো বুনো মেগোনিয়া আর ওই লাল রঙেরটা স্যালভিয়া, কিন্তু ওটা বুনো নয়। ওটা কোনোভাবে আমার বাগান থেকে ওখানে গিয়ে পড়েছে। তোমার ফুলের বিষয়ে কোনো বই নেই?’
‘না, মিস।’
‘ঠিক আছে, তুমি ভেতরে এসো, আমি তোমাকে একটা বই দেখাচ্ছি।’
তিনি ছেলেটিকে পথ দেখিয়ে সামনের একটা ছোট ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটা বই, আসবাবপত্র, ফুলদানি আর জ্যামের জারে ভর্তি। তিনি ছেলেটিকে একটা চেয়ার দিলেন বসতে। সে অদ্ভুতভাবে চেয়ারটার কানার ওপর বসল। কালো বেড়ালটা সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে তার হাঁটুর ওপর চড়ে বসে সজোরে গরগর শব্দ করতে লাগল। বইগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে মিস ম্যাকেঞ্জি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম কী?’
‘অনিল, মিস।’
‘তুমি কোথায় থাকো?’
‘স্কুল বন্ধ হলে আমি দিল্লি চলে যাই। আমার বাবা ব্যবসা করেন।’
‘ওহ্, তাঁর ব্যবসাটা কিসের?’
‘বাল্বের মিস।’
‘ফুলের বাল্ব?’
‘না, বৈদ্যুতিক বাল্বের।’
‘বৈদ্যুতিক বাল্ব। তাহলে যখন তুমি বাড়ি যাও, আমাকে কয়েকটা বাল্ব পাঠাতে পারো। আমার বাল্বগুলো অনবরত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আর আজকালকার প্রতিটা জিনিসের মতো ওগুলোও খুব দামি। আহ্ বইটা পেয়েছি।’ তিনি তাক থেকে একটা ভারি বই বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। বইটার নাম ফ্লোরা হিমালিয়েন্সিস, প্রকাশকাল ১৮৯২। ‘সম্ভবত এই বইটার দ্বিতীয় কোনো জুড়ি ভারতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটা খুব মূল্যবান একটা বই, অনিল। অন্য কোনো প্রকৃতিবিদ তাঁর বইয়ে হিমালয়ের এতো ফুলের বর্ণনা দিয়ে যেতে পারেননি। আর আমি তোমাকে বলছি, হিমালয়ে এমন অনেক ফুল ও গাছ আছে যার বর্ণনা কোনো শৌখিন উদ্ভিদবিদের জানা নেই, যাঁরা তাঁদের সারাটা সময় অনুবীক্ষণ নিয়ে গবেষণাগারে কাটিয়ে দেন; কিন্তু তুমি হয়তো একদিন এ ব্যাপারে কিছু করে দেখাতে পারবে।’
‘হ্যাঁ, মিস।’
তারা দুজন মিলে বইটা ঘাঁটতে লাগলেন। মিস ম্যাকেঞ্জি কয়েকটা ফুল দেখালেন, যেগুলো ওই পাহাড়ি শহরের আশেপাশে জন্মায়। ছেলেটা ওই ফুলগুলোর নাম আর তাদের প্রস্ফুটনের কাল টুকে রাখছিল। তিনি একটা স্টোভ ধরিয়ে কেটলিতে চায়ের জল চাপালেন। তারপর ওই বয়স্ক ইংরেজ মহিলা আর ছোট ভারতীয় বালকটি মিলে, মিষ্টি গরম চায়ের কাপ হাতে পাশাপাশি বসে একটা বুনো ফুলের ওপর রচিত বইয়ের মধ্যে ডুবে গেলেন।
যখন চলে যাওয়ার সময় হলো অনিল জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি কি আবার আসতে পারি?’
মিস ম্যাকেঞ্জি বললেন, ‘তুমি যদি চাও, আসতে পারো। তবে স্কুলের সময় এসো না। কিছুতেই ক্লাস ফাঁকি দেবে না।’
তারপর থেকে অনিল সপ্তাহে একদিন করে মিস মাকেঞ্জির কাছে যেত এবং প্রায় প্রতিটা সময় শনাক্ত করার জন্য হাতে করে একটা বুনো ফুল নিয়ে যেত। তিনিও ছেলেটার আসার পথ চেয়ে থাকতেন। আর যদি সপ্তাহ শেষ হলেও সে না আসত, তিনি হতাশ হয়ে একা একা কালো বেড়ালটার সঙ্গে গজগজ করতেন।
অনিল তাঁকে তাঁর ভাইয়ের ছেলেবেলার কথা মনে করিয়ে দিত। চেহারায় তাদের কোনো মিল ছিল না। অ্যান্ড্রুর ছিল সাদা চুল আর নীল চোখ। কিন্তু অনিলের আগ্রহ, আর তারপর উজ্জ্বল চাউনি, সে যেভাবে দাঁড়াত – পা দুটো ফাঁক করে, হাত কোমরের পেছনে দিয়ে, যেন একটা আত্মবিশ্বাসের ছবি – সব তাঁকে সেই ছেলেটার কথা মনে করিয়ে দিত, যাঁর সঙ্গে এই পাহাড়ে তিনি তাঁর যৌবনে অনেক কিছু ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।
অনিল কেন এতো ঘন ঘন তাঁর সাথে দেখা করতে আসত? প্রথমত, তিনি ফুল সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতেন আর তার সত্যিকার ইচ্ছে, বড় হয়ে একজন উদ্ভিদবিদ হওয়ার। দ্বিতীয়ত, তাঁর গা থেকে সদ্য বানানো রুটির গন্ধ বেরোত, যা ছিল তার দিদার গায়ের গন্ধের মতো। তৃতীয়ত, তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ, আর কখনোও কখনো একজন বারো বছর বয়সের বালক একজন বড় মানুষের চেয়ে ভালোভাবে নিঃসঙ্গতাকে অনুভব করতে পারে। চতুর্থত, কারণ সে ছিল অন্য ছেলেদের চেয়ে কিছুটা আলাদা।
অক্টোবরের মাঝামাঝি, যখন স্কুল বন্ধ হতে মাত্র পনেরো দিনের মতো বাকি, দূর পাহাড়ের ওপর প্রথম বরফ পড়লো। একটা পাহাড়চূড়া অন্যদের থেকে অনেক ওপরে তার সাদা মাথা উঁচু করে রেখেছিল নীল আকাশের বুকে। যখন সূর্য অস্ত যেত ওই চূড়াটা রং পাল্টাত – প্রথম সে কমলা, তারপর সোনালি, তারপর গোলাপি আর সবশেষে লাল হয়ে যেত।
অনিল জিজ্ঞাসা করল, ‘ওই চূড়াটা কত উঁচু?’
মিস ম্যাকেঞ্জি বললেন, ‘অবশ্যই ওটা বারো হাজার ফুটের বেশি হবে। সোজা পথে ওটা ত্রিশ মাইল হবে এখান থেকে। আমার সবসময় খুব ইচ্ছে হতো ওখানে যাওয়ার; কিন্তু ওখানে যাওয়ার কোনো সত্যিকার রাস্তা নেই। ওই উচ্চতায় যেসব ফুল ফোটে তাদের তুমি এখানে পাবে না – ব্লু জেনশিয়ান, পার্পন কলাম্বাইন, এনেমন, এডেল্টইস।’
‘আমি একদিন ওখানে যাব’, অনিল বলল।
‘আমি নিশ্চিত, তুমি যদি সত্যি ইচ্ছা করো, তাহলে একদিন ওখানে যাবেই।’
স্কুল বন্ধ হওয়ার আগের দিন অনিল গেল মিস ম্যাকেঞ্জিকে বিদায় জানাতে। তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয়, দিল্লিতে তুমি কোনো বুনো ফুল খুঁজে পাবে না। তবু, তোমার ছুটিটা ভালো কাটুক।’
‘ধন্যবাদ, মিস।’
যখন সে ওই স্থান ত্যাগ করতে উদ্যত হলো, মিস ম্যাকেঞ্জি মুহূর্তের তৎপরতায় ফ্লোরা হিমালিয়েন্সিস বইটা অনিলের হাতে গুঁজে দিলেন।
‘তুমি এটা রাখো’, তিনি বললেন। ‘এটা তোমার জন্যে একটা উপহার।’
‘কিন্তু আমি তো পরের বছর এখানে ফিরে আসব, আর তখন আমি এটা দেখতে পারব। এটা এতো দামি।’
‘আমি জানি এটা দামি আর তাই আমি এটা তোমাকে দিচ্ছি। না হলে এটা গিয়ে পড়বে আবর্জনা ক্রেতাদের হাতে।’
‘কিন্তু, মিস …।’
‘কোনো কথা বলো না। তাছাড়া, পরের বছর আমি এখানে নাও থাকতে পারি।’
‘আপনি কি কোথাও চলে যাবেন?’
‘আমি নিশ্চিত নই। আমি ইংল্যান্ডে যেতে পারি।’
তাঁর ইংল্যান্ডে যাওয়ার কোনোই বাসনা ছিল না। ছেলেবেলার পর আর কোনোদিনই তাঁর দেশটি দেখা হয়নি। তিনি জানতেন, যুদ্ধোত্তর ইংল্যান্ডে তিনি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবেন না আর। তাঁর বাড়ি এই পাহাড়ে, ওক, ম্যাপল আর দেবদারুর মাঝেই। এ জায়গাটা বড়ই নির্জন, কিন্তু তাঁর বয়সে সব জায়গাই নির্জন।
ছেলেটা বইটি বগলের নিচে রেখে, টাইটা সোজা করল, নিজে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল এবং তাঁকে বলল, ‘বিদায়, মিস ম্যাকেঞ্জি।’
প্রথমবারের মতো সে লেডির নাম উচ্চারণ করলো।
সেবার শীত এলো তাড়াতাড়ি। জোর বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টি আর বরফ কুচি পড়তে লাগল। দেখতে দেখতে বাগান আর পাহাড় ফুলশূন্য হয়ে গেল। বেড়ালটা কুণ্ডলী পাকিয়ে মিস ম্যাকেঞ্জির পায়ের কাছে শুয়ে থাকল। ঘর থেকে বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিলো বেড়ালটি।
মিস ম্যাকেঞ্জি তাঁর যা কিছু পুরনো শাল, মাফলার ছিল সব দিয়ে জড়ালেন নিজেকে। তবু তাঁর শীত গেল না। তাঁর আঙুলগুলো এতোই শক্ত হয়ে গেল যে, একটা সেদ্ধ সিমের কৌটো খুলতে লেগে গেল এক ঘণ্টা। তারপর কয়েকদিন ধরে একটানা বরফ পড়ল। দুধওয়ালা আসা বন্ধ করলো। ডাকপিয়ন তাঁর মাসোহারার কাগজ নিয়ে এলো; কিন্তু তিনি এতোই ক্লান্ত বোধ করছিলেন যে ওই কাগজ নিয়ে শহরে যাওয়ার তাঁর সামর্থ্য ছিল না।
তিনি অধিকাংশ সময় কাটাতেন বিছানায়। ওটাই ছিল সবচেয়ে গরম জায়গা। তিনি তাঁর পিঠের কাছে গরম জলের বোতল রাখতেন আর বেড়ালটা তাঁর পা গরম রাখত। তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে গ্রীষ্ম আর বসন্তের দিনগুলোর কথা ভাবতেন। তিন মাসের মাথায় প্রাইমরোজ ফুল ফুটবে আর বসন্তে ফিরবে ছেলেটা।
এক রাতে গরম জলের বোতল ফেটে ভিজে গেল বিছানাটা। একটানা সূর্যের দেখা না মেলায় কম্বলটা শুকানো সম্ভব হলো না। মিস ম্যাকেঞ্জির খুব ঠান্ডা লাগল এবং ভেজা ও কষ্টদায়ক বিছানায় শুয়ে থাকতে হলো তাঁকে। তিনি বুঝতে পারছিলেন তাঁর গায়ে জ্বর; কিন্তু জ্বর মাপার জন্য তাঁর কোনো থার্মোমিটার ছিল না। শ্বাস নিতে তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছিল।
এক রাতে একটা জোর বাতাস বইলো। তাতে জানালাটা খুলে গিয়ে সারারাত ঘটাং ঘটাং শব্দ করল। উঠে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করার মতো শক্তি ছিল না মিস ম্যাকেঞ্জির। বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টি আর বরফকুচি এসে ভরে গেল ঘর। বেড়ালটা গুটিসুটি মেরে বিছানার ভেতর তার মালিকের গরম শরীরের কাছে গিয়ে আশ্রয় নিল। কিন্তু সকাল হতেই ওই শরীর তার সকল উত্তাপ হারাল এবং বেড়ালটা বিছানা ছেড়ে মেঝেতে আঁচড়াতে লাগল।
সূর্যের একটা রশ্মি খোলা জানালা দিয়ে ঘরে এসে পড়লো। দুধওয়ালা এলেন। তিনি দরজার পাশে রাখা সরাতে বেড়ালটার জন্যেও একটু দুধ ঢেলে দিলেন আর বেড়ালটা জানালা দিয়ে নেমে এগিয়ে গেল সেই দুধের দিকে।
দুধওয়ালা মিস ম্যাকেঞ্জিকে অভিবাদন জানালেন;
কিন্তু কোনো প্রত্যুত্তর পেলেন না। তাঁর জানালা খোলাই
থাকল। দুধওয়ালা জানতেন তিনি সবসময় সূর্যোদয়ের
আগেই ঘুম থেকে ওঠেন। তাই খোলা জানালার ভেতর মাথা গলিয়ে তিনি ডাকলেন লেডিকে। কিন্তু কোনো উত্তর
দিলেন না মিস ম্যাকেঞ্জি। ততক্ষণে তিনি চলে গেছেন সেই পাহাড়ে যেখানে ব্লু জেনশিয়ান আর লাল কলাম্বাইন ফুটে থাকে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.