বনুট অথবা চিহ্ন

বৃষ্টি হলে, মনে হয়, আমি ঐ বৃষ্টির জলের
সঙ্গে ঢুকে মিশে যাবো পড়ে থাকা ভুবনে, মাটিতে –
কেন যাবো?

  • শক্তি চট্টোপাধ্যায়

ক্যানভাসের আকৃতিগুলি একে একে মিশে যায় জলের ধোয়ায়। আকারগুলো বিচ্ছিন্ন কিন্তু পুরো আয়তনের মাঝে ঐক্য গড়ে উঠেছে। এভাবে কাজী গিয়াসউদ্দিন ছবিতে স্বতন্ত্র ভাষা নির্মাণ করেন। জলরং আর তেলরঙের প্রথাগত বিন্যাস আর বক্তব্যপ্রধান ক্যানভাসে কাজী গিয়াসউদ্দিন থেমে থাকেননি। তাঁর ক্যানভাস এক পলকে বাংলার প্রকৃতির কাছে নিয়ে যায়। নিসর্গের মাঝে পরিবর্তিত হতে থাকা রং আর আকৃতি তাঁর ক্যানভাসের বিষয়।
নতুন রূপে গড়ে ওঠা বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের সুবীর চৌধুরী প্রদর্শনী কক্ষ ও কামরুল হাসান প্রদর্শনী কক্ষক্ষ প্রদর্শিত মোট কাজের সংখ্যা ৭৩টি; ছোট-বড় এসব কাজের মাধ্যম তেলরং ও জলরং। নির্বাচিত কিছু রঙের ব্যবহারের সঙ্গে কাজী গিয়াসউদ্দিন ছবিতে আলোছায়ার প্রক্ষেপণ, আকৃতির বিন্যাস, রেখা ও বুনটের মাধ্যমে ছবির বিষয় প্রকাশ করেছেন। একটু পিছিয়ে গিয়ে কাজী গিয়াসের কাজে মনোযোগী হলে দেখা যায় ২০১৫ সালের একক প্রদর্শনীর কাজে ধূসর রঙের মাঝে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার। এতে ক্যানভাসে রঙের প্রলেপ আকৃতি ও বুনটের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। আগের প্রদর্শনীর ক্যানভাসের সঙ্গে এবারের প্রদর্শনীর কাজের পার্থক্য হলো ধূসর ও শান্ত রঙের ব্যবহার।
কাজী গিয়াসউদ্দিনের কাজ আমাদের কী বার্তা দেয়? এ-প্রশ্ন সাধারণের কাছে উঠতে পারে। কাজী গিয়াস তাঁর কাজে প্রথাগত আলোছায়া আর অবয়বনির্ভর ফটোগ্রাফিক প্রকাশভঙ্গিতে বিশ্বাস করেন না। তিনি বুনট আর আকৃতির মধ্যে রঙের যোগাযোগ তৈরি করে দেন। রঙের ধোয়ায় আকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়, যেটি কখনো নির্দিষ্ট একটি শব্দ, অথবা বুনটের কথা বলে।
বাংলাদেশের প্রকৃতি কাজী গিয়াসউদ্দিনের ছবির বিষয়। কোনো কোনো ছবির বিষয়ের শিরোনাম হয় এমন – ‘আন্ডার দ্য স্কাই’ বা ‘আকাশের নিচে’। এমন শিরোনামের ছবিতে আমরা দেখি আকাশের মাঝে চলতে থাকা মেঘের সারি। ধূসর, নীলাভ, স্বচ্ছ মেঘের জমিনে আকৃতিগুলো আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় না। একটি আরেকটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। এক আকৃতির সঙ্গে আরেকটি আকৃতির সমন্বয় ক্যানভাসকে স্বস্তি দিয়েছে। অন্য আরেকটি ক্যানভাসে যখন ‘স্টোন ফ্লাওয়ারে’র কথা বলেন, সেখানে শুধু পাথরের বাইরের অবয়ব দেখা যায়। নিরেট পাথরের গায়ে জমে থাকা জ্যামিতিক বিন্যাসকে কাজে প্রকাশ করেন। তাঁর ক্যানভাসের সবটুকুতেই রং আর বুনটের উপস্থিতি বিষয়কে বিসত্মৃত করে। কাজগুলো নিয়ে নিজের বয়ান এমন – ‘ছবিতে আমি আমার আনন্দকে নির্মাণ করি, প্রকৃতিকে সরাসরি অনুকরণ করি না। আমি আকৃতির ভেতরের আকৃতিকে ছবিতে প্রকাশ করি।’ এক্ষেত্রে পল ক্লির জ্যামিতিক অভিব্যক্তিবাদী প্রকাশভঙ্গি উল্লেখ করা যায়। পল ক্লি বাস্তবধর্মী প্রকৃতির অবয়বকে ভেঙে অবয়বের ভেতরে থাকা রঙের বিন্যাস গ্রহণ করেছেন। এক্ষেত্রে কাজী গিয়াসের কাজের সঙ্গে মিল দেখা যায়।
কাজী গিয়াসউদ্দিন প্রকৃতির রং-আকৃতির পাশাপাশি সংগীতে ব্যবহৃত সুরের মূর্ছনা গ্রহণ করেন। সুরের যে তাল, লয়, ঝংকার রয়েছে, এটি তাঁর ছবিতে প্রকাশ পেয়েছে।
উনিশ শতকের শুরুর দিকে সাড়া জাগানো শিল্পকলার আন্দোলন ‘এক্সপ্রেশনিজম’। সে-আন্দোলনের মূল সুর ছিল শিল্পকর্মে অভিব্যক্তির মাধ্যমে অর্থ প্রকাশ করা। আবেগজাত অভিজ্ঞতাকে বাস্তবধর্মী অবয়বের চেয়ে বেশি মূল্য দেওয়া।
কাজী গিয়াসউদ্দিনের শিল্পকর্মে আমরা অভিব্যক্তির প্রকাশ দেখি। এখানে বস্ত্তর সঙ্গে শিল্পীর প্রকাশভঙ্গির ঐক্য তৈরি হয়।
বস্ত্ত, রং, আকৃতি আর বুনট মিলে একধরনের অভিব্যক্তি তৈরি হয়। এক্ষেত্রে চিহ্ন বা প্রতীকের কথা আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। জলরং ও তেলরঙের ঘন নিবদ্ধ বুনটের সাহায্যে তিনি যে প্রকাশচিহ্ন তৈরি করেন তা বাংলাদেশের শিল্পকলায় নতুন আবহ তৈরি করে, এটা বলা যায় না। বলা ভালো, বর্ণলেপনের নিরীক্ষায় তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ঐক্য গড়ে তুলেছেন। ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরো আয়ত আকৃতির ভেতর থেকে গোলাকার, অর্ধগোলাকার, ত্রিভুজাকৃতি তৈরি করেন শান্ত কোমল রঙের ব্যবহারে। এ-প্রদর্শনীর কাজে বিশাল ব্যাপ্তির উন্মুক্ত সারফেসে আকৃতি, বুনট
ও রেখা শান্ত-ধীর অনুভূতি প্রকাশ করে। প্রকৃতির স্বচ্ছ রূপকল্প ক্যানভাসে হাজির করে শান্ত-স্থিত রঙের স্থাপন দর্শকদের মাঝে জিজ্ঞাসার সুর তৈরি করে। বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে ‘দ্য ওয়ার্ক অব ক্রিয়েশন’ শিরোনামে এ-প্রদর্শনী শুরু হয় ৫ এপ্রিল, শেষ হয় ১৮ মে।