অনুবাদ : সুব্রত বড়ুয়া
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, দর্শনশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, লেখক ও রাজনীতিক অধ্যাপক হুমায়ুন কবির ১৯৬৭ সালে আমন্ত্রিত হয়ে আমেরিকার ম্যাডিসনের ইউনিভার্সিটি অব ভিসকনসিন-এ ‘টেগোর মেমোরিয়াল লেকচার’ প্রদান করেন। তাঁর এই চারটি বক্তৃতা পরবর্তীকালে ১৯৬৮ সালে The Bengali Novel নামে কলকাতা থেকে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এটিও মোট চারটি অংশে উপস্থাপিত হয়েছে। সে অংশগুলি হলো যথাক্রমে : (1) Bankimchandra and the birth of the Bengali Novel; (2) Rabindranath Tagore; (3) Sarat Chandra Chatterjee and the Realistic Novel; Ges (4) The Novel in Contemporary Bengal| হুমায়ুন কবিরের জন্ম ১৯০৬ সালে, মৃত্যু ১৯৬৯ সালে। কালি ও কলম-এর এই সংখ্যায় গ্রন্থটির চতুর্থ অংশটির বঙ্গানুবাদ পত্রস্থ করা হলো।
সমকালীন বাঙলা উপন্যাস নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে প্রধান অসুবিধাগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে এর নির্দিষ্ট রূপহীন চরিত্র এবং পূর্ববর্তী সময়কালগুলির সঙ্গে ধারাবাহিকতার অভাব। বস্তুত, এ-কথা বলার পর আমরা হয়তো আরও এগিয়ে যেতে পারি এবং জিজ্ঞেস করতে পারি, সমকালীন কথাটির অর্থ কী। দৃষ্টিভঙ্গির একটি দিক থেকে এই শতাব্দীর [বিংশ] পুরোটা সময়কালকেই সমকালীন গণ্য করা যায়। তবে অন্যরা হয়তো শুধু এর শেষ দশক বা তদনুরূপ সময়কালকেই সমকালীন গণ্য করবেন। এই আলোচনার ক্ষেত্রে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকাল ও শতাব্দীর মধ্যকালের সমাপ্তি পর্যন্ত সময়কাল নির্দেশ করার জন্য। এটি হয়তো যদৃচ্ছ মনে হতে পারে, তবে আলোচনা একটি যুক্তিযুক্ত সময়সীমার মধ্যে সীমিত রাখার জন্য এ-ধরনের কিছু সংজ্ঞা নির্ধারণের প্রয়োজন হয়।
উপর্যুক্ত বর্ণনা অর্থে সমকালীন বাঙলা উপন্যাস বহু রূপ পরিগ্রহ করেছে। যদিও পুরোনো ঐতিহ্য পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়নি – মানবিক বিষয়াবলির ক্ষেত্রে খুব কদাচিৎ তা সম্পূর্ণ নতুন ধরনও গ্রহণ করেনি – নতুন লেখকদের মনমেজাজ তাঁদের মহান পূর্বসূরিদের চেয়ে খুবই ভিন্ন। বঙ্কিমের যুগ ভারতীয় নবজাগরণের সূচনা প্রত্যক্ষ করেছিল, কিন্তু এর পূর্ণতা অর্জন প্রত্যক্ষ করেনি। বস্তুত, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বঙ্কিম নবজাগরণ প্রক্রিয়াকে ধীরতর করেছিলেন এবং কেউ কেউ এখনও বলতে চাইবেন যে, এই পূর্ণতা অর্জন এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন ও লেখার মধ্য দিয়ে নবজাগরণকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সবসময় কিছুটা দূরবর্তী ও নিরাসক্ত থেকে গিয়েছিলেন। বাঙলার মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করত, কিন্তু অনেকেই তাঁর বার্তা গ্রহণ করেনি এবং তিনি তাঁর আদর্শ অনুযায়ী বাঙলার মানুষকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সফল হতে পারেননি। তাঁর ব্যাপক প্রভাব সত্ত্বেও তিনি যেসব মূল্যবোধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন সেগুলি এখনও বাঙলার মানুষের
স্বভাব-প্রকৃতির কাছে ব্যাপক পরিমাণে অচেনাই রয়ে গেছে। শরৎ চন্দ্র একই ধারা অনুসরণ অব্যাহত রেখেছিলেন, কিন্তু কুসংস্কার ও ভাবালুতার অদ্ভুত এক মিশ্রণ দ্বারা তিনি নবজাগরণের প্রভাবগুলিকে তরলবৎ করে ফেলেছিলেন।
অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাদীক্ষা, মানসিক গঠন ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এই তিন লেখকের সবাই তাঁদের উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ছিলেন প্রধানত বুদ্ধিবৃত্তিক। তাঁদের পর থেকে একটি নতুন ধারার সূচনা ঘটেছে, যে-ধারায় বাঙলা উপন্যাস হয়ে উঠেছে প্রধানত প্রতিবুদ্ধিবৃত্তিক। এই বিষয়টি নিয়ে আমরা পরে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব এবং এখানে এ-কথা বলাই যথেষ্ট হবে যে, এই ধারার বিকাশে ফ্রয়েড এবং মার্কসের প্রভাব যেমন রয়েছে তেমনি সে-প্রভাব রয়েছে সারা বিশ^জুড়ে প্রতিবুদ্ধিবৃত্তিকতার বিকাশের ক্ষেত্রেও। ফ্রয়েড অসচেতনতাকে উচ্চতায় তুলে ধরেছিলেন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকাকে নিচে নামিয়ে এনেছিলেন। মার্কস তাঁর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও অর্থনৈতিক নিয়তিবাদের ওপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে ব্যক্তিক উদ্যোগ ও মুক্তচিন্তার গুরুত্বকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলেন। মার্কসের প্রভাব তরুণ ভারতীয় ঔপন্যাসিকদের শ্রেণিসংগ্রামভিত্তিক কাহিনি রচনার দিকে চালিত করেছিল আর ফ্রয়েডের প্রভাব কখনো কখনো তাঁদের নিয়ে গিয়েছিল
যৌন-আবিষ্টতার দিকে। রবীন্দ্রনাথ এই নতুন প্রবণতাগুলির বিষয়ে সংশয়াচ্ছন্ন ছিলেন এ-কারণে নয় যে, তিনি নতুনত্বের বিরোধী ছিলেন, বরং এ-কারণে যে, তাঁর দৃষ্টিতে সেগুলি কোনো প্রকৃত ভারতীয় বিকাশের প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং পাশ্চাত্য-প্রভাব অনুকরণের রূপায়ণ মাত্র।
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমরা উল্লেখ করতে পারব শুধু কয়েকটি প্রবণতার যেগুলি পূর্বোক্ত সর্বশেষ পর্যায়ের লেখকদের আলোড়িত করেছে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় একজন জন্মগত কাহিনিকথক। বুদ্ধদেব বসুর রয়েছে খণ্ডিত ব্যক্তিত্ব যাঁর লেখা সবসময় সম্ভাবনাময়, কিন্তু কদাচিৎ তা পূর্ণতালাভ করেছে। প্রেমেন্দ্র মিত্র অধিকতর সংহত চরিত্রসম্পন্ন, কিন্তু একজন ঔপন্যাসিকের কর্মপ্রেরণা ও বিস্তারশক্তির অভাব রয়েছে তাঁর। সেজন্য তিনি অধিক সফল একজন কবি ও ছোটগল্পকার হিসেবে। অন্নদাশঙ্কর রায় বিরাট সম্ভাবনা দেখিয়েছিলেন যার যেথা দেশ বইটিতে, যা বাঙলা ভাষায় রচিত প্রধান উপন্যাসগুলির মধ্যে একটির প্রথম খণ্ড হতে পারত, কিন্তু যুক্তিতর্কের প্রতি তাঁর অনুরাগ পরবর্তী খণ্ডগুলিকে একঘেয়ে ও আকর্ষণহীন করে দিয়েছে। আদর্শগত বিতর্ক নিয়ে অতিরিক্ত ভাবনা রক্তমাংসের চরিত্র সৃষ্টির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং তা হয়ে ওঠে তাঁর অধিকাংশ সৃষ্টিশীল সাহিত্যের জন্য সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। পুতুলনাচের ইতিকথায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই পর্যায়ের স্বল্প কয়েকটি যথার্থ ও সংহত উপন্যাসের মধ্যে একটি রচনা করেছিলেন। অন্যদিকে বিষয়বস্তু ও রচনাকৌশলের জন্যও তিনি গুরুত্বপূর্ণ। গজেন্দ্রকুমার মিত্র খ্যাতি অর্জন করেন কলকাতার উপকণ্ঠের নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবন নিয়ে লেখা তাঁর নির্দয় ও বাস্তববাদী উপন্যাসের জন্য। মনোজ বসু হচ্ছেন আর একজন চমৎকার গল্প-বলিয়ে এবং পেশাদার সমালোচকদের বিবেচনার প্রতি কটাক্ষ করে বলা যায়, তিনি একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁর চমৎকার আনন্দদায়ক গল্পগুলির জন্য নয়, বরং চৌর্যবৃত্তির সামাজিক সমস্যাগুলি নিয়ে লেখা একটি উপন্যাসের জন্য। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত অপর একজন ঔপন্যাসিক যিনি তাঁর প্রথমদিককার লেখায় যে সম্ভাবনা দেখিয়েছিলেন পরবর্তীকালে তা অব্যাহত রাখতে পারেননি। তিনি অপরিহার্যভাবে একজন কবি এবং তিনি উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণকে ভিত্তি করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আশ্রয় খুঁজেছিলেন একান্তই আবেগমূলক অতীন্দ্রিয়বাদের মধ্যে।
আমরা এর আগে উল্লেখ করেছিলাম যে, শরৎ চন্দ্র তাঁর একেবারে শেষদিকের উপন্যাসগুলিতে হয়ে উঠেছিলেন একজন অন্ধবিশ^াসী তত্ত্ববাগীশ ও প্রচারক। ধর্ম ও রাজনীতি, সমাজ ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনসমূহের অভিঘাত কখনো কখনো তাঁর ভেতরের শিল্পীসত্তাকে আড়াল করে ফেলেছিল এবং বিদ্রোহের সুর হয়ে উঠেছিল প্রবল ও উচ্চনাদী। ভাবনাগুলি সবসময় পুরোপুরি আত্তীকৃত হয়নি এবং বহু নভোত্থিত দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমত স্বীকৃতির জন্য দাবি জানাচ্ছিল। এর ফলে তাঁর সর্বশেষ কাজগুলি ঘুরপাক খাচ্ছিল অনিশ্চয়তার মধ্যে। তা ছিল যা কিছু অবশ্যই হারিয়ে যেতে হবে সেসবের প্রতি অন্ধ আনুগত্যসহ নতুন পরিবর্তনগুলির সোৎসাহ অনুমোদন। তিনি যে-সমাজে জন্মেছিলেন সে-সমাজের প্রতি সংযুক্ততা নতুন এক তীক্ষèতা গ্রহণ করে, কিন্তু কখনো কখনো এর সঙ্গে শৈল্পিক দৃষ্টির বিরোধও সৃষ্টি হয়। এসব দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যেহেতু গভীর আবেগজনিত সংশ্লিষ্টতা থাকে, সেহেতু আমরা তাঁর অধিকাংশ রচনার মধ্যে সেই বিচ্ছিন্নতা দেখতে পাই না, যা সমকালীন পাশ্চাত্য জগতের অধিকাংশ সংবেদী লেখকের কয়েকজনের মধ্যে আমরা খুঁজে পাই। শরৎ চন্দ্রের সর্বশেষ রচনাগুলির এসব বৈশিষ্ট্য তাঁর উত্তরসূরিদের অনেকের লেখায় ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়।
প্রথম বিশ^যুদ্ধের পর থেকে বাঙলা উপন্যাসের পথ হয়ে দাঁড়ায় প্রসারণ ও বিখণ্ডীকরণ। বঙ্কিম প্রভাবিত হয়েছিলেন প্রধানত স্যার ওয়াল্টার স্কটের মডেল দ্বারা। দীর্ঘকাল ধরে ইংল্যান্ডের উপন্যাসের, বিশেষত স্কট এবং জর্জ এলিয়ট, ঐতিহ্য দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত ছিল বাঙলা উপন্যাস। ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি ছিল আরো বেশি এবং তাঁর রচনাগুলিতে আমরা উভয়ত রুশ ও ফরাসি শ্রেষ্ঠ লেখকদের প্রভাবের চিহ্ন খুঁজে পাই। তিনি সচেতনভাবে টলস্টয়ের ঐতিহ্য অনুসরণ করেননি, তবুও এক অর্থে আমরা তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস গোরায় টলস্টয়ের প্রভাব অনুভব করতে পারি। চতুরঙ্গ ও পরবর্তী উপন্যাসগুলিতে অনুভব করতে পারা যায় বিষয়বস্তুর চেয়ে বরং বুদ্ধিবৃত্তি ও শৈলীর ওপর জোর দেওয়ার প্রতি সচেতন সাযুজ্যের ফরাসি প্রভাব। শরৎ চন্দ্রও শ্রেষ্ঠ ফরাসি লেখকদের বাস্তববাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, কিন্তু আমরা ইতোমধ্যে যেমনটা দেখেছি, তিনি এমনকি আরো বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন চার্লস ডিকেন্সের দ্বারা।
ফরাসি প্রভাব সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট প্রমথ চৌধুরীর লেখায়, যিনি সাধারণভাবে পরিচিত ‘বীরবল’ নামে। তাঁর এই ছদ্মনাম পছন্দ করার ব্যাপারটিও গুরুত্বপূর্ণ। বীরবল ছিলেন সম্রাট আকবরের রাজসভার বাককুশল সভাসদ। তিনি বিখ্যাত তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও হাস্যরসজ্ঞতার জন্য। হাস্যরস এমন একটি উপাদান যা অধিকাংশ বাঙলা উপন্যাসে অনুপস্থিত, যেহেতু সাধারণত বাঙালিরা একান্তভাবে ভাবপ্রবণ মানুষ। বাস্তবিক পক্ষে, একজন বাঙালির ভাবানুভূতি এতো সহজেই ভাববিলাসিতায় পরিণত হয় যে, বাঙলা রচনার বড় একটি অংশ একজন বিদেশি পাঠকের জন্য অরুচিকর হয়ে দাঁড়ায়। প্রমথ চৌধুরী অনুভব করেছিলেন যে, ব্রিটিশ প্রভাব বাঙালিদের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, যেহেতু ব্রিটিশরাও তাদের ভাবালুতার জন্য কুখ্যাত। প্রমথ চৌধুরী ফরাসি ঐতিহ্যের শুষ্ক ধীশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক বক্রাঘাত আমদানি করে এই ত্রুটি সংশোধন করতে চেয়েছিলেন। তিনি বুদ্ধিবৃত্তি যা প্রকাশ করে সেই অসংগতিগুলিকে প্রাধান্য দিয়ে ধীশক্তি ও বক্রাঘাতকে তাঁর রচনাশৈলীর প্রধান উপাদানে পরিণত করেছিলেন। তখন পর্যন্ত অধিকাংশ বাঙালি লেখকের মধ্যে বর্তমান প্রধান যে ভাব সেই রোমান্টিকতাকে বিদ্রƒপ করে লেখার প্রয়াসে তিনি কখনও ক্লান্তিবোধ করেননি। প্রথম দেখাতেই প্রেমের সূত্রপাত বিষয়টিকে নিয়ে তিনি ব্যঙ্গবিদ্রƒপ করেছেন এবং চোর, পাগল ও সমাজের অন্য অবাঞ্ছিতদের মধ্য থেকে তাঁর নায়ক-নায়িকাদের গ্রহণ করে এ নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করেছেন। তাঁর কিছু গল্পের ইউরোপীয় পটভূমি নির্বাচন করেছেন তিনি এই বক্তব্যে পৌঁছার জন্য যে, বাঙলার অনড় সামাজিক পটভূমি প্রেমের সুযোগ খুব কমই দিয়ে থাকে – তা সে অবাধ কিংবা অন্য যে-কোনো প্রকারে হোক না কেন। এমনকি সবচেয়ে অবাধ রোমান্টিক কল্পনাশ্রয়গুলির মধ্যেও বাঙলা উপন্যাসে তাঁর সময়কাল পর্যন্ত সাধারণভাবে জাতপাত ও সামাজিক প্রথাগুলি যথাযথভাবে মেনে চলা হয়েছে। বীরবল এই ভানগুলিকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলেছেন এবং দেখিয়েছেন যে, মানবিক অনুভূতিগুলিকে পূর্বনির্ধারিত সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার যে-কোনো চেষ্টা শুধু সবচেয়ে অবাস্তব ঘটনাবলির দিকেই চালিত করবে। তিনি যে শুধু ছদ্মভাবালুতাকেই বিদ্রূপ করেছেন তা নয়, বরং ছদ্মসম্মানবোধের প্রতিও বিদ্রূপবাণ বর্ষণ করেছিলেন – যে সম্মানবোধ নিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলির ক্ষেত্রেও আমরা আমাদের অহংবোধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার চেষ্টা করি।
বীরবল প্রথমত একজন ঔপন্যাসিক ছিলেন না, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি বাঙলা উপন্যাসের বিকাশে গভীর প্রভাব রেখেছেন। তাঁর প্রথম ও সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল ভাবালুতাপূর্ণ ভাববিলাসিতার আবদ্ধ কক্ষের অভ্যন্তরে বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণের পরিচ্ছন্ন বায়ু নিয়ে আসা। রোমান্টিকতার বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধ তৎকালীন বাঙলা উপন্যাসে বাস্তবতার অধিকতর সতেজ হাওয়া নিয়ে এসেছিল এবং রবীন্দ্রনাথকেও একাধিক উপায়ে সাহায্য করেছিল। অকুতোভয় প্রাতিস্বিক প্রমথ চৌধুরী ব্যক্তিক বিচারের মূল্যের ওপর জোর দিয়েছিলেন এবং এভাবে তিনি তাঁর সমকালীন ও উত্তরসূরিদের মধ্যে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক বোধের বিকাশেও সাহায্য করেছিলেন। সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ সমকালীন উপন্যাসের রচনাশৈলী ও ভাষার উন্নয়নে তাঁর অবদান। তিনি বাঙালি ঔপন্যাসিককে আনুষ্ঠানিক গঠনকাঠামো ও ভাষার প্রতি আবিষ্টতা থেকে মুক্ত করেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন – আখ্যান ছাড়াই কিভাবে গল্প নির্মাণ করা যায়। সম্ভবত আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তিনি কথ্যভাষার সম্ভাবনাশক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন এবং উপন্যাস ও গল্প লেখার জন্য একে উপযোগী করে তুলেছিলেন সেই ভাষার মতো করে, যে-ভাষায় সাধারণ নারী ও পুরুষ প্রতিদিন কথা বলে।
বীরবলের হাস্যরস বাঙলায় বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজাতদের আনন্দ দিয়েছিল, কিন্তু সাধারণ মানুষদের কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এর একটি কারণ হচ্ছে, তিনি ছিলেন অনেকের জন্য অতিমাত্রায় বুদ্ধিবৃত্তিক ও পরিশীলিত। অন্যদের জন্য, তিনি প্রধানত লিখেছিলেন তাঁদের অভিজ্ঞতার বাইরের বিষয়গুলি নিয়ে। যেসব হাস্যরসিক ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তাঁরা সফল হয়েছিলেন অস্বাভাবিকতা ও উদ্ভটতার আশ্রয় নিয়ে এবং কখনো কখনো এমনকি অশ্লীলতার সাহায্য নিয়েও। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হচ্ছেন রাজশেখর বসু। বাঙলা উপন্যাসে তাঁর প্রধান অবদান নিহিত প্রাত্যহিক বাঙালি জীবনে হাস্যরসের অবদান আবিষ্কারের মধ্যে। আমরা সাধারণত পরিচিত বিষয়গুলির মধ্যে কোনো হাস্যরসাত্মক উপাদান দেখতে পাই না। রাজশেখর বসুর ছিল প্রাত্যহিক জীবনের অন্তরালে প্রবেশ করার এবং সাধারণ বাঙালি জীবনের নানা হাস্যকরতা উন্মুক্ত করার মতো দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা ও শ্লেষাত্মক ধীশক্তি। তাঁর কৃতিত্ব নিহিত সাধারণ ঘটনাগুলির ওপর তাঁর বুদ্ধিমত্তার জোরালো আলো নিক্ষেপ করে সেগুলির ভেতর থেকে হাস্যরস বের করে নিয়ে আসার মধ্যে। তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি অসংগতিসমূহ আবিষ্কার করে, কিন্তু একই সঙ্গে চিহ্নিত করে যে, সেগুলি আমাদের জীবনের স্বাভাবিক পথ। শনাক্তকরণের এই মনোভাবের ভিত্তি হচ্ছে গভীর মানবিক সহানুভূতি এবং তা রাজশেখর বসুকে সমর্থ করেছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একটি সহানুভূতিপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে। যদিও তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লেখেননি, তবুও তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক প্রখরতা ও সৃজনধর্মী সহানুভূতির সমন্বয়ের মধ্যে তিনি উপন্যাসের জন্য একটি নতুন ক্ষেত্রের ইঙ্গিত প্রদান করেছিলেন।
বীরবল বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সাধারণভাবে বাঙলা সাহিত্য ও বিশেষভাবে বাঙলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে বড় প্রভাব রেখেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রত্যাবৃত্তি সহযোগে জাতির একটি আবেগমূলক উত্থান প্রত্যক্ষ করা গেছে। আমরা ইতঃপূর্বে প্রতিবুদ্ধিকতার ঢেউয়ের কথা উল্লেখ করেছি যা এসেছিল ফ্রয়েড ও মার্কসের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে। বিশ শতকের শুরু থেকেই ভারতীয় চিন্তাধারায় ফ্রয়েডের প্রভাব প্রাধান্য লাভ করছিল এবং বাঙলা উপন্যাসে এর অভিঘাত অনুভূত হলো এর পর থেকেই। সাম্প্রতিককালে খুব কমসংখ্যক মানুষই উপন্যাসের বিকাশকে এত বেশি প্রভাবিত করতে পেরেছেন। মনস্তত্ত্বে আগ্রহী এক চিকিৎসক ফ্রয়েড কিছু তত্ত্ব সূত্রবদ্ধ করেছেন, যা আমাদের প্রচলিত বিশ্বাসের অনেকগুলির মূলে কুঠারাঘাত করেছে। কবি ও নাট্যকাররা একেবারে প্রথম থেকেই মানুষের সেসব ক্রিয়াকর্ম বর্ণনায় নিয়ে এসেছেন যেগুলি সচরাচর বাইরে প্রকাশ পায় না। তাঁরা সবসময় অনুমান করেছেন, মানবচরিত্রে এমন অনেক ক্ষেত্র রয়েছে যেগুলি বিশ্লেষণের অতীত। ফ্রয়েড তাঁর অচেতন তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন প্রধানত সেসব ক্রিয়ার ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য এবং এভাবেই মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, আমাদের ক্রিয়াকর্মের অনেকগুলিই উদ্ভূত সেসব প্রণোদনা থেকে যেগুলি আমরা সজ্ঞানে চিহ্নিত করি না এবং বাস্তবিক পক্ষে নিজের বলে অস্বীকার করি – যদি সেগুলি প্রকাশ্যে নিয়ে আসা হয়। এতদসত্ত্বেও সেগুলি ব্যাপক শক্তির পরিচয় তুলে ধরে যা আমরা অস্বীকার করি শুধু নিজেদের কষ্ট দিয়েই। তাঁর গবেষণার ফলে এ-বিষয়টি প্রায় সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয়েছে যে, মানুষের মন একটি ভাসমান হিমশৈলের মতো, যার সামান্য একটি অংশমাত্র উপরিতলে দৃশ্যমান। ফ্রয়েড এভাবে কিছু মৌলিক শক্তির অস্তিত্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যেগুলি আমাদের অচেনা এবং তবুও নিয়তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি আরও এগিয়ে গিয়েছিলেন এবং এসব শক্তির প্রকৃতি নির্দেশ করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর মতে, যৌনতা শুধু একটি শক্তিশালী প্রবণতা নয়, বরং সম্ভবত মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশীল একটি উপাদান। ফ্রয়েডের মতানুসারে – ধর্ম, শিল্প ও নৈতিক আদর্শ সবই আদর্শায়িত যৌনতার রূপ। আদর্শায়ন যখন সফল হয় তখন তার ফলাফল মানুষের অনেক বড় উপকার সাধন করে। তবে যৌনতাকে যদি অবদমিত করে রাখা হয়, তাহলে এমনটা ঘটে না এবং এই অবদমন অন্তর্গত দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে যা মানুষের ব্যক্তিত্বকে বিকৃত ও কখনো কখনো ধ্বংস করে।
ফ্রয়েডের বিশ্লেষণের অব্যবহিত প্রভাব পড়েছিল ইউরোপীয় সাহিত্যে এবং আমরা তাঁদের পরবর্তী অনেক লেখক পাই যাঁরা বিভিন্ন মানবিক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে তাঁর বিশ্লেষণ প্রয়োগ করেছিলেন। বাঙলা কথাসাহিত্যও শীঘ্রই সাড়া দিয়েছিল তাঁর শিক্ষার প্রতি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনেক অনুসারী মানব প্রকৃতি অনুধাবনের চাবিকাঠি হিসেবে সরলভাবে গ্রহণ করেছিলেন ফ্রয়েডের সূত্র। বস্তুত ফ্রয়েডের বিশ্লেষণ প্রায়শ বর্ধিত ও প্রসারিত করা হয় এমনভাবে যাকে তিনি নিজেও হয়তো স্বীকৃতি দিতেন না। বিশ শতকের শেষের দিকে একদল তরুণ লেখকের আবির্ভাব ঘটল যাঁরা প্রায় সামগ্রিকভাবে যৌনকামনার ভাষায় মানবচরিত্র তুলে ধরার প্রয়াসে আত্মনিয়োগ করলেন। ফ্রয়েড ‘যৌনতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন সাধারণ অর্থে এবং বার্নার্ড শ যাকে জীবনীশক্তি বলেন তার সমরূপ অর্থে। বাঙলায় তাঁর অনুসারীরা প্রায়শ যৌনতাকে এর সংকীর্ণ ও প্রচলিত অর্থে ধরে নিয়েছেন এবং তারপরও মানব সম্পর্কের সকল দ্বন্দ্বকে শুধু যৌনতার ভাষায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।
ফ্রয়েডের বিশ্লেষণ তাঁর ইউরোপেই প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল। অনেকের কাছেই মনে হয়েছিল, এটি ধর্ম ও নৈতিকতার ভিত্তির প্রতিই একটি চ্যালেঞ্জ। এটিই শুধু স্বাভাবিক ছিল যে, ফ্রয়েডের মতবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ভারতে অনেক বেশি প্রবল হবে। ভারতীয় সমাজ সবসময় নরনারীর অবাধ মেলামেশাকে বাধা দিয়েছে। বাঙলা উপন্যাসও সবসময় রচিত হয়েছে একটি সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে, যেহেতু বাঙালি সমাজে নরনারীর মধ্যে সামাজিক সংযোগের সুযোগ ছিল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। বাঙলায় এবং প্রকৃতপক্ষে সারা ভারতে বেড়ে-ওঠা নারী-পুরুষের মধ্যে সংযোগ সীমিত ছিল প্রধানত পরিবারের মধ্যেই। এ-কথা সত্য যে, বড় যৌথ পরিবারগুলি, যেগুলি আসলে ছিল এক ছাদের নিচে বসবাসকারী অনেক কয়টি পরিবার, আবেগমূলক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি সুযোগ মাত্র প্রদান করত। এই সুযোগ ছিল অবশ্য সীমিত যেহেতু পালনীয় সামাজিক নিষেধ শক্তভাবে কার্যকর ছিল যে-কোনো ধরনের বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে। গোঁড়া হিন্দু সমাজে জ্ঞাতি-ভাইবোনেরা একে অপরকে দেখে আপন ভাইবোনের মতো এবং তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক বিবেচিত হয় অজাচার হিসেবে। সাধারণভাবে বলতে গেলে, যৌনতার ব্যাপারে ভারতীয় সমাজ অত্যন্ত বাকসংযমী এমনকি এর স্বাভাবিক প্রকাশসমূহের ক্ষেত্রেও। এর ফলে পারিবারিক সম্পর্কগুলির মধ্যে যৌনতার অস্বাভাবিক প্রকাশগুলির জট খোলার জন্য ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণ প্রয়োগের বিরুদ্ধে সকল গোঁড়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল।
খ্যাতিমান আইনজীবী ও সাংবাদিক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত ছিলেন যৌনতা বিষয়ে অধিকতর খোলামেলা হওয়ার পক্ষে নতুন এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তাঁর উপন্যাসগুলি গোঁড়ামি ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকদের মধ্যে বাদানুবাদের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। উজ্জ্বল বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের মধ্যে কল্পনাশক্তি দিয়ে নিজের উপন্যাসের চরিত্র রূপায়িত করার সামর্থ্যরে অভাব ছিল। তাঁর উপন্যাসগুলি সামাজিক পরিতৃপ্তিকে নাড়া দিয়েছিল ও মনকে আলোড়িত করেছিল, কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই তারা পাঠকদের হৃদয় স্পর্শ করতে পেরেছিল। তাঁর সময়ে তিনি ছিলেন অন্যতম আলোচিত ঔপন্যাসিক, কিন্তু তাঁর উপন্যাসগুলি আজ প্রায়বিস্মৃত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সেনগুপ্ত তাঁর উপন্যাসগুলিতে প্রধানত যৌনতা, বিপথগামিতার মনস্তত্ত্ব ও অপরাধতত্ত্বের সমস্যাগুলিকে বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ফ্রয়েডের ভাষায় তাঁর যৌনতা-ভাবনা সহজেই বুঝতে পারা যায়। যেসব নারী ও পুরুষ আইন ভঙ্গ করে তাদের সঙ্গে আইনজীবী হিসেবে তাঁর দৈনন্দিন যোগাযোগের ফলেই তিনি এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। অতএব এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, যৌনতা ও অপরাধের সমস্যাগুলি তাঁর রচনার বিরাট একটি অংশ জুড়ে থাকবে। সামাজিক ভাবনা ছিল তাঁর প্রবল; অতএব অপরিহার্যভাবে তাঁর উপন্যাসগুলি হয়ে উঠেছে সচেতনভাবে উদ্দেশ্যমূলক। এরূপ সচেতন নিবেদিতচিত্ততা থেকে প্রচারধর্মিতা মাত্র ছোট একটি ধাপ এবং তাঁর অনেক উপন্যাসই এই প্রচারধর্মিতা দোষে দুষ্ট। যেসব মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া মানুষকে অপরাধ কিংবা যৌন বিপথগামিতার পথে চালিত করে সেগুলির জট ছাড়ানোর কাজে তিনি এতই ব্যাপৃত ছিলেন যে, তিনি প্রায়ই ভুলে গেছেন ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর প্রথম কর্তব্য হচ্ছে, বিভিন্ন চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে একটি গল্প বলে যাওয়া। তাঁর সৃষ্ট নারী ও পুরুষগুলি প্রায়শ হয়ে যায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিভূ এবং তারা সেই বলিষ্ঠতা লাভ করে না যা একটি যথার্থ শিল্পকর্ম থেকে আশা করা হয়। বাস্তববাদের একজন দৃঢ় সমর্থক হিসেবে ঘটনার আধিক্য দ্বারা তিনি আপ্লুত এবং সেগুলির মধ্যে কোনো উদ্দেশ্য দেখতে পান না বা সেরূপ কোনো সন্ধানও দিতে পারেন না। রোমান্টিকতার বিরুদ্ধে তাঁর সচেতন বিদ্রোহ অবশেষে তাঁকে নিয়ে যায় পূর্বধারণাকৃত তত্ত্বগুলির ভিত্তিতে একটি জগৎ নির্মাণ দ্বারা নতুন রোমান্টিকতার দিকে। ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী অন্য অনেকের মতো তিনি শুধু প্রচলিত রীতিনীতিকেই লঙ্ঘন করেননি বরং তাঁর নিজের ঐতিহ্য-পরিপন্থী নতুন রীতিনীতিও তৈরি করেছেন।
অতএব ফ্রয়েডের অভিঘাত ছিল এই [বিংশ] শতাব্দীর বিশের দশক থেকে বাঙলা উপন্যাসের বিকাশে প্রভাবশীল একটি বড় উপাদান। সমভাবে শক্তিশালী প্রভাব ছিল মার্কসের মতবাদগুলির ক্রমপ্রসার। মার্কসবাদ ভারতে একটি তৈরি ক্ষেত্র পেয়েছিল যেহেতু লাখ লাখ মানুষ এখানে জীবনধারণ করে এসেছে দারিদ্র্য ও অধিকারহীনতার মধ্যে এবং এখনো সেভাবে বেঁচে থাকছে। বস্তুত আড়ম্বরপূর্ণ বিলাসিতা ও চরম অধিকারহীনতার মধ্যেকার বৈষম্য যুগ যুগ ধরে ছিল ভারতীয় সামাজিক জীবনের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। অতীতে সামাজিক সংঘাতের বিপদ কমিয়ে আনা হয়েছিল দারিদ্র্যকে আদর্শায়িত করার সচেতন প্রয়াসের মাধ্যমে। মহান ধর্মীয় পুরুষরা স্বেচ্ছায় কৃচ্ছ্রতার জীবন যাপন করেছিলেন। এমনকি মহাকাব্যগুলির যুগেও মহত্তম নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন দরিদ্র মানুষ। ধর্ম ও নৈতিকতা সারা পৃথিবীজুড়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ত্যাগের আদর্শকে উচ্চে তুলে ধরেছে এবং কয়েকটি ভারতীয় ধর্ম জীবনের পূর্ণ অনুধাবনের চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কৃচ্ছ্রতাব্রতকে উচ্চতর স্থান দিয়েছে। এর একটি ফল ছিল এই যে, ভারতে দরিদ্ররা দারিদ্র্যকে নিয়তির বিধান হিসেবে মেনে নিয়েছে এবং অন্যায়কারী শাসক ও অসম সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহে অবতীর্ণ হয়নি।
মার্কস দারিদ্র্যের প্রতি তাঁর প্রবল ঘৃণা এবং সামাজিক প্রগতির হাতিয়ার হিসেবে শ্রেণিসংগ্রামের ন্যায্যতার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় জীবনদৃষ্টির মূল ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। শ্রেণিবিলুপ্তির এবং ধনী-দরিদ্র পরিচয়ের নিশ্চিত অবসান ঘটানোর জন্য তাঁর ঘোষণা শুধু যে সাধারণ মানুষদের মধ্যেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তা নয়, বরং তা আমাদের শ্রেষ্ঠ মানুষদের সমতাবাদী সহজাত প্রবণতার প্রতিও আবেদন রেখেছিল। তাঁর বার্তা হয়তো অকার্যকর থেকে যেতে পারত, কিন্তু রুশ বিপ্লবের সাফল্য ও সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রলেতারিয়েত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে তা ঘটতে পারেনি। লেনিন হয়ে উঠলেন বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের কাছে আশা ও প্রগতির প্রতীক। ভারতেও এর অভিঘাত অনুভূত হলো এবং বাঙলা সাহিত্যে আমরা পেলাম সমতাবাদের এক নতুন সুর। প্রথমে এই প্রভাব সীমাবদ্ধ ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক রচনাগুলিতে, কিন্তু খুব শীঘ্রই মার্কসের বার্তার প্রভাব অনুভূত হতে লাগল সাহিত্যেও। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কয়েকটি ছোটগল্পে দরিদ্র মানুষের কথা লিখেছেন। দারিদ্র্যের কঠোরতা ও নিষ্ঠুরতা আরও অনেক স্পষ্টভাবে দেখা যায় শরৎ চন্দ্রের অনেক উপন্যাসে। এতদসত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ ও শরৎ চন্দ্র উভয়ের অধিকাংশ নায়ক-নায়িকা এসেছে সম্পদশালীদের শ্রেণিগুলো থেকেই। শরৎ চন্দ্র তাঁর কিছু চরিত্র নিয়ে এসেছেন নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে, কিন্তু এমনকি তাদের মধ্যেও সম্পদলিপ্সা বেশ জোরালোভাবে অনুভব করা গেছে। তাঁর রচনাগুলির মধ্যে নিঃস্ব হয়ে পড়া পরিবারগুলির বিবরণ রয়েছে, কিন্তু সেখানে নিঃস্ব হওয়ার বিষয়টি অনুভূত হয়েছে বঞ্চনা হিসেবে।
মার্কস দ্বারা প্রভাবিত নতুন শ্রেণির লেখকেরা তাঁদের নায়ক-নায়িকা হিসেবে পছন্দ করে নিয়েছেন সচরাচর নিম্নতর শ্রেণিরূপে বিবেচিত নারী ও পুরুষদের থেকে। প্রথমদিকের লেখকদের মধ্যে কখনো কখনো সমাজের গৃহহীন ও পরিত্যক্ত মানুষদের প্রতি আবেগমূলক মনোভাব পরিদৃষ্ট হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথমদিকের গল্পগুলির একটিতে নায়িকা হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন একটি পতিতাকে। শরৎ চন্দ্র তাঁর অনেক নায়িকা এনেছেন এই একই শ্রেণির চরিত্র থেকে। এ ধরনের সব লেখায় সমাজ দ্বারা নিগৃহীতদের প্রতি সহানুভূতিরূপে এক ধরনের রোমান্টিক প্রবণতা থাকে, যা প্রায় সব ক্ষেত্রে চলে আসে অসচেতনভাবে। যেভাবেই হোক না কেন, এগুলি হচ্ছে ব্যতিক্রম। কিন্তু উপন্যাসের চরিত্রগুলি যখন নিয়ে আসা হয় কৃষক, শ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমজীবী শ্রেণি থেকে, তখন সেটি হয়ে ওঠে একটি ভিন্ন বিষয়। এই মানুষেরা সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক জীবনের একটি অংশ এবং এই অবজ্ঞাত জীবিকাগুলি যেমন সমাজের টিকে থাকার জন্য তেমনই গুরুত্বপূর্ণ যেমনটা গুরুত্বপূর্ণ তাঁদের কাজ যাঁরা নিজেদেরকে উচ্চতর চিন্তামূলক ক্রিয়াকর্মে নিয়োজিত রাখেন। সমাজ দ্বারা নির্যাতিত একজন মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন তুলনামূলকভাবে সহজ, যেহেতু এ-ধরনের সহানুভূতির মধ্যে পৃষ্ঠপোষকতার একটি উপাদান থাকে। এটি আরো অনেক বেশি কঠিন সেই বিপুলসংখ্যক নারী ও পুরুষকে সমপর্যায়ভুক্ত বলে গ্রহণ করা যাদের রয়েছে নিজেদের সামাজিক নিয়ম ও আত্মসম্মান বিষয়ে নিজস্ব বোধ এমনকি যদিও তারা গরিব এবং সমাজকে চলমান রাখার জন্য নিরন্তর একঘেয়ে নীরস খাটুনির কাজ করে চলেছে। এই মানুষদের উপযুক্ত বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য ঔপন্যাসিককে যা করতে হতো তা হলো – তখনও পর্যন্ত সাহিত্যের চৌহদ্দির বাইরে পড়ে থাকা সমাজের সেইসব মানুষকে দৃষ্টির আওতায় নিয়ে আসার জন্য বাঙলা উপন্যাসের সীমানাকে প্রসারিত করা।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাঙলা উপন্যাস এত অধিক রূপ পরিগ্রহ করেছে যে, এর বহুবিচিত্র প্রকাশের একটি সংহত বা চলমান বর্ণনা প্রদান এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যেসব প্রধান প্রবণতা প্রভাব বিস্তার করেছে আমরা শুধু সেগুলি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত প্রদান করতে পারি বিগত তিন দশকের কয়েকজন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ লেখকের কাজের বর্ণনা প্রদানের মাধ্যমে। ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন ও সমাজের পরিশীলিত রূপপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে আবেগমূলক সংশ্লেষণের পরিবর্তে বরং বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণের দিকে এগিয়ে যাওয়া ঘটতে থাকে। শুধু সামাজিক রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ নয়, বরং এমনকি মানবিক অনুভূতিসমূহও বিস্তারিত নিরীক্ষণের বিষয় হয়ে ওঠে। যখন এই দুই ধারার মিলন ঘটে, যেমন ঘটেছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু রচনার ক্ষেত্রে, আমরা পেয়ে যাই উচ্চমানের কাজ। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে এ কথাও স্বীকার করতে হয় যে, বাঙলা উপন্যাসের অতি সাম্প্রতিক কাজগুলির ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তি ও আবেগের মিলন একটি অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ঘটনা।
বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ ও তজ্জনিত ব্যক্তিত্বহানি সত্ত্বেও ঐতিহ্যবাহী পথের অনুসারী লেখকেরা এখনো পুরোপুরি হার স্বীকার করেননি। আর রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক তাঁর মধ্যপর্যায়ের উপন্যাসগুলিতে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী ঘরানাও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি এখনও। যদি এরূপ না হয়ে অন্য কিছু ঘটত তাহলে তা হতো বিস্ময়ের ব্যাপার। ঐতিহ্যবাহী উপন্যাস মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলির একটি পূরণ করে। প্রত্যেকেই ভালোবাসে একটি ভালো গল্প এবং অধিকাংশ পাঠকই সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক বা অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় না গিয়ে শুধু এর গল্পের জন্যই একটি উপন্যাস উপভোগ করে সন্তুষ্ট থাকে। অনুরূপভাবে বাঙালি চরিত্রে হৃদয়াবেগের আতিশয্যের কারণে তা সবসময় কাব্যধর্মী সৃষ্টিকর্ম দাবি করেছে এবং তা পেয়েছেও। আর সে-কারণেই কাব্যধর্মী উপন্যাসগুলি কখনো ম্রিয়মাণ হয়ে যায়নি।
সমকালীন যাঁরা ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে লিখেছেন তাঁদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন দুজন – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁদের নিয়ে আলোচনার পূর্বে তাঁদের পূর্বসূরিদের মধ্যে একজনের কথা বলা প্রয়োজন যিনি কোনো নতুন রচনাকৌশলের প্রবর্তন করেননি, কিন্তু ভারতীয়দের বহির্ভারতের অভিজ্ঞতাসমূহ নিয়ে এসে বাঙলা উপন্যাসের পরিধিকে প্রসারিত করেছেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন ইন্দো-ইংরেজ সমাজ নিয়ে যে-সমাজ গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে সংযোগের ফল হিসেবে। এর সদস্যদের দুটি বড় ভাগে ভাগ করা যায়, যার একটি ভাগে ছিল জন্মসূত্রে যারা ভারতীয় তারা, কিন্তু এর বেশি কিছু নয়, এবং ভারতে ইউরোপের একটি অনুকৃতি সৃষ্টি করতে চাইত, আর অন্য ভাগে ছিল তারা যারা ভারতীয় জীবনে কিছু পাশ্চাত্য মূল্যবোধ অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর গল্পগুলির একটি সমৃদ্ধ উৎস খুঁজে পেয়েছিলেন ইউরোপে ভারতীয়দের অভিজ্ঞতার মধ্যে এবং তিনি ছিলেন বাঙলার সেই প্রথম ঔপন্যাসিকদের মধ্যে একজন যাঁরা ভারতীয় ছাত্রদের দীর্ঘকাল ধরে বিদেশে অবস্থানের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলি চিত্রিত করেছিলেন। অন্য লেখকেরা মাঝে মধ্যে এই
যুবক-যুবতীদের অনুরূপ বিদেশযাত্রা শেষে ভারতে ফিরে আসার পরের অবস্থাগুলি বর্ণনা করেছিলেন, কিন্তু প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বর্ণনা করেছেন তাদের বিদেশ ভ্রমণকালীন অভিজ্ঞতা। যেখানে অব্যবহিত পারিবারিক নৈকট্যের বাইরে খুব কদাচিৎ যৌন সম্পর্কের ঘটনা ঘটে তেমনি এক সামাজিক পটভূমি থেকে আসা তিন যুবক-যুবতী ইউরোপের মিশ্র সমাজে এসে প্রায়ই নিজেদের হারিয়ে ফেলছিল। একাকী ও বন্ধুহীন পরিবেশে থাকার ফলে তারা সদয় ব্যবহারগুলিকেই প্রায়শ
স্নেহ-ভালোবাসার প্রকাশ বলে ভুল করছিল। কখনও কখনও তা হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছিল, আবার সমভাবে প্রায়শ এসব অভিজ্ঞতার মধ্যে নিহিত ছিল দুঃখজনক পরিণতি এবং প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কয়েকটি রচনায় বর্ণিত হয়েছে এ-ধরনের যোগাযোগের ফলে সৃষ্ট মানবিক অনুভূতির মর্মভেদিতা।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের খ্যাতির প্রধান কারণ হলো প্রাত্যহিক জীবনের মধ্যে নিহিত এক রোমান্সকে তিনি পুনরাবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর সমসাময়িক অন্য অনেকের মতো তিনিও তাঁর উপন্যাস লিখেছেন নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষদের জীবন নিয়ে। এই শ্রেণির অধিকাংশ মানুষ যে দারিদ্র্য ও কষ্ট স্বীকার করে সে-সম্পর্কে তিনি পূর্ণমাত্রায় সচেতন ছিলেন। পথের পাচালী পরিপূর্ণ তাদের কঠিন ও নির্দয় জীবনের বর্ণনায়। এই কাঠিন্য ও নির্দয়তা অবশ্য অপসারিত হয়েছে কল্পনার জাদুস্পর্শে এবং এটিই সম্ভবত বাঙলা উপন্যাসে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান।
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের শক্তির উৎস নিহিত প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর অভিন্নতাবোধের মধ্যে। অন্য কোনো বাঙালি লেখক – কবিতা অথবা গদ্যে – মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যেকার এই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক এত জীবন্তরূপে অনুভব করেননি। তাঁর চিন্তায় ও অনুভবে প্রকৃতি এমন এক ভূমিকা গ্রহণ করেছে যা আমরা অন্য কোনো ভাষায় রচিত উপন্যাসে খুব কদাচিৎ দেখতে পাই। টমাস হার্ডি তাঁর (The Return of the Native) উপন্যাসে কখনও কখনও প্রকৃতিকে গল্পের বুননের সঙ্গে একাত্ম করে দিয়েছেন। Jane Eyre অথবা Wuthering Heights উপন্যাসে প্রকৃতি মানুষের মনের গতিতে সাড়া জাগায়, কিন্তু বিভূতিভূষণের প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতাবোধ আরো অনেক বেশি আন্তরিক। এটি কখনো কখনো মানুষের পরিবর্তে প্রকৃতিকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে তাঁর উপন্যাসগুলির নির্মাণকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। উপন্যাসে প্রকৃতির ভূমিকা অপরিহার্যভাবে মানুষের ক্রিয়াকর্মের একটি পটভূমি হিসেবে কাজ করে। অথচ বিভূতিভূষণের উপন্যাসে মানবিক ক্রিয়াকর্ম পরিণত হয়েছে প্রাকৃতিক প্রতিভাসগুলির পরম্পরায়। তাঁর উপন্যাস পড়তে গিয়ে প্রায়শ ওয়ার্ডসওয়ার্থের কথা মনে আসে। তাঁদের দুজনের মধ্যেই সাধারণ মানুষের জীবনের জন্য যথার্থ ভালোবাসার সঙ্গে একাত্মভাবে প্রকৃতির জন্য গভীর অনুভব রয়েছে। এই ভালোবাসাই বিভূতিভূষণকে প্রকৃতির প্রতি তাঁর আবিষ্টতা সত্ত্বেও সফল উপন্যাস রচনায় সমর্থ করেছে। এই আবিষ্টতা কখনও কখনও এত প্রবল হয়ে উঠেছে যে, এটি তাঁকে মানবসমাজ ও সংস্কৃতি অস্বীকার করার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তাঁর মধ্যে উদারমতি আদিমতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার প্রবণতাও দেখা যায়, যদিও জ্ঞানবৃক্ষের ফল একবার আস্বাদন করার পর মানুষ আর কখনো অপাপবিদ্ধতার আদিম যুগের জীবনে ফিরে যেতে পারে না। একটি রোমান্টিক ও সার্বিক সম্ভাবনায় অস্তিত্বহীন যুগের জন্য এই তীব্র কামনা প্রকাশ করে পরিণতাবস্থার অভাব, যা ব্যাখ্যা প্রদান করে কেন সব ধরনের কাব্যিক গুণ থাকা সত্ত্বেও তাঁর উপন্যাসগুলি আমাদের রেখে যায় ব্যর্থতা ও অসন্তোষের এক অনুভূতির মধ্যে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষয়িষ্ণু জমিদারদের নিয়ে লিখে। ভৌগোলিক দিক থেকে পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলার মধ্যে একটি প্রখর ব্যবধান রয়েছে। পূর্ব বাঙলা হলো অবারিত সবুজ ধানক্ষেত দ্বারা বিস্তৃত ও শত শত নদীধারা দ্বারা বিভক্ত এক সমতলভূমি। পশ্চিম বাঙলা প্রধানত লাল, অনুর্বর ও শুষ্ক মাটি দ্বারা গঠিত এবং ছোট ছোট গভীর নদী দ্বারা বিভক্ত একটি অঞ্চল। পূর্ব বাঙলার নদীগুলি নিরন্তর নতুন ভূখণ্ড গঠন ও পুনর্গঠন করে এবং জীবিকা অর্জনের জন্য এখানকার মানুষদের প্রকৃতির সঙ্গে অনবরত যুদ্ধ করে যেতে হয়। এরা উদ্যমশীল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরা অধিক প্রবৃত্তিতাড়িত আর মনের দিক থেকে বেশি রক্ষণশীল। সে-কারণে পশ্চিম অংশে সামাজিক রীতিনীতিগুলি অধিকতর অনড় পূর্ব অংশের তুলনায়। পূর্বদিকের পরিবারগুলি রাতারাতি দরিদ্রে পরিণত হয়েছিল; কিন্তু পশ্চিমের অঞ্চলগুলিতে বংশানুক্রমে একই পরিবারের কাছে থেকে গিয়েছিল জমিজমা এবং সেটিই সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। তারাশঙ্কর অন্তর্দৃষ্টি ও সহানুভূতি সহযোগে একদা ধনশালী এই পরিবারগুলির বংশধরদের মনের ভাব ধরতে পেরেছিলেন। তারা তাদের অতীত জাঁকজমকের বাহ্যিক রূপটি ধরে রাখতে চাইত, কিন্তু সেই আড়ম্বর দেখানোর বিত্ত তাদের নেই। তারাশঙ্করের গল্পগুলির নায়কদের মধ্যে তাদের হারিয়ে যাওয়া অতীতের জন্য প্রত্যাশা থেকে উদ্ভূত আড়ম্বরের এক ধরনের রেশ থেকে যায়। রোমান্টিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে যখন তাদের অতীতের ভিত্তির ওপর স্থাপিত আশা-আকাক্সক্ষা বর্তমান সময়ে তাদের সামর্থ্য দ্বারা বা এর অভাবের কারণে পূরণ হতে পারে না।
বাঙলার উপজাতি ও অর্ধ-উপজাতি জনগোষ্ঠীর জীবনচিত্র তুলে ধরার ক্ষেত্রেও তারাশঙ্কর খুবই সফল। তারাশঙ্করের আবির্ভাবের পূর্বে কোনো বাঙলা উপনাসে এরূপ ব্যাপক বিস্তারে তাদের জীবন উঠে আসেনি। আবেগপূর্ণ ও অপরিণামদর্শী চরিত্রের এই মানুষেরা যেমন দ্রুত বন্ধু হয়ে যেতে পারে, তেমনি শত্রুও হয়ে যেতে পারে খুব দ্রুত। সামাজিক প্রথাগুলিকে তারা বেশ হালকাভাবেই গ্রহণ এবং বিবাহের মতো প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কগুলিকে মুহূর্তমাত্র চিন্তা না করেই প্রত্যাখ্যান করতে পারত। তারাশঙ্কর তাঁর প্রথমদিকের কিছু গল্পে এই মানুষগুলিকে নিয়ে এসেছিলেন সমাজ ও সভ্যতা তাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলির অবিকৃত প্রকাশ মুছে ফেলার আগেই। পরবর্তীকালে তিনি তাঁর এসব কাজকে তাদের পূর্ণজীবনচিত্র নিয়ে রচিত উপন্যাসে রূপ দিয়েছিলেন। সম্ভবত পাশ্চাত্যের উপন্যাসগুলিতে নৃতত্ত্বের প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহ বাঙলা উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে লেখকদের এতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ব্রিটিশ ঔপন্যাসিকদের ক্ষেত্রে নাওমি মিচিসন (Naomi Mitchison) ছিলেন এই ক্ষেত্রে অগ্রপথিকদের মধ্যে একজন। তাঁর উপন্যাস স্প্রিং কুইন (Spring Queen) এবং কর্ন কিং (Corn King) কল্পনার গল্পগুলিকে নৃতাত্ত্বিক তত্ত্বসমূহ আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে নতুন পথ দেখিয়েছিল। তারাশঙ্করের দুটি নৃতত্ত্বভিত্তিক উপন্যাসের একটি নাগিনী কন্যার কাহিনীর বিষয় সর্পদেবীর জীবন। বিষয়বস্তু ও উপস্থাপন-রীতির বিচারে এটি একটি রোমান্টিক উপন্যাস। হাঁসুলি বাঁকের উপকথা হলো এক গ্রামীণ শ্রেণির মানুষের জীবনের ক্রমিক ধীরপরিবর্তনের গল্প,
যে-শ্রেণির জীবনে তখনও পর্যন্ত সভ্যতার ছোঁয়া লাগেনি। অনেক বিজ্ঞ সমালোচকের মতে এটি তারাশঙ্করের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। এখানে আমরা গ্রামের সেই নারী ও পুরুষদের দেখা পাই যাদের শেকড় প্রোথিত মাটির গভীরে। আমরা প্রথম যখন তাদের দেখা পাই তখন তারা সভ্যতার স্পর্শ-বিবর্জিত এবং আধুনিক সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কহীন। বস্তুত তাদের মধ্যে কয়েকটি শ্রেণির মানুষ এমনকি তখনও পর্যন্ত কৃষি সংস্কৃতির পর্যায়েও পৌঁছাতে পারেনি এবং ভাসমান ছিল যাযাবরজীবন ও বসতিজীবনের মধ্যে। আধুনিক সভ্যতার অভিঘাত যে রূপান্তর নিয়ে আসে তা হচ্ছে বৈপ্লবিক। মৃত্তিকার সন্তানেরা পরিবর্তিত হলো যন্ত্রের দাসে। অর্থনৈতিক পরিবর্তন ছাড়াও, এই অভিঘাত জীবনের পুরনো ধাঁচগুলি বদলে দেয় এবং তাদের ঐতিহ্যগত বিশ^াসের ভিত দুর্বল করে দেয়। তাদের অনুন্নত সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষিত হতো ব্যক্তিগত আনুগত্যের ভিত্তিতে, কিন্তু যন্ত্রের অগ্রগতি এর কোনো বিকল্প উপস্থাপন ছাড়াই এই কর্তৃত্বকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। পরিণামে সৃষ্টি হয় জীবনের ভাঙন – ব্যক্তিক ও সেই সঙ্গে সামাজিক। তারাশঙ্কর সহানুভূতি ও অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে এই সরল সমাজের মধ্যে নেতৃবৃন্দ ও সেই সঙ্গে তাদের অনুসারীদের পরিবর্তনশীল ভাগ্যের চিত্র অঙ্কন করেছেন। যেসব মানুষ তাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একদা কর্তৃত্ব আরোপ করেছিল তারা এই পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিল না এবং আচরণ করছিল অচেনা একটি জগতে পথ-হারানো মানুষদের মতো।
বাঙলা উপন্যাসের বিকাশে তারাশঙ্করের প্রধান অবদানের দুটি দিক রয়েছে। তিনি একদিকে ক্ষয়িষ্ণু ধনীদের জীবন তুলে ধরেছেন তাদের অতীতের স্মৃতি ও বর্তমান অনুশোচনার বর্ণনাসহ। অন্যদিকে, বাঙলা উপন্যাসের ক্যানভাসে তিনি নিয়ে এসেছেন আদিম অবস্থা থেকে উঠে আসা উপজাতি ও আধা-উপজাতিদের জীবন। তিনি যে এ-ধরনের বিচিত্রধর্মী চরিত্রের জীবন বিস্তারিতভাবে চিত্রিত করতে পেরেছেন এতে তাঁর কল্পনাশক্তির ব্যাপকতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর সাফল্যের একটি প্রধান কারণ হলো গল্প-বলিয়ে হিসেবে তাঁর দক্ষতা। তাঁর সহজ ও প্রবহমান রচনাশৈলী কোনো বাধা ছাড়াই পাঠককে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। উভয়ত চরিত্রচিত্রণ ও আখ্যান নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন, কিন্তু বাঙলা উপন্যাসের রচনাকৌশলের ক্ষেত্রে তাঁর কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবদান নেই। এতদসত্ত্বেও অতীত ও নতুন গতিধারার মধ্যে সংযোগসূত্র হিসেবে বাঙলা উপন্যাসের ইতিহাসে তিনি একটি সম্মানজনক স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর পরে বাঙলা উপন্যাস ব্যাপকভাবে নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়ে পড়ে। তারাশঙ্কর নীতিবাদী ছিলেন না, কিন্তু তাঁর রচনাগুলিতে একটি উদ্দেশ্যমূলকতার ভাব রয়েছে, যা তাঁর উত্তরসূরিদের অনেকের মধ্যে নেই।
আমরা এর আগেই ইতোমধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলেছি যিনি লেখা শুরু করেছিলেন যাকে প্রলেতারিয়েত সাহিত্য বলা যায় তা দিয়ে। তিনি নিঃসন্দেহে মার্কস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তাঁর লেখায় ফ্রয়েডের প্রভাবের দিকও চোখে পড়ে। তাঁর কিছু গল্প নির্দয় ও শক্তিশালী এবং তিনি যে ফ্রয়েডের অনুসারী তার প্রমাণ দেয়, কিন্তু তাঁর পরিচিতি প্রধানত বড় আকারে গরিব মানুষদের জীবনচিত্র তুলে ধরার জন্য। বাঙলার মানুষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই মানবেতর অবস্থায় জীবনযাপন করে, যেখানে তাদের শক্তির পুরোটাই ব্যয়িত হয় শুধু জীবন ধারণের সংগ্রামেই। জীবন পরিণত হয় নিরেট বাস্তব ঘটনায় এবং সূক্ষ্মতর অনুভূতির সুযোগ খুব কমই থাকে। জীবনের এমন এক পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন যৌনতা, ক্ষুধা ও মৃত্যুর সমস্যাগুলোয় – এতে কি বিস্ময়ের কিছু থাকতে পারে?
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষুধা ও যৌনতার সমস্যা দ্বারা আবিষ্ট একজন প্রলেতারিয়েত ঔপন্যাসিক, তবে এই আবিষ্টতা যতখানি জীবনের প্রত্যক্ষ নগ্ন অভিজ্ঞতার কারণে ততখানি নয় মার্কস বা ফ্রয়েডের কারণে। তাঁর প্রথমদিকের গল্পগুলি তিনি লিখেছেন গরিব ও অবাঞ্ছিত, ভিক্ষুক ও ভবঘুরে, পতিতা ও চোরদের নিয়ে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাদের জীবনের কঠিনতা সত্ত্বেও, এই নারী ও পুরুষদের অধিকাংশই উচ্চ মানবিক গুণে ঋদ্ধ। সমবেদনা ও বদান্যতা কেবল বড়লোকদেরই একচেটিয়া গুণ নয়। গরিব মানুষেরাও প্রায়শ নেতৃত্ব ও কল্পনার উচ্চতর গুণগুলি প্রদর্শন করতে পারে। এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা অনেক বড় অসামর্থ্য দ্বারা আক্রান্ত, কিন্তু তবুও তাঁরা শুধু তাঁদের চরিত্রবলের দ্বারাই সেসব সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে আসতে পারেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মাটির গভীরে শেকড়ের টান রয়েছে এমন কৃষকদের জীবন নিয়েও লিখেছেন, যাদের শক্তি ও টিকে থাকার সামর্থ্য ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে সভ্যতার পরশের সঙ্গে সঙ্গে। প্রকৃতির ধ্বংসলীলা ও লুণ্ঠনকারী মানুষদের বিরুদ্ধে গ্রামীণ মানুষের চিরায়ত সংগ্রামে তিনি আনন্দলাভ করেন। চরম দারিদ্র্যও তাদের পরাভূত করতে পারে না এবং জীবন এগিয়ে নেওয়ার প্রয়াসে তারা বিরূপ প্রকৃতির আঘাতগুলিকেও বরণ করে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বোত্তম উপন্যাসটিতে অবশ্য ভিন্ন ধরনের একটি সমস্যার অবতারণা করা হয়েছে। তাঁর পূর্ববর্তী গল্প ও উপন্যাসগুলিতে তিনি সহজ-সরল মানুষদের চিত্র এঁকেছেন, যাদের জীবন আবর্তিত হয় জীবনের কঠিন সত্যগুলিকে মোকাবিলা করার প্রয়াসে। পুতুলনাচের ইতিকথায় তিনি চিত্রিত করেছেন একজন উচ্চপরিশীলিত মানুষের ব্যক্তিত্বের ক্রমভাঙন, যিনি প্রকৃতির সরল জীবনে ফিরে আসার পথ খোঁজেন। তিনি একজন শিক্ষিত মানুষ এবং তাঁর ওপর জীবনের যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে সে-বিষয়ে সচেতন। উচ্চশ্রেণির সমাজ তাঁকে ক্লান্ত করে এবং গ্রামীণ জীবনের মধ্যে তিনি শক্তি খুঁজে ফেরেন। এটি আদমের কাহিনির বিপরীত গল্প। আদম স্বর্গোদ্যান থেকে বিতাড়িত হন যখন তিনি জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে ফেলেন। পুতুলনাচের ইতিকথার গল্পে নায়ক ইতোমধ্যেই জ্ঞানবৃক্ষের ফল আস্বাদন করেছেন, কিন্তু তিনি স্বর্গোদ্যোনে ফিরে আসতে চান। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে নায়কের সচেতনতার পরবর্তী ধাপগুলি এঁকেছেন এবং দেখিয়েছেন যে, অপাপবিদ্ধতা থেকে পরিশীলিততায় আসা সহজতর। ফিরে আসার কাজটি অসম্ভব না হলেও কঠিন। শেষ পর্যন্ত যা ঘটে তা অপাপবিদ্ধতার পর্যায়ে ফিরে আসা নয়, বরং সংবেদনশীলতার ক্রমিক অধোগতি। বাঙলা ভাষায় এমন উপন্যাস খুব কম আছে যেগুলিতে চেতনাপ্রবাহরীতি নিয়ে কাজ হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা জেমস জয়েসের ইউলিসিস-এর বাঙলা রূপান্তর নয়, তবে এর নিকট সমান্তরাল বাঙলা রচনা। এর সংবেদিতা, সরলতা ও প্রত্যক্ষ আবেদন উপন্যাসটিকে সমকালীন বাঙলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসগুলির মধ্যে একটির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
এখন আমরা সমকালীন বাঙলা উপন্যাস যেসব দিকে এগিয়েছে এবং বিভিন্ন লেখক যেসব নিদর্শ ও রচনাকৌশল গ্রহণের চেষ্টা করেছেন সেসব বিষয়ের কয়েকটি সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত প্রদানের চেষ্টা করব। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু করেছিলেন একজন কবি হিসেবে এবং তাঁর উপন্যাস কখনো তাদের অপরিহার্য কাব্যিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেনি। তিনি লেখালেখি শুরুর প্রথমদিকেই স্বীকৃতি পেয়েছিলেন প্রধানত, তাঁর বর্ণনামতে, রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিকতা ও বাস্তবতা থেকে পলায়নের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ প্রতিবাদের মাধ্যমে। তিনি যৌনকামনার অপ্রতিরোধ্য শক্তির বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেন এবং প্রথম বাঙালি লেখকদের মধ্যে অন্যতম যাঁরা ভালোবাসার শারীরিক দিকটির বিষয় তাঁদের লেখায় নিয়ে আসেন। তাঁর খোলাখুলি বর্ণনা নীতিবাদীদের আঘাত ও তরুণদের আনন্দিত করে, কিন্তু তাঁর বিদ্রোহ ছিল বাহ্যিক রূপের বিরুদ্ধে, সমাজের মৌলিক নীতির বিরুদ্ধে নয়। একটি অদ্ভুত অন্তর্গত অসংগতি তাঁর শৈল্পিক অর্জনকে নষ্ট করে দিয়েছে, কারণ তিনি যখন সকল সামাজিক প্রথাকে অগ্রাহ্যকারী প্রবল প্রতিবাদী হিসেবে কথা বলেন তখন তাঁর নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে অনেকেই শেষ পর্যন্ত সমাজের নির্দেশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাঁর ভাষা অত্যন্ত সুন্দর এবং তিনি বিভিন্ন ধরনের রচনাকৌশল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, কিন্তু তবুও তাঁর রচনাকর্ম আমাদেরকে এক অতৃপ্ত সম্ভাবনার মধ্যে রেখে দিয়ে যায়। তিনি কেন একজন মহৎ লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পাননি, সম্ভবত, তার প্রধান কারণ হচ্ছে জীবন সম্পর্কে তাঁর অসম্পূর্ণ উপলব্ধি। তাঁর চরিত্রেরা কথা বলে তাদের জিহ্বাটি মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে। এর ফলে তাদের বুদ্ধির চতুরতা প্রকাশ পায়, তবে মানবপ্রকৃতি সম্বন্ধে গভীর উপলব্ধি নয়। তাঁর চরিত্রগুলি থেকে যায় নকশা হিসেবে অথবা খুব বেশি হলে একটি রূপ হিসেবে। তারা কদাচিৎ রক্তমাংসের মানব-মানবীর মাত্রা লাভ করে।
সাধারণভাবে মানুষের মনে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সঙ্গে প্রেমেন্দ্র মিত্রের নামও একসঙ্গে চলে আসে, তবুও তাঁদের মতো পরস্পর পরস্পর থেকে ভিন্ন লেখক কদাচিৎ দেখতে পাওয়া যায়। তাঁদের মধ্যে একমাত্র মিল হচ্ছে তাঁরা দুজনেই লেখালেখি শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সর্বব্যাপী প্রভাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হিসেবে। তবে তাঁদের দুজনের মিলের শেষও সেখানেই। প্রেমেন্দ্র মিত্র বাঙলা ভাষার প্রথম লেখকদের মধ্যে একজন যিনি সমাজের নিম্নতম স্তরের জীবন থেকে সচেতনভাবে তাঁর লেখার উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর প্রথমদিকের কবিতাগুলির মধ্যে একটিতে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি কামার ও ছুতোর, কুলি ও মজুরদের কবি। তাঁর প্রথমদিকের একটি উপন্যাসের নাম ছিল পঙ্ক বা ‘কাদা’। এগুলিই ছিল তখনকার দিনের সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি ধরন। কিন্তু প্রেমেন্দ্র মিত্রের জন্য যা দুঃখজনক ছিল তা হলো, তিনি যখন অবক্ষয়ী সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন তখন তিনি সমাজে নতুন শৃঙ্খলার আবির্ভাবের কিছু দেখতে পাননি, যেখানে মানব-মানবী সকলেই জীবনের পূর্ণতা ও সুখ খুঁজে পাবে। নিপীড়ন ও অবিচারের সমস্যাগুলি নিয়ে ব্যাপৃত থাকলেও তিনি কখনো প্রচারকারী হয়ে ওঠেননি, যেহেতু তাঁর মতো শৈল্পিক কুশলতা ও কবিসুলভ সংবেদিতা তাঁর সময়ে খুব কম লেখকেরই ছিল। রোমান্টিকতার বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ শীঘ্রই তাঁর নিজস্ব এক নতুন রোমান্টিকতার জন্ম দেয় – সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলার এক জগৎ, যার অস্তিত্ব শুধু কবির কল্পনায়। তিনি তাঁর লেখকজীবন শুরু করেছিলেন অনেক উচ্চাশা নিয়ে এবং অভিজ্ঞতার নির্মম সত্য যখন তাঁর স্বপ্নগুলিকে চুরমার করে দেয়, তখন একটা ঝুঁকি ছিল যে, তিনি জীবন থেকে দূরে সরে যেতে পারেন। তাঁর একটি কি দুটি ক্ষুদ্রতর গল্পে এই বিচ্ছিন্নতার ভাব চোখে পড়ে, কিন্তু খুব শীঘ্রই তাঁর স্বভাবের রোমান্টিক উপাদান নিজের জায়গায় ফিরে আসে। এক অর্থে সেখানে বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটি ছিল, কারণ তিনি প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে আপস করতে অস্বীকার করেছিলেন এবং জীবন সম্পর্কে যে-স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তা নিয়ে লিখে যেতে থাকেন। তবে তাঁর লেখার আকর্ষণ কখনও হারিয়ে যায়নি, যেহেতু তাতে ছিল বিপন্ন মানবতার প্রতি তাঁর গভীর সহানুভূতি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর ভাষার জাদু। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের পর অন্য কোনো লেখকই রহস্য ও প্রত্যাশার ভাব সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে তাঁর মতো সফল হননি। প্রেমেন্দ্র মিত্রের মধ্যে মহৎ ঔপন্যাসিকের স্থপতিসুলভ গুণাবলির অভাব ছিল, কিন্তু সুন্দরের প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ ও জীবনের প্রতি সহানুভূতি তাঁর ভাষার জাদুর সঙ্গে একত্রে মিলিত হয়ে তাঁকে সমকালীন বাঙলার আকর্ষণীয় লেখকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠাদান করেছে।
বুদ্ধদেব বসু হলেন এমন আরেকজন লেখক যিনি প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখের চেয়ে আরো অনেক বেশি কিছু দাবি করেন। তরুণ বয়সেই তিনি কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন এবং তাঁর সব লেখাতেই কবির অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য তিনি ধরে রেখেছেন। একজন গীতিকবি সবসময়েই অপরিহার্যভাবে অহংসর্বস্ব হয়ে থাকেন। এটি তাঁর অভিজ্ঞতার পরিসর সীমিত করে রাখে, কিন্তু তাঁকে ভাগ্যের বিড়ম্বনা প্রতিহত করার শক্তিও জোগায়। বুদ্ধদেব বসু তাঁর প্রথমদিককার সব উপন্যাসে নিজেকে তুলে ধরেছিলেন এমনভাবে যা এক অর্থে ছিল রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক সূচিত কাব্যিক উপন্যাসের অনুবৃত্তি, আবার অন্য অর্থে সম্পূর্ণভাবে একটি নতুন বিস্মৃতি বা নিষ্ক্রমণ। রবীন্দ্রনাথের ছিল একজন মহৎ কবির অন্তর্দৃষ্টি যিনি মানব-অভিজ্ঞতার গভীরে পৌঁছেছিলেন এবং তবুও আশা ও আশাবাদিতা হারিয়ে ফেলেননি। বুদ্ধদেব বসুর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মতো বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি বা অন্তর্দৃষ্টি ছিল না এবং সেজন্য তাঁর কাব্যিক উপন্যাসগুলি আত্মপ্রতিকৃতির রূপ গ্রহণ করে যেখানে পাওয়া যায় বহির্জীবনের পরিচয়। তাঁর প্রথমদিকের অধিকাংশ উপন্যাসে চরিত্রের সংখ্যা মাত্র অল্প কয়েকটি এবং নায়ক অবশ্যই কবি নিজে। সংস্কৃতিবান ও পরিশীলিত এবং কিছুটা উদাসীন প্রকৃতির এই নায়ক তাঁর নিজের সীমাবদ্ধতাগুলি সম্পর্কে সচেতন। তিনি প্রগতিতে বিশ্বাস করেন, কিন্তু একই সঙ্গে সচেতন যে, এই প্রগতি অর্জনের উদ্যম তাঁর নেই। তিনি যদি সমাজের পরিবর্তন ঘটাতে না পারেন, তাহলেও যেন অন্তত এর ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে উপহাস করতে পারেন – এই মনোভাব লেখককে নিয়ে যায় শুষ্ক ছদ্মবুদ্ধিবৃত্তিমূলক রোমান্টিকতার দিকে এবং বুদ্ধদেব বসুর পরবর্তীকালের অধিকাংশ রচনা পরিপূর্ণ এই পরাজয়বোধে। এটি তাঁকে আনন্দময় ব্যক্তিগত রচনা লিখতে সমর্থ করেছে, কিন্তু রক্তমাংসের পূর্ণ মানব-মানবী সৃষ্টির পথে বাধাও হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বুদ্ধদেব বসুর পুরুষ চরিত্রগুলি যদি দুর্বল ও অরসিক হয়, তাহলে তাঁর উপন্যাসগুলির নারীরা আরো বেশি অসন্তুষ্টিকর। তারা কদাচিৎ, যদি কখনো আদৌ করে, রক্তমাংসের গঠন অর্জন করে। কেউ কেউ একে বুদ্ধদেব বসুর মৌলিক ঘাটতি বলে মনে করেন। তবে মনে হয় এটিই আসল কথা যে, তাঁর মধ্যে তাঁর চরিত্রগুলির সঙ্গে ভাবগত একাত্মতাবোধ গুণের অভাব রয়েছে। তাঁর গুণাবলি অবশ্যই গীতধর্মী এবং ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে পরিস্থিতি বা চরিত্র সৃষ্টির যে-গুণ একজন নাট্যকারের থাকে তাঁর মধ্যে সে-গুণের অভাব রয়েছে। ব্যাপক পঠন দ্বারা ঋদ্ধ বুদ্ধদেব বসুর কল্পনা প্রায়শ আহরিত প্রকৃতির। তিনি শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক উত্তরাধিকারী হিসেবে, কিন্তু খুব শীঘ্রই প্রভাবিত হয়ে পড়েন ফ্রয়েড এবং ডি.এইচ লরেন্স দ্বারা, যাঁদের বিশ^দৃষ্টি তাঁর নিজের প্রকৃতির সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। তাঁর অনেক গল্প ও উপন্যাসে তিনি যুক্তিভিত্তিক পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ উপস্থাপনের প্রয়াস গ্রহণ করেছেন, যদিও একই সময়ে বুদ্ধিবৃত্তির উপর স্বজ্ঞার অগ্রাধিকারের দাবিও করেছেন। এটি তাঁকে নিয়ে গেছে একটি অন্তর্দ্বন্দ্বের দিকে যা প্রধানত একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর দুর্বলতার বিষয়টির ব্যাখ্যা প্রদান করে। অনিবার্যভাবে একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে যুক্তিকে আবেগের অধীন রাখার চেষ্টা তাঁর দৃষ্টিকে অনিশ্চিত করে ফেলেছিল এবং সমন্বিত পরাদৃষ্টি ব্যতীত কেউই মহৎ কোনো উপন্যাস লিখতে পারে না। তবে এই দুর্বলতা তাঁর গীতিকবিতাকে স্পর্শ করতে পারেনি, যেহেতু সেগুলোতে মুহূর্তের মনোবেগ প্রায়শ তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্বের সমাধান ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। তবে কবিসুলভ মানসিক ধাত বুদ্ধদেব বসুকে রক্ষা করেছিল নৈরাশ্য ও হতাশা থেকে, যাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তাঁর সমসাময়িক অনেকেই এবং এখনো অনেকে মনে মনে এ-আশা পোষণ করেন যে, একদিন তিনিও তাঁর সন্দেহাতীত প্রতিভার উপযুক্ত একটি উপন্যাস লিখতে পারবেন।
অন্নদাশঙ্কর রায় বয়সে প্রেমেন্দ্র মিত্র বা বুদ্ধদেব বসুর চেয়ে কিছুটা বড় কিন্তু সাহিত্যরচনার ক্ষেত্রে তাঁদের কনিষ্ঠ। তিনি তাঁর ভ্রমণকাহিনি পথে প্রবাসে লিখে আকস্মিকভাবে খ্যাতি অর্জন করেন, যে-বইটি আক্ষরিক অর্থে পাঠকমনে ঝড় তুলেছিল। এই প্রথম বইটিতেই স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় কোথায় তাঁর শক্তি এবং কোথায় দুর্বলতা। তাঁর ভাষা সরল ও ধারালো এবং রায় প্রমাণ দেন, উচ্চ প্রশিক্ষিত মানসিকতার অধিকারী তিনি। তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে কোনোকিছুই এড়িয়ে যায় না। তবে তাঁর লেখায় রয়েছে ফলপ্রাপ্তির প্রবণতা এবং আত্মসচেতন বুদ্ধিবৃত্তিকতা যার মধ্যে নিহিত রয়েছে তাঁর আপন পরাজয়ের বীজ। তাঁর প্রথমদিকের উপন্যাসগুলিতে প্রকাশ পেয়েছে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণের বিষয়টি। বস্তুত এই পর্যায়ে প্রাচ্যের প্রাচীন সংস্কৃতির মধ্যে কদাচিৎ কোনো মূল্য খুঁজে পান তিনি। এটি ছিল সেই যুদ্ধ যখন তরুণ ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা বাস করতেন এইচ. জি. ওয়েলস, বার্নার্ড শ’ এবং বার্ট্রান্ড রাসেলের প্রেরণার ছায়ার নিচে। ‘লিগ অব নেশনস্’ সৃষ্টি করেছিল নতুন আশা এবং মানুষ বিশ্বাস করছিল যে, শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রসার দ্বারা বৈশ্বিক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হবে। মোহমুক্তির সূচনা তখনো ঘটেনি এবং তাঁর অনেক সমকালীনদের মতো অন্নদাশঙ্করও সে-যুগের বৈজ্ঞানিক ভাবধারা দ্বারা অভিভূত হয়েছিলেন। তবে প্রকৃতির মধ্যেই ছিল সহজাত এক রক্ষণশীলতা আর সেটিই তাঁকে এর যৌক্তিক উপসংহারের বিশ্লেষণ থেকে থামিয়ে দিয়েছিল।
অন্নদাশঙ্কর রায় ছিলেন বাঙলার সেই প্রথম ঔপন্যাসিকদের একজন যাঁরা তাঁদের উপন্যাসের মাধ্যমে জীবনের দর্শন ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন। এই ক্ষেত্রে তিনি সম্ভবত রোমা রোঁলার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, যাঁর জাঁ ক্রিস্তফ তরুণ ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। এটি ছিল যেমন একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব, অন্যদিকে ভারতীয় জীবনদর্শনের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা তথা গভীর অনুরাগের কারণে। যাই হোক না কেন, অন্নদাশঙ্কর ছয় খণ্ডে সত্যাসত্য নামে একটি মহাকাব্যোপম উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেছিলেন যেখানে মানুষের অস্তিত্বের সমস্যাগুলি সমাধান করা হবে শৈল্পিক দৃষ্টিতে। উপন্যাসটিতে রয়েছে অনেক চরিত্র – বরং বলা যেতে পারে অনেক বেশি চরিত্র – কিন্তু তারা থেকে গেছে অনেকটা গৎবাঁধা ধরনের এবং কোথাও রক্ত-মাংসের মানব-মানবী হয়ে ওঠেনি। প্রথম অংশ যার সেথা দেশ-এর শুরুটা ছিল চমৎকার, কিন্তু পরবর্তী অংশগুলি তেমন উজ্জীবনমূলক ছিল না। চরিত্রগুলি হয়ে উঠল লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির মুখপাত্র যেন শুধু। আর এমনকি সে দৃষ্টিভঙ্গিগুলিও সবসময় পরিষ্কার নয়। আত্মসচেতনতা একজন শিল্পীর অবিমিশ্র কোনো গুণ নয় এবং অন্নদাশঙ্করের মধ্যে দেখা যায় শক্তি ও দুর্বলতা উভয়ই, যা উৎসৃজিত হয় শৈল্পিক আত্মসচেতনতা থেকে। ভারত কখনো ইউরোপ হবে না – এই উপলব্ধি ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপ ও এর সংস্কৃতির প্রতি মুগ্ধতাবোধ তাঁর ক্রমশ ফিকে হয়ে আসতে থাকে। এই বোধ তাঁর মনে স্থিত হওয়ার পর তিনি চরমভাবে ভারতীয় মূল্যবোধের দিকে ফিরে যান এবং স্বজ্ঞাকে বুদ্ধিবৃত্তির উপরে স্থান দেন। তাঁর এই আকস্মিক রূপান্তর বিশ্বাসযোগ্যতা লাভ করতে ব্যর্থ হয় ও লেখকের মনে যে উদ্দেশ্য ছিল তাকে ব্যর্থ করে দেয়। রায় বুদ্ধিমত্তা ও ব্যাপক অভিজ্ঞতার অধিকারী, কিন্তু তাঁর মধ্যে আবার রয়েছে কল্পনার সেই জাদুকরী স্পর্শ যা এককভাবেই বুদ্ধিবৃত্তিধারী জীবসত্তার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে পারে।
স্থানাভাবের বিষয়টি বিবেচনা করে সমকালীন বাঙলার অন্য কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিকের রচনা সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা সম্ভব হলো না। আমি পূর্বে মনোজ বসুর নাম উল্লেখ করেছিলাম। তাঁর কয়েকটি ছোটগল্প আমাদের আনন্দ দিয়েছে। সেগুলিতে তিনি মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির পরিশীলনবিহীন জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। তাঁর দক্ষতার পরিচয় মেলে যখন তিনি সাধারণ নারী ও পুরুষের সরল আনন্দ ও দুঃখ নিয়ে লেখেন। বিশেষভাবে যুবক-যুবতী হয়ে উঠতে থাকা
তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ভালোবাসা গড়ে ওঠার আনন্দদায়ক বর্ণনা। যুগের হাওয়া তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল সমস্যাকেন্দ্রিক বিভিন্ন ধরনের উপন্যাস লিখতে, যেগুলির মধ্যে কয়েকটি ছিল বিশেষভাবে পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে বাঙলা ভাগের কারণে উদ্ভূত মানবিক দুঃখ-দুর্দশাকে নিয়ে। এই একই বিষয় উদ্বুদ্ধ করেছিল প্রবোধকুমার সান্যালকেও তাঁর প্রধান একটি উপন্যাস লিখতে। সান্যাল প্রথমত ছিলেন একজন ওস্তাদ গল্প-বলিয়ে এবং তাঁর ভ্রমণকাহিনি ভারতে ও ভারতের বাইরে ব্যাপক আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। তাঁর উপন্যাসগুলিতেও এই গুণ রয়েছে। একথা বলা যথার্থ হবে যে, তিনি ভ্রমণকাহিনির আবহ নিয়ে আসা ব্যতীত কদাচিৎ কোনো উপন্যাস লিখতে পারেন। তাঁর চরিত্রগুলিও সবাই ভ্রমণকারী এবং তারা ক্রমাগত অ্যাডভেঞ্চার ও নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সন্ধান করে বেড়ায়। তীব্র আবেগ তাঁর কাছে একটি ক্ষণস্থায়ী ভাব এবং তাঁর নায়ক ও নায়িকারা বিস্ময়কর সহজতার সঙ্গে প্রেমে পড়ে ও প্রেম থেকে বেরিয়ে আসে।
আমরা এখানে লেখকদের নাম আরও বাড়িয়ে যেতে পারি যেহেতু সমকালীন বাঙলায় উপযুক্ত ঔপন্যাসিকদের সংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁরা মহৎ শিল্পী না হতে পারেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রথম শ্রেণির রচনাকৌশল আয়ত্ত করতে পেরেছেন। সুবোধ ঘোষ সাহিত্যজগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন ‘ফসিল’ গল্পটি নিয়ে, যেটি বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব ও রচনাকৌশল বিবেচনার দিক থেকে বাঙলায় একটি নতুন রীতির প্রতিষ্ঠা করেছিল। প্রতিভা বসুকে প্রথমদিকে মনে করা হতো তাঁর স্বামী বুদ্ধদেব বসুর পদাঙ্ক অনুসরণকারী একজন অপেশাদার লেখিকা হিসেবে। তবে তিনি খুব শীঘ্রই নারীসুলভ গুণ ও নিবিড় পর্যবেক্ষণ-শক্তি আয়ত্ত করতে সক্ষম হন যা কিছু যোগ্য সমালোচককে বাধ্য করে তাঁকে একজন ভালো ঔপন্যাসিক হিসেবে মেনে নিতে। আশাপূর্ণা দেবী হলেন অপর একজন লেখিকা যিনি অবশ্যই পূর্ণতর বিবেচনা দাবি করতে পারেন, যেহেতু তাঁর মধ্যে শুধু বিশদ বিবরণ দেওয়ার মতো মহিলাসুলভ দৃষ্টিই যে আছে তা নয়, বরং জীবনের বক্রাঘাতের প্রতি করুণার অনুভূতিও রয়েছে। যেসব ঔপন্যাসিক মুসলিম সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন তাঁদের মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদ মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন প্রায় ত্রিশ বছর আগে। এর পর থেকে সেখানে আরো অনেক প্রতিভাবান লেখকের আবির্ভাব ঘটে যাঁদের একজন হচ্ছেন আবদুল জব্বার। সবচেয়ে কমবয়সীদের মধ্যে একজন হলেও তাঁর নিরেট বাস্তববাদিতা এবং পল্লিজীবনের কঠোরতা ও একান্ত পরিচিতিমূলক জ্ঞানের কারণে তিনি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখেন। বাঙলার মহিলা ঔপন্যাসিকরা, মুসলমান সমাজজীবনের নানা বিষয় নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের মতো, পৃথক ও স্বাধীন বিবেচনার দাবি যাঁরা রাখেন তাঁদের বিষয়টি পুনর্বার কোনো পঠনপাঠন ও বিবেচনার জন্য রেখে দেওয়াই উত্তম।
এখন আমরা সমকালীন উপন্যাসগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহের কয়েকটি সম্পর্কে আবার কিছু ইঙ্গিত প্রদান করে এই আলোচনা শেষ করতে পারি। এসব উপন্যাসে বিষয়বস্তু ও প্রসঙ্গ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে। পূর্বে শিল্পের জগৎ থেকে বাইরে রেখে দেওয়া জীবনের অনেক ক্ষেত্র ও অভিজ্ঞতা উপন্যাসের আওতার মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। একই সঙ্গে উপন্যাসে ব্যবহৃত রচনাকৌশলের ধরনগুলির ক্ষেত্রেও বিস্ময়কর প্রসার ঘটেছে। এখনকার লেখকরা শুধু লোকশিল্পের প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য ও চিরায়ত সাহিত্য থেকেই তাঁদের বিষয় আহরণ করেন না, বরং বিচিত্র প্রকৃতির ইউরোপীয় ও আমেরিকান মডেল থেকেও তাঁদের প্রেরণা খুঁজে নেন। কখনও কখনও পাশ্চাত্য পরিবেশের উপযোগী বিষয়বস্তু ও রচনাপ্রকৃতিও কোনো প্রকার পরিবর্তন ছাড়া অনুসরণ করা হয়ে থাকে, যার ফল হয় শৈল্পিক বিচারের দিক থেকে অসন্তোষজনক। সব ধরনের উদ্ভাবনের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী রচনা-প্রকরণেরও দেখা মেলে এবং আমরা তেমন উপন্যাসও পেয়ে থাকি যেগুলি লেখা হতে পারত একশ বছর আগে। আধুনিক ভারত বহু যুগ ও বহু অঞ্চলের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। আমরা দেখি, অত্যন্ত আধুনিক মনোভাবের পাশাপাশি বিদ্যমান রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতি ও বিশ্বাসসমূহ। একই ধরনের বিস্ময় সৃষ্টিকারী বৈচিত্র্য দেখা যায় বাঙলা সাহিত্যের জগতেও এবং আমাদের রয়েছে শিল্পের জ্ঞাত প্রায় প্রতিটি প্রকারের সমর্থক। ঐতিহ্যপন্থীরা অবশ্য সাধারণভাবে রয়েছেন আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে এবং তরুণতর লেখকরা বিশেষ উদ্বেগের সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন – কমিউনিস্ট ও অকমিউনিস্ট পাশ্চাত্যের চলতি ধারাগুলি অনুকরণ বা উপযোজনের মাধ্যমে – তাঁদের প্রেরণা ও ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী সাফল্য অর্জনের জন্য।
প্রথমদৃষ্টিতে কিছুটা বিস্ময়কর মনে হয় যে, পাশ্চাত্যের প্রতি এই মোহ সত্ত্বেও সমকালীন বাঙালি ঔপন্যাসিকরা সামগ্রিকভাবে নৈরাশ্য ও বিচ্ছিন্নতার বোধ থেকে মুক্ত, যা আজকের ইউরোপ ও আমেরিকার সবচেয়ে সংবেদী লেখকদের মধ্যে কয়েকজনের চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য। বাস্তবিক পক্ষে নৈরাশ্য ও বিচ্ছিন্নতাবোধের এই মনোভাব এখন সোভিয়েত লেখকদের মধ্যেও অনেককে অধিকার করেছে। এমন নয় যে, বাঙলার ঔপন্যাসিকরা কখনও বিষণ্নতা ও বিচ্ছিন্নতা বোধ দ্বারা আক্রান্ত হননি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাগুলির কয়েকটির মধ্যে বিষাদ ও হতাশার ভাবের উপস্থিতি এবং যে রূঢ় অভিজ্ঞতা প্রেমেন্দ্র মিত্রকে নিরেট বাস্তববাদী থেকে রোমান্টিক স্বপ্নদ্রষ্টায় পরিণত করেছে তার কথা আমরা উল্লেখ করেছি। এতদসত্ত্বেও এমনকি যখন লেখক সামাজিক অবিচার ও দুঃখ-যাতনা দ্বারা উৎপীড়িত তখনও সাধারণ আবহ হচ্ছে সমাজ নিয়ে ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা দ্বারা গভীরভাবে চিন্তাগ্রস্ত। এর ব্যাখ্যা, মনে হয় – অনেক বিদ্যমান অপকৃষ্টতা সত্ত্বেও মানুষজনের মৌলিক মনোভাব হচ্ছে আশাজনক ও প্রত্যাশাব্যঞ্জক। মুহূর্তিক বিষণ্নতা প্রকাশের পথ খুঁজে পেয়েছে ছোটগল্প ও কবিতায় এবং এদের মধ্যে অনেকগুলিতেই রয়েছে অবসাদ ও হতাশার ছাপ, কিন্তু জাতীয় জীবনের নতুন জাগরণকেন্দ্রিক অন্তর্নিহিত আশাবাদ প্রতিফলিত সেই প্রতিশ্রুতির ভাবার্থে যা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসগুলিকে উদ্দীপ্ত করছে।
বাঙলার অত্যাধুনিক উপন্যাসের বিরুদ্ধে প্রধান যে সমালোচনা তা হচ্ছে – এটি এখনও এর পায়ের তলার মাটি খুঁজে পায়নি। উপন্যাসের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, তা হবে বাস্তবতার যথার্থ প্রতিফলন। অবশ্য বাস্তবতা হচ্ছে অসীমসংখ্যক উপাদানের সামগ্রিকতা। সচেতন জীবন সংহতি ও গুরুত্ব অর্জন করে অপ্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি দিকগুলিকে বর্জন ও অত্যাবশ্যক উপাদানগুলির ওপর মনোযোগ নিবদ্ধ করার মাধ্যমে। যখনই কোনো উপন্যাসে অভিজ্ঞতার সকল দিক প্রতিফলিত করার চেষ্টা করা হয় তখনই এর সংহতি ও গুরুত্ব হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। জীবনের একটি সুসংগঠিত চিত্র পাওয়ার পরিবর্তে আমরা তখন হয়তো পেতে পারি ঘটনাবলি ও আপতিক ঘটনাসমূহের একটি সমাহারকৃত পিণ্ড, যা সেগুলির সংখ্যাধিক্য দ্বারা আমাদের হতবিহ্বল করে। ইউরোপে জীবনকে এর সমগ্রতায় চিত্রিত করার প্রয়াস চেতনাপ্রবাহভিত্তিক উপন্যাসের সূচনা ঘটায়। বাঙলায়ও আধুনিক ঔপন্যাসিকদের মধ্যে কয়েকজন একই মডেল অনুসরণের চেষ্টা করেছিলেন যার ফল দাঁড়িয়েছিল এমনকি ইউরোপ ও আমেরিকার চেয়েও কম সন্তোষজনক।
অত্যাধুনিক উপন্যাসের দ্বিতীয় বাধা হচ্ছে এর অপরিহার্য নিরীক্ষামূলক ভাব। অধিকাংশ ঔপন্যাসিকই তাঁদের নিজেদের ব্যাপারে নিশ্চিত নন এবং আস্থার সঙ্গে লেখেন না। তাঁরা পুরনো সামাজিক প্রথাগুলি প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং এমনকি উপন্যাসের ঐতিহ্যবাহী প্রকরণ নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করেন। অবশ্য তাঁরা জীবনের কোনো বিকল্প দর্শন খুঁজে পাননি এবং এও কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে, তাঁরা এমনকি উপন্যাসের রচনাকৌশল সম্পর্কেও নিশ্চিত নন। স্বীকৃত নৈতিক মানগুলি প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে তাঁরা কখনও কখনও বাড়াবাড়িও করে ফেলেছেন। বিমূর্ত স্বাধীনতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য তাঁদের প্রয়াস প্রায়শই পরিণত হয় ছাড়পত্রে। বিস্ময় সৃষ্টি ও আকস্মিক আঘাত দেওয়ার জন্য তাঁদের প্রয়াসে তাঁরা যে শুধু ঐতিহ্যগত নৈতিকতাকেই ভেঙে ফেলেন তা নয়, কখনও কখনও কোনো একটি নৈতিকতাবোধও তাঁদের থাকে না। ঐতিহ্যগত নৈতিকতার বিরুদ্ধে তাঁদের বিদ্রোহ সবচেয়ে বেশি স্পষ্টভাবে দেখা যায় যৌনতার প্রতি মনোভাবের মধ্যে। তাঁরা শুধু বিবাহবহির্ভূত ভালোবাসার বিষয়ই তাঁদের লেখায় নিয়ে আসেন না, বরং ভালোবাসাহীন যৌনক্রিয়ার মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পান। তাঁদের আত্মপক্ষ সমর্থনের একটি যুক্তি হলো – বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ হচ্ছে জীবনের বাস্তবতা। এমনকি যখন কোনো আবেগমূলক সম্পর্ক থাকে না তখনো এ-ধরনের আকর্ষণ বিদ্যমান থাকতে পারে। এমনকি যেক্ষেত্রে এরূপ আকর্ষণের কোনো নৈতিক বা আবেগমূলক যৌক্তিকতা থাকে না তখনও জীবনচিত্র তুলে ধরার যে-কোনো প্রয়াসে এর অস্তিত্বের বিষয়টিকে বিবেচনার মধ্যে নিতে হয়। তাঁরা যুক্তি দেখান যে, কয়েকজন ইউরোপীয় ঔপন্যাসিক যৌনতাকে কেবল বিদ্রোহের মনোভাব হিসেবে ব্যবহার করেননি, বরং বিষয়টিকে বিবেচনা ও নিরীক্ষা করে দেখেছেন মানবিক অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে। তাঁদের পশ্চিমি সমকক্ষদের মতো তাঁরাও এ-মত প্রচার করেন যে, প্রবল আবেগকে হৃদয়াবেগ বা কল্পনামূলক প্রতীকী সজ্জার দ্বারা আচ্ছাদিত করার পরিবর্তে স্বাভাবিক অনৈতিক প্রকাশ হিসেবে গ্রহণই উত্তম।
নারী ও পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ দ্বারা সৃষ্ট সমস্যাবলি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ সচেতন ছিলেন, কিন্তু তিনি সামগ্রিকভাবে এই বিষয়টিকে চিত্রিত করেছেন কিছুটা এর স্থূলতর প্রকার দ্বারা। সমাজের বিদ্রোহীদের প্রতি শরৎচন্দ্রের সহানুভূতি ছিল অনেক এবং তিনি কখনো কখনো তাদের যৌন বিচ্যুতির জন্য নতুন ও নৈতিক যৌক্তিকতা প্রদান করেছেন। রাজলক্ষ্মী বা সাবিত্রীর মতো চরিত্র আমাদের মনে সহানুভূতি ও শ্রদ্ধা জাগায়, যদিও এমনকি সমাজ তাদের হয়তো চরিত্রভ্রষ্টা হিসেবে ঘৃণা করতে পারে। এমনকি গৃহদাহের অচলার ক্ষেত্রে যেমনটি দেখা যায় – আমরা যখন তাদের চরিত্রকে সমর্থন করতে পারি না, সে ক্ষেত্রেও শরৎচন্দ্র তাঁর ভ্রান্তপথগামিনী নায়িকাদের জন্য আমাদের সহানুভূতি জয় করে নিতে সমর্থ হন; কিন্তু সমকালীন বাঙলার অনেক ঔপন্যাসিক তা করতে পারেন বলে আমরা বলতে পারি না।
আধুনিকতাপন্থী বাঙলা উপন্যাসে অবাস্তবতার উপাদান আসে প্রধানত ইউরোপ ও ভারতের সামাজিক আবহের ভিন্নতার কারণে। ইউরোপে নারী-পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক মেলামেশার ঘটনা অনেক অনেক বেশি। সেখানে বিপথগমন ও ভুলভ্রান্তির সুযোগও অনেক বেশি। ইউরোপীয় সাহিত্যে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে নারী ও পুরুষের মধ্যেকার বন্ধুত্ব যৌনসম্পর্কযুক্ত ভালোবাসায় পরিবর্তিত হয়। অধিকতর বাধানিষেধযুক্ত ও গোঁড়া ভারতীয় সমাজে এ-ধরনের রূপান্তরণের সুযোগ অনেক কম। এটি শুধু এজন্য নয় যে, এখানে নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশার এমন সুযোগ অনেক কম; সামাজিক ঐতিহ্যগুলিও এমন মানসিকতা তৈরি করে যেখানে ভুলভ্রান্তির প্রতিরোধও বেশি। এটি দুভাবে ঘটে। এর একটি কারণ হচ্ছে, ভারতীয় সমাজ শারীরিক সতীত্বকে অনেক বেশি মূল্য দেয় এবং এর ফলে তা আরো বেশি আদর্শায়িত হয়ে পড়েছে। ভারতে শারীরিক মিলনের পথে বাধাগুলি অতএব শুধু বাহ্যিক বিষয় নয়, বরং অন্তরগতও। ভারতে একজন নারীর একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক থাকার ব্যাপারটি প্রবল বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ইউরোপে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্নকারী মহিলা ও বিধবারা কোনোরূপ সামাজিক কলঙ্ক ব্যতীতই পুনর্বিবাহ অথবা স্বাভাবিক যৌনজীবন উপভোগ করতে পারে। ভারতে ভুলভ্রান্তির শাস্তিও ইউরোপীয় সমাজের চেয়ে অনেক বড়। ইউরোপীয় পরিবেশে পদস্খলনের পরও একজন নারীর উদ্ধার পাওয়ার অনেক সুযোগ থাকে। ভারতীয় জীবনের প্রেক্ষাপটে একবার মাত্র পদঙ্খলনের অর্থই হলো চিরকালের জন্য ধ্বংস হয়ে যাওয়া। রবীন্দ্রনাথের নষ্ট নীড় থেকে শুরু হয়ে অবৈধ প্রণয়ের সমস্যা সবসময় বাঙলার ঔপন্যাসিকদের আকর্ষণের বিষয় হয়ে রয়েছে। আমরা দেখেছি, রবীন্দ্রনাথ কিভাবে বারবার এই বিষয়বস্তুতে ফিরে এসেছেন। এই বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে শরৎ চন্দ্রের অধিকাংশ উপন্যাস। তবে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎ চন্দ্র দুজনেই সংযমের সঙ্গে বিষয়টিকে ব্যবহার করেছেন। তরুণতর লেখকদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য ঐতিহ্যের প্রতি বিদ্রোহ দ্বারা কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়েছেন এবং অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে কেবল এতেই তাঁদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছেন। যেমন দেখা যায় নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের ক্ষেত্রে কখনও কখনও ফলাফল এই দাঁড়িয়েছে যে – ভাববাদের প্রতি বিদ্রোহের ক্ষেত্রে তাঁরা মানবচরিত্রের অন্ধকার দিকটিকে ভিত্তি করে ছদ্ম-ভাববাদের বিকাশসাধন করেছেন।
অনেক সমকালীন বাঙলা উপন্যাসে বাস্তবতার এই ঘাটতি স্পষ্ট শুধু নৈতিকতা ও যৌনতার ব্যবহারের মধ্যেই নয়, বরং সাধারণ মানুষের জীবনের বিরাট অংশের প্রতি অবহেলার মধ্যেও। অধিকাংশ সমকালীন লেখক, বিরল কিছু ব্যতিক্রমসহ, তাঁদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন গ্রামীণ জীবনের চেয়ে বেশি করে শহুরে ও আধা-শহুরে জীবনের প্রতি। এটিই বাস্তবতা সম্পর্কে তাঁদের ধারণার অভাবের প্রমাণ। সম্ভবত বাঙলার দুই-তৃতীয়াংশ বা আরো বেশি মানুষ বাস করে গ্রামে। মোট জনসংখ্যার ষাট শতাংশ মানুষ কৃষক এবং তবুও এমনকি আজকের দিনেও অধিকাংশ বাঙলা উপন্যাসে চিত্রিত হয় শহরবাসী মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের জীবন। অবশ্য এটিই সব কথা নয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে বাঙলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল মুসলমান। এমনকি আজও পশ্চিম বাঙলার প্রায় এক-চতুর্থাংশ অধিবাসী মুসলমান। দুটি সম্প্রদায়ই প্রায় হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বাস করে আসছে। একই সুখ-দুঃখ তারা ভাগ করে নিয়েছে এবং ভোগ করেছে একই দুর্ভোগ। বাঙলা উপন্যাসে অবশ্য এই অভিন্ন জীবনের প্রতিফলন খুবই সামান্য এবং এমনকি দুই সম্প্রদায়ের পুরুষ ও নারীর মিলনও যখন হয় তখনও তাদের মধ্যে কৃত্রিমতা ও টানাপোড়েনের একটি অদ্ভুত ভাব থেকে যায়। বাঙলা এখনো অপেক্ষা করছে তেমন এক প্রতিভার আবির্ভাবের জন্য যিনি অন্তর্দৃষ্টি, কর্তৃত্ব ও তীব্র আবেগ সহকারে অভিজ্ঞতার এই অনির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলি নিয়ে লিখতে সক্ষম হবেন। বাস্তবতার এই ঘাটতিকে কেউ হয়তো অন্যভাবেও উল্লেখ করতে পারেন। শরৎ চন্দ্রের সময়কাল পর্যন্ত বাঙলার ঔপন্যাসিকদের যে প্রধান প্রণোদনা আন্দোলিত করেছিল তা হচ্ছে তাঁর মানবিক সহানুভূতি। এ-কথা সত্য যে, তাঁর সহানুভূতি প্রায়শ সীমিত থাকত তাঁর নিজ সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে এবং মনে হতো তিনি অন্যান্য ধর্মের অনুসারী তাঁর দেশবাসী মানুষদের সম্পর্কে সাধারণভাবে অনবহিত ছিলেন। ওপরে যা বলা হলো তা সত্ত্বেও বঙ্কিম, শরৎ চন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব লেখায় ভুলপথগামী ও দুঃখকষ্ট ভোগকারী স্বদেশবাসীদের প্রতি তাঁদের সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে।
এ-কথাও ঠিক নয় যে তাঁদের উত্তরসূরিরা নিজেদের সৃষ্ট চরিত্রসমূহের জন্য কিছু অনুভব করেন না। তাঁরা তা করেন এবং বাস্তবিক পক্ষে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সচেতনভাবে তাঁদের সহানুভূতির ক্ষেত্রের বিস্তার ঘটাতে চান; তবে কেউ যেমন ইচ্ছা করলেই ভালোবাসতে পারেন না, তেমনি কেবল ধীশক্তির নির্দেশক্রমেও কেউ একান্তবোধের অনুভূতি অনুভব করতে পারেন না। বহু ঔপন্যাসিকের ক্ষেত্রে যা সত্য তা হলো – ধীশক্তি তাঁদের মধ্যে অধিক প্রভাবশীল হয়ে পড়েছে এবং তাঁদের প্রধান প্রেরণা পরিবর্তিত হয়েছে সহানুভূতি থেকে কৌতূহলে।
নিজেদের সৃষ্ট চরিত্রগুলির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করার পরিবর্তে তাঁরা অধিক আগ্রহী অনুসন্ধানে ও বিশ্লেষণে। সন্দেহ নেই যে, এই বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহল উপন্যাসের পরিধি বিস্তৃততর করেছে এবং নতুন রচনাকৌশলের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। তবে এই প্রসারণ অবিমিশ্র প্রাপ্তিযোগ তৈরি করেনি, যেহেতু এই অনুসন্ধিৎসা কখনও কখনো সাহিত্যমানের পথেও বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণগুলি খুঁজতে দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ও দর্শনের অভিঘাতের ফলে সৃষ্ট রেনেসাঁস বিরাট প্রত্যাশার আশা জাগিয়েছিল, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শীঘ্রই সেটি জড়িয়ে গেল পুনর্জাগরণবাদী পশ্চাৎমুখিতার সঙ্গে। পশ্চিমের এই পতন হতোদ্যমী প্রভাব হিসেবে কাজ করেছে, তবে এর প্রধান কারণ ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির সামঞ্জস্যহীন প্রসারণের মাধ্যমে সমাজের ক্রমবর্ধমান ভাঙন। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুযোগ মানুষের ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি এবং এমনকি স্বাধীনতা অর্জনের ঘটনাও জাতির সৃজনশীল শক্তির বন্ধনমুক্তি ঘটাতে সক্ষম হয়নি।
সাহিত্যের বিকাশ অবশ্য কোনো স্থবির আইন অনুসরণ করে ঘটে না। অর্থনৈতিক নিয়তিবাদে বিশ্বাস অথবা অন্ধবিশ্বাসের প্রতি আত্মসমর্পণ কোনোটিই সাহিত্যিক প্রতিভার আবির্ভাব ব্যতীত মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে না। প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে না কেবল আমরা আঁর আগমনের প্রতীক্ষা করি বলেই, বরং সামাজিক অবস্থাসমূহই এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে যেখানে প্রতিভার স্ফূরণ ও পূর্ণতা ঘটবে। সাহিত্য-সমালোচকেরাও জনরুচির মানোন্নয়ন ঘটিয়ে সেই পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত সাহিত্যসৃষ্টির পূর্ণতা ঘটে তখনই যখন একজন মহৎ প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে। এবং একজন প্রতিভাবানের আবির্ভাব কেবল তখন ঘটে যখন পরম সত্তা তাঁর আবির্ভাব সম্ভব করেন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.