এটি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, বিজ্ঞান তার মাতৃরূপী দর্শনের থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। প্রাথমিক যুগের দার্শনিকদের অন্তর্জ্ঞান বিজ্ঞানীদের মনোজগৎকে আলোকিত করেছে। আবার একই সঙ্গে বিজ্ঞানের ওপর দর্শন অনেক সময় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ারও জন্ম দিয়েছে, যখন প্রথাগত জ্ঞানের বাইরে নতুন চিন্তার কোনো অভিযাত্রায় তা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই একটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বিজ্ঞান ও দর্শনের মাঝে একটি সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব স্মরণাতীত কাল থেকেই চলে আসছে। কারো কারো ধারণা যে, বিজ্ঞানীরা অনেকটা শিকারি কুকুরের মতো, যারা সত্য নিরূপণ করতে মাটি শুঁকে শুঁকে প্রকৃতির নিয়মকে আবিষ্কার করে। অন্যদিকে দার্শনিকদের ভূমিকা হচ্ছে ঈগল পাখির মতো, যারা উঁচু আকাশে উড়তে উড়তেই সে বস্তুটির সন্ধান পায়।
পদার্থবিজ্ঞানীরা অবশ্য একটি কার্যকর দর্শন নিয়ে চলেন, সেটি হচ্ছে, বাস্তবতা নামক সত্যটিকে খুঁজে বের করা। এটি করতে গিয়ে তাঁদের পেরোতে হয় প্রত্যক্ষণ ও পরীক্ষণের জটিল কার্যক্রম। সেক্ষেত্রে দর্শনলব্ধ কোনো জ্ঞান ও ঐশীবাণী তাঁদের খুব কম ক্ষেত্রেই সাহায্য করে থাকে। অন্তত বর্তমান বিজ্ঞানীদের কোনো দিকনির্দেশনা দিতে দর্শন তার কার্যকারিতা হারিয়েছে – এ-কথাটি নির্দ্বিধায় বলা যায়। সম্ভবত দার্শনিকেরাও এ-সত্যটি সম্বন্ধে অবগত রয়েছেন। বিজ্ঞানের দর্শনে তাঁর তিন দশকের অভিজ্ঞতা থেকে দার্শনিক জর্জ গেইল বলেন যে, ‘আমাদের প্রাচীনগন্ধী আলোচনা ও বিতর্ক বর্তমান অতি অল্পসংখ্যক কর্মরত বিজ্ঞানীকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম।’ বিশ শতকের একজন গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ভিটগেনস্টাইন বলেছেন, ‘আমি নিশ্চিত যে কোনো বিজ্ঞানী কিংবা গণিতবিদ, যিনি আমার লেখা পড়বেন – তিনি আমার কাজ দিয়ে লক্ষযোগ্যভাবে প্রভাবিত হবেন না।’
পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েনবার্গ নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন তাঁর ড্রিমস অব অ্যা ফাইনাল থিয়োরি নামক বইটিতে – ‘পদার্থবিদ্যা ও গণিতের উজ্জ্বল সাফল্যের বিপরীতে আমার পঠিত দর্শন গ্রন্থগুলো নিষ্প্রভ বলে মনে হয়েছে। এ সমস্ত গ্রন্থ এমনসব জটিল, দুর্বোধ্য বাক্য দিয়ে ভর্তি যে মাঝে মাঝে এগুলিকে অভেদ্য বলে মনে হয়েছে। আমি অবশ্য দু-একজন দার্শনিকের লেখা পড়ে উদ্দীপিত হয়েছি – যেমন ভিটগেনস্টাইন কিংবা পল ফেয়ারাব্যাল্ড। তবে তাদের সংখ্যা নগণ্য।’
এবার একটু অতীতের দিকে নজর ফেরানো যাক। ডেমোক্রিটাস ও লুসিপ্পাস চিন্তা করেছিলেন পরমাণুর কথা। মহাজগৎ পরিচালনার এমন একটি যান্ত্রিক ব্যাখ্যার কথা তাঁরা ভেবেছিলেন, যখন বাকি সবার বিশ্বাসের জগতে রাজত্ব করতো দৈত্য-দানো, দেবতা ও অন্যান্য অতিপ্রাকৃতিক শক্তি। এরপর এপিকিউরাসও অলিম্পিয়া পবর্তশীর্ষের মহাবলী দেবতাদের পরিবর্তে একটি যান্ত্রিক বিশ্বের ধারণা নিয়ে হাজির হলেন। সপ্তদশ শতকের ত্রিশের দশকে রেনে দেকার্তে যখন বিশ্ব পরিচালনার নিয়মগুলো বুঝে উঠতে একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা নিয়ে এলেন, তাঁর এই মতবাদ পরবর্তীকালে নিউটনের ওপর খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। যান্ত্রিকতার এই দর্শন ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে চূড়ায় আরোহণ করে, যখন পদার্থবিদ্যা, গণিত, রসায়ন ইত্যাদি শাস্ত্রে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ঘটে। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মানুষের চিন্তার ইতিহাসে এই যান্ত্রিক বিশ্বদৃষ্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রে রয়েছে সূর্য, যে তার মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে গ্রহ-উপগ্রহগুলোকে ধরে রেখেছে – নিউটনের এই ব্যাখ্যাকে মেনে নিতে দেকার্তের অনুসারীদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। এর কারণ, তাঁরা কেউ বিশ্বাস করতে পারেননি যে, ৯ কোটি ৩০ লাখ মাইল দূর থেকে শূন্যস্থানের ভেতর দিয়ে একটি বস্তু কীভাবে অন্য বস্তুদের আকর্ষণ করবে! এ-বিষয় মেনে নিতে বিজ্ঞানীদের আরো প্রায় দু-শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়েছে। যেসব ইউরোপীয় দেশের বিজ্ঞানীরা একে মেনে নেন, ক্রমানুসারে সেগুলি হচ্ছে – ব্রিটেন, হল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স ও জার্মানি। তবে এই পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছেন ফরাসি লেখক ভলতেয়ার ও জার্মান দার্শনিক কান্ট। এরপর ঊনবিংশ শতকে যান্ত্রিকতার দর্শন আরো প্রসার লাভ করে মাইকেল ফ্যারাডে, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল প্রমুখের কর্মকাণ্ডে।
এরপর ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্লাঙ্ক কর্তৃক কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন কর্তৃক আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আবিষ্কার হওয়ার পর ঘটলো একটি চূড়ান্ত মোড় পরিবর্তন। তবে এরপরও পুরনো ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী বিজ্ঞানীদের মধ্যে চিরায়ত বিজ্ঞানের দর্শন বেশ প্রভাব বজায় রেখেই চললো। এ-ঘটনাটি নিয়েই রাসেল ম্যাককরমাক তাঁর Night Thoughts of a Classical Physicis বইটিতে একটি কাল্পনিক চরিত্র – অধ্যাপক ভিক্টর জ্যাকবকে তুলে ধরেছেন, যিনি নতুন বিজ্ঞানের এ-দর্শনকে মেনে নিতে পারছিলেন না।
ঊনবিংশ শতকের সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক মার্কস ও এঙ্গেলসের অনুসারীরাও বিশ শতকের প্রথমদিকে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা নিয়ে গুরুতর সমস্যায় পড়েন। লেনিন রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করার আগেই, ১৯০৮ সালে, একটি শব্দাড়ম্বরপূর্ণ বই লেখেন, Materialism and of Empirio-criticism নামে, যার দর্শন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাকে সোভিয়েত বিপ্লব-পরবর্তী রাশিয়াতে গ্রহণ করে নিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি রুশ বিপ্লবের চার দশক পরও ১৯৬১ সালে প্রখ্যাত সোভিয়েত পদার্থবিদ ভøাদিমির ফক তাঁর বই The Theory of Space, Time and Gravitation-এর ভূমিকাতে লিখেছিলেন – ‘স্থান, কাল ও মহাকর্ষ নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা রূপ লাভ করেছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ থেকে – বিশেষ করে লেনিনের লেখা মেটেরিয়েলিজম অ্যান্ড ইম্পেরিও ক্রিটিসিজম বইটি থেকে।’
বিশ শতকের প্রথম দিকেই প্লাঙ্ক-আইনস্টাইন-বোহরের অভিভাবকত্বে ‘কোয়ান্টাম ও আপেক্ষিকতার যুগ’ শুরু হওয়ার পর থেকেই চিরায়ত পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রটি সংকুচিত হয়ে আসতে থাকে। পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে আবির্ভূত হলো বস্তু ও প্রতিবস্তু কণিকা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, পজিট্রন এবং অন্যদিকে বিভিন্ন বলক্ষেত্র – বিদ্যুৎ ও চুম্বকীয় ক্ষেত্র, মহাকর্ষীয় বলের ক্ষেত্র ইত্যাদি – যেসব বলক্ষেত্র নানা বস্তুকণিকারই সৃষ্টি। এরপর ১৯২৯ সালে পদার্থবিদ্যা আরো একটি একীভূত দৃষ্টিভঙ্গির দিকে এগুলো – যখন হাইজেনবার্গ এবং পাউলি কণিকা ও বলকে ব্যাখ্যা করলেন বাস্তবতার আরো এক গভীর স্তর – কোয়ান্টাম ক্ষেত্রে। এর আগেই কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে প্রয়োগ করা হয়েছে আইনস্টাইনের আলোককণিকা, ‘ফোটনে’র বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্রে। এখন পাউলি ও হাইজেনবার্গ দেখলেন যে, শুধু ফোটন নয়, সব বস্তুকণিকাই বলক্ষেত্রে একটি শক্তি – যেমন ইলেকট্রন হচ্ছে ইলেকট্রন ক্ষেত্রের শক্তি, নিউট্রিনো হচ্ছে নিউট্রিনো ক্ষেত্রের শক্তি ইত্যাদি। কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব (Quantum Field Theory) ১৯৫০-এর দশকে বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত তত্ত্ব হিসেবে গৃহীত হয় এবং মৌলিক পদার্থবিদ্যার একটি কাঠামো হয়ে দাঁড়ায়। এরপর থেকে পদার্থবিদরা বিশ্বসংসারের উপাদান হিসেবে দেখতে পান বস্তুকণা নয়, শুধু কিছু বল-ক্ষেত্রকে।
এরপর থেকে পুরনো যান্ত্রিক ব্যাখ্যার বিশ্বদৃষ্টি আর পুনর্জীবিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা গেল না। কিন্তু এই কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্বও চূড়ান্ত কিছু নয়, কারণ এতে মহাকর্ষ বলকে অন্তর্ভুক্ত করতে সমস্যা রয়ে গেল। এক্ষেত্রে পরবর্তীকালে এলো স্ট্রিং তত্ত্ব। কান্ট আমাদের শিখিয়েছিলেন যে, স্থান ও কাল বহির্জগতের কোনো বাস্তবতা নয়, বরং তা আমাদের আন্তর্জগতেরই পূর্বরচিত কাঠামো, যা আমাদের বস্তু ও ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করে। কিন্তু কান্ট-শিষ্যদের কাছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা আসে একটি আঘাত হিসেবে, যাতে স্থান ও কাল নির্ভর করে গতি এবং মহাকর্ষের ওপর। তবে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়ার পরও কিছু পদার্থবিদ মনে করেন যে, স্থান ও কাল নির্ভর করে বিশুদ্ধ চিন্তার ওপর।
মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে এরকম একটি ‘অধিবিদ্যাগত সমস্যা’ তৈরি হয় যখন বিগ ব্যাংগ তত্ত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় যে, তাহলে এর আগে কী ছিল? এর উত্তর দিতে গিয়ে পদার্থবিদরা বলেন যে, এর আগে বলে কিছু হয় না – যেমনটা চূড়ান্ত শীতল তাপমাত্রার (-২৭৩°k) নিচে কোনো তাপমাত্রা নামতে পারে না কিংবা উত্তর মেরুর উত্তরে কিছু হয় না। সেন্ট অগাস্টিন তাঁর ঈড়হভবংংরড়হ বইটিতে এ-প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করেছেন – বিশ্ব সৃষ্টির আগে ঈশ্বর কী করছিলেন, তা প্রশ্ন করা অর্থহীন। কারণ ঈশ্বর ছিলেন সময়ের বাইরে এবং তিনি একই সঙ্গে সময় ও মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন।
আধুনিক পদার্থবিদ্যার কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় ভূমিকা রেখেছে যে দর্শন, তার নাম প্রত্যক্ষবাদ (Confession)। পদার্থবিদ্যায় এই প্রত্যক্ষবাদের অনুপ্রবেশ আর্নেস্ট মাখের হাত ধরে, যিনি নিজে ভিয়েনার একজন পদার্থবিদ ও দার্শনিক। তিনি অবশ্য কান্টের অধিবিদ্যাকে নস্যাৎ করতেই প্রত্যক্ষবাদকে ব্যবহার করেছিলেন। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার সূত্রে (১৯০৫) মাখের প্রভাব অনস্বীকার্য। প্রত্যক্ষবাদই আইনস্টাইনকে এ-ধারণা দিতে প্রভাবিত করে যে, দুটি ঘটনাকে একজন দর্শক যেমন একইভাবে দেখবে না, তেমনি একটি ঘটনাকে দুজন দর্শকও একইভাবে দেখবে না। অবশ্য মাখের কাছে চিঠিতে আইনস্টাইন তাঁর ঋণ স্বীকার করেছেন – মাখের রচিত পুস্তক অনুভূতিসমূহের বিশ্লেষণ তাঁর প্রিয় বইগুলির একটি। মাখের কাছে লেখা একটি চিঠিতে আইনস্টাইন তাঁর নিজের নাম স্বাক্ষর করেছেন ‘আপনার অনুগত ছাত্র’ বলে। তবে প্রথম মহাযুদ্ধের পর ভিয়েনা সার্কেলের দার্শনিকরা, বিশেষত রুডলফ কারনাপ প্রত্যক্ষবাদকে অধিবিদ্যাগত আবর্জনা থেকে অনেকটা মুক্ত করেন।
১৯২৫ সালে হাইজেনবার্গের বিখ্যাত অনিশ্চয়তা তত্ত্ব, যা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সম্ভাব্যতার ধারণাকে ভিত্তি দিয়েছে, তা প্রত্যক্ষবাদের প্রভাবেই প্রাপ্ত। আইনস্টাইন ও হাইজেনবার্গের কাছে মূল্য থাকা সত্ত্বেও প্রত্যক্ষবাদ যথেষ্ট ক্ষতিও করেছে। তবে যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে প্রত্যক্ষবাদ তার বীরোচিত উজ্জ্বল মশাল অব্যাহত রেখেছে। জর্জ গেইল অবশ্য প্রত্যক্ষবাদকে দোষী করেছেন পদার্থবিদ ও দার্শনিকদের বর্তমান বিচ্ছেদের জন্য।
এমনকি বিশ শতকেও প্রত্যক্ষবাদ পরমাণু তত্ত্বের বিরোধিতা করেছে এবং তা অব্যাহত রেখেছে। ঊনবিংশ শতকেই ডেমোক্রিটাস ও লুসিপ্পাসের অতি পুরনো আইডিয়াকে পরিমার্জনা করে জন ডাল্টন ও আমাদেও এভোগাডরোর চিন্তা ভিত্তি খুঁজে পায়। এরপর থেকে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে তা একটি মৌলিক ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু প্রত্যক্ষবাদীরা বলেন যে, পদার্থবিদরা শুধু তাঁদের পরীক্ষণসমূহের ফলাফলই তুলে ধরতে পারেন, তবে যতক্ষণ তাঁরা অণু বা পরমাণুকে দেখতে না পান, ততক্ষণ তাকে বিশ^াস করা উচিত নয়। মাখ কখনো পরমাণুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেননি, এমনকি ১৯১০ সালে সবাই যখন পরমাণু তত্ত্বকে গ্রহণ করে নিয়েছেন, তখনো মাখ প্লাঙ্ককে বলেছেন – ‘পরমাণুর বাস্তবতা এতোই যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়, আমি তাহলে চিন্তার ভৌত পদ্ধতি পরিত্যাগ করছি। আমি আর একজন পেশাদার পদার্থবিদ হিসেবে পরিচিত হতে চাই না এবং আমি আমার বৈজ্ঞানিক খ্যাতি ফিরিয়ে দিচ্ছি।’
প্রত্যক্ষবাদী দর্শন কীভাবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে, তার আরো একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। আমরা জানি যে, জে. জে. থম্পসন ইলেকট্রন আবিষ্কার করেছিলেন ১৮১৭ সালে। তিনি তাঁর বিখ্যাত ক্যাথোড-রে পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান যে, কিছু কণিকা হচ্ছে পরমাণুর মৌলিক উপাদান, যাকে তিনি নাম দেন ইলেকট্রন বলে। তাঁর এই পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি সারাবিশ্বেই পরিচিতি পান ইলেকট্রনের আবিষ্কর্তা হিসেবে। কিন্তু এই একই পরীক্ষা, একই সময়ে বার্লিনে করেছিলেন পদার্থবিদ ওয়াল্টার কাউফম্যান। সে-পরীক্ষাটি এমনকি থম্পসনের পরীক্ষাটির চেয়েও ভালো মানের ছিল, কারণ ইলেকট্রনের চার্জ ও ভর যেটি কাউফম্যান পেয়েছিলেন, তা থম্পসনের প্রাপ্ত পরিমাপের চেয়েও সঠিক ছিল। তবু তাঁকে ইলেকট্রনের আবিষ্কারক বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, কারণ তিনি নিজেই বিশ্বাস করেননি যে, তিনি একটি নতুন বস্তুকণিকা আবিষ্কার করেছেন। থম্পসন নিউটন ও ডাল্টনের চিরাচরিত বৈজ্ঞানিক ধারাটি অনুসরণ করেছিলেন; কিন্তু প্রত্যক্ষবাদী কাউফম্যান বিশ্বাস করতেন যে, বিজ্ঞানীরা যা প্রত্যক্ষ করেন না, সে-সম্বন্ধে কথা বলার অধিকার তাঁদের নেই। এ-কারণেই তিনি তাঁর আবিষ্কারের কথা জনসমক্ষে প্রচার করেননি। তবে পরমাণু বিরোধিতার চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ ঘটেছে ১৯০৮ সালে রসায়নবিদ উইলহেলম অসওয়াল্ডের কথায় – ‘আমি এখন পুরোপুরি নিশ্চিত যে, শত-সহস্র বছর ধরে বিজ্ঞানীরা যে পরমাণুকে খুঁজছিলেন, সেই জিনিসটা পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা নিশ্চিতভাবেই পেয়ে গেছি।’
হাইজেনবার্গ জানিয়েছেন যে, আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নিয়ে প্রত্যক্ষবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে আইনস্টাইনের একটি দ্বিতীয় চিন্তা ছিল। একটি বক্তৃতায় ১৯৭৪ সালে হাইজেনবার্গ বলেন যে, বার্লিনে ১৯২৬ সালে আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছিল। হাইজেনবার্গ বলেন – ‘আমাকে অবাক করে আইনস্টাইন বললেন যে, প্রতিটি তত্ত্বই তার গভীরে অদৃশ্য কিছু উপাদান বহন করে। আমরা যদি শুধুমাত্র এর দৃশ্য অংশটুকু বিচার করি, তাহলে অনেক সময়ই তা অকার্যকর মনে হবে। আমি তখন তাঁকে মনে করিয়ে দিলাম যে, তাঁর আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বে তিনি তা করেছেন। তখন তিনি বললেন – হয়তো আমি সেরকম দর্শন আগে ব্যবহার করেছি, সে সম্পর্কে লিখেছি। কিন্তু এগুলো সবসময় ননসেন্স।’ এর আগে, ১৯২২ সালে প্যারিসে এক বক্তৃতায় আইনস্টাইন মাথ সম্পর্কে বলেছিলেন যে, তিনি যন্ত্রকৌশলে অসাধারণ হলেও দর্শনে যাচ্ছেতাই।
তবে পরমাণুবাদের বিজয় এবং আইনস্টাইনের পক্ষত্যাগ সত্ত্বেও প্রত্যক্ষবাদ এমনকি বিশ শতকের পদার্থবিদ্যায়ও তার উপস্থিতি বজায় রেখেছে। ওপেনহাইমার ১৯৩০ সালে লক্ষ করলেন যে, ফোটন ও ইলেকট্রনের তত্ত্ব, যাকে কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডিনামিকস বলা হয়, তা একটি অবিশ্বাস্য ফল জন্ম দেয় – পরমাণুর শক্তি অসীম হয়ে দাঁড়ায়। যেহেতু ৩০ ও ৪০-এর দশকের পদার্থবিদরা এই অসীমের সমস্যা নিয়ে বিব্রত ছিলেন, তাই তা এক ধরনের প্রত্যক্ষবাদী অপরাধবোধের জন্ম দেয়। তাঁরা মনে করেন যে, প্রত্যক্ষ করা যায় না, এমন একটি জিনিস পদার্থবিদ্যায় অন্তর্ভুক্ত করে তাঁরা একটি ‘পাপ কাজ’ করেছেন। তবে এই উদ্বেগ শুধু সমস্যাটির প্রকৃত সমাধানে সময় ক্ষেপণই করেছে। আরো দুটি ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষবাদ বিজ্ঞানবিরোধী ভূমিকা রেখেছে – একটি হচ্ছে ১৯৬০-এর দশকে বার্কলেতে জিওফ্রে চিউ-এর কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরি, অন্যটি প্রায় একই সময়ে মারে গেল-মান ও জর্জ জিয়ুগ কর্তৃক কোয়ার্ক তত্ত্ব আবিষ্কারের ক্ষেত্রে। ষাটের দশকে কোয়ার্কের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করা হলেও ৭০-এর দশকে এসে কোয়ান্টাম ক্রমোডিনামিকস তত্ত্ব এটিকে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করে এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।
আধুনিক বিজ্ঞান অবশ্যই মোকাবিলা করছে নানা রকম সমালোচনা ও আক্রমণের। এটি সত্য যে, পৃথিবীর নানা দেশের সভ্যতাই জন্ম দিয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা ইত্যাদি মহান অনেক কিছু। কিন্তু যেদিন থেকে গ্যালিলিও বৈজ্ঞানিক গবেষণার নীতিকে সামনে নিয়ে এসেছেন, সেদিন থেকেই পশ্চিমা সভ্যতা পৃথিবীর অন্যসব সভ্যতার ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছে। অবশ্য বর্তমানে জাপান, চীন, ভারত প্রভৃতি দেশও এই পাশ্চাত্য সভ্যতার দর্শনকে আত্মস্থ করে এগিয়ে চলেছে এবং পৃথিবীতে তাদের উপস্থিতি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞানের দর্শন সারা পৃথিবীতেই আলো ছড়াবে বলে আমরা আশা করি, যা মানবজাতিকে এনে দেবে অফুরন্ত সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য। সেটিই হবে পৃথিবীর বুকে মানবসভ্যতার চূড়ান্ত বিজয়।
জন আর্চিবল্ড হুইলার : পদার্থবিদ্যার কবি ও প্রেরিতপুরুষ
তরুণ বয়সে তিনি কাজ করেছেন পদার্থবিদ্যার দুই দিকপাল – তিরিশের দশকে নিলস বোহর এবং চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে। পারমাণবিক বোমা ও হাইড্রোজেন বোমা – এ-দুটো বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন নিবিড়ভাবে। কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল শব্দটি উদ্ভাবন করেছেন এবং আইনস্টাইন-পরবর্তী যুগের সাধারণ আপেক্ষিকতার জনক হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। তিনি হচ্ছেন বিশ শতকের পদার্থবিদ্যার শেষ টাইটান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রজন্মের পদার্থবিদদের অনেকেরই শিক্ষক জন আর্চিবল্ড হুইলার। ক্যালিফোর্নিয়া ইন্স্টিটিউট অব টেকনোলজির ফেইনম্যান অধ্যাপক ও হুইলারের প্রাক্তন ছাত্র কিপ থর্নের মতে – ‘তরুণ পদার্থবিদদের জন্য তিনি ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন মেন্টর।’ হুইলার বিশ্বাস করতেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র ভর্তি করা হয় তার শিক্ষকদের শিক্ষিত করার জন্য। তাঁর দীর্ঘদিনের কর্মস্থল প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অন্য যে-কারো চেয়ে বেশি, মোট ৪৬ জন, ছাত্রের পিএইচ.ডি গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। তাঁর গ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন রিচার্ড ফেইনম্যান, হিউজ এভারেট, জ্যাকব বেকেনস্টাইন, কিপ থর্ন, ডেভিড হিল প্রমুখ নামকরা পদার্থবিদ।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.