বিশ্বদর্শন ও আনন্দভ্রমণ

হামিদ কায়সার

রনবীর বিশ্ব দর্শন ও রম্যকথন

রফিকুন নবী

বেঙ্গল পাবলিকেশন্স

ঢাকা, ২০১২

৪০০ টাকা

রনবীর বিশ্ব দর্শন ও রম্যকথন বইটির লেখক রফিকুন নবী প্রথমেই ভূমিকায় বলে নিয়েছেন, ‘না কোনো জ্ঞানগর্ভ লেখনী হয়েছে, না কোনো সৃজনশীল কিছু। ভ্রমণ নিয়ে লেখা বটে কিন্তু পুরোপুরি ভ্রমণকাহিনিও নয়। যেটুকু হয়েছে তাকে খুব জোর ভ্রমণ-সংক্রান্ত স্মৃতিচারণমূলক লেখা বলা যেতে পারে। তবে খারাপ লাগছে এই ভেবে যে, আদি থেকে যদি ডিটেইলে সব ভ্রমণের আদ্যোপান্ত লেখা থাকতো, এখন তা কাজে লাগতো।’

আমাদের পাঠকদের সৌভাগ্য যে, তিনি ভ্রমণের সেই আদ্যোপান্ত লিখে রাখেননি, তাহলে হয়তো নিরেট এবং নিখুঁত একটি ভ্রমণকাহিনির বই আমরা ঠিকই পেতাম, কিন্তু এমন একটি ভ্রমণ-শিল্পকলা-স্মৃতিচারণা এবং নিজেকে নিয়ে চান্স পেলেই সরস রসিকতায় সমৃদ্ধ উপাদেয় ভাষার এ-বইটি আমরা পেতাম কি না সন্দেহ আছে। রফিকুন নবী এদেশের সৃজনশীল ব্যক্তিদের অন্যতম, যিনি বেশ কয়েক দশক জুড়ে বাংলাদেশের শিল্পকলার জগৎকে নানাভাবে বর্ণাঢ্য করে তুলছেন। সৃষ্টি করেছেন অমর এক কার্টুন চরিত্র ‘টোকাই’ – যা শুধু আজ বাংলাদেশেরই নয়, হয়ে উঠেছে সারা পৃথিবীরই ছিন্নমূল শিশুদের আইকন প্রতিনিধি। ‘টোকাই’ স্রষ্টা ছাড়াও তিনি জলরং, তেলরং মাধ্যমের একজন বিশিষ্ট শিল্পী, যিনি নিজের একটি আলাদা চিত্রভাষা তৈরিতে সমর্থ হয়েছেন। আর এই শিল্পচর্চায় নিমগ্ন থাকতে গিয়ে তিনি নিজের যে একটি বিশেষ প্রতিভাকে অবহেলা করেছেন, তার প্রমাণ হলো এ-বইটি। লেখালেখিতে সিরিয়াস হলে তিনি এক্ষেত্রেও সমান অবদান রাখতে পারতেন নিঃসন্দেহে। অবশ্য তিনি যে একেবারেই লেখেননি, তা নয়, তাঁর দুটি উপন্যাস (টেরোডাকটাইল, ফনিমনসায় লাশ), একটি কিশোর উপন্যাস (সবখানেই যুদ্ধ) এবং একটি রম্যকথার বই (রনবীর শব্দবাণ) রয়েছে।

রফিকুন নবী ভূমিকায় যা-ই বলুন, রনবীর বিশ্ব দর্শন ও রম্যকথন বইটি মূলত ভ্রমণকাহিনিই এবং এক-দুটি ভ্রমণ ছাড়া প্রায় প্রতিটি ভ্রমণের উপলক্ষই শিল্পকলা। কখনো শিল্পকলার পন্ডিত হওয়ার দীক্ষা নিতে ছুটে গিয়েছেন গ্রিস, কখনো চিত্র-প্রদর্শনীতে অংশ নিতে যুগোস্লাভিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউইয়র্ক, বেইজিং, মেক্সিকো, আগরতলা, ওমান, মালদ্বীপ, জাপান, লন্ডন, রাশিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়ায় ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। কখনো বা আর্ট ক্যাম্পে যোগ দিতে উপস্থিত থেকেছেন ভারতের পন্ডিচেরি, ইতালি, নেপাল ও ভুটানে। তবে শিল্পকলার বাইরে যে উপলক্ষে আর কটি ভ্রমণে তিনি গিয়েছেন, সেখানে কাকতালীয়ভাবে যোগ রয়েছে বিয়ের। শিল্পী হাশেম খান আর কথাসাহিত্যিক বুলবন ওসমানের সঙ্গে ভারতে যে প্রথম ভ্রমণটিতে গিয়েছিলেন, তার ইচ্ছেটির পেছনে ছিল দুটি কারণ – এক, বিয়ের আগে ফ্রি-ফ্র্যাংক ব্যাচেলর জীবনটাকে শেষবারের মতো উপভোগ করে নেওয়া, আর দুই, নিজের বিয়ের জন্য বেনারসি শাড়ি কেনা। এছাড়া গ্রিসে থাকাকালে তাঁর মিশর, ইতালি, সুইজারল্যান্ড এবং ফ্রান্সে বেড়ানোর যে-সুযোগ এসেছিল তার মধ্যে একটি ছিল ভারতীয় বন্ধু বালু ঠাকুরের বিয়ে-পরবর্তী হানিমুন-কার্যক্রমে উপযুক্ত সংগত দেওয়া। তবে সংগত দিতে গিয়ে যে উলটো অভিজ্ঞতা হলো, তিনি সেই কাহিনির শিরোনাম দিয়েছেন – ‘আমি হলাম পথের কাঁটা/ মধুচন্দ্রিমার কপাল ফাটা’।

রফিকুন নবীর সরস বর্ণনা, ‘প্যারিস পৌঁছাতে সন্ধ্যা ১১টা। পৌঁছেই তো মেজাজ সপ্তমে। যে-হোটেলটিতে রুম বুক করা আছে তা বাস কোম্পানিরই ঠিক করে দেওয়া। গার্দেলের একটি ছোটখাটো হোটেল। অবস্থা বেশি সুবিধের নয়। তবে রিসেপশনের মাঝবয়সী মহিলা বেশ সাজুগুজু। কড়া লাল লিপস্টিক, বাদামি চুলের স্টাইল আর থুঁতনিতে আঁকা তিলের ফোঁটা দেখে মনে হয় তুলু লুৎরেকের মুলা-রুর মডেল যেন। তবে আলাপে বেশ মার্জিত। বলল, তোমাদের তিনজনের জন্যে একটি ঘর বুক করা আছে। তা শুনে তো খাবি খাওয়ার জোগাড়। ঠাকুর আর নিৎসাকে দেখিয়ে কোনো রকমে বোঝালাম যে, ওরা স্বামী-স্ত্রী। হানিমুনে এসেছে। একসঙ্গে অতএব এক ঘরে এক খাটে থাকা যাবে না। মহিলা মুচকি হাসি ছড়িয়ে উত্তরে বলল, কোনো উপায় নেই। অন্য কোনো ঘর খালি নেই। বললাম, আমাকে তাহলে অন্য হোটেলে ব্যবস্থা করে দাও। তা শুনে টেলিফোনে চেষ্টা চালাল কিছুক্ষণ। তারপরে হাল ছেড়ে দিলো। বুঝলাম, কোথাও ঘর খালি নেই। ঠাকুর তো রেগে কাঁই। প্রায় চিৎকার করে সমস্যাটা বোঝাবার চেষ্টা করল। ভেতর থেকে এক বৃদ্ধ এসে একটি সমাধান দিলেন। তা শুনে তো আমার হাল খারাপ। ঘন ঘন ঢোক গেলার দশা। গলার অ্যাডামস অ্যাপেলের ওঠানামা শুরু। সমাধান দিলো এই রকমের যে – ঘরে আরেকটি খাট এনে দেবে এবং দুই খাটের মাঝ বরাবর একটি পর্দা টানিয়ে দেবে। বললেন, ‘মন্দের ভালো কথাটা ভাবো।’ সেইভাবেই পরবর্তী চার রাত কাটল।

সন্দেহ নেই যে, এটি একটি চমৎকার এবং অভিনব ঘটনা। এবং এ-ধরনের মজার ঘটনার ছড়াছড়ি রয়েছে বইটির প্রতিটি অধ্যায়জুড়েই। তাজমহলের ঘটনাই যদি তুলে ধরা যায়, ‘তবে তাজমহল দেখার অভিজ্ঞতা আমার খুব সুখকর নয়। গ্রীষ্মের খাঁ-খাঁ রোদে পুরো এলাকা যেন পুড়ছিল। সে-সময় ছায়ায় ঢাকা তাজমহলের একটি খিলানের পাশে ঠান্ডা মার্বেলে বসে একটু গা জুড়িয়ে নিচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম সম্রাট শাহজাহানের সম্রাজ্ঞী মমতাজকে নিয়ে পাগলা হবার কথা। কী অপূর্ব কান্ডই না ঘটিয়েছেন এই তাজমহল বানিয়ে। শুধু নিজে পাগল হয়েছিলেন যে তা-ই নয়, যুগ যুগ ধরে এই দর্শনীয় ইমারতটি দেখতে সারা বিশ্বের মানুষ ছুটে আসছে, পাগলপ্রায় হচ্ছে এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে। তো এইসব ভাবছি যখন ঠিক সেই সময় হঠাৎ করে আকাশ অন্ধকার করে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি এসে হুল ফুটিয়ে এমন অ্যাটাক শুরু করলো যে শেষতক ঘরের ভেতরের অন্ধকারে গিয়ে তবেই রক্ষা। সঙ্গে সঙ্গে জ্বর এসে গিয়েছিল।

ওই দুর্যোগে একটি মজার ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছিলাম। মৌমাছিরা কেন যেন শুধু দুজনকে বাছাই করেছিল হুল ফোটাবার জন্যে। এক আমি এবং অন্যজন এক সুন্দরী বিদেশিনী। বেচারা গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে রক্ষা পেতে খুবই স্বল্পবসনা ছিলেন। আমার কাছাকাছিতে দাঁড়িয়ে দেয়ালের নকশার ছবি তুলছিলেন মনোযোগ দিয়ে। রংসহ তাঁর শারীরিক ব্যাপার-স্যাপার এমনই নজরকাড়া যে, তা থেকে চোখ সরিয়ে রাখা সহজ ছিল না। বেরসিক মৌমাছির দল ঠিক ওই মুহূর্তে এসে হাজির। তারা বেরসিক হলেও একজন রসিক যে এই অত গরমে ছাই রঙের কম্বল হাতে দাঁড়িয়েছিল রোদ মাথায় করে, তা আগে নজরে পড়লেও প্রয়োজনটা বুঝিনি। দারোয়ানদের কেউ হবে হয়তো। বয়সে বছর চল্লিশেকের মতন। আমার পাশেই দাঁড়ানো ছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে মৌমাছি আসা আর সবার দিগ্বিদিক ছোটাছুটির যখন শুরু ঠিক তখনই আমার পাশ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে নিজেকেসহ মেম মহিলাকে কম্বলে ঢেকে ফেলেছিল হুল থেকে বাঁচতে কিংবা বাঁচাতে। তা দেখে অত হুল ফোটা দুর্যোগেও না হেসে পারিনি। যাই হোক, লোকটির কম্বল নিয়ে মহিলার পাশাপাশি ঘুরঘুর করা, ঠিক সময়মতো মৌমাছিদের জেটবেগে আগমন এবং লোকটির লম্ফ দিয়ে গিয়ে শুধুই মহিলাকে ঢেকে ফেলার ব্যাপারটি আজো রহস্যজনক রয়ে গেছে আমার কাছে।’

এরকম ভূরি ভূরি সরস কাহিনি তুলে ধরা যাবে বইটি থেকে। তাই বলে আবার কেউ যেন ভেবে না বসেন, এটি হালকা চালের বই। মোটেও তা নয়, একটি ভ্রমণকাহিনির ভেতর দিয়ে একটি দেশকে, দেশের মানুষকে, সে-দেশের বৈশিষ্ট্যকে যে জানার ব্যাপার আছে, তা কোনো কোনো লেখায় গভীরভাবেই ফুটে উঠেছে। কোনো কোনো লেখা বলছি এ-কারণে যে, কোনো কোনো ব্যাপার হয়েছে খুবই স্বল্পকালীন সময়ের জন্য। তা আবার তার পুরো সময়টিই কেটেছে চিত্র-প্রদর্শনী কিংবা আর্ট ক্যাম্পের কর্মকান্ড নিয়ে। সেখানে দেশ দেখবার ফুরসতই বা কোথায় আর মানুষ দেখবার সময়ই বা মেলে কীভাবে। সংগত কারণেই সেটা রনবীর কাছে আশা করা ঠিক নয়। কিন্তু যেখানেই তিনি একটু বেশি সময় অবস্থান করেছেন, সে জায়গার নাড়ি-নক্ষত্র তুলে ধরেছেন, জাতটা নিংড়ে বের করে এনেছেন। যেমন গ্রিসের কথাই ধরি, গ্রিসে তিনি গিয়েছিলেন শিল্পকলার পন্ডিত হতে। তো, সেটা তিনি ঠিকই হয়েছেন, সেজন্য তাঁকে গ্রিসে তিন বছরেরও অধিককাল থাকতে হয়েছিল। তিনি পুরাণ-সমৃদ্ধ সেই গ্রিস এবং এর আধুনিক সত্তার অন্তর্মূল পর্যন্ত তুলে ধরেছেন। তাঁর বর্ণনা থেকেই সে-পরিচয় মিলবে, ‘দীর্ঘ এক বছর সালোনিকিতে থেকে যখন প্রায় মায়া পড়ে গেছে, তখন চলে আসতে হলো এথেন্সে। সেই এথেন্সে যেখানে এককালে পেরিক্লিসের গুণী নাগরিকরা আড্ডা জমাতো দূর-দূরান্ত থেকে এসে, তর্কের আসর বসাত অ্যাক্রোপলিসের পাদদেশে অ্যাম্পিথিয়েটারে। সংগীত, শিল্পকলা আর নাটকের আয়োজন হতো উন্মুক্ত আকাশের তলে। সেই এথেন্সে বাস করছি, এখন ভাবতেই অবাক লাগে। সেই অ্যাক্রোপলিসকে কেন্দ্র করেই আধুনিক এথেন্সের জৌলুস। … অ্যাক্রেলিস মানে চূড়ার শহর। তার মাথায় দাঁড়িয়ে এথিনা দেবীর মন্দির পারথেননের ভগ্নাংশ। আর এই এথিনা দেবীর শহর হলো এথেন্স। আধুনিককালে এথেন্স হলো আরেক জগৎ। দালানকোঠা, গাড়িঘোড়া, যন্ত্রপাতি আর লোকারণ্যের এক বিরাটতেব হারিয়ে যাবার মতো। এখানে শুধু কাজ কাজ আর কাজ। পয়সার ধান্দাসহ কত কারণে লোক দৌড়ে বেড়াচ্ছে তার হদিস করা মুশকিল। তবে চুপি চুপি বলি, অকারণেও গ্রিকরা হন্তদন্ত হয়ে ছোটে, যেন কত ব্যস্তবাগীশ। আমার এলিস ইন দা ওয়ান্ডারল্যান্ডের র‌্যাবিট সাহেবের কথা মনে হতো এদের দেখে। দেখে মনে হবে গাড়ি ধরতে যাচ্ছে। কিন্তু আসলে কিছু না। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ যদি চোখে পড়ে যায় ফুটবলের ওপর লটারি পত্রিকাটা, তো বসে গেল এক কপি নিয়ে পাশের কফিহাউসে। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ বন্ধু-বান্ধবী কী পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা, ওখানেই ছোটা শেষ। এ নিয়ে ওরা নিজেরাও তামাশা করে।’

লেখক গ্রিসে থাকা অবস্থায় সেখানকার রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্যের বিশিষ্ট মানুষের সান্নিধ্য লাভ করেছেন। এ-বইটিতে আরেকটি উপাদেয় যে জিনিসের দেখা মিলবে, তা হলো, বাংলাদেশের বিশিষ্ট সব শিল্পীকে আন্তরিক এবং একটু ভিন্নভাবে জানার সুযোগ। বিভিন্ন আর্ট ক্যাম্প এবং চিত্র-প্রদর্শনীগুলোতে রনবী অংশগ্রহণ করেছেন বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে। তাঁর বর্ণনায় অন্য এক অলকেশ ঘোষকে খুঁজে পাওয়া যাবে ‘পন্ডিচেরিতে দিন দশেক’ অধ্যায়ে। সে যে কী মজার অভিজ্ঞতা, তা আর এখানে উল্লেখ করতে চাচ্ছি না। এক কথায় তুলনাহীন। বঙ্গোপসাগরের পাশঘেঁষা পন্ডিচেরির সেই আর্ট ক্যাম্পের নিসর্গও কলমে এঁকেছেন রনবী চমৎকারভাবে। মালদ্বীপের ট্যুরে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী কীভাবে প্রকৃতির সৌন্দর্যের চক্করে পড়ে কবিতা লেখার তন্ময়তায় ডুবে গেলেন সেই বর্ণনা, সেটা আরো চমকপ্রদ, ‘দ্বীপের একেক দিকে সাগরের চেহারাটি একেক রকম। কোথাও কালচে আলট্রামেরিন তো কোথাও সেরুলিন নীল, আবার কোথাও হালকা কোবাল্ট তো কোথাও ইন্ডিগো নইলে ল্যাপিস লাজুলি। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী তো অভিভূত হয়ে শুধু ছবি আঁকার মধ্যে আটকে রাখলেন না নিজেকে। রীতিমতো কবি হয়ে গেলেন। একের পর এক কবিতা লিখে চললেন। আর প্রতিটি কবিতার প্রথম শ্রোতা আমি। … কাইয়ুম ভাইয়ের লেখালেখির আমি একজন ভক্ত পাঠক। দারুণ গদ্য যেমন লেখেন, তেমনি শিশুতোষ ছড়াও। কিন্তু তাঁর কবিতার সঙ্গে পরিচয় আমার এই প্রথম। যেহেতু একই দৃশ্যাবলিতে দুজনই অভিভূত অতএব তাঁর ছত্রে ছত্রে বর্ণিত-বন্দনায় আমিও মুগ্ধ।’

এতো দেশ এতো জায়গা ভ্রমণ করেছেন যে-শিল্পী, তাঁকে যে মাঝেমধ্যেই মধুর অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে হয়েছে, তা কী আর বলতে! রফিকুন নবী অকপট। তবে দু-এক জায়গায় শুধুমাত্র ইঙ্গিত রেখেছেন। জাপানে যা ঘটেছিল, তা কিছুতেই উল্লেখ না করে পারা গেল না। ‘তো, প্রদর্শনীতে উদ্বোধনীর সময় প্রথম যে ছবিটি বিক্রি হয়েছিল সেটির ক্রেতা এক মহিলা। মহিলাটি গ্যালারির মালিক মিসেস মিসকো সাইতোকে নিয়ে আমার সঙ্গে পরিচিত হতে এলেন। লম্বা ছিপছিপে শরীরের। সুবেশী এবং দারুণ সুন্দরী।… আমার মনে হলো তিনি ছবির প্রশংসা করলেন। তা যদি হয় তো আমারও কিছু প্রশংসাবাণী শোনানো উচিত। অতএব ভাবলাম মহিলা যে অতীব সুন্দরী সেটি বলি। এটা তো চিরাচরিত নিয়ম যে, মেয়েদের সুন্দরী বললে খুশিই হয়। এইসব শাস্ত্রীয় কথা স্মরণ করে খাঁটি জাপানি শব্দ উচ্চারণ করলাম। বললাম – ‘তুমি দারুণ ঐশি।’ এ-কথা বলামাত্র মহিলাটি প্রথমে ‘ব্লাশ’ করলেন। যেন কিছুটা থতমতও খেলেন। তারপর খিলখিল করে হেসে ফেললেন। তাঁর হাসি শুনে তো আমিও খুশি। ভাবলাম যাক! আমার প্রশংসায় আপ্লুত হয়েছেন।…অদূরেই আফজাল দাঁড়িয়ে ছিল। হাসি শুনে এগিয়ে আসতেই জাপানিতে প্রশংসার কথাটি বললেন। তা শুনে আফজাল মাথা চুলকে বলল, ‘স্যার, ভাষায় মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। আপনি যে ঐশি বলেছেন, তার অর্থ হলো, ‘সুস্বাদু, টেস্টি’। এরপর আর কি, ক্ষমা চাওয়ার পালা শুরু। মহিলাকে সুস্বাদু বলা হয়েছে।’

এরকম অভিনব, মজাদার নানা ঘটনা, নানা দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অসাধারণ বর্ণনাগুণে আর শিল্পকলার নানা গভীর বিশ্লেষণে বইটি পড়া এক কথায় দুর্লভ এক আনন্দময় ভ্রমণই বটে। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, এমন সুখপাঠ্য বই অনেকদিন আমরা পাইনি। যেখানে বিশুদ্ধ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আর তথ্য এবং তত্ত্বের ব্লেন্ডিং পরিমিত মাত্রায় যোগ হয়েছে। তবে দু-তিনটি অধ্যায়ে ভ্রমণের সময়কাল উল্লেখ হয়নি, সেটা হলে আরো নিখুঁত হতে পারত। কেননা পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কোন সময়কার ঘটনাপ্রবাহ এটা। পরিশেষে এই বইটির বাইন্ডিংয়ের কথাটা আলাদাভাবে না বললেই নয়। আমাদের দেশে বইমেলা উপলক্ষে হাজার হাজার বই প্রকাশের হিড়িক পড়ে যায়। কিন্তু কটা বই সঠিক বই হয়ে ওঠে? সেটা এখন প্রশ্নেরই বিষয়। মুদ্রণপ্রমাদ, বানানবিভ্রাট তো আছেই, বাইন্ডিংয়েও থাকে যত্নের অভাব। এ-বইটির বাইন্ডিং এক কথায় জুতসই, মজবুত তো বটেই, অনুকরণযোগ্য। তার সঙ্গে মিলেছে রফিকুন নবীর প্রচ্ছদ এবং অঙ্গসজ্জার হৃদযোগ। স্বভাবই বইটি দর্শনেন্দ্রিয়কেও মোহিত করে।