ভোঁতা এবড়োখেবড়ো একটা রাস্তা হাজীগঞ্জের কাপড়িয়াপট্টি ধরে চলে গেছে ব্যাংকপাড়ার দিকে। যাওয়ার সময় ঝাপসা স্মৃতির মতো কুমোরবাড়ি ছুঁয়ে যায়। ব্যাংকপাড়ার পাশেই একটা খাল। বিকেল হলে স্বপ্না আন্টি খালপাড়ে বসে থাকে। জলে নিবদ্ধ চোখ স্থির হয়ে কী যেন দেখে। সুপ্রাচীন অন্ধকার ঠেলে ওই চোখে ভাঙা রোদ হরিয়ালের মতো দৌড়াতে থাকে। কাকে যেন খোঁজে আন্টি। পেছনে কুমোরদের বড় বড় মাটির মটকা সারি সারি পড়ে থাকে। ওগুলোর ভেতর ব্যাংকপাড়ার ছেলেমেয়েরা লুকোচুরি খেলে। একেকটি মটকায় তিন-চারজন অনায়াসে থাকতে পারে। দূরে কাঁঠালগাছের আড়ালে একজন সংখ্যা গোনে। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয় … এভাবে বিশ পর্যন্ত। বিশের আগেই যে যেভাবে পারে লুকোনোর জায়গা খুঁজে নেয়। রনক মটকায় না গিয়ে খালপাড়ের আড়ালে থাকা স্তূপীকৃত মাটির হাঁড়ি-পাতিলের কাছে চলে আসে। একটু সরু রাস্তা খোঁজে। কোনোরকমে একটি পাতিল ঠেলে ঢুকতে যাবে অমনি ওপর থেকে কয়েকটি পাতিল গড়িয়ে স্বপ্না আন্টির পায়ে গিয়ে পড়ে। জল থেকে দৃষ্টি সরে আসে রনকের ওপর। রনককে দেখে বৃষ্টির ঝটকার মতো ছুটে ঝাঁকি দিয়ে বলে, এই রনক খেলছিস?
হুম আন্টি, খেলছি।
তোকে চকলেট দেবো। একটা কাজ করে দিতে পারবি?
কী কাজ?
যা না! দোতলায় গিয়ে দেখ, সুবলদা কী করছে?
তিনি নেই।
কই গেছে?
আমরা যখন হারুকাকাদের দোকান থেকে আসছি তখন দেখেছি গলির বাইরে চলে গেছে।
কখন গেল?
এই তো আরেকটু আগে।
ওটা তো একটু আগে। এখন অনেক সময় হয়ে গেছে।
যা গিয়ে দেখ, আছে কি না?
যদি না থাকে?
না থাকলে চলে আসবি। খেলবি।
আমার চকলেট?
আরে বোকা, থাকলেও পাবি, না থাকলেও পাবি। যা! আর শোন, কাউকে কিছু বলবি না। চুপ থাকবি। ঠিক আছে?
রনক খেলা ছেড়ে দৌড় দেয়। ওকে দৌড়াতে দেখে শাহিন ডাকে, কীরে কই যাস? যে একটু আগে সংখ্যা গুনছিল দৌড়ে এসে রনককে ছুঁয়ে বলে, দেখ তুই চোর হয়ে গেলি। এবার তোর পালা। তুই সংখ্যা গুনবি, আমরা লুকাবো।
সর সামনে থেকে। এক ঝটকায় শাহীনের হাত ছুড়ে রনক দৌড়ায় দোতলা বাড়ির দিকে। বাড়িটি কাঠের। এখানে সুবল দাস থাকেন। গানের শিক্ষক। গান শেখান ফুলকুঁড়ি আর কচি-কাঁচার মেলায়। রনকের মা রুবিনা খানম সুবলকে মামা ডাকতে বলেছেন।
স্বপ্নাকে আন্টি। স্বপ্না আন্টি রনকের কাউসার খালামণির বয়সী। রনক খেয়াল করেছে খালামণি যখন বেড়াতে আসে স্বপ্না আন্টির খুশির সীমা থাকে না। স্বপ্না আন্টির তখন কী আনন্দ! কাউসার খালামণি এলে স্বপ্না আন্টি একটু বাইরে বেরোতে পারেন। সে বিধবা। বাইরে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা আছে। কবে সে বিধবা হয়েছে রনক সেটা জানে না। খালামণি এলে একটু স্বাধীনতা মেলে। না হলে রনক দেখে স্বপ্না আন্টি খালপাড়ে একা বসে থাকে।
ওখানে একটা বড় তেঁতুলগাছ আছে। ওটার শিকড় মাটির চাক কামড়ে নিচু হয়ে জলের স্রোতে ঝুলে আছে। স্বপ্না আন্টি ওখানে পা ঝুলিয়ে বসে দূরে চেয়ে থাকে। বহুদূরে চেয়ে থাকা স্বপ্না আন্টিকে পড়ন্ত বিকেলের কমনীয় ছাঁটের মতো মনে হয় রনকের। মনে হয়, বুনো জল খাদের গা ছেড়ে আন্টির পদতলে দোল খাচ্ছে। পায়ে বালা আর দুই বৃদ্ধাঙ্গুলিতে রুপার আংটি ধবধবে পা-দুটোকে ধুয়ে দিয়ে যায়। ইস! কী সুন্দর দুটি পা! রনক মাঝে মাঝে লুকোচুরি খেলা ফেলে ওদিকে তাকিয়ে থাকে। সবুজ জলের ভেতর ফর্সা দুটো পা আহা! অপরূপ সৌন্দর্যের সূচনা। মুখের চেয়েও নান্দনিক পায়ের ভেতর নিসর্গের অভিধান লিখে যায় চৌদ্দ বছরের রনক।
জলের কী সৌভাগ্য এমন পা ছুঁয়ে থাকে। আন্টির ওই পদযুগল চেয়ে চেয়ে কতবার খেলা থেকে আউট হয়েছে – সে-হিসাব নেই। তাকে যখন চোর হয়ে সংখ্যা গণনা করতে হতো সে খেলোয়াড়দের খোঁজা ছেড়ে ওই খালপাড়ে গিয়ে দাঁড়াত। অনর্থ ভাষা, শ্লথ সময়, নাবালক মন ঘেঁটে কিশোর রনকের ভেতর কী হতো সে বুঝে উঠতো না। শুধু এতটুকু জানে স্বপ্না আন্টির লম্বাটে চোখে রোদেরা কানামাছি খেলে। অসংখ্য ঢেউ সেখানে সংখ্যা গোনে। রনক ওই চোখের ভেতর লুকিয়ে পড়ে। কেউ তাকে খুঁজে পায় না। রনকের ভেতর কৈশোরের প্লাবন লুটোপুটি খেলে। ওর শরীর সাপের খোলসের মতো আলগা হয়ে আসে। মুহূর্তেই সুবলমামার মতো বড় হয়ে ওঠে। মটকার ভেতর কিশোর রনক পড়ে থাকে। সুবলের ছায়া হয়ে সে কল্পনায় স্বপ্না আন্টির পাশে দাঁড়ায়।
ওহ্হ, সুবলমামাকে দেখে স্বপ্না আন্টির কী যে হয়! লাজুক মুখে বলে, প্রতিদিন এখানে বসে থাকি। নিজ থেকে আসতে পারেন না!
এলাম তো!
কই এলেন! বসতে বসতে সন্ধ্যা। চোখ আঁধার হয়ে আসে না আমার?
স্বপ্না!
হুম!
এসো ভেঙে দিই তোমার জনপদ!
পারবেন?
ভাটির ক্রান্তিকালে নৌকা ভাসাবো। যাবে আমার সঙ্গে?
প্লিজ, আমাকে নিয়ে চলুন! স্বপ্না হাত বাড়াতেই খেয়াল ভাঙে রনকের। ওহ্হ! নিজেকে সুবলমামা ভেবে স্বপ্না আন্টিকে নিয়ে কত কী ভাবছে! সুবলমামাকে হিংসে হয়। কেন সে বড় হয় না? কেন সে সুবলমামার মতো হারমোনিয়াম বাজাতে পারে না? সুবলমামা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গেয়ে স্বপ্না আন্টিকে মুগ্ধ করে। ভাবতে ভাবতে সে দোতলার চৌকাঠে দাঁড়ায়। মনে মনে বলে, সুবলমামাকে না পেলেই হয়। তখন আন্টি বিকেলের শেষরং জলে না ডোবা পর্যন্ত তেঁতুলতলায় বসে থাকবে। সুললিত পায়ের ওপর কুলুকুলু জলের ধ্বনি বয়ে যাবে। লাবণ্য কুসুম এঁদোপানায় পাক খেতে খেতে মূর্ছা যাবে। বেঁচে থাকবে প্রতিদিনের স্বভাবমাখানো কিশোরের চোর পুলিশ খেলা। চোখ বেঁধে গুনে যাওয়া এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ … আঠারো, উনিশ, বিশ। এরপর সংকেত কুউক, কুউক, কুউক। চোখ বেঁধে সংখ্যা গণনার অতলে ভেসে আসা কুলুকুলু ধ্বনি রনকের ঘোলা নদী কাঁপিয়ে দেবে। ওই নদী রনক দেখে কিন্তু ছুঁতে পারে না। কবে ছোঁবে সে নদী? সুবলমামার মতো বড় হলে?
কীরে, সুবলদাকে পেয়েছিস?
রনক খুশির ছটা আড়ালে রেখে মাথা নিচু করে বলে, দরজা বন্ধ।
বন্ধ মানে, ভেতর থেকে?
না, তালা মারা।
আচ্ছা যা।
রনক চলে আসতেই, এই এদিকে আয়।
গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায়।
সন্ধ্যায় আসিস। সন্দেশ সঙ্গে লাড্ডু আর চকলেট পাবি। বুঝলি?
ঠিক আছে।
যা, খেলগে।
রনক পেছনে তাকায় না। সুবলমামাকে না পেয়ে স্বপ্না আন্টির বুক কী শোকগ্রস্ত হয়ে গেছে?
তিনি কি মনপ্রাণের ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন? কী হচ্ছে ওনার ভেতর? মাতাল প্রতিমা কি জলের মতো কাঁপছে? কে জানে? স্বপ্না কি কোনো নারীর নাম? তিনি বিধবা কেন? স্বামী মরে গেলে বিধবা হতে হয়? স্বামী যখন ছিল না তখন কি তিনি অন্যরকম ছিলেন? কী রকম ছিলেন? তার যখন বিয়ে হয়নি তখন কি সবাই তাকে বিধবা ভাবতো? এখনো স্বামী নেই, তখনো ছিল না, তাহলে? আজকের মতো তখন শিক-আঁটা জীবন ছিল কী তার? অথচ তার ছোট বোন ঝুমকা কী সাবলীল চলাফেরা করে। কোথাও যেতে বিধিনিষেধ নেই। কলেজে পড়ে। গান গায়, নাচে। স্বপ্না আন্টির মতো এত সুন্দর গাইতে পারে না ঝুমকা আন্টি। গান যতটুকু না ভড়ং তার চাইতে বেশি। সুবলমামা গান শেখায়। সুবলমামার দোতলার বাসায় অবাধে যেতে পারে। কেউ কিছু বলে না। শুধু স্বপ্না আন্টি কোথাও যেতে পারে না।
রনক নিজেকে স্বপ্না ভাবে। স্বামীহারা বিধবা। আচ্ছা, ও তো ছেলে। সে স্বপ্নাকে বলতে পারে না, আন্টি তুমি আমার দিকেই তাকিয়ে থাকো অনন্তকাল। আমি এই খালপাড়ের শাখা নদী হবো। তুমি এতেই ডুবিয়ে রাখো তোমার নূপুরপরা পা দুটি। আমি তোমার নূপুরের রুমঝুম হবো। জলের নিচে ডুবিয়ে বাজাবো তোমাকে। তুমি কি জলের নূপুর হবে? আমার হাতের ওপর রেখে দেবে তোমার পা? তোমার এই দু-পা ধরে ব্রহ্মার একদিনের আয়ু পেতে চাই। আমি কচ্ছপ হবো। পৃথিবীটা যেমন কচ্ছপের পিঠের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তেমন করেই আমার হাতের ওপর রাখো তোমার দু-পা। আমি দু-পায়ের ভর নিয়ে জলে দাঁড়িয়ে রবো। কত কী যে ভাবে রনক! এসব ভাবনা কল্পলোকে ছড়িয়ে দিয়ে গেছে বিষ্ণু। হারাধন কাকুর ছেলে। ওরা সহপাঠী। ক্লাস এইটে পড়ে হাজিগঞ্জ পাইলট হাই স্কুলে। বিষ্ণু দারুণ বাঁশি বাজায়। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল। ফর্সা ধবধবে মুখ। সন্ধ্যা নুয়ে এলে ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে বসে যখন বাঁশিতে সুর তোলে তখন জল কেঁপে ওঠে। তিরতির জল বাঁশির সুরে কথা বলে। দূরে স্টিমারের ভেঁপু শোনা গেলে তখন থামে। স্টিমারের আঘাতে জলে জলোচ্ছ্বাস এলে রনকের দিকে সুন্দর চোখ রেখে বিষ্ণু বলে, জানিস রনক, এই যে জল দেখিস এটা তেজ ও শব্দ থেকে সৃষ্টি। পরাব্রহ্মই এই তেজ ও শব্দ দান করেছেন। তিনি সুবর্ণময় অণ্ডে বিশাল জলরাশি ধারণ করেন।
কী বলিস?
হ্যাঁ।
পরাব্রহ্ম কে?
তিনি দেবতা। জলের ভেতর জগৎবীজ রোপণ করেন। এই বীজ বড় হয়ে সুবর্ণময় এক অণ্ডে পরিণত হয়। তখন এটাকে বলে ব্রহ্মাণ্ড।
রনক চোখ বড় করে বলে, তুই এতসব কীভাবে জানিস?
আমার ঠাকুমা প্রতিদিন এসব গল্প শোনায়। তিনি অনেক লেখাপড়া জানেন। সময় পেলে বেদ পড়েন। আমাকেও শোনান।
বাহ দারুণ তো!
হ্যাঁ, ঠাকুমা বলেন, এই পরাব্রহ্মাই আদিতে ছিলেন। তাই তাকে আদিত্য বলে।
আদিত্য? বাহ খুব সুন্দর নাম।
আরো আছে। এই যে মহাবিশ্ব দেখিস তা কয়েক হাজার কোটি বছর ধরে জীবিত আছে। প্রতিটি মহাবিশ্ব বিলিয়ন বছর ধরে স্থায়ী হয়। এই সময়কালকে এক কল্প বা ব্রহ্মার এক দিন বলে।
মাত্র একদিন? রনকের বিস্ময়ের সীমা থাকে না। কী বলছে বিষ্ণু এসব? বিষ্ণুর কাছে এসব শুনে শুনে কিশোর রনকের কল্পজগৎ স্বর্গমুখী হয়ে ওঠে। এই স্বর্গে যেতে হলে স্বপ্না আন্টির পা ছুঁয়ে যেতে হবে। একেকবার রনকের মনে হয় স্বর্গের সিঁড়ি কি স্বপ্না আন্টির পায়ের মতো?
রনকের দৃষ্টি প্রখর হতে থাকে। ডাকাতিয়ার গভীর জলে চেয়ে কী যেন ভাবে। বিষ্ণু গুঁতো দিয়ে বলে, কী ভাবছিস?
কিছুই না। তবে তোদের ব্রহ্মাকে দেখার চেষ্টা করছি।
তাই?
হ্যাঁ।
শোন, আরো আছে। এই যে জলসমেত পৃথিবী দেখছিস এটা কচ্ছপের পিঠের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
সত্যি?
হ্যাঁ রে!
এগুলো সব আমাদের পুরাণে লেখা আছে।
রনক অবাক হয়ে বলে, কচ্ছপের পিঠে পৃথিবী দাঁড়িয়ে? অবাক কাণ্ড! এই ডাকাতিয়ার জলে কত কচ্ছপ আছে। অথচ …
রনকের কৌতূহলে কিছুটা অবিশ্বাস দেখে বিষ্ণু হাসে।
বিষ্ণুর কাছে এসব অলৌকিক কথা শুনে রনক অন্যরকম হয়ে যায়। সে শুধু ভাবে, এসব কি আসলেই সত্যি?
রনকের এসব ভাবনা বাক্সময় হয়ে ওঠে যখন খালপাড়ে জলের তলে ডুবে থাকা স্বপ্না আন্টির নূপুরপরা ধবধবে মসৃণ দু-পা দেখে। ওর কল্পনা জুড়ে ঘুরপাক খায় কচ্ছপ। সে ভাবে, কচ্ছপ পারলে সে পারবে না কেন স্বপ্না আন্টির দু-পা ওর হাতের ওপর নিয়ে নিতে?
সন্ধ্যায় রনক যায় স্বপ্না আন্টির কাছে। ধূপের গন্ধে ম-ম করছে ঘর। আন্টি ধূপের থালায় মাথা ঠুকছেন। দিদিমণি কাঁসার থালায় কীসব পুরে পুজোর ঘরে ঢুকবেন। এমন সময় রনককে দেখে, হ্যাঁ রে রনক তোর মাকে আসতে বলিস তো। আজ পুজোয় প্রসাদ করেছি। তোর মায়ের জন্য রেখেছি কটা।
মা আসতে হবে কেন? আমার কাছেই দিয়ে দাও না দিদিমণি?
দিদিমণি স্বপ্না আন্টির মা। রনকরা তাকে দিদিমণি ডাকে। রনকের মা ডাকতে বলে দিয়েছেন। শুনে দিদিমণি বলেন, না, তোর মায়ের হাত ছুঁয়ে দেব। আর কিছু কথাও আছে। তুই প্রসাদ খেতে চাইলে পুজো শেষ হওয়া পর্যন্ত থাক। আমি প্রণাম করে আসি ঠাকুরকে। দিদিমণি পুজোর ঘরে চলে যান। ঘর থেকে পুজোর ঘণ্টা ও উলুধ্বনি আসে। রনকের এই ঘণ্টার শব্দ খুব ভালো লাগে। কী সুন্দর শব্দ! প্রতিদিন ভোরে দিদিমণি হাতে একটা সাঁঝি নিয়ে ফুল কুড়াতে যায়। ব্যাংকপাড়ার এদিকে বিশাল মাঠ। মাঠের চারপাশে কত রকমের ফুলগাছ। ফুলগাছ শুরু হয়েছে রনকদের লাগোয়া বারান্দা থেকে। ওখানে রনকের মাথা সমান লম্বা কয়েকটি পদ্মগাছ আছে। অনেক বড় বড় পাপড়ি মেলে হালকা গোলাপি রঙের পদ্মফুল ফুটে থাকে পুরো বারান্দা জুড়ে। ফুল দেখে রনকের চোখ জুড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে দিদিমণি এখান থেকে ফুল নিয়ে যান। ঝুমকা আন্টিও খোঁপায় গুঁজে সুবলমামার দোতলায় গান শিখতে যায়। কলেজে যায়। ঝুমকা আন্টি স্বপ্না আন্টির ছোট বোন। খুব আহ্লাদী। ঝুমকা আন্টির চুলগুলো সুন্দর। অনেক লম্বা আর ঝরঝরে। মাঝে মাঝে রনকের ইচ্ছে করে ব্যাংকপাড়ার শেষ মাঠ থেকে ঝুমকো জবা ছিঁড়ে এনে ঝুমকা আন্টিকে পরিয়ে দিতে। লম্বা চুলের মাঝে ঝুমকো জবা দুলবে ঝুমকা আন্টির খোঁপায়। কেমন লাগবে? মাঝে মাঝে ওর বকফুল পরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কালো কুচকুচে চুলের ভেতর সাদা বকফুল, কী যে লাগবে না? রনকের কী যে হয় এই দুই বোনকে দেখলে। একজনকে মনে হয় বিকেলের গাঢ় গম্ভীর সন্ধ্যার মতো পূত পবিত্র। ওখানে কেমন একটা মায়াবী মৌসুম মুঠো খুলে রাখে। তাড়াতাড়ি এই মৌসুম ধরতে না পারলে মুঠো বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এই সৌন্দর্য হচ্ছে স্বপ্না আন্টির। কেমন মায়া ছড়ানো থাকে চারদিকে। অন্যদিকে ঝুমকা আন্টি বিপরীত। খরস্রোতা জল। কোথাও থামবে না। সামনে যা পাবে তা নিয়েই দৌড়াবে। চাঁদজ্বলা, নক্ষত্রপোড়া রাতের মতো উপুড় চিৎ করে লম্বাচুলে এমন ঝাঁকি মারে রনকের বুক টনটন করে। এটা বেশিরভাগ স্নানের পর হয়। রনকদের ঘর আর ঝুমকা আন্টিদের ঘর মুখোমুখি। ও-ঘরে দিদিমণিরা যা করে এ-ঘর থেকে কিছুটা দেখা যায়। ঝুমকা আন্টি স্নান শেষ করে বাইরের উঠোনে এলে রনক এক দৌড়ে ওখানে চলে যায়। মাঝে মাঝে ঝুমকা আন্টি বলে, ভালোই হলো এসেছিস, চুল ঝাড়ার কাঠিটা নিয়ে আয় তো? বা কখনো বলে, এই রনক তোর দুই হাত সামনে মেলে ধর। চুলগুলো তোর হাতে ছড়িয়ে দিই। রনকের তখন কী আনন্দ! সে এটার জন্য অপেক্ষা করে। ওর পকেটে থাকে রক্তজবা বা বকফুল। কখনো কখনো মরিচফুল। বকফুল পেড়ে আনতে কী যে কষ্ট! তবুও রনক চেষ্টা করে বকফুল পেতে। হারুকাকার ঘরের সামনে থোকা থোকা ফুটে থাকে বকফুল। অনেক উঁচু হয়ে গিয়েছে গাছ। ফুল পাড়তে কষ্ট হয়। হারুকাকা দোকানে যাওয়ার আগে মাঝে মাঝে এই ফুল পাড়েন। রনক দাঁড়িয়ে থাকে কাকুর সামনে। কাকু তখন বলেন, কীরে রুনু? বকফুল নিবি? রনককে সবসময় তিনি রুনু ডাকেন।
রনক চোখ উজ্জ্বল করে বলে, কাকু দেবে আমাকে?
হ্যাঁ, তার আগে তোর কাকিরে এগুলা দিয়া আয়। তোর কাকি ডালের গুঁড়োর গোলা করে রেখেছে। বলগে, তাড়াতাড়ি চুবিয়ে ভাজি করতে। আমি খেয়ে দোকানে যাবো। রনক একদৌড়ে দিয়ে আসে কাকিকে। ফিরে এলে কয়েক গোছা ওর হাতে তুলে দিয়ে কাকা বলেন, যা বউদিকে বল তোকে ভেজে দিতে।
হারুকাকু রনকের মাকে বউদি ডাকেন। রনক ওখান থেকে প্রায়সময় কয়েকটি রেখে দেয়। আশায় থাকে সুযোগ পেলেই ঝুমকা আন্টির খোঁপায় গুঁজে দেবে। হারুকাকু মিষ্টি ব্যবসায়ী। ওনার দোকানের নাম হারাধন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। পরিচিত কেউ কাকুকে হারাধন ডাকে না। যে যার মতো হারুদাদা, হারুকাকু, হারুজেঠাই ডাকে। হারুকাকুর বিশাল পেটের জন্য বুক দেখা যায় না। দেখতে রীতিমতো একটা দৈত্যের মতো। ওই হারুকাকুর দোকানের মিষ্টান্ন দিয়ে রনকদের সকালের নাস্তা চলে। রনকের মা প্রতিদিন সকালে পরোটা ভাজেন। ওর বাবার বলা আছে প্রতি সকালে হারাধন কাকুর দোকান থেকে ক্ষীর, কোনোদিন মিষ্টি, কোনোদিন রসগোল্লা, কোনোদিন সন্দেশ নিয়ে আসতে। রনকেরা সেগুলো পরোটা দিয়ে খায়। কী যে সুস্বাদু হারুকাকুর দোকানের ক্ষীর! আহা অমৃত কাকে বলে! পরোটা ছিঁড়ে ক্ষীর দিয়ে খেতে কী যে মজা!
কীরে হাত ভালো করে মেলে ধর! ঝুমকা আন্টির ঝাঁকুনিতে রনকের সম্বিত ফেরে। রনক দুই হাত ইংরেজি অক্ষর আইয়ের মতো মেলে ধরে। ঝুমকা আন্টি চুলগুলো ওর হাতে ছড়িয়ে নিজের হাতে ঝাড়তে থাকে। চুল থেকে অভিস্রবণীয় বাষ্পীয় ধোঁয়া বের হয়ে আসে। চুলের ঢেউয়ে বুঁজে আসে রনকের চোখ। আবার জলের ক্ষেপায়ও খুলে যায় চোখ। আহা! এত সুন্দর চুল হতে পারে কারো? রনক প্যান্টের ভেতর থেকে বকফুল বের করে খোঁপায় দেওয়ার জন্য। কিন্তু দেবে কী! পকেটের ভেতর তাপে সিদ্ধ হয়ে ফুল ততক্ষণে ভর্তা! নরম পাপড়ি কতক্ষণ তাজা থাকে? রনকের আর ফুল দেওয়া হয় না। সে এক হাত দিয়ে ঘেঁটে দেয় চুল।
আহ! কী করছিস, কী করছিস! ঝুমকা আন্টি খেঁকিয়ে ওঠে। রনকের ভ্রƒক্ষেপ নেই। এই দীর্ঘ চুলগুলোয় ওর লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ওরা যখন লুকোচুরি খেলে তখন ঝুমকা আন্টির চুলগুলো মনে পড়ে। ইস! বিকেলে যদি ঝুমকা আন্টি খালপাড়ে বসে থাকতো? তাহলে চুলের ভেতর লুকিয়ে জলে ডুবে থাকা স্বপ্না আন্টির ফর্সা পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু সে উপায় কি আছে? ঝুমকা আন্টি তখন বাবুল মামার কাছে গিয়ে নাচ শেখে।
বাবুল মামার নাচের স্কুল আছে। ঝুমকা আন্টির কত জায়গায় প্রোগ্রাম থাকে। জান খান্দান করে নাচের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একদিন সকালে রনক দেখে ঝুমকা আন্টির হাতে ফুলের সাঁঝি। ফুল কুড়াতে এসেছে। মনে হয় দিদিমণি পাঠিয়েছেন সকালের আহ্নিকের জন্য। খাড়া উপত্যকার চূড়া বেয়ে সমতলে পর্যটক যেভাবে নেমে আসে তেমন ঝুমকা আন্টির খোলা চুল কোমর বেয়ে হাঁটু অবধি নেমে আছে। ওরে বাবা! শারদীয় প্রতিমা যেন ব্যাংকপাড়ায় নেমে এসেছে। সামনে দুর্গাপূজা। পূজা উপলক্ষে ফুলগাছের যত্ন নেওয়া হয়। এখানে যে কয়টা হিন্দু বাড়ি আছে সবাই পালাক্রমে ফুলগাছের খেয়াল রাখে। যত্ন পেয়ে ব্যাংকপাড়াটা যেন ফুলের স্বর্গ হয়ে ওঠে। এত ফুল চারদিকে! লতানো ফুলগাছ থেকে কাঠফুল সব ধরনের গাছ আছে এই প্রান্তরজুড়ে। একটু দূরে সাদা অপরাজিতার ঝোপ। থোকা
থোকা ফুলগুলো একে অপরের পাপড়ি ছুঁয়ে যেন জীবন বিনিময় করে। এত সুন্দর ফুল! একপাশে গোলাপি পদ্মের দোল, হেমন্তের শিউলির মিষ্টি ঘ্রাণ, টগরের ডাগর চোখ, থোকা থোকা রক্তজবা, সাদাজবার সবুজ পাতায় মিলন, মরিচ ফুলের লাল টকটকে আগুন, গাঁদাফুলের ঝোপ, ফুলগুলো যেন সদ্য নবজাতকের মতো চোখ খুলে তাকিয়ে আছে। কত রকমের গোলাপ।
নাম-না-জানা আরো কত ফুল সৌন্দর্য নিয়ে ফুটে আছে চারপাশ! আহা ফুল! কে এদের এত অপরূপ করে বানিয়েছে?
ফুল কেন এত সুন্দর! ঝুমকা আন্টি আর স্বপ্না আন্টির মতো? রনক ভাবে, ঝুমকা আন্টি আর স্বপ্না আন্টি ওরাও কোনো না কোনো ফুল। হয়তো মানুষের জন্ম পেয়েছে। কিন্তু ওরা আসলেই ফুল। না হলে ওরা এত সুন্দর কেন? ওর দুজনকে খুব ভালো লাগে। সে ফুলগাছের পাশ ধরে হাঁটে। যেখান দিয়ে হাঁটে এর পাশেই সারি সারি কলাবাগান। কলাবাগান ঘেঁষে বহুরকমের পাতাবাহার আর ঘণ্টি ফুলের গাছ। কী সুন্দর হলুদ ঘণ্টিফুল ফুটে আছে! রনক মাঝে মাঝে ঘণ্টিফুল পেড়ে মাইকের মতো মুখের সামনে ধরে। এগুলো থেকে হালকা একরকমের উটকো গন্ধ বের হয়। উহু, কী বাজে গন্ধ! নাকে নিয়ে ফুলগুলো ছুড়ে ফেলে দেয়। এগুলোর একপ্রকার ফল হয়। ফলগুলো শুকিয়ে এলে ওখান থেকে বিচি বের করে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে গুটি খেলে। এই ঘণ্টি ফুলগুলোও যেন ঝুমকা আন্টির চুলে ওঠার জন্য মুখিয়ে থাকে। রনক ভাবে, বাগানের সমস্ত ফুল ঝুমকা আন্টির খোঁপার জন্য ফোটে। রনকের হাতে পদ্মফুল। ঝুমকা আন্টিকে দেখে তুলে নিয়েছে। আজ সে খোঁপায় দেবেই দেবে। একটু এগিয়ে দেখে ঝুমকা আন্টি শিউলি ফুল কুড়াচ্ছে।
কীরে কখন এলি? পায়ের শব্দে ঝুমকা আন্টি টের পায় রনক এসেছে।
ঘুমাসনি?
ঘুমিয়েছি তো। তোমাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এলাম।
আমি তো আহ্নিকের ফুল কুড়াচ্ছি। এখন তোর সঙ্গে কথা বলতে পারবো না।
বলতে হবে না। তবে তোমার জন্য একটি জিনিস এনেছি।
ঝুমকা আন্টি সাঁঝি বুকে চেপে মাথা ওপরে বেঁকে তাকায় রনকের দিকে।
কী এনেছিস?
রনকের বুক ধক্ করে ওঠে। আহা কী সুন্দর ঝুমকা আন্টির মুখ! একেবারে সকালের সূর্য। কী নরম আর কোমল। রনকের ছুঁতে ইচ্ছে করে মুখটা।
পদ্মফুল দেখিয়ে বলে, এই যে!
ওমা, পদ্ম? তোদের গাছের?
হ্যাঁ আন্টি। তোমার খোঁপায় পরাবো।
আমার খোঁপায়? কীভাবে পরাবি? আমি চুল বেঁধে ফেলেছি না? দেখছিস না পূজার ফুল কুড়াচ্ছি?
খুলে দাও না একটু!
ধুর বোকা, ফুল কুড়োনোর সময় চুল খোলা রাখতে নেই। তাতে অমঙ্গল হয়।
এই সাতসকালে রনকের হাতে ফুল দেখে আঁতকে ওঠেন নমিতা পিসি। মানে হারুকাকার বোন।
এম্মা, রোনু, দুগ্গাপূজা সামনে। ফুল ছিঁড়েছিস তুই? আমাদের কী হবেরে?
না, পিসি তোমাদেরটা ছিঁড়িনি। আমাদের দাওয়া থেকে ছিঁড়ে এনেছি।
ওই হলো, তোদের দাওয়া। আমাদের পুজোয় লাগলে ওখান থেকে নিতে হবে নারে বাপ?
রনক ভয় পেয়ে যায়। ঠিক আছে পিসি আর ছিঁড়বো না।
ঘরে যা। এই ভোরে এখানে ঘুরঘুর করিস কেন?
রনক আর কথা না বাড়িয়ে ঘরে ফেরে।
দেখতে দেখতে দুর্গাপূজা চলে আসে। ব্যাংকপাড়ায় হইহই রইরই উৎসব। কাপড়িয়াপট্টির হিন্দু বাড়িগুলো অতিথিদের সমাগমে মুখর হয়ে ওঠে। এখানে যে কয়টি মুসলমান পরিবার আছে আনন্দের ঢেউ ওদেরও ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রনকেরা মুসলমান।
হিন্দু-মুসলিম মিলে একই উঠানে বাস। পূজা এলে রনকের বাবা দিদিমণি, হারুকাকা আর কাকিমার জন্য পোশাক কিনে উপহার দেন। দিদিমণিকে সাদা থান আর হারুকাকাকে দেন সাদা থানের ধুতি, পাঞ্জাবি। কাকিমাকে দেন জামদানি কাজ করা সুতি শাড়ি। সেই সঙ্গে মায়ের জন্যও কেনা হয় একইরকম শাড়ি। উপহার পেয়ে ওরা খুব খুশি হয়।
ওরা কয়েকটি মুসলমান পরিবার এই পূজার আনন্দে মেতে ওঠে। পূজা মানেই হরেকরকম প্রসাদ, কতরকম খানাপিনা, মেলা, কীর্তন, তা কী আর বলতে? ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল মণ্ডপের বেদির পাশে বসে থাকে। কী দিন কী রাত। বাড়ির সঙ্গেই স্কুল। ছুটি হলে বইখাতা বাড়িতে ছুড়েই মণ্ডপে দেয় দৌড়। হারাধনকাকু পূজার সময় বিশাল প্যান্ডেল করেন।
প্যান্ডেলের ভেতরই পূজামণ্ডপ। পেছনে পাতলা কাঠের কাঠামো করে দেবী বানানোর ছোট ঘর তৈরি করেন। বাঁশের ফ্রেমে পেরেক ঠুকে কাঠ জোড়া লাগিয়ে এই ঘর তৈরি হয়। ওখানে দেবী দুর্গার উত্থান হয়। কাকু কলকাতা থেকে শিল্পী আনিয়ে রাখেন এক মাস আগেই। চারদিকে হারাধন কাকুর কী নাম-ডাক! হবে না? দেবী বানানো কি চাট্টিখানি কথা? তাও কলকতার শিল্পীদের হাতে তৈরি দুর্গা। ওই সময় মাতৃবন্দনার প্রস্তুতি চলে চারদিকে। প্রতিমা গড়ার কাজে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। রনক সারাক্ষণ বিষ্ণুর সঙ্গে পড়ে থাকে। বিষ্ণুর সঙ্গে আসে একইপাড়ার কালীপদ, হরিপদ, ধ্রুবক ও সন্তোষ। এরা সারাক্ষণ মণ্ডপের দেখাশোনা করে। পাহারা দেয়।
কাঠের ঘরে পাটাতনের ওপর শিল্পীরা বাঁশ দিয়ে দেবী দুর্গার কাঠামো বানায়। কাঠামোয় খড় বেঁধে প্রতিমার আদল তৈরি করে। এরপর চলে একমেটের কাজ। মাটিতে তুষ মিশিয়ে কাঠামোয় প্রলেপ দেওয়াকে একমেটে বলে। মণ্ডপে ছেলে, যুবা, বুড়োবুড়ির ভিড় লেগে থাকে। কারিগরদের প্রতিমা বানানোর নৈপুণ্য হাঁ হয়ে দেখে সবাই। এরপর শুরু হয় দোমেটের কাজ। কলকাতা থেকে আসার সময় শিল্পীরা গঙ্গার জল, গঙ্গার মাটি আরো নানান জায়গার মাটি নিয়ে আসে প্রতিমা বানানোর জন্য। শিল্পীরা দিনরাত খেটে প্রতিমা গড়ে। একেক করে বানিয়ে নেওয়া হয় প্রতিমার মুখ, আলাদা করে বানানো হয় প্রতিমার হাত ও পায়ের পাতা। পরে এগুলো জোড়া দিয়ে মূর্তির সঙ্গে সেঁটে দেওয়া হবে। যেদিন প্রতিমাকে দোমেটে প্রলেপ দেবে সেদিন এক কাণ্ড ঘটে। ভেতরে ভেতরে গুঞ্জন। প্রতিমার জন্য আনা পতিতাপল্লির মাটি যে বাক্সে রাখা ছিল তা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে উপায়? গঙ্গার পলিমাটির বাক্স আছে। কিন্তু এই মাটি নেই। তাল আর গোলা বানাতে, প্রতিমার ফাটল সারাতে সব মাটির সঙ্গে এই মাটি লাগে। কী হবে এখন? কীভাবে প্রতিমা হবে? বাক্স কই? ভেতরে ভেতরে খোঁজ খোঁজ রব পড়ে যায়। হারাধন ছুটে আসেন। কী হবে এবার? শাস্ত্র মেনেই যুগে যুগে এই প্রথা চলে আসছে। এটা যে পুণ্যমাটি! তিনি ভয় পেয়ে যান। দুর্গাপূজার সময় মহামায়া নয় রূপে পূজিত হন। নর্তকী অথবা অভিনেত্রী, কাপালিক, ধোপানী, নাপিতানী, ব্রাহ্মণী, শূদ্রাণী, গোয়ালিনী, মালিনী ও পতিতা। সমাজের উঁচু-নিচু সকল স্তরের নারীরূপে দেবী মহামায়া আরাধ্য হন। নারীশক্তিকে আলাদা করে বিচার করা যায় না। এখানে সব নারী সমান।
নবম কন্যা পতিতা এই সমাজের অংশ এবং শক্তির আধার মহামায়া সেই রূপেও ধরায় আসেন। যৌনপল্লির মাটি ছাড়া আলোয় মুখরিত দুর্গাপূজা অসম্পূর্ণ। যৌনকর্মীর দ্বারে পুরুষরা ওদের সমস্ত পুণ্য বিসর্জন দিয়ে আসে। সে-কারণেই ওই মাটি পবিত্র হয়ে ওঠে। আর তা দিয়ে গড়া হয় মাতৃমূর্তি। সমগ্র নারী জাতির এক অখণ্ড রূপ হলো দেবী দুর্গা। জাতি, শ্রেণি নির্বিশেষে উঁচু-নিচু সকল নারীর শক্তি এক করে শক্তিময়ী মাতার পুজো করা হয়। এখানে দুর্গা সকল নারী রূপে প্রকট হয়ে ওঠেন।
দেবীমূর্তি তৈরির বিশেষ মাটি নেই – এই কথা এক কান দু-কান হতে হতে অনেকের কানে পৌঁছে যায়। মণ্ডপে ভিড় বাড়ে। হারাধনকাকু মূল পটুয়া সঞ্জয় পালকে খোঁজেন। দেবী যেখানে তৈরি হচ্ছে সেখানেই তাকে ও তার দলকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। সঞ্জয় পাল সেখানে নেই। হারাধনকাকুর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সামনে বিষ্ণুকে পেয়ে চটকনা দিলেন।
মারছো কেন আমাকে?
হারামজাদা কোথায় টইটই করিস? সব্বোনাশ হয়ে গেছে। মণ্ডপ ছেড়ে থাকিস কোথায়?
আমি এতক্ষণ এখানে ছিলাম। একটু আগে পটুয়া সঞ্জয় পালকে ঠাকুমার কাছে নিয়ে গেছি।
কী! সঞ্জয় পাল ঘরে?
হ্যাঁ, ঠাকুমা যেতে বলেছে মাটির বাক্স নিয়ে। ঠাকুমা মাটির বাক্স প্রণাম করে ওদের দক্ষিণা দেবে। ঠাকুমার মানত ছিল। তুমি যদি অসুখ থেকে সেরে ওঠো তবে দেবীর দোমেটে রূপ দেওয়ার আগে পুণ্যমাটিতে প্রণাম দেবেন। ওই মাটিতে টাকা ছোঁয়াবেন। তারপর সে টাকা ওদের দান করবেন।
হারাধনের মনে পড়ে। গতবছর কালাজ্বরে ভুগেছিলেন তিনি। দুনিয়ার ডাক্তার, কবিরাজ, বদ্যি দেখিয়েও অসুখ সারছিল না। পাক্কা তিন মাস ভুগেছেন। সে-সময় তার মা এক মানত করে বসেন। পুণ্যমাটিতে মাথা ঠেকাবেন। ভগবান যেন হারাধনকে সুস্থ করে দেন। একসময় সুস্থ হয়ে ওঠেন হারাধন।
ওহ্হ ভগবান! সম্মান রক্ষা করলে আমার! হারাধনের বুকে প্রাণ ফিরে আসে। তিনি দৌড়ে অন্দরমহলে চলে যান। হারাধনকে দেখে হারাধনের মা সরযুবালা এগিয়ে এসে গায়ে টাকা ছোঁয়ান।
এসেছিস বাবা? ভালোই হলো। তোর জন্য মানত ছিল। পূরণ করলাম।
দেখতে দেখতে দেবীর চক্ষুদানের সময় চলে আসে।
কাঠের ঘরে দেবী। পুরোহিত আর পটুয়া ছাড়া কেউ নেই। কীভাবে দেবীর চোখ দেওয়া হয় এটি দেখার জন্য বিষ্ণু সবসময় অপেক্ষা করে।
যেদিন পটুয়া সঞ্জয় পালকে ঠাকুমার কাছে নিয়ে যায় বিষ্ণু সেদিন সঙ্গে একটি পেরেক রাখে।
পটুয়াকে ঠাকুমার কাছে রেখে একদৌড়ে চলে আসে দেবীর ঘরে। ছোট একটি ফুটো করে দেয় কাঠের দেয়ালে। নরম কাঠ। বাইরে দাঁড়িয়ে রনক। বিষ্ণু ফুটো করতেই পেছন থেকে রনক পেরেকের মাথায় টান মারে। অমনি ছিদ্র হয়ে যায় কাঠ। দেবীর চক্ষুদানের সময় আশেপাশে কেউ থাকতে পারে না। চক্ষুদানের রাত। হারাধন এবং কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্রাহ্মণ আর তান্ত্রিকের উপস্থিতিতে ভেতরে বীজমন্ত্র পাঠ হচ্ছে। বিষ্ণু আর রনক চুপিচুপি মণ্ডপে এসে দাঁড়ায়। দেয়ালের যে জায়গাটা ফুটো ওদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রথমে চোখ রাখে বিষ্ণু। এক হাতে রনকের হাত ধরা। ফিসফিস করে বলে,
রনক! কী অদ্ভুতরে!
আমাকে একটু দেখতে দে!
দেখ!
রনক দেখে ভীষণ অবাক হয়। মানুষের হাতে নারীমূর্তি এত সুন্দর হয় কী করে? মানুষ এত সুন্দর করে নারীরূপ আঁকতে পারে? পটুয়া কুশের অগ্রভাগে কাজল মেখে দেবীর চোখে পরাচ্ছেন। এই চোখ কিছুক্ষণ আগেও মাটির প্রলেপ ছাড়া কিছুই ছিল না। অথচ পটুয়া কী সুন্দর করে এঁকে চক্ষু দিচ্ছেন প্রতিমার।
অসাধারণরে বিষ্ণু! আমার তো পটুয়া হতে ইচ্ছে করছে!
চুপ! কথা কম বল! তোর এতকিছু হতে ইচ্ছে করে ক্যান?
রনক দেখে পটুয়া রঙিন রঙে সাজিয়ে নিচ্ছে বাঁচক্ষু। শেষে ডানচক্ষু মন্ত্রপাঠ করে আঁকছেন। এবার ত্রিনয়নের পালা। মন্ত্রের জোর বাড়ছে দেখে বিষ্ণু বলে, আমাদের দেবীর ত্রিনয়ন হবে এবার।
সর, এবার আমি দেখি।
আহা! কী সুন্দর দৃশ্য! দুর্গা পৃথিবী দেখছেন। জাগ্রত হলেন মা। মাটির প্রতিমা প্রাণ পেল। রনক ঘোরে টলছে। বিষ্ণুও।
হঠাৎ ফিসফিস শব্দে দুজন চমকে ওঠে। কান খাড়া করে। মণ্ডপ থেকে সরে সামনে এগিয়ে দেখে ঝুমকা আন্টি আর সুবলমামা কথা বলতে বলতে অন্ধকারে চলে যাচ্ছে। পূজার সময় সুবলমামাকে এখানে গান গাইতে হয়। এ-সময় গান গেয়ে অনেক টাকা পান তিনি। তাই প্রতিবছর দুর্গাপূজায় ব্যাংকপাড়ায় থেকে যান। এত রাতে ওদের দুজনকে এখানে দেখে রনক অবাক হয়। সে ওদের পিছু নেয়। বিষ্ণু থামায়।
পাগল হয়েছিস? দেবী প্রাণ পেয়েছে। একটু পর মণ্ডপে নেওয়া হবে। ডাকাতিয়ায় স্নানে যাবে সবাই। নবপত্রিকা আসবে। তার পরেই পূজা শুরু হবে। ওদের যেতে দে। আমার সঙ্গে চল।
মহাসপ্তমীর দিন। ভোরে সবাই চলে আসে ডাকাতিয়া নদীতে। রনককেও ডাকাতিয়ার জলে নামায় বিষ্ণু। রনকের মন খচখচ করে। ওর এমন লাগছে কেন?
এত গভীর রাতে সুবলমামার সঙ্গে ঝুমকা আন্টি কী করছে? দাঁতে দাঁত চেপে ডাকে সুবইল্যারে! তারপর জলে দেয় ডুব। স্নান সেরে পূত পবিত্র হয়ে বিষ্ণুরা পূর্বপুরুষদের জন্য মঙ্গল চেয়ে তর্পন করে। তর্পন শেষে পুরোহিত নবপত্রিকা নিয়ে মণ্ডপে প্রবেশ করে। নবপত্রিকার আরেক নাম কলা বউ। নয়টি উদ্ভিদের শেকড় সাদা অপরাজিতার লতা দিয়ে কলাগাছে বেঁধে দেয় পুরোহিত। এরপর কলাগাছকে লালপাড় সাদা শাড়ি পরিয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। স্ত্রীরূপ দিতে বেল দিয়ে করা হয় স্তনযুগল। তারপর সিঁদুর পরিয়ে দেবী প্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করানো হয় নবপত্রিকা।
কলাবউ মণ্ডপে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে পূজা শুরু হয়। পুরোহিত একনাগাড়ে মন্ত্র পড়ে যাচ্ছেন, ‘রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী।’ মন্ত্রপাঠের সঙ্গে সঙ্গে ঢাক বেজে ওঠে। চারদিকে উলুধ্বনি আর মুহুর্মুহু শঙ্খের শব্দে মুখরিত হয়ে যায় ব্যাংকপাড়ার চারপাশ। মহাসমারোহে পূজা চলতে থাকে। মানুষের মনে-প্রাণে কী আনন্দ! দেখতে দেখতে বিসর্জনের দিন চলে আসে। মর্ত্যগামিনী মা এবার অমর্ত্যলোকে পাড়ি জমাবেন।
পরদিন মহাবিজয়া। চারদিকে উৎসব আর উৎসব। মণ্ডপে প্রসাদ বিলি হচ্ছে। উলুধ্বনি, ঢাকের শব্দ, শঙ্খের শব্দে কিছুই শোনা যায় না। এর ওপর আছে মানুষ। মানুষের হইহুল্লোড়ে চাপা পড়ে শব্দ, কথা। ভিড়ের ভেতর একটি হাত রনককে চেপে ধরে। হাতটি মানুষ ঠেলে রনককে টেনে প্যান্ডেলের বাইরে নিয়ে যায়। ওহ তুমি?
কী ভেবেছিস?
না, স্বপ্না আন্টি, তুমি এভাবে টানবে বুঝতে পারিনি।
পূজা কী আমাদের, না তোদের?
কেন কী হয়েছে?
কোথায় থাকিস? তোকে খুঁজে পাই না কেন?
আমি তো মণ্ডপেই থাকি। বিষ্ণুর সঙ্গে।
যেখানেই থাকিস আজ ঘরে আসবি। কথা আছে জরুরি, বুঝলি?
সন্ধ্যায় রনক আসে স্বপ্না আন্টির ঘরে। আন্টি কাঁদছে। কী ব্যাপার, কী হয়েছে আন্টি?
দিদিমণির চিৎকার – তোকে যেতেই হবে। তোর জন্য ছোটটার ক্ষতি হোক তুই চাস? ওর বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে তোর জন্য, দেখতে পাচ্ছিস না? গতবছরও তোকে পাঠাতে চেয়েছি। এরকম কেঁদেকেটে ছিলি। এবার আর মানছি না বাপু।
বাক্স-পেঁটরা গোছাও। গয়া তোমাকে যেতে হবে। পূজাটা শেষ হোক। পুরোহিতদের সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা যাওয়ার সময় নিয়ে যাবে।
দিদিমণি এসব কী বলছে? কাকে গয়া পাঠাবে? স্বপ্না আন্টিকে? কেন?
স্বপ্না আন্টির কাছে দাঁড়ায় রনক। আলতো করে বলে, আন্টি আমি এসেছি। কী যেন বলবে বলেছিলে?
স্বপ্না আন্টি মাথা তোলে। অপ্রতিরোধ্য জলধারা ঠেলে কোনোরকম বলে, শুনতে পেলি, মা কী বলেছে? আমাকে গয়া পাঠাবে। এই জীবন আর ভালো লাগে না। ওদের ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো? বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে আন্টি।
তুমি একা যাবে ওদের সঙ্গে?
হ্যাঁ, আমাকে একা ওদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেবে।
কী বলছো আন্টি? একা? এ সম্ভব?
একটা কাজ করে দিতে পারবি? সুবলদা বাসায় আছে কি না দেখে আসবি? থাকলে বলবি আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই। পারবি?
সুবলমামাকে দিয়ে তোমার কী কাজ? বলতে গিয়েও বলতে পারে না রনক। যে-মেয়ে গয়া চলে যাবে সুবলমামার সঙ্গে হয়তো তার কথা থাকতে পারে।
ঠিক আছে আন্টি আমি যাচ্ছি।
রনক দোতলায় আসে। কাঠের দোতলার শেষ প্রান্তে সুবলমামা থাকে। একটু একটু এগিয়ে দরজার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। ভেতরে নারীকণ্ঠ। অন্ধকার কক্ষে ঝুমকা আন্টি সুবলমামার সঙ্গে?
ঝুমকা আন্টি বলছে, ছাড়ুন, ছাড়ুন! আমাকে ছাড়ুন।
আরে কী ছাড়ে তোমাকে?
না, সুবলদা, মানুষ এসে পড়বে।
আরে আসবে না। পূজায় সবাই মাত হয়ে আছে। এসো, এখন আমরা মাত হই।
না, সুবলদা! আমি যাই। আরেকদিন হবে।
প্রতিদিনই বলো, আরেকদিন হবে। এই আরেকদিনটা কবে আসবে? আজকেই সুযোগ তোমাকে কাছে পাওয়ার। শুধু চুমুতে মন ভরে?
রনকের হাত-পা অসাড় হয়ে আসে। হিম হয়ে আসে শরীর। সে কী করবে? দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকবে? উচিত হবে? এখন ওরা যেভাবে আছে সে কি ভেতরে গিয়ে বলতে পারবে সুবলমামা, স্বপ্না আন্টি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। রনক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। দু-পা সামনে এগোয় আবার পেছনে সরে আসে। ওর কান ঝাঁ-ঝাঁ করে। চোখ জ্বালা করে। ওরা কী বলে কিছুই শুনতে পায় না। কখন যে গুটিগুটি পায়ে সিঁড়ির শেষধাপে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি। একটু দূরে উঁচু বেদির মতো একটি ঢিবি আছে। রনক ওখানে গিয়ে স্থাণুর মতো বসে পড়ে। কতক্ষণ কেটে গেছে জানে না। একটি ছায়ামূর্তি দেখে সে কান খাড়া করে। দেখে অন্ধকারে এক নারীমূর্তি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। খুব দ্রুত এবং বিড়ালের মতো চুপিচুপি শব্দ না করে। রনক পিছু নেয়। দূর থেকে দেখে নারীটি দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। রনকের বুক কাঁপে। এ যে স্বপ্না আন্টি! ওর দেরি দেখে নিজেই চলে এসেছে। অবাক হয় রনক। স্বপ্না আন্টির কী এমন কথা যে অন্ধকার ঠেলে আসতেই হলো?
স্বপ্না আন্টি বাতি জ্বালালেন। মূর্ছা যাওয়া রোগীর মতো কেঁপে বললেন, সুবলদা, এত বড় প্রতারক তুমি? আমার সর্বনাশ করে এখন ঝুমকাকেও করলে? আমাকে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়ে এ তুমি কী করলে? দু-চোখে আমি এ কী দেখছি?
স্বপ্না আন্টি মেঝেয় ধড়াম করে পড়ে যায়। ঝুমকা আন্টি ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচ্যাকা খায়। উলঙ্গ ঝুমকা আন্টি হাত দিয়ে স্তন ঢাকতে চেষ্টা করে। কম্পমান দু-হাতে কোনোরকম কাপড় হাতড়ে জামা-পায়জামা নিয়ে অন্ধকারে দৌড়ায়। সুবল বিছানার চাদর দিয়ে লজ্জাস্থান ঢাকতে চেষ্টা করে। কথা বলতে পারে না। বোবার মত
ব-ব-স-স- করতে থাকে। উন্মাদ কাঙালের মতো উঠে দাঁড়ায় স্বপ্না আন্টি। সমস্ত চোখ বিস্ফারিত হয়ে বের হয় আগুন। চামুণ্ডার মতো ফুঁসতে থাকে সমস্ত অবয়ব। দু-পা মাতঙ্গিনী ভৈরবীর মতো তাথৈ-তাথৈ করতে থাকে। নাক ফুলে ত্রিশূলের মতো হয়ে ওঠে। শুধু একটি মুহূর্ত! তবেরে! মহিষাসুর বধের মতো দু-পা ত্রিশূলের মতো করে সজোরে সুবলমামার শিশ্নে লাথি মারে।
ওহ মাগো! কঁকিয়ে পাটাতনে পড়ে যায় সুবলমামা।
স্বপ্না আন্টি একের পর এক লাথি মারতে থাকে। উন্মাদনায় স্বপ্না আন্টির জিভ বের হয়ে দাঁতে আটকে যায়। এ কী! এ যেন সাক্ষাৎ কালী! মণ্ডপ ছেড়ে রূদ্রবেশিনী স্বপ্না আন্টির গায়ে উত্থিত হলেন।
স্বপ্না আন্টির কালীরূপ দেখে রনক ভয় পেয়ে যায়। সে জাপটে ধরে আন্টিকে থামাতে চেষ্টা করে। উন্মত্ত স্বপ্না আন্টিকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসে রনক। টের পায় ভয়ংকর ক্রোধে স্বপ্না আন্টির বুক ফুঁসছে। বাসায় নিয়ে এলে দিদিমণি শুরু করে, ওই অপয়া, এই রাতে কই থেকে এলি? কাল বিসর্জনের দিন। পূজা সারতে হবে না? সন্ধ্যার ধূপ না জ্বালিয়ে কই গিয়েছিস? মণ্ডপে? আহ্নিক শেষ করে তোর কোথায় কী আছে গোছাতে বলছি না? কাল সন্ধ্যার পরেই পুরোহিতরা বের হয়ে যাবে। বিসর্জনে দেবীর সঙ্গে আমরা সবাই গেলে ওখান থেকে এসে কখন কী গুছাবি? কানে যায় না কথা? স্বপ্না আন্টি কিছু বলে না। নীরব পায়ে ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে খিল মেরে দেয়। যাওয়ার সময় রনককে শুধু বলে, যাইরে, ভালো থাকিস।
পরদিন দেবীর বিসর্জন। নানারকম আয়োজন চলছে।
দেবী দুর্গাকে প্রাণভরে দেখার জন্য মণ্ডপে মানুষের ঢল নেমেছে। মণ্ডপে বেজে উঠেছে বিষাদের সুর। বিজয়া দশমীর সকালেই দশ উপাচারে বিহিত পূজা ও দর্পন বিসর্জন সম্পন্ন হবে। দেবীর চরণে ফুল, সিঁদুর, বেলপাতা ও মিষ্টি দিয়ে বিভিন্ন আচার পালন করা হচ্ছে। সবার মনে করুণ সুর। মর্ত্যলোক ছেড়ে দেবী কৈলাসে পাড়ি জমাবেন।
বিজয়া দশমীর সকালবেলা। রনক জেগে ওঠে। জেগেই স্বপ্না আন্টির কথা মনে পড়ে। গতকাল রাতে যা হয়েছে তা ভেবে একফোঁটা ঘুমাতে পারেনি সে। ছটফট করে মরেছে স্বপ্না আন্টির জন্য। দিদিমণি যে ব্যবহার করেছেন স্বপ্না আন্টির সঙ্গে তা দুঃখজনক। সন্তানের সঙ্গে কোনো মা এমন করতে পারে? অচেনা-অজানা জায়গায় অপরিচিত লোকের হাতে কেউ কি তুলে দিতে পারে নিজ সন্তানকে? তাও আবার মেয়ে? হোক না সে পুরোহিত। এসব ভাবতে ভাবতে ভোররাতের দিকে তন্দ্রায় বুঁজে আসে চোখ। আজ সন্ধ্যায় স্বপ্না আন্টিকে পুরোহিতরা গয়া নিয়ে যাবে। রনকের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কিছুতেই স্বপ্না আন্টিকে গয়া যেতে দেবে না। দরকার হলে মাকে বলে ওদের কাছে রেখে দেবে। রনক দৌড় দেয়। ঘরে গিয়ে স্বপ্না আন্টিকে খোঁজে। না পেয়ে খালপাড়ে যায়। রনক জানে, এত সকালবেলা স্বপ্না আন্টি মণ্ডপে যাবে না। তাছাড়া সে বিধবা। একটু পর দেবীর চরণে বিবাহিত নারীরা সিঁদুর দেবে। নিজেরাও পরবে, একে অপরকে পরাবে। ওখানে স্বপ্না আন্টির কাজ নেই। স্বপ্না আন্টির জগৎ বলতে ওই এক খালপাড়। রনক এগোয় সেদিকে। কিছুদূর গিয়ে সে থমকে দাঁড়ায়। এ কী! না! এ হতে পারে না! সে ভুল দেখছে। চোখ ডলে রনক। না, যা দেখছে সব সত্যি। খালপাড়ের তেঁতুল গাছ থেকে একটি ডাল ঢালু হয়ে নিচে নেমে এসেছে। ওই ডাল বেয়ে ওপরে ওঠা যায়। স্বপ্না আন্টি সেই ডাল বেয়ে উঠে আরেকটি ডাল টেনে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে আছে। কী বিভৎস! গতকাল রাতে সুবলমামার নিম্নাঙ্গে লাথি মারার সময় চোখ যেভাবে বেরিয়ে ছিল, ঠিক তেমনি ডিমের মতো চোখ বাইরে বের হয়ে আছে। লাথি মারার সময় যেভাবে দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে ছিল তেমন করেই কামড় দেওয়া জিভ বের হয়ে আছে। রনক শুধু চিৎকার দেয় – ওহ মাগো! কে কোথায় আছো দেখে যাও। রনকের চিৎকার শুনে বের হয়ে আসে ঝুমকা আন্টি। দেখে নিথর নিস্তব্ধ হয়ে ঝুলে আছে স্বপ্না আন্টি। রনক চিৎকার দিতে থাকে। একে একে সবাই বের হয়ে আসে। স্বপ্না আন্টির প্রয়াণের খবর মণ্ডপ ছাড়িয়ে বহুদূর পৌঁছে যায়। দু-চার-দশ গ্রাম পেরিয়ে বহুজনপদ ভেঙে মানুষ ছুটে আসে ব্যাংকপাড়ায়। মানুষের ঠাঁই নেওয়ার জায়গা নেই। মানুষের ঢলে বিসর্জনের দেবীর কথা সবাই ভুলে যায়। সবাই খালপাড়ে সমবেত হয়। ওদিকে মণ্ডপে দেবী করুণ চোখে দাঁড়িয়ে থাকেন। মর্ত্যলোকের এক নারী এর আগেই বিসর্জিত হয়ে গেল। দেবীর আগেই অমর্ত্যলোকে পাড়ি জমালো।
এই বিসর্জিত নারী না পেল ফুল, না পেল পূজা।
মাটির মূর্তির জন্য যত পূজা-অর্চনা হলো এক জ্যান্ত মূর্তি এসব না পেয়েও অলক্ষেই হারিয়ে গেল। বিসর্জনের দেবীর ত্রিনয়নও অবলোকন করতে পারেনি এই প্রয়াণ। অবজ্ঞা, অবহেলা আর ভালোবাসাহীন বেদিতে কী অদ্ভুত বিসর্জন!
সবাই বলাবলি করে, আজ পুরোহিতের সঙ্গে গয়া চলে যাওয়ার কথা ছিল আত্মহননীর। অভিমানে, রাগে, দুঃখে নির্বাণ নিল সে। ব্যাংকপাড়ায় মা, বোনকে রেখে একা গয়া থাকবে কী করে আত্মভিমানিনী?
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.