ভালোবাসার নাম

রফিকুর রশীদ

আমি তার নাম রেখেছিলাম মেঘনীল।

স্কুল-কলেজের খাতায় তোলা ভালো নামের পাশাপাশি খুব ছোট্ট একটা আটপৌরে ডাকনামও ছিল তার। বেশ মিষ্টি। খানিকটা আদুরে-আদুরে শব্দ – নীপা। কিন্তু ওই আদুরে নামে আমার মন ভরেনি। পরিচয়ের পর থেকে আমি তাকে ওই নামে ডাকিনি বললেই চলে। ‘নীপা’ শব্দের অর্থ কী? এই নাম যে বয়ে বেড়াচ্ছে এতদিন ধরে, সে মোটেই জানে না, কখনো জানতে চেষ্টাও করেনি। আমি বলি ডিক্শনারি খুলে দ্যাখো। নিজের নাম নিয়ে সামান্য এইটুকু কৌতূহল থাকতে নেই! তখনকার দিনে আমাদের সেই ছোট্ট মফস্বল শহরে বাংলা অভিধান মোটেই সুলভ ছিল না। ডিক্শনারি বলতে এ.টি. দেবের ইংলিশ-টু-বেঙ্গলি কিংবা বেঙ্গলি-টু-ইংলিশ কারো-কারো ঘরে পাওয়া যেত। নীপা কোথায় পাবে বাংলা অভিধান! সেই সহযোগিতাও আমিই করি। আমাদের শিক্ষক বাবা অবসর সময়ে শব্দ নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন, শব্দের গায়ে শব্দ ঘষে পাথরে পাথর ঠুকবার আনন্দ পান। সেই সুবাদে বাবার কাচভাঙা আলমারিতে বহুব্যবহৃত ডিক্শনারি আছে বেশ কয়েকটা। তারই মধ্যে থেকে সংসদ বাংলা অভিধান আমি বের করে এনে দিই।

নিজের নাম নিয়ে নীপা তখন মহাবিপাকে। রোজ বিকেলে সে আসে আমাদের বড় বোনের কাছে নজরুলগীতি শিখতে। ওস্তাদ বলতে এমন কেউ নেই, বাবার উৎসাহে এবং নিজের চেষ্টায় বড়বু রীতিমতো শিল্পী হয়ে উঠেছে। নজরুলগীতিই তার প্রিয় প্রসঙ্গ। তবে কলেজে কিংবা শহরের অন্যান্য ফাংশনে শ্রোতাদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে নজরুলগীতির বাইরেও দু-চারটি গান পরিবেশন করে। বড়বুর গানের ছাত্রী নীপা।

শুনেছি ফুড অফিসারের মেয়ে। কী খাদ্য যে খায় সে-ই জানে, স্বাস্থ্য বলতে পাতলা লিকলিকে, দেখতে কৃষ্ণকলি; কিন্তু কণ্ঠ তার সন্ধ্যা মুখার্জির কাছাকাছি প্রায়। আমাদের অনুরোধে একদিন সে ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’ গেয়ে শুনিয়েছিল। বাববা! নেহায়েত চোখের সামনে নীপা উপস্থিত ছিল, তাই রক্ষা, না হলে সন্ধ্যার কণ্ঠ বলেই সবার ভ্রম হতো।

নীপার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের দিন, আজো বেশ স্পষ্ট মনে পড়ে – সেটা ছিল ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’। না না, তখনো কালিদাসের মেঘদূত-টেঘদূত কিছুই চিনি না। এটা যে সংস্কৃত-কবি কালিদাসের বাক্য, সে-কথা অনেক পরে জেনেছি। তখন সবে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, বিদ্যের দৌড় আর কতই হবে! তবে সেদিন কলেজে গিয়ে আমাদের কমনরুমের খবরের কাগজে একেবারে প্রথম পাতায় মোটা হরফে লেখা দেখেছিলাম – আষাঢ়স্য প্রথম দিবস। আরো শৈশবে বাংলার ষড়ঋতুর পরিচয়ে জেনেছি – আষাঢ় শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল; কিন্তু সেদিন বর্ষা বা বৃষ্টি ছিল না। গোমরামুখো আকাশ নুয়েছিল মাথার ওপরে। রোদ নেই, কেমন যেন ছায়া-ছায়া পরিবেশ, আবার গুমোট গরম। সেদিন বৃষ্টি নামল শেষে বেলাগড়ানো বিকেলে। তড়িঘড়ি করে আমি বাইরে যাবার জন্যে দরজা খুলতেই দেখি – বৃষ্টি নেমে গেছে ঝিরঝিরিয়ে, আর সেই বৃষ্টির রেণু উড়ুউড়ু চুলে এবং সারা গায়ে মাখিয়ে নীপা দাঁড়িয়ে কদমতলায়।

এই মেয়েটিই যে নীপা, এমন নির্দিষ্ট করে তখনো আমি তাকে চিনি না। বড়বুর কাছে গান শিখতে আসা মেয়ে, সেটুকু আমি বুঝতে পারি। বিকেলের ব্যাচে বড়বুর কাছে আসতে দেখেছি বলে মনে হয়। আসলে বিকেল আমাকে টানে খেলার মাঠে। সেটা ফুটবলেও আপত্তি নেই, তবে ক্রিকেটে বিশেষ আনন্দ। এদিকে আমাদের বড়বু স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা সংগঠন খুলেছে, বিকেলে হয় তাদের রিহার্সেল। সমবেত কণ্ঠে কোরাস গায় – ‘ধনধান্যপুষ্পভরা, আমাদের এ বসুন্ধরা…।’ নীপাদের মতো উঁচু ক্লাসের কয়েকটা ছাত্রীর জন্য বড়বু ওরই মধ্যে আলাদা করে সময় দেয়, কিন্তু ছোটদের আবৃত্তি শেখানোর ভারটা সে বরাবরই আমার কাঁধে চাপাতে চায়। আমি ওভাবে গৃহবন্দি হয়ে বিকেল মাটি করতে রাজি নই। তাছাড়া আমি আবৃত্তির কীইবা এমন জানি! ছোটবেলা থেকে বাবার গমগমে কণ্ঠে শুনে আসছি – ‘ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনই অন্ধ বন্ধ ক’রো না পাখা…’ অথবা, ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিবাইছে তব আলো/ তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?’ এভাবে শুনতে শুনতেই আমরা ভাইবোনেরা অনেক কবিতা মুখস্থ করে ফেলেছি। কাজী নজরুলের ‘মানুষ’, ‘নারী’, এমনকি ‘বিদ্রোহী’ কবিতারও অংশবিশেষ আমাদের মুখস্থ করতে হয়েছে বাবার চাপেই। তা কবিতা মুখস্থ আর আবৃত্তি কি এককথা হলো। বড়বু নাছোড় – না, তোর ভরাট কণ্ঠে আবৃত্তি খুব ভালো হয়, তুই আবৃত্তির দায়িত্বটা নে দেখি!

ভরাট কণ্ঠ!

বড়বুর কথা শুনে আমার হাসি পায়। এ আমার কুড়িয়ে পাওয়া ধন। আসলে কিন্তু উত্তরাধিকারসূত্রেই পেয়েছি এই বাচনভঙ্গি, এই কণ্ঠস্বর। বাবার ইচ্ছে, আমি যেন রবীন্দ্রসংগীত শিখি। তাঁর পছন্দ পূজা ও প্রার্থনা পর্বের গান এবং সেইসঙ্গে প্রকৃতিপর্বের মধ্যে বাদল দিনের গানও। ঘরকন্নার মাঝে ডুবে থাকা আমাদের নির্বিবাদী মায়ের কাছে খেয়ালি আবদারও জানাতে দেখেছি আমাদের বাবাকে। ছুটির দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামতে দেখে মন তার হয়ে ওঠে শ্রাবণ মেঘের সঙ্গী, তখন স্ত্রীকে তোয়াজ করে – গাও না পারুলের মা – ‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে/ দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে,/ ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে\’ বাবাকে আমরা বহুদিন গুনগুন করতে শুনেছি, কিন্তু মাকে তো কোনোদিন কোনো গান গাইতে শুনিনি! অথচ সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমাদের সেই সংগীতবিমুখ মা-ই কিনা একদিন বলে বসে – খোকা তুই রবীন্দ্রসংগীত শিখলেই পারিস! তোর বাপের তো সাধ পূরণ হয়!

রবীন্দ্রসংগীত কিংবা আবৃত্তি – কোনোটিতেই আমার আগ্রহ কম কিছু আছে এমন নয়, তবে সবার ওপরে খেলার মাঠ। রোদ-বৃষ্টি কি ঝড়-বাদলা – কিছুতেই আমাকে রুখতে পারেনি, বিকেল হলেই আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি ঠিকই; কিন্তু সেদিন সেই বাদলবিকেলে কী যে হলো, দরজা খুলতেই কদমতলায় আমার দুচোখ আটকে গেল, পা দুটি থমকে দাঁড়াল; বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তো ছিলই, বৃষ্টিভেজা মেয়েটির চোখে চোখ পড়তে আমার বুকের ভেতরে শুরু হলো ঝড়ো হাওয়ার মাতামাতি। কে যে কবে রাস্তার পাশে এই কদমগাছ লাগিয়েছিল জানি না, বর্ষা এলেই দেখি নতুন জীবন পায়, সবুজপাতার ফাঁকে ফুলে-ফুলে হেসে ওঠে তার সারা শরীর; আলোকিত করে তোলে দশ দিগন্ত। বৃষ্টিধোয়া কদম ফুল নাকি বৃষ্টিভেজা নীপা – কে যে আমার ধমনিতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, আমি টের পাই আমার রক্তের প্রবাহে শুরু হয়েছে উথালপাতাল তোলপাড়। আমি স্থির হয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। পায়ে-পায়ে এগিয়ে যাই কদমতলায়, মেয়েটিকে জিগ্যেস করি, তুমি বড়বুর ছাত্রী না?

মুখের রা কাড়ে না, সে ঘাড় নাড়িয়ে জবাব দেয়, হ্যাঁ। ঠিক কোথায় সাদৃশ্য, সে-কথা পুরোপুরি বুঝিয়ে বলতে পারব না, তবে এতক্ষণে বৃষ্টিভেজা কদমফুলের সঙ্গে তার মুখের আদলটুকু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলি, তা গাছতলায় দাঁড়িয়ে ভিজছ কেন? ভেতরে যাও।

আমার বোধহয় বেশ খানিকটা দাদাগিরি ফলানো হয়ে যায়, অসময়ের গার্জেনগিরিও বলা যেতে পারে; মেয়েটি ভীরুপায়ে চলে যায় বড়বুর গানের ঘরে। শ্রাবণ-মেঘের আওলা সরে গেলে বৃষ্টি ধরে আসে ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটির গায়ের আসমানি রঙের  জামা- ওড়না ভিজে সারা। আসমানি রং? মানে তো সেই আকাশের রং। সেটা তবে কোন আকাশ – শরতের নির্মেঘ আকাশ, নাকি বর্ষার নতমুখী মেঘলা আকাশ? মনে পড়ে ব্যাকরণে শিখেছিলাম – নীল যে অম্বর = নীলাম্বর। রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে ‘মেঘনীল’ রঙের কথা আছে – ‘পরো দেহ ঘেরি মেঘনীল বেশ।’ তবে কি সেদিন সে ওই মেঘনীল বেশই পরেছিল।

সেবারই নীপা স্কুল ফাইনালের পাঁচিল টপকে কলেজে চলে এলে আমি সেকেন্ড ইয়ারে উঠে গেলাম। আমাদের মধ্যে ব্যবধান আসলে এক বছরের। তবু সেটা চোখে পড়ত স্কুল আর কলেজের মধ্যে দূরত্বের কারণেই। নীপা কলেজে চলে আসার ফলে অতিদ্রুত সেই দূরত্ব গেল ঘুচে। অথচ বড়বুর গানের ক্লাসে সেভাবে বসলে এ-দূরত্ব আরো আগেই মোচন হওয়ার কথা। বাস্তবে কিন্তু হয়নি। সেই বৃষ্টিভেজা মুখ আমাকে প্রতিনিয়ত টেনেছে, ভেতরে-ভেতরে শেকড়বাকড় উপড়ে ফেলার জোগাড় হয়েছে; তবু বড়বুর গানের ঘরে আর সহজভাবে ঢুকতেই পারিনি। রাজ্যের সব দ্বিধা-সংকোচ এসে দুপায়ের গতি রোধ করেছে, বুকের মধ্যে হাজারটা হাতুড়ির বাড়ি পড়েছে। তবু সত্যি যা সেটুকু কবুল করতে দ্বিধা নেই – দেখতে যতই কৃষ্ণকলি হোক না কেন, তার ওই কদম-কদম মুখটা না দেখলে আমার দিনের প্রহর ভারি হয়ে যেত, রাত্রি পাড়ি দেওয়া যেনবা সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার মতোই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠত।

সেই নীপা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কেমন যেন এক লাফে বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে এলো, হোক এক বছরের ছোট-বড়, তবু সম্পর্কটা সহসা বন্ধুত্বের মতোই হয়ে গেল। সম্পর্কের এই নতুন মাত্রা রচনার জন্য আমি তো হাত বাড়িয়েই ছিলাম, কে জানে ভেতরে-ভেতরে তারও কোনো প্রস্ত্ততি ছিল কিনা! এই কলেজ-অধ্যায়ের একেবারে সূচনাপর্বেই তাকে নামের অর্থ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। সংসদ বাংলা অভিধান ঘেঁটে কোথাও ‘নীপা’ পাওয়া যায় না। কী আশ্চর্য! তবে কি অর্থহীন এক শব্দের ভার অকারণেই বয়ে চলেছে নীপা! হ্যাঁ, পাতা ওলটাতে-ওলটাতে পাওয়া গেল নীপ, নীপবন; অর্থ হলো ‘তমালতরু’। না না, এতদিন পর ভুল হচ্ছে; নীপ মানে ‘কদমফুলের গাছ’। অভিধানে কদমগাছের কথাই লেখা আছে। কিন্তু নীপা? এ কি তবে ‘নীপ’ শব্দেরই লিঙ্গান্তর? তা নীপা কি নিজেকে কদমগাছের সঙ্গে তুলনীয় ভাবতে রাজি? আমি তো তার দিকে তাকালে সেই বৃষ্টিধোয়া কদমফুলই দেখতে পাই, সারা শরীরভরা বৃষ্টিরেণু, কী যে মিষ্টি সেই দৃশ্য!

বিপন্ন নীপাকে উদ্ধারের জন্য আমিই তখন এগিয়ে আসি। সুহৃদ বান্ধবের মতো বুঝিয়ে বলি, মানুষের তো কতরকম নামই থাকে, কোনোটা ঘরে ব্যবহারের, কোনোটা বাইরে ব্যবহারের। কোনোটা শুধুই বাবার, কোনোটা মায়ের ভাইয়ের। আবার বন্ধুবান্ধবের ইয়ার্কি-ঠাট্টাতেও কারো নাম ভেঙেচুরে দুমড়ে-মুচড়ে অন্যরকম হয়ে যায়। নীপা হেসে ওঠে আমার বিবরণের ভঙ্গি দেখে। তখন আমি আরো তৎপর হই, মুখে আঙুল তুলে বলি, হেসো না, হেসো না খুকি, শোনো।

নীপা হাসতেই থাকে। যেন বিকেলের তাপহীন রোদ্দুরে গড়িয়ে পড়ে মুক্তোদানা। ঝলমলিয়ে ওঠে চতুর্দিক। আমি সেই হাসির রেণু গায়ে মেখে প্রস্তাব রাখি, আমি বরং তোমাকে একটা নতুন নাম দিই।

প্রস্তাব শুনে হাসির লাগামে টান পড়ে। মুখে কিছুই বলে না। তার দুচোখের পাতা কেঁপে ওঠে তিরতিরিয়ে। এ যে তার সম্মতি নাকি অসম্মতি, আমি কিছুই বুঝতে পারি না। খুব বিনম্রভাবে জিগ্যেস করি, সেই কবে থেকে ভেবে ভেবে আমি একটা নাম ঠিক করে রেখেছি, বলব সেই নামটা?

নাহ্, নীরবতা ভাঙে না নীপা। কিন্তু আমি তার চোখের তারায় চোখ রাখতেই ঠিক উত্তর পেয়ে যাই। দেখি তার দুচোখের পুতুল ঘাড় দুলিয়ে নেচে-নেচে সম্মতি জানাচ্ছে, রীতিমতো প্ররোচিত করছে – কই বলো বলো, নতুন নাম বলো শুনি!

আমি খুব সযত্নে উচ্চারণ করি, মেঘনীল।

নীল নয়, চেয়ে দেখি নীপা লাল হয়ে গেছে লজ্জায়। গায়ের রং তার ফর্সা নয় মোটেই, তবু নতুন নামকরণে চোখে-মুখে লালিমার আভা ঠিকই ছলকে উঠেছে। আমি রাবীন্দ্রিক শুদ্ধতায় আবারো উচ্চারণ করি ‘মেঘোনীল’। তারপর জানতে চাই – পছন্দ হয়েছে তোমার?

সরাসরি উত্তর না দিয়ে নীপাই আমাকে জিগ্যেস করে, এখন থেকে সবাই তাহলে এই নামে ডাকবে আমাকে?

না না, তা হবে কেন? আমি প্রতিবাদ করি – সবাই ডাকবে কোন অধিকারে? ওটা শুধুই আমার ডাকার জন্য।

একার জন্যই একটা নাম! নীপা যেন বিস্মিত হয়। আমি সোজা জানিয়ে দিই, হ্যাঁ, শুধু আমার জন্য। তবে কেউ যদি তোমাকে আমার মতো ভালোবাসে, তাহলে ডাকতে পারে ওই নামে; আপত্তি নেই। ওটা ভালোবাসার নাম।

এবার মেঘনীল আর লাল নয়, যথার্থই নীল হতে শুরু করে। কোথায় উড়ে যায় উচ্ছ্বসিত হাসির পেঁজাতুলো, সারামুখে ঘনিয়ে আসে মেঘ। সহসা এই রংবদলের দৃশ্য দেখে আমারও ভাবনা হয়, জিগ্যেস করি, কী হলো হঠাৎ!

আমার খুব ভয় করছে।

সত্যিই অবাক কান্ড – এরই মাঝে তার চোখের কোণে উথলে ওঠে শ্রাবণজলের অশ্রুদানা। এমন অশ্রুপাতের কী যে মানে, আমার জানা নেই। এর মধ্যে ভয়ভীতিই বা ঢুকল কেমন করে তাও আমি ভেবে পাই না। অবাক হয়ে শুধাই, কী বলছ তুমি?

না, সেদিন আর কোনো কথা হয় না।

অথচ ভীতুর ডিম সেই মেয়েটি কিন্তু ঠিকই রবীন্দ্রনাথের গানের শরীর ঘেঁটেঘুঁটে কয়েক দিনের মধ্যে আবিষ্কার করে বসে ‘মেঘনীল’ শব্দটি আমি কোত্থেকে সংগ্রহ করেছি। আমাকে অবাক করে দিয়ে একদিন সে দিব্যি গুনগুনিয়ে ওঠে – ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে…’। বড়বুর কাছে সে নজরুলগীতির তালিম নেয় আমি জানি, তাই বলে রবীন্দ্রসংগীতের বাণীর ওপরও এতটা দখল থাকবে, আশা করিনি। ওই গানেই আছে – ‘দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ, পরো দেহ ঘেরি মেঘনীল বেশ -।’

অতঃপর সহসা একদিন মেঘনীল আমার চোখেমুখে তার ঘনকালো কেশ এলিয়ে দিয়ে অন্ধকার করে দেয় আমার পৃথিবী। সামনে আমি একবিন্দু আলোর আভাস দেখতে পাই না। অথচ ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা তখন ঘরের দুয়ারে। আমি যাই কোথায়, কী করি। সরকারি চাকরিজীবী বাবার বদলির সুবাদে আমার আকাশে বিষাদের নীল রং ছড়িয়ে দিয়ে মেঘনীল চলে গেল বহুদূরে। আমার কিছুই করার থাকল না। মাথার ওপরে শ্রাবণ আকাশ দম ধরে দাঁড়িয়ে রইল শুধু।

জীবন তবু থেমে থাকেনি কারো। ঘন মেঘের আড়ালের কারণে সাদা চোখে দেখা যাক বা না যাক, নক্ষত্ররাজি আপন অস্তিত্বে ঠিকই থাকে বিরাজমান; জীবন কেন রইবে শুধু মুহ্যমান! জীবনের দাবি জীবন ঠিকই আদায় করে নেয়, তার কাছে ক্ষমা নেই। বাবার নতুন কর্মস্থল থেকে দু-চার দফা চিঠি লিখে নীপা খুব ক্ষমা-টমা চায়। চিঠি তো নয়, শ্রাবণজলে ভেজা কদমপাতা। কতদিন কতরাত, ভেবেও আমি জবাব লেখার ভাষা খুঁজে পাইনি। এ-জীবনে নিজের বহু বোকামির কারণ অনুসন্ধান করে পরে নিজেই হেসেছি, বোকার মতোই হেসেছি; কিন্তু যৌবনের শুরুতে ভালোবাসাবাসির নামে যে ঘূর্ণিপাকের খেলায় আমি নেমেছিলাম, সে-খেলার পরিণাম যে এমনই হতে পারে, ভাবতেই পারি না – সে-কথা কেন একবারও মাথায় আসেনি! প্রথম প্রেম কি তবে এতটাই অবুঝ হয়।

আমি এখন দৈনিক কাগজের অফিসে কাজ করি। সাংবাদিক। প্রিয়-অপ্রিয় বিবেচনা নেই, বস্ত্তনিষ্ঠ সংবাদ লিখতে হয়। সপ্তাহে দুটো সাব-এডিটরিয়ালও। কোথায় আমার আবৃত্তি, কোথায় আমার রবীন্দ্রসংগীতের কণ্ঠ, কোথায় আমার খেলার মাঠ! আমাদের সেই ছোট্ট মফস্বল শহরের আনন্দ-কোলাহল, হইহল্লা, দুঃখ-বেদনা সব চাপা পড়ে গেছে রাশি-রাশি নিউজপ্রিন্টে মুদ্রিত কালো অক্ষরের আড়ালে। দিনশেষে গভীর রাতে অফিস থেকে বেরিয়ে বাসায় ফিরি হাই তুলতে-তুলতে। খাবার টেবিলে ভাত-তরকারি এগিয়ে দেওয়ার পর মা আমাকে বিয়ের তাগাদা দেয়। তার সব ছেলেমেয়ে বিয়ে-থা করে সংসারী হয়েছে, চিন্তা শুধু আমাকে নিয়ে। আমার বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ তুলে দিতে পারলে সে ফিরে যাবে আপন সংসারে। বাবা নেই, বাড়িতে এখন কেউ থাকে না। তবু তাকে সেখানেই যেতে হবে, একা-একাই থাকবে, এই তার ইচ্ছে। আমার জন্যই হচ্ছে না সেটা। কিন্তু আমিই বা কী করতে পারি। বিয়ে করার মতো জরুরি কাজটাই যে কেন হয়ে উঠছে না তার উপযুক্ত কারণ আমি নিজেই নির্ণয় করতে পারি না; মাকে আর কত মিথ্যে অজুহাত দেখাব।

শুক্রবারে আমার ডে-অফ। দেরি করে ঘুম থেকে উঠি। চা খাই। কাগজ পড়ি। বাথরুমে যাই। রুটিনটা এরকমই। গত শুক্রবার সকালে চোখ মেলতেই দেখি, বাইরে তুমুল বৃষ্টি। কাগজ হাতে নিয়ে চমকে উঠি, সেই পুরনো শিরোনাম – ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’। পাশেই ছাপা হয়েছে কদমফুলের রঙিন ছবি। নতুন বলতে এই ছবিটুকুই। ভেতরে সেই একই গৎবাঁধা কথা, ব্যক্ত হয়েছে চিরপুরনো সেই প্রত্যাশা – নবধারাজলে স্নাত হয়ে উঠুক ধরণী…। বর্ষা শুরুর দিনটি শুক্রবার হওয়ার ফলে সাহিত্য সাময়িকীতেও তার প্রভাব পড়েছে। লিড স্টোরির শিরোনাম : ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’। কী বলা যায়, কারে বলা যায়, সেসব আর পড়া হয় না, চোখ আটকে যায় কবিতার পাতায়। অনেকগুলো কবিতা ছাপা হয়েছে। নবীন-প্রবীণ অনেক কবির নাম ছাপা হয়েছে। কবিতা নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ না থাকলেও কাগজের অফিসে চাকরির সুবাদে অনেক কবির সঙ্গে পরিচয়ও ঘটেছে। কিন্তু সহসা আমার দুচোখ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায় বিশেষ এক কবির নামের ওপর। কবিতার নিচে লেখা আছে কবির নাম – মেঘনীল। হৃৎপিন্ড লাফিয়ে ওঠে – এ কোন মেঘনীল? আগে বা পরে আর কিছু নেই, শুধু ওই একটি শব্দ। মেঘনীল কবিতা লেখে? কবে থেকে? গান ছেড়ে তবে কি কবিতাচর্চা শুরু করেছে? কোথায় আছে, কেমন আছে মেঘনীল, খুব জানতে ইচ্ছে করে।

সাহিত্য-সম্পাদক নাসিমভাইকে ফোন করতেই পেয়ে যাই কবি মেঘনীলের ঠিকানা এবং ফোন নম্বর। ই-মেইল অ্যাড্রেস দেখে আমার তো চোখ কপালে – কবি তাহলে কানাডাপ্রবাসী বাঙালি! নাসিমভাই বেশ তো সপ্রশংস মন্তব্য করলেন – বাঙালি নারী লেখকেরা দেশের বাইরে গেলে ফেমিনিজম নিয়ে যেরকম হইহল্লা করে, এই ভদ্রমহিলার প্রবণতার মধ্যে সেসব নেই। আছে চিরায়ত বাঙালি নারীর সর্বংসহা এবং সর্বজয়ী কল্যাণী রূপের ছবি। আজকের কবিতাটাই পড়ে দ্যাখো না!

তাই তো! এতোক্ষণ কবি-ভাবনাতেই মগ্ন হয়ে আছি, কবিতা তো পড়া হয়নি। অবশ্য কবিতার আমি কীইবা বুঝি! আমাদের শিবনারায়ণ স্যার বলতেন, অঙ্ক কিংবা বিজ্ঞান যেমন বুঝে নেওয়ার বিষয়, কবিতা কিন্তু তা নয়। কবিতা হচ্ছে অনুভবের বিষয়। নইলে কালিদাস কি পারতেন মেঘকে দূত করে পাঠাতে! নির্বাসিত যক্ষের বিরহের আর্তি – সে তো শুধু অনুভবেরই বিষয়। আমি অনুভূতিকে সজারুসজাগ করে একালের কবি মেঘনীলের কবিতার রাজ্যে প্রবেশ করি। কবি লিখেছেন – আমি আনত মেঘ হয়ে ছায়া দিয়ে তোমাকে স্পর্শ করি হে ক্লান্ত পথিক/ আমি আকাশভাঙা বৃষ্টি হয়ে ছুঁয়ে দিই তোমার বুক হে তৃষ্ণিত মাঠ/ তুমি টের পাও বা না পাও, আমি আছি শস্যদানার অন্তরে…।

কবিতা শেষ না হতেই হঠাৎ ভাবনা হয়, কে এই মেঘনীল? আমি কি চিনি এই কবিকে! আমাদের সেই নীপাই যদি কবিতা লিখবে তাহলে এই নামে কেন? আমি তো বলেছি এ-নাম ভালোবাসার নাম। এ শুধু আমার ব্যবহারের জন্যই আমি রচনা করেছি। কিন্তু এ তুমি কী করেছ মেঘনীল, সবার মধ্যে বিলিয়ে দিলে সেই প্রিয় নাম! কই, আমি তো এতটা উদার হতে পারিনি।

মা এসে নাস্তার তাগাদা দিতেই সম্বিত ফিরে আসে আমার। এতোদিন পরে এসব কী যে আকাশকুসুম ভাবছি! কবি মেঘনীল নিশ্চয় অন্য কেউ হবে। বাঙালি বটে, পশ্চিমবাংলার বাঙালিও হতে পারে। ওখানে ইন্দ্রনীল, মেঘনীল – এসবই যথেষ্ট সুলভ। নাসিমভাই হয়তো এ-কবির নাগরিক-পরিচয়ও জানতে পারেন; কিন্তু আমার এতোটা কৌতূহলের কী যে ব্যাখ্যা করবেন কে জানে! আমাকে ব্যাচেলর পেয়ে অফিস-কলিগরাও নেহায়েত কম খোঁচাখুঁচি করে না। নাহ্, নাসিমভাইকে আর ফোন করা হয় না। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, ফোন যদি করতেই হয়, সেটা আমার মেঘনীলকেই করব।

সত্যি ফোন করব? মেঘনীলকেই? নিজেকে পরিহাস করে উঠি – আমার মেঘনীল! কী যে স্পর্ধিত উচ্চারণ। হ্যাঁ, আমাদের সেই মফস্বল শহরের বৃষ্টিভেজা নীপার মাথায় একদা আমি নতুন নামের মুকুট পরিয়ে দিয়েছিলাম ঠিকই, মেঘনীল আমারই রচিত নাম; কিন্তু এখন যদি ফোনের ওপার থেকে অচেনা নারীকণ্ঠে উচ্চারিত হয় – দুঃখিত, আমি নীপা নই, মেঘনীল। আপনার বোধহয় ভুল হচ্ছে। ফোনের সুইচ যদি অফ করে দেয়। ভাবতে পারি না।

আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটে এসেছে। ভারি সংগীতপ্রিয় মানুষ। প্রায়শ উচ্চশব্দে গান বাজায়। প্রবল বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে তার রেকর্ড প্লেয়ার ছড়িয়ে দেয় অমিয় সুধা : ‘বাদল-দিনের প্রথম কদমফুল করেছ দান,/ আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান…।’ এরই মাঝে আমার ভয় করে। নীপাও একবার ভয় পেয়েছিল, বেশ মনে পড়ে। আমারও খুব ভয় পায়। ফোন করার সাহস হয় না। তখনো গানের আভাস ভেসে আসে – ‘মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে/ রেখেছি যে ঢেকে তারে…’।

মনে হলো শেষে, আমার মেঘনীলও থাক না ঢাকা সময়ের অন্ধকারে।