‘I want to forget what I have learnt. In principle, I just follow my instincts…’ ক্যাটালগে প্রিমার দেওয়া এ-স্টেটমেন্টটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীর বর্তমান চিন্তার ধরনকে বোঝার জন্য। কারণ, এর সঙ্গে সম্পর্কিত ‘PRIMA DONNA’ শীর্ষক একক চিত্রকলা প্রদর্শনী। গত ৪ মে বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জের আয়োজনে শুরু হয়েছে শিল্পী প্রিমা নাজিয়া আন্দালীবের চতুর্দশতম একক চিত্রকলা প্রদর্শনী।
প্রিমা নাজিয়া আন্দালীবের ৪৮টি শিল্পকর্মের অধিকাংশই নারীচরিত্রের মূর্ত-বিমূর্ত আঙ্গিকে প্রকাশবাদী উপস্থাপন; কিন্তু যথেষ্ট স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা বিদ্যমান। ক্যানভাসকে নান্দনিক সুখবোধজ্ঞাপক কোনো পরিণতি দেওয়ার চাইতে শিল্পী ক্যানভাস নিয়ে যথেচ্ছপনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার স্বরূপ স্পষ্ট হয় চিত্রকর্ম নির্মাণে শিল্পীর ব্রাশ চালনা, ড্রইং, রং লেপন ইত্যাদির ভারসাম্যের দিকে নজর দিলে। খুব সূক্ষ্ম ও বস্ত্তগত কলাকৌশল প্রিমার ছবির বৈশিষ্ট্য। প্রিমার ছবি বরং অনেক বেশি সূক্ষ্মতা বা ডিটেইলিং করে নারীর শোষিত ও অবদমিত আকাঙ্ক্ষার ও স্বপ্নের। এই নারীরা সমাজের সর্বস্তরের নয়; বরং শিল্পীর নিজের শ্রেণির। উচ্চবিত্ত কিংবা উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণিকে চিহ্নিত করে। কারণ, শ্রমিক শ্রেণির নারীর শরীর অবয়ব কিংবা বাস্তবতা প্রিমার নারীর রূপ, ফ্যাশন কিংবা মোহনীয় অভিব্যক্তির বাস্তবতার সঙ্গে রাত-দিন তফাতের। যদিও ‘নারী’র সামগ্রিক শ্রেণিগত শোষণের চিত্রণে মিল রয়েছে। ‘কসমোপলিটন’ শিরোনামের শিল্পকর্মটিতে কাগজ, কোলাজ ও তেলরং ব্যবহার করেছেন শিল্পী। ছয়জন নারী প্রতিকৃতির যে-ধরনের গঠন, এবং অভিব্যক্তি এবং প্রিমা নিজেকে যেভাবে আরো বেশি লেপ্টে দিয়েছেন রং-রেখার সজ্জা, ফলে পুরুষশাসিত কসমোপলিটন শহরের নারীদের সাজ-ফ্যাশন, আবেদনময়তা ও ভোগবাদিতার অভ্যন্তরের দৈন্য উন্মোচিত হয়েছে।
ডোনা (DONNA) একটি ইতালিয়ান শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ অগ্রগামী নারী বা অগ্রবর্তিনী। কোনো অপেরা দলের প্রধান নারীচরিত্রকে ‘ডোনা’ বলা হতো। নামের যথার্থতা প্রিমা নাজিয়া আন্দালীবের প্রদর্শনীতে রয়েছে। নাটকের মঞ্চসজ্জা একটি সুনির্দিষ্ট গল্প বিবিধ চরিত্রের ভিড়ে দর্শকের সামনে উপস্থিত প্রধানতম নারীচরিত্রটি যেন দর্শকের চোখে এক বিস্ময়। কামনা জাগে পুরুষের; কিন্তু এই বাস্তবতার ভেতরে নারীর একান্ত নিজস্ব সাহস, সততা, বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা কিংবা পুরুষের শোষণে বিধ্বস্ত নারীর আত্মসম্মান ইত্যাদি নৈতিক মূল্যবোধের অধিকার একবিংশ শতকে পুঁজিবাদী সমাজের প্রধানতম সংকট। প্রিমা তো বলেছেন, তিনি নিজে তাড়না থেকে ছবি অাঁকেন; যদিও তিনি নিজেই আবার বলেন, ‘শিল্প আমার কাছে জীবনকে উদযাপন করার হাতিয়ার। আমি ছবি অাঁকি প্রাণকে অনুভব করতে, সম্ভাবনাকে উন্মোচন করতে।’
প্রিমা হয়তোবা যা শিখেছেন দীর্ঘ ২০ বছর দৃশ্যশিল্পের ভাষা-নির্মাণের চর্চা করতে গিয়ে, তার সবাই ভুলে যেতে চান। কিন্তু আসলেই কি তিনি তা পারছেন? আমার বিশ্লেষণ বলে, তিনি নিরীক্ষা করছেন প্রতিনিয়ত পূর্বের সকল কলাকৌশল ভুলে যেতে এবং একেবারে নিজের মৌলিক তাড়নাকে ভেতর থেকে বের করে আনতে। কারণ তিনি পেইন্টিংয়ের ওপর হঠাৎ বৈদ্যুতিক আলোর ঝালর লাগিয়েছেন কোনোরকম তথাকথিত কম্পোজিশন না ভেবেই এবং তা প্রদর্শন করছেন দর্শকের সামনে। প্রিমা নাজিয়া আন্দালীব দীর্ঘদিন ধরে দৃশ্যশিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করছেন। বিগত বেশকয়েক বছর প্রিমা ভিডিও আর্ট, পারফর্মিং আর্ট ও ইনস্টলেশন আর্ট করেছেন এবং সেগুলোতেও বাংলাদেশের নারীদের জীবনের গল্প উন্মোচিত হয়েছে। গৃহবাসিনী নারীর সন্তান জন্মদান-ক্ষমতা, প্রচলিত বিয়ের আনুষ্ঠানিক শর্তপালনে নারীর অন্তিম ভূমিকার তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন তিনি। নির্ভীক, আত্মবিশ্বাসী, কিছুটা খামখেয়ালিপনা, উষ্ণতা, কর্মঠ, স্বাধীনচেতা, আবেদনময়ী, ফ্যাশনদুরস্ত ইত্যাদি সবকটা শব্দই যথার্থভাবে শিল্পী নিজের জীবনে চর্চা করেন। ফলে একই সঙ্গে এসব শব্দের ইতিবাচক ও নেতিবাচক পরিস্থিতিতে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং ‘প্রিমা জেনা’ হলো ২০১৩ সাল অবধি যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার ফলন। আর্ট লাউঞ্জের দেয়ালে ঝুলছে ‘টি অর মি’, ‘হোয়াট ইফ আই ওয়্যার ইউ’, ‘ব্রাইড ইনসাইড’ ও ‘ক্যাসেল ইন দ্য স্কাই’ সিরিজের কিছু ড্রইং ও পেইন্টিং। ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ সিরিজের কাজগুলো অন্য ধাঁচের আবার গ্যালারিকক্ষে হঠাৎই চোখে পড়ে যায় আয়নায় প্রতিফলিত ‘হিল’ স্যান্ডেল। হিলের সঙ্গে নারীর জীবনের ফ্যাশনদুরস্তপনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ‘হিল স্যান্ডেলে’র ইতিহাসও বেশ বিতর্কিত যাত্রা পেরিয়েছে। ‘হিল স্যান্ডেল’ প্রিমার দৃষ্টিতে হয়তো সমাজে ‘নারী’কে উন্মোচিত করার একটা হাতিয়ার। কারণ গোড়ালিতে হিল দিয়ে লম্বা হওয়ার ইল্যুশন বা বিভ্রম তৈরি করে সমাজে নারীর পথচলা। ঠিক রাস্তায় পুরো পা ফেলে হাঁটা নয়, অর্ধেক পা বাতাসে, অর্ধেক মাটিতে এবং হিল যেভাবে নির্ণয় করে নারীশরীরের দোলাচলন, তাও বিতর্কিতভাবে গৃহীত আজো। নারীকে স্বাধীনতা ও পরাধীনতা দুই-ই দেয় এই জুতো। নারীবাদীরা অবশ্য বহুবার সমালোচনা করেছেন ‘হিল স্যান্ডেলে’র। কিন্তু প্রিমাকে তো আসলে নারীবাদী বলা যায় না, বরং অনেক বেশি পুরুষশাসিত সমাজের রমণীর সমালোচনাকারী শিল্পী। ১৯৭৪ সালে জন্ম নেওয়া প্রিমা বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনের প্রেক্ষাপটে অনেকভাবেই অবদান রাখছেন। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে মাস্টার্স করেছেন। রবীন্দ্রসংগীতের ওপর ছায়ানটে সাত বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করেছেন। প্রিমা নিজেকে আসলে মেলে দিতে পছন্দ করেন শিল্পের বহুমুখিনতায়। উপভোগ করেন জীবন ও শিল্পকে সংশ্লিষ্ট করেন। দেশে-বিদেশে অসংখ্য দলবদ্ধ প্রদর্শনী, কর্মশালা করেছেন। কিউরেটর হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সে ২০০৯-১২ সাল নাগাদ বড় দুটো প্রদর্শনী সফলভাবে আয়োজন করেছেন। ২০০৯-এ জাতীয় মহিলা পরিষদ কর্তৃক সম্মাননাসহ অনেক সম্মাননা পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের অ্যাডভাইজার ও ক্রিয়েটিভ এডিটর, বাংলাদেশ আর্ট ফোরামের ডিরেক্টর ও কিউরেটর এবং প্রিমা’স আর্ট লেয়ারে কাজ করেন প্রতিনিয়ত। ফলে প্রিমা ডোনার শিল্পকর্মের অভ্যন্তরীণ রসবোধ কিন্তু সকল কিছু ঘিরে আবর্তিত প্রিমার প্রতিফলন, যা এই সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বিশ্বব্যবস্থার সংকট ও সম্ভাবনার খানিকটা প্রতিফলন। প্রদর্শনীটি ১৩ মে পর্যন্ত চলেছে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.