মানব-অস্তিত্বের নাগরিক আখ্যান

শিল্পী সনজীব দাস অপু কয়েক বছর ধরে আবার নিয়মিত ছবি আঁকছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে তাঁর কতক চিত্রকর্ম আমরা দেখেছি। এবার ঢাকার গ্যালারি চিত্রকে ১৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে হওয়া তাঁর তৃতীয় একক প্রদর্শনীতে গত চার বছরে আঁকা ৫৪টি চিত্রকর্মের সমাবেশ ঘটেছে। ‘দ্য স্টোরি টেলার’ নামে এ-প্রদর্শনী শেষ হয় গত ৬ই মার্চ।

সনজীব দাস অপুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা প্রায় একচল্লিশ বছর আগে – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়। ১৯৮৩-৮৪ শিক্ষাবর্ষে তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউটে তাঁর ভর্তির পর। প্রথম থেকেই উদ্যমী ও পরিশ্রমী এক শিল্পশিক্ষার্থী হিসেবে জানলেও, ক্রমশ লক্ষ করি এই নবীন তীক্ষ্নধী, যুক্তিবাদী এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক মানুষটির পারিবারিক জীবনেও তার চিন্তাভাবনার প্রভাব পড়েছে। চিন্তা ও চেতনায় তাঁর সঙ্গে বেশ খানিকটা মিল থাকায়, আমার থেকে বয়সে ছোট হলেও ঘনিষ্ঠ হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। বিশেষ করে চারুশিল্পীদের পেশাজীবী সংগঠনসহ শিল্পীসমাজের কল্যাণধর্মী নানা উদ্যোগে আমরা একত্রে কাজ করে আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছি।

সনজীব সরকারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরিতে ছিলেন পঁচিশ বছর। সেখান থেকে স্বেচ্ছা-অবসর নিয়ে ছবি আঁকায় এখন অনেকটাই নিয়মিত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্থান পাওয়া তার চিত্রকর্মে আমরা দেখতে পেলাম নাগরিক মন ও মননের নানা ছবি, যাতে সংগীতময়তার স্নিগ্ধ আবেশ জড়ানো অনুভূতির সঙ্গে রোমান্টিক একটা আবহ মনকে প্রফুল্ল করে। গান শুনতে শুনতে ছবি আঁকার অভ্যাসের বশে চিত্রপটে বাদ্যযন্ত্রের উপস্থাপন সংগীতের প্রতি শিল্পীর ভালোবাসারই নৈবেদ্য বলা যায়। যেমন লালরঙের প্রাবল্যের মধ্যে শিল্পীর আঁকা একটি চিত্রে পিয়ানো বাদনরত এক তন্বীর পেছন ফেরা অবয়ব লালের ওপর কালচে ও ধূসর বর্ণের আলিম্পনে অসামান্য এক স্বপ্নিল আবহ তৈরি করেছে।

সারা দুনিয়া জুড়ে নগর পত্তনের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সারা দেশ থেকে চলে আসা মানুষ তাদের বহুত্ববাদ, বহু পেশাজীবীর আশা-আকাক্সক্ষার সম্মিলনেই গড়ে ওঠে নগরজীবন ও এর বিচিত্র সংস্কৃতি। ঢাকা গড়ে ওঠার পেছনের ঘটনাও তদ্রƒপ। ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে ৪০০ বছরের পুরনো নগরী ঢাকা আজ বর্তমান চেহারায় দৃশ্যমান।

দেশের সব প্রান্ত থেকে মানুষজন নগর ঢাকায় আসেন নিজেকে গড়ার স্বপ্ন নিয়ে, ভাগ্যের অন্বেষণে, বেঁচে থাকার তাগিদে। তাদের কেউ সফল হন, তবে বেশিরভাগ মানুষের ভাগ্যে সাফল্য জোটে না। তাই এ-নগর অনেকের কাছে যেমন চেনা, তেমনি অচেনাও। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও আধ্যাত্মিক চেতনা এ-নগরকে যেন একটা ঐন্দ্রজালিক আবহে ঘিরে রেখেছে। সেই ইন্দ্রজাল ছিঁড়ে এই জাদুর শহরের অলিগলি, কিংবদন্তির রহস্য ব্যবচ্ছেদ করেছেন কবি শামসুর রাহমান, শহিদ কাদরী, ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, লেখক মুনতাসীর মামুন, সাহিত্যিক শহিদুল জহির ও দেশি-বিদেশি চিত্রশিল্পী চার্লস ডয়েল, রফিকুন নবী, জামাল আহমেদ প্রমুখ। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য এক যুগ আগে পুরনো ঢাকায় আয়োজিত বৃত্ত আর্ট ট্রাস্টের ‘এক দৈর্ঘ্যমাইল’ শীর্ষক দলীয় প্রদর্শনী। সংশ্লিষ্টদের বর্ণনামতে এবং প্রদর্শনীর চিত্রকর্মগুলির আঁকায়-রেখায় এই ইট-কাঠ, লোহা-কংক্রিট নির্মিত নগরের বিচিত্র রূপ উন্মোচিত হয়। যেখানে নানা শ্রেণি-পেশার, নানা গোত্রের জীবনযাপন ও নাগরিক সংকট সত্ত্বেও সবার শ্রম-ঘামে তুমুল এক সচল নগরজীবন প্রতিভাত হয়, এ-নগরীর প্রকট শ্রেণিবিভাজিত সুরম্য অট্টালিকার পাশে জীর্ণ বস্তিঘর এবং যানবাহন যেমন রেলগাড়ি, বাস-ট্যাক্সি, রিকশা-ভ্যান, লঞ্চ-ইস্টিমার-ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ঘোড়াটানা শকট আর ঠেলাগাড়িতে। এসবই চলে আসে সনজীবের চিত্রপটে নতুন আর পুরনো ঢাকার চাকচিক্যময়তার সঙ্গে জীর্ণতার অসমতার প্রতীক হয়ে।

নগরজীবনে শোষিত মানুষের শ্রমসাধ্য এ অজানা অধরা অকথিত গল্পগুলোকে সযত্নে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন শিল্পী সনজীব দাস অপু। তিনি ওই মানুষগুলোর জীবন ও তাদের জীবনসংগ্রামকে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন এ-শহরের একজন আগন্তুক হিসেবে ঐতিহাসিক নগর স্থাপনার আবহকে ব্যবহার করে। সনজীব তাঁর ছবিতে পুরনো দিনের নানা ভবন, আর্চ আকৃতির দরজা, জানালা, ঘোড়ার গাড়ি, এক্কাগাড়ি এসব এঁকেছেন ভিনসেন্ট কালার প্রয়োগ করে। এতে চার শতাধিক বছর আগে গোড়াপত্তনকৃত নগর ঢাকার অতীত-বর্তমান সময়ের আবহ তৈরি হয়েছে। ঢাকার নবাববাড়ি, লালবাগ কেল্লা, বড় ও ছোট কাটরা, সাতমসজিদ, শাপলা চত্বর, বায়তুল মোকাররম, গুলিস্তানের কামান, বঙ্গভবন, বর্ধমান হাউজ, ঢাকা মেডিক্যালের পুরনো ভবন, হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্ট এসব ভবন ও স্থাপনা নগর ঢাকার এসব অবয়বকে আকারে-ইঙ্গিতে ব্যবহার করেছেন
ইতিহাস-সচেতন এই শিল্পী।

অতীত স্থাপনা আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। একজন শিল্পীর দায়বদ্ধতাও রয়েছে তার দেশ, দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে শিল্পকলায় তুলে ধরার। ঐতিহ্যসন্ধানী মন আর অনুভূতিপ্রবণ হৃদয় দিয়ে সনজীব নগরজীবনের নানা গল্প-ঘটনা, ঐতিহ্যিক স্থাপনা, মানুষের সুখ-দুঃখ ও জীবনসংগ্রামকে জড়িয়ে অসংখ্য ছবি এঁকে নগর ঢাকার অনবদ্য এক কথাকার হয়ে উঠেছেন তিনি।

কোভিড-১৯ মহামারিকালে ঘরে আবদ্ধ থেকে বাড়ির জানালা দিয়ে কিংবা সংসারের প্রয়োজনে বাজারঘাটে তাঁর আসা-যাওয়ার পথে দেখেছেন গরিব রিকশাওয়ালা, ঠেলাগাড়ি আর ভ্যানচালক, মিন্তিসহ শ্রমজীবী মানুষগুলোর বেকারত্বের দুর্দশা, হতাশাজর্জর ওই মানুষদের অনাকাক্সিক্ষত অবসর। সেইসঙ্গে মানুষ ও মালগাড়ি টানা ঘোড়া, বানর, রাস্তার কুকুর-বেড়াল, কাকগুলোর খাবার না পাওয়া করুণ চেহারা তাঁকে বিচলিত করেছে। এ সবকিছু বড় মানবিক গুণে তুলে এনেছেন সনজীব।

যেমন – ২০২১ সালে আঁকা ‘অকথিত গল্প’ শীর্ষক ধারাবাহিক চিত্রের অন্যতম একটি কাজের কথাই ধরা যাক। রিকশার আসনে অলস শুয়ে থাকা চালকের দেহভঙ্গি করোনাকালের অযাত্রিক বেকারত্বের দুর্দশার সাক্ষ্য দেয়। একই রকম আরো কয়েকটি চিত্রে দেখতে পাই নগর প্রেক্ষিতে রিকশা, রিকশাভ্যান চালকদের অবসরজনিত অবসাদ উঠে এসেছে। রেললাইনের ধারে কাজকর্মহীন এক বস্তিবাসী নারীর রূপচর্চিত মুখে অনিশ্চয়তার দূরদৃষ্টি সে-সময়ের কঠিন পরিস্থিতিতে পতিত শ্রমজীবী মানুষের অস্তিত্বের লড়াইকে মনে করিয়ে দেয়। ‘নগরের না বলা গল্প’ শীর্ষক একটি চিত্রকর্মে নগরপথের আবহে রিকশাভ্যানে এক মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাচ্ছে তরুণ চালক। পেছন থেকে আরো একজন ভ্যান ঠেলছে। সময়ের নিরিখে বড় মূল্যহীন সেই মানবজীবন – করোনা থেকে বেঁচে থাকার সংগ্রামে তখন কেউ কারো নয়!

এই অমানবিকতার কাল আর বেঁচে থাকার লড়াই, তুমুল হতাশা থেকে বেরিয়ে মুক্তির সম্ভাবনাকেও শিল্পী চিত্রিত করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন, দুর্দৈব থেকে দর্শকদেরও মুক্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন। যেমন – ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের উল্টোদিকে ভাস্কর শ্যামল চৌধুরীর গড়া রাজু স্মৃতি ভাস্কর্যের সামনে এক নবীনার ধনুকের মতো বাঁকানো দেহের নৃত্যভঙ্গিমায় উল্লম্ফনের আনন্দ উদ্যাপনের বিরল মুহূর্তের ফটোগ্রাফ অনুসরণে শিল্পী বালিকার সেই বাঁধভাঙা উল্লাসকে তাঁর চিত্রপটে তুলে ধরেছেন। বৃক্ষডালে শান্তির শ্বেত কপোতের মুক্তরূপ, ডানা ঝাপটে নীড়ে ফেরার নির্মল আনন্দ, ঢোলক বাজানো বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উৎসব যাপনের আনন্দকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন আমাদের মধ্যে। আবার অতল জলের গহিনে সাঁতাররত নারী-পুরুষের রোমাঞ্চের অনুরণনও তুলে ধরেছেন তাঁর চিত্রপটে। শিল্পীর কল্পনার চোখ দিয়ে দেখা ও চিত্রপটে তুলে আনা ‘দুই কবি’ শিরোনামে বাঙালির ইতিহাসে উদযাপিত দুই মানব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শেখ মুজিবুর রহমানের আলাপচারিতা তাঁর ইতিহাস আশ্রিত ইতিবাচক মনোভাবকে দর্শকের সামনে হাজির করে।

সনজীবের আঁকা অধিকাংশ চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু বাস্তবানুগ ও বিষয়ভিত্তিক হলেও তিনি অঙ্কনের দৃঢ়তাকে সরাসরি না দেখিয়ে রং, আলো আর নানা রেখার ঘেরাটোপে তাকে রহস্যের বাতাবরণে বেঁধেছেন। উজ্জ্বল সব রং, প্রধানত নীল, হলুদ, লাল – এসব রঙের সঙ্গে সাদা-কালোর প্রতি তুমুল পক্ষপাত দেখি তাঁর সব চিত্রপটে। চিত্রপটের আবহে পুরনো স্থাপনাগুলোকে তিনি আলোছায়ায় রেখেছেন বলে তবে আলোছায়ার দ্বান্দ্বিক কন্ট্রাস্ট,
প্রচলিত-অপ্রচলিত বর্ণলেপনের দক্ষতা, রেখার কারিকুরি দিয়ে স্থাপনার সঙ্গে বিষয়ের দূরত্ব সৃজন আর অংকনরহস্য তৈরির মুন্সিয়ানা মিলিয়ে শিল্পী একটা স্বকীয় অবস্থান নির্মাণে সমর্থ হয়েছেন।

চারকোলে আঁকা কয়েকটি অঙ্কন দর্শকচোখকে বৈচিত্রের সম্মুখীন রয়েছে। এ-কাজগুলোতেও শিল্পী তাঁর নিজস্বতার ভাবনা প্রোথিত করতে সচেষ্ট ছিলেন।

শত হতাশার মাঝেও সনজীব দাস অপুর মানব-অস্তিত্বের আশাবাদী এই শিল্পদর্শনে আমরা প্রত্যক্ষ করি ইতিহাস-ঐতিহ্যে তাঁর অঙ্গীকার, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সম্মানবোধ, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, জনজীবনের

সুখ-দুঃখ, আবেগ-উত্তাপময় ছন্দ-আনন্দ। আর এখানেই শিল্পীর সৃজন সার্থকতা। সনজীব দাসের শিল্পীজীবনের এ-যাবৎ বৃহত্তম আয়োজন গ্যালারি চিত্রকে দেখতে পেয়েছেন দর্শকরা।