মিথ ও চৈতন্যের মিথস্ক্রিয়া

মোবাশ্বির আলম মজুমদার

সৌন্দর্যের প্রথাগত ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে রনি আহমেদ দর্শকদের জানিয়ে দেন – ধর্মীয় মিথ, অলীক কল্পনা আর আধ্যাত্মিক জগতে মানুষ সবসময়ই বাস করে। বাঙালি জীবনাচারে মিথ মানুষের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। ২০০৫ সালে ঢাকায় একশ ফুট লম্বা শিল্পকর্মে দেখিয়েছেন ‘আর্কিওলজি অব নুইস আর্ক’। ধর্মীয় এই মিথের প্রসঙ্গে আমাদের সমাজে যে-ধারণা আছে তারই প্রতিফলন ছিল ওই প্রদর্শনীর শিল্পকর্মে। রনি আহমেদের শিল্পকর্মে পরিবেশ বিপর্যয়, রাজনৈতিক সংঘাত, দ্বন্দ্ব, আমত্মর্জাতিক রাজনীতি ও বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন উঠে এসেছে।

এবারের প্রদর্শনীর চলিস্নশটি কাজে রনি আহমেদ ছবির বিষয় ভিন্ন ভিন্ন রূপে বর্ণনা করেছেন। এছাড়া মানুষের সম্পর্কের সমকালীন অনুষঙ্গকে ছবির বিষয় করে তোলেন কখনো কখনো। রনি আহমেদ নিজে তাঁর প্রদর্শনী নিয়ে বলেন, ‘হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈনসহ বিভিন্ন ধর্মের মিথ নিয়ে এ-প্রদর্শনীর অধিকাংশ কাজ করা। যত মতই থাক, এক আধ্যাত্মিক শক্তির মাঝে সব মত আর পথ এক হয়ে যায়।’

সুফিবাদের বাইরে রনি স্থাপনাশিল্প ও ভিডিও আর্টে যুদ্ধ, মহামারি, দুর্ভিক্ষ নিয়ে মত ব্যক্ত করেছেন। যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় পৃথিবীজুড়ে বিসত্মৃত হচ্ছে। মানুষ সেখানে লড়াই করে জয়-পরাজয়ের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, রনির শিল্পকর্ম আমাদের সে-ভাবনার জগতে নিয়ে যায়।

দৃশ্যশিল্পের সব শাখায় প্রতিবাদ, দ্রোহ, আশা, আকাঙ্ক্ষা, দেহতত্ত্ব, মনসত্মত্ত্ব থাকে। রনির শিল্পকর্মে নন্দনতাত্ত্বিক দর্শন অনুপস্থিত। তাঁর শিল্পকর্ম একাধারে আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ আবার অন্যদিকে নন্দনের বিপরীত। দোদুল্যমান এ-অবস্থানে থেকে শিল্পসৃষ্টির কাজটি বেশ শ্রমসাপেক্ষ। চিমত্মা ও মননে মিথোলজি ও চলমান বৈশ্বিক পরিবেশ তাঁর ভাবনায় গেঁথে থাকে। রনি আহমেদ চিত্রকলায় করণকৌশল প্রয়োগ করেন পশ্চিমা রীতিতে। ইউরোপীয় চিত্ররচনায় কমিক বইয়ের উৎকট রঙের ব্যবহারকে তিনি বেছে নেন। মৌলিক রঙের বিপরীতে তিনি শক্ত ভিত তৈরি করে নেন কালো-সাদা রঙের ব্যবহারে। হলুদ আর লাল রঙের চড়া জমিনে কম্পোজিশন বা চিত্ররচনার ব্যাকরণ তিনি মেনে চলেন না। ছবির ব্যাকরণ মেনে নেওয়ার রীতি হয়তো তিনি বিশ্বাস করেন না। রনির চিত্রকলায় রচনা ও বিষয়ই মুখ্য। অন্যসব পদ্ধতির সঙ্গে তিনি একমত না হয়ে একটি পথে চলেন, তাই তাঁর ক্যানভাস হয়ে ওঠে ব্যতিক্রম।

রনি আহমেদের কয়েকটি শিল্পকর্ম পাঠ করলে আমরা তাঁর কাজ সম্পর্কে বিসত্মারিত জেনে যাব। ‘কালী ইটিং টাইম’ ছবিটি ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে করা। কালীর মুখাবয়ব থেকে বেরিয়ে আসছে সাপ আকৃতির লম্বা রেখা। ছবির জমিনে আড়াআড়ি লাল রঙের প্রয়োগ। কালীর মাথায় একটা ঘড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে অসংখ্য কালো রেখা। এখানে ছবির মূল চরিত্র কালীমূর্তিকে প্রধান করে চলমান সময়ের প্রতিচ্ছবি দেখানো হয়েছে। বাসত্মবে এরকম না হলেও কল্পনায় রনি এমন এক গল্পের কাঠামো গড়ে তোলেন। ‘বার্থ অব ভেনাস’ স্থাপনাশিল্পে সাদা রঙের গোলকের ওপর ভেনাসের অবস্থান আর ঝিনুকের খোল এসে গোলকের গায়ে অবস্থান করছে। ঝিনুকের আকৃতিকে কখনো প্রজাপতির আকৃতিও মনে হয়। ‘লর্ড নরসিমা কিলিং আশুরা’ ছবিতে আশুরার তাজিয়া মিছিলে ব্যবহৃত মাথার তাজ ব্যবহার করে তিনি ছবিতে ফ্যান্টাসি তৈরি করেছেন। রঙের ব্যবহারে উষ্ণ বিপরীত আবহ তৈরির কথা মনে রেখে তিনি কাজ করেছেন। রনি আহমেদ ছবির কেন্দ্রবিন্দু তৈরি করেন মানুষ অথবা কোনো প্রাণীর অবয়বের হাত দিয়ে। ‘লর্ড নরসিমা কিলিং আশুরা’ ছবিতে তেমনি এক কেন্দ্রবিন্দু লক্ষ্য করা যায়। ‘গণেশ রাইটিং মহাভারত’ ছবিতে তিনি গণেশের আকৃতি ছবির কেন্দ্রে উপস্থাপন করেছেন। রনি আহমেদ বড় আকৃতির ক্যানভাস তৈরির প্রতি বেশি আগ্রহী। এ-ছবির ক্ষেত্রে সেটি বলা যায়। গণেশ মিথোলজিতে যে-গল্পের আভাস পাওয়া যায়, সে-গল্পের চরিত্রকে ছবির প্রধান করে নেন। গণেশ ও মহাভারত গল্পের বর্ণনা এখানে রং ও আকৃতির সাহায্যে প্রকাশ করেন। ‘হেল নিডস কোল টু বার্ন’ ছবিতে লাল ও হলুদ রঙের ব্যবহারে ছবির মূলভাব তৈরি হয়েছে।

ক্যানভাসের বাইরে গড়ে ওঠা স্থাপনাশিল্পে রাজনীতির প্রসঙ্গ তিনি বারবার টেনে এনেছেন। সংগত কারণে প্রদর্শনীর শিরোনাম দিয়েছেন ‘গডস অ্যান্ড বিস্টস’। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে পাশ্চাত্যে কমিক বইয়ের রঙের প্যালেটকে রনি আহমেদ নিজের মতো করে সাজিয়ে তাঁর ক্যানভাস গড়েছেন। সুফিবাদ, ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা, বিশ্ব ও স্থানীয় রাজনীতির গোলকধাঁধায় ঘুরতে থাকা মানুষের সর্বশেষ পরিণতি হয়তো এমনই। রনি আহমেদ আমাদের সে কল্পলোকে নিয়ে যান। বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে এ-প্রদর্শনী চলবে আগামী ১৭ অক্টোবর পর্যমত্ম।