মির্চা ও মৈত্রেয়ী : জীবনের শিল্পিত রূপকার

চারুকলার বকুলতলা খুব প্রিয় জায়গার একটি ছিল একসময়। কখনো যেতাম তাকে সঙ্গে নিয়ে কখনো যেতাম বাতাসের আড়ে লুকিয়ে থাকা তার সুবাস নিতে। তেমনি কোনো এক একাকী বাদল দিনে সাতরঙা ছাতাটিকে মেলে ধরে অবসন্ন পায়ে আনমনে হাঁটতে হাটতে পুরনো বইয়ের দোকানের সামনে এসে থমকে দাঁড়াই। দেখলাম বিখ্যাত লেখকদের দারুণ সব বই বৃষ্টিস্নাত হতে উন্মুখ আর দোকানি মামা বড় সযত্নে সেগুলোকে মুছে মুছে নীল পলিথিনের নিচে ঢুকিয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। একে পুরনো বই তার ওপর হঠাৎ বরষায় ভিজে একাকার হয়ে যাওয়া বইগুলো নিতে চাইলে মামার মুখে চাঁদের হাসি ছড়িয়ে পড়ে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলাম, নামমাত্র মূল্যে দিয়ে দেওয়া বইগুলো বগলদাবা করে কালবিলম্ব না করে ক্ষণিকা বাসে করে বাসার উদ্দেশে রওনা দিই। পুরোটা সময়জুড়ে মনে হচ্ছিল আমি যেন বাসে নয়, পঙ্খিরাজ ঘোড়ার পিঠে করে উড়ে চলেছি।

বাসায় গিয়ে দেখি আকাশ পরিষ্কার। ঝকঝকে রোদ কোলে নিয়ে আকাশ বসে আছে আমার ক্ষুদ্র আনন্দটুকুতে আলো ভরে দিতে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে প্রতিটি বইকে মুড়মুড়ে করে শুকিয়ে তারপর  নানা রং, রঙিন কাগজ, আঠা, সুই ও সুতা নিয়ে বসে গেলাম বইগুলোর অপারেশনে। ঘণ্টাখানেকের মাঝে জরাজীর্ণ বইগুলো পেল নবরূপ। নিজের প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ তাকিয়ে। এবার পড়ার পালা। কিন্তু তা হবার ছিল না। কারণ তার ঠিক তিনদিন পর থেকে ছিল টার্ম ফাইনাল।

দীর্ঘ পনেরো দিন পর শেষ হলো পরীক্ষা। মনে হলো যেন পেরিয়ে গিয়েছে এক যুগ। একে একে শরৎ, শীর্ষেন্দু ও সমরেশ শেষ করে নজর পড়ল পলকা এক নাম-না-জানা লেখকের বইয়ের দিকে। শুরু করলাম কিন্তু বারবারই শেষ না হবার প্রার্থনা করছিলাম। একসময় শেষ হলো। কিন্তু রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। সম্পূর্ণ নতুন লেখক, সেই সঙ্গে লেখনী। গল্প বলার ঢঙের সঙ্গে সঙ্গে বিষয় বেছে নেওয়ার সীমাহীন দুঃসাহস সেদিন দারুণ লেগেছিল। গল্পের বাঁকে বাঁকে মিশে থাকা বিষয়ের চমৎকারিত্বের চেয়ে প্রগাঢ় অনুভূতির বর্ণননৈপুণ্য আমায় সেদিন দারুণ মুগ্ধ করেছিল। মূল গল্পটি পড়ার জন্য মনটা খুব আনচান করছিল; কিন্তু জানলাম মির্চা এলিয়েদের লা নুই বেঙ্গলীর মূল গল্পটি রোমানিয়ানে লেখা। অবশ্য ফরাসিতে অনুবাদের পর এর সাফল্য সফলতার সকল উচ্চতাকে স্পর্শ করে একসময় কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত হয়।

মির্চা এলিয়েদের উপন্যাস মৈত্রেয়ী‌ (Maitreyi) রোমানিয়ান ভাষা থেকে ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়ে লা নুই বেঙ্গলী (La Nuit Bengalie) হয়। যার অর্থ ইংরেজিতে ‘The Bengalie night’ এবং বাংলায় ‘বঙ্গরজনী’। উপন্যাসটি মির্চার জবানে বর্ণিত হয়েছে। বইয়ের প্রথম শব্দ  মৈত্রেয়ী, মাঝের শব্দগুলো এই নারীকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি আর অন্তিমের শব্দসমূহ মৈত্রেয়ীকে শেষবারের মতো দেখার আকুতিতে ভারাক্রান্ত। অনুভূতির তাজা রঙে ভিজিয়ে নিয়ে উপন্যাসটি আস্বাদ করলে  মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটবে। কিন্তু কোনো প্রকার সংস্কার কিংবা ছুৎমার্গের দোহাই দিলে এ-উপন্যাসের রসাস্বাদন মাঠে মারা পড়বে। তাই প্রয়োজন কেবল একটি পাঠক মনের। সেই সঙ্গে মেধা আর মননের সংযোগ হলে তা হবে সোনায় সোহাগা।

১৯২৮ সালে ২১ বছর বয়সী রোমানিয়ান যুবক মির্চা এলিয়াদ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের অধীনে ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে গবেষণা করার উদ্দেশ্যে কলকাতায় আসেন। পেয়িং গেস্ট হিসেবে অধ্যাপক দাশগুপ্তের ভবানীপুরের বাড়িতেই একটি কক্ষ নিয়ে থাকার ব্যবস্থা হয় মির্চার। সম্পূর্ণ ভিনদেশি ছাত্র ছিল মির্চা এলিয়াদ। কিন্তু মৈত্রেয়ীর পরিবার কোনো দিক হতেই কম ছিল না – আভিজাত্য, উচ্চশিক্ষা আর জ্ঞানতপস্যায় নিয়োজিত গোটা পরিবারটি মির্চাকে বেশ সহজভাবেই গ্রহণ করে। বিশেষ করে মৈত্রেয়ীর বাবা। নিজের জ্ঞানকে উজাড় করে দেওয়ার যোগ্য শিষ্য হিসেবে তিনি মির্চাকে সাদরে গ্রহণ করেন। তাঁর অকৃত্রিম আদর ও স্নেহে একসময় মির্চার প্রবেশ অবাধ হয়ে যায় অন্দরমহলে। পড়াশোনার প্রতি অধ্যাপক সাহেবের ঝোঁকটা ছিল বেশি। তাই সমকালের আর সবার মতো মেয়েদের পড়াশোনার প্রতি তিনি রক্ষণশীল ছিলেন না। ছিলেন বরং উলটো। সাহিত্যচর্চার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও একাগ্রচিত্ততা তিনি তাঁর সন্তানদের মাঝে সঞ্চারিত করতে সমর্থ হন। বিশেষ করে বড় কন্যা মৈত্রেয়ী ছিল বাবার যোগ্য উত্তরসূরি। বয়সের তুলনায় তাঁর বুদ্ধি, বিবেচনা ও প্রখর ব্যক্তিত্ব সকলের নজর কেড়ে নিত। খুব স্বাভাবিকভাবেই মির্চা আকৃষ্ট হন এই চঞ্চলা, বুদ্ধিমতী ও বিদুষী কন্যার প্রতি। ধীরে ধীরে সে-আকর্ষণ প্রবল রূপ ধারণ করতে থাকে। মৈত্রেয়ীর পক্ষেও একসময় আর অতি সুদর্শন ও জ্ঞানী মির্চার আকুল চাহনি, আকুতিভরা মিনতি, প্রজ্ঞা ও প্রতিভার দারুণ সম্মিলনকে উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। দেশ-ধর্ম-বর্ণ সংস্কার, সংস্কৃতি ও দূরত্বের বাধা পেরিয়ে, সকল নিয়মকানুন ও ভয়কে জয় করে এক অমোঘ টানে বাঁধা পড়ে দুটি হৃদয়। একদিকে অন্দরমহলে অবাধ যাতায়াতের অনুমতি, পরস্পরের নিকট পরস্পরের ভাষা শেখার চেষ্টা, সাহিত্যবিষয়ক নানা আলোচনার ফাঁক গলে দুজন বড্ড বেশি দুজনের কাছে চলে আসেন। মৈত্রেয়ীর পরিবার এ-সম্পর্ককে সহজে মেনে নিতে চাইবেন না জেনেও তাঁরা দুজনে ফিরে আসতে পারেননি। মৈত্রেয়ীর মা যতই তাঁকে ছেলের মতো নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিন, মৈত্রেয়ীকে তাঁর হাতে তুলে দিতে যে তাঁরা সকলে সহস্র কদম পিছিয়ে যাবেন, এ তাঁদের দুজনেরই জানা ছিল। তবু ক্ষীণ আশা নিয়ে তাঁদের প্রেম প্রতিবন্ধকতার সকল দুয়ার ক্রমশই ভেঙে ফেলছিল। খুনসুটি, রাগ, অভিমান, রাগ ভাঙানোর খেলা, বেড়াতে যাওয়া … এসব নিয়ে চলছিল বেশ। মাঝেমধ্যে অবশ্য মির্চা রবীন্দ্রনাথের প্রতি মৈত্রেয়ীর ভালোবাসা নিয়ে অভিমান করতেন, ঈর্ষান্বিত হতেন। মৈত্রেয়ী চুপ থেকে সে ঈর্ষানলে ঘি ঢালতেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু হঠাৎ একদিন উথালপাথাল করা সেই প্রেমাকাশে দেখা দেয় দুর্যোগের ঘনঘটা। মুহূর্তের মাঝে মধুর সে-সম্পর্কের ইতি ঘটে।

মৈত্রেয়ী দেবীর ছোট বোন চিত্রিতা দেবী, ভালোবেসে সবাই তাঁকে ছবু বলে ডাকত। ১৯৩০ সালে চিত্রিতা দেবীর বয়স ছিল এগারো বছর। সে-সময় পুরো পরিবার চিত্রিতাকে নিয়ে চিন্তিত ছিল। বয়ঃসন্ধির সময় চিত্রিতা হঠাৎ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর কথাবার্তা, চলাফেরা সবই অস্বাভাবিক হয়ে যায়। নানা চিকিৎসা চললেও চিত্রিতার অবস্থার তেমন পরিবর্তন হচ্ছিল না। এসময় মৈত্রেয়ী আর মির্চা ছোট বোন চিত্রিতাকে নিয়ে বিকেলবেলা প্রায় ঘুরতে বেরোতেন। এরকমই এক বিকেলে মৈত্রেয়ী আর মির্চা, চিত্রিতার হাওয়া বদলের জন্য তাঁকে নিয়ে ঘুরতে বেরোলেন। এবং সেদিন তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ভুলে বিপদ ডেকে আনেন। চিত্রিতার সামনেই দুজন হঠাৎ অসাবধান হয়ে পড়েন। মানসিকভাবে অস্থিতিশীল চিত্রিতার চোখে তাঁর মির্চা দাদা আর বড়দিদির আচরণ ভালো লাগে না। সে-সময় তাঁর ধারণা জন্মে, মির্চা কেবল তাঁর দিদিকেই ভালোবাসেন। কিন্তু তাঁকে বাসেন না। এ-অভিমানের কথা যখন তিনি জানান তাঁর মাকে তখন দাবানলের মতো তা ছড়িয়ে পড়ে সকলের কাছে। কাজের লোক ও বন্ধু মারফত সে-খবর অন্দরের দোর পেরিয়ে বেরিয়ে পড়ে লোকালয়ে। মানুষের মুখে মুখে মুখরোচক গল্পে পরিণত হয় তা। মির্চা অনেক চেষ্টা করেন মৈত্রেয়ীর বাবাকে বোঝাতে। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না  তাঁদের। এক কাপড়ে মৈত্রেয়ীর বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হয় মির্চাকে। দোতলা থেকে এসব দেখে মৈত্রেয়ী মূর্ছা যান। দিদির এমন বিপদাপন্ন অবস্থা দেখে মৈত্রেয়ীর ছোট বোন অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন। পূর্বেই তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। সেইসঙ্গে যুক্ত হয় অপরাধবোধ ও আতঙ্ক, যা তাঁকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়; যার মধ্য দিয়ে মৈত্রেয়ীর পরিবারে নেমে আসে নতুন বিপর্যয়। সবকিছুর পরও মৈত্রেয়ী নানাভাবে নানাজনের সহায়তায় মির্চার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু গুরুর কাছে দেওয়া ওয়াদা রক্ষার নিমিত্তে মির্চা তাঁর একবুক ভালোবাসাকে সমাধিস্থ করতে বাধ্য হন। মৈত্রেয়ী প্রাণপণ চেষ্টা করে গিয়েছিলেন মির্চার সঙ্গে যোগাযোগের। কিন্তু তা আর হয়নি। অবশেষে বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে শেষ হয় উপন্যাসটি। লেখকের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকও বেদনা ও বিষণ্নতায় বিহ্বল হয়ে পড়েন। অতৃপ্ততার গুঞ্জন পাঠকমনেও বারবার ঢেউ তুলে হাহাকারে ভরিয়ে তোলে তাঁর সমগ্র সত্তা। তখন শরৎচন্দ্রের মতো পাঠকও সান্ত্বনা খোঁজেন সেই পরম বাক্যে – ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়।’

উপন্যাসের যেসব চরিত্র রয়েছে তাদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থেকেও যে-চরিত্রটি প্রথমাবধি দারুণ ঔজ্জ্বল্যে উপন্যাসমধ্যে বিরাজ করছে তিনি হলেন সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। একজন বিদেশিকে নিজ বাড়িতে থাকতে দেওয়া এবং পরিবারের সবার সঙ্গে একটি সুন্দর ও সাবলীল সম্পর্ক স্থাপন করার সুযোগ দেওয়ার পেছনে তাঁর যে-উদার মানসিকতা বিরাজ করছিল সে-সম্পর্কে জানতে হলে তাঁর উচ্চশিক্ষা, মননশীল চিন্তা, দার্শনিক প্রজ্ঞা ও কর্মক্ষেত্রের ব্যাপকতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া দরকার। নতুবা সাধারণের সারিতে দাঁড় করিয়ে বিবেচনা করলে উনিশ শতকের সেই বাঙালি পরিবেশে তাঁর সিদ্ধান্তের অপব্যাখ্যা হতে পারে। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত (১৮৮৭-১৯৫২)  সংস্কৃত পণ্ডিত ও দার্শনিক। সুরেন্দ্রনাথ কলকাতার রিপন কলেজ থেকে সংস্কৃতে বিএ (সম্মান) এবং  সংস্কৃত কলেজ থেকে এমএ (১৯০৮) পাশ করেন। ১৯১০ সালে পাশ্চাত্য দর্শনে এমএ পাশ করে তিনি কিছুদিন রাজশাহী কলেজে অধ্যাপনা করেন; পরে চট্টগ্রাম কলেজে সংস্কৃত ও বাংলার প্রধান অধ্যাপক হন।  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করার পর গবেষণার জন্য তিনি ইংল্যান্ড যান এবং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুনরায় পিএইচ.ডি (১৯২২) ডিগ্রি অর্জন করেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন বাংলা সাহিত্যে অধ্যাপনা করে ১৯২৪ সালে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে দর্শনের অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। সাত বছর পর ১৯৩১ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ এবং ১৯৪২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিবিজ্ঞানের অধ্যাপক হন। সুরেন্দ্রনাথ ১৯৩৮ সালে দার্শনিক ক্রোচের আমন্ত্রণে ইতালি যান এবং রোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৫ সালে অবসর গ্রহণের পর তিনি পুনরায় বিদেশ যান এবং ১৯৫০ সাল থেকে লখনৌ শহরে বসবাস করেন। সুরেন্দ্রনাথ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯২১ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ‘ইন্টার-এলায়েড কংগ্রেস অব ফিলোসফি’তে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯২৪ সালে নেপলসে এবং ১৯২৬ সালে হার্ভার্ডে আন্তর্জাতিক ফিলোসফিক্যাল কংগ্রেসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং বাংলা সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯২৫ সালে তিনি রাশিয়ায় আমন্ত্রিত হন এবং পরের বছর শিকাগোতে হ্যারিস বক্তৃতা প্রদান করেন। ১৯৩২ সালে তিনি ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৬ সালে তিনি লন্ডন এবং ১৯৩৯ সালে প্যারিসে আন্তর্জাতিক ‘কংগ্রেস অব রিলিজিয়নে’ ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করেন। সুরেন্দ্রনাথ একটি নিজস্ব দার্শনিক মতবাদ গড়ে তুলেছিলেন, যা Theory of Dependent Emergence বা সংক্ষেপে ‘সম্ভূতিবাদ’ নামে পরিচিত। সুরেন্দ্রনাথের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো পাঁচ খণ্ডে রচিত Theory of Dependent Emergence। এছাড়া তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গবেষণাধর্মী রচনা হলো : Theory of Dependent Emergence (১৯২০), Yoga Philosophy in Relation to other Systems of Indian Thought (১৯৩০), A History of Sanskrit Literature

(১৯৪৭), Rabindranath : The Poet and Philosopher (১৯৪৮), কাব্যবিচার, সৌন্দর্যতত্ত্ব, রবিদীপিকা ইত্যাদি। এছাড়া তিনি পাঁচটি মৌলিক কাব্যগ্রন্থ এবং একটি উপন্যাসও রচনা করেন।  চিত্রকলা,  অলংকারশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়েও তাঁর প্রবন্ধাদি রয়েছে। অতি সংক্ষেপে এই হলো সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কর্মময় জীবনের নানাদিক, যা পাঠককে স্পষ্টত বুঝিয়ে দেয়, কেন মির্চা মি. দাশগুপ্তের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করতে আসেন এবং তিনিও অবলীলায় একজন বিদেশিকে তাঁর গৃহে অভ্যর্থনা জানান। নিজ কন্যাদের অন্য ভাষায় পারদর্শিতা অর্জনের জন্য কেন তিনি একজন বিদেশির শরণাপন্ন হন। কারণ তিনি উদারনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা মানুষকে সরল ও সংযত করে। কিন্তু নিজ কন্যা ও প্রিয় শিষ্যের প্রণয় মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি ধর্ম ও সমাজের বিপরীতে হয়তো যেতে পারতেন; কিন্তু আপন শিক্ষাভিমানকে তিনি ত্যাগ করতে পারেননি। ফলে হাজার বছরের যে-ইতিহাস তারই পুনরাবৃত্তি ঘটে – মির্চা ও মৈত্রেয়ীর বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে ওঠে। যদিও তা ছিল সাময়িক বা সামাজিক। কারণ সে-প্রেম অমরতাকে আলিঙ্গন করে আজো পাঠকমনকে গভীর আবেশে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। অবিনশ্বর আত্মার মাঝে লালন করা সে প্রেমই চির অমলিনভাবে বেঁচে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। মানুষ প্রতিনিয়ত কষ্ট পায়, কাঁদে, দুঃখের দহনে দগ্ধ হয়ে অঙ্গার হয়ে ওঠে, তবু সে প্রেমানলে আত্মাহুতি দিতে পিছপা হয় না। হোক সে-ভুল, তবু তা প্রেম। তা সুন্দর ও অভাবনীয় অনুভূতির জন্ম দেয়। ক্ষুদ্র মানুষকে অসীম ক্ষমতা দান করে। সীমার মাঝে থাকা মানুষ প্রেমের ছোঁয়ায় কেবল অসীমের বুকে স্থান পায়। এ-কারণেই হয়তো রোমানিয়ার মানুষের মুখে মুখে ফেরে মির্চা ও মৈত্রেয়ীর গল্প। শ্রদ্ধাভরে তারা স্মরণ করে তাঁদের। এমনকি রোমানিয়ার স্কুল সিলেবাসে এখনো মির্চা এলিয়াদের মৈত্রেয়ী পড়ানো হয়।

আলোচনার এ-পর্যায়ে মির্চা এলিয়াদ বা মির্চা ইউক্লিডকে নিয়ে আলোচনা অনিবার্য, যিনি একই সঙ্গে এ-উপন্যাসের লেখক ও নায়ক বা প্রধান চরিত্র। মির্চা এলিয়াদ তৎকালীন ‘Noel & Noel’ কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে ভারতবর্ষে আসেন ১৯২৮ সালের দিকে। কিছুদিন চাকরির প্রয়োজনে তিনি ভারতবর্ষের নানা স্থানে ভ্রমণশেষে তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯২৯ সালে ভবানীপুরে মৈত্রেয়ীদের বাড়িতে অতিথি হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করেন। লক্ষ্য ছিল ভারতীয় ভাষা-সংস্কৃতি তথা প্রাচ্যের দর্শন সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ। সেখানেই মৈত্রেয়ীর সঙ্গে মির্চার অসাধারণ এক সম্বন্ধ গড়ে ওঠে। দার্শনিক এলিয়াদের অন্তরমাঝে সে প্রেম যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে তারই শিল্পিত প্রকাশের মধ্য দিয়ে মৈত্রেয়ী উপন্যাসের জন্ম। ১৯৩৩ সালে মির্চা এই উপন্যাসটি লেখেন, যা তাঁকে রাতারাতি ঔপন্যাসিক খ্যাতি এনে দেয়। এই মহান প্রেমিক ও দার্শনিক মির্চা এলিয়াদ ১৯০৭ সালে রোমানিয়ার বুখারেস্টে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রোমানীয় ভূমিবাহিনীর কর্মকর্তা ঘিওরঘে ইলিয়াদে এবং জিনা নি ভাসিলেস্কুরের পুত্র। ছোটবেলা হতেই এলিয়াদ প্রকৃতপ্রেমিক ছিলেন। মুগ্ধতা ও বিস্ময় নিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করতেন তাঁর চারপাশকে। প্রকৃতির অপার রহস্যের সন্ধানে দুঃসাহসিক সব অভিযানে অংশ নেন তিনি। এজন্য তিনি স্কুলের বয়েজ স্কাউটে যোগ দেন এবং বন্ধুদের সঙ্গে মিলে নৌকা তৈরি করে তুলসিয়া হতে কৃষ্ণসাগর পাড়ি দেন। এছাড়া পর্বতারোহণ ও ভ্রমণ তাঁর নেশায় পরিণত হয়। একসময় নানান ভাষায় পারদর্শিতা অর্জনের জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন এবং ইংরেজি, ফার্সি, হিব্রু ও ইতালীয় ভাষা রপ্ত করে ফেলেন। এছাড়া রসায়ন, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পাশাপাশি অলৌকিক বিষয়ের প্রতি তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং এনটোমোলজিক্যাল বিষয়ের ওপর লেখালেখি শুরু করেন। এ-সময় তিনি সাহিত্য অধ্যয়নেও মনোনিবেশ করেন। সক্রেটিস, ভাসিল কন্টা এবং স্টোইস মার্কাস অরেলিয়াস এবং এপিটেটাসের দর্শন দ্বারা তিনি প্রভাবিত হলেও তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে রোমানিয়ার দার্শনিক বাগদান পেট্রিসিকু হাসদেউ এবং নিকোলাই আইওরগা। ১৯২১ সালে প্রথম তাঁর লেখা প্রকাশ পায়। ১৯২৫ থেকে ১৯২৮ সালের মধ্যে তিনি বুখারেস্টের দর্শন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং আর্লি মডার্ন ইতালিয়ান দার্শনিক টমাসো কাম্পানেলার ওপর একটি গবেষণার মাধ্যমে ডিপ্লোমা অর্জন করেন। ১৯২৭ সালে এলিয়াদ ইতালি ভ্রমণ এবং বিখ্যাত দার্শনিক পাপিনির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এরপর তিনি মিশর সফর শেষ করে হিমালয়ে কিছু সময় অবস্থান করেন। অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনি লেখাপড়া শুরু করেন। এরই এক পর্যায়ে তিনি ক্যামব্রিজের প্রাক্তন ছাত্র এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের অধীনে সংস্কৃত ও দর্শন অধ্যয়নের জন্য ভবানীপুরে তাঁর বাসগৃহে বসবাস করতে থাকেন। দাশগুপ্ত পরিবারের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে মির্চা নতুন এক জীবন শুরু করেন। আর সে-জীবনের পুরোটা জুড়ে অবস্থান করছেন একজন মহীয়সী নারী – মৈত্রেয়ী। মৈত্রেয়ীর সঙ্গে মির্চার আত্মিক এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কাছে সে প্রণয় গ্রহণযোগ্যতা পায় না। ফলে একসময় দূরে সরে যেতে বাধ্য হন এলিয়াদ। রোমানিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেও যখন তাঁর পক্ষে কোনোমতেই মৈত্রেয়ীকে ভোলা সম্ভব হয় না তখন ১৯৩৩ সালে তিনি রোমানিয়ান ভাষায় মৈত্রেয়ী নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন, যা একদিকে তাঁকে এনে দেয় ব্যাপক জনপ্রিয়তা, অপরদিকে তাঁর প্রেমকে দান করে অমরত্ব। এর পরে তিনি রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েন। অবশেষে তিনি ১৯৫৪ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ম, কল্পকাহিনি লেখক, দার্শনিক এবং অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়ে তাঁর ধর্মীয় মতবাদ প্রকাশে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।  তিনি ধর্মীয় অভিজ্ঞতার একজন নেতৃস্থানীয় গবেষক ছিলেন। যিনি আজো ধর্মীয় গবেষণায় আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ধর্মীয় গবেষণায় তাঁর অন্যতম অবদান ছিল তাঁর শাশ্বত প্রত্যাবর্তন তত্ত্ব, যা প্রথম প্রকাশের পর এক লক্ষ কপি বিক্রি হয়। তাঁর বিখ্যাত রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো Sabel and the Devil’s Waters, Maitreyi, Santier, Novel of the Nearsighted Adolescent, Return from Paradise, The Hooligans, Marriage in Heaven, Fantastic and Fantasy Literature, The Snake, A Big Man ইত্যাদি গ্রন্থ। এছাড়া তাঁর অসংখ্য লেখার ওপর ভিত্তি করে নানা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে পরবর্তীকালে। তার মধ্যে অন্যতম The Bengali Night (১৯৮৮), Miss Christina (১৯৯২), The Snake (১৯৯৬), Eu sunt Adam! (১৯৯৬), Youth Without Youth (২০০৭), Domnisoara Christina (২০১৩) ইত্যাদি। তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে অসংখ্য গবেষণাগ্রন্থ রচিত হয়েছে। A History of Religious Ideas, Images and Symbols : Studies in Religious Symbolism (trans. Philip Mairet, Myth and Reality Myths, Dreams and Mysteries, Patterns

in Comparative Religion, The Quest for the ‘Origins’ of Religion, The Sacred and the Profane : The Nature of Religion, Yoga : Immortality and Freedom ইত্যাদি সেগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য। ৭৯ বছরের যে-জীবন মির্চা এলিয়াদ যাপন করেছিলেন তা ছিল বর্ণাঢ্য ও কর্মচঞ্চল। দর্শনচিন্তায় মগ্ন ও উচ্চশিক্ষায় শাণিত মির্চার প্রণয়ও ছিল অসীম। সীমার বাঁধনে বেঁধে সে-বোধের মূল্যায়ন করলে কেবল কাঁকর ও কাদা হাতে আসবে। সোনা বা হীরার সন্ধান আর পাওয়া যাবে না। দক্ষ ডুবুরির মতো অতলে তলালেই কেবল তুলে আনা সম্ভব মণি-মুক্তা, হীরা-জহরত। নতুবা পানি ও ঢেউয়ে ভেসে যাবে সবই। 

‘মনে পড়ে গেল সেদিন সকালে টেলিফোনে মৈত্রেয়ীর কথাগুলো – চিরবিদায় অ্যালেন, চিরবিদায় প্রিয়তম। অন্যজীবনে আমরা নিশ্চয়ই ফিরে পাবো আমাদের ভালোবাসা। দু’জনে দু’জনকে নিজের করে পাবো। তখন তুমি আমাকে চিনতে পারবে তো? আমার জন্য অপেক্ষা করবে তো? আমায় ভুলো না অ্যালেন। আমি কিন্তু তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।’ আমি ওকে কিছুই উত্তর দিতে পারিনি। শুধু বলেছিলাম – মৈত্রেয়ী, মৈত্রেয়ী, আমার মৈত্রেয়ী …।’

এ-কথাগুলোর গূঢ়ার্থ উপলব্ধি করা একান্তভাবেই অনিবার্য। মির্চার উপন্যাসে অনেক কিছু ছিল। তার কিছু সমাজবিরোধী, কিছু ধর্মবিরোধী আবার কিছু কালবিরোধী। কিন্তু কোনো কিছুই প্রণয়বিরোধী ছিল না। ভালোবাসার বিপুল বাষ্পে ভেসে জীবনের অন্তিম দিন পর্যন্ত সে-প্রণয় তাঁকে বেঁধে রেখেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে।

মৈত্রেয়ী – একজন অসাধারণ নারীর নাম। মির্চার উপন্যাসের তিনি নায়িকা। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের তিনি কন্যা। একজন ষোড়শী সুন্দরী। শিক্ষা-দীক্ষা, প্রজ্ঞা ও প্রতিভার আশ্চর্য সমন্বয় ছিল তাঁর মাঝে। প্রতিটি চরিত্রের মতো তাঁর পরিচয় প্রদানের সময়ও উপন্যাসবহির্ভূত কিছু তথ্যউপাত্তের সংযোজন প্রয়োজন। কারণ একই আকাশের মাঝে বিরাজ করে চাঁদ, তারা ও সূর্য। দূর হতে অস্পষ্টভাবে দেখে তাদের পরিচয় লিখতে বসলে কেবল ফাঁকি দেওয়া হবে। সত্যিটা দূরে রয়ে যাবে। তাই পরিচিত হবার পূর্বে পরিচয় প্রদান করা আবশ্যক। ১৯১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মৈত্রেয়ী দেবী। তাঁর পিতা ছিলেন দার্শনিক, প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত আর মা ছিলেন হিমানী মাধুরী রায়। মৈত্রেয়ী দেবীর শৈশব কাটে বাবার বাড়ি বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়ার গৈলা গ্রামে। তবে পিতার কর্মক্ষেত্রের সুবাদে তিনি কৈশোরেই সপরিবারে কলকাতার ভবানীপুরে বসবাস শুরু করেন। সেই সঙ্গে ক্রমেই তিনি তৎকালীন কলকাতার ‘এলিট’ বা ‘ক্রিম অব কলকাতা’ সম্প্রদায়ের সাহচর্য তথা স্নেহধন্যা হতে থাকেন। ভবানীপুরের বিখ্যাত এই বাড়িতে রোজ আনাগোনা হয় তৎকালীন বিখ্যাত সব লেখক-লেখিকা, সম্পাদক, এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও। ১৯৩৬ সালে মৈত্রেয়ী দেবী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে প্রাইভেট রেজিস্ট্রেশন করে দর্শনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। স্নাতক ডিগ্রি লাভের আগেই ১৯৩৪ সালে তিনি ড. মনোমোহন সেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। মনোমোহন সেন ছিলেন একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী। তিনি মংপুতে সিনকোনা ফ্যাক্টরির ম্যানেজার ছিলেন ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ভেষজ সিনকোনা চাষ নিয়ে গবেষণা করেন। মংপুতে সিনকোনা চাষের ব্যাপারে তাঁর স্বামীর বিশেষ অবদান ছিল। মৈত্রেয়ী দেবী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহভাজন হওয়ায় তাঁরা মংপুতে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ীর আমন্ত্রণে ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে চারবার সেখানে গিয়েছিলেন। শৈশবে  মনীষী সাহিত্যিকবর্গের সাহচর্যে বড় হয়েছেন মৈত্রেয়ী দেবী। সাহিত্যজীবনের স্ফূরণ নিতান্ত অল্পবয়সেই তাঁর। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ উদারতা, যার ভূমিকা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ চিত্তছায়া। ১৯৪২ সালে, রবীন্দ্রনাথের মংপুতে কাটানো দিনগুলোর স্মৃতি ও তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতা নিয়ে, লেখেন স্মৃতিকথা মংপুতে রবীন্দ্রনাথ। কবির অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার এক উজ্জ্বল পরিচয় ফুটে উঠেছে এই অনবদ্য গ্রন্থে। অসাধারণ জনপ্রিয়তার কারণে বইটি ইংরেজিতে অনূদিত হয় টেগোর বাই ফায়ারসাইড নামে। রবীন্দ্রবিষয়ক তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ : স্বর্গের কাছাকাছি, বিশ্বসভায় রবীন্দ্রনাথ, গৃহে ও বিশ্বে, কবি সার্বভৌম, রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ দি ম্যান বিহাউন্ড হিজ পোয়েট্রি প্রভৃতি। তাঁর অচেনা চীন, মহাসোভিয়েত, চীনে ও জাপানে প্রভৃতি গ্রন্থ এ-বিষয়ে স্মরণীয়। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : বিধি ও বিধাতা, এত রক্ত কেন, ঋগবেদের দেবতা ও মানুষ, হিরণ¥য় পাখি, আদিত্য মারীচ প্রভৃতি। সাহিত্য রচনা ছাড়াও সমাজসেবামূলক কর্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন মৈত্রেয়ী দেবী। ১৯৬১-তে রবীন্দ্র শতবর্ষে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে তিনি সোভিয়েত রাশিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও গণতান্ত্রিক জার্মানিতে গিয়েছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁকে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী পদকে ভূষিত করে। মৈত্রেয়ী দেবী সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউরোপ ও আমেরিকাতে রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি শান্তির সমস্যাবিষয়ক বহু ভাষণ দেন। তিনি ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলাকালে ‘কাউন্সিল ফর প্রমোশন অব কমিউনাল হারমনি’ সংস্থা স্থাপন করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দেন। এছাড়া এই সময়ে তিনি কলকাতা থেকে ২৪ মাইল দূরে বাদু নামক গ্রামে একটি নয় বিঘা জমি জুড়ে কৃষি, মীন পালন, মৌ পালন, গো পালন, হাঁস-কুকুর পালনের সঙ্গে শরণার্থী শিবিরের অনাথ শিশুদের জন্য ‘খেলাঘর’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই সংস্থা দেখাশোনা করেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ন হন্যতে পাঠকমহলে তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। এই বইতে তিনি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনবোধ, ইংরেজ শাসনামলে ভারতের সমাজব্যবস্থা এবং জীবনযাপনের চিত্র তুলে ধরেন। এই বইটির জন্য তিনি ১৯৭৬ সালে ভারতীয় ‘লেখিকা সংঘ’ থেকে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বইটি ইংরেজি ভাষায় It Does Not Die : A Romance নামে অনূদিত ও প্রকাশিত হয়। লেখিকার জীবনবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি মূল চরিত্র মির্চার তুলনায় নিঃসন্দেহে অনেক গভীর, যা পাঠকমহলকে বেশ নাড়া দেয়। তাঁর অনেক গ্রন্থ একাধিক ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সাহিত্য ছাড়াও সমাজসেবায় অনন্য অবদান রাখার জন্য ১৯৭৭ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হন। 

৭৪ বছরের কর্মময় জীবনে মৈত্রেয়ী দেবী তথাকথিত প্রথার বিপরীতে গিয়ে প্রজ্ঞার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন। যে-সমাজের মেয়েরা বাড়ির দহলিজ পার হওয়ার অধিকার পেত না, সেখানে তিনি কলকাতার শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞানে ও গৌরবে সমাজের যে-উঁচু অংশ তাদের সান্নিধ্য ও অনুপ্রেরণায় নিজেকে শাণিত করার সুযোগ পান। তাঁরই বয়সী অন্য মেয়েরা যখন ঘরকন্না ও সন্তান পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সেখানে তিনি সাহিত্যচর্চা, কবিতা লেখা, ধর্ম ও সংস্কৃতি চিন্তা নিয়ে একপ্রকার আরাধনা করে সময় কাটান। তাই তাঁর উপলব্ধির গভীরতা ও অনুভূতির সূক্ষ্মতম কোণগুলোকে বিবেচনায় না এনে সমসাময়িকতার আপতিক চাপ ও সামাজিক মানুষের সহজাত প্রবণতা ও প্রবৃত্তির দ্বারস্থ হয়ে তাঁকে বিবেচনা করতে গেলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে, সার বলে কিছু লভ্য হবে না। মির্চার লেখনীতে যে-মৈত্রেয়ীর দেখা আমরা পাই, তিনি ষোড়শী, বুদ্ধিমতী, জ্ঞানতাপস ও সাহিত্যচর্চায় নিবিষ্ট এক নারী। পাশাপাশি তিনি ছিলেন চঞ্চলা, চপলা ও আনন্দময়ী। ক্ষুরধার বুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আপন সত্তার মাঝে যিনি লালন করতেন একজন প্রেমময়ী নারীকে। যিনি কি না প্রতিনিয়ত পাড়ভাঙা নদীর মতো ভেঙে ভেঙে নদীর বুকে বিলীন হয়ে যাওয়ার মাঝেও আপনার চরম সার্থকতা উপলব্ধি করেন। কিন্তু কালিক চিন্তাদর্শের বিপরীতে গিয়ে মৈত্রেয়ী ও মির্চা যে-প্রেম সাজিয়েছিলেন চিরকালের বুকে অর্ঘ্যদানের নিমিত্তে সমকাল ও সংস্কার তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়। নানা জল্পনার আল্পনা এঁকে তাঁদের প্রেমের যে-চিত্র সমাজ মনস্তত্ত্বে ধারণ করা হয় তা ছিল কুৎসিত, কদর্য ও কালিমাযুক্ত। মির্চার উপন্যাসে বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অবদমিত সত্তার যে-মোহনীয় কামুকতার প্রকাশ ঘটেছে তাকে সত্য বিবেচনা করে  কালো মনের শুভ্র-পোশাক পরিহিত মানুষেরা নিন্দা ও কুৎসার করাতকলে সত্য, সুন্দর ও সহজাতকে নির্মমভাবে বলি দিয়েছে। কিন্তু সমাজ, সভ্যতা, সমকাল ও সংসারের সামনে ভালো মানুষের ঠুনকো মুখোশ পরে থাকা মানুষ মৈত্রেয়ী ছিলেন না। যে-প্রেম তাঁর কাছে ছিল আত্মার আনন্দ, তাকে তিনি কাল্পনিক কথকতার মাঝে ম্রিয়মাণ হতে দেননি। সব ভয় তুচ্ছ করে তিনি সবসময় থেকেছেন সত্য প্রকাশে অটল। রবীন্দ্রনাথের মোহময় স্নেহের পরশে যে-মন তাঁর ধারণ করেছিল নান্দনিক ঐশ্বর্যকে তাকে কাল কিংবা কালিমার মাঝে কিম্ভুত হতে দেননি। সেই না দেওয়া কথার কথামালা তিনি সাজিয়েছেন তাঁর ন হন্যতে উপন্যাসমাঝে। সে-গল্পের আগে ও পরে রয়েছে আরেকটু গল্প। সেটুকু জানা প্রয়োজন সবটুকু জানার জন্য।

১৯৩৮ কিংবা ১৯৩৯ সালের দিকে মৈত্রেয়ীর পিতা অধ্যাপক দাশগুপ্ত ইউরোপ সফরে গিয়ে প্রথম মির্চার লেখা বইটি সম্পর্কে জানতে পারেন। এবং দেশে ফিরে তিনি তা তাঁর মেয়েকে জানান। পরবর্তীকালে ১৯৫৩ সালে ইউরোপ সফরকালে মৈত্রেয়ী দেবীর নাম শুনে কিছু রোমানীয় জানান তারা তাঁর সম্বন্ধে বই পড়েছেন। কিন্তু তখনো বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। ১৯৭২ সালে এলিয়াদের এক  ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেরগুই কলকাতায় থাকাকালে তাঁর কাছ থেকে মৈত্রেয়ী দেবী জানতে পারেন বইতে মিরচা তাঁদের শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন। এক বন্ধুর সাহায্যে ফরাসি থেকে অনুবাদ করিয়ে তিনি বইটি পড়েন ও মর্মাহত হন। যে-জীবনের মূলে ছিলেন তিনি, তাঁর সেই কৈশোর জীবনের রক্তক্ষরণের সত্যভাষ্য তাঁর অধিক জানা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। এলিয়াদের লেখা পড়ে তিনি তাঁর জীবনের সঙ্গে  ঘটে যাওয়া ঘটনা ও অনুভূতির কেবল উপরিতলকে খুঁজে পান। এবং তাও অনেকটা একপেশে মনে হয় তাঁর কাছে। সেই সঙ্গে শারীরিক বিষয় নিয়ে লেখা অংশসমূহের প্রতি তিনি জানান ঘোর আপত্তি। কিন্তু কীভাবে কী করবেন তিনি বুঝতে পারছিলেন না। সে-সময় হঠাৎ করেই তাঁর সামনে দারুণ একটা সুযোগ এসে উপস্থিত হয়। ১৯৭৩ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৈত্রেয়ী দেবী আমন্ত্রণ পান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে বলবার জন্য। তিনি এই সময় না জানিয়ে মির্চা এলিয়াদের, যিনি তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, দফতরে হাজির হন। যে দুই মাস মৈত্রেয়ী দেবী ওখানে ছিলেন, তার মধ্যে দুজনের একাধিকবার দেখা হয়। বইতে মির্চা তাঁদের শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে যে মিথ্যাচার করেছেন তার কারণ জানতে চান তিনি। মির্চা অনুতপ্ত হন এবং কথা দেন মৈত্রেয়ী দেবীর জীবিতকালে তাঁর বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হবে না। কথা রেখেছিলেন মির্চা, মৈত্রেয়ী দেবীর মৃত্যুর চার বছর বাদে, ১৯৯৪ সালে লা নুই বেঙ্গলী ‘বেঙ্গল নাইটস’ নামে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে এ-গ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে ১৯৮৮ সালে নিকোলাস ক্লতজের পরিচালনায় দি বেঙ্গলি নাইট নামে একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়।

মৈত্রেয়ী দেবী ১৯৭৩-এ শিকাগো থেকে দেশে ফিরেই আত্মজৈবনিক এ-উপন্যাসটি রচনায় হাত দেন। ১৯৭৪ সালে উপন্যাসটি পাঠকের হাতে পৌঁছে যায় এবং পাঠক অবাক বিস্ময়ে উপলব্ধির এক অনন্য জগতে পৌঁছে যান। যে-জীবনের কথা প্রকাশ করে মির্চা পাঠককে প্রজ্বলিত এক অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেন সেই একই জীবনের কথা বলে মৈত্রেয়ী দেবী সে-জ্বলনে ঠান্ডা মলমের প্রলেপ লাগান ক্ষত সারিয়ে যা মন, মনন ও মস্তিষ্ককে শরতের শুভ্র সতেজ কাশফুলের নরম ছোঁয়ায় ভরে দেয়। সেই উপন্যাসটির নাম ন হন্যতে। 

ন হন্যতে শব্দের অর্থ যা মরে না (‘It does not die’)।  ‘নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ – অর্থাৎ শস্ত্র ছিঁড়তে পারে না যাকে, অগ্নি দহন করতে পারে না। এ-উপন্যাসে সেই কালজয়ী ও শাশ্বত প্রেমকে ‘ন হন্যতে’ বলা হয়েছে। অন্যত্র গীতায় আত্মা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা আছে – অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে (গীতা ২.২০)। অর্থাৎ, (আত্মার) জন্ম নেই, (আত্মা) নিত্য, শাশ্বত, প্রাচীন – শরীরকে হত্যা করলেও একে হত্যা করা যায় না। তবে বইটির আলোচ্য বিষয় আধ্যাত্মিক তত্ত্বালোচনা নয়। লেখিকার যাপিত জীবনের শিল্পিত ভাষ্য হলো ন হন্যতে। তিনি অন্যত্র লিখেছেন,

দেখি তুলে তার বুকের আচ্ছাদন,

সেখানে এখনো বাস করে কি না মন,

হন্যমান এ শরীরের মাঝে যার

অজর অমর সত্তার সম্ভার

পদে পদে গায় অসম্ভবের গান

তাই শুনতেই আজো পেতে আছি কান

শস্ত্র ছেঁড়ে না যারে অগ্নি দহে না যারে

দেখবো তারেই অশ্রুর পারাবারে

পাগলের মতো দু-হাত বাড়ায়ে ধরে

অধরা প্রাণের আবার স্বয়ংবরে

চলো যাই দূরে যেখানে দাঁড়ায়ে কাল

ভেঙে চুরে দিয়ে ঝেড়ে ফেলে জঞ্জাল

শুধু হাতে নিয়ে মুক্ত প্রাণের দীপ

নতুন বধূর কপালে পরাবে টিপ্ …

সেখানে যাবোই যেখানে রয়েছে থেমে

বাসররাত্রি, অবিচল কারু প্রেমে …

ন হন্যতে মৈত্রেয়ী দেবীর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। অনেকের মতে, এ-উপন্যাসটি মির্চা এলিয়াদের লেখা Bengali Nights

বা লা নুই বেঙ্গলী বইয়ের প্রত্যুত্তর; কিন্তু এটি মোটেও তা নয়। এ-উপন্যাসের প্রতিটি শব্দ ও চরণে গাঁথা রয়েছে কেবল একটি চরণের প্রতিধ্বনি, তা হলো ‘weapon cannot pierce, fire cannot burn’। আর রয়েছে আদি অন্তহীন এক ‘তুমি’র আরাধনা। ১৯৩০ সালে মির্চার সঙ্গে মৈত্রেয়ীর বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৭২-এ তাঁদের পুনরায় দেখা হয়। এই বিয়াল্লিশ  বছরের ইতিহাসের অগণিত তথ্য ও উপাত্তের ভিড়ে বারবার মৈত্রেয়ী দেবী ফিরে গিয়েছেন তাঁর ভবানীপুরের সেই পুরনো বাড়িতে। বিয়াল্লিশ বছরের ব্যবধান ভুলে বারবারই তিনি ষোড়শী মৈত্রেয়ীতে পরিণত হয়েছেন। এবং তখনই পাঠক তার মানসচক্ষে স্পষ্ট দেখতে পায় মির্চার গ্রন্থে পাঠ করা এক অসম্পূর্ণ প্রেমের পূর্ণরূপ। প্রাক্তন বিচ্ছেদের পুনর্জাগরণ প্রকাশ পেয়েছে এই ন হন্যতেতে। যেন আগের সেই দিনগুলো এখনো তাঁর জীবনে অম্রিয়মাণ, এখনো খুব স্পষ্টভাবে ভাসছে তাঁর চোখের পাতায়, হাত বাড়ালে এখনো ছোঁয়া যাবে আগের সেই প্রিয় মানুষটিকে।

জীবনের প্রথম হৃদয় উথালপাথাল করা এই ব্যর্থ প্রেম ভুলতে মৈত্রেয়ী ও মির্চা, দুজনকেই প্রচুর কষ্ট করতে হয়েছিল। মৈত্রেয়ী অনেককাল মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। ধীরে ধীরে কবিগুরুর শরণাপন্ন হয়ে তিনি নিজেকে স্থিতধী করার চেষ্টা করেন। একসময় লেখাপড়ায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন। সেই সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ঘোরতর উন্মাদনায় জড়িয়ে পড়েন তিনি এবং পরে যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক হন। এর কয়েক বছর পর পারিবারিকভাবে মৈত্রেয়ী দেবীর বিয়ে হয় তাঁর চেয়ে চৌদ্দ বছরের বড় বিজ্ঞানী মনোমোহন সেনের সঙ্গে, মৈত্রেয়ীর বয়স তখন বিশ। স্বামীর সঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবীর জীবন কাটে মংপুর পাহাড়ি অঞ্চলে। মানুষ হিসেবে মৈত্রেয়ীর স্বামী এত সহজ-সরল ও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন যে, মৈত্রেয়ী জীবনকে আবার ভালোবাসতে শিখে গেলেন এবং পৃথিবীর সমস্ত কালিমাকে মুছে দিতে তাঁর কোল আলো করে জন্ম নেয় দুটি সন্তান। ঘরকন্নার পাশাপাশি তিনি সাহিত্যচর্চা ও সমাজসেবা করে সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে শরণার্থী শিবিরে মৈত্রেয়ী সর্বাত্মকভাবে সেবা ও সাহায্য করেন। 

ওদিকে ভারতবর্ষ ত্যাগ করার পর মির্চা এলিয়াদ তাঁর গবেষণা, লেখাপড়ার মধ্যেই নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। ভালোবাসা, সংসার যেন মির্চার ভাগ্যে কখনো স্থায়ী হতে চাইত না। তাই মৈত্রেয়ীর সঙ্গে ব্যর্থ প্রেমের পর অভিনেত্রী সোরানা টোপার ভেতর প্রেম খুঁজতে গিয়ে আবার ব্যর্থতার স্বাদ পান তিনি। এরপর নিনা মার্সের কাছে আবারো ভালোবাসার আশ্রয় খোঁজেন মির্চা। আগে থেকেই বিবাহিত ও এক কন্যার মা নিনাকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেন ও এই সংসারে থিতু হন। তবে মধ্যবয়সে এসে মির্চা একদম একাই ছিলেন। 

কিন্তু মৈত্রেয়ীর পাশে পরশপাথর হয়ে আজীবন বিরাজ করেন কবিগুরু। তারই সাধক ছিলেন মৈত্রেয়ী। ফলে সত্য, সুন্দর ও শাশ্বতের সাধনা তাঁর আজীবনের ব্রত ছিল। তারই কাছ হতে তিনি পেয়েছিলেন সর্বসংস্কারমুক্তির দীক্ষা। সেই প্রজ্ঞার বাঁধনে বাঁধা পড়ে সস্তা লোকলজ্জার ভয়ে তিনি আপনার জাগ্রত বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পারেননি কখনো। অকুণ্ঠচিত্তে সত্য প্রকাশে তিনি ছিলেন অকুতোভয়। আটান্ন বছর বয়সে এসে নাতি-নাতনিঘেরা সুখের সংসারে অবস্থান করে একজন প্রৌঢ় নারীর পক্ষে এ-ধরনের সত্যভাষণ কোনোমতেই সহজ ছিল না। বরং ছিল প্রচণ্ড কঠিন। তবু তিনি তাঁর অনুভূতির যে-বিস্তৃত ব্যাখ্যা  দিয়েছেন তা সত্যিই অসাধারণ। যে-মৈত্রেয়ীর সঙ্গে আমাদের কেবল পরিচয় ঘটেছিল মির্চা মারফত; অস্থি, মজ্জা ও অনুভবের সকল প্রান্ত নিয়ে সেই তিনি উপস্থিত হয়েছেন ন হন্যতে-এর মাঝে।

বিয়াল্লিশ বছর পর মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে দেখা হয় রোমানিয়ার নাগরিক সেরগেই সেবাস্টিনের। তিনিই মৈত্রেয়ীকে মির্চার লেখা সম্পর্কে জানান। আরো জানান, সে লিখেছে রাত্রে তুমি তার ঘরে আসতে। মৈত্রেয়ী আর্তচিৎকারে বলে ওঠেন, ‘কী সর্বনাশ! কী অন্যায়! বিশ্বাস কর সেরগেই, সে সত্য নয়, একেবারে সত্য নয়।’ এভাবেই শুরু হয় ন হন্যতে উপন্যাস। পরে এই মিথ্যার প্রতিবাদ ও সত্য-অনুভূতির প্রগাঢ় বর্ণনায় পূর্ণতা পায় উপন্যাসটি। ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার এক অনন্য উপন্যাস এটি। যার প্রতিটি শব্দ ধারণ করে আছে অতীতের রোমাঞ্চ, বর্তমানের সংযম ও অনন্ত জীবনের প্রত্যয়। এ এক মানসযাত্রার কাহিনি, যেখানে লেখিকা একই সঙ্গে তিনটি কালের মাঝে পরিভ্রমণরত ছিলেন। বর্তমানের মাঝে তাঁর অতীত ফল্গুধারার মতো বহমান ছিল। আবার মির্চার সঙ্গে শেষ দেখার সময় তাঁর পাথরদৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আবার শাশ্বত বা অনন্ত প্রেমের মাঝে আপন আত্মার আকুতিকে সঁপে দিয়ে ধীরপায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু জলকল্লোলের শব্দ ভেদ করে তিনি যেন শুনতে পান কে যেন তাঁকে বলছে, ‘কোন ভয় নেই অমৃতা, তুমিই ওর চোখে আলো জ্বালাবে।’ তিনি ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, কবে? কবে? সে বললে, ‘যে দিন ছায়াপথে তোমাদের দেখা হবে, তার তো আর বেশি দেরী নেই -।’ এভাবেই এক গূঢ় রহস্যের বাতাবরণ সৃষ্টি করে পাঠককে মোহাচ্ছন্নতার মায়ায় জড়িয়ে শেষ হয় উপন্যাসটি। একই ঘটনাকে দুদিক থেকে দেখার ও বোঝার চমৎকার দুটি উপন্যাস লা নুই বেঙ্গলী ও ন হন্যতে। জীবনবোধের গভীরতায় শেষোক্ত গ্রন্থটি অধিক রমণীয়। আর তারুণ্যের চঞ্চলতায় উষ্ণ প্রথমটি। জীবন ও যৌবনের ধর্ম তার আপন আপন গতি ও মতি নিয়ে উপস্থিত হয়েছে গ্রন্থ দুটির মাঝে। মির্চা একদা বলেছিলেন মৈত্রেয়ীকে, ‘আমি তোমাকে না তোমার আত্মাকে ধরতে চাই।’ মূলত অবিনশ্বর আত্মাকে ধারণ করার কথাই হলো ন হন্যতে ও লা নুই বেঙ্গলী। আর মির্চা ও মৈত্রেয়ী সেই অসীমবোধের রূপকার।

তথ্যসূত্র

১। ‘মৈত্রেয়ী দেবী’, দৈনিক মানবকণ্ঠ, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬।

২। দিনেশচন্দ্র জয়ধর, ‘অনন্য সাহিত্যিক মৈত্রেয়ী দেবী’, এইবেলা, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬। 

৩।মীর ওয়ালীউজ্জামান (৭ মার্চ ২০১১), ‘পঞ্চম কাহন : ক্রিসমাসে দার্জিলিং’, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। 

৪। মৈত্রেয়ী দেবী, ন হন্যতে, দি স্কাই পাবলিসার্স, ঢাকা, ২০০৯।

৫।Devi, Maitreyi, Rabindranath–the man behind his poetry, Sudhir Das at Nabajatak Printers,1973.

৬। গাজী সাইফুল ইসলাম, “মৈত্রেয়ী দেবীর উপন্যাস ‘ন হন্যতে’, যায়যায়দিন, ২১ অক্টোবর, ২০১৬।

৭। শ্রাবণী দত্ত, ‘জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও মৃত্যুর গণ্ডি পেরিয়ে যে প্রেম : মির্চা এলিয়াদ ও মৈত্রেয়ী দেবী’, ৩ আগস্ট ২০১৯, রোয়ার মিডিয়া।

৮। লা নুই বেঙ্গলী, মির্চা এলিয়াদ, দি স্কাই পাবলিসার্স, ঢাকা, ২০০৯।

৯। সারমিনা সাহাদাত, ‘ন হন্যতে : অপূর্ণ এক প্রেম আর অনন্য এক জীবনবোধের গল্প’, ৩ অক্টোবার ২০১৯, রোয়ার মিডিয়া।

১০। Chakraborty, Satyanarayan (2012), ‘Dasgupta, Surendranath’. In Islam, Sirajul; Jamal, Ahmed A. (eds.). Banglapedia : National Encyclopedia of Bangladesh (Second ed.). Asiatic Society of Bangladesh. (Wikipedia) .১১। ‘Biografia lui Mircea Eliade la o editură germană radicală de dreapta’ (‘Mircea Eliade’s Biography at a Right-Wing Radical German Publishing House’) Archived 2007-09-03 at the Wayback Machine, in Altitudini, Nr. 17, July 2007; retrieved November 8, 2007 (in Romanian (Wikipedia).