মৃত্যুহীন প্রাণের মহাপ্রয়াণপর্ব ও প্রতিক্রিয়ার প্রতিবেদন

রোকেয়া প্রয়াণলেখ : সাময়িকপত্রের সাক্ষ্য ও অন্যান্য সংকলন-সম্পাদনা-ভূমিকা : আবুল আহসান চৌধুরী – পাঠক সমাবেশ – ঢাকা, ২০২৪ ষ ৭৭৫ টাকা

প্রথম যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে,

কেঁদেছিলে একা তুমি, হেসেছিল সবে।

এমন জীবন তুমি করিবে গঠন,

মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন ॥

শব্দগত সরণ-প্রতিসরণ দেখিয়ে উপর্যুক্ত উদ্ধৃতির ওপর সংশোধন-প্রস্তাব আনতেই পারেন কেউ। আবার যদি শ্লোক-লেখকের নাম স্মরণ করিয়ে দেন আমজনতা, তবে সেখানে অন্তত চারজনের নাম এসে পড়বে – যথা : রামমোহন, বিদ্যসাগর, শরৎচন্দ্র ও নজরুল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমি অন্তত এ-চারটি নাম দেখেছি। এতে প্রমাণিত হয়, এই পঙ্ক্তিচয় প্রৌঢ়োক্তি ও লোককবিতা বিশেষে উন্নীত হয়েছে।

বক্তব্যের যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন নেই; এই নির্দেশনা সকলেরই জীবনদর্শন হওয়া উচিত। প্রশ্ন হচ্ছে, ওই রকম একটি জীবন গঠনের পরও ভুবন সকলের মৃত্যুবরণে ক্রন্দন করে কি না? কিংবা সময়মতো কাঁদে কি? ‘জন্মিলে মরিতে হবে/ অমর কে কোথা কবে?’ – মধুকবির এই তিক্ত সত্যবাণী অস্বীকার কে করবে? তবু কিছু মানুষ অমরত্ব লাভ করেন তাঁদের জীবনসাধনার কারণে। কিন্তু তাঁরা সবাই যে মহাযাত্রার কালে যথাপ্রাপ্য সংবর্ধনা পেয়ে থাকেন, এমন নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এর ভূরি-ভূরি প্রমাণ মিলবে। নানা কারণে এটা হতে পারে। প্রথমত, সমকালের চেয়ে তাঁরা যদি প্রাগ্রসর হয়ে থাকেন, তবে সমাজ তাঁদের যথাযথ মূল্যায়নে অসমর্থ হয়।

লেখক-চিন্তক-বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে এমনটি হতে দেখা যায়। দ্বিতীয়ত, মৃত্যুর সময় হয়তো প্রতিকূল প্রতিবেশ থাকে – বিশেষত, রাজনীতিক-রাষ্ট্রনেতা-সমরনায়কদের ভাগ্যে এরকম ঘটতেই পারে। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) প্রথম শ্রেণিভুক্ত; তিনি একজন সমাজসংস্কারক ও সাহিত্যিক ছিলেন। সম্পূর্ণতই সমাজসংস্কারক তিনি; আদৌ ছিল না বলেই বাঙালি মুসলমান নারীদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। খ্রিষ্টানদের তো বটেই, হিন্দু-ব্রাহ্ম মেয়েদের জন্য তখন বিদ্যালয় চালু হয়ে গেছে। তাই মুসলমান সমাজের একজন হিসেবে সেখান থেকেই শুরু করেছেন। তাঁর অন্যান্য সামাজিক কার্যক্রম ও লেখালেখি প্রমাণ করে যে, তিনি শুধু বাঙালি মুসলমান নারী নয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বাংলা-ভারত শুধু নয়, সমগ্র মানবসমাজের উত্তরণ-উন্নয়ন কামনা করেছিলেন। একইভাবে তাঁর লেখক সত্তাকে জেন্ডার বা ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিতি দেওয়া সমীচীন হয় না। এটা সত্য যে, নারীকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে সর্বাগ্রে তার শিক্ষার প্রবর্তনে সচেতনতামূলক লেখাই অধিক পরিমাণে লিখেছেন। মনে হতে পারে, পর্দা বা পারিবারিক আইনবিষয়ক রচনা তারই পরিপূরক। বস্তুত তাঁর সমস্ত আলোচনাই সামাজিক প্রেক্ষাপটে ও মানবিক-যুক্তিবাদী দৃষ্টিতেই তিনি করেছেন। এর ধারাবাহিকতায় কৃষকের সমস্যা, অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ একান্ত ব্যক্তিক গদ্যরচনাসম্ভারকেও যোগ করা যায়। সৃজনশীল রচনার ক্ষেত্রে তিনি অপার সম্ভাবনার সাক্ষ্য রেখেছিলেন – তাঁর এরকম লেখা আজকের দিনে উন্নত বিশ্বেও পঠন ও চর্চার অংশ হচ্ছে। এসব কারণেই তাঁকে একজন প্রাগ্রসর চেতনার যুক্তিবাদী সমাজসংস্কারক ও খাঁটি সাহিত্যিক হিসেবেই দেখা উচিত।

শুধু চিন্তক নন, রোকেয়া ছিলেন কর্মযোগী। সমকালের প্রেক্ষাপটে প্রাগ্রসর আর ধর্মীয় স্ব-সম্প্রদায়ের বিবেচনায় বিপ্লবী ছিলেন। কার্যকালে তো প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েই ছিলেন, আজো তাঁর সম্পর্কে স্ব-সম্প্রদায়ের সকলেই যে শংসাবাচক উক্তি ও সশ্রদ্ধ মূল্যায়ন করেন, তা নয়। এমনকি উচ্চশিক্ষিতদের আসরেও তাঁকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতে শুনেছি। আবার সেকালের আরেক বৃহত্তর সম্প্রদায়ের বড় অংশের কাছে হয়তো তাঁর কর্মসাধনা অজানিতই ছিল। তবে যাঁরা জেনেছেন, তাঁদেরও অনেকেই অবজ্ঞা-উপেক্ষা করেছেন, কিংবা সম্যক গুরুত্ব দেননি। এতকিছুর পরও বলতে হবে, রোকেয়ার কর্মসাধনা বিস্ময়করভাবে ও বেশ পরিমাণে সফলতা লাভ করেছিল। পক্ষে-বিপক্ষে, বিরোধিতায়-সমর্থনে নানা স্তরের অনেকেই সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন। কাজেই তাঁর মৃত্যু মুসলমান তো বটেই, পুরো বাঙালি সমাজ থেকে শুরু করে তৎকালীন বিদেশি শাসকবর্গের কাছে কীরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, সে-বিষয়ে জানার আগ্রহ সম্ভবত সকলেরই ছিল।

রোকেয়া প্রয়াণলেখ : সাময়িকপত্রের সাক্ষ্য ও অন্যান্য শীর্ষক  বইটি সেই চাহিদা শতভাগ পূরণ করে গ্রন্থিত হয়েছে। দুর্লভ প্রমাণাদি সংগ্রহসাপেক্ষে সংকলন-সম্পাদনা করে, মূল্যবান ভূমিকাযোগে বইটি পাঠকদের উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক, সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ আবুল আহসান চৌধুরী। যদিও ক্ষুধা মিটলো, কিন্তু খেদ রয়ে গেল – তার দায় অবশ্য সম্পাদকের নয়, সমাজের। সে-কথায় পরে আসছি, এই বইয়ে কী কী রত্নরাজি গ্রন্থিত হয়েছে তার পরিচয় প্রথমে দিয়ে নিই।

প্রথমত রয়েছে রোকেয়ার মৃত্যুতে তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত শোক সংবাদ। পত্রিকাগুলোর মধ্যে রয়েছে : মোহাম্মদী, মোয়াজ্জিন, আনন্দবাজার পত্রিকা, প্রবাসী, গুলিস্তাঁ, বঙ্গলক্ষ্মী, প্রদীপ, The Mussalman, The Statesman, The Amrita Bazar Patrika, Modern Review ইত্যাদি। প্রাজ্ঞ পাঠকবর্গ নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন যে, সেকালের মোটামুটি সব প্রধান পত্রিকাই এই তালিকায় আছে। তবু যে এক-দুটি বিখ্যাত পত্রিকার নাম দেখা গেল না, সেগুলোর সবই সংগ্রহ-ঘাটতির কারণে নয়। যেমন, সম্পাদক সন্ধান শেষে জানিয়েছেন ভারতবর্ষ, বসুমতী পত্রিকা ছিল ‘এক্ষেত্রে বিরল ব্যতিক্রম’। সওগাত পত্রিকার উল্লেখ না দেখে পাঠকের মনে বিস্ময় জাগতে পারে; তবে ওই সময় পত্রিকাটির যে প্রকাশনা-বিরতি চলছিল, সে-তথ্য জানিয়ে সম্পাদক আমাদের বিভ্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন।

আমাদের বিস্মিত করেছে রোকেয়াপ্রয়াণে মোহাম্মদী পত্রিকার দায়িত্বশীল ও প্রেরণাপ্রদায়ক প্রকাশনা। প্রয়াণ-সংবাদ, সম্পাদকীয় কলাম প্রদান (পৌষ ১৩৩৯) ছাড়াও পত্রিকাটি রোকেয়া-স্মরণে বিশেষ ক্রোড়পত্র (মাঘ ১৩৩৯) প্রকাশ করেছিল। ক্রোড়পত্রের সমুদয় রচনাই এই বইয়ে পাওয়া যাবে। সেখানে বিশিষ্ট সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের রচিত কবিতা-গান, প্রবন্ধ, আলোচনা রয়েছে। এ-আয়োজনে কবি কাজী নজরুল ইসলামেরও লেখা প্রকাশিত হবে বলে পূর্ববর্তী সংখ্যায় জানানো হয়েছিল। কিন্তু স্মরণ-সংখ্যায় দেখা গেল, লেখক হিসেবে বিজ্ঞাপিত ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র নজরুল অনুপস্থিত। বিষয়টি সম্পাদকের কাছে ‘রহস্যজনক’ মনে হয়েছে। একজন বস্তুনিষ্ঠ গবেষক হিসেবে তিনি জানিয়েছেন, নজরুলের ধূমকেতু পত্রিকায় রোকেয়ার একাধিক রচনা প্রকাশিত হয়েছে, রোকেয়ার সভানেত্রীত্বে আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম-এর বড় সভায় নজরুলের ‘মোর্হরম’ কবিতা আবৃত্তি পরিবেশিত হয়েছে। কিন্তু রোকেয়ার মৃত্যুতে বিজ্ঞাপিত হওয়ার পরও নজরুলের লেখা পাওয়া গেল না। আবার রোকেয়ার মৃত্যু-পরবর্তী শোক-স্মরণ সভায়গুলোতেও কবি অনুপস্থিত থাকলেন, অথচ তার
আগে-পরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলোতে তাঁকে দেখা গেছে। সম্পাদক মহোদয় প্রমাণ পেয়েছেন যে, ওই দিনগুলোতে বা কাছাকাছি সময়ে ‘নজরুল পীড়িত বা অন্তরীণ বা দূরবর্তী কোনো স্থানে ছিলেন না’। কাজেই তাঁর অভিমত : ‘নজরুল সেই সময়ে বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যসমাজের প্রধান প্রতিনিধি, তাই সেই অবস্থান থেকেও বিষয়টি তাঁর কাছে কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য ছিল। রোকেয়ার মৃত্যুতে যেখানে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই নানাভাবে তাঁদের শোক-স্মরণ-শ্রদ্ধা নিবেদনে অকুণ্ঠিত, সেখানে কোনো দৃশ্যমান বা যৌক্তিক কারণ ছাড়াই নজরুলের নীরবতা বিস্ময়কর শুধু নয় বেদনাদায়কও বটে।’

‘নীরব কেন কবি’ এ-প্রশ্ন এ পর্যায়ে স্বতোই সৃষ্টি হতে পারে। তবে আমরা মনে করি, এ হলো বিদ্রোহী কবির বিশিষ্ট জীবনাচরণ। নজরুল নিজের সংবর্ধনা সভায় কথা দিয়েও যাননি – এমন তথ্য দিয়েছেন কাজী আবদুল ওদুদ; ওদুদ সে-সভায় পরিশ্রম করে প্রবন্ধ লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন। কাজেই অসুস্থ না হলেও, চিরচঞ্চল কবি ব্যস্ত কী কাজে ছিলেন বা কেন আসেননি তা আর নিশ্চিত করে কে বলবে?

অবশ্য সম্পাদকের মতোই আমাদের কাছেও রবীন্দ্রনাথের নীরবতাও প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। সম্পাদক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ-সংশ্লিষ্ট পত্র-পত্রিকায় রোকেয়ার অভিভাষণ, বক্তব্য-সংক্ষেপ, মৃত্যুসংবাদ বেরিয়েছে। এসব রবীন্দ্রনাথের চোখে না-পড়ার কথা নয়। কেউ তাঁর ‘গোচরে’ আনবেন, সে অপেক্ষাও থাকার কথা নয়। এটাই সত্য যে, ‘… কত তুচ্ছ বা মূল্যহীন রচনা বা বইতেও তাঁর [রবীন্দ্রনাথ] দৃষ্টিপাত ঘটেছে এবং সেসব সম্পর্কে তাঁর মতামত দিয়েছেন – করেছেন হ্রস্ব-দীর্ঘ মন্তব্যও’, অথচ কারো কারো প্রসঙ্গে বিস্ময়করভাবে স্বল্পবাক কিংবা বাকহীন। নজরুল প্রতিভার বিশেষ রূপ চঞ্চলতা আর রবীন্দ্রমনীষায় ছিল সস্থৈর্য মৌনতা – যা হয়তো আমাদের মতো সাধারণের বিচারের ঊর্ধ্বে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সূত্র ধরে ঠাকুরবাড়ির মহিলাদের প্রসঙ্গে সম্পাদক যেদিকটি ধরিয়ে দিয়েছেন, তা আমাদের কিছুটা অসন্তুষ্ট করেছে। সম্পাদকের সতথ্য সংক্ষোভ : ‘আবার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-পরিবারের যাঁরা (স্বর্ণকুমারী দেবী, সরলা দেবী, ইন্দিরা দেবী) নারীশিক্ষা ও নারীজাগরণের নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁরাও রোকেয়ার কোনো খবর রাখেননি – না-তাঁর জীবৎকালে না-মরণের পরে, অথচ বাংলা-মুলুকের বাইরের বাসিন্দা সরোজিনী নাইডু সুদূর হায়দরাবাদ থেকে মর্মস্পর্শী এক চিঠি লিখে (১৬ সেপ্টেম্বর ১৯১৬) রোকেয়ার কাজের প্রশংসা করে তাঁকে ‘উৎসাহ’ জোগাতে ভোলেননি।’

এসব ঘটনায় এই সত্যই হয়তো উদ্ভাসিত হয় যে, তখন পর্যন্ত আপামর বাঙালি সমাজ তাঁকে পরিপূর্ণভাবে মূল্যায়ন করার মতো আধুনিক ও সুযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। সম্পাদক ‘নিবেদন’-এ যে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এই বলে, ‘রোকেয়ার মৃত্যুতে বাংলার বিদ্বৎসমাজ, কী হিন্দু কী মুসলমান, যে ব্যাপক শোক-প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন তা অভূতপূর্ব’, সে হয়তো অন্যদের বিবেচনায় আনুপাতিক হিসেবে সত্য।

এ-গ্রন্থের ‘শোক-স্মরণ রচনা’ বিভাগে কয়েকজন বিশিষ্ট নারীব্যক্তিত্বের রচনা স্থান পেয়েছে; এঁদের মধ্যে আছেন অনুরূপা দেবী, শান্তা দেবী প্রমুখ। ১৫ ডিসেম্বর ১৯৩২ কলকাতার অ্যালবার্ট হলে চারটি সংগঠনের মিলিত উদ্যোগে অনুষ্ঠিত শোকসভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন মিসেস পি. কে. রায় [সরলা বসু]; ইনি প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ পি. কে. রায়ের সহধর্মিণী। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা রায়ের সহোদরা। অবলা রায় নিজেও স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন, সভানেত্রী ছিলেন নিখিল ভারত মহিলা সম্মিলনের। শোকসভায় তাঁর উপস্থিতি ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন প্রসঙ্গ পত্র-পত্রিকায় গুরুত্বসহ স্থান পেয়েছিল; এরকম একাধিক রিপোর্ট এই বইতে পাওয়া যাচ্ছে। অভূতপূর্ব কি না জানি না, তবে গ্রন্থভুক্ত সাক্ষ্যাবলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য, রোকেয়ার মৃত্যুতে বাংলার তৎকালীন গর্ভনর জন অ্যান্ডারসনের শোকবাণী। হবীবুল্লাহ বাহার, কায়কোবাদ, সৈয়দ এমদাদ আলীর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, স্মরণ-অভিভাষণ এই গ্রন্থে লভ্য। আরো আছে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বিভিন্ন কবির শোকোচ্ছ্বাসমূলক কবিতা, বিভিন্ন শোকসভার সংবাদভাষ্য, আয়োজক প্রতিষ্ঠানের কার্যবিবরণী। আমরা বিস্মিত হয়েছি এতদিন পরও রোকেয়ার দু-দুটি অপ্রকাশিত চিঠি গ্রন্থমধ্যে দেখতে পেয়ে। গবেষক-সম্পাদকের প্রতি মুগ্ধতা বেড়েছে ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের রোকেয়ার নামে পার্ক করার সিদ্ধান্ত ও অবাস্তবায়িত সড়ক-নাম সম্পর্কিত প্রমাণপত্র দেখে।

এতক্ষণ যেসব দুর্লভ-আগ্রহোদ্দীপক প্রমাণের কথা আমরা বললাম, সেগুলোর প্রায় সবই হুবহু অনুলিপি (facsimile) হিসেবে বইটিতে উপস্থাপিত। অর্থাৎ পাঠকেরা সেদিনের শোককর অধ্যায়ের একটি ঊনবাস্তব স্পর্শ লাভ করবেন।

অনস্বীকার্য যে, নানা প্রমাণের (evidence) প্রামাণিক (authentic) সংযোজন এই বইয়ের অমূল্য সম্পদ। তবে সম্পাদকের ভূমিকাটিও নিঃসন্দেহে মূল্যবান। সম্পাদিত গ্রন্থে সম্পাদকের একটি ভূমিকা থাকা অনেকে দস্তুরমাত্র মনে করেন। সেখানে তথ্য-উৎস নির্দেশ আর কিছু ঋণস্বীকার থাকলেই যেন যথেষ্ট হয়ে গেল। তথ্য-নির্দেশ অধ্যাপক চৌধুরী যথাযথই করে থাকেন। ঋণস্বীকারে আরো বেশি সত্যনিষ্ঠ ও সৌজন্যপরায়ণ। যেমন, এই বইয়ে একজন পূর্বসূরি লেখকের (মুহম্মদ শামসুল আলম) বইয়ের (রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন : জীবন ও সাহিত্যকর্ম) ঋণস্বীকার করেই শেষ করেননি, ‘দূরভাষে অনেকবারই তাঁর সঙ্গে বইয়ের বিষয়ে কথা’ হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন।

আমরা মনে করি, একটি সম্পাদিত গ্রন্থ যেমন গবেষণার আকর, তেমনি তার প্রকাশ থেকেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর আরো গবেষণার সূত্রপাত হওয়া আবশ্যক। আবুল আহসান চৌধুরীর সম্পাদিত সকল গ্রন্থে এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এই বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়। লক্ষ করা গেল, মহীয়সী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবনের শেষ দিনগুলি,  মৃত্যু ও পরবর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রমাণ-সাক্ষ্যের সমান্তরালে ব্যক্তি ও সমাজের দ্বান্দ্বিক ধারাভাষ্য সম্পাদকের ‘নিবেদন’ ও ‘ভূমিকা’। সন্দেহ নেই যে, লেখকের ‘নিবেদন’ ও ‘ভূমিকা’ সারবান এবং গ্রন্থটিকে বিশেষ মাত্রা ও সার্থকতা দিয়েছে, তবে আমাদের মনে হয়েছে, এ-দুটো পৃথক রচনার প্রসঙ্গ কখনো কখনো নির্দিষ্টতা হারিয়ে বিমিশ্র হয়ে গেছে।

সম্পাদক প্রমাণনির্ভর ও বিশ্লেষণী বক্তব্য অনেকটা বিবরণধর্মী গদ্যে উপস্থাপন করেছেন, যা একদিকে পাঠে উপভোগ্য, অপরদিকে প্রশ্ননির্মাণ করে সংবেদী পাঠকের মনে। এই বয়ান পাঠকালে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, বয়স যে রোকেয়ার খুব বেশি হয়ে গিয়েছিল এমন নয়, তবে এত অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন কেন? সেটি শুধুই রোকেয়ার বর্ণনামতে ‘হাড়ভাঙ্গা খাটুনী’র কারণে? বস্তুত, মানসিকভাবেও আক্রান্ত হচ্ছিলেন প্রথমাবধি। আঘাত যে আসবে, তা জেনেই তো তিনি কাজে নেমেছিলেন। হয়তো সেসব আঘাতের প্রকৃতি ও চরম রূপ সম্বন্ধে ধারণা করতে পারেননি। তবে দমে যাননি। বিষয়গুলো সম্পাদকের বক্তব্যে এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যে, উদ্ধৃতি ও তথ্যসূত্র আকীর্ণ ‘ভূমিকা’র মধ্যেই সৃজনশীল সাহিত্য পাঠের সামান্য আস্বাদ পাওয়া যায়। রোকেয়া যেন আধুনিক উপন্যাসের প্রধান ও পজিটিভ চরিত্র। আবার ক্লাসিক ট্র্যাজিক চরিত্রের ছায়াপাত চোখে পড়ে রোকেয়া-জীবনীতে। এখানেই ভূমিকার বিশেষ সার্থকতা। আমরা কিছুটা পাঠ করি : ‘মৃত্যুর দু’তিন বছর আগে থেকে রোকেয়ার চিকিৎসা-বিশ্রাম কিছুটা নিয়মমাফিক হতে থাকে। এরই অনুষঙ্গে আসে হাওয়াবদলের পালা – কিন্তু এর শৃঙ্খলাও ভঙ্গ হয়েছে মাঝেমধ্যেই – সেও ওই নিজের হাতে-গড়া স্কুলেরই জরুরি সব কাজের জন্যে। হাওয়াবদলের স্থান হিসেবে ঘাটশিলা ছিল তাঁর প্রিয় ও পছন্দের – বলা চলে আদর্শ। কখনো সখনো জলপাইগুড়ি যাওয়া হতো, হয়তো বিশেষ কোনো শারীরিক সমস্যার কারণে চিকিৎসক তখন দার্জিলিং-ভ্রমণের অনুমোদন দেননি তাঁকে। শুধু সাময়িক হাওয়াবদল নয়, স্থায়ীবাসের প্রয়োজনে ১৯৩০-৩১ সালের দিকে ‘তাঁর জন্য ঘাটশীলায় একটা বাড়ী বানানো হচ্ছিল’…। ১৯৩১ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঘাটশিলা ছেড়ে কলকাতা যান। ১৪.১২.১৯৩১ তারিখে তাসাদ্দক আহমদের স্ত্রীকে রহস্য করে লিখেছিলেন : ‘আমার ঘাটশীলা-লীলা সম্বরণের আর অধিক দেরী নাই’… এরপর আর ঘাটশিলায় ফিরে আসা হয়নি – এক বছরের মাথায় তো তিনি ‘ইহলীলাই সম্বরণ’ করেন।’

রোকেয়া ইহলীলা শেষ করলেন বটে, তবে সমাজের ‘লীলা’ তখনই শেষ হয়নি। একজন ব্যক্তির জীবন তো একান্তই তার নয়, সমাজেরও বটে। রোকেয়ার মতো ব্যক্তির জীবন সেই সমাজকে আরো গভীরভাবে চিনিয়ে দেয়। কথাটা এই কারণে বলতে হলো যে, এহেন রোকেয়া কিন্তু তাঁর প্রত্যাশামতো সমাধি পাননি। তিনি কি তাজমহলের মতো সমাধিসৌধ চেয়েছিলেন? হ্যাঁ, তাই বটে, – বলেছিলেন : ‘…আমার শেষ বিশ্রামস্থান রচনা করিও আমার প্রাণের এই তাজমহলের একপাশে – কবরে শুইয়াও যেন আমি আমার মেয়েদের কল-কোলাহল শুনিতে পাই।’ সেটি তো হয়ইনি, আবার এমন কোনো সাধারণ গোরস্তানেও ঠাঁই মেলেনি, যেখানে বহুমানুষের অস্থি-মজ্জার সঙ্গে মিশে ‘তাঁহারও আত্মা অধিকতর তৃপ্তিলাভ করিত’। কলকাতা থেকে প্রায় ষোল কিলোমিটার দূরে সুখচর গ্রামে আত্মীয় (যদিও তাঁর মৃত্যুতে মোহাম্মদী লিখেছিল : ‘রক্তের হিসাবে তাঁহার পরিজন বলিতে কেহই নাই…।’) মাওলানা আবদুর রহমান খানের পারিবারিক গোরস্তানে তাঁকে দাফন করা হয়। কবরটি অচিহ্নিত, কোনোকালে সংরক্ষণ করার উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। এই বিষয়টি রোকেয়া অনুরাগীদের ক্ষুব্ধ করেছে স্বাভাবিকভাবেই।

একটি চিহ্নিত-বাঁধানো কবর হয়তো ধর্মের দৃষ্টিতে অত্যাবশ্যক নয়, বরং এ-বিষয়ে ভিন্নমতের কথাও আমরা শুনে থাকি। মৃত ব্যক্তির কাছে তো তার গুরুত্ব শূন্য। কিন্তু সমাজের শূন্যতা পূরণে এরকম নিবেদিতপ্রাণ মানুষের সমাধি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রেরণাসঞ্চারক স্মারক হিসেবে কাজ করে। সেদিন রোকেয়ার মৃত্যুতে ‘শোকের তুফান বহিয়াছিল’, তাঁর স্কুলসীমা ছাড়িয়ে রাস্তা-ফুটপাত পরিপূর্ণ হয়েছিল শোককাতর জনমানুষে, কিন্তু তাঁকে যথাযথ স্থানে সমাধিস্থ করতে পারেনি সমাজ। অবশ্য জীবদ্দশায়ই কি যথাযথ স্থান-সম্মান পেয়েছিলেন? এইসব বেদনাত্মক তথ্য পাঠ করেই প্রশ্নশীল পাঠককে পুস্তকমধ্যে প্রবেশ করতে হবে।

তবে প্রবেশপূর্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদেয়। সম্পাদক বইটি উৎসর্গ করেছেন ‘রোকেয়ার উত্তরসূরি’ পাঁচ মহীয়সীকে। এঁরা হলেন : এম. ফাতেমা খানম (১৮৯৩-১৯৫৭), ফজিলাতুন নেসা (১৮৯৯-১৯৭৭), রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণী (১৯০৭-১৯৩৪), শামসুন নাহার মাহমুদ (১৯০৮-১৯৬৪), সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯)। একটা সম্পাদিত গ্রন্থ কতটা পূর্ণরূপে প্রসঙ্গকে ধারণ করতে পারে, এই উৎসর্গপত্র তারই প্রমাণ। ‘নিবেদন’-এর শেষ বাক্যে আবুল আহসান চৌধুরী লিখেছেন : ‘শেষে বলি, রোকেয়াচর্চায় এই বই কোনো ভূমিকা রাখলে সে-ই হবে আমার পরম প্রাপ্তি।’ আমরা ‘রাখলে’র মতো সাপেক্ষ শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজন দেখছি না। নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, এই বই রোকেয়াচর্চায় বিশেষ অবদান রাখবে; অবশ্যই বইটি আমাদের এক বড় প্রাপ্তি।