মেঘালয় : বারবার যেতে ইচ্ছে হয়

‘কিন্তু হঠাৎ কী হলো, শিলঙ পাহাড়টা চারদিক থেকে অমিতকে নিজের মধ্যে যেন রসিয়ে নিচ্ছে। আজ সে উঠেছে সূর্য ওঠবার আগেই; এটা ওর স্বধর্মবিরুদ্ধ। জানলা দিয়ে দেখলে, দেবদারু গাছের ঝালরগুলো কাঁপছে, আর তার পিছনে পাতলা মেঘের উপর পাহাড়ের ওপার থেকে সূর্য তার তুলির লম্বা লম্বা সোনালি টান লাগিয়েছে – আগুনে-জ¦লা যে-সব রঙের আভা ফুটে উঠেছে তার সম্বন্ধে চুপ করে থাকা ছাড়া আর-কোনো উপায় নেই।’ (শেষের কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃ ২০, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ১৯৯২)

ছোটবেলা থেকেই শিলং নামটার প্রতি কেন যেন একটা আকর্ষণ বোধ করতাম। যৌবনে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা পড়ার পরে তা যেন আরো দুর্নিবার হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কোনোমতেই শিলংয়ে যাওয়া হয়ে উঠছিল না। আমার এক ফেসবুক বন্ধু, যিনি সিলেটে বাস করেন, তিনি প্রায়ই শিলং বেড়াতে যান। যাওয়ার আগে তিনি ফেসবুকে পোস্ট দেন – ‘শিলং ডাকছে’। সম্প্রতি তাঁর এই ডাকে সাড়া দিয়ে ঘুরে এলাম শিলং অর্থাৎ মেঘালয়।

ডাউকি স্থলবন্দর দিয়ে আমরা চার বন্ধু ঢুকেছি মেঘালয়ে। ডাউকির নতুন ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস ভবনের নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ শেষ হয়নি। ফ্যান-এসি লাগেনি। ভাদ্র মাসের তালপাকা গরমে শিলংযাত্রীদের নাকানিচুবানি খাওয়ার অবস্থা ইমিগ্রেশনের লম্বা লাইনে। মাঝে একদিনের ছুটি নিয়ে চারদিনের ছুটিতে বিস্তর মানুষ চলেছেন মেঘালয় বেড়াতে।

ইমিগ্রেশন-কাস্টমসের কাজ শেষে আমরা শিলং পর্যন্ত একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে নিলাম। ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভার ফজর আলীকে অনুরোধ করলাম গাড়ির এসি চালানোর জন্য। ফজর আলী আসামের মানুষ। বাংলা ভালোই জানেন। তিনি বললেন, একটু অপেক্ষা করো, প্রাকৃতিক এসি পেয়ে যাবে। কিছুটা পথ যেতেই সত্যি সত্যি প্রাকৃতিক এসি পেয়ে গেলাম। যতই শিলংয়ের দিকে এগোচ্ছি, ততই নির্মল ঠান্ডা বাতাস আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছিল। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে এগিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি। আমাদের কোনো তাড়া ছিল না। পথে যেতে যেতে যেখানে থামতে ইচ্ছে করছিল, আমরা সেখানে থেমেছি। গাড়ি থেকে নেমেছি, পথের পাশে দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে মেঘের রাজ্যের আহ্বান অনুভব করেছি। কালো মেঘের বিস্তীর্ণ পাহাড় দু-পাশ থেকে আমাদের টেনে নিয়েছে তার শরীরের ভেতরে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি এসে আমাদের পরশ বুলিয়ে দিয়েছে। রাস্তার পাশের পাথুরে পাহাড় কিংবা ঝরনা আমাদের হাতছানি দিতেই আমরা থেমে গেছি। এরই মাঝে ফ্রাইড মমো আর বিয়ার দিয়ে আমরা মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিয়েছি মূল সড়ক থেকে ভেতরে জঙ্গলের মতো বাড়ির (ধাবা) আঙিনায়। বলে রাখা ভালো, আমাদের সিলেটের বন্ধুকে আমরা আমাদের এই ভ্রমণের নেতা নির্বাচন করেছিলাম। তিনি যেভাবে বলবেন, যেখানে আমাদের নিয়ে যাবেন, আমরা সেভাবে চলবো, সেখানে যাবো। এর কারণ হলো, তিনি অন্তত শ’খানেকবার মেঘালয়ে গেছেন। পুরো মেঘালয় তাঁর নখদর্পণে। প্রচুর লোকজন তাঁকে চেনেন, তিনিও তাঁদের চেনেন। আমাদের দলনেতা বলে দিয়েছেন, মেঘালয়ে দেখার জিনিসের অভাব নেই। একবারে তিন-চারদিনে তেমন কিছুই দেখা যাবে না। মেঘালয় দেখতে হলে বার বার আসতে হবে। রাস্তার পাশের বুনোফুলের দিকে সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতে হবে। হাতে যেহেতু বেশি সময় নেই, বেছে বেছে কিছু স্পটে নিয়ে যাবেন। সেগুলি মন দিয়ে দেখতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে। ছোটাছুটি কিংবা তাড়াহুড়ো করা যাবে না।

আমরা তিনজন তাঁর কথামতোই চলছিলাম। আমাদের চারজনের মধ্যে একটা অদৃশ্য ঐক্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল শুরুতেই। আমাদের ভাবনাচিন্তাতেও যথেষ্ট মিল। আরো মিল খুঁজে পেয়েছিলাম আমাদের সন্তানদের নামকরণেও। আমাদের চারজনের নাম বলা জরুরি নয়, তবে সন্তানদের নাম বলার লোভ সামলাতে পারছি না। নির্ভয় সার্ত্রে, সর্বত্রজয়ী রেমাক্রি, ফিদেল মণ্ডল, সম সুলোক, ঋষ্য ঋষভ – এসব নাম যাদের সন্তানদের, তাদের মাঝে চিন্তার সাযুজ্য থাকাটাই স্বাভাবিক। এখন বলা যেতে পারে সন্তানদের নামের সঙ্গে তাদের

পিতৃদেবদের ভ্রমণের সম্পর্ক কী? সম্পর্কটা হয়তো মোটাদাগে কোথাও পরিলক্ষিত হবে না। তবে সূক্ষ্মভাবে তাদের দেখার চোখ, উপলব্ধির অন্তর সমান্তরাল হওয়ায় ভ্রমণটা সমভাবে উপভোগ্য হওয়ার সুযোগ থাকে। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব বলেছিলেন, ‘নাটকে লোকশিক্ষা হয়।’ এই ভ্রমণে আমাদের সকলের মনে হয়েছে, ভ্রমণে সব ধরনের শিক্ষাই হয়।

ডাউকি থেকে শিলংয়ের পথে যেতে যেতে আমরা অনুমান করতে পারছিলাম আমাদের পরবর্তী তিনটি দিন কেমন কাটবে। পথে যেতে চারপাশ দেখছিলাম আর আমাদের দলনেতা বন্ধুর কাছে মেঘালয় সম্পর্কে নানা অভিজ্ঞতার কথা শুনছিলাম। হঠাৎ লক্ষ করলাম তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুমিয়ে পড়েছেন অন্য আর এক বন্ধুও, যিনিও এর আগে দু-একবার মেঘালয় বেড়িয়ে গেছেন। আমরা যে দুজন প্রথমবার এসেছি, তারা জেগে জেগে দেখছি রাস্তার চারপাশ। ভ্রমণের ক্লান্তি আমাদের কাবু করতে পারেনি।

আমাদের ছোট্ট গাড়িখানা ইতোমধ্যে শিলং শহরে ঢুকে পড়েছে। ওদিকে সন্ধ্যাও নেমে এসেছে। পাহাড়ি শহরের রাস্তার সন্ধ্যার সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। রাস্তার পাশের বাড়িঘর আরো মনোমুগ্ধকর। বিলাসের কোনো আধিক্য নাই। বরং রুচি ও ঐতিহ্যের আভিজাত্য চারদিকে। অফিস শেষে যে যার আস্তানায় ফিরছে, কেউ হেঁটে, কেউ গাড়িতে কিন্তু কোথাও বিশৃঙ্খলা নেই। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। টু ওয়ে রাস্তা কিন্তু কেউ রাস্তার মাঝের সাদা মার্ক অতিক্রম করে কিংবা একজন আর একজনকে ওভারটেক করে আগে যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি করছে না। গাড়িগুলি সুশৃঙ্খলভাবে অপেক্ষা করছে, একটি থেকে অন্যটি দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান করছে। কেউ হর্ন বাজাচ্ছে না। জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পথচারীরা সুশৃঙ্খলভাবে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। এ-ঘটনাগুলি আমাদের ঢাকা শহরে দুর্লভ। আমরা রাস্তায় নেমে যেন বিশৃঙ্খলার প্রতিযোগিতায় মত্ত হই।

শিলং শহরে ইংরেজ আমলের কিছু বাড়িঘর এখনো দেখা যায় রাস্তার পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে। এসব বাড়ির নির্মাণশৈলীতে রয়েছে পাশ্চাত্যের ছোঁয়া। আবহাওয়ার কারণে ব্রিটিশ আমলে ইংরেজরা এই শৈল-শহরটিতে বসবাস করতে আগ্রহী ছিল। ফলে এখানকার বাড়িঘর, গির্জা এসবে মিশনারি ছাপ অত্যন্ত স্পষ্ট। যদিও কালের আবর্তনে ব্রিটিশদের স্মৃতির অনেকাংশই বিলুপ্ত, তারপরও যেটুকু বর্তমান, তাতে নস্টালজিক সেই সময়ের সাক্ষ্য বিদ্যমান।

আমরা শিলংয়ে পুলিশ বাজার নামে একটি স্থানে হোটেলে উঠেছিলাম। বাংলাদেশ থেকে যাঁরা মেঘালয়ে বেড়াতে যান, তাঁদের বেশির ভাগই শিলংয়ের এই জায়গাটা বেছে নেন। রাস্তা, ফুটপাতে, খাবার দোকানে এখানে অনেক বাঙালির দেখা মেলে। প্রবাসে নিজ ভাষার মানুষের দেখা পাওয়ার মধ্যেও আনন্দ আছে।

পরদিন আমরা সকালে নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়লাম শিলংয়ের উদ্দেশে। শহর থেকে বেরুতেই চোখে পড়লো রডোড্রেনড্রন ফুলের উদ্যান লেখা একটা সাইনবোর্ড। আবার শেষের কবিতার নস্টালজিয়ায় পড়ে গেলাম। সময়ে কুলানো যাবে না বলে দলপতির অনুমতি মিলল না রডোডেনড্রন উদ্যানে ঘুরে বেড়ানোর। তবে পথে যেতে যেতে রাস্তার পাশের পাইন বন দেখে রডোডেনড্রন না-দেখার দুঃখ কিছুটা হলেও ভুলতে পেরেছিলাম।

আমাদের দলনেতা জানালেন, চেরাপুঞ্জি নামটি এসেছে সোহ্রা থেকে। সোহ্রা মানে কয়লা বা কয়লা পাথর। এলাকাটি খুব লোভনীয় ছিল ব্রিটিশদের জন্য। তারা নাকি সোহ্রা উচ্চারণ করতে পারতেন না, বলতেন চেহ্রা। সেখান থেকে চেরাপুঞ্জি নামের উদ্ভব বলে জানা গেল। তো এই চেরাপুঞ্জিতে দেখার মতো জিনিসের অভাব নেই। এর ল্যান্ডস্কেপ আপনাকে বিমোহিত করবে। মেঘ-বৃষ্টির খেলা আপনাকে পুলকিত করবে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে জমে থাকা মেঘমালা, পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া মেঘের পুঞ্জ আপনাকে অনির্বচনীয় আনন্দ দেবে। কোনো এক জায়গায় বুঁদ হয়ে বসে থেকে মেঘ-বৃষ্টির খেলা দেখে দেখেই কেটে যাবে বেলা। চেরাপুঞ্জিতে আমরা যা যা দেখেছি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – নংথিম্মাই ইকো পার্ক, মাওসামি কেভ, সেভেন সিস্টার্স ঝরনা, ডেইন্থলেন ঝরনা, ওয়া কাবা ঝরনা এবং নোহকালিকাই ঝরনা। নংথিম্মাই ইকো পার্কটি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। নানা প্রজাতির ফুল ও বৃক্ষের সমাহার রয়েছে এখানে। এই পার্কের শেষ প্রান্তটি এমনভাবে সাজানো যে সেখানে বসে আপনি আরাম করে কাছের গিরিখাদ যেমন দেখতে পাবেন, তেমনি অনতিদূরত্বের গিরিশৃঙ্গও দেখতে পাবেন। আপনার নিচে মেঘ, ওপরে মেঘ। মেঘের রাজ্যের যুবরাজ মনে হবে নিজেকে।

চেরাপুঞ্জির পথে পথে ঝরনা। তবে সেভেন সিস্টার্স, ডেইন্থলেন, ওয়া কাবা, নোহকালিকাই ঝরনাগুলি বেশ বড় বড়। এসব ঝরনার পাদদেশে দাঁড়ালে আপনি এক সিক্ত অনুভূতি অর্জন করবেন। ভারতের শীর্ষস্থানীয় ঝরনাগুলির মধ্যে রয়েছে এখানকার অনেক ঝরনা। সব ঝরনার পাদদেশে যাওয়া সম্ভব নয়, ট্রেকিং করে যেতে হয়। সেই সময় ও সুযোগ সবসময় মেলেও না। তবে ওদের পর্যটন বিভাগ এমনভাবে সবকিছুর ব্যবস্থা করে রেখেছে, যাতে আপনি সুন্দরভাবে সবকিছু উপভোগ করতে পারেন।

আমাদের দলনেতা অভিজ্ঞ মানুষ। আমরা ঘুরতে ঘুরতে ক্ষুধায় ক্লান্ত হয়ে পড়লেও তিনি আমাদের আরেকটু ধৈর্য ধরতে বলেছেন। পরন্ত বিকেলে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন নোহকালিকাই ঝরনায়। ঝরনার পাশের একটা রেস্তোরাঁয় নিয়ে বসলেন। খাবার অর্ডার করলেন। তারপর বললেন, নাও এবার ঝরনার গান শোনো, ঝরনা দেখো আর পেটপুজো করো। সেই ঝরনার পাশের রেস্তোরাঁতে বসে খেতে খেতে ঝরনার সৌন্দর্য উপভোগ করার অভিজ্ঞতা সত্যি বিরল। পরে জেনেছি, ওই বাড়তি সুবিধাটির জন্য ওই রেস্তোরাঁয় কয়েকগুণ বেশি দামে খাবার কিনতে হয়।

নোহকালিকাই ঝরনার উল্টোদিকের  ল্যান্ডস্কেপটি অসাধারণ। মনে হয় সুইজারল্যান্ডের মতো। একটু দূরে হেঁটে এগিয়ে আমরা দূর থেকে বাংলাদেশকে দেখেছি। মেঘালয়ে ঘুরতে ঘুরতে পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে কখনো কখনো উঁকি দেয় বাংলাদেশের সমভূমি। আর নিজের দেশ দেখার তখন যে অনুভূতি হয়, তা অতুলনীয়।

তৃতীয় দিনের প্রভাতে কোথাও রবির কর নেই, ঝরঝর মুখরিত বাদল দিনে আমরা রওনা হলাম রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস মিউজিয়াম দর্শনে। এই বাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথ শেষের কবিতা লিখেছিলেন। গিয়ে হতাশ হলাম। সেই মিউজিয়ামে তেমন কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথের কোনো কাজের ছোঁয়াও নেই। তাঁর একখানা প্রতিকৃতি আছে, যা কোনোভাবেই দৃষ্টিনন্দন নয়। তবে বাড়িটির সামনে রবীন্দ্রনাথের একটি ভাস্কর্য রয়েছে, যার রং, অবস্থান ও নির্মাণ মনোমুগ্ধকর। রবীন্দ্রনাথ সেখানে একাই দাঁড়িয়ে ভেজেন আর শিলংয়ের লুকোচুরির বৃষ্টিতে আমাদেরও ভেজান। পাশেই মেঘালয়ের অ্যাসেম্বলি ভবন। দুয়ের মিলনে এক ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ চারপাশটায়।

রবীন্দ্রদর্শন শেষে আবার আমরা বেরিয়ে পড়লাম। মেঘবৃষ্টির লুকোচুরিতে আমাদের যাত্রা ডাউকির পথে। মাঝে কোথাও কোথাও গাড়ি থেকে নেমে মেঘের রাজ্যে অবগাহন করেছি। আমরা গেলাম মাওলিনং গ্রামে। পরপর কয়েকবার এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রামের তকমা পেয়েছে এ-গ্রাম। সত্যি সত্যিই অনেক পরিচ্ছন্ন গ্রাম এটি। কোথাও কোনো আবর্জনা বা নোংরা নেই। এরপরে যাই জীবন্ত গাছের শিকড় দিয়ে তৈরি হওয়া ঝুলন্ত সেতু দেখতে। এই সেতু দেখা একটা কঠিন কাজ। প্রায় তিনশো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হবে আপনাকে। আবার সমপরিমাণ সিড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হবে। এই ওঠানামার ধকল আপনার কাছে নস্যি মনে হবে এর সৌন্দর্যের তুলনায়। এই সেতুর নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝরনায় পা ভিজিয়ে বসলে সব ক্লান্তি উবে যায়। মেঘালয়-ভ্রমণ সার্থক মনে হয়।

ফেরার পথে চমৎকার একটি জায়গা রয়েছে – খাসি পাহাড়, গারো পাহাড় ও জৈন্তা পাহাড়ের মিলনস্থল। তিনদিক থেকে তিনটি পাহাড় এসে মিশেছে এক জায়গায়। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে ৩৬০ ডিগ্রি কোণে চারপাশ ঘুরে দেখার আনন্দ অভূতপূর্ব।

তৃতীয় রাতটি আমরা কাটিয়েছি শ্নোংপেডেং-এ। উমনগট নদীর পাড়ে চমৎকার একটি গ্রাম এটি। এই গ্রামকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ইকো ট্যুরিজম। এখানে ছোট ছোট রিসোর্ট বা বাড়িতে রাতযাপনের ব্যবস্থা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে নদীর পাড়ে তাঁবুতে রাতযাপনের সুবিধা। আমরা তাঁবুতে রাতযাপন করেছিলাম। রাতের বেলা পাহাড়ি খরস্রোতা নদী উমনগটের বুকে নৌকায় বসে ঠান্ডা পানিতে পা ভিজিয়ে আড্ডা-পানাহারের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য এক বিরল প্রাপ্তি। রাতের বেলা তাঁবুতে শুয়ে বৃষ্টির শব্দ আর উমনগটের কুলকুল রব আমাদের কানে-মস্তিষ্কে ঢেলে দিয়েছিল স্বর্গীয় সুখ।

পরদিন ইতস্তত ঘোরাঘুরি, ঝুলন্ত সেতুতে পারাপার ছিল সাধারণ কার্যক্রম। তবে অসাধারণ ব্যাপার ছিল আমাদের দলনেতার কথামতো তাঁর নিজস্ব সুইমিংপুলে স্নান করতে যাওয়া। তিনি আমাদের নিয়ে ট্রেকিং করে চলে গেলেন দুর্গম এক ঝরনার নদীতে, যা এসে মিশেছে উমনগট নদীতে। প্রায় নির্জন একলা। জনমানব নেই বললেই চলে। দূরে দু-একজন বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে। আমরা বড় বড় পাথুরে ঝরনার নদীতে গিয়ে অবগাহন করলাম। ট্রেকিংয়ের সব ক্লান্তি মুছিয়ে দিলো ঝরনার শীতল জল। আমরা সেখানে জলে ডুবে ভেসে গল্পে পানাহারে সময় কাটালাম। সে এক অত্যাশ্চর্য অভিজ্ঞতা আমার জীবনে। আমরা সেখানে ঝরনার জলের বিপরীতে গামছা বিছিয়ে রেখে মাছ ধরে আবার ছেড়ে দিয়েছি। ধ্যান করেছি, পাহাড়ের-প্রকৃতির নির্জনতা উপভোগ করেছি। দক্ষ দলনেতার সঙ্গে ভ্রমণ করায় এরকম বিরল অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ ঘটেছিল মেঘালয়-ভ্রমণে।

ভ্রমণ তো শুধু দু-চোখে সৌন্দর্য দেখা নয়, চোখের জানালা দিয়ে মনের অন্দরে যদি সৌন্দর্যের উপলব্ধি-অনুভব ধরা না পড়ে, তাহলে তা ভ্রমণ হয় না। শুধু দেখা হয়। দেখতে সেঘালয়ে যাওয়ার দরকার নেই, অনুভব করতে মেঘালয়ে যেতে হয়। তাই মেঘালয় বারবার যাওয়ার মতো জায়গা।